micro-story-signal

সিগন্যাল
রাখী আঢ্য


সময় সকাল দশটা। এই সময় শ্যামবাজারের মোড়টায় খুব ভিড় হয়। অপেক্ষায় আছি রেড সিগন্যালের। জীবন যখন গল্পের চেয়েও অবাক করা কিছু এনে দেয়, তখনই লোকে বলে “ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান…।” গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। প্রায় কুড়ি বছর আগে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো।

এতগুলো বছর পেরিয়ে এলেও যেন মনে হয় পুরো জীবন্ত। সেদিনও রাস্তায় খুব ভিড় ছিল। হাতে নানা রঙের অনেক গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম চৌরাস্তার মোড়ে। সিগন্যাল রেড হতেই ছুটে গেলাম গাড়ি গুলোর দিকে…”বাবু একটা গোলাপ নিন, মাত্র কুড়ি টাকা।” কোন গাড়ির বাবুরা বা তাদের ড্রাইভাররা দরজা খোলা তো দূর, গাড়ির কাঁচও নামাচ্ছে না। আর নামাবেই বা কেন? বৈশাখের দুপুর… প্রচন্ড তাপে রাস্তার পিচও বোধহয় গলে যাবে এবার। এক বোতল জল ছিল সাথে। তবে নিজের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নয়, গোলাপগুলোতে জল দিয়ে তাদের তাজা রাখবো বলে। কিছু পয়সা আসলে আমার মায়ের দুপুরের খাওয়াটা হয়ে যাবে। সাদা গাড়িটার জানালায় ঠোকা দিতেই এক মধ্য বয়সী পুরুষ কোঁচকানো ভুরু আর ভেটকে থাকা ঠোঁটজোড়ায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কী চাই?” আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি পেছনে দাঁড়ানো নীল গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। হঠাৎ সেই গাড়ির দরজা খুলে গেলো, ভিতর থেকে উঁকি দিল একটি কালো চশমা পরা একটি সুন্দর মহিলার মুখ। আমার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বললো, “এদিকে আয়, সব গোলাপ আমি নেবো।” আমি সানন্দে এগিয়ে যেতেই সজোরে আমার হাতটা টেনে গাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে নিল। হতভম্ব,বিস্মিত, ভয়ার্ত আমি চিৎকার করার সময়টুকু পাইনি। কিসের একটা মিষ্টি গন্ধে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। পরে নিজেকে পেলাম একটি অপরিচ্ছন্ন ঘরে। পরে সেই ঘর থেকে নিয়ে গিয়ে বিরাট বড় বাড়িতে রেখে দিলো। তারপর যত দিন যেতে থাকলো আমাকে ওরা নাচ, গান, পড়াশোনায় পারদর্শী করে তুলতে থাকলো। অবশ্য পড়াশোনার থেকে নাচ-গানের উপরেই জোর দিতো বেশি। ষোলো বছর পেরোনোর পর আমাকে বোঝানো হলো – করলাম আমি নিজেই আমার দেহের বিক্রেতা, যার জন্য পেতে লাগলাম অনেক অনেক টাকা। আর আজ আমি নিজেই একটি গাড়ির মালকিন। আজ আমার টাকা পয়সার কোন অভাব নেই। আজ এখানে আমি একটা সিগন্যাল পাবার অপেক্ষায় আছি, একটা গ্রীন সিগন্যালের আশায়…

হঠাৎ গাড়ির জানালায় আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি একটি হতদরিদ্র মুখ, চুল উস্কোখুস্কো, হাতে এক গোছা গোলাপ। জানলার কাঁচ নামাতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর,” দিদি গোলাপ নেবে? নাও না খুব ভালো গোলাপ।” গাড়ির দরজা খুলে মেয়েটির হাতটা ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে হাতে দিলাম দুইহাজার টাকার একটি নোট, নিয়ে নিলাম তার সব গোলাপগুলো। তার হাতে ভালো থাকার চাবিকাঠি তুলে দিতে পারলাম কিনা জানিনা, তবে তাকে কিছুদিনের জন্য হলেও নরকের দরজা থেকে দূরে রাখতে পারলাম সেটাই শান্তির। এইরকম অনেক চাবির দরকার আজ আমার।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

8 thoughts on “micro-story-signal

  1. খুব সুন্দর লাগলো দিদি, অসাধারণ জাস্ট❤️

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *