micro-story-nishkriti

নিষ্কৃতি
সুনেত্রা সাধু


পরী দুটো বেশ মিষ্টি করে হাসে। হাসিতে লাস্য, বিষাদ, করুণা সব মিলেমিশে একাকার হয়। ঘরে থাকলে কল্লোল হাঁ করে তাকিয়ে দেখে। পরীরা এখন কেমন করে হাসছে? ইচ্ছে থাকলেও দেখার উপায় নেই। দরজাটা ভিতর থেকে খিল আঁটা। শুধু ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দটা ভেসে আসছে। কল্লোলের ঠাকুরদাদা শখ করে পালঙ্কটা গড়িয়েছিল। গায়ে কারুকাজ। মাথার কাছে দুটো পরী আয়না ধরে ডানা মেলে উড়ছে। পালঙ্কটার বয়স হয়েছে, তা প্রায় সত্তর হবে। আর উদ্দামতার ভার নিতে পারে না। কল্লোলের বউ মণির চেহারাটাও রোগাসোগা নয়, বিশুও তাগড়া জোয়ান, আওয়াজটা ওরা আগল দিয়ে রুখতে পারে না। চেষ্টাও করে না। কল্লোল একটা ক্ষয়ে যাওয়া ফুটো পয়সা। মূল্যহীন। আজ বাদে কাল মরে যাবে। রক্তমাংসের কেউ কল্লোলকে ভয় করে না, ভক্তি তো নয়ই…

তবে কেউ কেউ ভালোবাসে, এই যেমন পলেস্তারা খসা দু’মহলা বাড়ি, ফাটল ধরা লাল মেঝে, আগাছায় ভরা বাগান আর ঐ দূরের মোটা নিম গাছটা…

বাগান আর বাড়ি মিলে পঁয়ত্রিশ কাঠা। বিশুই আমিন ডেকে মাপিয়েছিল। তারপর মণির সঙ্গে বসে হিসেব করেছিল কত টাকা দেবে। টাকার অঙ্ক শুনে মণির চোখটা চক চক করছিল। বিশু এলাকার উঠতি প্রমোটার। আজ বললে কাল ক্যাশ ফেলে দেবে, কিন্তু ওই উইলটাই কাল হয়েছে। বাবা লিখে গিয়েছে কল্লোলের মৃত্যুর আগে এ বাড়িতে হাত দেওয়া যাবে না। বললেই তো একটা মানুষ মরে যায় না, সে যতই ক্যন্সারের রুগী হোক না কেন। তাই মণি শরীর দিয়ে বিশুকে বেঁধে রাখে।

বিশু চলে গেলে কল্লোল ওই পালঙ্কে গিয়েই শোয়, আয়নায় চোখ রাখে, রমণের ছবি খোঁজে। পরীদুটোর হাসিতে তখন করুণা উপচে পড়ে। ওরা বলে আর এসব দেখো না কল্লোল, এইবার ছুটি নাও…

নিলেই হয়, নড়বড়ে চেয়ারটায় বসে কল্লোল ভাবে। কিন্তু কীভাবে ছুটি নিতে হয় সেকথা কেউ শিখিয়ে দেয়নি। কল্লোলের ভিতরটা অস্থির হয়। আজ দরজাটা অনেকক্ষণ বন্ধ। খিদে পেটে একথালা ভাত নিয়ে বসলে পাঁচ মিনিটে শেষ হয়ে যায়, শরীরের ক্ষিদে মিটতে আর কত সময় লাগবে? দুপুর গড়িয়ে আসছে, এক কাপ চায়ের জন্য ফোঁপরা বুকটা ফেটে যাচ্ছে, ওদের খেলাই শেষ হয় না। কল্লোল উঠে পড়েছে, ওর এবার ছুটি চায়।

তিনদিন হয়ে গেল কল্লোল নিঁখোজ। পালঙ্কের উপর থম মেরে বসে আছে মণি। উল্টোদিকের চেয়ারে বিশু। পরীদুটো আজও হাসছে। মরে যাওয়া আর হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। মৃত্যু প্রমাণ হতে সাত বছর অপেক্ষা লাগে। কল্লোলের খোঁজ না পাওয়া গেলে বিশু কি মণির পিছনে টাকা ঢালবে? বিষয়টা মণিকে ভাবাচ্ছে। দরজায় খিল দিয়ে বিশুকে পালঙ্কে ডাকল। সবই হল তবে খেলাটা দর্শকের অভাবে বিশেষ জমল না। বাইরের দালানে পেতে রাখা চেয়ারটা ফাঁকা।

লোকটার তো দশ পা হাঁটলে হাঁফ ধরে, সে হারালো কোথায়? প্যান্টের চেন টানতে টানতে বিশু ভাবছিল। পার্টির কানেকশন না থাকলে বিশু এতক্ষণ জেলে থাকত। মালটা এভাবে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেল?

পোদ্দারদের পুকুরে সেদিন জাল ফেলা হল, কল্লোলের জন্য নয়। এমনিই, মাছ তুলতে। পুকুরটা যেখানে শেষ হয় সেখান থেকেই কল্লোলদের বাগান শুরু। ভাঙাচোরা পাঁচিল, সাপ বেজির আখড়া। কেউ ওদিকে যায় না। সেদিন জেলেরা গেল। গন্ধটা ওরাই পেল, একেবারে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসা মৃত্যুর গন্ধ। নিম গাছটার উঁচু ডালে ডাঁশ ডাঁশ মাছি ভিনভিন করছিল। গামছায় ঝুলছিল ফুলেফেঁপে ওঠা লাশ। কল্লোলই ছিল। কারো মনে হয়নি আগাছা ভরা একটেরে বাগানের উঁচু ডাল খুঁজে দেখি…

গন্ধটা ঘুরপথে কল্লোলদের সদর দরজায় এসে দাঁড়ালো। পুলিশই সঙ্গে নিয়ে এল। বিশু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। লোকটা এমনিই মরত। মণি খুব কাঁদছিল, আছাড়ি-বিছাড়ি কান্না। পালঙ্কটা দুলছিল। আওয়াজ ভেসে আসছিল, ক্যাঁচ ক্যাঁচ…

পরীদুটো হাসছিল।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

6 thoughts on “micro-story-nishkriti

  1. বাবা রে!! ভেতর টা কেঁপে উঠলো। কিন্তু এরকম আজকাল শোনা যায়। তাই চমকালাম না। ছোটবেলা থেকে প্রবাদগুলো শুনেছিলাম। মানে বুঝতাম না। একটু বড় হয়ে মানে বুঝেছিলাম।”অর্থ‌ই অনর্থের মূল”।
    “লোভে পাপ,পাপে মৃত্যু”

  2. অসামান্য একটি লেখা। অবশ্য তোমার কাছে এমন লেখাই এক্সপেক্টেড। খুব ভালো লাগলো। শুভদা লাকি এমন একজন রাইটারকে পেয়ে। অভিনন্দন।

  3. দুর্দান্ত একটি লেখা দিদিভাই এর,,,,ওনার সবকটি উপন্যাস এর ভাষা,যে কোনো লেখার অতি সহজ সরল শব্দ মনের মধ্যে অজানা কোনো আঁকিবুকি কাটে।সশ্রদ্ধ প্রণাম নিও।

  4. খুব ভাল লাগল । এত অল্প পরিসতে এতটা কথা বলা । মনে থাকবে ।

Leave a Reply to Saibal Chattopadhyay Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *