micro-story-shikar-khuje-firi

শিকড় খুঁজে ফিরি
শাম্ব চ্যাটার্জী


॥১॥


ধুত্তেরি! কোত্থেকে যে জোটে এই উটকো আপদগুলো। সেই কখন থেকে হাঁক পেড়ে গলা ব্যথা হয়ে গেলো, হতচ্ছাড়াদের নড়বার নাম নেই! কাজের সময় বাধা পড়লে মথুরা প্রসাদের মটকা গরম হয়ে যায়। একেই সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি, তার ওপর ধান্দারও বাজে অবস্থা। সেই ভোররাত থেকে কাজে লেগে পড়তে হয়। লকডাউনের পর এই লাইনে লোক বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই রোজগারে ভাঁটা পড়েছে। আগে সংখ্যাটা ষাট-সত্তরের কাছাকাছি ছিল। তার উপর লাভের গুঁড় পিঁপড়েয় খায়। শেষমেশ রেগেমেগে যখন সজোরে লাথি মারতে যাবে, ঠিক তখনই চারপেয়ে সারমেয়টি লাফ মেরে উঠে ল্যাজ গুটিয়ে দৌড় মারল। বেচারার মুখ দেখে সঠিক আন্দাজ করা গেলো না, এভাবে পালাবার কারণ অকস্মাৎ মথুরার লাথিবর্ষণ নাকি অন্য কিছু? কানখাড়া মুখটাতে এক অদ্ভুত ভয়ের রেশ লেগে ছিল! কেঁউ কেঁউ শব্দটার পিছু নিল বাকি স্যাঙাতরা। ওদের গলার আওয়াজ গলির মোড়ে মিলিয়ে যেতে না যেতেই…


॥২॥


মথুরার বাড়ি মেটিয়াবুরুজ এলাকায়। প্রতিদিন শহর কলকাতার রাতঘুমের আমেজ কাটতে না কাটতেই বউবাজারে চলে আসে সে—বরাবরের সঙ্গী একখানা ছোট কড়াই, লোহার ব্রাশ আর প্লাস্টিকের জগ। সেই কাকভোর থেকে বেলা প্রায় এগারোটা পর্যন্ত চলে নিরন্তর জীবন সংগ্রাম। লোকে বলে এ অঞ্চলে ধুলো হাতড়ালেও টাকাপয়সা মেলে। তা কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। ওর এক বাঙালি দোস্তের কাছে শুনেছে, কোনও একজন মহাপুরুষ নাকি বলেছেন—‘টাকা মাটি, মাটি টাকা।’ গোঁফ-দাড়িওয়ালা সেই মহাপুরুষের ছবি সে একদিন দেখেও ছিল, রাস্তার পাশে লাগানো হোর্ডিং-এ। চেহারাখানা একবার দেখলেই পেন্নাম ঠুকতে ইচ্ছে করে। এরপর ওরাস্তা দিয়ে হাঁটলেই সকলের অলক্ষ্যে মাথা ঝোঁকাতো মথুরা প্রসাদ। আড়াল করার একটাই কারণ—হঠাৎ যদি কেউ প্রশ্ন করে, তাহলে বেজায় ফাঁপরে পড়তে হবে তাকে… রাস্তা ঝাঁট দিয়ে জড়ো করা ধুলো জগে ভরে সে নিত্যদিন তুলে রাখে পাশে রাখা কড়াইয়ে। এছাড়া কারিগরদের পোশাক, কারখানার পাপোশ কিংবা চাটাই থেকেও গুঁড়ো সোনা মেলে। এরপরে তাতে জল ঢেলে ভেজানোর পর তবে নিশ্চিন্দি! নইলে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই সংগ্রহের ধুলো আবার ধুলোয় মিশতে এক চুলও দেরি হবে না।

দুর্গা পিতুরি লেনের সোনাপট্টির রাস্তায় রোজ দেখা মিলবে মথুরা প্রসাদের। আসলে ওর মতো সব নেহারালাদেরই এলাকা ভাগ করা আছে—স্যাকরাপাড়া লেন, গৌর দে লেন বা হৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায় লেন। হ্যাঁ, নেহারালা—মথুরা নামটা মুছে গিয়ে কবে যে ওই পরিচয়টাই নামের জায়গা দখল করে নিয়েছে তা আর মনে পড়ে না। দোকান ঝাঁট দেওয়ার সময় ধুলো ঝেড়ে সোনা বের করে ভাগ্য গুছোতে গিয়ে পিতৃদত্ত সোনাহেন নামটুকুও ঝেঁটিয়ে বিদায় করা গেছে। বাপ-দাদার আমলে উত্তরপ্রদেশের পাট চুকিয়ে এ তল্লাটে চলে আসা। ফেলে আসা ছোটবেলার ধূসর স্মৃতিকে সরিয়ে প্রাণের শহর জায়গা করে নিয়েছে মনের মাঝে। দুবেলা দুমুঠো অন্ন ঠিক জুটিয়ে দেয় এ শহরের মানবিক মাটি। ধুলো ঝেড়ে মেলা সোনা বেচে দিনে শ’তিনেক টাকা আয় হয়। মথুরার ভাগের দোকানমালিককে বাঁধা দরে দাম মিটিয়ে তার নিজের দিন গুজরান হয়ে যায়।


॥৩॥


চারপেয়েদের দলটা গলির মোড়ে অদৃশ্য হতেই মনটা হঠাৎ কু গাইল মথুরার। পায়ের তলার জমি কেঁপে উঠলো থরথর। পলক ফেলতে না ফেলতেই পাশের জীর্ণ বাড়িটা…


***


ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়ানো বহুকালের বাসিন্দার চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মাটির নীচে এগিয়ে চলা আধুনিক প্রযুক্তি এশহরের বার্ধক্যের বলিরেখা চিনতে ব্যর্থ। অদূরে ইট-কাঠ-পাথরে গড়া শহরের কংক্রিট চাঙড়ের বাধা উজিয়ে জেগে রয়েছে একখানা ধূলিমলিন হাত—মুঠোয় তখনও লোহার ব্রাশখানা ধরা। পিঁপড়ের সারি অন্য হাতের তালুতে রুধিরধারায় মুছে যাওয়া জীবন-রেখা ফের সাজিয়ে তুলতে ব্যস্ত। ঠিক তার পাশে ভেঙে পড়া ঘুলঘুলির ফোঁকরে সাদা রঙের ভাঙা খোলার নীরব অস্তিত্ব। খেয়াল করলে দেখা যাবে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে সদ্য জন্মানো সরীসৃপের লেজটুকু সাঁৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেলো। ডারউইনের থিয়োরি মেনে যাকে বলে সার্থক যোগ্যতমের উদ্বর্তন।

(সব চরিত্র ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক)

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “micro-story-shikar-khuje-firi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *