micro-story-tarikhera-theke-jai

তারিখেরা থেকে যায়
দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়


মা, তোমার হলো? আমার আর সময় নেই কিন্তু! এরপর ওই বুড়োর বাড়িতে বেল বাজিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতে হবে হাঁ করে। তার তো নড়েচড়ে উঠে এসে দরজা খুলতেই বেলা বয়ে যায়!”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি বোলাতে বোলাতে বলল তিন্নি। ওরা থাকে নয়াবাদে। তিন্নির অফিস এলগিন রোডে। তার মা অনিতা স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। অবসর নিয়েছেন বছর চারেক। শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁর আরেকটি গুণের সুখ্যাতি আছে। অনিতার রান্নার হাত দুর্দান্ত। অবসরের পর ছোট করে একটা রান্নার হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেটা রমরমিয়ে চলছে। আগে কাছেপিঠের কিছু বাড়ি থেকে অর্ডার আসত, এখন ঢাকুরিয়া, যোধপুর পার্ক, সাদার্ন এভিনিউতেও নিয়মিত খাবার যায় তাঁর হেঁশেল থেকে। একটি ছেলে রোজ দুবেলা অনিতার কাছ থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো নিয়ে ডেলিভারি করতে যায়। মাসখানেক আগে পঞ্চসায়র থেকে এক ভদ্রলোক যোগাযোগ করেছিলেন। এখানে নতুন এসেছেন ওঁরা। ভদ্রলোকের বাবা এখানে একা থাকেন। তাঁর জন্য দু’বেলা খাবারের প্রয়োজন ছিল। এই বাড়িতে লাঞ্চটা তিন্নি ডেলিভারি করে প্রতিদিন। পঞ্চসায়রে খাবার দিয়ে কবি সুভাষ স্টেশন থেকে মেট্রো ধরে সে চলে যায় অফিস।

ছ’টা সাদা কন্টেনার একটা প্যাকেটে ভরে ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখলেন অনিতা। তিন্নি চিলের মতো ছোঁ মেরে সেটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ কী মনে হতে সে প্যাকেটটা নেড়েচেড়ে বলল,

“এত কিছু কী দিয়েছ মা? বেশি ভারি ভারি লাগছে!”

অনিতা মেয়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। রান্নাঘরে চলে গেলেন অন্যান্য খদ্দেরদের জন্য খাবার গোছাতে।

********

অলোকেন্দুর বরাবরই সকাল সকাল লাঞ্চ সেরে নেওয়া অভ্যেস। সাধারণ মানুষ যে সময় ভাত খেতে বসে, সেই সময় তিনি চুমুক দেন লেবু চায়ে। আজও নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই, সে যতই আজকের তারিখটা বিশেষ হোক। ছেলে তার বৌ আর মেয়েকে নিয়ে রাত্রে আসবে। রোজকার নিয়ম মেনে ঠিক এগারোটার সময় প্যাকেট থেকে কন্টেনারগুলো নামিয়ে একে একে খুলতে শুরু করলেন তিনি। এবং প্রতিটা ঢাকনা খুলেই চমকে চমকে উঠলেন। শেষ কন্টেনারটির ভিতরে জিপার প্যাকে ভরা ছিল একটা পান। কিন্তু সেটা পেরিয়ে অলোকেন্দুর চোখ গিয়ে পড়ল নিচে ভাঁজ করে রাখা একটা সাদা কাগজে।

সেটা বের করে ভাঁজ খুলতেই দেখা গেল তাতে লেখা আছে…

“সন্দেহটা হয়েছিল প্রথম দিনই যখন তোমার ছেলে বলেছিল তার বাবার খাওয়ার সময়টা একটু বিচিত্র। যেদিন আমার মেয়ে বলল পঞ্চসায়রের বুড়ো ভদ্রলোক তাকে কথায় কথায় জানিয়েছেন তিনি দুপুরে স্রেফ লেবু চা খান, সেদিনই বুঝেছিলাম আমার সন্দেহ ভুল নয়। তার কাছে তোমার চেহারার বর্ণনা শুনে আবার ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কৌতূহলটা সংবরন করতে পারিনি। ছেলে ফোনে ঠিকানা পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাতে তোমার নাম ছিল না। একদিন বিকেলে পৌঁছে গিয়েছিলাম তোমার বাড়ির কাছে। ঠিক সেই সময়ই তুমি রিক্সা থেকে নামছিলে। আমি আর দাঁড়াইনি। তোমার জন্য আমার অপেক্ষা না করার ট্র‍্যাডিশনটা বজায় রয়েই গেল।

যাক সে কথা! মানুষ চলে গেলেও তারিখেরা থেকে যায় স্মৃতি উস্কে দেওয়ার জন্য। আজকের তারিখ জীবদ্দশায় ভোলা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। তোমার অভ্যেস, পছন্দ অপছন্দগুলোও ভুলতে পারিনি। কাজু দেওয়া বাসন্তী পোলাও, ঝুরঝুরে কিমা কষা, সর্ষে দিয়ে ভাঁপা চিংড়ি, ফুলকপির রোস্ট, কাঁচা আমের শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া চাটনি আর মিষ্টি পান পাঠালাম। একটু মিলিয়ে দেখো তো! কিছু কি বাদ পড়ল? শুভ জন্মদিন! ভাল থেকো, সুস্থ থেকো।”

বারোটা নাগাদ অনিতার মোবাইল বেজে উঠল। ওপারে তিন্নি অসম্ভব উত্তেজিত! সে বলছে,

“মা, পঞ্চসায়রের বুড়ো ফোন করেছিল এইমাত্র, জানো? বলছে ‘মা’কে বোলো আগের মতো আর ঝাল খেতে পারি না। বাকি সব ঠিক ছিল!’ মা, কেসটা কী বলো তো?”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “micro-story-tarikhera-theke-jai

  1. দেবাঞ্জন বাবু, আপনার গল্প টি পড়লাম, একদম ঠিক বলেছেন, তারিখেরা থেকে যায় স্মৃতি উসকে দেওয়ার জন্য, ভালো ও খারাপ স্মৃতি, আমার ও কত তারিখের কথা মনে পড়ে গেল, খুব সুন্দর হয়েছে আপনার গল্প টি,?

  2. তারিখেরা শুধু থেকেই যায় না, তাড়িয়ে নিয়ে যায় সেই কোন দূর সময়ের অলিন্দে, যেখানে সহায় সম্বলহীন সম্পর্কের নামগোত্রহীন চারাগাছগুলোর বয়স বাড়ে না। অথচ কী অবলীলায় লেগে থাকে ক্ষয়ে যাওয়া শিলার ফাটলে।
    একটা অনবদ্য অনুভূতিতে জড়িয়ে দিলে তোমার লেখার মাধ্যমে। আবেশটা থাক।

    ধন্যবাদ নিও। আরও লিখো।

Leave a Reply to Parikshit Manna Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *