micro-story-status

স্ট্যাটাস
রম্যাণী গোস্বামী


আসামের নির্জন জঙ্গলে বেড়াতে এসেছেন করবী। সঙ্গে রয়েছে দুই মেয়ে-জামাই, ছেলে-ছেলের বৌ এবং তিন নাতি-নাতনি। বেড়ানো নয়, পুজোর ছুটিটা সকলের একসঙ্গে কাটানোই উদ্দেশ্য। মেয়েদের দূরে দূরে বিয়ে হয়েছে। একজন থাকে নাগপুরে, অন্যজন ভুবনেশ্বরে। ছেলেও কর্মসূত্রে বাইরে। দুর্গাপুর। এখনও শারীরিকভাবে শক্তসমর্থ আছেন করবী। কোচবিহারে নিজের বাড়িতে স্বামীর স্মৃতি আগলে, ঘর সাজিয়ে, বাগান করে, সকাল বিকেল খোলা বাঁধরাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে দিব্যি কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। ছেলের হাজার অনুরোধেও তার কাছে গিয়ে থাকেন নি। কাজকর্মের জন্য লোক রাখা আছে। তবুও নাতি নাতনিরা এলে উৎসাহ উদ্দীপনা তুঙ্গে ওঠে করবীর। স্পেশাল চার-পাঁচখানা নিজস্ব দিশী পদ রোজ বানাবেনই তিনি। আর সবাই সেগুলো তারিয়ে তারিয়ে খাবেও। তাঁর হাতের পুঁই অথবা চালকুমড়ো পাতার ভিতরে সর্ষেবাটা মাখিয়ে বেসন দিয়ে ভাজা, রসুন দিয়ে ডিমঝাল, তিল বেগুন, খইয়ের বড়া, কাঁঠাল বিচির পান্তুয়া… এসব কোনও ফাইভ-স্টার রেস্তোরাঁতেও মিলবে না খুঁজলে।

সেই কারণেই হয়ত বেড়াতে টেরাতে এলে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে ওঁর। কাজকম্ম নেই। কী করবেন? রিসোর্টে হাঁক পাড়া মাত্র কটেজগুলোতে পৌঁছে যাচ্ছে কেটলি কেটলি চা, পনীর পকোড়া, কফি, চিকেন ললিপপ। ফোনেই দেওয়া হচ্ছে লাঞ্চ অথবা ডিনারের অর্ডার। বিশাল সুসজ্জিত ডাইনিং রুমে সময় হলে চলে যাও। সাফারি ইত্যাদি বিকেলের মধ্যেই শেষ। সন্ধের পর থেকে সত্যিই কিছু করার নেই। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। নিজেদের জগতে ব্যস্ত। তাদের দোষ দেওয়া যায় না। বাবারা একটা বারান্দা দখল করে সোনালি তরলের আসর সাজিয়ে বসে আছে। মায়েরা ব্যস্ত ফোনে অথবা সিরিয়ালে। আর বাচ্চাগুলো? অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেন শুধু করবী। প্রত্যেকে নিজের নিজের গ্যাজেটে মুখ থুবড়ি খেয়ে বসা! ট্যাব, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ অভাব নেই তো কিছুরই। আরে! তাহলে আর একসঙ্গে বেড়াতে আসা কেন বাপু? করবীর মাথাতে এটা কিছুতেই ঢোকে না। এই নিয়ে বলতে গিয়ে আজ মৃদু বকাও খেয়েছেন ছেলের কাছে।

আহ্‌, সারাদিন তো একসঙ্গে ঘুরলাম। কী বীভৎস চাপে থাকি সারাবছর জানও তুমি মা, বেড়াতে এসে সন্ধেটা প্লিজ একটু রিলাক্স করতে দাও। আর ডিনার টাইমে তো মিট করছিই। তিয়াস… যাও, ঠামির ঘরে গিয়ে বসও। সায়নকেও ডেকে নাও। আর জুডো কোথায় গেল? গেল কোথায় দুষ্টুটা? উফ্‌, ভাইটাকে তোরা একা একা ছেড়ে দিয়েছিস? এবার জোর ধমক।

বাবার কাছে অকারণে বকা খেয়ে তিয়াসের ঠোঁট ফুলে ওঠে। মুঠোফোন আঁকড়ে ধরে লম্বা লম্বা পায়ে ঠামির কটেজে ঢুকে সে ধপ করে বসে পড়ে সোফার উপরে। স্ক্রিনের উপরে ঝুঁকে গলায় উষ্মা মিশিয়ে বলে, হু, দাদাভাইয়ের আসতে বয়ে গেছে। ও এখন খুবসে ফ্রি-ফায়ার খেলছে ট্যাবে।

আর জুডো? সবচাইতে ছোট নাতির খোঁজ করেন করবী।

জুডো মোবাইলের জন্য ওর মায়ের কাছে ভীষণ জেদ করছিল। তানিয়াপিসি দিয়েছে কষে এক চড়…! এখন কোথায় লুকিয়ে বসে কাঁদছে দেখো।

সেকী! ব্যথায় মুচড়ে ওঠে অসহায় করবীর অন্তস্থল। গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ান বারান্দায়। সন্ধে পেরিয়ে রাত নামছে। গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে আজ। রিসোর্টের সীমা পেরিয়ে দেখা যায় বহুদূর প্রসারিত অ্যালুভিয়াল গ্রাসল্যান্ড। ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়েছিলেন। এক মানুষ সমান উঁচু হাতিঘাসে ভরা প্রশস্ত তৃণভূমি। পূর্ণিমার চাঁদ অতি দরদ মিশিয়ে নরম আলো ফেলেছে তার উপরে। বাতাসে দুলছে ঘাসজমি। অপূর্ব মায়াভরা সেই দৃশ্য!

করবীর চোখে ভেসে ওঠে ছোটবেলার এক অনুপম ছবি। বাড়ির সকলে মিলে ঘাটশিলায় বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। বাবা, কাকারা, ভাই বোনেরা। নদী লাগোয়া খুব সাদামাটা হোটেল। এত লাক্সারি ছিল না জীবনে। প্রয়োজনও ছিল না। তা সেদিনও ছিল পূর্ণিমা। সারাদিন বেরিয়ে ফিরে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে সফেদ বালুচরে বাড়ির সকল সদস্যরা মিলে বসা হয়েছে মাদুর পেতে। সঙ্গে ফ্লাস্কে গরম চা। কাগজের ঠোঙায় পেঁয়াজি- মুড়িভাজা। চাঁদের আলো পড়ে রুপালি জড়ির মত ঝকঝক করছে নদীর বুক। অনেকক্ষণ হাসিঠাট্টা গল্পগাছার পর কাকিমা ধরলেন অতুলপ্রসাদী – ‘একা মোর গানের তরী’। করবীর গানের তালিম ওঁর কাছেই। বিয়ের পর থেকে আর চর্চা নেই।

অপূর্ব সুরেলা সেই সঙ্গীত অতীতের ঢেউ ভেঙে আজ কানে ভেসে এল যেন। ছটফট করে ওঠেন করবী। ব্যাগ খুলে বের করেন দামী স্মার্টফোন। ছেলে দিয়েছিল গতবছর। নাতনির দিকে এগিয়ে দিয়ে লাজুক হেসে বলেন, তোরা সারাক্ষণ কী যেন দিস না ফোনে? ওহ, হ্যাঁ, স্ট্যাটাস। আমারটাতে দিয়ে দিবি একটু? নে, ওই চাঁদের দিকে ফোকাস করে ভিডিও কর।

তিয়াস ভিডিও করছে আর হাঁ করে শুনছে – পূর্ণিমা রাতের আবহে তার ঠামির মিষ্টি কণ্ঠের গান। তার জীবনে এমনটা এই প্রথমবার!

উফ্‌, ঠামি, সুপার্ব! হোয়াটসঅ্যাপে তোমার এই স্ট্যাটাস দেখে এখনই সবাই ছুটে আসবে এখানে। ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ! কোনওমতে স্ট্যাটাসটা আপলোড করেই তিয়াস ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তার ঠামি’কে। কী মিষ্টি পান জর্দার গন্ধ ঠামির গায়ে!

আহা, সত্যিই যদি তাই হয়। এখনও কি ফিরিয়ে আনা যায় না অতীতের মায়াবী সেই দিনগুলো? নাতনিকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলেন করবী। তাঁর দু’চোখে চিকচিক করে উঠল সুবর্ণরেখার রুপালি আলো।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *