সাধ

সাধ
নীলা নাথদাস
আলেমার চিংড়ীমাছ দিয়ে লাউঘন্ট খেতে বড় ইচ্ছে করে। একদিন ঘাস বিক্রী করে ফেরার সময় মাছের বাজারে গিয়ে দাম করেও এসেছে। ছোট ছোট কুঁচো চিংড়ী তারও কত দাম! আশি টাকা পোয়া। ঘরে ফিরে, সন্ধ্যেবেলায় স্বামী সফিকুলকে বলেছিল ইচ্ছের কথা। শুনে তার কি মুখভঙ্গী! আসলে দুজনের মনের মিলই নেই। কাক ভোরে, ঘাস কাটতে বের হয় স্বামী-স্ত্রী। ঘাস বেচে ঘরে ফিরে আলেমা শুধু নিজের জন্য রাঁধে। সফিকুল দুবেলাই পাইস হোটেলে খায়। ঘরের খাবার নাকি ওর রোচেনা। রাতে শুধু শোয়ার জন্য আসে। যা আয় করে তা খাওয়া আর মদের পিছনেই যায়। আলেমারও সব দিন ডাল-ভাত মুখে রোচেনা, কিন্তু পয়সা কোথায়? এই ঝুপড়ী ঘরটাও তো নিজের নয়, ভাড়ায় নেওয়া। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় ওর। সবাই ভাববে, কুঁজোর আবার চিৎ হয়ে শোয়ার শখ! তবু, ইচ্ছেকেতো সবসময় আটকে রাখা যায়না। মনে মনে ভাল-মন্দ খাওয়ার স্বপ্ন দেখে আলেমা। তাই, সফিকুলকে লুকিয়ে টাকা জমিয়েও ফেলে। আশি টাকা। একপোয়া কুঁচো চিংড়ীর দাম! বলেনি সফিকুলকে। বললেই মদ খাওয়ার জন্য কেড়ে নেবে। তা একদিন ঘাস বেচে ফেরার পথে চিংড়ী মাছ কিনেই ফেলল আলেমা। লাউ ঘরেই আছে। সফিকুল ফিরবে রাতে। তার আগেই খেয়ে শেষ করে ফেলবে আলেমা। কিন্তু সেদিন ঘরের সামনে এসে দেখে অবাককান্ড। দরজায় তালা লাগানো নেই! ভয়ে ভয়ে ভেজানো দরজা খুলতেই, সফিকুলকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখল আলেমা। আওয়াজ শুনেও উঠলনা। সন্তর্পণে মাছের ক্যারীব্যাগটা উনোনের পিছনে লুকিয়ে রেখে, সফিকুলের কাছে গেল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে চোলাইয়ের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল। নাহ,নেশা করেনি। চুপচাপ শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। বুকের উপর দুহাত জড়ো করা। ভঙ্গীটা স্বাভাবিক নয় দেখে স্বামীর কপালে হাত রাখল আলেমা। গা বেশ গরম। জ্বর এসেছে। আলেমা ক’বার ডাকল। সাড়া দিলনা সফিকুল। এদিকে বড় খিদে পেয়েছে ওর। সফিকুল নিশ্চয়ই খেয়ে এসেছে। আর দেরী না করে মাছ পরিস্কার করে, লাউ ঝুরো ঝুরো করে কেটে রান্না বসিয়ে দিল আলেমা। ঘন্ট তৈরী হলে, ভাত নামিয়ে স্নান সেরে ঘরে ঢুকতেই, ঘড় ঘড় আওয়াজটা শুনতে পেল আলেমা। সফিকুল করছে। সেইসঙ্গে অস্থির ভাবে ছটফট করছে। কপালে হাত রাখতেই যেন ছ্যাঁকা লাগল হাতে। জ্বর অনেক বেড়ে গেছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছেও সফিকুল। ভাল করে কান পাতে আলেমা। ওর মৃত আম্মাকে ডাকছে ও। একি সর্বনাশ! অত জোরে শ্বাস নিচ্ছে কেন? তবে কি? আর ভাবতে পারেনা আলেমা। কি কপাল ওর! আজই এসব হল? কিছু হয়ে গেলে আর খাওয়াই হবেনা। ভাত, লাউ-চিংড়ী! নাহ, আর ভাবাভাবি নয়। থালা নিয়ে তাড়াতাড়ি ভাত বেড়ে নেয় ও। সফিকুল বড় আওয়াজ করছে। করুক যত খুশি! সাধের লাউচিংড়ী দিয়ে বড় বড় গ্রাস তুলে ভাত খায় আলেমা। বলা যায় না, আজ রাতেই যদি সফিকুলের ইন্তেকাল হয় তবে লাউ-চিংড়ী, ভাত সব নষ্ট হবে। বাড়িওলী বুড়ীর কান যা সজাগ! জেনে যাবেই। সফিকুলের বুকের ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে শুনতে গপাগপ ভাত মুখে দিতে লাগল আলেমা। কখন যে ঘড়ঘড় শব্দ চিরতরে থেমে গেছে জানেও না।

2 thoughts on “সাধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *