micro-story-onuranan

অনুরণন
তুলিকা মজুমদার


আমেরিকা নিবাসী ফিলোমেলা উইনস্টন এক বিশেষ প্রজেক্টের কাজে অ্যাথেন্স এসেছে। সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বিভাগের সহকারী। আজ ফিলোমেলার সাথে এখানকার স্টাডি গাইড জুলিয়াসের দেখা করার কথা। আগামী ক’দিন ওই সঙ্গে থাকবে বিভিন্ন মন্দির আর স্থাপত্য পরিদর্শনের সময়। রিভারসাইড বে অঞ্চলের একটা কফিশপে বসে ছিল ফিলোমেলা। আর ঠিক তখনই কোথা থেকে উদয় হল এই কুঁজো জিপসি বুড়ি। হাতে একটা নীল রঙের উজ্জ্বল পাথরের মালা কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। সে বললো মালাটা নাকি দেবী অ্যাথেনার! বিশ্বাস না হলেও কৌতূহলে মালাটা পরে নিল ফিলোমেলা। নীল পাথরগুলোর শীতল স্পর্শ বেশ লাগলো ওর, কিন্তু ব্যাগ থেকে পয়সা বের করে বুড়ির হাতে দিতে গিয়ে ফিলোমেলা দেখলো বুড়ি যেনো এক লহমায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। “যাহ্! — টাকাটা না নিয়েই চলে গেলো!” নিজের মনেই স্বগতোক্তি করলো ফিলোমেলা। “তোমার মত সুন্দরীর থেকে কে পয়সা নেবে বলো?” — অচেনা কণ্ঠস্বরে এহেন মন্তব্য শুনে ফিলোমেলা চোখ তুলে দেখলো সামনে একটি তরুণ দাড়িয়ে আছে। চোখে মুগ্ধতা আর ঠোঁটে এক টুকরো লম্পট মার্কা হাসি। “আমি জুলিয়েন, তুমি নিশ্চয় ফিলোমেলা উইনস্টন! আমি সত্যি ভাগ্যবান যে বিশ্ববিদ্যালয় তোমার মত সুন্দরীকে পাঠিয়েছে আমার শহরে” — তরুণ হাত কচলাতে কচলাতে বললো। গায়ে পড়া লোকটাকে দেখে ফিলোমেলা বিরক্ত হলো মনে মনে।

জুলিয়েনের সাথে ফিলোমেলা যখন অ্যাথেন্সের মূল আকর্ষণ দেবী অ্যাথেনার মন্দিরে পৌঁছালো, তখন দিনের আলো পড়ে এসেছে আর আকাশ কালো করে এসেছে আসন্ন বৃষ্টির পূর্বাভাস নিয়ে। মন্দিরে তখন কোনো ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে। ফিলোমেলা সাগ্রহে প্রবেশদ্বার দিয়ে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে, তার চোখে অপার বিস্ময়। এই সেই “অ্যাথেন্সের রক্ষক” — দেবী অ্যাথেনার প্রার্থনা গৃহ! কত গল্পই না পড়েছে ফিলোমেলা এই দেবীকে নিয়ে। একসময় গ্রীক সমুদ্রের দেবতা পোসাইডনকে হারিয়ে অ্যাথেনা এই শহরের পূজ্য দেবী নির্বাচিত হয়েছিল। তারপর তাকে কত ঘটনার বিবরণ রয়েছে গ্রীক-পুরাণের পাতায় — ফিলোমেলা সম্পূর্ণ আত্মগত ভাবেই মন্দিরের গায়ের খোদিত কারুকার্যে পুরাণের সেসব গাঁথা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। ও খেয়ালই করেনি কখন প্রাসাদোপম মন্দিরটি ট্যুরিস্ট শূন্য হয়ে গেছে। দেওয়ালে গ্রথিত মশালের আলোয় আলোকিত মন্দির প্রাঙ্গণে তখন শুধুমাত্র সে আর জুলিয়েন। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত পুরো শহর। ফিলোমেলা ঘুরতে ঘুরতে দেবী অ্যাথেনার বিশাল শ্বেতপাথরের মূর্তির সামনে এসে দাঁড়াল। একাগ্র চিত্তে সে মূর্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ অনুভব করলো একজোড়া লোভী হাত তার মুখ চেপে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছে। প্রবল আতঙ্কে ফিলোমেলা চিৎকার করতে গিয়ে দেখলো, নেশাগ্রস্থ জুলিয়েন সাক্ষাৎ শয়তানের মত কদর্য লোলুপ অভিব্যক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর উপর। নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় ছিল না ফিলোমেলার, সে অসহায়ভাবে চিৎকার করতে করতে অনুভব করছিল জুলিয়েন নোংরা স্পর্শে তার সারা শরীর কলুষিত করছে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ ওর গলার পাথরের মালাটা ছুঁয়ে ফেললো জুলিয়েন, আর সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সরে গেল। তারপর কাটা কলাগাছের মত ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল, নিস্পন্দ, অচৈতন্য। ফিলোমেলা কোনোমতে নিজের আক্রান্ত, অবিন্যস্ত শরীরটাকে তুলে, অ্যাথেনার সামনে থাকা প্রস্তর ফোয়ারার জল মুখে ছিটাতে গিয়ে আতঙ্কে স্থবির হয়ে গেলো — স্বচ্ছ জলের প্রতিবিম্বে তার দিকে চেয়ে আছে এক অদ্ভুত নারী, তার মুখাবয়ব ফিলোমেলার, কিন্তু কেশরাশির বদলে কিলবিল করছে অসংখ্য সরীসৃপ! ঠিক যেন গ্রীক গর্গণ মেডুসা, অ্যাথেনার অভিশাপে রূপান্তরিত বিষধর নাগকন্যা। যার চোখের দৃষ্টিতে প্রস্তরবৎ হয়ে যায় পুরুষের শরীর…! পুরাকালে মন্দিরের গর্ভগৃহে যৌনসংসর্গে অপবিত্র করার অভিশাপ আজ আবার অনুরণন হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু সেই অভিশাপ ফিলোমেলার জীবনে দুর্যোগ নয় আশীষ হয়ে নেমে এসেছে!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *