শূণ্যে ফেরা

শূণ্যে ফেরা
শ্যামলী আচার্য
– আমাকে কয়েকটা প্রেমের কবিতার নাম বলবি পরপর?
– হঠাৎ?
– খুব দরকার।
– প্রেমের কবিতা? দাঁড়া, ভাবতে হবে। এখন তো তেমন অভ্যেস নেই আর কবিতা পড়ার…
– আমারও তাই। কবিতা আর পড়া হয় কোথায়?
– তবুও তুই এখনও কবিতা পড়িস… গান করিস… কিন্তু বললি না তো কেন লাগবে…
– এই রবিবার অনন্যর জন্মদিন। কোটেশন লিখে কার্ড পাঠাব। আমাদের ছোটবেলার মতো।
– ও। তাই বল। ভার্চুয়াল কার্ড। এবার আর দেখা করার উপায় নেই… ইস!
– হ্যাঁ রে। অনেক প্ল্যান ছিল। আমিই ভেবে রেখেছিলাম। অনেক সারপ্রাইজ। কিচ্ছু হবে না।
– ঠিক আছে দেখছি। পেলে তোকে জানাব।
জয়িতার ফোন কেটে দিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে রিক্তা। ভার্চুয়াল উপহার বলে তো কিছু হয় না। শুধু মনের সান্ত্বনা।
অনন্যর সঙ্গে দেখা হয় না প্রায় সাড়ে চার মাস। তার বেশিও হতে পারে। বইমেলা চলে গেল। তারপর দু’তিন সপ্তাহ। যেমন হোত বরাবর। গঙ্গার ধারে ছোট্ট ক্যাফেতে। অফিসফেরত বিকেল। শেষ দেখা মার্চের এক বিকেলে। সেদিন নিভৃত আড্ডার পালা চলেছিল দীর্ঘক্ষণ। বই বিনিময়। শব্দ দেওয়া-নেওয়া। উষ্ণতার আদান-প্রদান। সন্ধের আলো-আঁধারিতে আঙুলের নরম ছোঁওয়ায় ঠোঁটের বাঁশিতে বেহাগের সুর। তখনও বসন্ত। এপ্রিলের এক উইক-এন্ডে ওদের দুজনের এই শহর ছেড়ে একদিনের নিভৃতযাপনের পরিকল্পনাও হয় সেদিন। দুঃসাহসী সব প্ল্যান। সেসব এখন দুঃস্বপ্ন।
করোনা ভাইরাসের নামও তখন জানে না কেউ। অনন্য আর রিক্তাও না। জানে না কোয়ারান্টিন। শোনেনি লকডাউন। পৃথিবীর অস্তিত্বসংকট ওদের দুজনকেও কোন এক অনিশ্চয়তায় টেনে নিয়ে গেল। প্রতিদিন সাধারণত ওদের কথা শুরু হয় রাত ঠিক বারোটায়। সেইসময় ওদের নিয়মিত নির্জন আলাপ। এখন শুধুই অনন্ত অসহায়তা। যৌনতা জেগে উঠলেও মাথার মধ্যে এক অসহ্য বোধ। কবে সব স্বাভাবিক হবে?
ঠিক তিনদিন পরে অনন্যর জন্মদিন। সংসারের নানান কাজের ফাঁকে একের পর এক কার্ড এঁকে জমাতে থাকে রিক্তা। মোবাইলের অ্যাপে বহু ডিজাইন। বইয়ের তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে কত কবিতার বই। কার্ড বানাতে বানাতে ছেলেবেলার দিনগুলো বড় মনে পড়ে।
জন্মদিনের তারিখে রাত বারোটা বাজতে না বাজতেই এই প্রান্ত থেকে ভেসে যেতে থাকে ভালোবাসার শব্দ, শুভেচ্ছার উষ্ণতা, শুভকামনার গাঢ় নিঃশ্বাস। একটা আস্ত দিন। চব্বিশ ঘন্টায় প্রতি আধ ঘন্টা অন্তর। নতুন কিছু, অন্যরকম। প্রতিবার আলাদা।
সন্ধের পর থেকেই খুব দমবন্ধ লাগতে থাকে রিক্তার। একটা আশ্চর্য বিপন্নতা। সব কার্ড পৌঁছচ্ছে একের পর এক। প্রত্যুত্তরে হাসিমুখ। ভালবাসার চিহ্ন। তবু কেন এই অস্থিরতা?
কী অদ্ভূত এক প্রত্যাশা ঘিরে ধরে রিক্তাকে। অকারণে। কেমন অস্বাভাবিক এক চাহিদা। শরীরী প্রেম নয়। যৌন তাড়না নয়। আরও যেন অন্য কিছু। অপ্রত্যাশিত কিছু। তার হদিস নেই রিক্তার নিজের কাছেই।
সেদিন রাত ন’টার পর থেকে অনন্য রিক্তার কোনও মেসেজ দেখেনি। এমনকি প্রতিদিনের রাত বারোটার নিভৃত আলাপচারিতায় সেদিন আসেইনি অনন্য। রিক্তা ফোন বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের শক্ত বাঁধনে অনন্যর পরিবারের নিজস্ব আনন্দ-উৎসবে আজ সে অবৈধ। তাকে লুকিয়ে থাকতে হয়, লুকিয়ে রাখতে হয়। সপ্তাহান্তের প্রতীক্ষা, গভীর রাতের শব্দযাপনের পরেও জন্মদিনের ভার্চুয়াল উপহারের আসলে কোনও রিটার্ন গিফট হয় না।
রিক্তা বা অনন্য যে যার নিজস্ব পরিসর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল মাঝেমধ্যে। নিজেদের বহুদিনের পুরনো সংসারের চেনা গণ্ডির বাইরে দুজনের এই সম্পর্ক তাদের একটুকরো ঘুলঘুলি। জাগ্রত যৌনতা নিয়েও তো মানুষ পথ হাঁটে। তার এক হাতে মারী, এক হাতে বিলুপ্তি। রিক্তা রাস্তা খুঁজে পায় না। শূন্যতার মধ্যে তার অস্থির আবর্তন চলতেই থাকে। হাতে ধরা থাকে কবিতার বই। প্রেমের কবিতার সংকলন। সেটুকুই মুহূর্তের অবলম্বন।

1 thought on “শূণ্যে ফেরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *