ভিক্টোরিয়ার পরি

ভিক্টোরিয়ার পরি
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

(১)

কাছেই একটা জায়গায় কাজে এসেছিলাম। হাঁটতে হাঁটতেই খেয়াল করলাম আকাশে হঠাৎই বর্ষার মেঘ জমতে শুরু করেছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে যখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে পৌঁছলাম তখন ভর দুপুরে যেন অন্ধকার নেমে এলো। আমি বুঝতে পারলাম গতিক সুবিধার নয়, এখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল বলে! আমি কথাটা ভাবতে না ভাবতেই বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা এসে পড়ল আমার গায়ে। জল থেকে বাঁচার জন্য আমি ঢুকে পড়লাম ভিক্টোরিয়ার বাগানে। তারপর একছুটে গিয়ে দাঁড়ালাম একটা শেডের নীচে। ইতিমধ্যে আরও বেশ কয়েকজন লোক আশ্রয় নিয়েছে সেখানে।

(২)

আমি জায়গাটাতে গিয়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল বেগে বৃষ্টি নামল ভিক্টোরিয়ার বাগানে। কালো ঘন মেঘ ঢেকে ফেলেছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথায় বসানো বিখ্যাত পরিটিকে। প্রবল বর্ষণে সামনের চারপাশেও সব কিছু অস্পষ্ট। আমার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে এক দম্পতি। লোকটার কোলে বছর-চারেক বয়সের একটা ফুটফুটে মেয়ে। ঠিক যেন পরির মতোই দেখতে তাকে। স্বামী-স্ত্রী আর বাচ্চা মেয়েটার পরনে রঙচঙে সস্তা পোশাক। মেয়েটার মায়ের হাতে একটা নাইলনের থলে থেকে কাপড়, বিস্কুটের প্যাকেট ইত্যাদি উঁকি দিচ্ছে। তাদের পোশাক আর ওই ব্যাগ দেখে আমার মনে হলো ওই দম্পতি বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে কলকাতা বেড়াতে এসেছে কোনও গ্রাম থেকে। যেমন আসে অনেকেই। শহরে লোকেরা অমন নাইলনের বাজারের ব্যাগে জামা কাপড় নিয়ে ঘোরেনা।

(৩)

প্রচণ্ড শব্দে এরপর কোথায় যেন একটা বাজ পড়ল। বাজের শব্দে মেয়েটা আরও শক্ত করে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার খুব ভয় করছে বাবা।’

লোকটা তার মেয়েকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘ভয় পেওনা। একটু পরই সব থেমে যাবে। তোমার নামতো পরি। আমাদের সামনের বিরাট বাড়িটার মাথাতেও তোমার মতো সুন্দর একটা পরি আছে।
বাবার কথা শুনে মেয়েটা বলল, ‘কোথায় পরি? আমিতো দেখতে পাচ্ছিনা!’
মেয়েটা কেন, আমরা তখন কেউই দেখতে পাচ্ছিনা পরিটাকে। কালো মেঘের আড়ালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথায় দাঁড়ানো পরি তখন সবার চোখেই অদৃশ্য। আমি বাচ্চা মেয়েটার উদ্দেশ্যে হেসে বললাম, ‘মেঘ-বৃষ্টি কেটে গেলে ঠিক তুমি দেখতে পাবে ওই পরিটাকে।’ আমার কথা শুনে চুপ করে গেলো মেয়েটা। কিছুক্ষণের মধ্যে সত্যিই বৃষ্টি কমতে শুরু করল। বর্ষার বৃষ্টি এমনই হয়। এই আসে এই যায়!

(৪)

বৃষ্টি থামল একসময়। মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমল করে উঠল সূর্য। ভিক্টোরিয়ার মাথায় দেখা দিলো পরি। সূর্যের আলোতে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে সদ্য বৃষ্টি স্নাত পরিকে। এবার আমাকে পথে নামতে হবে। লোকটাও এবার তার মেয়েকে বলল, ‘বৃষ্টি থেমেছে, এবার আমরা বেরব।’
তাদের সাথেই শেড ছেড়ে বেরোবার মুখে পরির মতো সুন্দর বাচ্চা মেয়েটার উদ্দেশ্যে আমি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললাম – ‘ভালো করে বেড়াও। ওই দেখো মেঘ কেটে গিয়ে এবার কী সুন্দর দেখা যাচ্ছে পরিটা! আমিও তোমার মতোই ছোটবেলায় বাবার কোলে চেপে এখানে পরি দেখতে এসেছিলাম।’
আমার কথা শুনে অন্য দিকে পা বাড়াতে গিয়েও কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়ে কোলে নিয়ে বাবা। আমার উদ্দেশ্যে লোকটা বিষণ্ণ হেসে বলল, ‘মেঘ যেন একদিন কেটে যায় আপনাদের আশীর্বাদে। বেড়াতে নয়, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে এখানে এসে ঢুকেছিলাম। বেড়াতে নয়, মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় এসেছিলাম হাসপাতালে ওকে ডাক্তার দেখাতে। আমার পরি চোখে দেখতে পায়না।’
লোকটার কথা শুনে আমার মনে হলো হঠাৎই আবার যেন অন্ধকার নেমে এলো। অদৃশ্য হয়ে গেলো ভিক্টোরিয়ার পরি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

8 thoughts on “ভিক্টোরিয়ার পরি

  1. অণুগল্প। তাও বড়ো মন-ছোঁয়া। শেষে বিষাদের সুর।

  2. মিস্টার দাশগুপ্ত, আপনি যে হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন আপনার এই অণুগল্পের অসাধারণ উপস্থাপনের মাধ্যমে ! আপনি উপন্যাস এবং ছোটগল্প লিখে থাকেন। প্রথম আপনার লেখা অণুগল্প পড়লাম। শেষ কয়েক লাইনে করেছেন বাজিমাত, ভরিয়ে দিয়েছেন পাঠকের মন। আন্তরিক শুভেচ্ছা।

  3. প্রিয় সাহিত্যিকের লেখা প্রথম অনুগল্প পড়ে মুগ্ধ হলাম অন্যান্য লেখাগুলো পড়ার মতনই। বড় মর্মস্পর্শী সুন্দর লেখা। একজন লেখকের লেখা খুব বেশী পড়ার এই একটাই কুফল হলো পড়তে পড়তেই বোঝা যায় গল্পের মোচড়টা কোনদিক থেকে আসতে চলেছে।

  4. অপূর্ব, অণুগল্পেও তোমার সাক্ষর রেখে গেলে দাদা। মন ছুঁঁয়ে গেল।দারুন।

Leave a Reply to De dutta banerjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *