শুক্রাচার্য

শুক্রাচার্য
বৈশাখী ঠাকুর
আজকাল মাথাটা কেমন ধরে তাকে আহিরির। আলো আবছায়াতে কেমন যেন তার অতীত বর্তমান গুলিয়ে যায়। ফিরদৌসের সাথে কাটানো দিনগুলো আর প্রোফেসারের সাথে এখনকার জীবন যেন কাটাকুটি খেলে যায় তার মনে।
কি অদ্ভুত ভাবে পুরনো দিনের কথা সব ফিরে আসে। ফিরদৌসের প্রেমে আহিরিই পরেছিল। সেই কলেজ থেকে তাঁদের পরিচয়। প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছিল দুজনেই। ভিন জাতির হওয়ার দরুন কেউ সাহস পেত না প্রকাশ করার। নিখাদ বন্ধুত্বই —এর বেশী কিছু নয় –এমনটাই বোঝাতে চেয়েছে দুনিয়াকে। কিন্তু কলেজ শেষের দিকে একদিন ফিরদৌস তাকে টেনে ধরে ক্যানটীনে বুঝিয়েছিল— বাইরে পালাতে হবে। স্পন্সরশিপ জুটিয়ে বাইরে পড়াশোনা করে সেটেল করলে তবেই তাঁরা একসাথে থাকার ছাড়পত্র পাবে। প্রেম একটা পরিণতির দিকে এগোবে নতুবা নয়।
ফিরদৌস গ্র্যাজুয়েশানের পরই পাড়ি দিল জার্মানিতে। বছর দুয়েক আহিরিও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করল। অতঃপর ফিরদৌস যার কাছে রিসার্চ করছিল, প্রফেসরের মিলারের আন্ডারেই রিসার্চের ব্যবস্থা করে দিল আহিরির।
তারপরই শুরু হল তাদের স্বপ্নের জীবন। ইন্ডিয়া ছেড়ে না এলে একসাথে এইভাবে লিভ ইন করতে পারত কি! যা জীবনে ভাবেনি তাই বাস্তবায়িত হল। ভেসে গেল দুজনে। সহবাসের কত মুহূর্ত –কত হাসি মজা –ঠাট্টা — কত খুনসুটি –কত মান –অভিমান —সেই সব কেমন কোলাজের মত ভেসে ওঠে। নাঃ তাতে অবশ্য প্রফেসর মিলার রাগ করেন না। বরঞ্চ শুনতে চান। বলেন,
—- বল বল আহিরি বল তোমাদের সেই সুন্দর যাপনের দিনগুলোর কথা বল। আহিরি না চাইলেও তিনি অনুরোধ করেন বারংবার। প্রথম প্রথম একটু আশ্চর্যই হত। তারপর এড়িয়ে যেত। তিনি হেসে বলতেন, —–আসলে তোমাদের দুজনকে দেখে একদম পারফেক্ট কাপল মনে হয়। দুজনেই তোমরা এত ব্রিলিয়ান্ট—এত সফল। ফিরদৌসের তো কথাই নেই। ও যেভাবে গবেষণা করছে ওর পেপার নিয়ে – ব্রেন ডেথ আর ব্রেন ম্যাপিং এর এক অন্যন্য জগত খুলে যাবে ওর আবিষ্কারে। তুমি দেখে নিও। মানুষ অমর হবে।
সেদিন ভালবাসাবাসির সময় আহিরি শুনতে চেয়েছিল ফিরদৌসের কাছে। তার মস্তিষ্কও যথেষ্ট উর্বর। ফিরদৌস সরল সহজ ভাষায় যা বুঝিয়েছিল তা তার ধরতে অসুবিধে হয়নি। সব শুনে তার শরীরে শিহরণ খেলে গেছিল। বিজ্ঞানের কি বিশাল অগ্রগতি হবে এই গবেষণার ফলে! এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। ভীষণ গর্ব হয় ফিরদৌসের জন্য।
একপরই একদিন ফিরদৌস আচমকা নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। মানসিক চাপে নাকি দুঃখে আহিরির মাথাটাও কেমন খারাপ হতে বসল। সর্বক্ষণই যেন সেই অতীত দিনের কথা তার মনে পরে। রোজ একটু একটু করে সে স্মৃতি রোমন্থন করে। ঘুমোয়। খুব অল্প সময়ের জন্য। উঠে প্রাতাহ্যিক কাজ সারে। আবার কেমন এক ঘোরে ঢুলে পরে। প্রোফেসার তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে না রাখলে যে কি হত! সেদিন বেশ গভীর রাতে তার ঘুমটা কিরকম পাতলা হয়ে এল। সে উঠে বসতেই প্রোফেসার তার দিকে ওষুধটা বাড়িয়ে দিলেন। উনি চিকিৎসা করে সামলেসুমলে রাখছেন আহিরিকে এই দুঃসময়ে। তারপর ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে আহিরি ভাবল বাথরুম ঘুরে এসে ওষুধটা খাবে। সে উঠে বাথরুমে যেতে গিয়ে প্রোফেসারের ঘরে আলো দেখল। একটু উঁকি মেরে দেখতেই দেখল কার এক ব্রেনের ম্যাপিং নিয়ে স্ক্রিনে ফেলে সিনেমার মত দেখার চেষ্টা করছে সেই ব্যাক্তির মাথায় কি চলছিল। ফিরদৌসের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছিল এবং সে নিজেও বিজ্ঞানের ছাত্রী হওয়ার দরুন বুঝতে পারছিল প্রোফেসারের স্ক্রিনে তার ব্রেনের ম্যাপিং। গায়ে কাঁটা দিল তার।
রাতে আর ওষুধটা খেল না আহিরি। প্রোফেসারের জন্যে ঢাকা জলের গ্লাসে ঢেলে দিল। গুলে গেল নিমেষে। ভোর রাতে উঠে প্রোফেসারের ব্রেন ম্যাপিং করে স্ক্রিনে ফেলল আহিরি। ফিরদৌসের কথা অনুযায়ী সে নির্দিষ্ট ডেটে ফেলার কায়দাটা জানত। প্রোফেসার সেটা জানতেন না। তাই শুরু থেকে আহিরির ব্রেন ম্যাপিং চলছিল। আহিরি ফিরদৌসের নিরুদ্দেশের দিন নির্ধারিত করল। বহু দৃশ্যাবলীর পরে অবশেষে ফিরদৌসকে পেল। বিরাট বাদানুবাদ চলছে। তারপর আচমকাই ঘাড়ের কাছে একটা ইঞ্জেকশান। অজ্ঞান ফিরদৌসকে হিমশীতল ঘোরে ঢোকাল প্রোফেসার।
ব্রেন ডেথ থেকেও মানুষকে ফিরিয়ে আনা যায়। জানে আহিরি। বলেছিল ফিরদৌস যে। মেমারির রিসেট বাটানটা টিপে দিল আহিরি। এক গভীর ঘুম থেকে উঠল যেন ফিরদৌস। এক নতুন সকাল দেখল। কতদিন ঘুমিয়েছিল কে জানে! আহিরিকে জড়িয়ে অশ্লেষে চুমু খেল।

2 thoughts on “শুক্রাচার্য

  1. অসাধারণ , অনবদ্য ।।
    মস্তিষ্কপ্রসূত বিজ্ঞান আর অমোঘ ভালোবাসার মেলবন্ধনে এক অপূর্ব অণু গল্প ।। ভালো লাগলো ।।

Leave a Reply to Baishakhi Thakur Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *