কল্যানী মিত্র ঘোষ
নীলম সারাক্ষণ অবসাদে ডুবে থাকে, যেন এক গলা জলের মধ্যে তার বাস। স্বপ্নে যেমন মানুষ ছটফট করে তারপর হঠাৎ চোখ খুলে হতভম্ব হয়ে যায়, সে ভাবেই একেকটা রাত কাটিয়ে নীলম ভোরবেলা তাকিয়ে দেখে জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের সোনালী কিরণ বালিশের পাশে ঝলমল করছে। তার শুকিয়ে দড়ি হয়ে যাওয়া শরীরটাকে সারা রাত নানা ভাবে ব্যবহার করে হৃষ্টপুষ্ট আয়ুষ নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মেয়ে জন্মাবার পর থেকেই এই অবসাদ নীলম কে খেয়ে ফেলেছে। ডাক্তার বলছেন প্রসবের পর এই ধরণের অবসাদ খুব স্বাভাবিক। আতঙ্ক, উত্তেজনা ইত্যাদি কমানোর জন্য কয়েকটা ওষুধ ও দিয়েছেন এবং বিশ্রামে থাকতে বলেছেন, কিন্তু নীলম আর সুস্থ হয় না। মেয়ের নাম সমিরা, অনেক আগে থেকেই নামটা ভেবে রেখেছিল নীলম, ছেলে হলে সমীর।
কলকাতায় থাকলেও ওরা রাজস্থানের লোক। আয়ুষ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ তাই ওর শ্বশুরমশাই টুকটুকে ফর্সা বৌমা চেয়েছিলেন, নীলম তপ্ত কাঞ্চন বর্ণা। আয়ুষের বড় বাজারে কাপড়ের ব্যবসা, ওরা বলে গদি। সকাল ন়টার সময় খেয়ে দেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় আয়ুষ আর আসে রাত ন টায়। ওদের যৌথ পরিবার, সকলেই খুব বেঁধে বেঁধে থাকে। ননদের শ্বশুরবাড়ি ও কাছাকাছি তাই প্রায়ই বাড়ি সরগরম। নীলমের দুর্বল শরীরের জন্য বছর দুয়েকের সমিরা ছোটি চাচীর কাছেই মানুষ হয়।
আয়ুষ এবার ছেলে চায়। ছোটি বহু কিরণ ছ মাস হলো এক শিশু পুত্রের জননী হয়েছে। রোজ রাতে আয়ুষ নিয়ম করে মিলিত হয়, স্ত্রীর কঙ্কাল সার চেহারাও তাকে নিবৃত্ত করতে পারে না। নীলম বাধা দেয় না কিন্তু ও মনে হয় তিলে তিলে নিজেকে শেষ করার সংকল্প নিয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া স্তন, কোটরাগত চোখ, উঁচু হয়ে থাকা গালের হনু আর শিরা বার করা হাত, এই শরীর কী সন্তান ধারণে সক্ষম? রয়েছে শুধু দুধের মতো রঙ, যার জন্য এই বিয়ে। যখন কোনো জ্যোৎস্না রাতে সে অলস ভাবে জানলার গরাদে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকে তখন তাকে দেখলে বুকের মধ্যে ছাঁত করে ওঠে, যেন কোনো প্রেতিনী, শুধু কানে, গলায় আর নাকে হীরের কুচির ঝিলিক।
শাশুড়ি কিন্তু কোনো অযত্ন করেন না, পয়সার অভাব নেই, গাওয়া ঘিয়ের রান্না, গেলাস ভরে দুধ, কাজের মেয়ে সময় সময় সব দিয়ে যায়। নীলম মুখেও তোলে না। আয়ুষের কিছুতেই কিছু এসে যায়না। সে নিজে তৃপ্ত হলেই হলো। একদিন ননদ এসে জোর করে নীলম কে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেল। তিনি ভালো করে দেখে বললেন বেশি দিন এভাবে চললে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিছু ওষুধ ও দিলেন।
ইতিমধ্যে ওদের বাড়িতে একটি অল্প বয়সী আয়া কাজে ঢুকলো, দুটো বাচ্চা কে সামলানো ছোট বউয়ের পক্ষে একটু অসুবিধা হয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটি বিহারী, আঁটোসাঁটো চেহারা, সব সময় হাসি খুশি, নাম বেবী। বেবী এসেই বড়ি ভাবিজির “হালত” শুধরোনো র হাল ধরল আর বাড়ির অন্যরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাচ্চা দুটোকে দেখে বাকি সময় সে নীলমের চুল বেঁধে দেয়, ঢলঢলে ব্লাউজের হাতা মেরে দেয়, ভুলিয়ে ভালিয়ে ফলের রস, ঘোল এসব খাইয়ে দেয় আর সারাক্ষণ হাবিজাবি বকে যায়। বয়স তার কুড়ি র কাছাকাছি। মোটকথা সে একটা দমকা বাতাস এই বাড়িতে।
একদিন সন্ধ্যেবেলা নীলম বেবী কে পানের দোকানের ছেলেটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলল। সে জানলায় বসেছিল, খিলখিল হাসি শুনে নীচে গ্যারাজের খাঁজে দেখে ওই ছেলেটার শরীরে বেবী লেপ্টে রয়েছে ঠিক যেন লতানে গাছ। ছেলেটা দু হাতে বেবীর মুখটা কাছে এনে ঠোঁট ঠেকাতেই বেবী আরো জোরে হেসে দৌড়ে পালাল।
সে রাতে আয়ুষ অভ্যাসবশতঃ পাজামার দড়ি টা খুলে নীলমের তলপেটে হাত রাখে, ঠিক তখনই নীলম উঠে বসে আয়ুষের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে, তারপর আয়ুষের মাথায়, পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বিস্মিত আয়ুষের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “জরা প্যার সে!”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভাল লাগল।তোমার সব গল্পের বাঁধুনি খুব সুন্দর আর চোখের সামনে সব ছবি ভেসে ওঠে।🙏❤️
আরো নতুন গল্পের আশায় রইলাম।
খুব খুশি হলাম ইন্দ্রানী দি, তুমি আমার অনুপ্রেরণা।
দারুণ। সবকিছুতেই যে জোরজবরদস্তি চলে না, সবকিছুই যে যান্ত্রিক নয় এই বোধটাই নেই গড়পরতা সাধারণ মানুষের মধ্যে। খুব সুন্দর presentation.
অসংখ্য ধন্যবাদ।
Bhison sundor ekta lekha ja mon chuye jaye.
অনেক ভালোবাসা।
Wow, what a captivating story! Absolutely loved it!
Thank you so much, it means a lot to me ❤️
গল্পটা তে একটা strong message আছে..পুরুষ কেবল গতানুগতিক স্রোতে গা ভাসিয়ে চলবে এটা বন্ধ হওয়া আবশ্যক ।।
খুব খুশি হলাম তোমার মন্তব্যে। পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়া এই দুই খুব জরুরী দাম্পত্য ও যে কোনো সম্পর্কে।