সুমিত্রার কলম
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
‘সুমিত্রা মনোজের ঘর থেকে বেরিয়ে বেড়ালের মতো নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। অসীম ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরেছিল যখন, মনে হয়েছিল পাশটা খালি, সুমিত্রা নেই…’ এটুকু লেখার পরই পেনের কালি শেষ। বিরক্ত হন জয়ন্ত। এতগুলো ম্যাগাজিনে লিখতে হচ্ছে বলে দ্রুত কালি শেষ হচ্ছে এই ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ পেনগুলোর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত দেখেন, রাত একটা সাত। কালই গোটা কুড়ি পেন কিনে আনতে হবে। সব কটা পেন দিয়ে কাগজে আঁচড় কাটতে কাটতে গজগজ করেন জয়ন্ত। জয়ন্ত গাঙ্গুলি, এসময়কার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত লেখক। আসন্ন পুজো উপলক্ষে হেন একটা শারদ সংখ্যা নেই, যেখানে ওঁর লেখা নেই। একটাই দুঃখজনক ঘটনা, সেটা হল সুমিত্রা, ওঁর স্ত্রী, বছরখানেক আগে হঠাৎই ঘুমের মধ্যে ইহলোক ছেড়ে চলে যান। ম্যাসিভ কার্ডিয়াক ইনফার্কশন। সেই শক থেকে বেরোতে আরো বেশি করে লেখায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছেন জয়ন্ত।
স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাবশত বড়দের সব লেখার প্রধান চরিত্রের নাম সুমিত্রা রাখেন। অন্যান্য অনেক লেখকই ব্যাপারটা নিয়ে ব্যঙ্গ করেন। কেউ কেউ আবার গল্পের ঘটনাকে সত্যি ধরে নিয়ে সুমিত্রার চরিত্র সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করে। বিচিত্র মানসিকতার মানুষের তো অভাব নেই!
সুমিত্রাও ইদানীং বিজ্ঞানভিত্তিক ছোটদের লেখা লিখে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। মাত্র দু-তিন বছরে নাম ছড়িয়েছিল বেশ অনেকটাই। অঘটন ঘটে যাওয়ায় সকলেই ব্যথিত।
“আরো ঘন্টাখানেক অন্তত লেখা যেত যদি একখানা পেন পাওয়া যেত। ক্লাইম্যক্সে এসে বাধা পেলে সেই রোমাঞ্চটা পরে আনা মুশকিল হয়।” বিড়বিড় করেন জয়ন্ত। চিন্তা করতে করতে হঠাৎ মাথায় আসে সুমিত্রার কলমের কথা। সুমিত্রা পেন কে বলতেন কলম। পেন বললে ওঁর পেইন অর্থাৎ ‘ব্যথা’ মনে হত, তাই কলম বলতেন। সেই কলম কি চালু আছে?
দেরাজ থেকে সেই কলম বের করে এনে কাগজে আঁচড় কাটতেই উজ্জ্বল কালির দাগ পড়ে। চকচক করে ওঠে জয়ন্তর মুখ। যাক্, লেখাটা অনেকটাই এগোবে তাহলে। লিখতে শুরু করেন জয়ন্ত।
‘তুমি জানতে যে আমার আইবুপ্রোফেন সহ্য হয়না, তাও সামান্য মাথাব্যথা, কোমর ব্যথা করছে বললেই তুমি আমাকে আইবুপ্রোফেন দিতে। বলতে, এটা নতুন ওষুধ, খুব ভালো কাজ হয়।’ চমকে ওঠেন জয়ন্ত।
‘আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলাম তোমাকে। ভেবেছিলাম, সন্তান তো নেই আমাদের, একে অপরকে আঁকড়েই বাঁচব। কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না। কী ক্ষতি করেছিলাম তোমার? আমার নাম যশকে ভয় পাচ্ছিলে তুমি? ভাবছিলে, তোমার থেকে বেশি খ্যাতি পেয়ে যাব? তোমার পঁচিশ বছরের লেখক জীবনের থ্রেট হয়ে যাচ্ছিলাম?’
‘তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও, আমার কলম তা করবে না। পেইন দেবে.. .যেদিন সুযোগ পাবে… শেষ করে দেবে তোমাকে…’। লিখে চলে কলম।
সাংঘাতিক, তার সাথে এক চূড়ান্ত নগ্ন সত্য।