ব্রততী সেন দাস
আমি একটা কালো ছিট ছিট টিকটিকি।টিকটিকি সমাজে ব্রাত্য। ডালহৌসির একটা মার্চেন্টাইল অফিসে চার-পাঁচ পুরুষ ধরে আমার বাস। দিনের বেলা একটা টিউবলাইটের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকি, রাত্রে বের হই। সারা রাত আলমারি খাঁজখোঁজ থেকে অজস্র আরশোলা ফরফর করে ওড়ে, আমি তাদের তাক করে ধরি আর মুখে পুরি। কী পুরুষ্টু সেগুলো, তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসে!
এই অফিসে আমার মত আর একজন আছ, হেড ক্যাশিয়ার বড়ালবাবু। হ্যাঁ, দেখতে লোকটা মানুষের মত কিন্তু আসলে আমার ভায়রা ভাই, এক উন্নত জাতের সরীসৃপ। সারাদিন ভিজে বেড়ালের মত সুকসুক করে চায় যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানে না! অথচ লোকটা খুব চতুর, ওর ডান হাত কী করছে বাঁ হাত জানতে পারে না। দেওয়াল আঁকড়ে ওকে আমি মন দিয়ে লক্ষ্য করি। চোখে হাই পাওয়ারের মোটা ফ্রেমের চশমার মধ্যিখান দিয়ে ওর জ্বলজ্বলে নজর। নেশা বলতে ওর পান খাওয়া চারশো বিশ জর্দা দিয়ে। পান-খয়েরে রাঙানো মোটা ঠোঁটখানা জিভ দিয়ে ভিজিয়ে ও নরম আর চটচটে করে রাখে। দু হাতের আঙুলে আটটা আংটি, চার রকমের পাথর। মোটা আঙুলগুলো যখন থুতুতে ভিজিয়ে নোট গোনে তখন ওর টাকটা দেখি দিনের আলোয় চকচক করে, রূপোর মুদ্রার মত। মসৃণ আর ঢালু।
সন্তোষ স্যানালের সদ্য বিধবা স্বপ্না স্যানাল এলে বড়ালের জিভ চাটাটা আরো বেড়ে যায়। মৃত স্বামীর পি এফ, গ্র্যাচুয়িটি নিয়ে মহিলা প্রায় দিনই এই অফিসে চক্কর কাটছে, বাড়িতে বাতে পঙ্গু বুড়ি শাশুড়ি আর এক প্রতিবন্ধী মেয়ে আছে। বদ্ধ কেবিনে আমি দেখতে পাই বড়ালের থাবা অক্টোপাসের মত কেমন করে স্বপ্নার ওপর বিলি কাটে। ব্লাউসের ফাঁক, কোমরের খাঁজ, শাড়ির আড়ালে থাকা হাঁটুতে বড়ালের আঙুল রোদ-ছায়ার ঝিলিমিলি খেলা করে। স্বপ্না জলে পড়ে যাওয়া ডুবন্ত প্রাণীর মত হাঁকপাঁক করতে থাকে। আমি আরো দেখেছি প্রতিবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় স্বপ্না তার দোমড়ানো রুমালে চোখ মোছে।
সেদিনও বড়াল ঠোঁট চেটে বলল-আমি বড় সাহেবকে ফাইল পাঠিয়েছি, সময় লাগবে।
স্বপ্না ককিয়ে উঠল-আরো সময় লাগবে স্যার! আমার মেয়ের ওষুধ কেনার আছে, বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে আছে সাত মাস…
চোখের কোণা দিয়ে চেয়ে বলল-কাল দুপুরে একবার আসুন। আমি দেখব। আসলে বড়বাবু একটা খড়ুশ শালা, বলে বড়াল পানের পিক ফেলল জানালা দিয়ে।
আমি জানি মিথ্যে কথা। ও ফাইল আলমারির মাথায় রাখা রয়েছে, ওর ওপর আমার নাদি পড়ে আছে, এক চুলও সরায়নি বড়াল। আমি জানি ও টিকটিকি যেমন ভয় পায় তেমনই ঘেন্না করে। একবার আমি টাল সামলাতে না পেরে ওর টেবলের ওপর ছেতরে পড়েছিলাম। বড়াল চমকে উঠে ভয়ে, ঘেন্নায় ঘর ছেড়ে বারান্দায় উলটানো আরশোলার মত ছটফট করছিল। পরশু শনিবার, হাফ ডে। সেকেন্ড হাফে তো কেউ থাকবে না। তার মানে তারিয়ে তারিয়ে খাবে! আমিও দেখি কী করতে পারি!
স্বপ্না এসে বসতেই বড়াল কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিল। স্বপ্নার মুখটা ঘামে জবজব করছে। ব্যাগ খুলে রুমালটা বার করে মুখটা মুছে নিল। চোখের কোলের বিষণ্ণতা মুছে গিয়ে ব্যগ্রতা আসন পেতে বসা। বড়ালও যেন আজ একটু বেশিই ছলবল করছে। আমি আজ বেপরোয়া হয়ে ফ্যানের পেছন থেকে উকি মারছি। কতটা কৌণিক দূরত্ব মেপে ঝাঁপ দিলে এই ধূর্ত শেয়ালটাকে ভড়কে দিতে পারব এই হিসেব চলছে মাথা জুড়ে। রাতের আরশোলাদের ফরফরানি আমি যেমন অনায়াসেই থামাই তেমনই আমি চাই আমার ছায়ায় ঢেকে যাক বড়ালের টাক আর স্বপ্না টুপ করে খসে পড়ুক ওর লোভের থাবা থেকে। আমার ছিটছিটে পুরুষ্টু শরীর বড়ালের অবচেতন মনে থাবা বসাক, রাতে স্বপ্ন দেখুক এক ক্লেদাক্ত ঘিনঘিনে টিকটিকির মত ওর চেতনা থেকে অনিবার্য লালসা খসে পড়ছে। এই ঘরে বসে বড়াল যত চেষ্টাই করুক ওর লালসাকে কখনও তৃপ্ত হতে দেব না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন