মানসী গাঙ্গুলী
১০ বছরের বড় দাদা রমেন ছোটভাই সৌমেনের গালে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিলেন মুখে মুখে তক্কো করছিল বলে। সামনে ছিল সৌমেনের তিনমাস আগে বিয়ে করা নতুন বউ। এমন চড় থাপ্পড় আগেও খেয়েছে সৌমেন দাদার হাতে কিন্তু তাই বলে নতুন বউয়ের সামনে? এতে তার সম্মানহানি হল। রাতারাতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বউ নিয়ে। ছোট থেকেই বাবা নেই, মা নেই, একমাত্র দাদা-ই তার আপনজন, বাবার মত। একমাত্র বৌদি, মায়ের মত, পথ আগলে আটকাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হারিয়ে গেল সৌমেন নিঃসন্তান দাদা-বৌদির জীবন থেকে। সৌমেন ছোট ভাই হলেও সে ছিল দাদার সন্তানের মত। মনবেদনায় দাদা কাতর, বৌদিও ততোধিক। ক্রমে মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়াই হল শ্রেষ্ঠ পন্থা। মনের দূরত্ব এতটাই বেড়ে গেল যে দাদার খোঁজ নেওয়ার কথাও মনে এল না তার। দাদা বলে যে একজন কেউ আছে তা-ও যেন তার মনে থাকল না। জল গড়াতে গড়াতে কেটে গেল মাঝে ৫০টা বছর। সংসার, চাকরি করতে করতে সৌমেন ৮০তে পৌঁছালো। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে ভরা সংসার তার। কিন্তু আনন্দ নেই মনে। বৈরাগ্য এলো জীবনে। দাদাকে দেখার জন্য মন বড় অধীর হয়ে উঠল। তবে মনে তার সংশয় “কী জানি বেঁচে আছে কী-না।” আশা আশঙ্কার দোলায় দুলতে দুলতে বাড়ি গিয়ে পৌঁছায় সে। বাড়ি তখন ধ্বংসাবশেষ। ভাঙার কাজ চলছে। দাদা কোথায় জানে না সে। ৩০০ বছরের পুরনো জরাজীর্ণ বাড়িটি প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়েছেন দাদা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। চারিদিক থেকে খোঁজখবর করে প্রোমোটারের। অবশেষে সন্ধান পায়। তার বাড়ি পৌঁছে জানতে পারে প্রোমোটার বাড়ি ভাড়া করে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তার দাদাকে মাসছয়েক আগে। তার কাছেই জানতে পারে দাদার শারীরিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ ছিল। টিঁকে আছেন কিনা তার জানা নেই। সৌমেন হিসাব করে। দাদা তার ৯০ পেরিয়েছেন। মনে আশঙ্কা। “দাদাকে দেখতে পাবো তো?” সেখানে পৌঁছে দেখে এক ঝুঁকে পড়া থুত্থুড়ে বুড়ি, শনের মতো সাদা চুল। “এ তো আমার বৌদি নয়, কে ইনি?” “রমেনবাবু বাড়ি আছেন?” তার প্রশ্নে বৃদ্ধা মুখ ফিরিয়ে তাকালে সৌমেন দেখে ঠোঁটের ওপরে কালো আঁচিল। “বৌদিই তো”। শনের মতো চুলের মাঝে লাল সিঁদুরের রেখা। ধড়ে প্রাণ আসে সৌমেনের। ছুট্টে গিয়ে বুড়ির পায়ে একটা পেন্নাম ঠুকে বুড়িকে জড়িয়ে ধরে। ঘর থেকে রমেনবাবু কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করেন, “কে ডাকলো আমার নাম ধরে?”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন