জয়তী রায়
—– মায়ের হাতের বেগুন বড়া …আহা, যে না খেয়েছে, তার জীবন বৃথা!
—-বেগুন বড়া? বেগুনী বলছো?
—- ধুস। বেগুনী একটা খাবার? রাস্তা ঘাটে যত্র তত্র বেগুনী মিলবে। কিন্তু, বেগুন বড়া … আহা!
—- জীবনে শুনিনি বাপু। বেগুন বড়া? তুমি যা হাঁদারাম। ঐ বেগুনিকেই বেগুন বড়া না কি বলছো!
—-চুপ করো। তিন টাকার মাইনের চাকরি করে তোমার বড্ড ফুটানি বেড়েছে রাধা! আমি হাঁদারাম? নিজে তো বুদ্ধির ঢেঁকি একেবারে। ভারী তো বাংলায় অনার্স। তার আবার এতো ফুটানি।
—-সে- ই! সেতো বলবেই। আজ এই বাংলায় অনার্স না থাকলে না খেয়ে মরতে হতো। সরো সরো। সরে শোও একটু। সকালে উঠেই ছুটতে হবে অপিসে। তোমার মতো শুয়ে বসে থাকলে চলবে?
—-আহা! রাগ করছো কেন? হচ্ছিলো বেগুনের বড়ার কথা। জানো রাধা! শীতের সন্ধ্যে, রাতের নিভন্ত উনুনে রান্না খিচুড়ী অপেক্ষা করছে। পিঁড়ি পেতে বসতে না বসতেই পাতে পড়লো খিচুড়ী, আর পেঁয়াজ রসুন কালজিরে কাঁচালংকা চালবাটার মধ্যে সেদ্ধ বেগুন ডুবিয়ে ডুবিয়ে গরম গরম বড়া। সংসারে আয় বেশী ছিল না গো। খাওয়ার মুখ অনেক। তবে মায়েরা বোধহয় ম্যাজিক জানে রে রাধা। সামান্য বেগুন, তাই দিয়ে …মনে হয়… স্বপ্নের মত।
—- এদিকে সরে এসো। কাঁথাটা জড়িয়ে নাও। তোমার বুকের কষ্ট বেড়ে যাবে আবার! এসো। ওম নাও বুকের। জানো কৌশিক কথাটা ঠিক বলেছো গো। মায়েরা ম্যাজিক জানতো। আমার মা … বুঝলে, বেগুনের চাটনী বানাতেন। জিভে জল আসবে গো। কাঁচা টমেটো পোড়া, বেগুন পোড়া, শুকনো লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন সব পোড়ানো তারপরে কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে ধনেপাতা দিয়ে মাখা– ওর মধ্যে আবার তেঁতুলের রস আর একচিমটি চিনি— গরম ভাতে ঐ চাটনী– অই কৌশিক, উফ্। আরে ছাড়ো ছাড়ো ওতো জোরে চেপে ধরল কেন? দম বন্ধ হয়ে আসছে। ছাড়ো বলছি। উফ্।
—- রাধে, আমার জিভ কেমন করছে, শরীর কেমন জেগে উঠছে। আমার কাছে আয় রাধে। কতদিন কাছে পাইনি তোকে।
—–থাক কৌশিক। এসব হলেই রিমির কথা খুব মনে পড়ে। কেমন ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো আমার মেয়েটা!
—- চাকরী চলে গেল যে। রিমির চিকিৎসা করতে পারলাম না। শালা। ইউনিয়নের পাছায় লাথি। নিজেরা মস্তি করছে। মাঝে থেকে কারখানা দিলো লকআউট করে।
—–আবার বিড়ি ধরালে কেন? একে কাশি কমছে না!
—-রাধে। তোর খুব কষ্ট না রে? সারাদিন কত খাটিস! মনে পড়ে তোর কত চুল ছিল মাথায়। ছোট্ট কপালে একটা টিপ পরে সামনে দাঁড়াতেই মাথা খারাপ হয়ে যেত মাইরি।
—-আবার মাইরি? ঐ ছোটলোক গুলোর সঙ্গে মিশে মিশে এই সব শিখছো?
—-বস্তিতে আর ভদ্দরলোক কোথায় পাবো রে? এরা অনেক ভালো রে রাধে। এই তো সেদিন কানা বাবলু আমায় ডেকে একটা কাজ দিলো। গতকাল পঞ্চাশ টাকা পেলাম রে রাধে!
—-বলোনি তো!
—-বলবো তো ভাবছিলাম। মাঝে ঐ বেগুন এসে পড়লো যে, কি করবো?
—- আমিও কিছু টাকা দেব। একটু বেগুন আনি বরং কাল। সঙ্গে একটু চারা মাছ। বেশ তেল বেগুনের ঝোল বানাবো।
—–আহ্হঃ তেল বেগুনের ঝোল উসস। রাধে। রাত যে আর কাটে না রে!
—-উফ ঘুমোও তো এবারে। মাথা ধরে যাচ্ছে আমার। কাল আবার সেক্রেটারী বাবু আসবেন। আমার অস্থায়ী চাকরী। দেখি একটু হাতে পায়ে ধরে।
—-হাতে পায়ে বেশী ধরতে যাসনে। সুযোগ পেলেই বিছানায় তুলবে।
—- থামবে? নোংরা লোক কোথাকার। আজকাল খুব সন্দেহ করো আমাকে!
—- পাড়ার লোক বলে রে, আমি না। বস্তির লোকেরা বলে। তোর ঐ বুক উঁচু করে চলা দেখে বলে।
—-ঝাঁটা মারি ওমন বস্তিকে। আমি ঠিক জানি, ওদের নাম করে তুমিই এসব বলো! হিংসে হিংসে। নিজে বেকার। অকম্মার ধাড়ি। সারাদিন বাড়ি বসে থাকে।
—–মুখ সামলে রাধা।
—- কেন? মুখ সামলাবো কেন? তোমার জন্য মরে গেলো মেয়েটা। নেতাগিরি? হুঁ, নেতাগিরি। আমার পয়সায় খাও আবার আমাকেই যা তা বলা। বেগুনের বড়া খাবো, বেগুনের চাটনী খাবো! লজ্জা করে না। মুরোদ থাকে নিজে করে কিনে খাও।
—–রাধে! তবে রে! আজ তোর শেষ দিন। আজ আর ছাড়বো না। অনেক সহ্য করেছি। তুই মর। মর আজকে। আমাকে পাগল বলা? আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঢলানি করা? মর তুই মর।
*********
রাত কাটে। সূর্য ওঠে। কোনো কোনো জীবনে আঁধার আর কাটে না। কেউ বাঁচে। কেউ মরে। জীবন গতিময়। নিজের ছন্দে চলে।
*********************
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব সত্যি
অসাধারণ…তোমার গল্প গুলো পড়লে মনের খিদে বেড়ে যায়…আরো লেখো…💗💗