micro-story-rajar-aadesh-shirodharjo

রাজার আদেশ শিরোধার্য
হামিরউদ্দিন মিদ্যা


সবাই এটা জানত যে শীতকাল পড়লেই ওরা দল বেঁধে বন থেকে বেরিয়ে আসবে লোকালয়ে, আর প্রতিবারের মতো শাকসবজি, ধানের ক্ষেত, আখের ক্ষেত, কলাবাগান সব তছনছ করে দিয়ে যাবে। এটা জেনে-বুঝেও কেউ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারত না, কেন না তারা সবাই চাষি। চাষ ছাড়া অন্য কাজ কেউ তেমন জানে না।

এক পাশে শাল-সেগুন, মহুয়ার বন, বনের অন্য পাশে চাষের ক্ষেত, ছোট ছোট গ্রাম, গ্রামের পর আবার ক্ষেত। শীতকালে বনের পাতা ঝরে গাছগুলো উলঙ্গ হয়ে যায়। হাতিদের এই সময়টা পেটের টান পড়ে। তাই দিনের আলো ফুরালেই ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলো বন থেকে বেরিয়ে আসে ফসলের ঘ্রাণে। সারারাত পেটপুজো করে সকালের আলো ফোটার আগেই আবার হেলতে দুলতে বনে ফিরে যায়।

একদিন চাষিরা আলোচনায় বসল, বার বার এমন ক্ষয়ক্ষতি তো মেনে নেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত করা দরকার। তাদের রাজা করছেন কী! বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র সবই তো তাঁর সম্পত্তি। কারও গোয়ালের গরু অন্যের ক্ষেতে মুখ দিলে যেমন চাষি দুটো কথা শুনিয়ে দেয়, পরেরবার আটকে না রাখলে মুড়ির সঙ্গে কীটনাশক বিষ মিশিয়ে খেতের পাশে নামিয়ে দেয়। তিনি বন-জঙ্গলের মালিক হয়ে কেন তাঁর জীব-জন্তুগুলোকে সামলে রাখবেন না। এ তো ভারী অন্যায়!

কেউ কেউ খুবই উত্তেজিত। বলল, এবার আসুক দেখি হাতিরা। দু’-একটা না মরলে শালার রাজার টনক নড়বে না।

ঘরের বউ-ঝিরা জিভ কেটে বলল, বালাইষাট! এমন কথা মুখে আনো না। গণেশ বাবাজি। ভগবান পাপ দেবে। সংসারের অমঙ্গল হবে।

গৃহিণীদের কথা কানে তুলল না চাষিরা। কত কষ্ট করে, ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলায় তারা। সেই ফসল বনের পশুরা এসে খেয়ে যাবে! মগের মুল্লুক নাকি! চাষের যা খরচ, সেই অনুপাতে ফসলের দামই নেই। আবার রাজার কর আছে, খাজনা আছে। সব হিসেব করে দেখতে গেলে, ঘুরে লস। তবুও তারা চাষ করেই যায়, লাভ-লোকসানের অঙ্কটা তো ভালো করে শেখেনি। তারা হল সব মুর্খ চাষি। শুধু লাঙল চালাতে জানে। ফসল ফলাতে জানে। বলতে যাও, শুনিয়ে দেবে—চাষ না করলে খাবে কী!

এবার চাষিরা একজোট হল। নানারকম যুক্তি-বুদ্ধি করে ফন্দি এঁটে রাখল। তারপর গুটি গুটি পায়ে শীতকাল নেমে আসতেই প্রতিবারের মতো বাবাজিরাও বেরিয়ে এল দল বেঁধে।

হৈহৈ করে তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল চাষিরা। বিষ-তীর মারা হল। কেউ বা আগুনে গরম করে লাল টকটকে ছুঁচালো রড ছুঁড়ে মারল। বোম ফাটানো হল। গোঁ-ও-ও, গাঁ-আ-আ ডাক ছেড়ে, আকাশে শুঁড় তুলে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল জন্তুগুলো। খেপে গিয়ে দু’-একজন মানুষকেও মেরে ফেলল।

মাটিতে গর্ত খুঁড়ে উপরে ডালপালা ঢাকা দিয়ে মরনফাঁদ পেতে রাখা হয়েছিল এক গ্রামে, একটি হাতির বাচ্চা সেই খালে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেনি। সকালে গ্রামের লোকেরা ইট,পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরে ফেলল বাচ্চাটিকে।

ব্যাস! চারিদিকে এবার ত্রাহিত্রাহি রব উঠল। ছুটে এল বনের রক্ষকরা। রাজার পাইক-বরকন্দাজরা। কয়েকজনকে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হল। পশু হত্যার বিচার হবে।

এতদিন বনের রক্ষকরা বেশ সুখনিদ্রায় দিন কাটাচ্ছিল, এবার পড়ল মহাচিন্তায়। শুধু হাতিকে মারা হয়েছে বলে রাজা যদি এক পেশে বিচার করেন, তা তো কেউ মেনে নেবে না। যেহেতু হাতিতেও মানুষ মেরেছে।

চাষিরা তাদের স্পষ্ট কথা জানিয়ে দিল, হাতিগুলোকে যেন আটকে রাখা হয়। বার বার তাদের ফসল খেয়ে নিলে, তছনছ করে দিলে তারা খাবে কী! আবার যদি হাতিরা ফসল খেতে আসে, তো মজা দেখিয়ে দেবে।

বনরক্ষকরা জানাল, বনের কোনও পশুকেই তো মারা চলবে না। সেটা রাজার নির্দেশ। সবাই এটা ভালো করেই জানো যে রাজার নির্দেশ কেউ অমান্য করলে কঠোর সাজা ভোগ করতে হয়।

তো আমাদের ফসলের কী হবে?

রাজা ক্ষতিপূরণ দেবে।

মানুষ মারলে?

তারও ক্ষতিপূরণ দেবে।

চাষিরা এবার একটু শান্ত হল।

নিয়ম করে শীত আসে। মাঠের ফসল পেকে হলুদ হয়। আর বনের হাতিরাও ঠিক হাজির হয়ে যায় সময় মতো। সন্ধে থেকেই সতর্ক থাকে চাষিরা। কেউ আর বিষ-তীর ছুঁড়ে না, বোম ছুঁড়েও মারে না। মরণফাঁদও পাতে না। ক্ষেতের ধারে ধারে মশাল জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকে। টিন বাজিয়ে, হৈ-হুল্লোড় করে খেদিয়ে দেয় হাতিদের। হাতিরা ভয়ে অন্য গ্রামের দিকে পা বাড়ায়। যে গ্রামের দিকেই যাক না কেন, এটা জেনে রাখা দরকার কোনও গ্রামের চাষিই কিন্তু নাক ডেকে ঘুমায় না। হৈচৈ শুনলেই বেরিয়ে আসে। সারারাত এ গ্রাম, সে গ্রাম চরকি ঘোরা ঘুরে ঘুরে ক্ষুধার্ত হাতিরা খেপে ওঠে। দল ভেঙে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সামনে যাকে পায়, পায়ের তলায় পিষে দেয়। পরেরদিন খবর হয়। বনরক্ষকরা ছুটে আসে। রাজার কাছে ক্ষতিপূরণের আর্জি পাঠানো হয়।

ক্ষতিপূরণ দিতে দিতে রাজা আলাতন হয়ে পড়লেন। একদিন ভাবলেন, হাতিতে যদি রোজ এত এত মানুষ মেরে ফেলে, খেত-ফসল তছনছ করে দেয়, তাহলে তো রাজকোষাগার খালি হয়ে যাবে! এর একটা বিহিত করা দরকার।

ভাবতে ভাবতেই ব্যবস্থা নিয়ে ফেললেন রাজা। হাজার হাজার মানুষকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গলের চারিধার দশহাত গভীর খাল কাটা করালেন। তারপর দেওয়া হল কাঁটাতারের বেড়া। এবার বেরও দেখি হাতি বাবাজিরা!

রাজা ঘোষণা করে দিলেন, প্রজাদের আর কোনও চিন্তা নেই, হাতিগুলোকে আটকে রাখা হয়েছে। এবার কোনও প্রজাও যেন কাঁটাতার ডিঙিয়ে বনের ভেতরে না ঢোকে। এই নিয়ম যেই লঙ্ঘন করবে,তাকে গুলি করা হবে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *