micro-story-suicide

সুইসাইড
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


“পরশু মরেছি আমি। লাইনে মাথা দিয়েছিলাম। আসলে এত চাপ আর নিতে পারিনি। বাড়িতে অসুস্থ বাবা, তার ওষুধপত্রের খরচ, ছেলের স্কুলের খরচা, সংসারের হাল টানা — এইসব আর নিতে পারলাম না। তুমি ?”

ডানদিকের বেডের লোকটা তাকাল বাদলের দিকে। বাদল কী বলবে বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। কী বলছে লোকটা? তার মানে কি লোকটা আর বেঁচে নেই? তাহলে এইভাবে কথা বলছে কী করে? লোকটা কি পাগল নাকি?

আর বাদলকেই বা জিজ্ঞেস করছে কেন? সে কি ভাবছে বাদলও মরে গেছে? হাঃ হাঃ হাঃ। এ তো বড়ো মজার ব্যাপার। কী বলবে বাদল? কীভাবে বোঝাবে লোকটাকে? সে উল্টোদিকে তাকাল। বাঁ দিকের বেডেও আর একটা লোক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। সেই লোকটাও পাশ ফিরে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে।

বাদল কিছু বলছে না দেখে এবার সে নিজেই বলে উঠল, “আরে আমারও তো প্রায় একই ব্যাপার। সংসারে নিত্যদিনের অশান্তি আর ভালো লাগছিল না। প্রায় দশ বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু বিয়ের পর থেকে একদিনের জন্যেও সুখ পাইনি। রোজই বউয়ের সঙ্গে খিটিমিটি। তাই শেষ পর্যন্ত তিতিবিরক্ত হয়ে একসঙ্গে দু পাতা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নিলাম। ব্যস, এখন নিশ্চিন্তি। আর তুমি?”

বাদলের মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। বলে কী এরা? তার মানে এখানে কি সবাই মৃত মানুষ নাকি? এই নার্সিং হোমের এই ওয়ার্ডের এদিক ওদিক দুদিকে, এই যে আটটা আটটা ষোলটা বেড, এখানে শুয়ে থাকা সবাই মরে গেছে? আর মরে গিয়েও দিব্যি কথা বলছে? আর আশ্চর্য ব্যাপার, বাদলও তা শুনতে পাচ্ছে? কী করে তা হয়? তাহলে কি বাদল নিজেও …

তার মানে কি এটা নার্সিং হোমই নয়? এটা কি মর্গ নাকি? কী আশ্চর্য, কী সব আজগুবি ব্যাপার ভাবছে বাদল। তা আবার হয় নাকি?

হ্যাঁ এটা সত্যি যে, বেঁচে থাকার সব আশা ভরসা শেষ হয়ে যাবার উপক্রম হতে বাদল নিজেও আজ সন্ধেবেলা মরার চেষ্টা করেছিল। একলা ঘরে পাখার ব্লেডে মোটা একটা দড়ি বেঁধে তাতে ঝুলে পড়েছিল, আর পড়বার আগে পায়ের তলা থেকে লাথি মেরে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল বসার টুলটা।

কিন্তু তা সত্ত্বেও বাদল তো মরেনি! মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই যখন গলার শিরা ফুলে গিয়ে চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসবার উপক্রম হয়েছিল, তখনই দরজায় পরের পর ধাক্কা পড়েছিল। তাতে সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়েছিল ওর ছোট বোন আর পাশের বাড়ির হারুদা। তারপর মিনিট খানেকের মধ্যেই যখন ওরা বাদলকে ধরাধরি করে নামিয়ে এনেছিল, ততক্ষণে বাদল এলিয়ে পড়েছে। চোখের সামনে সব অন্ধকার। তবু তার মধ্যেও সে শুনতে পেয়েছিল, “অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সে খবর দাও। এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

কে বলছিল কথাটা? হারুদা? নিশ্চয়ই তাই। কারণ তার পাশাপাশি বাদল শুনতে পেয়েছিল ওর বোন শর্মিলার আর্তনাদ, “এ কী সব্বোনাশ করলি তুই দাদা? কেন করলি?”

ব্যস, এর পরেই বাদলের চেতনা পুরোপুরি লোপ পেয়েছিল। সেই জ্ঞান যখন ওর ফিরেছিল, বাদল দেখেছিল ও এই নার্সিং হোমের বেডে। ওকে ঘিরে একজন ডাক্তার আর দুজন নার্স। না, কোনও চেনা লোকের দেখা ও তখন পায়নি। সেটা পেয়েছিল কয়েক ঘন্টা পর। তার আগে কীসব ওষুধ আর ইঞ্জেকশান ওকে দেওয়া হয়েছিল। আবার ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতে বেশ ফ্রেশ লাগছিল নিজেকে। তখনই ওর মা আর বোনকে ও দেখতে পেয়েছিল বেডের পাশে। তাদের সঙ্গে কথাও বলেছিল। তাহলে? তার মানে তো ও বেঁচেই আছে। তাহলে এরকম কেন মনে হচ্ছে?

বাদল আবার তাকায় পাশের দিকে। লোকটা তখনও বাদলের জবাব শোনবার আশায় ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দেখে এবার বাদল ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “কী আশ্চর্য! আপনারা কি পাগল নাকি? নিজেরা মরে গেছেন ভাবছেন, আর আমাকেও মেরে ফেলতে চাইছেন? নার্স, নার্স, ডাক্তার … কে আছেন?”

“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। কাকে ডাকছ? কেউ আসবে না। ঘড়িতে কটা বাজে জানো?”

বাদল উল্টোদিকের দেয়ালে টাঙানো দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে দুটো বাজে। তার মানে কি রাত দুটো? তাহলে তো সত্যি কেউ আসবে না। কিন্তু এইরকম দুপাশে দুই মাথাখারাপ লোককে নিয়ে থাকাও তো মুশকিল। বাদল অসহায়ের মতো এদিক ওদিক দেখে। অন্য বেডগুলোয় সাদা চাদর মুড়ি দেওয়া লোকগুলো ঘুমোচ্ছে।

সত্যিই ঘুমোচ্ছে, নাকি ওরা সবাই মরে গেছে? সকলেই কি লাশ?

এবার বাদলের ভয় ভয় করে। সেইসঙ্গে মনের ভেতর একটা জোর পায় ও। ওকে পালাতে হবে। এই মৃত জগৎ থেকে পালাতে হবে ওকে। ও কিছুতেই মরবে না। একবার ক্ষণিকের দুর্বলতায়, জীবনের অক্ষমতায় ও মরার কথা ভেবেছিল ঠিকই, কিন্তু তারপর, এইভাবে বেঁচে ওঠার পর, বাড়ির লোকেদের আবার পাশে পেয়ে ও মরার কথা আর মনে করতে চায় না। কিন্তু ওর এই দুপাশের লোক দুটো? ওরা যে মরার কথা বলছে! ওকে কি ওরা টেনে নিয়ে যেতে চায় ওদের সঙ্গে? ওকেও কি মেরে ফেলতে চায় ওরা?

বাদল ওর ডানপাশের বেডটার দিকে তাকায়। কী আশ্চর্য! বেডটা তো ফাঁকা! চকিতে বাঁদিকে ঘুরে বাদল দেখে, না, কেউ নেই। ওর বাঁদিকের বেডটাও বিলকুল ফাঁকা। পরিপাটি করে সাজানো ফাঁকা বিছানা।

বাদল আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *