সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
খুকুমনির বিয়ে হয়ে গেল। খুকুমনি খাতুন। কৃষ্ণকায়া, মোটাসোটা, ফ্যালফেলে চোখ। ক্লাস নাইনের ছাত্রী, কিন্তু বছর কুড়ি বয়স! মন বা মগজে পরিণতির ছাপ কম পড়লেও তার দেহাভ্যন্তরে হরমোনের যে খেলা শুরু হয়েছিল, সেটা তার আচরণেও বিপজ্জনকভাবে প্রকাশ পাচ্ছিল। শেষে শ্রেণিশিক্ষিকা জবাদেবী তার মা’কে ডেকে বলতে বাধ্য হলেন, ‘মেয়েকে এবার স্কুলের জামার ভিতর কিছু পরতে বলুন। ও কিন্তু বড় হয়েছে। আমরাও সবসময় নজরে রাখতে পারি না, এটা কো-এড স্কুল, বুঝতেই পারছেন।’ তিনি কী বুঝলেন বলা মুশকিল, তবে খুকুমনির নিয়মিত স্কুলে আসা বন্ধ হল। তারপর হঠাৎ একদিন তার বিয়ের খবরটা এল। সুদূর বিহারের কোনও গ্রামের একটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে খুকুমনি চলে গেল। সবাই ভাবলেন, যাক একটা হিল্লে তো হল মেয়েটার!
কয়েক বছর পেরিয়েছে। করাল অতিমারি, লকডাউনে স্কুলের ক্লাসরুমগুলো খাঁ খাঁ। টিচাররা নাকে মুখোশ এঁটে মিডডে মিলের সামগ্রী বিলোচ্ছেন, আর ভিতরে তাঁদের বুকটা হু-হু করে উঠছে সন্তানসম ছেলেমেয়েগুলোর জন্য। এমনই এক দুপুরে জবাদেবী স্টাফরুমে ছিলেন, হঠাৎ একটা পরিচিত স্বর ভেসে এল, ‘দিদিমনি গো, ভাল আছ?’ চমকে মুখ তোলেন তিনি। খুকুমনি! হ্যাঁ, কোনও ভুল নেই, সে-ই। গাত্রবর্ণ আরেকটু তামাটে, চেহারা একটু যেন রোগা, কপাল-মাথা কাপড়ে ঢেকে কোলে একটা বছর দুয়েকের বাচ্চা ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে।
‘আরে খুকুমনি, তোর ছেলে নাকি? বেশ, বেশ। কবে এলি? কেমন আছিস?’
একগাল হেসে সে বলে, ‘হ্যাঁ গো দিদিমণি। এটা আমার ছেলে। গতমাসে এসেছি। আমার ভাই তো সিক্সে পড়ে। তাই বাবা মিডডে মিল নিতে আসবে বলে আমিও সঙ্গে এলাম। আমি খু-উ-ব ভাল আছি। আর এখন এখানেই থাকব।’
শেষ কথাটা শুনে একটু খটকা লাগে জবাদেবীর। ‘এখানে থাকবি? আর তোর বর?’
মুখটা একটু ভেটকে খুকুমনি বলে, ‘সে আছে ওখানে। ওর তো কাজ চলে গেছে লকডাউনে, এখন খুব টানাটানি। তাই আমায় ছেলেসুদ্ধু ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছিল। জানো আমার একটা মেয়েও আছে, ছ’মাসের। ওকে দিল না।’
চমকে জবাদেবী বলেন, ‘মানে? ঐ একরত্তি মেয়েকে রেখে এলি! কী সর্বনাশ। কেন?’
‘না গো, দিল না। বলল যদি ওকে দিয়ে দিলে আমি আর ফিরে না যাই? আমিও বলেছি, রাখো তোমাদের কাছে। আমি চললাম।’
‘ফিরে না যাস? কেন? আচ্ছা, ওখানে তোর কী খুব কষ্ট?’
‘হ্যাঁ গো দিদি। জানো সারাদিন ধরে চুলা জ্বালিয়ে রুটি করেই যাই। কত্ত রুটি, উফ। আমার হাত ব্যথা করে, ঘাড় ব্যথা করে। তাও ছাড়ে না। এই দেখো হাত কেমন পুড়ে গেছে।’ বলে সে তার ডান হাতটা দেখায়।
যে ফোস্কাগুলোর ক্ষত সেখানে রয়েছে সেগুলো শুধু রান্না করতে গিয়ে হয়েছে বলে মনে হল না জবাদেবীর। তিনি অন্য ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘তা হ্যাঁ রে, এত যে খাটিস, তোর শ্বশুর বাড়িতে কে কে আছে?’
‘সবাই আছে। সবাই।’
‘আহ, সবাই মানে কে কে, তাও বল একটু।’
খুকুমনি ছেলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘এর বাবা, তার বাবা আর এর বাবার তিন ভাই।’
মানে স্বামী, শ্বশুর আর তিন দেওর। মনে মনে ভেবেই শিউরে উঠলেন জবাদেবী, কোনও মহিলার নাম তো করল না! যদি ধরেও নিই শাশুড়ি গত হয়েছেন তাহলেও, তাহলে কী… ! তাঁর মনের পর্দায় একটা আতঙ্কের ছবি ভেসে উঠল, বহুদিন আগে দেখা একটা হিন্দি সিনেমা, নাম ছিল “মাত্রুভূমি”। এই পোড়া দেশের এক গ্রাম কন্যাভ্রূণ হত্যার অভিশাপে নারীশূন্য, কেউ কোনও মেয়েকে বিয়ে করে সেই গ্রামে আনলে সে ছোট বড় নির্বিশেষে সেই পরিবার এমনকি গ্রামের সমস্ত পুরুষের একমাত্র ভোগের বস্তু হয়। খুকুমনির কপালেও কি এমন কিছুই লেখা ছিল? পরক্ষণেই মনে হয় ছ’মাসের শিশুকন্যাটির কথা। এই দুর্ভাবনার একাংশও যদি সত্যি হয়, তবে তার ভাগ্যে না জানি কী আছে! তাঁর চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন করে খুকুমনি ফের বলে ওঠে, ‘আমি এখানে খু-উ-ব ভাল আছি গো দিদি। ওখানে আর যাব না। মেয়েকে রাখুকগে ওরা। আমি ছেলেকে নিয়ে বাবার কাছেই থাকব। আর মাঝেমাঝে তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসব। যাচ্ছি, বাবার চাল নেওয়া হয়ে গেছে, ডাকছে আমাকে ঐ যে।’
জবাদেবী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন তার চলে যাওয়ার দিকে, খুকুমনি অন্যরকম বলেই কি নিজের ছোট্ট মেয়েটাকে ঐ নরকে রেখে আসতেও তার কোনও ভয় হচ্ছে না? কোনও পিছুটান অনুভব করছে না সে? নাকি অত্যাচার সইতে সইতে এই সরল মেয়েটাও সারসত্যটা বুঝে গেছে, যে বড় হলে ওর মেয়ের পরিণতিও হয়ত একই হবে, তার চেয়ে যদি এখনই… ছেলেটাকে বুকে আঁকড়ে এক মা তার বাবার পিছু পিছু ঘরে ফিরে যাচ্ছে। পড়ন্ত বিকেল তাদের পিছনে পড়ে থাকা কালো ছায়ার দিকে অসহায়ভাবে চেয়ে রইল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন