মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর
হুজুর- জীবজন্তুর ছবি আঁকতে নেই! ছবিতে তো আর জান দিতে পারবা না- এজন্যই তো আল্লাহ প্রাণীর ছবি আঁকতে নিষেধ করেছেন।
চিত্রকর- ছবিতে আমি জান দিতে পারি না ঠিকই কিন্তু প্রাণ দিতে পারি। এই যে দেখুন আমার আঁকা …
হুজুর ক্যানভাসে আঁকা নারীর শৈল্পিক উদোম তৈলচিত্রে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয় – মাশাআল্লাহ!
অফিসে যাওয়া-আসার পথে মেট্রোতে সহযাত্রী হিসেবে ওকে প্রায়ই পাই। জিনসের উপর পিংক-কালার টপসে আজ কী যে লাগছে, যেন বসরাই গোলাপ! বুকের গহীন থেকে উঠে আসে কবিতা, ‘সময়ের সিঁড়িতে লেগেছে হাওয়া / তুমি পুলসিরাত, পার হবো আমি’
ঘোরের মাঝে তলিয়ে গিয়ে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। কৌতুহলী হরিণীচোখে চোখ রাখি এবার।
– আংকেল, আপনি কি কিছু বলবেন?
ধ্যুত! ঘোর ভেঙ্গে গেলো।
গভীর রাত। ওয়াড্রোব খুলে ভদ্রমহিলা আলতো করে স্পর্শ করেন সযত্নে রাখা ছোট্ট ছোট্ট জামা, মিকিমাউজের ছবি আঁকা একটি ফিডার আর ছোট্ট একজোড়া লাল জুতা। বেলকনি থেকে সিগারেটে সুখটান দিয়ে রুমে ঢুকেন ভদ্রলোক। স্ত্রীর পিঠে হাত রাখেন। সজল চোখে দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থাকেন। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারেন না। জানালার ফাঁক গলে হঠাৎ দুজনের চোখে পড়ে দূর-আকাশের মিটিমিটি তারা।
ফোর-বি র ম্যাডামকে দেখলেই গা শির শির করে উঠে সিকিউরিটি গার্ড জহিরের। তার কি দোষ! সে ভাবে, শরীরের এমন সেক্সি বান্ধন, আর যেভাবে ওড়না এক কান্ধে ফেলাইয়া সামনে দিয়া যায় বুড়ারাও তো না তাকাইয়া পারে না। টু-ইর মাঝবয়সী সাহেব তো চোখ দিয়াই ম্যাডামকে খাইতে থাকে। ম্যাডাম কি কিছুই বুঝবার পারে না!
ম্যাডাম সামনে পড়লে জহির অবশ্য একবারের বেশী তাকায় না। তার তখন মনে পড়ে যায় স্কুলের মৌলানা মহিউদ্দিনের কথা। ক্লাসে তিনি প্রায়ই বলতেন,’বাবারা, দুইটা জিভকে খুব সাবধানে রাখবা। একটা হইলো দুই ঠোঁটের মাঝখানের জিভ। আরেকটা হইলো গিয়া, দুই ঠ্যাং-এর মাঝখানের জিভ”। চৌদ্দ/পনেরো-র বালক জহির তখন অবশ্য বুঝতে পারতো না মৌলবী স্যারের এই বয়ান। ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্টে কাজ করতে এসে এখন সে খুব বোঝে।
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয়, মৌলানা স্যারের বয়ানটা টু-ইর সাহেবকে বলতে। তবে সাহস হয় না। তাছাড়া, সে নিজেও ধর্মের কারণে নাকি চাকরি খোয়ানোর ভয়ে ম্যাডামের দিকে কম তাকায় এ বিষয়ে নিশ্চিত না।
লালমাটিয়া মাটির মসজিদ রোডে একতলা বাংলোবাড়ি। আশেপাশের সব প্লটেই ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে সুউচ্চ আবাসিক অট্টালিকা, নগরবাসীর কাছে যা অ্যাপার্টমেন্ট বলেই পরিচিত। কংক্রিট জঙ্গলের ভিড়ে গাছ-গাছালি ঘেরা আধাবিঘা জমির উপর হঠাৎ সবুজ এ বাড়িটি যেন আজ কালের সাক্ষী। তবে দূর্মুখরা বলাবলি করে, এ বাড়িও দেখিস … বুড়ো পটল তুলুক আগে!
এ মূহুর্তে বাড়িটির বসার ঘরে চলছে পারিবারিক মিটিং। সত্তরোর্ধ বাবা রিটায়ার্ড সরকারী আমলা আর তাঁর তিন ছেলে। বড় ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, মেঝ ডাক্তার আর সবার ছোট আর্কিটেক্ট। সরকারী আমলা হয়েও সরকারী বরাদ্দ এই প্লটটি ছাড়া তেমন সহায় সম্পত্তি আর কিছু করতে পারেননি। বাড়িটাও করেছেন ধীরে ধীরে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আর হাউজ বিল্ডিং-এর লোন নিয়ে। তবে এ নিয়ে ভদ্রলোকের কোন আফসোস নেই, বরং সৎ থাকার কারণেই যে তিনি তার ছেলেদের উচ্চশিক্ষিত করতে পেরেছেন এ তার দৃঢ় বিশ্বাস।
ছোট ছেলেই প্রসঙ্গ তোলে। হাতে ধরা কাগজটি দেখিয়ে বলে, “বাবা, ডিজাইনটা দেখো …”
-কীসের ডিজাইন?
-অ্যাপার্টমেন্টের। রাজুক দশতলা পর্যন্ত করার অনুমতি দিবে জানতে পেরেছি। আধাবিঘা জমির উপর ডিজাইনটা বেশ ইচ্ছেমতো করা গেছে। নিজেদের জন্য রাখা অ্যাপার্টমেন্টগুলো এক ইউনিট করে করানোর কথা ভাবছি। বেশ খোলামেলা, ডিজাইনও করেছি মডার্ণ অ্যাপ্রচে …
– কী অ্যাপার্টমেন্ট? এই বাড়ি ভেঙ্গে? গাছগাছালি কেটে! বাগান তছনচ করে!
এবার হাল ধরে মেজো ছেলে, “বাবা, এ সব ইমোশনের কি কোন মানে আছে! অ্যাসেট, ইস্টার্ণ হাউজিং সহ সব বড় বড় রিয়েল অ্যাস্টেটের সাথে কথা হয়েছে। ওরা ৬০:৪০ শেয়ারে কাজ করতে রাজি হয়েছে। এছাড়া সাইনিং মানি হিসেবে এক কোটি টাকা এবং কনস্ট্রাকসন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বাড়ি ভাড়া চালানোর চুক্তিও করবে। এ রকম সুযোগ কিন্তু পরে আর পাওয়া যাবে না বাবা।”
বাবা এবার ভীষণ ক্ষেপে উঠেন, চেচিয়ে বলেন, “জানিস, তোদেরকে যেমন আমার রক্ত পানি করে তিলে তিলে গড়ে তোলেছি, এ বাড়িটাকেও সেভাবে.. বাড়িটির প্রতিটি ইট জানে এ কথা.. তাছাড়া, বাগানে ঐ যে শুয়ে আছে তোর মা, দেখছে তোদেরকে আর আমাকে.. এ বাড়ি ভেঙ্গে তোরা করতে চাচ্ছিস অ্যপার্টমেন্ট, মধ্যবিত্তের বস্তি!”
মিটিং ভেঙ্গে যায়। বাবা গজ গজ করতে করতে ঢুকে পড়েন বেডরুমে।
প্রফেসর বড় ছেলে বাস্তববাদী এবং বেশ প্রাগমেটিক। চাপাস্বরে ভাইদের বলে, ” বাবাকে কেন তোরা মিছেমিছি কষ্ট দেস, এতো তাড়াহুড়ার কি আছে, অপেক্ষা কর, অপেক্ষা কর, আর কটা বছর…”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন