micro-story-sesh-raat

শেষ রাত
রাখী আঢ্য


ছোট থেকেই আমার রাত বারোটার আগে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস। স্কুলের পরীক্ষার সময়টুকু অবশ্য এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতো। কিন্তু যতো বড় হতে লাগলাম তত দেখলাম ব্যতিক্রমটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে যেতে লাগলো। রাতেরবেলা প্রায় জেগেই কাটতো আর দিনের বেলা ঘুমিয়ে। মা-বাবা আমাকে প্রথমে বুঝিয়ে তারপর মারধোর করেও কিছুতেই এই অভ্যাস ছাড়াতে পারলেন না। দিনের পর দিন এই চলতে চলতে পড়াশোনা ঠিকমতো হলো না, আর কোন কাজও ঠিকমতো শিখলাম না। কোনমতে স্কুলের গন্ডিটা পার করতেই বাবা-মা আমাকে পাত্রস্থ করে দিলো। ভাবলো বোধহয় বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু কোথায় কি??? কিছু ঠিক হলো না তো!!! ঘুম তো বেড়েই গেল, তার সাথে একটা নতুন উপসর্গ যোগ হলো। নিজেকে সবসময় সবার থেকে গুটিয়ে থাকতে লাগলাম। কাউকে বলতে পারিনি আমার সারা গায়ে এতদিন যে ছোট ছোট গোল সাদা অংশ ভিড় করেছিল, সেগুলো আস্তে আস্তে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। এবার সবাই দেখতে পাবে। দূরে দূরে থাকতাম সবাইকার থেকে। আমার এত ভীড় সহ্য হতো না। মনে হতো একটু একা থাকি। কিন্তু সে গুড়ে বালি! সবসময়ই কেউ না কেউ রয়েছেই ঘরে, বাড়িতে এমনকি বিছানাতেও! বিছানায় নিজে একা থাকার উপায় নেই।

সেদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখি ঘরের জানালাগুলোর পাল্লা দুহাট করে খোলা। বাইরে বোধহয় কিছুক্ষণ আগে ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেছে। বেশ ঠান্ডা জোলো হাওয়া আসছে। খানিকটা দূরে কুকুর ডাকছে। দুদিন ধরে আমার ভালো করে ঘুম হচ্ছে না। পরশুদিন আমার বর মুম্বাই গেছে একটা জরুরী কাজে। যাবার সময় আমার সাথে দেখা হয়নি। আমার শরীর ভালো লাগছিল না বলে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর ঘুম যখন ভাঙলো তখন দেখি আমি একা পুরো বাড়িতে… যা আমি চেয়েছিলাম। আনন্দ হবার কথা, কিন্তু তারপর থেকেই ঘুম আসছে না আমার। না দিনে, না রাতে। সর্বক্ষণ সারা গায়ে একটা জ্বালা ধরানো অনুভূতি। ভাবলাম একবার ছাদে যাই। ছাদে উঠতে গিয়ে দেখি আবার বৃষ্টি জোরে নেমেছে। মনটা খিঁচড়ে গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে মনে হলো ছাদের উপরে চিলেকোঠার ঘরে একটা খসখস আওয়াজ হচ্ছে। আমার এবার একটু ভয় হতে লাগলো। চোর ডাকাত হলে তো খুব মুশকিল, আমি বাড়িতে একা… কি করবো? ভাবলাম দরকার নেই, আমি নিচে গিয়ে ঘুমাই। কিন্তু আওয়াজ টা ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো… সিঁড়ির দরজার পাশে রাখা ভাঙ্গা লাঠিটা নিয়ে চিলেকোঠার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। যা থাকে কপালে কিন্তু এভাবে ভয় পেলে চলবে না।

চিলেকোঠা ঘরের দরজাটা আস্তে করে খুললাম। একটা ক্যাঁচ আওয়াজ হতেই মনে হল যেন চারিদিকের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। যে আওয়াজটা শুনে আমি এইঘরে এসেছিলাম, অদ্ভুতভাবে সেই আওয়াজটা আর হচ্ছে না। একটা আঁশটে গন্ধ নাকে ঝাপটা মারলো। ঘরের উপর থেকে একটা দোলনা দোলার আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন খুব জোরে জোরে দুলছে। আমার ভয়ে আতঙ্কে জীভের তালুটা শুকিয়ে যেতে লাগলো। তবুও শব্দের উৎস সন্ধান এর জন্য ঘরের উপরের দিকে তাকালাম।

দেখলাম ঘরের সিলিং থেকে দড়িতে ঝোলানো রয়েছে একটা মহিলার দেহ। সেটাই খুব জোরে জোরে দুলছে। বেঁচে আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। গলায় ফাঁসের জন্য জিভ বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আতঙ্কের চোটে গলা দিয়ে চিৎকার ও বের হলো না। গায়ের পোষাক বড় চেনা চেনা লাগছে। একটু কাছে যেতেই সেই বিশ্রী গন্ধ নাকে ঝাপটা লাগলো। মুখের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলাম এটা তো আমি…হ্যাঁ এবার আবছা আবছা সব মনে পড়ে গেলো। দুদিন আগেই আমি তো ওইভাবে নিজেকে শেষ করে দিয়েছি, নিজের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পাবো বলে। ধীরে ধীরে আমার সমস্ত অনুভূতি গুলো বরফ হয়ে যেতে লাগলো, আমার দেহ যেন কোন এক অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে লাগলো। এবার তাহলে আমার অস্তিত্ব পুরোপুরি শেষ হলো।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-sesh-raat

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *