novel-aapekkhik

আপেক্ষিক
অজিতেশ নাগ




আমি শ্রবণা মুখার্জী। মিন্দাল স্টিল অ্যান্ড কন্সট্রাকশন লিমিটেডের সিনিয়ার জেনারেল ম্যানেজার। আমাদের কোম্পানিটা একটি বহুজাতিক প্রযুক্তি, প্রকৌশলী, নির্মাণ ও উৎপাদন সংস্থা। আমার বয়স, একদম সঠিক ধরতে গেলে, আজকের দিনে ঠিক আটত্রিশ বছর, চার মাস, চার দিন। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। আমার স্বামী, সাম্যব্রত, বয়স বিয়াল্লিশ, একটি বিদেশি ব্যাঙ্কে উচ্চপদে কর্মরত। আমাদের দুটি সন্তান রয়েছে। দুটিই মেয়ে। উৎসষী আর রূপমেঘা। ওরা যমজ। ফলে দুজনেরই বয়স এগারো। ওরা কনভেন্টে পড়ে। সাধারণত যমজ সন্তানের নামের মধ্যে মিল রাখার একটা প্রয়াস দেখা যায় বাবা-মা’দের মধ্যে। ব্যাপারটা সাম্যব্রত বা আমার, কারও পছন্দসই ছিল না। ও হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতে আরেকজন সদস্য থাকে। রত্নাদি। বলা যায়, আমরা দু’জনেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকায়, রত্নাদিই আমাদের মেয়েদের, একদম ওদের জন্মের সময় থেকেই, সামলেসুমলে রেখে আসছে। রান্নাবান্নাও সে-ই করে থাকে। রত্নাদির হাতের রান্না খাসা।

বারুইপুর বাইপাসের ধারে গড়ে ওঠা এই বিশাল রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের ভেতরের অসংখ্য অ্যাপার্টমেন্টের একটার ছ’তলায় মোটামুটি আড়াই হাজার স্ক্যোয়ার ফিটের এই ফ্ল্যাটটায় চলে এসেছি আজ বছর ঘুরতে চললো। এই ফ্ল্যাটে মোট চারটে বেডরুম। তার মধ্যে যেটি মাষ্টার বেডরুম, অর্থাৎ যে ঘরটা আমার আর সাম্যব্রত’র, সেই ঘরের গোলাপি চাদর ঢাকা বিছানায় এখন টানটান হয়ে শুয়ে আছেন কাবেরী ভট্টাচার্য। আরও একটু খুলে বলতে হলে, উনি চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ওর দেহটা একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। দেহটা ঢাকা হলেও দিব্য বোঝা যাচ্ছে, উনি হাতদুটো জড়ো করে বুকের উপরে রেখেই চোখ বন্ধ করেছেন।

এই মুহূর্তে আমি বসে আছি সেই বিছানা ছুঁয়ে, মেঝেতে পাতা কার্পেটের উপরে দুই পা ভাঁজ করে। একটু আগেও সাম্যব্রত এসেছিল এই ঘরে। আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, “কেশব আঙ্কলকে ফোন করে দিয়েছি। উনি এসেই ডেথ সার্টিফিকেট…” এই অবধি বলে, সম্ভবত আমার পক্ষ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে, ফিরে গেছে নিজের স্টাডিতে। ডক্টর কেশবরঞ্জন খাস্তগীর আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। এই মুখার্জী ফ্যামিলির সঙ্গে ডক্টর খাস্তগীরের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সাম্যব্রত’র কাছে উনি কেশব আঙ্কল। দেখাদেখি আমিও তাই ডাকি।

আজ রবিবার নয়। মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছি সকালেই, চিরাচরিত। তখনও কাবেরীদেবী জীবিত ছিলেন। সাম্যব্রত টয়লেটে ঢুকেছিল। ওর বেরোনোর কথা ন’টার মধ্যেই। রত্নাদি দ্রুত হাতে রান্না সারছিলো। আর আমি, এক গ্লাস মৌসুম্বির রস হাতে, ল্যাপটপে একটা আপকামিং প্রজেক্টের খুঁটিনাটি ব্যাপারে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম, এমন সময় ধীর পায়ে ভাব্যা এসে খবর দিয়েছিল, “কাবেরীম্যাম ইজ নো মোর।” ভাব্যা, গত এক মাস ধরে এই ফ্ল্যাটেই আছে। ওকে অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছিল, ডক্টর কেশবরঞ্জন খাস্তগীরের পরামর্শেই, কাবেরীদেবীর সর্বক্ষণ সেবাশুশ্রূষা করবার জন্য।

মিনিট কুড়ি আগে ভাব্যার মুখের খবরটা পেয়ে ঠিক করলাম আজ অফিসে যাবো না। দুটো আর্জেন্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো। মেহরাকে ফোন করে ম্যানেজ করে নিয়েছি। আমার অনুরোধে সাম্যব্রতও আজ অফিস বাঙ্ক করেছে। ও না থাকলে আমার একার পক্ষে সব দিক সামলানো মুশকিল হবে।

আপাতত আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি কাবেরীদেবীর মুখের দিকে। ঘরের মধ্যে প্রায়-শব্দ-না-করে চলা এয়ারকন্ডিশনার মেশিনটা বুঝতেই দিচ্ছে না, বাইরে জুন মাসের দাবদাহ চলছে। কাবেরীদেবী আমার মাসি-পিসি-দিদা কেউ হন না। রক্তের কোনও সম্পর্ক তো নেইই, উপরন্তু দূরসম্পর্কের কোনও আত্মীয়ও নন তিনি। অথচ ওনার নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হুহু করে যেন স্মৃতির কলসি উপচে জল গড়িয়ে পড়ছিলো আমার চোখের সামনেই। পূর্বাপর সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত।

আমার কাছে সময়ের দাম প্রচুর। পাঁচ মিনিট মানে ঠিক পাঁচ মিনিটই, ছয় নয়। সেই জন্য একদম শুরুতেই আমার সঠিক বয়স হিসেব করে বলেছিলাম। আমার অধস্তন কর্মচারীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় এই কথাটাই আগে মাথায় ঢুকিয়ে নিতে বলি, তাদের কর্মদক্ষতার পরিমাপ পরে।

তাই, এই মুহূর্তে, আমি মনে করতে পারছি, ঠিক এক মাস ছ’দিন আগেকার কথা। দিনটা শুক্রবার ছিলো। আমি বেশ খানিকটা অতিরিক্ত গতিবেগেই গাড়ি চালিয়ে যখন আমাদের অফিসের চৌহদ্দিতে ঢুকেছিলাম, ঘড়িতে তখন দশটা পাঁচ। ঠিক দশটা পনেরোতে আমার ক্লায়েন্ট মিট ছিলো। গাড়ির পেছনের সিট থেকে বাঁ হাতে চারটে ফাইল আর আমার ল্যাপটপটা তুলে, ডান হাতে দারোয়ানের দিকে গাড়ির চাবিটা ছুঁড়ে দিয়ে, লিফটের দিকে পা বাড়াতেই, দারোয়ান ছুটে এসে জানিয়েছিলো, একজন আমার সঙ্গে দর্শনপ্রার্থী। আমি তীব্র চোখে তার দিকে তাকাতেই সে প্রায় কুঁকড়ে গিয়েছিলো। আমি বলেছিলাম, “তুমি কি এই অফিসে নতুন, ছোটেলাল?”

“সরি, ম্যাডাম, কিন্তু উনি সাড়ে আটটা থেকেই বাইরে অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য।”

“নাম?”

“সেটাই তো মুশকিল হয়েছে, ম্যাডাম। উনি কিছুতেই নাম বলছেন না।”

আমি লিফটের ভেতরে পা দিয়েই মাছি তাড়ালাম, যার অর্থ একটাই। বাদ দাও।

লিফটের দরজা বন্ধ হচ্ছিল। আমি হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। ছোটেলাল সম্ভবত শেষ চেষ্টা করল, “আমি বহুবার বলেছি, ম্যাডাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করেন না। আপনার নাম আর দরকারটা বলুন, আমি স্লিপ পাঠিয়ে…”

ছোটেলালের কথা মিলিয়ে গেলো। আমি আন্দাজ করলাম, লোকটা সম্ভবত ছোটেলালের কেউ। সরাসরি আমাকে বলতে পারছে না, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নাটক বানাচ্ছে। মিন্দালে জয়েন করবার পর থেকে অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার, ডেপুটি ম্যানেজার, ম্যানেজার, সিনিয়ার ম্যানেজার, অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, জেনারেল ম্যানেজারের ধাপ পার করে আজ সিনিয়ার জেনারেল ম্যানেজার পোস্টে আমার উত্তরণ ঘটেছে। এতগুলো বছরে অনেককে অনেকভাবে চাকরির উমেদারি করতে দেখেছি। ছোটেলালকে আমি বুঝতে দিইনি, তবে আসল চক্করটা আমি বুঝে গেছি। অফিসের একজন পিওন, চৌধুরি, তার বয়স হয়েছে অনেক। আগামি মাসে তাকে সবেতন ছুটি করিয়ে দেওয়া হবে। তার মানে সেই জায়গাটা খালি হতে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই সেই খবরটা ছোটেলালের কানেও গেছে। তাই নিজের বেরাদরির কাউকে সেই জায়গায় ঢোকাতে চায় সে। যাক গে। আমি সরাসরি মিটিংরুমে ঢুকে অপেক্ষামান ভদ্রমহোদয়দের যখন স্মিত হেসে ‘সুপ্রভাত’ জানালাম, দেওয়ালের ঘড়িতে তখন ঠিক দশটা বেজে পনেরো।

মিটিং শেষ হতে হতে দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গেলো। সেই ঘরে শুধু ক্লায়েন্টের লোকজনই ছিল না, আমাদের কোম্পানির চারজন সিনিয়ার মেম্বারও ছিলেন। ক্লায়েন্ট বেরিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে আরও মিনিট কুড়ি কথা বলে, আমি আমার চেম্বারে এসে বসেছি। বেয়ারা অরুণ আমাকে এক কাপ গরম কফি সার্ভ করে গেছে। আমি কফিতে চুমুক দিয়ে একবার সাম্যব্রত’র সঙ্গে কিছু দরকারি কথা সেরে নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। এবার আমার ল্যাপটপ থেকে অফিসের পিসিতে ডাটা ট্রান্সফার করার সময়। সেই সব সেরে নিয়ে আগামি দুটো প্রজেক্টের ব্লু-প্রিন্ট খুলে বসেছি, এমন সময় আমার টেবিলের উপরে ইন্টারকমটা বেজে উঠলো।

আমি সামান্য বিরক্তই হলাম। আমি একবার নিজের চেম্বারে ঢুকে গেলে, একমাত্র সিনিয়ার কোনও স্টাফ তলব না করলে, অ্যাটলিস্ট লাঞ্চের আগে, আমাকে ইন্টারকমে অপারেটর ডিস্টার্ব করে না। সেই রকমই অর্ডার দেওয়া আছে। আমি ডট সোয়া একটায় লাঞ্চ স্টার্ট করি। দেড়টা থেকে ফের কাজে।

রিসিভার তুলতেই অপারেটর মেয়েটি অত্যন্ত সঙ্কুচিতস্বরে, বার দু’য়েক ক্ষমা চেয়ে নিয়ে, জানালো, একজন দর্শনার্থী আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি একেবারে নাছোড়বান্দা। আগে নাকি নিচে অপেক্ষা করছিলেন, এখন সরাসরি হেল্প ডেস্কে এসে পড়েছেন। বার বার আমার নাম ধরে, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছি আমি, আমার নাম ধরে দেখা করতে চাইছেন। বলছেন, অনেক দূর থেকে আসছেন। ট্রেনে করে। পাঁচ মিনিট দেখা করেই চলে যাবেন। কিন্তু কিছুতেই নিজের নাম বলতে চাইছেন না। কী দরকার সেটাই পরিষ্কার করে বলছেন না। ভদ্রমহিলা মিডল-ওল্ড এজেড। এখন লাউঞ্জে বসে আছেন আর বার বার হেল্প ডেস্কে এসে খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না, যে আমি প্রি-অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা করি না।

অপারেটর মেয়েটি একদমে এত কথা বলে ফেলে জানতে চাইল, আমার সিদ্ধান্ত কী?

মেয়েটি এতক্ষণ যা যা বলে গেলো, তার প্রথমাংশ শুনে আমার মাথাটা চট করে গরম হয়ে গিয়েছিলো। ছোটেলালের এত বড় দুঃসাহস যে, তার লোককে একেবারে আমার চেম্বারে পাঠাতে চাইছে? কালই একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু শেষের দিকে ‘ভদ্রমহিলা’ শব্দটা শুনে থমকে গেলাম। আমি এতক্ষণ একজন পুরুষমানুষকে কল্পনা করছিলাম। একজন ভদ্রমহিলা, তাও প্রৌঢ়া, আসছেন নাকি অনেক দূর থেকে? তার কী এমন দরকার থাকতে পারে আমার সঙ্গে? আমার বা সাম্যব্রত’র কোনও রিলেটিভ হলে তো সরাসরি বাড়িতে আসবে, অফিসে এসে দেখা করতে চাইবে কেন? তবে কি মন্দাপিসি, যার বাড়ি কুচবিহারে? ধ্যাত, মন্দাপিসি তো আমার গৃহপ্রবেশে এসেছিলেন। আর বর্তমানে তো শুনেছি বাতের ব্যাথায় তিনি এতটাই কাতর হয়ে পড়েছেন, যে দোতলা থেকে একতলায় নামতে পারেন না। তার পক্ষে সেই কুচবিহার থেকে এই সেক্সপিয়ার সরণীতে আমার অফিস চিনে আসা নেক্সট টু ইমপসিবল, কষ্টকল্পনা বিশেষ। তবে? অপারেটর মেয়েটি আমার উত্তরের অপেক্ষা করছিলো। আমি আদ্যোপান্ত কিছু ভেবে না পেয়ে, নিতান্ত কমপেশনাট গ্রাউন্ডে, বললাম, “পাঠিয়ে দাও।”

বলেই ফের কম্পিউটার স্ক্রিনে ডুবে গেলাম। এক সপ্তাহ আগে গিয়েছিলাম শেওড়াফুলিতে হওয়া আমাদের নির্মীয়মান নতুন প্রজেক্টে। যদিও আমার বা আমার ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে সদলবলে মাঠে নেমে পড়ার কাজ, এখনও সেই অর্থে শুরু হয়নি, তবে যে কোনও প্রজেক্টের একদম শুরু থেকে লেগে থাকলে চোখের সামনে পুরো স্বপ্নটা সার্থক হতে দেখা যায়। তার আনন্দই আলাদা। গিয়ে দেখেছিলাম, প্রায় পৌনে একর জমি জুড়ে প্ল্যান্টের কাজ শুরু হয়েছে। শুরু বলতে অবশ্য এখন শুধুমাত্র মাটি খোঁড়ার কাজটাই শুরু হয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রচুর কাটার, ডাম্পার, জেসিপি, টাওয়ার ক্রেন, লিফটিং ক্রেন এইসব। আসছে মাসের কুড়ি তারিখটা পেরিয়ে গেলে তবে এক ধাপ এগোনো গেলো বলে ভেবে নেওয়া যেতে পারে। আশা করা যাচ্ছে তার মধ্যে এক্সক্যাভেশনের কাজ কমপ্লিট হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে টপসয়েল রিম্যুভেলের কাজ কমপ্লিট। এক্সক্যাভেশনের কাজ শেষ হয়ে গেলেই ফুটিংসের কাজ শুরু। এর মধ্যে বিশাল বিশাল কংক্রিটের স্ল্যাব আনানো হয়েছে। একদিকে পাহাড় করে রাখা হয়েছে। লিফটিং ক্রেনের ঘর্ঘর আওয়াজ চলেছে দিনরাত। এখন সিভিল অ্যাক্টিভিটি চলছে। তারপরে মেকানিক্যাল অ্যাক্টিভিটি শুরু হবে। তার পরে…

“আসবো?”

আমার চিন্তায় বাধা পড়লো। আমার চেম্বারের দরজা সামান্য ফাঁক করে একটি মুখ উঁকি মারছে। আমি নিজের গলাটা যথাসম্ভব মোলায়েম করে বললাম, “আসুন।”

ফের স্ক্রিনের দিকে চোখ। তবে বুঝতে পারছিলাম, ভদ্রমহিলা অত ধীর পায়ে এগিয়ে এসে, আমার টেবিলের ওপারে রাখা তিনটে চেয়ারের মধ্যে একটায় বসলেন। সামান্য শিউড়ে উঠলেন। তারপর আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিনিট খানেক পরে আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম, “কিছু বলবেন? আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে…”

ভদ্রমহিলা আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, “আমাকে চিনতে পারছো না, বনা?”

বনা! নামটা কানে যেতেই যেন মনে হলো কত যুগের ওপার থেকে ডাকটা ভেসে এলো। এই গোটা পৃথিবীতে এই নামে আমাকে…। চমকে উঠে তার মুখের দিকে সরাসরি তাকাতেই আবার চমকাতে হলো। মাঝখানে অনেক অনেক বছর কেটে গেছে। সেই মুখটা ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে গেছে। তবুও চিনতে সমস্যা হল না। মিসেস কাবেরী ভট্টাচার্য। কিন্তু তিনি তো…

আমি শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার মুখে কথা সরছিলো না। কোনওমতে নিজেকে সামলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রণাম করলাম পা ছুঁয়ে।

“আপনি? কোথা থেকে?”

তিনি সেই আগেকার মত, গালে অল্প টোল ফেলে, হাসলেন, “যাক, আমি ভেবেছিলাম তুমি চিনতে পারবে না। তবুও আশায় আশায়…”

বুঝলাম আবেগে তার গলা বুজে আসছে। আমি টেবিলের উপরে রাখা জলের গ্লাসটা তুলে তার সামনে ধরলাম। তিনি একবারে গ্লাসটা শেষ করলেন। আমি কোনওমতে বললাম, “আপনি হেল্পডেস্কে নিজের নামটা বলেননি কেন? তাহলে তো এতক্ষণ দাঁড়াতে হতো না।”

বলেই আমি টেবিলের উপরে রাখা ঘণ্টাটা টিপে দিলাম। নিমেষে অরুণ হাজির। আমি কাবেরীদেবীকে বললাম, “সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি মনে হচ্ছে?”

তিনি সামান্য ইতস্তত করে বললেন, “খেয়েছি। তবে…”

অরুণকে এক প্লেট ভেজ স্যান্ডুইচের কথা বলে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে তার সামনে বসতেই তিনি বললেন, “বনা, আসলে আমি ভেবেছিলাম, তুমি আমাকে এখনও ক্ষমা করতে পারোনি। নাম শুনে যদি দেখা করতে না চাও?”

আমি কার্যত লজ্জা পেলাম। ছিঃ ছিঃ, কাবেরীদেবী সেই সকাল থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন? আমি বললাম, “আপনি সেই কথা এখনও মনে রেখে দিয়েছেন?”

“আমি… আমি…” কাবেরীদেবী কথা শেষ করতে পারলেন না, চোখে আঁচল চাপা দিলেন।

আমি বললাম, “আমি ভুলে গেছি। কিন্তু আজও আমি বলবো, সেদিন আমার কোনও দোষ ছিল না।”

কাবেরীদেবী আচমকা আমার হাত চেপে ধরলেন, “আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বনা। কিন্তু তোমাকে মুখ ফুটে জানাতে পারিনি। তারপরে তুমি রায়গড় ছেড়ে চলে গেছো। ঈশ্বর জানেন, আমি অনেকবার ভেবেছি, তোমার সামনে গিয়ে কথাটা বলে ফেলি, নিজেকে হাল্কা করি, কিন্তু…। শেষে আর পারলাম না, বনা। তুমি তো আর আমাদের কোম্পানিতে নেই। অনেক খুঁজেছি তোমায়। শেষে অশোক… অশোক মালহোত্রা… অশোককে মনে আছে নিশ্চয়ই? সেই আমাকে সন্ধান দিলো। তারপর এই অফিসের ঠিকানাটা জোগাড় করে… এখন…।”

“আপনি কি একা এলেন?”

আমার কথার উত্তর দেওয়ার আগেই ভদ্রমহিলার মাথাটা সামান্য টলে গেলো। আমি ধরে ফেলে বললাম, “শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”

তিনি ম্লান হেসে ‘না’ করলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমি আবার চমকেছি। ভদ্রমহিলার গা তো বেশ উত্তপ্ত। জ্বর এসেছে নাকি? তাকে বলতেই কাবেরীদেবী বললেন, “ও কিছু না। এতক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে ছিলাম তো।”

বাইরের প্রচণ্ড দাবদাহের কথা মনে পড়ায় আমার সত্যিই খারাপ লাগল। অরুণ এসে হাজির। ওর হাতে ট্রে। আমি স্যান্ডউইচের প্লেটটা তার সামনে ধরে অরুণকে বললাম, “পনেরো মিনিট পরে কফি আনবে।”

কাবেরীদেবী এক দৃষ্টিতে আমার হাতের প্লেটটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বললাম, “নিন, খেয়ে নিন। এরপরে কফি খেলেই দেখবেন অনেকটা চাঙ্গা লাগছে। তারপরে শুনছি, আপনার কথা।”

কাবেরীদেবী শুধু ক্ষমা চাইবার জন্য রায়গড় থেকে এতটা পথ অতিক্রম করে এসেছেন, ভাবতেই অবাক হলাম। যে ট্রেনই ধরেন না কেন, তাহলেও তো তের-চোদ্দ ঘণ্টার পথ। দুরন্ত ধরলে কিছুটা কম সময়। ভদ্রমহিলার কী চেহারা ছিল। রীতিমত আগেকার দিনের হিন্দি সিনেমা আর্টিস্টদের মত। আভিজাত্যও ছিল মারাত্মক লেভেলের। অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতেন ভ্রু তুলে। সেই মানুষটা….

আমার ভাবা শেষ হল না, কাবেরীদেবীর হাত থেকে প্লেটটা মেঝেয় পড়ে গেলো। ভাগ্যিস মেঝেতে পুরু কার্পেট পাতা, নইলে খানখান হয়ে যেত। সব খাবার ছড়িয়ে পড়ল কার্পেটের উপরেই। আমি বিদ্যুৎগতিতে তাকে ধরে না ফেললে, তিনিও ভূপাতিত হতেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম, “অরুণ!”

“শ্রবণা, কেশব আঙ্কল এসেছেন।”

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে বসেছিলাম। সাম্যব্রত’র গলা পেয়ে মাথা তুলতেই মনে হল মাথাটা ধরে গেছে। এক কাপ চা পেলে ভালো হতো। রত্নাদিকে বললেই হয়, কিন্তু কিছুতেই ইচ্ছে করলো না। আমি উঠে দাঁড়ালাম। একটা চেয়ার টেনে দিলাম বিছানার পাশে। ডক্টর কেশবরঞ্জন খাস্তগীরের মিনিট দশেক লাগল কাবেরীদেবীকে পরীক্ষা করে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিতে। তারপর ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বললেন, “স্টেমি হার্ট অ্যাটাক। স্টেমি কি জানো তো সাম্য? যে করোনারি আর্টারিস দিয়ে ব্লাড হার্টমাসলে যায়, তাতে কমপ্লিট ব্লকেজ। আর ওনার যেহেতু সুগার ছিল, তাই…। বাট, ভাব্যা, তুমি কোনও রকম…”

ভাব্যা বললো, “বিশ্বাস করুন, স্যার। আমি শেষ অবধি চেষ্টা করেছিলাম, স্যার। প্রথমেই…।”

আমার কিছু ভালো লাগছিল না। বললাম, “কেশব আঙ্কল, এই সব ডিসকাশনের আর কী দরকার আছে?”

“তা তো নেইই। আচ্ছা, আমি তো শুনেছিলাম, ইনি তোমাদের রিলেটিভ ছিলেন না। ইন দ্যাট কেস, এনার কোনও…”

কেশব আঙ্কল আর সাম্যব্রত দুজনেই জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো আমার মুখের দিকে। আমি ক্লান্তস্বরে বললাম, “ওনার হাজবেন্ড আর ছেলে আছে।”

কেশব আঙ্কলের গলায় বিস্ময় ফুটল, “ওনার রিলেটিভ কেউ থাকলে তাকে আগে ডাকলে না কেন? আমি তো বলেইছিলাম, ওনার সিচুয়েশন…”

আমি থামালাম, “ব্যারাকপুরে ওনার এক পিসতুতো বোন থাকেন। বাট, উনি চাননি, তাদের কারও সঙ্গেই কোনও রকম কন্ট্যাক্ট করা হোক। আমিও তাই কন্ট্যাক্ট নাম্বার নিইনি। আমি জাস্ট ওনার ডিশিসানকে রেসপেক্ট করেছিলাম। বাট, এখন উনি নেই। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের উচিত অ্যাটলিস্ট ওনার হাজবেন্ডকে জানানো। সাম্য, আমি তোমাকে নাম্বার দিচ্ছি। তুমি একবার দ্যাখো তো। আমার কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।”

আমার ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। সাম্য বুঝতে পেরে কেশব আঙ্কলকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমি সাম্য’কে পার্থ নারায়ণ ভট্টাচার্যের নাম্বারটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিয়ে আবার ধপ করে বসে পড়লাম মেঝেয়।

কাবেরীদেবী কি আমার আত্মীয় ছিলেন? আত্মীয় কাকে বলে? বাপির মুখটা ভেসে উঠল। বাবাকে আমি বাপি বলে ডাকতাম। বাপি বলতেন, “সম্পর্ক দুই প্রকারের হয়। এক, রক্তীয় আর দুই, আত্মীয়। যাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক তারা রক্তীয় গোত্রভুক্ত আর যাদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক, তারাই আসল আত্মীয়। আমি কাবেরীদেবীর নিথর মুখের দিকে তাকালাম। চোখ দুটো যেন এতক্ষণে ভিজে এল। মনে হল, শুধু কেশব আঙ্কল কেন, এই পৃথিবীর সবাইকে যদি চিৎকার করে বলতে পারতাম, কাবেরীদেবী আমার আত্মীয় ছিলেন। হয়ত সারা জীবনই থাকতেন, যদি না, সেই দিন…”

সাম্য ফিরে এসেছে, “ওনার নাম্বার তো ইনভ্যালিড বলছে। আর কোনও নাম্বার আছে?”

আমি এইরকমই একটা কিছু আশা করেছিলাম। বললাম, “নাহ।”

“ওনার ছেলের নাম্বার?”

“ছেড়ে দাও।”

“আচ্ছা। শোনো, মর্চুয়ারি ভ্যানকে বলা হয়েছে। কেশব আঙ্কলই যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। আধা ঘণ্টার মধ্যেই এসে পড়বে। আর আমার কিছু ফ্রেন্ডস আসছে। একা একা তো আর শ্মশানে নিয়ে যাওয়া যায় না।”

আমাকে নিরুত্তর দেখে সাম্য বললো, “তুমি যাবে শ্মশানে?”

অসম্মতি জানালাম। সাম্য বললো, “সেই ভালো। তুমি কিছু মুখে দাও। একদম খালি পেটে থাকা উচিত হবে না। আর একটা কথা। উমা আর মেঘা স্কুল থেকে ফিরলে ওদের বুঝিয়ে বোলো। এই ক’দিন…”

সাম্য বেরিয়ে গেলো। উমা আর মেঘা হল আমাদের দুই মেয়ে উৎসষী ও রূপমেঘার ডাকনাম। তা সত্যি। বিগত প্রায় একমাস মেয়েদুটো, আমার বারণ করা সত্ত্বেও, কাবেরীদেবীর সঙ্গে গল্প জমাতো। স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সামান্য কিছু মুখে দিয়েই দৌড়তো কাবেরীদেবীর ঘরে। আমি বলতাম, “ওঁকে বিরক্ত কোরো না। রেস্ট নিতে দাও।” কাবেরীদেবীই মানা করতেন, “আর রেস্ট নিতে বোলো ন, বনা, সারাদিন শুয়ে শুয়ে…”

সেদিন অরুণ এসে না ধরলে আমার পক্ষে হয়তো কাবেরীদেবীকে সামলানো মুশকিল হয়ে যেত। শরীরটা আর আগের মত শক্তপোক্ত না থাকলেও, উচ্চতার আন্দাজে কিছু ভারভারিক্কি তো ছিলেনই। তার উপরে সংজ্ঞা হারিয়ে পুরো শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। যাই হোক, আমার চিৎকারে শুধু অরুণ নয়, ডিপার্টমেন্টের বেশ কিছু স্টাফও ছুটে এসেছিলো। ওরা ভেবেছিলো, আমার কিছু হয়েছে। ওরা যতক্ষণ কাবেরীদেবীকে ধরে বাইরের সোফায় শুইয়ে দিচ্ছিলো, ততক্ষণ আমি আমার কাজগুলো মেহরাকে বুঝিয়ে দিতে দিতে ডক্টর দাশমুন্সিকে ফোন করে ঘটনার মোটামুটি একটা ডেসক্রিপশন দিয়ে দিয়েছিলাম। ডক্টর দাশমুন্সির চেম্বার আমাদের অফিসের পাশের বিল্ডিংয়ের একতলায়। তিনি ছিলেন আমাদের কোলকাতা ব্রাঞ্চের আনঅফিশিয়াল চিকিৎসক। এই অফিসের কারও কোনও শারীরিক সমস্যা হলে তিনি ছুটে আসেন বা আমরা যাই।

ডক্টর দাশমুন্সি এসে পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, অল্পের উপর দিয়ে মহিলা বেঁচে গেছেন। ইটস’ আ কাইন্ড অফ মাইল্ড হার্টঅ্যাটাক। তিনি সঙ্গে সঙ্গে নাইট্রোগ্লিসারিন জাতীয় মেডিসিন ও তার সঙ্গে একটা ইঞ্জেকশন চার্জ করলেন। বললেন, “খুব ভালো হয়, যদি নার্সিংহোমে শিফট করা যায়।”

নার্সিংহোমে শিফট অবশ্য করতে হয়নি। ডক্টর দাশমুন্সি চলে গেলে, কাবেরীদেবী ধীরে ধীরে চোখ মেলেছিলেন। তবুও আমি কোনও রিস্ক না নিয়ে কেশব আঙ্কলকে ফোন করি। সবটা শুনে উনি বলেছিলেন, “বাড়িতে নিয়ে যা। আমি আসছি।”

আমি ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম পেছনে কাবেরীদেবীকে বসিয়ে। ওঁকে ধরে ছিলো অরুণ, পুরোটা রাস্তা। প্রধানত অরুণের সাহায্যেই ওঁকে আমাদের মাষ্টার বেডরুমে এনে শুইয়ে দিয়েছিলাম। কেশব আঙ্কল এলেন তার মিনিট কুড়ির মধ্যেই। সঙ্গে আরেকজন ডাক্তার আর একজন নার্স, ভাব্যা। বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে তারা বলেছিলেন, আপাতত আমার চিন্তার কিছু নেই বা ইমিডিয়েটলি নার্সিংহোমে ট্রান্সফার করবারও কোনও প্রয়োজন দেখছেন না তারা। ভাব্যাকে রেখে গেলেন, চব্বিশ ঘণ্টা কাবেরীদেবীর উপরে মনিটারিং করবার জন্য। তবে বেশি কথা না বলাই ভালো। কারণ ওঁর হার্টের অবস্থা ভালো নয় ও সুগার লেভেলও আতঙ্কজনক।

কেশব আঙ্কলরা চলে গেলে কাবেরীদেবী সামান্য হাসলেন, “আমি মরবো না, বনা। ঈশ্বর সহায় আছেন। নইলে রাস্তাতেই তো কিছু একটা হয়ে যেত পারতো।”

“আপনি কী সরাসরি রায়গড় থেকে এখানেই আসছেন?”

“না, না। ব্যারাকপুরে আমার এক পিসতুতো বোন থাকে। তার বাড়িতে এসে উঠেছি আজ প্রায়… তুমি আবার ওদের ফোন-টোন করতে যেও না বনা। ওরা ডিস্টার্বড হোক, আমি চাই না।”

“বেশ। শরীরের এই কন্ডিশান হল কী করে?”

“সে অনেক গল্প। পরে বলবো।”

“উনি কোথায়?”

উনি মানে কাবেরীদেবীর স্বামী পার্থ নারায়ণ ভট্টাচার্য’র কথা বলছি, সেটা বুঝতে সময় নিলেন না, “আমি জানি না। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে আজ বছর সাতেক আগে।”

“ছেলে?”

“উচ্ছ্বাস? ঐ বছর সাতেক আগেই….। রোড অ্যাক্সিডেন্ট। জানোই তো কীরকম র‍্যাশ ড্রাইভিং করতো। তারপরেই পার্থ চলে গেলো, একদিন ফাইন মর্নিংএ। কোথায় যে গেলেন। ফোন সুইচড অফ। তাই আর…”

উচ্ছ্বাসের মুখটা মনে পড়ল। আমি শিউড়ে উঠলাম, “সে কী! আপনি একা রয়ে গেলেন?”

কাবেরীদেবী সেই অননুকরনীয় ভঙ্গিমায় হাসলেন, “কেউ সঙ্গে না থাকতে চাইলে…”

একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক কাঁপিয়ে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। ফ্রেশ হতে টয়লেটে ঢুকে গেলাম।

উমা আর মেঘা ফিরে এলো যথাসময়ে। বাড়িতে নতুন অতিথি-আগমন দেখে তাদের চরম ঔৎসুক্য। আমিই কোনওরকমে আটকে রাখলাম। গণ্ডগোলটা বাঁধল সাম্য বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই।

“হ্যাভ ইউ লস্ট ইওর কমন সেন্স?”

“কেন? এমন করে কথা বলছো কেন? আর সাউন্ডটা কমাও। উনি অসুস্থ হলেও জেগেই আছেন।”

সাম্য নিমেষে গলা খাদে নামিয়ে এনে বললো, “ফার্স্ট কোয়েশ্চেন, ইনি কে?”

“সব বলবো। একটু সময় দাও।”

“তোমার কোনও রিলেটিভ?”

রত্নাদি ঘরে এসেছিলো। আমাদেরকে কথা বলতে দেখে কিচেনে ঢুকে গেলো। আমি বললাম, “রক্তের নয়, তবে আত্মার তো বটেই।”

সাম্য জামা ছাড়ছিলো, “ঘুরিয়ে কথা বোলো না, শ্রবণা। আর যদি ধরেওনি, উনি তোমার রিলেটিভ হন, তাহলেও আমাদের বেডরুমে… হাউ অ্যান্ড হোয়াই?”

আমি সাম্যকে কোনওমতে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করেছিলাম। আশ্বস্ত করেছিলাম এই বলে, যে দিন কয়েকের তো ব্যাপার। তারপরেই তো উনি ফিরে যাবেন নিজের ডেরায়। তবুও পরের বেশ কয়েকদিন সাম্য’র রাগ যায়নি। বাচ্চাদেরও কাবেরীদেবীর কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। তবে আমার মেয়েদুটিও সেয়ানা হয়ে উঠেছে বিলক্ষণ। বাপি বাড়ি ফেরার সময় হলেই সুড়সুড় করে নিজেদের পড়ার ঘরে ঢুকে যেত। আর না থাকলে, ‘দিদা’ ‘দিদা’ বলে কাবেরীদেবীর গায়ে প্রায় লেপ্টে থাকতো। আমি একবার ওঁর সামনেই উমা আর মেঘাকে ধমকে দিয়েছিলাম। তাতে কাবেরীদেবীর মুখে ভর-বিকেলে সন্ধ্যে নেমেছিল, “থাক না, বনা, ওরা আমার কাছে। আমার উচ্ছ্বাসের তো আর…।” এরপরে আর না করা যায়নি।

সাম্য প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেই একবার কাবেরীদেবীর ঘরে উঁকি মেরেই গজগজ করতো। তার কারণও ছিল। কাবেরীদেবী আমাদের বাড়িতে শিফটেড হওয়ার দু’দিন পরেই কেশব আঙ্কল আমাদের মাষ্টার বেডরুমটাকে এক প্রকার নার্সিংহোমের চেহারা দিয়েছিলেন। লাগিয়ে ছিলেন হল্টার মনিটর মেশিন। আরও কী কী সব। হল্টার মেশিনে কন্টিনিউয়াসলি কাবেরীদেবীর হৃদস্পন্দন দেখা যেত। সেই হিসেবে ভাব্যা রিপোর্ট পেশ করত কেশব আঙ্কলকে। বেডসাইড টেবিলটাও ভরে উঠেছিল নানান ওষুধের শিশি আর স্ট্রিপে।

সাম্যকে যদিও বুঝিয়েছিলাম এই বলে যে, উনি সেরে গেলেই ফিরে যাবেন নিজের ডেরায়, তবুও আমার মনের কোনে একটা আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিলো, ওঁকে এই বাড়িতেই রেখে দিই। আমাদের তো চারটে বেডরুম। তার একটায় ঠিক অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবেন। তবে পাশপাশি একটা প্রচ্ছন্ন ভয়ও ছিলো। পার্থ নারায়ণ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরেও এতগুলো বছর যিনি নিঃসঙ্গপুরীতে কাটিয়ে দিলেন, যিনি শুধুমাত্র ক্ষমা চাইবার জন্য এই শরীরেও এতটা রাস্তা ট্রাভেল করতে পারলেন, তিনি কি আর আমার অনুরোধ রাখবেন? আমি শুধু সময়ের অপেক্ষাই করতে পারি।

আশ্চর্য ব্যাপার। প্রথম দিন পনেরো অত্যন্ত ধীরলয়ে হলেও কাবেরীদেবীর শারীরিক উন্নতি হলেও, পরের দিকে আবার তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হচ্ছিলেন। কেশব আঙ্কল, যিনি এক সপ্তাহ পরেই বলেছিলেন, ‘শি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। এখন শুধু দরকার রেগুলার চেকআপ আর রুটিন ধরে ধরে প্রোটিন ফুড’, তাঁরও কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি তারপর থেকে নিয়মিতই আসতেন আমাদের বাড়িতে। কোনওদিন সঙ্গে থাকত একজন না একজন ডাক্তার-বন্ধু।

কিন্তু শেষমেশ কিছুই হলো না। কাল রাতেও তিনি আমাকে বিছানার কাছে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিলেন। দিন পাঁচেক হলো তিনি উঠে বসতেও পারছিলেন না। আমি বাচ্চাদের কাছে আসতে দিতাম না। সেটাও কেশব আঙ্কলের নির্দেশেই। কাবেরীদেবী অত্যন্ত নিচু গলায় বলেছিলেন, “বনা, তুমি কি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছো? প্লিজ, আমার সঙ্গে কার্টসি করে ‘হ্যাঁ’ বোলো না।” আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনি। ওঁর বাঁ হাতটা চেপে ধরেছিলাম। উনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করেছিলেন। এক ফোঁটা করে জল গড়িয়ে পড়েছিলো বাইরে।

“ওরা এসে গেছে, শ্রবণা, তুমি উঠে দাঁড়াও দেখি।”

কাবেরীদেবীর পাশে, হাতের উপরে মাথা রেখে, আমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চমকে জেগে উঠে দেখি, সামনে সাম্য। তার পেছনে পাঁচ-ছ’জন মানুষ। এদের আমি চিনি। সাম্য’র কিছু ইন্টিমেট ফ্রেন্ডস। আর দু’জন অচেনা লোক। সাম্য বললো, “মর্চুয়ারি ভ্যান এসে গেছে। তুমি সরে দাঁড়াও। আর…” বলে সাম্য নিজেই কাবেরীদেবীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। আমিও। ভেবেছিলাম কাবেরীদেবীকে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার কান্না পাবে। কিন্তু আমার চোখ শুকনো। এটা কিসের জন্য? গভীর শোক? নাকি গভীর যন্ত্রণার স্মৃতি? নাকি অতলান্ত এক ক্ষোভের সমুদ্র, যার বশবর্তী হয়ে, সেদিনও আমি এক ফোঁটা চোখের জল ফেলিনি, শুধু শান্ত চোখ দুটো মেলে কাবেরীদেবীকে বলেছিলাম, “আমি কিন্তু কোনও ভুল করিনি, ম্যাডাম।”

আমি ছ’তলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চারদিকে দূর দূর অবধি অন্য কোনও বাড়ি-ঘর না থাকার জন্য সারা বছরই প্রচুর দামাল হাওয়া আসে। এই মুহূর্তে হুহু করে সামান্য গরম হাওয়া ছুটে এসে আমার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। নিচে ভ্যানটা দাঁড়িয়ে। ধুপকাঠি জ্বালানো হচ্ছে, চারদিকে চার গোছা রজনীগন্ধার স্টিক লাগানো হচ্ছে, আশপাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিছু লোক বেরিয়ে এসে ঘিরে ধরেছে ভ্যানটাকে। সাম্যকে দেখতে পাচ্ছি। ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।

একসময় ভ্যানটা চলে গেলো। রত্নাদি হাতে একটা ধূমায়মান কাপ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো, “সকাল থেকে ফ্রুটজুস ছাড়া তো আর কিছু পেটে পড়েনি তোমার। কফিটা খেয়ে নিয়ে স্নান সেরে ফেল। দাদাবাবুরা ফিরে এলে আমি দেখে নোবো। আমি একটু নিচে যাচ্ছি। নিমপাতা কোথায় পাওয়া যায় দেখি।”

আমি বারান্দাতেই বেতের চেয়ারে বসে পড়ে আগুন-গরম কফিতে এক সিপ দিলাম। তারপর তাকালাম দিগন্তের দিকে। তাকিয়েই থাকলাম, যত দূর দৃষ্টি যায়।

তখন আমার কতই বা বয়স? ষোল পেরিয়ে সতেরোর দোরগোড়ায়। বয়স হিসেবে লেখাপড়ায় একটু তাড়াতাড়িই এগিয়েছিলাম হয়তো বা। হায়ার সেকেন্ডারির পরে দ্বিধায় পড়লাম। জয়েন্ট দেবো? নাকি ডিগ্রি কোর্সের দিকে এগোবো? বাপি বললো, “দ্যাখ, যেটা ভালো মনে করিস।” বাপি আমাদের দুই ভাইবোনের কারও উপরেই নিজের মত চাপিয়ে দেয়নি, কোনদিনই। তার একটা কারণ ছিলো। ছোটবেলা থেকেই আমি আর আমার ভাই, লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিলাম। শুধু পাস করবার জন্য নয়, বই পড়তেই আমি খুব ভালোবাসতাম। ধরা যাক, ইংরেজী পাঠ্যপুস্তক। তার মধ্যে যে ক’টা গল্প আমাদের সিলেবাসের ভেতরে, তা তো পড়তামই, বইয়ের বাকি গল্পগুলোও পড়ে ফেলতাম। বয়সের হিসেবে ভাই আমার থেকে অনেকটাই ছোট। প্রায় বছর দশেকের ফারাক। আমরা দুই ভাইবোন শুধুমাত্র স্কুল আর লেখাপড়া নিয়েই থাকতাম। বন্ধুবান্ধব বেশি ছিলো না। মা ছিলো, যাকে বলে আক্ষরিক অর্থে, দুর্বল মানুষ। তবে শুধু শারীরিক স্তরে, মানসিক স্তরে নয়। মাসের মধ্যে বেশিরভাগ দিনই মা খানিকটা করে অসুস্থ হয়ে পড়তো। তবুও রান্না-বান্না, ঘর সামলানো, বাসন-মাজা, কাপড়-কাচা ইত্যাদি হাজারো কাজ নিজেই সামলে নিতো। বাপি কোর্টে পেশকারের কাজ করত। আমরা থাকতাম দক্ষিণ কোলকাতার বাঘাযতীন কলোনিতে। দুই কামরার ঘর। নিজস্ব।

যাই হোক, জয়েন্ট দিলাম। ভালো নাম্বার পেলাম, র‍্যাঙ্ক করবার মতই। ব্যস, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব। চার বছরের কোর্স। ফলে বাপির ফিক্সড ডিপোজিটে হাত পড়লো। বাপি অবশ্য দু’বার ভাবলেন না।

চার বছর ঝড়ের মত কেটে গেলো। প্রবল বজ্রপাত সহযোগে ঘূর্নিঝড় এসে আছড়ে পড়লো তারপরেই। সবে যখন ভাবতে বসেছি, এবার এফই, পিই এগজামগুলো দিয়ে বছর খানেকের মধ্যে একটা মনের মত চাকরি জোগাড় করে ফেলব। ব্যস আর চিন্তা নেই। ভাইটাকে ভালো কলেজে পড়াবো, এই বস্তিমত জায়গাটা ছেড়ে একটা ভদ্রস্থ জায়গায় বাড়ি কিনবো কী নিদেনপক্ষে ভাড়া নেবো, মাকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলবো আর হ্যাঁ, অবশ্যই বাপিকে এবার বিশ্রাম দেবো, ঠিক তখনই, একদিন সকালে খেয়েদেয়ে বাপি কোর্টে গেলেন, ফিরে এলেন নিথরপাথর হয়ে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। পেশকারের তো আর পেনশন থাকে না। জমানো টাকা যা ছিলো, সব গলে গেছে আমার আর ভাইয়ের পেছনে। এবার?

মাস পাঁচেক গেলো চারদিকে দৌড়োদৌড়ি করে। কাউকে ধরতে বাকি রাখিনি। চুলোয় যাক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি, একটা অফিসে পিওনের কাজ হলেও বেঁচে যাই। ছাত্র পড়াতে শুরু করলাম। সকাল থেকে সন্ধ্যে। মায়ের সব গয়না বেচে দেওয়া হল এক এক করে। শেষে যখন তালপুকুরের জল ঠেকেছে একেবারে তলানিতে, একদিন সকালে ধূমকেতুর মত বিভাসকাকু এসে উদয় হলেন আমাদের বাড়িতে। বিভাসকাকুকে দেখে মা কান্নায় ভেঙে পড়লো। আমার বাপির চাইতে কিছু বছরের ছোট হলেও বিভাসকাকু বাপির প্রিয়বন্ধু ছিলেন। বহুদিন আগে, আমি তখন পাঁচ কী সাত, আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন। তখনই বড় চাকরি করতেন একটা। পরে শুনেছিলাম, আরও বেটার চান্স পেয়ে মুম্বাই, না দুবাই, কোথায় যেন চলে গেছেন।

বিভাসকাকু তো আকাশ থেকে পড়লেন। বাপি যে নেই, তিনি একপ্রকার বিশ্বাসই করে উঠতে পারছেন না যেন। চলে যাওয়ার সময়, একটা কার্ড দিয়ে বললেন, “বৌদি, মেয়েকে এই ঠিকানায় একবার পাঠিও তো। পরশু। সকাল এগারোটার মধ্যে। দেখি কী করা যায়।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “কী রে মা, ডালহৌসি চিনে যেতে পারবি না?”

আমার তখন এমন অবস্থা, কোলকাতার ডালহৌসি কেন, একটা চাকরির জন্য আমি হিমাচলের ডালহৌসিতেও যেতে রাজি।

আজও মনে আছে। সেদিন ছিল অক্ষয়তৃতীয়ার পরের দিন। ডালহৌসি আমি চিনলেও অফিসটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগলো। বিভাসকাকুর সামনে সব সার্টিফিকেটগুলো রাখতেই তিনি ভারি মনোযোগসহকারে সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন। আমি ততক্ষণে চারদিকটা দেখছি। বাপ রে! কী ঝকঝকে অফিস! চারদিকে কী সব চকচকে স্টাফ! আচ্ছা, এই অফিসে একটা চাকরি হয় না? বিভাসকাকুকে বলার আগেই তিনি বললেন, “তুই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এখনও বসে আছিস দেখে আমার আশ্চর্য লাগছে। দ্যাখ মা, আমি আমার অফিসেই তোর একটা চাকরি করে দিতে পারি। মাইনেও মোটামুটি ভালোই পাবি। কিন্তু প্রসপেক্ট নেই, রে। তোর এত ভালো রেজাল্ট। হাউএভার তোর স্ট্রিম কমার্স হলে তবু খানিকটা দূর উঠতে পারতিস। নাহ। তুই দেবুদা আর শাশ্বতীবৌদির মেয়ে। তোর বাবাটা এত কম বয়সে… দাঁড়া।”

আমার বাপি দেবপ্রসাদ সান্যালকে বিভাসকাকু ‘দেবুদা’ বলে ডাকতো। বাপির কথায় মনটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, বিভাসকাকুর কথায় তাকালাম। তিনি বললেন, “রায়গড় যেতে পারবি?”

আমার মুখ দেখে তিনি হাসলেন, “বাড়িতে শাশ্বতীবৌদির সঙ্গে কথা বলে ভালো করে ভেবে-টেবে জানা। রায়গড় হল মধ্যপ্রদেশে। বড় শহর। সেখানে একটা বড় ফ্যাক্টরি আছে সিমার স্টিল অ্যান্ড পাওয়ারের।”

আমার তখন মরিয়া অবস্থা। বলে দিলাম, “মা’কে আমি ম্যানেজ করে নেবো। আমি যাবো।”

“তুই একদম দেবুদার মতো। ডেয়ারডেভিল। জানতাম তুই রাজি হবি। তবুও বৌদি’র ওপিনিয়ন নিস। আমি গতকাল সব কথাবার্তা একপ্রকার বলেই রেখেছি। তোর সেল-ফোন আছে?”

ইচ্ছে ছিল চাকরি পেয়েই প্রথমেই যে জিনিসটা কিনবো, সেটা একটা মোবাইল। আজকাল খুব চল হয়েছে। লোকের হাতে হাতে ঘুরছে। অবশ্য শব্দটা অনেক পরে চালু হয়েছে। সেইসময়ে লোকে বলত সেল-ফোন। আমি চুপ করে আছি দেখে তিনি প্যাডে কিছু লিখে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি পড়ে দেখলাম, তাতে একজন ভদ্রলোকের নাম লেখা আছে। পার্থ নারায়ণ ভট্টাচার্য। নামের নিচে একটা পাঁচ লাইনের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার।

“একটা মুশকিল আছে। তোকে যেতে হবে এই সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো কোনও ট্রেনের রিজার্ভেশন এখন পাবি না। সেটা কী ভাবে ম্যানেজ করবি ভেবে নে। আর যেতে না পারলে, কার্ডে আমার নাম্বার আছে। জানিয়ে দিস। আর এটা রাখ।”

তিনি ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “আপাতত কিছু টাকা আছে। লোন দিচ্ছি। ওখানে যা। মনে রাখিস, আমার রেফারেন্সে কিন্তু কিছু হবে না। তোকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। জয়েন করে গেলে আমার ধারটা মিটিয়ে দিস না হয়। আর নেগেটিভ হলে…”

“অত দূর যাবি? একা একটা মেয়ে হয়ে? কেউ যে সঙ্গে যাবে, তেমনও তো কেউ নেই রে।”

এটাই ছিল আমার মায়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া। বললাম, “নাও যেতে পারি। তবে শুধু টিউশনিতে তো আর সংসার চলবে না। ভাইয়ের পড়া তো ছেড়েই দাও। ভাবো। ভেবে জানাও।”

পরদিন ভোর ভোর ঘুম ভাঙ্গল কপালে মায়ের স্পর্শ পেয়ে। মা বললো, “যা। ভাবিস না সংসারের কথা ভেবে বললাম। কিন্তু তোর ভবিষ্যৎ তো আমি এইভাবে নষ্ট করতে পারি না। তোর বাপি বেঁচে থাকলে তোকে যেতেই বলতো। সাবধানে যাস। পাশেই স্বপনদার বাড়িতে তো টেলিফোন আছে। পৌঁছে জানিয়ে দিস। নইলে একটা টেলিগ্রাম। যাওয়ার আগে বাপিকে প্রণাম করে যাস।”

দিনটা ছিল শুক্রবার। তার আগের দিনই বিভাসকাকুকে ফোন করে বলে দিয়েছি, আমি কবে, কোন ট্রেনে যাচ্ছি, সব কিছু। যাই হোক, হাওড়া-সমরসতা ধরে শনিবার যখন রায়গড় জংশনে নামলাম, তখন আমার বিধ্বস্ত অবস্থা। রিজার্ভেশন পাওয়ার তো কোনও প্রশ্নই ছিল না। জেনারেল কম্পার্টমেন্টে একটা একচিলতে আসনে কোনও মতে পেছন ঠেকিয়ে, সারা রাত জেগে, বেলা সোয়া এগারোটা নাগাদ ট্রেন থেকে নামলাম। সঙ্গে লাগেজ বলতে একটা সুটকেসে কিছু জামাকাপড়, আমার সব সার্টিফিকেট আর নিতান্ত দরকারি কিছু জিনিসপত্র। কাঁধে একটা ব্যাগ, তাতে আমার মানি-পার্স, তাতে বিভাসকাকুর দেওয়া সেই ঠিকানা-লেখা কাগজ, বিভাসকাকু যা টাকা দিয়েছিলেন, তার অর্ধেকটা মার হাতে দিয়ে, অবশিষ্ট যা টাকা ছিল আর পুজোর ফুল, কিছু টুকিটাকি। ভেবেছিলাম, ট্রেন থেকে নেমেই ঠিকানাটা দেখে নেবো। কিন্তু স্টেশনে যা ভিড়, মাথা ঘুরে গেলো। যে যাকে পারছে, ধাক্কা মেরে চলে যাচ্ছে। আমি হাতের আর কাঁধের ব্যাগ সামলাতে সামলাতে যখন বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তার আগেই গোটা দশেক ধাক্কা সামলাতে হল।

বাইরে এসে অবশ্য মনটা ভালো হয়ে গেলো। হাওড়ার মত গ্যাঞ্জাম নয়। কী বিশাল চত্বর। আর বেশ ফাঁকা ফাঁকা। কাছে পিঠে কিছু প্রাইভেট গাড়ি। দূরে দূরে ট্যাক্সিচালকেরা দাঁড়িয়ে আছে। সামনে গাছ-লাগানো-ডিভাইডার দেওয়া তিন লেনের রৌদ্র-ধোয়া ঝকঝকে রাস্তা। সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি সুটকেসটা সিঁড়িতে নামিয়ে কাঁধের ব্যাগটা খুলতেই মাথা ঘুরে গেলো। আমার মানিপার্স? স্টেশনের সিঁড়িতেই বসে পড়ে পুরো ব্যাগটা উল্টে ফেললাম মেঝেয়। নাহ। সেটি নেই। না থাকার কারণটাও দৃশ্যগত হল একটু পরেই। ব্যাগের একদিকটা নিপুণভাবে কাটা। মানে, যারা যারা ধাক্কা মেরেছিল, তাদের মধ্যেই একজনের শিল্পকর্ম। কিন্তু ঐ পার্সেই তো ঠিকানাটা লেখা ছিল। আমি প্রাণপণে মনে করবার চেষ্টা করলাম। নামটা পার্থ নারায়ণ না পার্থ রঞ্জন? টাইটেল তো ভট্টাচার্য ছিল। কিন্তু ঠিকানা? মিনিট পনেরো ধরে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আমার মাথায় হাত পড়ে গেলো। সর্বনাশ! শুধু ঠিকানাই বেপাত্তা হল তাই নয়, আমার টাকাগুলোও গেলো। এখন এই অচেনা জায়গায় আমি নিঃস্ব। কী করে খুঁজে বের করবো ভদ্রলোকের ঠিকানা? কে আমাকে তাঁর কাছে বিনাপয়সায় পৌঁছে দেবে? কী ভাগ্যিস এগজিট গেটে টিকিট দেখতে চায়নি। টিকিটটাও পার্সে ছিল। ফাইন দিতে না পেরে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমার জেলযাত্রা ঘটতো।

মিনিট কুড়ি সেইভাবে বসে থাকলাম। খিদে আর তেষ্টায় ততক্ষণে আমার কাহিল অবস্থা। আচমকা মনে পড়ল, আচ্ছা, আমার সুটকেসে আমি কিছু টাকা রেখেছিলাম না? এটা আমার বাপির হ্যাবিট ছিল। কোথাও বেড়াতে গেলেই তিনি টাকাগুলো বিভিন্ন জায়গায় নিতেন। সুটকেসে, পার্সে, প্যান্টের চোর-পকেটে, এমনকি সিগারেটের প্যাকেও। উৎসাহিত হয়ে পাশে তাকাতেই আমার চোখের দৃষ্টি নিভে আসার যোগাড়। আমার সুটকেসটা তার জায়গায় নেই। নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করলো। যখন মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম, সেই সুযোগে…। আমার বুকটা হাহাকার করে উঠল। ওর মধ্যে যে আমার সার্টিফিকেটগুলো ছিল। হে ভগবান! বুঝলাম, এখন আমার হারাবার কিছু নেই, পাওয়ারও কিছু নেই।

স্টেশন-চত্বর যখন প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, তখনই একটা লাল রঙয়ের গাড়ি এসে থামলো। শূন্য দৃষ্টিতে দেখলাম। একজন সামার-স্যুট পরা লম্বা ভদ্রলোক নেমেই একপ্রকার দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। আরেকজন ভদ্রলোক আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখে ফের চলে গেলো। আমি শুধু ভাবছিলাম, এর পরে কী? একমাত্র রাস্তা ফিরতি ট্রেনে বিনা টিকিটে উঠে যাওয়া। পরে যা হবে দেখা যাবে। নয়তো এইসব রাস্তার পাশেই ভিক্ষে করতে বসে পড়া। তেষ্টায় আলজিভ অবধি শুকিয়ে আসছে। আশেপাশে কোথাও জলের কল আছে কিনা দেখার জন্য উঠতে যাবো, এমন সময় কানে এলো, “এক্সকিউজ মি।”

আমি চোখ তুলে দেখলাম, সেই সামার-স্যুট পরা ভদ্রলোক। গায়ের রঙ গৌরবর্ণ। চোখে হাল্কা ফ্রেমের চশমা। আমি উঠে দাঁড়ালাম, “বলুন।”

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি খানিক থমকালেন। কী একটা বলব, বলব করে বলেই ফেললেন, “আপনি কি শ্রবণা মুখার্জী?”

আমার নিজেকে হতবুদ্ধি লাগলো। কোনও মতে ‘হ্যাঁ’ বলতেই তিনি হেসে উঠলেন, “কী কাণ্ড! আমি এদিকে পুরো স্টেশন ঝাঁট দিয়ে ফেললাম? এখানকার স্টেশনমাষ্টার আমার ফ্রেন্ড। তাকে বললে, সে প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করে জানালো, এই নামে তো কেউ আসেনি। চিন্তায় পড়লাম। তবে যে বিভাস বললো, সমরসতাতেই আপনি আসছেন? তারপর ভাবলাম, যদি জেনারেলে এসে থাকেন? কী হলো ভাবতে ভাবতে বাইরে এসে দেখি… তো আপনি এইভাবে সিঁড়িতে বসে আছেন কেন? এই দেখুন, আমার নামটাই তো আপনি জানেন না। আমি পার্থ নারায়ণ ভট্টাচার্য।”

আমার তখন কেঁদে ফেলার অবস্থা। ঈশ্বর তাহলে আছেন? সত্যিই আছেন? আমার চোখে জল দেখে ভদ্রলোক সিরিয়াস মুখে বললেন, “কী হয়েছে! আর আপনার লাগেজ কই?”

আর চোখের জল আটকে রাখা গেলো না। ‘সব চুরি হয়ে গেছে’ বলেই আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। তারপর আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।

চওড়া কালো পিচে ঢাকা রাস্তা। কোথায় যাচ্ছি জানি না। পেছনের সিটে ভদ্রলোক আমার পাশে চুপ করে বসে আছেন। একটু আগেই এক বোতল জল এগিয়ে দিয়ে বলেছেন, “তুমি আমার ছেলের চাইতেও ছোট। তাই তুমি করেই বলছি, কেমন?”

কী আর বলি? গাড়ির ভেতরের ঠাণ্ডায় ততক্ষণে আমার দু’চোখ বুজে আসছিল। একটু হেসে ‘নিশ্চয়ই’ বলতেই তিনি বললেন, “গুড গড। কাবেরী অবশ্য বলছিলো, যাওয়ার কী দরকার, অ্যাড্রেস লেখা আছে, চলে আসবে। তবুও আমার কেমন জানি লাগলো। নতুন জায়গা। আজ আমার ছুটি। তাই ভাবলাম, যাই। ভাগ্যিস এসেছিলাম।”

দেখলাম, ওঁর হাতে একটা সেল-ফোন। উনি সেটাই দেখছেন। আমি বললাম, “আমার ড্রেস, আমার সার্টিফিকেট…”

“ড্রেস নিয়ে চিন্তা নেই। সব জোগাড় হয়ে যাবে। আর সার্টিফিকেট? শ্রবণা, তোমার সার্টিফিকেট তুমি নিজে। বিভাস তোমার কোয়ালিফিকেশন আমাকে বলেছে। আর কাবেরী তো আছে। সব হয়ে যাবে। কী কী সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছিলে, একটা লিস্ট বানিয়ে আমাকে দিও। আমি, বিভাসকে বলে, সব রি-ইস্যু করে নেবো। সময় লাগবে। বিভাসের অনেক হোল্ড। চিন্তা কোরো না। আপাতত, আমার কাজ তোমাকে কাবেরীর হাতে তুলে দেওয়া।”

তিনি শব্দ করে হাসলেন। আমি চিন্তায় পড়লাম। এঁর স্ত্রীর কী কাজ থাকতে পারে আমার সঙ্গে? ইনি নিশ্চয়ই কোনও উঁচু পোস্টে আছেন আর সেই সুত্রেই তো বিভাসকাকু এঁর কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন। তাহলে?

এক দৃষ্টিতে বাইরের চলমান রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় সম্ভবত আমার চোখ লেগে এসেছিল, চটকা ভাঙল ভদ্রলোকের কথায়, “ঘুমোলে নাকি? ঘুমিও না শ্রবণা, এখন চোখ চেয়ে দেখবার সময় তোমার।”

আমি লজ্জা পেয়ে হাসলাম। তারপর দেখলাম হাইওয়ে ছেড়ে গাড়ি এখন একটা মোটামুটি চওড়া রাস্তা ধরে চলেছে। দু’দিকে কী সুন্দর সুন্দর সব বাড়িঘর। এক পাশে একটা পার্ক। রাস্তার পাশে ফুলগাছের সারি। বাড়িঘরের আন্দাজে রাস্তায় লোক চলাচল কম। মুখে বলেও ফেললাম সে কথা।

“এখানে সব কাজের মানুষ। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান, সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। রাস্তায় ফর নাথিং হাঁটাহাঁটি, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা, তুমি ওগুলো এই সব লোকালিটিতে দেখতে পাবে না। আস্তে আস্তে সবই জানতে পারবে। আমরা কোটা মার্গ ছেড়ে এখন যে জায়গাটা দিয়ে চলেছি, এর নাম ক্রেস্ট গার্ডেন। সামনের মোড়ে এসে ডান দিকে টার্ন নিলে ক্রেস্ট ক্লাব, এখানকার ইনহ্যাবিটেন্টসদের জন্য খুব বড় একটা আড্ডা মারার জায়গা। পেছনে ছেড়ে এলাম দিশা কলেজ। এবার বাঁ দিকে ঘুরবো।”

আমি সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলাম। দেখলাম, গাড়িটা বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে গুনে গুনে ছ’টা বাড়ি পেরিয়ে সাত নাম্বারের সামনে দাঁড়াল। একজন উর্দিধারী লোক গেটের ভেতরে বসেছিল টুল পেতে। সে সেলাম ঠুকে দরজা খুলে দিতেই পার্থবাবু গাড়ি নিয়ে চৌহদ্দির ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে বাড়িটাকে দেখলাম। ভাইয়ের একটা বইতে বিদেশের পটভূমিকায় হুবহু এইরকম একটা ছবি দেখেছিলাম। এই বাড়িটা দোতলা। দোতলা থেকেই টালির আকৃতির ছাদ নেমে এসেছে কাত হয়ে। বাড়ি ঘিরে চারদিকে প্রচুর ঘাসে ঢাকা জমি। রকমারি ফুলের গাছ বাউন্ডারি ঘেঁষে। একদিকে একটা গ্যারেজ। চারদিকে প্রচুর গাছ আর গাছ। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, মোটামুটি সব বাড়িই একই ধাঁচের। বিস্তৃত গ্রিনারির মাঝখানে মিল্ক-হোয়াইট বাড়িগুলো দেখতে কী অপূর্ব যে লাগছিল।

পার্থবাবুর পেছন পেছন বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে তিন ধাপ সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিতেই পর্দা সরিয়ে যিনি আবির্ভূতা হলেন, আন্দাজে বুঝলাম ইনিই মিসেস কাবেরী ভট্টাচার্য, পার্থ নারায়ণবাবুর স্ত্রী। ভদ্রমহিলা তার যৌবন বয়সে মারকাটারি সুন্দরী ছিলেন বোঝাই যায়, তবে এখনও যা আছেন, অনেককে ফেল করিয়ে দিতে পারেন। মিসেস ভট্টাচার্য আমাকে একবার অপাঙ্গে দেখে নিয়ে কাকে যেন ডাকলেন। একটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে দাঁড়ালো। তিনি আমাকে দেখিয়ে বললেন, “একে, এর ঘর দেখিয়ে দাও। কী যেন নাম?”

ভদ্রমহিলা যেন ভদ্রলোকের ঠিক বিপরীত। আন্তরিকতার লেশমাত্র নেই। আমি যেন একজন রবাহূত। নাম বললাম।

ভদ্রমহিলা সরু ভ্রু তুললেন, “ইয়েস, শ্রবণা। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে নাও। পরে কথা হবে। আমি ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছি।”

শেষের শব্দ তিনটে নিশ্চয়ই আমার উদ্দেশ্যে নয়। অথচ উনি পার্থবাবুর দিকে ফিরেও তাকালেন না। আমি আর সময় নষ্ট না করে ঝপ করে ওঁকে প্রণাম করে ফেললাম। উনি তিরিশ সেকেন্ডের মত আমার মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। পার্থবাবুর মুখ গম্ভীর। বললেন, “সাবিত্রী, একে নিয়ে যাও। শ্রবণা, লাঞ্চে দেখা হচ্ছে।”

“উনি লাঞ্চ করবেন না?” আমি বলেই ফেললাম।

পার্থবাবু ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। হাসলেন, “নাহ। উনি প্রচুর ব্যস্ত মানুষ। ফ্যাক্টরিতেই লাঞ্চ সেরে নেন। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার বলে কথা। বুঝলে না?”

আমি বিস্ময়ের সীমায় পৌঁছে গেলাম, “আর আপনি?”

“আমি… ও মাই গড। তুমি কি ভাবলে তোমাকে কাজের জন্য বিভাস আমার কাছে পাঠিয়েছে? আরে না, না। আমি তো ব্যাঙ্কের কলমপেষা স্টাফ। আমার উনি… উনিই তোমার জন্য যা করার করবেন। লেগে থেকো। না পারলে কিন্তু ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।”

মনে পড়ল আমি কিন্তু এখনও এঁকে প্রণাম করিনি। প্রণাম করতেই পার্থবাবু হাসলেন, “আশীর্বাদ করলাম। আর হ্যাঁ। প্লিজ কল মি, আঙ্কল।”

“ও। আচ্ছা, আমি একটা ফোন করতে পারি? আমার বাড়িতে?”

পার্থ-আঙ্কল একটা ল্যান্ডলাইন দেখিয়ে দিয়ে দোতলায় চলে গেলেন। আমি ফোন সেরে সাবিত্রী নামের মেয়েটির পিছু পিছু বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে ভাবলাম, মিসেস কাবেরী ভট্টাচার্যই তাহলে আমার ইন্টারভিউ নেবেন? সর্বনাশ!

ইন্টারভিউ পর্ব অল্পেতে সেরে নিয়েই কাবেরীদেবী বললেন, “আমাদের কোম্পানি স্ট্রাকচারাল স্টিল, প্লেট, প্লেট ছাড়াও, অ্যাঙ্গেল চ্যানেল, এইচবি, আইবিম, এই রকম নানা ধরণের বিম বানায়। একটা লিকুইড মেটাল থ্যেকে সেগুলোকে সলিটিফাই করে সেখান থেকে সেগুলোকে ফারদার প্রসেস করে ওগুলোকে রোলিং করা হয়। প্লেট রোলিং মানে একটা স্ল্যাব থেকে ওটাকে ডাইরেক্ট রোলিং করে একটা রোলার উপরে বড় রোলার দিয়ে ওটাকে, সাপোজ যদি একটা স্ল্যাবের লম্বা-চওড়া তিনশ বাই দুশো হয়, তখন তার থিকনেস রিডিউস করে একটা পার্টিকুলার টেম্পারেচারে রেইজ করা হয়, অলমোস্ট হাজারের কাছাকাছি, তখন ওটাকে ওয়ান পাস, টু পাস করে, সেটা ডিজায়ার্ড থিকনেসে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে স্যাম্পল কালেক্ট করে কোয়ালিটি টেস্ট করা হয়। যদি পাস হয়ে যায়, তবে প্রাইম কোয়ালিটি, সেকেন্ডারি কোয়ালিটিতে ভাগ করা হয়। তবে চেষ্টা থাকে, যত প্রাইম কোয়ালিটি হবে, ততই কোম্পানির প্রফিট, ম্যানেজমেন্ট ওয়ার্কশিপ সেগুলো ভালো হয়, কোম্পানি-কস্ট-সেভ হয়। সেদিকে নজর রাখতে হয়।”

“আমার কাজটা?” আমি কোনওমতে জানতে চাই।

“ইনিশিয়ালি তোমার ডাইরেক্ট কাজ বলে কিছু নেই। ধরে নাও, প্রবেশনারী পিরিয়ডে আছো। একজন এক্সপেরিয়েন্সড ইঞ্জিনিয়ারের আন্ডারে তোমাকে দিয়ে দেবো। সে তোমাকে মেন্টর-গাইড করে দেবে। তুমি নিজে হাতে কাজ শেখো। স্টিলকে যে ফর্মেশনে আনা হচ্ছে, সাপোজ পনেরোশো ডিগ্রিতে মেল্টিং হচ্ছে যেখানে, সেখানে তোমাকে দেবো। একদম কাছে গিয়ে কাজ করতে হবে। অবশ্য তোমার অ্যাডেকোয়েট প্রোটেকশন-ড্রেস দেওয়া হবে, বাট, ইউ উইল ফিল ডাইরেক্ট হিট ফর দ্য ফ্রম দ্য ল্যাডেল। তবে তোমার এবং সবারই, যাতে কোনও ফিজিক্যাল লস না হয়, তার জন্য হেলথ অ্যান্ড সেফটি টিম আছে। এ বাদেও অনেক অ্যান্সিলিয়ারি জব আছে, সেগুলো শিখতে হবে।”

তারপর আরও প্রচুর জ্ঞান-গর্ভ বক্তৃতার শেষে তিনি বললেন, “মোট কথা, কাজে যখন ঢুকবে তখন হাসিমুখে ঢুকবে, পরের আটঘণ্টা অনেক প্রচুর কষ্ট হবে, তবে যখন বেরোবে তখনও হাসিমুখে থাকবে।”

“তুমি কিন্তু এবার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে গো। এতো কী ভাবচো বলো দিকি? কাবেরীমাসিকে নিয়ে? কী করবে বলো। মানুষ কি চিরকাল…”

“রত্নাদি, চুপ করে থাকো। কোনও কথাবার্তা ভালো লাগছে না।”

“সে না হয় থাকলুম। কিন্ত হাতের কফি তো জল। আরেকটি কাপ দোবো, নাকি চানটা সেরে নেবে?”

“দাদাবাবুরা ফেরেনি?”

রত্নাদি গালে হাত দিল, “শোনো কথা। শ্মশান-মশানে আজকাল কী লাইন পড়ে বলো দিকি। ওদের ফিরতে দেরি আচে।”

আমি হোয়াটসঅ্যাপে দেখলাম, সাম্য মেসেজ পাঠিয়েছে। দু’টো। ‘রিচড গড়িয়া ক্রিমেটোরিয়াম’ আর ‘ভেরি ক্রাউডেড। উই আর ইন কিউ। ইট উইল বি লেট টু রিটার্ন, এক্সপেক্টেড।’

আমি স্নান সেরে রত্নাদিকে ‘দাদাবাবুরা ফিরলে ডেকো’ বলে উমা-মেঘাদের বেডরুমে টানটান হলাম।

ট্রেনি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ যোগ দিলাম। সোমবার। বাড়িতে জানিয়ে দিলাম, জানিয়ে দিলাম বিভাসকাকুকেও। ঠিক তার আগের দিন, রবিবার, এক অদ্ভুত প্রাণীর সঙ্গে মোলাকাত হয়ে গেলো। দুপুরে আমি, পার্থ-আঙ্কল আর কাবেরীদেবী এক সঙ্গে খেতে বসেছি, একটি ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের যুবক ঢুকে এলো ডাইনিং-রুমে। এর কথা লাঞ্চ-টেবিলে একটু আগেই পার্থ-আঙ্কল বলেছেন। ওদের একমাত্র পুত্র উচ্ছ্বাস। সে নাকি কাল গভীর রাতে এসে উপস্থিত হয়েছে। পার্থ-আঙ্কল এও জানিয়েছেন, উচ্ছ্বাস যে কখন বাড়িতে থাকে আর কখন বাইরে, তার কোনও হিসেব নেই। বাইরে গেলে কবে ফিরবে, কেউ জানে না। বুঝলাম, বড়লোকের বিগড়া-হুয়া-অওলাদ। উচ্ছ্বাসের বাড়ি আসার খবরটা পার্থ-আঙ্কল নিজেই পেয়েছেন সাবিত্রীর মুখে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, যদি দাদা এসেই থাকেন, তাহলে লাঞ্চে জয়েন করলেন না কেন? কাবেরীদেবী একবার খাওয়া থামিয়ে আমার মুখের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চাইলেন। পার্থ-আঙ্কল বললেন, “সে কি বাড়িতে আছে? কে জানে। সকাল নাগাদ তো দেখলাম গাড়ি নিয়ে বেরোলো। এর পরে…”

পার্থ-আঙ্কলের কথা ফুরোবার আগেই বাইরে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষার শব্দ হল। কাবেরীদেবী মুখ দিয়ে একটা শব্দ করলেন, যেটা বিরক্তিসুচক। দেখতে দেখতে ডাইনিং হলে যে প্রবেশ করলো, তাকে দেখেই চিনতে পারলাম। পার্থ-আঙ্কলের সঙ্গে মুখের প্রচণ্ড মিল। চেহারাতেও। বেশ লম্বা, প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি। মুখে চাপদাড়ি। পেটানো চেহারা। চুল উস্কোখুস্কো। পোশাক কিন্তু বেশ রুচিসম্মত। খয়েরি পাতলুনের ভেতরে সাদা সার্ট ইন করে পরা। পায়ে চকচকে বুট। এই তাহলে উচ্ছ্বাস? সে ঘরে ঢুকেই এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল, “আমার সঙ্গে লাঞ্চ করতে তোমাদের ভালো লাগে না। তাই না?”

কাবেরীদেবীর খাওয়া থেমে গেছে, “উচ্ছ্বাস, কতোদিন বলেছি, জুতো পরে খাওয়ার ঘরে তুমি ঢুকবে না।”

উচ্ছ্বাস পার্থ-আঙ্কলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বাড়িটা কি আমারও নয়? আমার যদি ইচ্ছা করে জুতো পরে ঢুকতে সেখানে বাধা কোথায়? বাড়িতে চাকর-বাকর রাখা হয়েছে কি মুখ দেখতে?”

আমার লজ্জা লাগলো। কী বাবা-মায়ের কী সন্তান! পার্থ-আঙ্কল বললেন, “আহা, তুমি যে দুপুরেই বাড়ি ফিরে আসবে, সেটা আমরা জানবো কী করে? জানতে পারলে…”

“সেটা আমাকে ফোন করে নিলেই হতো। আমি বলে দিতাম। সব বুঝি। একজন বাইরের লোকের সঙ্গে বসে খেতে তোমাদের প্রবলেম হয় না। শুধু আমাকে…”

আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। কী অসভ্য ছেলে রে বাবা। খারাপ লাগলো। এখানে ‘বাইরের লোক’ একমাত্র আমি। অকারণে ছেলেটি অপমান করলো? পার্থ-আঙ্কল আর কাবেরীদেবী চুপ। উচ্ছ্বাস অবশ্য থামলো না, “তোমরা দুজনেই বোকা, বোকার হদ্দ। যতো সুযোগখোরের দল, সব এখানে এসে জোটে। তবে চিন্তা নেই। আমি রাতের ট্রেনেই ফিরে যাচ্ছি। তাতে আমারও শান্তি, তোমাদেরও।”

জুতোতে মচ মচ শব্দ তুলে উচ্ছ্বাস বেরিয়ে গেলো। আমি মাথা নামিয়ে বসে ছিলাম। কাবেরীদেবীও। আমাদের দু’জনের অপমান দু’রকমের। পার্থ-আঙ্কল আমার মাথায় হাত রাখলেন, “ও আমাদের পাগল ছেলে। ওর কথায় কিছু মনে কোরো না। তুমি খাওয়াটা কমপ্লিট করে নাও।”

আমি নিচুস্বরে বললাম, “আই হ্যাভ ডান।”

পার্থ-আঙ্কল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “জানো শ্রবণা, ছেলেটার মেরিট ভালো ছিল। ডাক্তারিটা পাশ করলো। কিছুদিন প্র্যাকটিসও করলো। তারপর সব ছেড়েছুড়ে কোন এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে বিজনেসে লেগে গেলো। ও কী করে, আমি জানি না, ও-ও বলে না। অবশ্য এর পেছনে একটা কারণ আছে।”

কাবেরীদেবী বলে উঠলেন, “শ্রবণা, তোমার খাওয়া হয়ে থাকলে উঠে পড়ো। তোমার বেডরুমে রিডার্স-টেবিলের উপরে কিছু পেপারস রাখা আছে দেখতে পাবে। সেগুলো গো-থ্রু করে নাও। কাল ন’টার মধ্যে রেডি হয়ে থেকো। আমি তোমাকে নিয়ে ফ্যাক্টরিতে যাবো।”

বুঝলাম, তিনি কথাগুলো বললেন, পার্থ-আঙ্কলকে থামানোর জন্য। পার্থ-আঙ্কল অবশ্য স্ত্রীর কথা শেষ হলে শুরু করলেন, “উচ্ছ্বাস ইংলিশ লিটারেচার নিয়ে পড়তে চেয়েছিলো।”

“তাহলে তাকে সেটা করতে দিলেই তো হতো।” আমি বললাম।

“শ্রবণা, সবাই যদি তোমার মতো ভাবতো। কেউ কেউ নিজের জেদটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলে।”

পার্থ-আঙ্কল উঠে চলে গেলেন। তীরটা যে কাবেরীদেবীর জন্য সেটা বুঝতে পারলাম। আমি আর ওঁর দিকে না তাকিয়ে উঠে হাত ধুতে চলে গেলাম।

দুপুরে ঘুমোনো আমার কোনওদিনেরই অভ্যেস নয়। কাবেরীদেবীর পাঠানো পেপারগুলো একদম প্রথম থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলাম। কিছু পেপার একটা প্ল্যান্টের গোড়াপত্তন থেকে শেষ অবধি কমপ্লিট ডায়াগ্রাম আর ইনফরমেশনে ভর্তি। পরের লটটায় একটা চালু ফ্যাক্টরির খুঁটিনাটি ব্যাপারে। নানান ইঞ্জিনিয়ানিং কারুকুরির ডিটেইলস নিয়ে পাতার পরে পাতা। তার মধ্যে ডিজাইনিং, নিউ ইকুইপমেন্ট টেস্টিং, ইকুইপমেন্ট ইনস্টলিং, অ্যাসেম্বলিং, ইমপ্লিমেন্টেশন অফ ইলেকট্রিক্যাল স্ট্রাকচারস, নন-কেমিক্যাল অ্যান্ড নন-বায়োকেমিক্যাল জবস এইসব তো আছেই, তার উপরে ইঞ্জেকশন মোল্ডিং, থ্রিডি প্রিন্টিং, প্রেশিসন মেজারমেন্ট এইরকম হাজারো। আসলে খাতায় কলমে শেখা আর একেবারে কর্মক্ষেত্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাতে ধরে শেখা, একটা বড় পার্থক্য তো থেকেই যায়।

কতক্ষণ ডুবে ছিলাম জানি না। একসময় দিনের আলো কমে এলে ক্লান্ত বোধ করলাম। পেপারগুলো গুছিয়ে রেখে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে, এই অবধি দেখা মানুষগুলোকে, অ্যাসেস করবার চেষ্টা করলাম। পার্থ-আঙ্কল মানুষটাকে, এখনও অবধি, নিপাট ভালোমানুষ বলেই তো মনে হচ্ছে। তবে একটা মানুষকে তো আরেকজন সারাজীবনেও সঠিক চিনে উঠতে পারে না। কাবেরীদেবীকে যতটা বাইরে থেকে হার্ড-শেল মনে হচ্ছে, আশা করি ততটা উনি নন। তা ছাড়া, এটা তো সত্যি, অত বড় কোম্পানির অত উঁচু পোস্টে উনি আছেন আর আমি নিতান্ত চুনোপুঁটি। এটুকু ট্যানট্রাম তো ওঁকে রাখতেই হবে। দেখা যাক পরে কী দাঁড়ায়। তবে বিভাসকাকু সেরা মানুষ। আমার কাছে ঈশ্বর-প্রেরিত দূত। তার কী দায় ছিল অ্যাদ্দিন বাদে ফিরে এসে পুরোনো বন্ধু-কন্যার জন্য এতটা করার? যদি চাকরিটা টিকে যায়, তবে এই ভটচাজ-ফ্যামিলির সঙ্গে সঙ্গে বিভাসকাকুর কাছেও আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। ভটচাজ-ফ্যামিলির কথা মনে আসতেই উচ্ছ্বাসের মুখটা মনে পড়লো। ওর সঙ্গে ওর প্যারেন্টসদের প্রবলেম থাকতেই পারে, সেটা ওদের পার্সোনাল ব্যাপার। আমি আউটসাইডার, আমাকে ফর নাথিং অপমান করতে গেলো কেন? নাকি এটাই ওর স্বভাব? বাজে ছেলে একটা।

কিন্তু আরও বড় একটা প্রশ্নচিহ্ন চোখের সামনে ঝুলে আছে। পার্থ-আঙ্কল আর কাবেরীদেবী একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন না কেন? ওঁদের কি ঝগড়া হয়েছে?

এমন সময় সাবিত্রী ঘরে ঢুকে লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেলো আর আমিও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ধমকালাম, ‘তুই যা করতে এসেছিস, তাই কর মন দিয়ে, অন্যের ব্যাপারে অনধিকার চর্চা করছিস কেন?’

ট্রেনি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেখতে দেখতে মাস দুয়েক কেটে গেলো। আমি রীতিমত ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কত কী শিখলাম এই দু’মাসেই। তা সে যে পাত্রে স্টিল-মেল্টিং হচ্ছে, সেই ল্যাডেলের, প্রপার কোয়ালিটি-ম্যানুফ্যাকচারিং হোক বা রোলিঙয়ের ইরোশন আটকাবার ওয়েল্ডিং প্রসেসিং হোক বা স্টিলের সারফেসকে কীভাবে ডিপ্রেসন বা ডেন্ট থেকে বাঁচাতে হয় তাই হোক, সব বিষয়ে কম-বেশি জ্ঞান ঠুসে নিয়েছিলাম মগজে। মানে একটা স্টিল মেকিং ফ্যাক্টরি বানাতে গেলে যা যা লাগে, মানে একদম শুরু থেকে র-মেটেরিয়াল, মানে আয়রন-ওর, ডলোমাইট, কোল, ফ্ল্যাক্স, আরও ইনগ্রেডিয়েন্টস… সব ব্যাপারেই আমাকে আর আমার মত ট্রেনি ইঞ্জিনিয়ারদের ঠেলে দিচ্ছিল কোম্পানি। আমাকে মূলত ফ্যাব্রিকেশন ডিপার্টমেন্ট দেওয়া হলেও, প্রায় সব জায়গাতেই পাঠানো হতো। সে লোহার খনিই হোক, বা কোথায় ও কীভাবে সেই লোহা প্রসেস হচ্ছে সেটাই হোক, কীভাবে ও কোথা থেকে মেল্টিংয়ে পাঠানো হচ্ছে, ব্লাস্ট ফার্নেস, যেখানে লোহা গলিয়ে কীভাবে স্টিল বানানো হয়, খাদ-ফাদ বাদ দিয়ে, তারপরে ক্রেন-অপারেশনের ব্যাপারটা তার নানারকম প্রসেস স্বচক্ষে দেখে প্রচুর কাজ শিখে নিয়েছিলাম। এ বাদেও কীভাবে সি-শেপে, আই-শেপে স্টিল বানানো হয়, ফ্ল্যাঞ্জ, ওয়েব কাকে বলে এইসব একদিন খাতায়-কলমে শিখেছিলাম, এবার হাতে-কলমে করে দেখলাম। ভালো কথা, একদম শুরুর দিন থেকেই আমার একটা মেডিক্যাল কার্ড করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অত গরম ল্যাডেলের সামনে কাজ করতে গিয়ে শরীর-ফরির খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল।

আমার ভাগ্য ভালো আমার ইমিডিয়েট বস ছিলেন, সিনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার, অশোক মালহোত্রা। বয়স আন্দাজ চল্লিশ থেকে চুয়াল্লিশের মধ্যে। ভারি সজ্জন লোক। আমার সঙ্গে মালহোত্রা-স্যারের যখন ফার্স্ট ইনট্রোডাকশন করিয়ে দিলেন কাবেরীম্যাম, তিনি চোখ কপালে তুলে, হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে বলেছিলেন, “আপনি তো বাচ্চা মেয়ে! এক্সপেরিয়েন্স আছে?”

আমি বলেছিলাম, “স্যার, আমি এফই, পিই এগজাম…”

“দূর দূর। ফেলে দিন। ওসব তো বানানো জিনিসে হাত পাকানো। অল আর্টিফিশিয়াল। এসি ঘরে বসে ফিল্ম কী করে বানাতে হয় শেখা আর হেভি সানলাইটে রাস্তায় নেমে, উইদিন ক্রাউড, শ্যুট করা কি এক জিনিস?”

স্বীকার করলাম, মোটেও এক নয়। সেদিন আড়চোখে দেখেছিলাম কাবেরীম্যামের ঠোঁটের কোনে হাসি।

“ওখানে ওরা যা জানে তাই শেখায়। অ্যাকচুয়াল ফিল্ডে কাজে নেমে নতুন নতুন আইডিয়ার ইনোভেশন হয় মিস…”

“সান্যাল, শ্রবণা স্যান্যাল, স্যার।”

ওঁর জিভের কারণেই হয়ত ‘শ্রবণা’ নামটা উনি সঠিক উচ্চারণ করতে পারলেন না। পরেও পারেননি, কোনদিনই। বলেছিলেন, “ভেরি গুড নেম। সরবণা সান্যাল।”

পরে, বাড়িতে ফিরে, কাবেরীম্যাম বলেছিলেন, “তবুও ভালো, সরবণা বলেছে। শেষে একটা শ লাগালেই সর্বনাশ হয়ে যেত।”

বলেই খুব হাসছিলেন। সেই প্রথমবার তাকে প্রাণখুলে হাসতে দেখেছিলাম। আমিও সেই হাসিতে যোগ দিতে দিতে ভাবছিলাম, তাহলে আমি ঠিকই ধরেছি। ওঁর হার্ড-শেল ব্যাপারটা শুধুই বাইরের একটা খোলস মাত্র। ঠিক সেই সময়ে ঘরে পার্থ-আঙ্কল ঢুকতেই গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন কাবেরীম্যাম। এদের কী যে সমস্যা কিছুতেই বুঝি না। আমি শুনেছি, দম্পতিদের মধ্যে রাগারাগিটা ন্যাচারাল। আমার বাপি-মায়ের মধ্যেও হতো। কিন্তু এ তো দিনের পর দিন প্রেজেন্ট কনটিনিউয়াস টেন্স।

“ইয়েস সরবণা, যা বলছিলাম। এখানে আপনাকে ইনোভেটিভ হতে হবে। আপনি যদি ভেবে বসে থাকেন, মিস্টার মালহোত্রা যা অর্ডার দেবে, সেটাই আপনি ব্লাইন্ডলি অ্যান্ড লিটার‍্যালি অ্যাক্সেপ্ট করবেন, সেটাই অ্যাপ্লাই করবেন, তাহলে আপনার চাকরিটা হয়তো টিকে যাবে, বাট ইউর প্রোগ্রেস উইল বি স্লোয়ার, ইওর নলেজ উইল বি লাইক আ সেস পুল, আ ব্লাইন্ড লেন। আন্ডারস্টুড?”

এগারো মাসের মাথায় আমি সিনিয়ার অ্যাসোসিয়েট ইঞ্জিনিয়ার পোস্টে উন্নীত হলাম। কলিগরা সেলিব্রেট করল। পার্থ-আঙ্কল আমাকে একটা সেল-ফোন গিফট করলেন। বললেন, “যাক, নিজেকে প্রমাণ করেই ছাড়লে। এটা ধরো। দিলাম তার কারণ, আর তোমাকে আমার ল্যান্ডলাইনের বিল বাড়াতে দেবো না। এবার নিজের খরচ নিজেই চালাও।” বলেই হাহা করে হেসেছিলেন। ফোন পেয়েই প্রথমে কল করেছিলাম বিভাসকাকুকে। কাকু ভীষণ খুশি। বললেন, কোলকাতা ফিরলে ট্রিট দেবেন। তারপরেই ফোন করেছিলাম স্বপনকাকু মারফত মাকে এবং ভাইকেও। সবার খবরাখবর নিলাম। মা শুধু বললো, “কতদিন তোকে দেখিনি। একটিবার আয়।” বললাম, “আর কিছুদিন সময় দাও মা, আসবো।” এখানে বলে রাখা ভালো, চাকরির প্রথম বেতন পাওয়ার পর থেকে এই এগারো মাস ধরে প্রতিমাসেই আমি বাড়িতে সিংহভাগ টাকা পাঠিয়ে দিই।

কাবেরীম্যামের মধ্যে অবশ্য তেমন কোনও ভাবাবেগ দেখা গেলো না। জাস্ট একটা ব্যাপার ছাড়া। একদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে উনি বললেন, “শ্রবণা, তোমার কাজে তোমার ইমিডিয়েট বসেরা বেশ খুশি। গুড। এই পারফরমেন্স থাকলে বছর দেড়েকের মধ্যে ইউ উইল প্রোমোটেড অ্যাজ ইঞ্জিনিয়ার।”

ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করি, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হয়ে আমার কাজ আপনার ভালো লাগেনি? কিন্তু সাহস হলো না। তিনি বলে চললেন, “তাই বলে ভেবো না, আমি তোমাকে সার্টিফাই করছি। এখন আরও খাটতে হবে। তোমার প্রোমোশনের আরেকটা কারণ আছে। এবার থেকে তোমাকে একটা নতুন প্রজেক্টে কাজ করতে হবে। এখান থেকে তেরো চোদ্দ কিলোমিটার দূরে বস্তারনগরে আমাদের নতুন একটা প্রজেক্ট চালু হয়েছে। এখনও প্রোডাকশন চালু হয়নি। আগামী মাসের পয়লা তারিখ থেকে। একটা পুরো টিম যাবে, তার মধ্যে তুমিও আছো। তোমার নিজস্ব রেসপন্সিবিলিটি ছাড়াও কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার হয়েও কাজ করতে হবে।”

নতুন জায়গায়, নতুন দায়িত্ব, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। এরপরেই ম্যাম যা বললেন, আমি তো হাঁ। ভীষণ গম্ভীর হয়ে বললেন, “শোনো শ্রবণা, অত খটমট নামে তোমাকে ডাকতে আমার প্রবলেম হচ্ছে। আমি যদি তোমাকে বনা ডাকি, আপত্তি?”

আপত্তি! আমি সজোরে মাথা নাড়লাম। তিনি বললেন, “গুড।”

উনি উঠে চলে গেলে পার্থ-আঙ্কল বললেন, ““দূর, শ্রবণাই বেটার, বনা শুনলে কেমন বনিবনা মনে হয়।”

আমি শব্দ করে হেসে উঠেছিলাম। পার্থ-আঙ্কল আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “কী রে, বাড়ি যাবি?”

সেই প্রথম উনি আমাকে ‘তুই’ করে সম্বোধন করলেন। আমার মনে হল, ঠিক যেন আমার বাপি আমার মাথায় হাত রেখেছেন। আমি আঙ্কলের হাত ধরে ফেললাম, “খুব ইচ্ছে করে মা’কে দেখতে, ভাই’কে দেখতে। কিন্তু আঙ্কল, এখন না। তার উপরে তো শুনলেন, নতুন প্রজেক্ট। এখন লিভ অ্যাপ্লিকেশন সাবমিট করলে ম্যাম হয়ত অ্যাক্সেপ্ট করে দেবেন, কিন্তু আমার মন মানবে না। আরও মাস তিনেক যাক। আমি আপনাকে ঠিক বলবো।”

পার্থ-আঙ্কল আমার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বললাম, “কী দেখছেন?”

তিনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার মেয়ে হলে ঠিক তোর মত দেখতে হতো।”

“আমি তো আপনার মেয়ের মতোই, আঙ্কল।”

“তা নয় রে। তুই তো কাবেরীকে ইয়াং এজে দেখিসনি। তোকে স্টেশনে দেখেই আমি থমকে গেছিলাম। তোর মুখের আদল অনেকটাই ইয়াং কাবেরীর মতো। এখন তো চর্বি-ফর্বি জমে…”

আর কথা না বাড়িয়ে উঠে গেলেন আঙ্কল। খুব ইচ্ছে হল, জিজ্ঞেস করি, আপনারা একই বাড়িতে থেকে আলাদা ঘরে থাকেন কেন। এটা অবশ্য শোনা-কথা নয়। সাবিত্রীর সঙ্গে সারা বাড়ি ঘুরে বেরিয়েছিলাম একদিন। তখনই জেনেছিলাম। দেখেওছিলাম। দু’জনের ঘরই দোতলায়, তবে দুই প্রান্তের দুটো ঘরে, একটা করে সিঙ্গল বিছানা পাতা। কেন? কে উত্তর দেবে?

নতুন প্রজেক্টে কাজ করতে হবে শুনে প্রথমে খানিকটা চিন্তায় পড়লেও পরে তলিয়ে ভেবে অনেকটাই স্বস্তি পেলাম। তার কারণ আছে। প্রথম প্রথম কাবেরীম্যাম রোজ আমাকে নিয়েই বাড়ি ফিরতেন। এটা ম্যামের নিজস্ব গাড়ি। আরেকটা আছে পার্থ-আঙ্কলের। ছেলের আবার স্বতন্ত্র। বড়লোকদের ব্যাপারই আলাদা। যাই হোক, ফেরাটা ম্যামের সঙ্গে হলেও যাওয়াটা আমি বাসেই যেতাম। ম্যামের সঙ্গে আমার ফেরাটা নিয়ে প্রথম প্রসঙ্গ তুলেছিল সিদ্ধার্থ। আমার এক কলিগ। সিদ্ধার্থ সর্বজ্ঞ। বেশ ভালো চটপটে ছেলে। বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা। ঝরঝরে বাংলা বলতে পারে। বলেছিল, “দ্যাখ শ্রবণা, ম্যামের বাড়িতে তুই থাকার চান্স পেয়েছিস। আবার একই গাড়িতে বাড়ি যাচ্ছিস। তুই কিন্তু হেব্বি লাকি। বাট…”

“বাট?”

“দ্যাখ, আমি তোর ভালো চাই। ইতিমধ্যে অনেকেই বলাবলি করছে। তোকে নাকি ম্যাম বেশি ফেবার করছেন। তুই কি ম্যামের রিলেটিভ হোস?”

আমি হেসে উঠে বলেছিলাম, “দূর দূর থেকে না, স্বপ্নের জগতেও না।”

সিদ্ধার্থ গম্ভীর হয়েছিল, “আবার দ্যাখ, বছর পেরোবার আগেই প্রোমোশন। আমার তো পৌনে দু’বছর লেগেছিল। সবাই ভাবছে, ম্যামের স্পেশাল রেকমেন্ডশনেই…”

“কী যা তা! যারা বলছে, তাদের ম্যামের কাছেই স্ট্রেইট দরবার করতে বল না।”

“আমি একটা কথা বলি? তুই তো আসিস বাসে। ফেরাটাও বাসে করে নে। নইলে আমার সঙ্গে মোটরবাইক আছে। আমি তোকে নামিয়ে দেবো।”

পরের দিনগুলোতে সিদ্ধার্থই আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতো। ওর বাড়ি বিরাটগঞ্জ কলোনীতে। ক্রেস্ট গার্ডেন থেকে বেশি দূরে নয়। ম্যামকে ম্যানেজ করেছিলাম, এক্সট্রা ওয়ার্কিং-লোডের অজুহাত দেখিয়ে। জানি না, ম্যাম বুঝতে পেরেছিলেন কিনা। তাই যখন নতুন প্রজেক্টে জয়েন করবার কথা এলো, আমি বেঁচে গেলাম। আর সুসংবাদ হল, আমার সঙ্গে ট্রান্সফার্ড হচ্ছে সিদ্ধার্থও।

একদিন সকালে। আজ এই ফ্যাক্টরিতে আমার লাস্ট ডে। ব্রেকফাস্ট সেরে নিজের ঘরে গিয়ে ভাবছিলাম, সেদিন কী ড্রেস পরবো। এখানে আসার সেই প্রথমদিনই আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে চার সেট জামাকাপড়, মায় অন্তর্বাস কিনে দিয়েছিলেন কাবেরীম্যাম। বলেছিলেন, “ভুলেও এগুলোর বিনিময়ে কিছু রিটার্ন গিফট করতে চেও না। পয়সা পেলে জমাও। তোমারই কাজে আসবে।” আমি অবশ্য সে চেষ্টা করিনি। স্যালারি পেয়ে নিজের জন্য ভালো কিছু ড্রেস মেটেরিয়ালস কিনেছি। আর লিপস্টিক, ক্রিম এইসব।

আজ সকাল থেকেই মনটা ফুরফুরে ছিল। পার্থ-আঙ্কল আর বিভাসকাকুর যৌথ উদ্যোগেই আমার সব সার্টিফিকেটের কপি রি-ইস্যু করা গেছে। সেগুলোর স্ক্যানড কপি পার্থ-আঙ্কলকে মেইল করেছেন বিভাসকাকু। পার্থ-আঙ্কল ফরোয়ার্ড করে দিয়েছে কাবেরী ম্যামের ইমেলে। এগুলো সত্যিই দরকার ছিলো, অফিসিয়াল রেকর্ডবুকে রাখার জন্য। আরও একটা কাজ হয়েছে। পার্থ-আঙ্কল আমার একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলেন তার ব্রাঞ্চে। স্যালারির চেকটা সেখানেই জমা করে দিতেন, আবার তুলতেও হতো চেক দিয়েই। কাজটা সহজ শোনালেও বেশ কঠিন ছিল। কারণ আমার আইডেনটিটি প্রুফ বলতে কিছুই ছিলো না। পার্থ-আঙ্কল, জানি না কী পোস্টে আছেন, নিজে গ্যারান্টার হয়ে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলেন। আমাকে ব্যাঙ্কেও যেতে হয়নি। এবার আইডেনটিটি প্রুফগুলো ব্যাঙ্কের কাজেও আসবে। শুনেছিলাম, মিন্দালের সব স্টাফের স্যালারি অ্যাকাউন্ট নাকি সেই ব্যাঙ্কেই।

আচমকা দরজায় শব্দ হলো, “আসতে পারি?”

বলেই অনুমতির প্রত্যাশা না করে ঘরের মধ্যে উদয় হলো উচ্ছ্বাস। আমি সিঁটিয়ে গেলাম। আবার কী অভিযোগের তীর ছুড়তে এসেছে ছেলেটা?

উচ্ছ্বাসের ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি, “মেয়েরা খুব ভালো যাদু জানে, জানো?”

কী বলব? আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

“খুব ভালো করেই জানো। অ্যাই, তোমার মতলবটা কী বলো তো? মিস্টার ভটচাজকে কোন মন্ত্র জপিয়েছো? উড়ে এসে জুড়ে বসা, তারপরে এতো ফার্স্ট কাবেরীদেবীর মতো মানুষকে বশে আনা, প্রমোশন বাগিয়ে নেওয়া। স্যালারিও নিশ্চয়ই বেড়েছে? বেশ গুছিয়ে খেলতে নেমেছো, তাই না?”

অপমানে আমার চোখ ফেটে জল বেরোতে চাইল।

“তোমার সোর্সটা কী? স্পিক আউট, স্পিক আউট। সেই মহেশ মিত্রের কেউ হও নাকি? ঝেড়ে কাশো তো। ঐ সব চোখে জল-ফল এনে তুমি পার্থ নারায়ণ ভটচাজকে গলাতে পারবে, উচ্ছ্বাস ভটচাজকে নয়। কেসটা কী?”

আমি কোনওমতে বলতে পারলাম, “আপনার যা জিজ্ঞাসা করবার, দয়া করে আপনার বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করুন। প্লিজ, আমি কোনও মহেশ মিত্তিরকে চিনি না। আর আপনি আমাকে ফর নাথিং অপমান করেন কেন? কী আনন্দ পান? আমি…”

উচ্ছ্বাস ধমকে উঠল, “থামো। যত্তসব ধান্দাবাজের দল। পড়তে আমার পাল্লায়…”

দড়াম করে দরজা বন্ধ করে উচ্ছ্বাস চলে গেলো। আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছি আমি?

দিন কুড়ি-বাইশ কেটে গেলো। উচ্ছ্বাস এখন আপাতত বাড়িতেই থাকে। সেই দিনের পর আর সে আমার সঙ্গে কোনও কথা বলেনি। সামনাসামনি হয়ে গেলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এদিকে নতুন প্রজেক্টে সপ্তাহে একদিন ভিজিট করেন কাবেরীম্যাম। যা বুঝেছি, আমার পারফরমেন্সে তিনি হ্যাপি।

একদিন রাতে আমরা চারজনই খেতে বসেছি। ডিনারের শেষ পর্যায়ে ম্যাম বললেন, “কাল ইভনিংয়ে অনুভবের বাড়িতে ইনভিটেশন। মনে আছে তো উচ্ছ্বাস?”

এই রিমাইন্ডারটা শুধু উচ্ছ্বাসের জন্যই ছিল না, বুঝতে পারলাম। সে বললো, “হুঁ। কাল আমার লেট হবে, কিন্তু যাবো।”

ম্যাম আমার উদ্দেশ্যে বললেন, “অনুভব পারেখ। আমার জুনিয়ার ছিলো। এখন অন্য কোম্পানি জয়েন করেছে। ওর ফাদার আমাদের কোম্পানি থেকেই রিটায়ার করেছেন, অ্যাজ অ্যান এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার। ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের গুড রিলেশনশিপ। অনুভবের বার্থডেতে এভরি ইয়ার আমরা সবাই যাই। কাল সেই ডেট। এইবার তুমিও যাবে।”

আমি অবাক, “আমি? আমি গিয়ে কী করবো? আমি তো কাউকে চিনি না।”

খানিক ধমকের সুরেই ম্যাম বললেন, “না গেলে চিনবে কী করে? তা ছাড়া এই সব পার্টি অ্যাটেন্ড করা ভালো। অনেক সিনিয়ার অফিসাররা আসেন। ভালো ড্রেস আছে?”

আমি ঘাড় নাড়লাম। সামনের মাসে সিদ্ধার্থের বার্থ-ডে। সে অনেক আগে থেকেই ইনভিটেশন দিয়ে রেখেছে। তার জন্য একটা স্পেশাল পার্টি-ড্রেস কিনে এনেছিলাম গত সপ্তাহেই, কাছের শপিংমল থেকে।

ম্যাম বললেন, “কাল দুপুরে ফ্যাক্টরি থেকে আমি একটু কাজে বেরোবো। সেখান থেকে ডাইরেক্ট চলে যাবো। তুমি বাড়ি এসে, ফ্রেশ হয়ে, আর যদি কেউ যায়, তার সঙ্গে চলে আসবে। না হলে ট্যাক্সি নিয়ে আসবে। বাসে করে এসো না আবার।”

পার্থ-আঙ্কল নিচুস্বরে ফুট কাটলেন, “তুই আমার সঙ্গে যাবি। আর হ্যাঁ, সিদ্ধার্থ আসবে। তুই বোর হবি না।”

কথাটা ধীরে বললেও বাকি দু’জনের কানে গেলো। ম্যাম ভয়ঙ্কর ভ্রু-কুঞ্চন করে উঠে চলে গেলেন আর উচ্ছ্বাস, গলায় ‘হুঃ” করে একটা ব্যাঙ্গাত্বক আওয়াজ তুলে ফের খাওয়ায় মন দিল।

নাহ। এই ছেলে আর শুধরোবে না।

পার্থ-আঙ্কলের গাড়িতে চেপে যখন অনুভব পারেখের বাড়িতে পৌঁছলাম, দেখি নিমন্ত্রিত লোকজনে গমগম করছে। জায়গায় জায়গায় জটলা করে সবাই গল্পগুজব করছে। তবে বড়লোকরা তো ‘জন্মদিনের অনুষ্ঠান’ বলে না, বলে ‘বার্থ-ডে পার্টি’। শুধু নামই আলাদা নয়, দুটোর মধ্যে একটা মূলগত পার্থক্যও আছে। গরীবদের অনুষ্ঠানে হইচই হয় বেশি, বিশেষ করে যার জন্মদিন তাকে ঘিরেই। আর এইসব পার্টিতেও গল্পগুজব হয়, তবে এক একজায়গায় দল বেঁধে, অতি নিম্নস্বরে। আলোচনার বিষয়বস্তু মোটেই বার্থডে বয় বা গার্লকে নিয়ে হয় না। মূলত এইসব পার্টিতে গেলে কার যে জন্মদিন বোঝাই দায়। আমি বাপির সঙ্গে হাইকোর্টের এক প্রখ্যাত ক্রিমিনাল ল’ইয়ারের ছেলের জন্মদিনে গিয়েছিলাম। একদম ভালো লাগেনি। যাকে দেখি, তার হাতেই একটা করে পানীয়ের গ্লাস। মনে আছে, বাপিকে বলে খেয়েদেয়ে টুক করে পালিয়ে এসেছিলাম। সেই এক চিত্র দেখলাম এইখানেও। জটলার আকার কোথাও বেশি ঘন, কোথাও হাল্কা। কোথায় যেন একটা হাল্কা মিউজিক বাজছে। চারদিকে তাকিয়েও সিদ্ধার্থকে দেখতে পেলাম না।

পার্থ-আঙ্কলকে দেখতে পেয়েই সম্ভবত, একটা জটলা থেকে কাবেরীম্যাম বেরিয়ে এসে, আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি তো অবাক। তারপর আমাকে ধরে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি একটা জটলার মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বেঁটেখাটো স্যুটেড-বুটেড স্থুলকায় ভদ্রলোককে ইংরেজিতে বললেন, “এই সেই, যার কথা আপনাকে বলেছিলাম, স্যার।”

কাবেরীম্যাম ‘স্যার’ সম্বোধন করছেন দেখে বুঝলাম, ইনি উচ্চপদে আসীন কোনও কেউকেটা হবেন। কাবেরীম্যাম হাসিহাসি মুখে আমাকে বললেন, “এঁকে চেনো? ইনি এ.পি. কমল চোলানাইকন। রেস্পেক্টেড কমলজী। আমাদের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর।”

বড়দের প্রণাম করতে হয়। আমি ঝপ করে কমলজীর বুট ছুঁয়ে প্রণাম করা মাত্র, উনি যেন সর্পদষ্ট হয়ে লাফিয়ে সরে গেলেন। মোটাসোটা চেহারা নিয়ে কাজটা ঠিক যুতসই হল না, খানিকটা পানীয় চলকে পড়ল ওঁর জুতোয়। কাবেরীম্যাম আমার কানের পাশে মুখ এনে ক্রুদ্ধস্বরে ফিসফিস করলেন, “ডোন্ট ডু দ্যাট।”

কমলজীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা জটলাটার প্রত্যেক সদস্য পারলে যেন নিজেরাই ন্যাপকিন এনে জুতো মুছিয়ে দেয়। যাই হোক, শু-ক্লিনিং পর্ব শেষ হলে দু’তিন জন আমাকে ধমকধামক দিলেন। কমলজী কিন্তু হাসছেন। হাসতে হাসতেই আমার দিকে এগিয়ে এলেন, “ডোন্ট ব্লেম হার। ইট ইজ ইন দেয়ার কালচার। গুড। হোয়াটস ইওর নেম, মাই লেডি?”

নিজের নাম বললাম।

উনি ইংরেজিতেই বললেন, “কাবেরীর কাছে তোমার নাম শুনেছি। খুব ভালো পারফরমেন্স তোমার। ক্যারি অন।”

আমার কেন জানি না, ওঁর হাসি, ওঁর কথা ভালো লাগলো না। যেমন লাগলো না আন্তরিকতা দেখানোর ছলে আমার মাথা, কাঁধ, পিঠ ছুঁয়ে দেওয়া। আবার সবাই নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, ঘরের লাগোয়া একটা বারান্দা আছে দেখে, সেখানে চলে গেলাম।

বারান্দাটা অন্ধকার। প্রথমে ভাবলাম কেউ নেই। চোখ সয়ে এলে দেখলাম একজন আছেন। একটি পুরুষমানুষের অবয়ব এবং তিনি রাস্তার দিকে মুখ করে সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছেন। সাদা ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে হাওয়ায়। আমি ভেতরে চলে যাচ্ছিলাম, আওয়াজ পেলাম, “এক্সকিউজ মি।”

ঘুরে দাঁড়ালাম। যুবকটি এগিয়ে এসে সুইচবোর্ডে হাত দিয়ে সব ক’টা আলো জ্বালিয়ে দিলেন। এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। আমিও তাকে দেখলাম। মাঝারি উচ্চতা। ক্লিন শেভন অবাঙালি মুখ। চুলে সম্ভবত জেল মেখেছেন। দোহারা চেহারা। বয়স আন্দাজ কম-বেশি তিরিশ-বত্রিশ। হিন্দিতে প্রশ্ন ধেয়ে এল, “আপনি কে?”

নিজের নাম বলে লাভ নেই। আমি কার সঙ্গে এসেছি সেটা বললাম। যুবকটি নিঃস্পৃহ গলায় বললো, “মিস শ্রবণা মুখার্জী?”



এই রে! আমি তো নিজের নাম বলিনি। আর উচ্চারণটা একেবারে সঠিক করেছেন। যুবকটি এইবার হাসলো। ওর গজদন্তটা খেয়াল করলাম। যুবকটি সরাসরি আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল, “আমার নাম অনুভব পারেখ। আপনার নাম আমি শুনেছি কাবেরীআন্টির কাছে।”

করমর্দন সেরে আমি বললাম, “স্বীকার করতেই হচ্ছে, আপনার গ্রে-ম্যাটার যখন তখন কুস্তি লড়বার জন্য তৈরি।”

শব্দ করে হাসলো অনুভব। হাসিটা আমার বেশ লাগলো। আজকাল এইরকম দিলখোলা হাসি লোকে হাসতেই ভুলে যাচ্ছে। হাসি থামলে সে বললো, “কিন্তু আপনি বাইরে কেন? ভেতরে সবাই এনজয় করছে। জয়েন দেম।”

“কারেক্ট। আমার মাথাতেও এই মুহূর্তে সেম থট এসেছে। এবং সেটা আরও পাওয়ারফুল। বার্থ-ডে বয় হয়েও ইনভাইটিসদের থেকে আলাদা, একা, এই বারান্দায়, কেন?”

“এটা আমার প্রশ্নের উত্তর?”

“সার্টেইনলি নট, বাট আমার প্রশ্নের উত্তর, যা আপনি এতক্ষণে গ্রে-ম্যাটারে সাজাচ্ছেন, তার অ্যান্সারটাই আমার মুখে বসিয়ে দেবেন, স্লাইটলি উল্টেপাল্টে।”

এইবার আরও জোরে হেসে উঠল অনুভব। হাসতে হাসতে চোখে জল এসে গেলো। হাসছিলাম আমিও। এমন সময় ছন্দপতন ঘটলো। বারান্দায় এসে উপস্থিত হলো উচ্ছ্বাস। অনুভব তাকে দেখতে পেয়েই বললো, “আও ভাই আও, জয়েন আস।”

উচ্ছ্বাসের হাতে একটা রঙিন পানীয়ের গ্লাস। দৃষ্টি আমার দিকে। ঠোঁটে হাসি। বললো, “দেখেছো? আমি কত বড় ফিউচার-টেলার। সেদিনই আমি বলেছিলাম, মেয়েরা যাদু জানে। তো? এখন কী? অনুভবকে পটাচ্ছো? লাভ হবে?”

অনুভব কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি হাত তুলে ওকে থামালাম। আমার মাথায় তখন আগুন জ্বলে উঠেছে। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলাম উচ্ছ্বাসের দিকে। বললাম, “আপনি কী মনে করেন, না করেন, আমার কিস্যু যায় আসে না। আমার একটা চাকরি দরকার ছিলো। আর সেটা করতেই আমি এখানে এসেছি। আপনি যদি আমাকে এইভাবে কনটিনিউয়াসলি টিজ করতে থাকেন, যখন তখন অকারণে অপমান করেন, তাহলে রেজিগনেশন লেটার সাবমিট করতে আমার দু’ঘণ্টার বেশি লাগবে না। আর একটা কথা। আপনি যদি এখান থেকে এখনই চলে না যান, তাহলে আমি দুটো কাজ করবো। ফার্স্ট, কাবেরীম্যাম আর পার্থ-স্যারকে ডেকে এনে আপনার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এইরকম ইললিসিট বিহ্যাভিয়ারের কৈফিয়ত চাইবো, ওঁদের কাছেই। আর সেকেন্ডলি, ওঁদের সামনেই একটা চড় মেরে আমার পাঁচ আঙুলের দাগ আপনার গালে ফেলে দেবো।”

পরের বেশ কয়েকটা সপ্তাহ মনটা খারাপ হয়েই রইল। সেদিন আমার অমন রুখে দাঁড়ানোয় উচ্ছ্বাস থমকে গিয়েছিল, আমার দিকে আগুন-ঝরানো দৃষ্টি ফেলে দিয়ে ওই বাড়ি ছেড়েই কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল। পার্থ-আঙ্কল হয়তো শুরু থেকেই আমাকে ফলো করছিলেন, আমি হনহন করে সেই বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ানোর আগেই তিনি আমাকে ধরে ফেললেন। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলেন। নাহ। আমি বলিনি। দুর্বিনীত পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে এক পিতার অসহায়তা আর বাড়াতে চাইনি। অনেক প্রশ্ন করেও আমার থেকে কোনও সদুত্তর না পেয়ে, উনি আমাকে হাত ধরে খাবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার গলা দিয়ে কিছু নামতে চাইছিল না। তবু পার্থ-আঙ্কল বার বার রিকোয়েস্ট করায় অল্প কিছু খেতেই হয়েছিল। আমার সঙ্গে ডিনার সেরে নিয়েছিলেন পার্থ-আঙ্কলও। তারপর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। তার মধ্যেই আমি খেয়াল করেছিলাম কাবেরীম্যাম আমাকে নোটিস করে যাচ্ছিলেন।

আজ বেশ কয়েকদিন হলো, মা আর ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। পার্থ-আঙ্কল অবশ্য এর মধ্যেই দু’বার বলেছে, আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে চাই কিনা, কারণ এমনিতেই আমার অনেকগুলো ছুটি জমে আছে। আমিই না করেছিলাম। ভেবেছিলাম, কাজ আরেকটু সামলে নিই, তার পরে। মা আর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হতো নিয়মিত, কিন্তু তাদেরকে আঁকড়ে ধরার, তাদের স্পর্শ পাওয়ার যে আনন্দ, এখন মনে হচ্ছে আমি ইচ্ছে করেই নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছি এতোদিন।

আসলে আমি ভারি দোটানায় পড়ে গিয়েছিলাম। এই বাড়িতে পার্থ-আঙ্কল আমাকে ভালোবাসেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু কাবেরীম্যামকে বোঝা আমার পক্ষে এখনও দুষ্কর। এতো দিন কেটে গেলো, তবুও পার্থ-আঙ্কল আর কাবেরীম্যামের মধ্যের হিমশীতল সম্পর্কটা আমাকে খোঁচা দিতে ছাড়তো না।। বারবার নিজেকে বোঝাতাম, কী দরকার ওদের সম্পর্ক নিয়ে এতো ভাবার? কিন্তু কোথাও যেন আমি, আমার অজ্ঞাতেই, একটা আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধা পড়ে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। গোদের উপরে বিষফোঁড়া উচ্ছ্বাস। এই ছেলেটির কি, আমাকে হেনস্থা করা ছাড়া, আর কোনও কাজ নেই? কী পায় ও এইভাবে আমাকে অপমানের পর অপমান করে? উচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলে লাভ নেই, কারণ আফটার অল আমি বাইরের মেয়ে আর ও ঘরের ছেলে। উল্টে দেখা যাবে হয়তো আমার চাকরিটা নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে। টাকা। টাকা অতি বিষম বস্তু। একবার এই ভাবনাও মাথায় এলো যে, উচ্ছ্বাসের কি নিজস্ব কোনও ক্যান্ডিডেট আছে, কোনও চাকুরিপ্রার্থী বেকার ইঞ্জিনিয়ার? আমাকে সরাতে পারলে তাকে এই জায়গায় ঢোকাবে? তো সেটা নিজের মা’কে বললেই তো হয়। ওঁর মা-ই তো সর্বেসর্বা। আরও একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করতো। উচ্ছাস বাড়িতে খুব কম কথা বলতো। যেটুকু বলতো পার্থ-আঙ্কলের সঙ্গে। কাবেরীম্যাম প্রশ্ন করেও উত্তর পান না। এ আমার সামনেই ঘটেছে অনেকবার।

মানুষের জীবনে উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-যন্ত্রণা একটা বৃত্তের মতো। একটার পরে একটা আসে, যেমন পৃথিবীতে রাত গিয়ে দিন আসে, আবার দিনের পরে রাত। অনুভব পারেখের জন্মদিনের কয়েকদিন পরেই সিদ্ধার্থের জন্মদিন আসছিল। তার আগে একদিন কথায় কথায় বললাম, পার্টি-ড্রেসটা তো অনুভবের জন্মদিনেই পরে ফেললাম। এবার? সে বললো, চিন্তা কী? আরেকটা কিনে নিলেই হয়। তার সঙ্গেই গেলাম সেই শপিংমলে। সিদ্ধার্থই পছন্দ করে দিল একটা। আমারও ভারি পছন্দ হল। টের পেলাম আমার চয়েসের সঙ্গে তার চয়েস দিব্য মিলে যাচ্ছে। দাম মেটানোর সময় চমক। সিদ্ধার্থ দিয়ে দিল। আমি বললাম, “এটা কী হলো? তুই দিলি কেন?”

সে আমাকে হাত ধরে শপিংমলের কফিবারে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো, “ধরে নে এটা রিটার্ন গিফট। এবার তুই প্ল্যান কর, আমাকে কী গিফট দিবি।”

বোঝো কাণ্ড! সেদিন কফি খেতে খেতে খুব হাসাহাসি করেছিলাম। তখন জানতাম না দিনের পরে রাত আসছে। জন্মদিনের আগের দিন ওর গাঁও থেকে ফোন এলো। বাবা এক্সপায়ার করেছেন। ব্যস। সিদ্ধার্থ রাতের ট্রেন ধরে চলে গেলো। এবার সমস্যা হল, আমাকে নতুন সাইটে নিয়ে যাবে কে? কাবেরীম্যাম আগেই একাধিকবার বলে দিয়েছেন, বাসে ট্র্যাভেল করা চলবে না। বাসে চড়ে গেলে ওঁর কী সমস্যা সেটা আমি বুঝিনি, তবে সমস্যা আরেক জায়গায়। যেখানে কাজ হচ্ছে, ততদুর বাস তো বটেই, কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্টই যায় না। যে অবধি যায়, সেখানে নেমে অন্তত মাইলখানেক হাঁটতে হবে। এখন উপায়? উপায় বাতলালেন কাবেরীম্যাম। ঠিক হলো, তার সঙ্গেই আমি বেরোবো, গাড়ি তাকে তার জায়গায় নামিয়ে দিয়ে, আমাকে আমার জায়গায় নামিয়ে দিয়ে আসবে। এই অবধি ঠিক ছিল। বাড়া ভাতে ছাই দিল ম্যামের সুপুত্রটি। এই ছেলেটার মাথায় যে এক সঙ্গে এতো রকমের পোকা আছে, কী করে জানবো? কাবেরীম্যাম ডিনার টেবিলে যখন তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন, ঠিক তক্ষুনি উচ্ছ্বাস বলে উঠলো, “কোনও দরকার নেই। আমি তো এখন ফ্রি। আমি যদ্দিন আছি, আমি পৌঁছে দিয়ে আসব মেয়েটাকে।”

মাথাটা যেন দপ করে জ্বলে উঠল। মেয়েটা! আমার কোনও নাম নেই? ফ্রি হয়ে ঘরে বসে থাকা ছেলের কাজ কি দুটোই? আমাকে অপমান করা আর নিজের জন্মদাত্রীর সব কথার বিরোধিতা করা? আমার দুর্ভাগ্য। পার্থ-আঙ্কল আর কাবেরীম্যাম দু’জনেই ছেলের প্রস্তাবে সিলমোহর দিলেন। ঠিক হলো, উচ্ছ্বাসই পৌঁছে দিয়ে আসবে। ফেরার সময় অবশ্য অন্য ব্যবস্থা। ম্যামের গাড়ি আমাকে পিকআপ করে ম্যামকে তার কাজের জায়গা থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে। ঘরে এসে ভাবলাম, ধুর। ঘাট হয়েছে। কোথায় ফেঁসে গেছি? এবার ইস্তফা দিয়ে ফিরে যাবো কোলকাতায়। যা এক্সপেরিয়েন্স গেইন করেছি, নিশ্চয়ই সেখানে একটা চাকরি জুটে যাবে। যা ছেলের মতিগতি। হয়তো মাঝরাস্তায় নামিয়ে দিয়ে কেটে পড়বে।

প্রথম তিন দিন সিঁটিয়ে বসে রইলাম। উচ্ছ্বাস গাড়ি চালাতে চালাতে কোনও কথা বললো না। নির্বিঘ্নেই সব সম্পন্ন হলো। ঈশ্বর হয়ত হাসছিলেন। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। আজ কোটা মার্গে চাকা রাখতেই স্পিডোমিটারের কাঁটা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। আমি খুব ভয় পেয়ে বললাম, “এতো জোরে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন? প্লিজ, প্লিজ।”

উচ্ছ্বাস হাসল, “যা জেটস্পিডে তুমি এগোচ্ছ, সেই স্পিডেই তো চালাচ্ছি হে। মজা লাগছে না?”

আচ্ছা পাগলের পালায় পড়া গেলো তো! সবে ভাবছি, আজ ঈশ্বর রক্ষা করলে, কাল থেকে আমি আর নেই। হেঁটে যাবো, সেও ভালো, অমনি একটা ট্রাককে ওভারটেক করে রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারলো আমাদের গাড়িটা। আমার মাথাটা সামনের উইন্ডস্ক্রিনে সজোরে আঘাত করে ভেঙে খানিকটা বেরিয়েও গেলো। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।

জ্ঞান ফিরলো যখন, তখন আমার মাথা তো বটেই, শরীরের উর্ধাংশের প্রায় পুরোটা ব্যান্ডেজে মোড়া। আমার বেডের সামনে তখন দাঁড়িয়ে সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত একজন প্রৌঢ় ডাক্তার, পরে জেনেছিলাম ইনি ডক্টর রোহিত শ্রীবাস্তব, তার সঙ্গে দু’জন নার্স। আমাকে পুরোপুরি সজ্ঞানে আসার সময় দিয়ে ডক্টর শ্রীবাস্তব বললেন, “অ্যাট লাস্ট ইউ আর ব্যাক। গুড গড। হাউ আর ইউ?”

“ভালোই তো লাগছে।”

সত্যিই আমার নিজের শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠলাম। বললাম, “আমার কী হয়েছিল?”

“ম্যাসিভ কার অ্যাক্সিডেন্ট। ব্যস। আর বেশি কিছু মনে করবার চেষ্টা করবেন না। শুধু এটুকু জানিয়ে রাখি, হেভেনের পথে পা বাড়িয়েই দিয়েছিলেন, আমরা শুধু কনস্পিরেসি করে আপনাকে আটকে দিয়েছি। হোপ, দ্য গ্রেট গড অলরেডি আন্ডারস্টুড। কদ্দিন সেন্সলেস ছিলেন জানেন? সেভেন ডেজ।”

আমার অবশ্য মনে পড়তে খুব বেশি সময় লাগলো না। তার মানে ম্যাসিভ হেড ইনজুরিই হয়েছিল। মুহূর্তে মনে পড়লো আরেকটা কথা। উচ্ছ্বাস? ডক্টর শ্রীবাস্তব বললেন, “তার চোট অল্পই।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, ডক্টর।”

“আরে, থ্যাঙ্কস দিতে হলে মিস্টার ভটচাজকে দিন, আমাকে নয়।”

পার্থ-আঙ্কল! তিনি কোথায়? আমি চারদিকে চোখ ঘোরাতেই দেখতে পেলাম। উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আমার দিকে। নিমেষে আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেলো। আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েও শান্তি হয়নি? উচ্ছ্বাস বললো, “আই ইউল মাস্ট লজ কমপ্লেইন টু পোলিশ এগেইন্সট দ্যাট ব্লাডি কোম্পানি। নতুন ব্র্যান্ডের এই হাল?”

প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও অনতিবিলম্বে ওদের আলোচনায় ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। কার অ্যাক্সিডেন্টের সময়ই উচ্ছ্বাসের এয়ারব্যাগ খুলে গিয়েছিল, কিন্তু আমারটা নয়। এই এয়ারব্যাগ ব্যাপারটা তখন ইন্ডিয়াতে নতুন লঞ্চ করেছিলো। সেই মডেলের লেটেস্ট গাড়িটাই কিনেছিলো উচ্ছ্বাস। সময় মতো লেফট-সাইডের এয়ারব্যাগ না খোলায় আমার এই দশা। কিন্তু তার জন্য উচ্ছ্বাসকে ধন্যবাদ দেবো কেন? ডক্টর শ্রীবাস্তবের কাছে জানতে চাইলাম, উচ্ছ্বাসের সামনেই। আমি এর উত্তর চাই। ওর কী অধিকার আছে, আমার সঙ্গে ছেলেখেলা করবার? কী দরকার ছিল অত জোরে গাড়ি চালাবার?

ডক্টর শ্রীবাস্তব বললেন, “কেন যে জুনিয়ার ভটচাজ প্র্যাকটিশটা কনটিনিউ করলেন না, আমি বুঝি না। মিস মুখার্জী, আপনাকে সুস্থ করে তোলার জন্য এই সাত দিন উচ্ছ্বাস যে পরিমাণে লেবার দিয়েছে, আনবিলিভেবল। ওর একটাই চাহিদা ছিল, গেট ইউ ব্যাক টু দ্য লাইফ। ইউ নো, এই সাত দিন ও বাড়ি যায়নি? এই নার্সিংহোমটাকেই বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিল? মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ভটচাজ যতবার তোমাকে দেখতে এসেছিলেন, ততবার উচ্ছ্বাসকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন, যাতে একটা দিন সে রেস্ট নেয়। কারণ এই নার্সিংহোমে অনেক এক্সপার্ট ডক্টরস রয়েছেন, আমি রয়েছি। বাট…”

ডক্টর শ্রীবাস্তবের একটা সার্জারি ছিল। তিনি চলে গেলেন। নার্স দু’জন আমাকে কিছু ক্যাপসুল খাইয়ে বিদায় নিতেই উচ্ছ্বাস এসে সামনে দাঁড়ালো। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর চোখে এই দৃষ্টি আমি আগে দেখিনি। ও কি কাঁদছে? নাকি আমিই ভালো করে এখনও দেখতে পাচ্ছি না? উচ্ছ্বাস আমার ব্যান্ডেজ-বাঁধা হাতের উপরে নিজের হাতের পাতা রাখলো।

“সরি।”

আমি বিমূঢ় হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে ও বললো, “আয়াম এক্সট্রিমলি সরি। এক্সট্রিমলি, এক্সট্রিমলি সরি। প্লিজ ফরগিভ মি।”

আমি বললাম, “ডক্টর উচ্ছ্বাস ভটচাজ, এই অ্যাক্সিডেন্টে একটা পার্মানেন্ট লস হয়ে গেছে আমার। আই থিঙ্ক সো।”

উচ্ছ্বাস ঝুঁকে পড়ল, “কী হয়েছে?”

“কানে সমস্যা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে আমি ভুলভাল শুনছি।”

ম্লান হেসে সোজা হল উচ্ছ্বাস, “রিয়্যালি আয়াম সরি শ্রবণা। বিলিভ মি। তুমি ভাবতে পারবে না, আমি কী পরিমাণ টেন্সড হয়ে গিয়েছিলাম। জানো, এই অ্যাক্সিডেন্টে আমার তেমন চোট না লাগলেও, আমিও সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলাম। তোমাকে যখন আমি নার্সিংহোমে ফার্স্ট দেখি, ইওর বডি… ফুল্লি কভারড বাই ব্লাড… কনটিনিউসলি ড্রিপিং ব্লাডস… আই হ্যাভ রিয়ালাইজড, হোয়াট আই হ্যাভ ডান। ও মাই গড!”

উচ্ছ্বাস চোখ বুজলো। একবার শিউড়ে উঠলো। আমি বললাম, “বাড়ি যাওনি কেন?”

“আমি পারিনি। বাড়িতে থাকতে পারতাম না। রাতে ঘুমোতে পারতাম না।”

“কদ্দিন স্নান করোনি?”

“জানি না। কিস্যু মনে নেই। কেন?”

“আমার নিজের কান নিয়ে ডাউট থাকলেও নাক নিয়ে নেই। বাড়িতে গিয়ে স্নান সেরে নাও। বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোচ্ছে।”

এক লাফে সরে গেলো উচ্ছ্বাস। হাসলো। আমি বললাম, “আঙ্কল, ম্যাম আসেননি?”

“রোজ আসেন। আজও আসবেন। আমি স্নান সেরেই আসছি।”

বিকেলে পার্থ-আঙ্কল এলেন, উচ্ছ্বাসের পেছন পেছন, হাসতে হাসতে। মানে সুখবরটা উনি পেয়েছেন। শুনলাম, কাবেরীম্যামের সামান্য জ্বর এসেছে। উনি কাল আসবেন। এটা সেটা কথার পরে, পার্থ-আঙ্কল বললেন, “তাই বলে ভাবিস না, সুস্থ হয়েই ফের কাজে লেগে পড়বি। এবার কিন্তু লম্বা রেস্ট। আগে সুস্থ ‘হ। তারপর তোকে আমি ঘুরতে পাঠাবো। না শুনলে কিন্তু এবার আমার হাতে চড় খাবি।”

আমি হেসে বললাম, “কোথায় শুনি?”

“কোলকাতা। মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না, তুই কেমন মেয়ে রে? অ্যাই, তোর মা’কে কিন্তু আমরা কিছুই জানাইনি। ডক্টর শ্রীবাস্তবের সঙ্গে আমার সব কথা হয়ে গেছে। ভাবিস না, এটা আমার একার সিদ্ধান্ত। কোম্পানি থেকে তোকে লিভ দেওয়া হচ্ছে। আর দিন কুড়ি। তারপরেই তোকে ছেড়ে দেবে ডক্টর শ্রীবাস্তবে। তারপরে তুই যাচ্ছিস নিজের বাড়ি। উঁহু, একা নয়, উচ্ছ্বাস যাবে তোর সঙ্গে, আবার ফিরিয়েও নিয়ে আসবে।”

“আবার আপনার ছেলে?”

আমি কথাটা বলতেই উচ্ছ্বাস বাচ্চাছেলের মতো খিলখিল করে হেসে ফেললো। পার্থ-আঙ্কলও সেই হাসিতে যোগ দিলেন।

“দিদি।”

অতীতের নানান ছবি সেই কবেকার সাদাকালো মুভির মতো চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। এমন সময় রত্নাদির গলা কানে এলো, “দিদি, ঘুমোলে নাকি?”

আর ঘুম! আজ সারা দিন তো বটেই, সারা রাতও ঘুমোতে পারবো কিনা জানি না। আমি জানি, হয়তো ধীরে ধীরে একদিন এই কাবেরীম্যাম, এই পার্থ-আঙ্কল, এই উচ্ছ্বাস, সিদ্ধার্থ এদের স্মৃতি ফিকে হয়ে আসবে। আসল সত্য তো তাইই। এতো দিন পরে কাবেরীম্যাম না এসে পৌঁছলে, সেই কবেকার স্মৃতিগুলো জীর্নপাতার মতই ঝরে পড়বার উপক্রম করেছিলো। হয়ত মনে পড়তো, তবে আজকের মত নয়। যেন পরিত্যক্ত চৌবাচ্চার নিচে কিছু মাছের কঙ্কাল শুয়ে ছিলো কতো শতাব্দী ধরে, আচমকা জলে আলোড়ন ওঠায় তারাও নড়েচড়ে উঠেছে, তাও সেই শতাব্দীকাল পরেই। এই আলোড়ন হয়তো আবার স্তিমিত হয়ে আসবে, আবার মাছের কঙ্কালগুলো পাথরের মতো স্থির হয়ে যাবে, তবে এখনই নয়, আজই নয়।

“জেগে আছি। বলে যাও।”

“দাদাবাবুরা এয়েচেন।”

বলার ইচ্ছে হল, ‘তা আমি কী করব? শিলনোড়া, আগুন, নিমপাতা যা দেওয়ার আছে দিয়ে স্নান করতে পাঠিয়ে দাও’ কিন্তু কী ভেবে উঠে পড়লাম। বেলা অনেক হয়ে এলো। আর ঘণ্টাখানেক বাদেই উমা আর মেঘা এসে পড়বে, ওদের কীভাবে কী বোঝাবো জানি না।

দুপুরের আহারাদির পরে সাম্য’র বন্ধুরা চলে গেলে সাম্য বললো, “তুমি নাকি কিছুই খাওনি? রত্নাদি বলছিলো।”

“খিদে পাচ্ছে না। পেলে খেয়ে নেবো।”

“পেট খালি রেখো না। আমার প্রেসারের ওষুধটা ফুরিয়েছে। একবার নিচের ডিসপেনসারিতে যাচ্ছি। ভালো কথা, এবার তো একটা ব্রাহ্মণ ডেকে… মলয়দাদুকে আনার একটা ব্যবস্থা করি?”

মলয় চাটুজ্জে সাম্যদের পারিবারিক পুরোহিত। এখন খুবই বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। উনি আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। সাম্য’র মুখে শুনেছি, উনি সাম্য’র বাবা-মায়ের বিয়েও নাকি করিয়েছিলেন। এই ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশের দিনে তাকেই আনা হয়েছিল, গাড়িতে চড়িয়ে। ফোকলা দাঁতে হেসে বলেছিলেন, “সমুবাবা, এর পরে কী উমা-মা আর মেঘা-মায়ের বিয়েও আমার হাত দিয়ে দেওয়াবে?”

সেই নিয়ে বেশ হাসাহাসি হয়েছিল।

অন্যমনস্ক ছিলাম। বললাম, “মলয়দাদু কেন?”

“মানে ঐ শ্রাদ্ধশান্তি… বুঝতেই পারছো।”

“আজকের দিনটা আমাকে ছেড়ে দাও, সাম্য। পরে জানাচ্ছি।”

সাম্য আর আমাকে বিরক্ত করেনি। লিফটের দিকে পা বাড়িয়েছিলো।

মাথা ধরাটা একেবারে ছিনে জোঁকের মত লেগে আছে। রত্নাদিকে ডেকে বললাম, “আমাকে এক কাপ লাল-চা দিয়ে তুমি ভাত খেয়ে নাও। আর চারটে নাগাদ আমাকে জল-মুড়ি দিও। তারপর তুমি শুয়ে পড়ো। আজ উমা, মেঘার জন্য জলখাবার আমি বানাবো।”

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাষ্টার বেডরুমে এসে বসলাম। সারা বিছানাটা খাঁ খাঁ করছে যেন। অথচ কাবেরীম্যাম আসার আগেও এই বিছানাটা এমনই দেখাতো। এমনই ঝকঝকে রোদ্দুরভাসা। তবে আজ এমন শূন্য মনে হচ্ছে কেন? ভাব্যা খুব করিৎকর্মা মেয়ে। এই ঘর থেকে বডি রিমুভড হয়ে গেলে, সে মিনিট কুড়ির মধ্যেই আগের চেহারা ফিরিয়ে দিয়েছে। সমস্ত যন্ত্রপাতি খুলে সে যে ঘরে শুতো, সেই ঘরে জড়ো করে ফেলেছে। চাদর বদলে ফেলেছে। যে বালিশে উনি শুতেন সেই বালিশ বডির সঙ্গেই দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভাব্যা, হয়তো রত্নাদির হেল্প নিয়ে, নতুন বালিশ এনে পেতে ফেলেছে। টেবিলের উপরে ডাঁই হয়ে থাকতো ওষুধপত্র। সেগুলো ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গিয়েছে। এখন আবার সেখানে একটা টেবিল-ক্যালেন্ডার আর টেবিল-ঘড়ি। সব শেষ হয়ে গেলে সম্ভবত রুম ফ্রেশনার স্প্রে করেছিলো, এখনও তার সুগন্ধ পাচ্ছি। কখন করলো ও এইসব? সত্যিই কি এখন সব কিছু ঠিক আগের মতো? আমি বিছানার উপরে বসলাম। হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম সেই জায়গাটা, যেখানে কাবেরীম্যাম শুয়ে থাকতেন। চাদর বদলে ফেললেই সব কি সব দাগ মুছে ফেলা যায়?

বাপি আমাকে বলতেন, “জানিস মা, এই পৃথিবীতে কেউ একশো ভাগ ভালো বা একশো ভাগ মন্দ হয় না। তাহলে সে হয় ভগবান হয়ে যাবে, নয়তো শয়তান। ভগবানের বাড়ি কোথায়? উপরে। আর শয়তানের জায়গা? নিচে, পাতালে। তাহলে এই দুইয়ের মাঝখানে কারা থাকে? আমরা। সব মন্দ মানুষের মধ্যেই কিছুটা ভালো থাকে আর সব ভালো মানুষের মধ্যেই কিছুটা মন্দ। তাই তোকে একটা কথা বলি। মানুষের সেই ভালোটুকুই খোঁজার চেষ্টা করিস, সারাজীবন।”

আমি তো তাই করেছিলাম বাপি। নইলে কাবেরীম্যামের মধ্যেও যে অমন নিচ মানসিকতা লুকোচুরি খেলছিল, বুঝতে পারলেও পাত্তা দিই নি তো। আমি যতোটুকু মানুষ চিনেছিলাম, তাতে করে কাবেরীম্যাম যে একজন উচ্চবুদ্ধিসম্পন্না মানুষ, সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। নইলে অতো উঁচু পোস্টে বিলং করতে পারতেন না। গোটা ফ্যাক্টরিটা যেন তারই অঙ্গুলিহেলনে চলতো। উচ্ছ্বাস যে আমার সঙ্গে দিনের পর দিন খারাপ ব্যবহার করে গেছে, সেটা তিনি যে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি, এমনটা তো নেক্সট টু ইম্পসিবল। তাই না? অথচ তিনি টুঁ শব্দটি করেননি। নার্সিহোম ফেরত, আমি কোলকাতা যাবো বলে তৈরি হচ্ছি। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ ভালো হয়ে এসেছে, মাঝেমধ্যেই বারান্দায় চেয়ার পেতে দু’জনে গল্প করি। সেই গল্পের বিষয় থাকে নিতান্তই সাদামাটা। উচ্ছ্বাস তার ছেলেবেলার গল্প শোনাতো, বেশিরভাগই তার আর তার বাবার। মায়ের প্রসঙ্গ এলেই সে কায়দা করে এড়িয়ে যেতো। কাবেরীম্যাম, দেখতাম নানান অজুহাতে সেইসময়, বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন, যেন বাইরের প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছেন। একদিন আমাকে বলেই ফেললেন, “শুধু শুধু আড্ডা না মেরে, বিছানায় শুয়ে অফিশিয়াল পেপার-ওয়ার্কগুলো সেরে ফেললেই তো পারো।” সেরে ফেললাম। আরেকদিন বললেন, “উচ্ছ্বাস যাচ্ছে যাক, কিন্তু তাকে হোটেলে উঠতে বলে দিও।” কী মুশকিল। তিনি কি আমাকে তার হবু বৌমা ভেবে ফেলেছেন নাকি? একবার ইচ্ছে হল বলি, নিজের পেটের ছেলে, নিজের মুখে বলতে পারছেন না? কিন্তু বড়দের অপমান করতে আমি শিখিনি। আরেকদিন। আমি, কেন জানি না, পার্থ-আঙ্কলের মধ্যে নিজের বাপিকে খুঁজে পেতাম। বাপি সময় পেলেই আমাকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতেন, “চিন্তা করতে হলে ভালো চিন্তা কর।” কী আশ্চর্য! কোলকাতা রওনা দেওয়ার দিন আমি সুটকেস গুছিয়ে নিজেকে তৈরি করে সবে বাইরে বেরোবো ভাবছি, পার্থ-আঙ্কল এসে বললেন, “তাড়াতাড়ি ফিরিস। ভালো থাকিস।”

আমি ঢিপ করে প্রণাম সেরে বললাম, “আপনিও ভালো থাকবেন, আঙ্কল। আমি তাড়াতাড়িই ফিরবো। অনেক কাজ বাকী আছে।”

“রেখে দে তোর কাজ। ভালো কিছু চিন্তা করতে করতে বাড়ি যা। অফিসের চিন্তা মাথায় নিয়ে ব্রেন ড্যামেজ করিস না।” বলেই তিনি আমাকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। সেই মুহূর্তে চোখ বন্ধ করতেই আমি যেন পার্থ-আঙ্কলের পাঞ্জাবি থেকে বাপির ঘ্রান পাচ্ছিলাম।

“চমৎকার। এবার ট্রেন ফেল করলে টিকিটের পয়সাগুলো জলে যাবে, সেটা কেউ ভেবেছে কি?”

কাবেরীম্যাম! তাকিয়ে তার চোখে যে দৃষ্টি খুঁজে পেলাম, তা যে এতো জঘন্য হতে পারে, কল্পনাতেও আনতে পারিনি। পার্থ-আঙ্কল আরেকবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। আমি বললাম, “উচ্ছ্বাস বলেছে, সে রেডি হয়ে নিচে নামলেই আমাকে খবর দেবে।”

কাবেরীম্যাম তার পরেও এক অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের ঘরদোর কেমন আমি জানি না। উচ্ছ্বাস জেদ করবে ওখানে থাকার। ও ছোটবেলা থেকেই পাগল। তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতি। আশা করি আমি যা বলতে চাইলাম, বুঝতে পারলে?”

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে তিনি সামনে এগিয়ে এলেন, “তোমার পার্থ-স্যার বলেছেন, তোমাকে আমার মতো দেখতে?”

কী সর্বনাশ! এই সব কথার উত্থান কেন? আমার মাথাটা আবার একটু একটু করে গরম হচ্ছিল। সুপারিয়র বস হয়ে বসেছেন বলেই কী যা খুশি তাই বলতে পারেন? আমি বললাম, “এই পৃথিবীতে বায়োলজিক্যালি অনেককেই অনেকের মতো দেখতে হয়, ম্যাম। আসল কথা হল, মানুষের বিহ্যাভিয়ার, আচার-আচরণ। সেখানেই একজনের চাইতে অন্যজনকে আলাদা করে দেয়।”

কাবেরীম্যাম যেন হিসহিস করে বললেন, “এটাই মাথায় রেখো।”

বলেই তিনি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলার কি কোনও মানসিক সমস্যা আছে? তিনি নিজে তো পুরুষমহলে দিব্যি আড্ডা দিতে পারেন। যতো সমস্যা কি তার স্বামী আর পুত্রকে নিয়ে? কেন উচ্ছ্বাস, মায়ের প্রসঙ্গ উঠলেই, এড়িয়ে যায়? কেন আজ অবধি আমি ম্যাম আর আঙ্কলকে সরাসরি কথা বলতে দেখলাম না? জানতে হবে। এবার আমাকে জানতেই হবে। তবে আপাতত, বাপি যা বলতেন সেটাই ঠিক। কাবেরীম্যাম আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমার সংসারটাকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। সেই কৃতজ্ঞতার নিচেই বরং আমি চাপা থাকি।

ট্রেনে আমাদের সিট পড়ল একদম উপরের বাংকে। জ্ঞানেশ্বরী। ট্রেন ছাড়ল দুপুর দুটো কুড়িতে। সারাদিন অলসভাবেই কেটে গেলো। আমাদের দু’জনের লাঞ্চ বানিয়ে দিয়েছিল সাবিত্রী। রাতে? উচ্ছ্বাস বলেছিল, ট্রেনেই অর্ডার দিয়ে দেবে। দুপুরে লাঞ্চের পর ঘুমোনোর হ্যাবিট না থাকলেও, সম্ভবত ট্রেনের দুলুনিতেই, সামান্য তন্দ্রা এসে যাচ্ছিলো। পাশে তাকিয়ে দেখলাম উচ্ছ্বাসের রীতিমত নাক ডাকছে। মুখটা খোলা। দেখে হাসি পেলো। একদম বাচ্চাছেলের মত ঘুমোচ্ছে।

ট্রেন একদম কারেক্ট টাইমে চলছিলো। ডিনার শেষে যখন ভাবছি, কোলকাতায় গিয়ে ওকে একটা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেবো, এই ব্যাপারটা আগেভাগেই জানিয়ে রাখি, তখনই উচ্ছ্বাস বললো, “শোনো, রাত তিনটে নাগাদ কিন্তু আমাদের নামতে হবে। আমি একবার কোলকাতা গিয়েছিলাম। হাওড়ায়। এবার তো নামতে হবে সাঁতরাগাছি। চেনো?”

“চিনে নেবো। আমি যখন রায়গড় গিয়েছিলাম, তখনও কি সব চিনতাম?”

“সত্যিই, সুটকেস, মানি-পার্স হারিয়ে তোমার যা অবস্থা হয়েছিলো, আমি হলে তো কেঁদে ফেলতাম। ভাগ্যিস বাপি গিয়ে পৌঁছেছিলো।”

“তুমি পার্থ-আঙ্কলকে বাপি ডাকো?”

“হ্যাঁ। কেন?”

“আমিও ডাকতাম। আচ্ছা, উচ্ছ্বাস, তুমি কাবেরীম্যামকে নিয়ে….”

“শ্রবণা, আমি একবার টয়লেট থেকে ঘুরে আসি। তারপর গল্প করছি, কেমন?”

“কোথাও যাবে না। তুমি একটু আগেই গেছো। আচ্ছা, আমি জিজ্ঞেস করছি না। তুমি জাস্ট বলো, তুমি আমাকে দেখলে অমন ক্ষেপে যেতে কেন?”

“তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও, শ্রবণা। এখনও সময় আছে হাতে। আমি ঠিক ডেকে দেবো।”

“আমি ঘুমোচ্ছি না। তুমি বলো।”

“বলতেই হবে?”

“হ্যাঁ। জোরজবরদস্তি।”

উচ্ছ্বাস হাসলো, “একটু পরেই লাইট নিভিয়ে দেবে। আর ট্রেনের যা আওয়াজ। দাঁড়াও।”

সে পা বাড়িয়ে আমার বাঙ্কে চলে এসে বেশ গুছিয়ে বসলো আর অমনি ওর গা থেকে বেশ সুন্দর একটা গন্ধ পেলাম। দামি পারফিউম।

“দেখো, শ্রবণা। তুমি নিশ্চয়ই এতো দিনে বুঝতে পেরেছো, বাড়ির সঙ্গে, স্পেশালি, কাবেরীদেবীর সঙ্গে আমার রিলেশন ন্যাচারাল নয়। হ্যাঁ। নিজের মা’কে কাবেরীদেবী বলছি বলে মনে কিছু কোরো না। তুমি তো মাত্র বছর দেড়েক হলো কাবেরীদেবীকে দেখছো। আর আমি? ফ্রম দ্য ভেরি বার্থ। তোমাকে প্রথম যেদিন আমি দেখি, সেদিন চমকে গিয়েছিলাম।”

“আমি কাবেরীম্যামের মত দেখতে বলে? পার্থ-আঙ্কল বলেছে আমাকে।”

“ধরে নাও নাইন্টি পারসেন্ট, এক্সেপ্ট কমপ্লেকশন। কাবেরীদেবী ছিলেন দারুণ ফর্সা, একদম গোলাপ ফুলের মতো।”

“আর আমি কালো।”

“সেটা কোনও ব্যাপারই না। শাহিনও তো ফর্সা ছিল। একদম পাটালিগুড়ের মতো।”

“শাহিন?”

সামান্য থেমে একটা নিঃশ্বাস ফেললো উচ্ছ্বাস, “আমার প্রেমিকা। লাস্ট ইয়ারে কেটে গেছে। শাহিন যেইমাত্র জানতে পারলো, আমি বাড়ির সঙ্গে কোনও রিলেশন রাখতে চাই না। চাই না ডাক্তার হতে। ইন আ নাটশেল, আমার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষাই নেই। ব্যস।”

“এইটুকুতেই? তাহলে সে ভালোবাসেনি বলো?”

“তারও আগে একটা ব্যাপার ঘটেছিলো। সে আমাকে… আই মিন… ইনভাইটেড টু বেড। সেদিন আমি টের পেয়েছিলাম, আমি কী নোংরা মেয়ের সঙ্গে…। তারপর… বাদ দাও। তারপর থেকেই আমি মেয়েদের কেন জানি না, সহ্য করতে পারতাম না। এই সময় তোমাকে দেখলাম। তার উপরে তুমি কাবেরীদেবীর মতো দেখতে। বিলিভ মি, শ্রবণা, আমি নিজেকে অনেকবার বুঝিয়েছি। এতে তোমার দোষটা কোথায়? বাট, তোমাকে দেখলেই মাথার ভেতরটা কেমন গোলমাল হয়ে যেতো।”

আমি হাত বাড়িয়ে উচ্ছ্বাসের নাকটা মুলে দিয়ে বললাম, “বুঝলাম, কিন্তু তার সঙ্গে…”

“জানি তুমি কী জানতে চাইছো। দাঁড়াও।”

হাত বাড়িয়ে জলের বোতল থেকে খানিকটা জল খেয়ে উচ্ছ্বাস শুরু করলো, “এতো আর শর্টফিল্ম নয়, যে পনেরো মিনিটেই বলে ফেলবো। আমার বাপি বলেছিল প্রায় সারা রাত ধরে। সবটা শোনার ধৈর্য আছে তো?”

আমি ঘুরে ওর মুখোমুখি বসলাম, “ধৈর্য তো আছেই মোরওভার হাতে ঘণ্টা চারেক সময়ও আছে।”

উচ্ছ্বাস খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। হয়তো মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর শুরু করলো, “আমার বাপি প্রবাসী বাঙালি। আমাদের আদি বাড়ি ছিল বোরঘাটে। বোরঘাট কোথায় নিশ্চয়ই জানো না? আসামে।”

“আর তোমার মা?”

“দ্যাখো। অনেকদিন আগে শোনা। মনে মনে সাজিয়ে বলতে হচ্ছে। তুমি প্লিজ আমাকে ইন্টেরাপ্ট কোরো না। সব বলবো।”

“অর্থাৎ মুখে ছিটকিনি। প্রসিড।”

“যে বাড়িটায় তুমি ছিলে, তার কাছেই, দিশা কলেজের পেছনে, আমার দাদুর বাড়ি ছিলো। ছিলো বলছি, তার কারণ বাড়িটা আর নেই। দিদা অনেক আগেই মারা গেছিলেন। দাদু মরে যাওয়ার পরে কাবেরীদেবী সেই জমি-বাড়ি বেচে দেন। এখন সেখানে হাইরাইজ বিল্ডিং। সেই বাড়ি-জমি বিক্রির টাকায় ক্রেস্ট গার্ডেনের এই বাড়িটা কেনেন কাবেরীদেবী। কেনেন বলছি, এই কারণে যে, তখন এই বিশাল জায়গাটা অনেক আগে পুরো খালি ছিল। ক্রেস্ট কনস্ট্রাকশন, এখানকার খুব নামী কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, এইরকমভাবে প্ল্যান করে, একই ছাঁদের বাড়ি বানাচ্ছিল পরপর। শুধু প্লট বিক্রি করলে যে যেমন ইচ্ছে বাড়ি তুলে ফেলতো। তাতে সব মিলিয়ে খুব একটা ভালো দেখাতো না, এখন যেমন দেখায়। ঠিক কিনা?”

কথা বলা বারণ। তাই আমি নীরবে সম্মতি জানালাম।

“আমার দাদু পুলিশের বেশ উঁচু পোস্টে ছিলেন। কাবেরীদেবী তার একমাত্র সন্তান। যদিও বাপির মুখে শুনেছি, আমার দাদু খুব অনুশাসনে নিজের মেয়েকে বড় করেছিলেন। টাকাপয়সার তো কোনও অভাব ছিল না। বেস্ট স্কুলে পড়িয়েছেন। বেস্ট এডুকেশন দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কাবেরীদেবীও খুব স্টুডিয়াস ছিলেন। শুনেছি, জীবনে ফার্স্ট থেকে থার্ডের মধ্যেই ঘোরাঘোরি করতেন। যাই হোক। কাবেরীদেবী ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইলেন, দাদু তাতেই রাজি। আমার দাদু, সেই আমলের লোক হলেও, যথেষ্ট লিবারেল মেন্টালিটির মানুষ ছিলেন। দেয়ারফোর, মেয়ে মানেই যে, বাড়িতে থাকবে, ঘরকন্নার কাজ শিখবে, তারপর বিয়ে, বাচ্চা এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন না। দাদু নাকি বলেছিলেন, তার মেয়ে যতো পড়তে চায়, তিনি তত পড়াবেন। তুমি শুধু তার মতো দেখতেই নও, আরও মিলও আছে। তোমার মতোই কাবেরীদেবী অল্প বয়সেই ট্রেনি ইঞ্জিনিয়ারের পোস্টে যোগ দেন এবং নিজস্ব দক্ষতায় দ্রুত উপরে উঠে আসেন। তবে এখানে তোমার সঙ্গে একটা ফারাক আছে।”

এই অবধি বলে থেমে উচ্ছ্বাস আমার মুখের দিকে চাইলো। তারপর হেসে ফেলে বললো, “একটু আধটু মুখ খুলতেই পারো।”

“তাহলে জানতে ইচ্ছে করছে, আমার সঙ্গে একটা ফারাক আছে, এই কথাটা জোর দিয়ে বললে কেন?”

“তার কারণ হল, তোমার সাকসেসের পেছনে হাত শুধু তোমার। কিন্তু কাবেরীদেবীর দ্রুত উত্থানের পেছনে আমার দাদুর প্রভাব ছিল অনেকটাই। যেহেতু তিনি পুলিশের উচ্চপদে ছিলেন এবং এই শহরের একজন গণ্যমান্য মানুষ, তাই… তুমি বুদ্ধিমতি। আর বললাম না। কাবেরীদেবীর মধ্যে তুমি অনেক রূপ দেখতে পাবে। তার কিছুই আমি পাইনি। সো, আই ফিল মাইসেলফ লাকি। কাবেরীদেবীর রূপ আছে, প্রেজেন্স অফ মাইন্ড ফ্যান্টাস্টিক আর পিআর পাওয়ার দুর্ধর্ষ। ইউ নো পিআর? পাবলিক রিলেশন। দাঁড়াও, চা খাই।”

একজন চাওয়ালা উঠেছিল, তার কাছে থেকে দুটো কাগজের কাপে চা নিয়ে একটায় চুমুক দিয়ে উচ্ছ্বাস ফের শুরু করলো, “হাউএভার। এবার বাপির কথা বলি। আগেই বললাম বাপিদের বাড়ি ছিল আসামের বোরঘাটে। বাপির চাইল্ডহুডটা স্মুথ ছিল না। নিজের বাবা ছেড়ে চলে গেছেন। মানে অন্য কারও হাত ধরে আর কী। আর মা, মানে আমার ঠাকুমা, তিনি তো অনেককালই ক্যান্সার পেসেন্ট ছিলেন, ঠাকুর্দা যা সম্পত্তি করেছিলেন, সে সব চিকিৎসার পেছনে হাওয়া করে দিয়ে একদিন নিজেই হাওয়া হলেন। এবার বাপি একা এবং নিঃস্ব। ভাগ্য সহায় ছিলো। ঠাকুমার বড়বোন বাপিকে নিয়ে চলে গেলেন। নওগাঁতে। বাপিকে একপ্রকার দত্তক নিলেন। মানে খাতায় কলমে নয় অবশ্য। তো বাপির সেই মাসি আর মেসোমশাই নিঃসন্তান ছিলেন। ফলে মাসি-মেসোর কাছেই বাপি মানুষ হতে লাগলো। কিন্তু ঐ যে মজা করে বলে না, ব্যাডলাকটাই খারাপ, সেই অবস্থা। কথা নেই, বার্তা নেই বাপির সেই মাসির হল হার্টঅ্যাটাক অ্যান্ড ডেড। বাপি তখন ক্লাস এইট। কাণ্ড বোঝো।”

“তোমার ঠাকুর্দার সেই বাড়িটা কী হল?”

“সে সব বেচে দেওয়া হয়েছিলো। যাই হোক, বাপির সেই মেসো ছিলেন শিপিং করপোরেশনের অফিসার। ভালো চাকরি। এইটাই যা বাঁচোয়া। তাই তিনি বাপির পড়াশোনার খরচ ভালোভাবেই চালিয়ে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে বাপি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট হল। এইখানে জানিয়ে রাখি, বাপির সেই মেসো কিন্তু মাসির চাইতে অনেকটাই বয়সে বড় ছিলেন। সেই আমলে এইরকম বিয়ে ন্যাচারাল ছিলো। তার ফলে হলো কী, বাপিও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটের বেড়া পার করলেন আর মেসোও রিটায়ার করলেন। ব্যস। এবার শুধু পেনসন। ইনকাম তো হাফ। তার উপরে সেই মেসোও কী সব রোগভোগ বাঁধিয়ে বসেছিলেন। তার নিজেরই মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টে অনেকগুলো করে টাকা মাসে মাসে গলে যেতে লাগলো। বাপির তখন ইচ্ছে পিএইচডিটা করবার। কিন্তু সব জায়গাতেই যেটা আগে লাগে, সেটা হল টাকা। টাকা ফুরিয়ে আসতে লাগলো দ্রুত। সেই মেসো তো আবার খরচে স্বভাবের ছিলেন। যৌবনে টাকাপয়সা কামিয়েছেন প্রচুর, সঙ্গে উপরিও ছিল, তেমনই উড়িয়েছেনও দেদার। অ্যাজ আ রেজাল্ট, পেনসনের টাকাটুকু বাদ দিলে বাকি আর কিছু নেই। বাপি পিএইচডির স্বপ্নকে পাশে সরিয়ে রেখে নেমে পড়লেন ছাত্র পড়াতে। সন্ধ্যেবেলা করে। আর সারাদিন ঘুরতেন একটা চাকরির সন্ধানে। যাই হোক, বছর ঘুরতেই বাবা ব্যাঙ্কিং এগজামে বসলেন এবং সরাসরি প্রবেশনারী অফিসার। সরকারি ব্যাঙ্ক। প্রথম পোস্টিং ডিব্রুগড়ে। বাড়িতে একা মেসোকে দেখাশোনার জন্য একটা পার্মানেন্ট মহিলা রাখলেন। দু’ বছর পরে ফের প্রোমোশান। এবার বিজয়নগরে। রাজস্থানে। এরপরেই বিলাসপুর এবং সেখান থেকে এই রায়গড়।”

“ও বাবা! এতো প্রায় ভারতবর্ষ ঘোরা।”

“হুহু। এমনি কি মানুষটা আজ ব্যাঙ্ক ম্যানেজার হয়েছে?”

আমার মনে পড়ল পার্থ-আঙ্কলের মুখটা। কতোটা বিনয়ী হলে তিনি বলতে পারেন, তিনি শুধুমাত্র ব্যাঙ্কের একজন কলমপেষা স্টাফ। বললাম, “তারপর?”

উচ্ছ্বাস হাসলো।

“হাসছো কেন?”

“তুমি নিশ্চয়ই এবার কাবেরীদেবীর সঙ্গে বাপিকে লিঙ্ক করবার চেষ্টা কোরছো?”

“তা তো বটেই।”

“দাঁড়াও, এই তো শুরু। এইবার প্রেম জমবে।”

সত্যি বলতে কী, এবার আমাকে হোঁচট খেতে হলো। পার্থ-আঙ্কল, কাবেরীদেবীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন? আমি তো ভাবতেই পারিনি। আমার মাথায় একটা চিন্তা এসেছিলো, যে হয়তো কাবেরীদেবীর অমতে তার বাবা পার্থ-আঙ্কলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমি এবারে নড়েচড়ে বসলাম।

উচ্ছ্বাস শুরু করলো, “বেশি ভাটাচ্ছি না। তুমি হয়তো জানো না শুধু তোমার নয়, মিন্দালের সব স্টাফের স্যালারি অ্যাকাউন্টই বাপির ব্রাঞ্চে। তো কাবেরীদেবী চাকরি পেয়ে ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলেন সেই ব্রাঞ্চে অ্যান্ড শি মেট মাই ফাদার। অবশ্য লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট কিছু হয়নি। হাহাহা। কাবেরীদেবী অ্যাট্রাকটিভ হতেই পারেন, কিন্তু আমার বাপিও কিছু কম ছিলেন না।”

“সে পার্থ-আঙ্কলকে এখন দেখলেও আন্দাজ করা যায়। রীতিমত সুপুরুষ যাকে বলে।”

“সেই আমলে কিন্তু প্রেম জিনিসটা এতো সহজ ছিল না। এখন যেমন ‘আই লাভ ইউ’ বললাম আর অমনি…। কাবেরীদেবী, দরকার না থাকলেও, ব্যাঙ্কে আসতে লাগলেন। কোনওদিন এক বান্ধবীর অ্যাকাউন্ট খুলতে, কোনওদিন আমার দাদুর নামে একটা এফডি করতে।”

“তারও অ্যাকাউন্ট ছিলো!!”

“ছিলো না। অন্য ব্যাঙ্কে ছিল। কাবেরীদেবী সেখান থেকে এফডি তুলে এনে বাপির ব্যাঙ্কে এফডি বানিয়েছিলেন। এইরকম আর কী। ধীরে ধীরে প্রেম বাড়লো। বাপিও মাঝেমধ্যেই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কাবেরীদেবীর কাজের জায়গায় গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যাক গে। অবশেষে বাপিকে দাদুর কাছে নিয়ে গেলেন কাবেরীদেবী। দাদু তার আত্মীয়দের জানালেন। সবাই এলেন। বাপিকে দেখলেন, বিয়ে ঠিক হলো। এইবার দুটো কাণ্ড ঘটলো। ব্যাঙ্কের কাছেই বাপি একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। সেই বাড়িতে একদিন সন্ধ্যের দিকে কাবেরীদেবী এসে হাজির। বাপি তো অবাক। সেই আমলে একটা ব্যাচেলার ছেলের ফাঁকা বাড়িতে মরে গেলেও কোনও মেয়ে আসতো না। কাবেরীদেবী এসে বাপিকে ধরলেন। তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে নিতে হবে। কেন? কারণ, কাবেরীদেবীর সঙ্গে একটা ছেলের মেলামেশা ছিল। খুব লুকিয়েচুরিয়ে। কাবেরীদেবীই সম্পর্কটা কাটিয়ে দিয়েছিল। সে নাকি আবার ফিরে এসেছে। এদিকে দাদু জানতে পারলে মেয়েকে গুলি করে দিতে দু’বার ভাববেন না। এবারে প্রথম যে কাণ্ডটা হলো, তার জন্য দু’জনেই হয়তো তৈরি ছিলো না। তুমি আন্দাজ করতে পারছো তো?”

“নাহ। সেভাবে…”

“বাপি আশ্বাস দিয়েছিলেন, দাদু রাজি থাকলে তিনি এই মাসেই বিয়ে করতে পারেন কাবেরীদেবীকে। কারণ বাপির তো থাকার মধ্যে এক প্রায় শয্যাশায়ী মেসো। তার অনুমতি ফোন করেও সে নিয়ে নিতে পারে। কৃতজ্ঞতায় হোক বা আনন্দে হোক, সেই প্রথমবার কাবেরীদেবী বাপিকে জড়িয়ে ধরলেন অ্যান্ড… এবার নিশ্চয়ই আরও বুঝিয়ে বলতে হবে না?”

আমি বুঝে গেছিলাম। বললাম, “আন্ডারস্টুড। দেন?”

“বিয়ের দিন আসতে তখনও তিন-চার দিন বাকি। নওগাঁ থেকে টেলিগ্রাম এলো। মেসো মৃত্যুসজ্জায়। ডাক্তার কার্টেন-কল দিয়ে দিয়েছেন। বাপিকে একবার দেখতে চান, শেষবারের মতো। ব্যাঙ্ক থেকে ছুটি নিয়ে বাপি দাদুকে জানাতেই তিনি বেঁকে বসলেন। কেন? সেটাই হলো সেকেন্ড ব্লান্ডার। দুঁদে পুলিশ-অফিসার হওয়ার কারণে দাদুর চেনাজানা লোকের অভাব ছিলো না। ফলে বাপির বাড়িতে কাবেরীদেবীর যাওয়ার খবরটা পৌঁছে গেছিলো যথাস্থানে। কে বলেছিল কে জানে। দাদু মেয়েকে চেপে ধরলেন। শুনেছিলাম, সোয়া এক ঘণ্টা ধরে দাদুর পুলিশি স্টাইলের জেরায়, মেয়ে ভেঙে পড়ে। যাই হোক। দাদু কোনও রিস্ক নিতে চাইলেন না। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, তার মেয়ের সর্বনাশ করে বাপি পালাচ্ছে। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, আগে বিয়ে, তারপরে নওগাঁ। বাপির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তার মেসো তার কাছে জন্মদাতার মতো আর এই বিপদে তিনি তাকে শেষ দেখা দেবেন না? বাপি শুধু দাদুকে বুঝিয়েই ব্যর্থ হলেন, তাই নয়, বাপিকে লিটার‍্যালি নিজের বাড়িতে বন্দি করে ফেললেন দাদু। দাদুকে পায়ে ধরে অনুরোধও করেছিলেন বাপি, কাজ হয়নি। অসহায় বাপি এবার কাবেরীদেবীর কাছে সাহায্য চাইলেন, কিন্তু কেন কে জানে, হয়তো দাদুই মেয়ের ব্রেন-ওয়াশ করে দিয়ে থাকবেন, কাবেরীদেবীও দাদুর সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, “আর দিন তিনেকের তো ব্যাপার। মেসো মরবেন না।”

“ইসস। সো ইনহিউম্যাইজম।” আমি বললাম।

“সেটাই। বাপি বিয়ে করলেন এবং স্ত্রীকে নিয়ে নওগাঁ পৌঁছে দেখলেন ততক্ষণে সব শেষ। বাপি গুম মেরে গেলেন। কাবেরীদেবী নিজের ভুল বুঝতে পেরে বাবার পা চেপে ধরলেন। বাট, বাপি ওয়াজ সো মেন্টালি উন্ডেড, তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, কাবেরীদেবীকে তিনি তাড়িয়ে দেবেন না ঠিকই, কিন্তু জীবনে কোনওদিনই তাকে স্পর্শ করবেন না।”

আমি বজ্রাহতের মত তাকিয়ে থাকলাম উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস ম্লান হাসল, “বাপি আর কাবেরীদেবীর সেই বিবাহবহির্ভূত প্রেমের ফসল, এই আমি, উচ্ছ্বাস ভটচাজ।”

“কী গো, মেয়েরা তো এখনও এলো না?” আমি সাম্যকে প্রশ্ন করলাম।

ও ল্যাপটপে কিছু একটা করছিলো, বললো, “হ্যাঁ। খবর পেয়েছি। রাস্তায় কী একটা পলিটিক্যাল র‍্যালি বেরিয়েছে, তাই দেরি হচ্ছে। চলে আসবে। তুমি চিন্তা কোরো না।”

চিন্তা কোরো না বললেই কি চিন্তা চলে যায়? আমি বারান্দায় গিয়ে শূন্য অন্ধকারের দিকে তাকালাম। সন্ধ্যে নামছে। সে তো প্রতিদিনই নামে। কিন্তু রায়গড়ের সেই আলোকোজ্জল দিনগুলোর উপরে যে এইভাবে ঝপ করে সন্ধ্যে নেমে আসবে, ভাবিনি। এই সব ঘটনা জীবনে কাউকে বলিনি, বললে নিজের কানেই বেসুরো ঠেকবে।

কোলকাতা থেকে রায়গড়ে ফিরেছি তখন এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। কাজের চাপ বেড়েছে। আজকাল কাজ শেষে বেরোতে বেরোতে অনেক দেরি হয়ে যায়। আমি কাবেরীম্যামকে বলে দিয়েছি, গাড়ি পাঠাতে হবে না। একটা ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে কথাবার্তা হয়ে গেছে। আমাদের প্রজেক্টের সিকিউরিটি-গার্ডের তুতো ভাই। সে কথা দিয়েছে, প্রতিদিন আমাকে দু’বেলা আমাকে ক্রেস্ট গার্ডেন থেকে নিয়ে যাবে আর নিয়েও আসবে। ব্যবস্থা মাসকাবারি।

আজ এই আটত্রিশ বছর, চার মাস, চার দিন বয়সে দাঁড়িয়ে হয়তো ফেলে আসা জীবনের অনেক কিছুই ভুলে গেছি, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত। তবে সেই দিনটা আমৃত্যু মনে থাকবে। সেদিন ছিল শনিবার। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নিজের জন্য কিছু টুকটাক কেনার পাশাপাশি পার্থ-আঙ্কলের জন্য একটা ঘরে পরবার ফতুয়া কিনেছি। ঘিয়ে কালারের। পার্থ-আঙ্কলকে খুব মানাবে। উচ্ছ্বাস আবার কোথাও উধাও হয়ে গেছে আর কাবেরীম্যাম তো কিছু নেবেন না।

পরদিন রবিবার দুপুরে লাঞ্চের পরে পার্থ-আঙ্কল নিজে ঘরে ছিলেন, আমি গিয়ে হাজির হলাম। ফতুয়াটা তার হাতে তুলে দিতেই তিনি কেমন বাঁধনছাড়া আত্মহারা হলেন। চোখদুটো নিমেষে ছলছল করে এলো। বললেন, “জানিস মা, আমার জন্য আমার ছেলেও কোনওদিন একটা রুমাল অবধি কিনে আনেনি। আমার কোনও কিছুর অভাব নেই, কিন্তু… তুই আমার সত্যিকারের মা ছিলি রে।”

বলেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আহ! মনে হলো যেন আমার বাপি আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। আমারও গলা বুজে এসেছিল। বললাম, “তোমাকে কি আমি বাপি বলে ডাকতে পারি?”

“বাহ, চমৎকার, এক্সেলেন্ট, নাইস সিনারিও।”

ঘরে যেন বাজ পড়ল। দরজায় কাবেরীম্যাম! তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কেঁপে উঠলাম। একজন নারীর দৃষ্টি যে এতো হিংস্র হতে পারে, আমার আন্দাজ ছিলো না। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “আমার মতো তুমি দেখতে হতেই পারো, কিন্তু সেটাকে ভাঙ্গিয়ে তুমি এতদূর যাবে, জাস্ট কুড’নট ইমাজিন। পুরুষ আর নারী। প্রথমে ছেলে, তারপরে বাপ। এজ ইজ নো ফ্যাক্টর। তাই না মেয়ে? অ্যাম আই রাইট?”

আমার মনে হচ্ছিল পচা নর্দমা থেকে এক বালতি ময়লা তুলে কেউ আমার মাথায় ঢেলে দিয়েছে। অবরুদ্ধ গলা থেকে কোনওমতে বলতে পারলাম, “আপনি ভুল বুঝছেন। আমি কিন্তু কোনও ভুল করিনি, ম্যাডাম।”

কাবেরীম্যাম চিৎকার করে উঠলেন, “শাটাআআআপ! আর যেন কোনদিনও তোমাকে… দিস ইজ ইওর লাস্ট চান্স।”

এইবার পার্থ-আঙ্কল নড়লেন। কাবেরীম্যামের দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন, “আয়াম সরি কাবেরী। যে কাজটা আমার অনেক আগেই করা উচিত ছিল। করিনি। করতে পারিনি। আজ করবো।”

পার্থ-আঙ্কল সজোরে একটা থাপ্পড় কষালেন কাবেরীম্যামের গালে আর উনি ছিটকে পড়লেন মেঝেতে।

মনে আছে, আমি পার্সটা উঠিয়ে নিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছিলাম বাড়িটা থেকে। তারপর কীভাবে স্টেশনে পৌঁছেছি, একটা জেনারেল টিকিট কেটেছি, কতক্ষণ বসেছিলাম স্টেশনে, কখন যে বোম্বে-হাওড়া মেল-ট্রেন এলো, তাতে চড়ে বসলাম আর পরদিন কী ভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে বাঘাযতীন কলোনির দুই কামরার ঘরে পৌঁছলাম, স্পষ্ট মনে নেই। মনে করতেও চাই না।

পনেরো দিন বিশ্রাম নিলাম। একদিন একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এল। কী ভেবে রিসিভ করতেই দেখি, সেই সিমার স্টিলের অশোক মালহোত্রা। তিনি ঐ কোম্পানি ছেড়ে দিয়ে এখন মিন্দাল স্টিল অ্যান্ড কন্সট্রাকশন লিমিটেডে জয়েন করেছেন। আমি মিন্দালের সঙ্গে কাজ করতে রাজি কিনা, জেনে নিয়ে চিঠি পাঠালেন। প্রজেক্ট ভুবনেশ্বর থেকে প্রায় ষোলশ’ কিলোমিটার দূরে ভরতপুরে। এবার আমার পোস্ট আর অ্যাসোসিয়েটের নয়, অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ারের। প্লাস কোম্পানি থেকে কোয়ার্টার অ্যালট করা হবে অ্যান্ড আদার পার্কস। তারপর ধীরে ধীরে প্রমোশন।

স্কুলভ্যান ঢুকে এলো বাউন্ডারির ভেতরে। দেখতে পাচ্ছি কিছু বাচ্চার পেছন পেছন উমা আর মেঘা নেমে এলো। এবার ওরা লিফটে চড়ে উঠে আসবে। আমি মনস্থির করে ফেলেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম, ওদের বলবো, ওদের দিদা নিজের বাড়ি চলে গেছেন। এখন মনে হচ্ছে, সত্যিটাই বলবো। বেশ কিছুদিন হয়তো ওরা মনখারাপ করে থাকবে। থাকুক। তারপরে একদিন ভুলে যাবে। স্মৃতিকে গ্রে-ম্যাটারে ধরে রাখা বা না-রাখা তো একটা আপেক্ষিক বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। ঠিক করলাম, আজ রাত থেকেই আমি আর সাম্য মাষ্টার বেডরুমটা শেয়ার করবো, আবার আগের মতো।

দরজার বাইরে লিফট থামার শব্দ হল।



-সমাপ্ত-

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “novel-aapekkhik

  1. অজিতেশ বাবুর বেশ কিছু লেখার মতই এই উপন্যাসটিও মন জয় করল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *