micro-story-sadhona

সাধনা
অভীক মুখোপাধ্যায়


অতি বড় সুন্দরী হওয়াও কিন্তু এক ধরণের ক্রাইম।

এত সুন্দরী কেউ হয় নাকি? তাই না?

এগুলো অবশ্য আমিই মনে-মনে ভাবি। ভাবি, যেদিন চান্স পাব, সেদিন এই কথাগুলোই বলে দেব। ইমপ্রেস করার ধান্ধা। টিভির বাইরে আমি এত সুন্দরী কখনও দেখিনি। এই সোসাইটিতে এসেছে অন্তত আড়াই মাস তো হবেই। আমলা-পুত্রের করোনা আনার আগে আগেই। কিন্তু চোখ তুলে দেখতই না। আমিও হাল ছাড়িনি, আগে হেলথ কনশিয়াস না-থাকলেও এখন ডেইলি মেজারে মর্নিং ওয়াক করছি। ও-ও রোজ বেরোয় যে। সবটাই সাধনা। হিন্দু ধর্মে হাজার হাজার বছরের তপস্যার কাহিনি ঘোরাফেরা করে, সেটাই আমার প্রেরণার উৎস।

অবশেষে ফল পেয়েছি। চোখে চোখ পড়েছে। এক সপ্তাহ আগে প্রথমবার। তারপর থেকে রোজ। দুবেলা। নিয়ম করে। পরশু হাসিও ফ্রী ছিল। পরের পুরো রাস্তাই আমার চেনা। নাম বলাবলি হল। মধুরিমা কাহালি। ফেসবুকে খুঁজে বের করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। সকাল এগারোটার দিকে অ্যাক্সেপ্ট করল। প্রথমে হাই-হ্যালো। তারপর ফরম্যাল কথা। মাঝে একটা হামির ইমোজি দিয়েছিলাম সাহস করেই। কথা বন্ধ করেনি। সিগন্যাল তো এগুলোই। ফুল দমে কথা চালু হয়ে গেছে। এই যেমন আজ ফ্ল্যাটে ডেকেছে। কী শুনে ডাকল জানেন? যখন বললাম—‘আমার বউ লকডাউনে বাপের বাড়ি গিয়ে আটকা পড়ে গেছে। আজ ফিফটি সিক্সথ ডে।’

‘বাপের বাড়ি কোথায়?’

‘ঘাটশিলা। আনলেই আনা যায়। কিন্তু ওই থানায় ধরতে হবে, পারমিট বের করা। ফেরার পরে আবার সোসাইটির লোকে বাঁকা চোখে দেখবে—এসব ভেবে এগোইনি।’

এরপর একদম ক্যালকাটা নাস্তা বিস্কিটের বিজ্ঞাপনী ঢঙে মধুরিমা বলল—‘আজকে ডিনার আমার সঙ্গে, কি বউ জানলে বকবে না তো?’

উফ! বউ বকলে আমার ইয়ে…মানে জানতেই পারবে না। তলপেট থেকে একটা প্রজাপতি শিরশিরে ভাব নিয়ে উঠে এসে, তুমি আমার আশা… আমি তোমার ভালোবাসা করতে –করতে নাভির কাছটাতে মিলিয়ে গেল।

পাক্কা সন্ধে আটটায় গিয়ে কলিং বেল টিপলাম। মধুরিমা যেমন সুন্দরী, তেমনি তার রুচিবোধ। সুরেলা কণ্ঠে গান বাজল, ও-রে গৃহবাসী খোল দ্বার খো-ও-ল…। একটা ফিনফিনে পাতলা শিফন শাড়িতে এসে দাঁড়াল। একঘর মাইরি! কী দিয়ে কথা শুরু করব বুঝতে না-পেরে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে গেলাম। বললাম—‘সাদা শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে তোমায়।’

‘তাই? বাংলা সিরিয়ালের বিধবা মনে হচ্ছে না তো?’

‘একদমই নয়।’

‘বিধবাকে যদি বিধবাই মনে হয় তাতেই বা ক্ষতি কী? সাদা পরলে খুব শান্তি পাই।’

আমি একটু থম মেরে গেলাম। একবার জিজ্ঞেসও করলাম—‘আর কাউকে দেখছি না?’

‘একাই থাকি।’

‘একা!’ মনের গুমসুম ভাবটা মুহূর্তে মেঘ হয়ে উড়ে গেল। মিউজিক সিস্টেমে গান বাজছে—আমার খোলা হাওয়া…।

সুন্দরী ভনিতা জানে না বোধ হয়। সোজা প্রশ্ন করল—‘অনলি হার্ড ড্রিংক্স কিন্তু। দোকান খুলে গেছে। ফ্রিজ ভরে রেখেছি। কী খাবে?’

আমি কিছু বলার আগেই অবশ্য সে আবার বলে উঠল—‘হুইস্কি?’

মাথা নাড়লাম—হ্যাঁ। অবশ্য ওর শরীর দেখতে দেখতে যেন পান না-করেই একটু নেশা হয়ে গেছিল। ভাবলছিলাম—‘এগুলো কি বাস্তবেই ঘটছে? আরও অবাক হলাম, যখন ও কমণ্ডলের মতো একটা পাত্রে করে হুইস্কি নিয়ে এল। পান করার জন্য গ্লাস দিল না, দুজনের জন্য দুটো ছোট্ট –ছোট্ট নারকেল মালার মতো স্যুপ বোউল। দু’পেগ চাপাতেই কথায় তোড় এল।

‘এই যে একা-একা থাকো, বোর লাগে না?’

‘না তো। বই পড়ি। সাধনা করি।’

আমি শালা বইপত্তর থেকে দূরে পালানো পাবলিক। কী খাপ খুলব বুঝতে না-পেরে বললাম—‘কী ধরণের বই ভাল্লাগে?’

‘তন্ত্রের।’

‘তাহলে ওই যে সাধনার কথা বললে, সেটাও কি তন্ত্র সাধনাই?’ প্রশ্ন করলাম বটে, তবে কৌতূহলের বদলে এবার একটু ভয় করছিল।

‘হ্যাঁ। আমার সঙ্গে পাঁচটা আত্মা থাকে। তারা আমার দাস।’

‘এই প্লিজ, ভয় দেখিও না তো। আমার এগুলো শুনে কেমন একটা লাগছে।’

‘তাই নাকি? ভয় লাগছে? বাচ্চা ছেলে? তা যখন ডিনারের জন্য বললাম, তখন তো ভয় লাগেনি? এখন কী ভাবছ—পালাতে পারলে বাঁচি? পালাবে? চেষ্টা করো। পারবে না। তোমার দুপায়ের হাঁটুর নীচে থেকে অবশ হয়ে গেছে।’

আমি পাগুলো নড়াতে চেষ্টা করলাম। সাড় নেই। ভয়ে ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। হাত জোড় করে বললাম—‘আমাকে ছেড়ে দাও! আমি কী ক্ষতি করেছি তোমার?’

খিল খিল করে হেসে উঠল মধুরিমা। তারপর আচমকাই হাসি থামিয়ে বলল—‘আরেকটু হুইস্কি দিই, বাঁদরের খুলিতে?’

আমার যেন মাথা ঘুরে গেল—‘বাঁদরের খুলি? মানে?’

হাতের পানপাত্রটা নাচিয়ে বলল—‘আমি তো বাঁদরের খুলিতে করেই মদ খাই। এই যে এইটা। আর…’

‘আর কী?’

‘আর খাবার খাই মানুষের খুলিতে করে…। পরশু ছিল বুধবার। মঙ্গলবার রাতে আগের খুলিটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। এবার একটা নতুন খুলির দরকার। তাই…’

আমি হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলাম—‘আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ! আমি আর কখনো কোনো মেয়েকে ঝাড়ি মারব না!’

ও অল্প হাসল। তারপর বলল—‘আচ্ছা ঠিক আছে। এসো। গুড নাইট।’

পায়ে সাড় ফিরে এসেছে দেখলাম। উঠে একছুটে বাইরে চলে এলাম। পেছন থেকে সুরেলা কণ্ঠ ভেসে এল—‘কাল মর্নিং ওয়াকের সময় দেখা হবে তাহলে?’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-sadhona

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *