micro-story-obak-hoi

অবাক হই

খায়রুল আনাম

কোলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে বিএসসির রেজাল্ট আউট হওয়ার পর অনার্সে সেকেন্ড হওয়া আলি হোসেন ফার্স্ট হওয়া তপতী বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলল, “মনে হচ্ছে শীগগিরই একটা চাকরি ফাকরি হয়ে যাবে। হয়ে গেলেই আমরা বিয়ে করে ফেলব”।
তপতী হোসেনের মুখে হাত চেপে রেখে বলল, “বিয়ে করতে চাইলে কর। তবে খবরদার, চাকরির কথা মুখে আনবে না”।
“সেকি? কি বলছ তুমি? তাহলে সংসার চলবে কি করে?”
“সে ভাবনা তোমার করতে হবে না। বিয়ের জন্য দিন ঠিক করো। আর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে এমএসসিতে ভর্তির সব কাগজপত্রের ঝামেলাগুলো সেরে ফেল”।
“পাগল? এমএসসি পড়ার পয়সা কোথায়? আর বিয়ের কথা বাদ দিলেও, খালি হাতে আর কতদিন প্রেম করব? তার চেয়ে তুমি বরং এমএসসিতে ভর্তি হও। তুমি তো ফার্স্ট হয়েছ, আমার চেয়ে লেখাপড়ায় ভালো। আমি চাকরিতে ঢুকি”।
“কথা বাড়িও না তো। যা বলছি তাই ক’র। তুমি পড়বে, আমি চাকরি করব। ব্যস, এটাই ফাইনাল”।


মায়ের এই আদরের শাসনকে বাবা খুব সম্মান করত। দুজন দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসত। খুনসুটি হতো, তবে সত্যিকার অর্থে যাকে ঝগড়া বলে, তা তাদের কোনদিন করতে দেখিনি। কিন্তু ব্যাপারটা আমার মায়ের মা, অর্থাৎ আমার দিদার একটুও পচ্ছন্দ হয়নি। তাঁর কথা হলো, প্রথমত ছেলেটি মুসলমান। তারপর সে নিতান্তই গরীব ঘরের। তাঁর নিজের মেয়ে ছেলেটির চেয়ে লেখাপড়ায় ভালো। তাছাড়া ছেলে পড়বে, মেয়ে চাকরি করে তার রসদ যোগাবে, এটা কি ক’রে হয়? এভাবে তাঁর মেয়েকে ফুঁসলে নেবার জন্য তিনি বাবার উপর অত্যন্ত বিরক্ত ও রাগান্বিত ছিলেন। এদিকে বাবা ফিজিক্স নিয়ে এমএসসিতে ঢুকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে বেরুলেন, এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার একটা স্কলারশিপ পেয়ে নিউইয়র্ক চলে আসলেন। পরে একটু চেষ্টা করে মা’র জন্য একটা অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ যোগাড় করে, মা’কেও আমেরিকা নিয়ে আসলেন। ইতিমধ্যে আমি ও আমার ছোটবোন বাবামা’র সংসার আলো করে এসে পড়েছি। আমরা সপরিবারে দু’তিনবার কোলকাতা গিয়েছি। কিন্তু লক্ষ্য করেছি, বাবার মুখ দেখলে দিদা যেন ভীষণ ব্যাজার হয়ে জ্বলেপুড়ে মরতেন। বাড়ির জামাই, কিন্তু খুবই অযত্ন হতো। ঠিকমতো খাবার দাবার দেবার বদলে বরং নানা ধরণের মুখনাড়াও তাকে খেতে হতো।


মা বলত, “তুমি কিছু মনে ক’রো না, প্লীজ। ক’টা দিন একটু চোখ কান বুজিয়ে থাক”।
বাবা বলত, “পাগল নাকি, কিছু মনে করব কেন? অন্যায় তো আমরা করেছি। এতে গুরুজনরা রাগ তো হবেনই”।
এভাবে বছর দশেক যাবার পর, একদিন টেলিগ্রাম এল, দাদু হঠাৎ মারা গেছেন। আমরা চারজন কোলকাতা গিয়ে দাদুর সৎকারের পর দিদাকে আনার ব্যবস্থা করি। দাদুর কাগজপত্রের বেশি ঝামেলা ছিল না। রিটায়ার করেছিলেন আর ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। দিদা তো কিছুতেই এই বিজাতীয় জামাইয়ের বাড়ীতে উঠবেন না। কিন্তু দেশে আর কেউ নেই বলে শেষ পর্য্যন্ত বাধ্য হয়ে, অবাধ্য মেয়ের বাড়িতে এসে উঠলেন। মেয়ে জামাইয়ের সংসারে উঠলেও আগের মতোই জামাইকে সহ্য করতে পারতেন না। বাবা কাজ থেকে বাড়ি ফিরলে, উনি ভেতরের ঘরে ঐ যে চলে যেতেন, বাবা শুতে যাবার আগে পর্য্যন্ত আর বেরুতেন না। বাবা কিন্তু মা’র কাছ থেকে ওনার সব খোঁজ খবর নিতেন। চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। ঠিকমতো ওষুধপত্র এনে দিতেন।


মোটামুটি এভাবেই চলছিল। একদিন হঠাৎ দিদা মারা গেলেন। সেদিন বাবার সে কি কান্না! মনে হয়েছিল, মা’র চেয়ে বাবা চারগুণ বেশি কান্নাকাটি করছেন। ওর মধ্যেই সব খোঁজখবর করে কোথায় মৃতদেহ পোড়ানো হয় সেগুলো জেনে হিন্দুপ্রথা মতো দিদার সৎকারের সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। বাবাকে তিনদিন পর্য্যন্ত কারুর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়নি। বাবার ঐধরণের আচরণের কথা মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বলেছিল, “তোর বাবাকে জন্ম দিতে গিয়ে তোর দাদি মারা গিয়েছিল। তাই তোর দিদা বা নানীকে সে তার মায়ের জায়গায় বসিয়েছিল। তাই তাকেও হারিয়ে সে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল”।
আজ আমাদের মা’ বাপ কেউ বেঁচে নেই। বিদেশে মিশ্র ধর্মের সংসারের দ্বিতীয় প্রজন্ম আমরা। কোন ধর্মটা ঠিক ও কোনটা মেনে চলা উচিত, তা নির্ণয় করতে আমরা আজো হিমশিম খাই। তা সত্ত্বেও ক্লাসের ফাঁকে বা ক্লাস শেষ হয়ে বাড়ি যাবার আগে টিচার্স রুমে বসে যখন ভাবি, এক ধর্মের লোক, নানা অপমান সত্ত্বেও অন্য ধর্মের একজনকে মায়ের আসনে যদি বসাতে পারে, তাহলে মানুষের কাছে ধর্ম বড় না মানুষ বড়?


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *