novel-aporaboudi

অপরাবউদি
রতনতনু ঘাটী


অপরাবউদিকে কাল চুমু খাওয়ার বাজি ধরতে চেয়েছিল অনীক। বাজি ধরছিল আমার সঙ্গে। আমি বলেছিলাম, “তুই কী রে? অত মমতাময়ী, অমন হাসিখুশি, অমন সুন্দরী, অমন বন্ধু যে বউদি, তাকে…? তুই আর কোনও দিন আমার সামনে এ ধরণের কথা বলিস না। আমার শুনতে ভাল লাগে না।”

অনীক চোখে একটা বিচিত্র ভঙ্গি করে আমার সামনে থেকে কেটে পড়েছিল। আজ সন্ধের পর থেকে আমার মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কথা হয়েছিল অনীকের সঙ্গে, ও অফিস থেকে ফেরার পথেই সোজা চলে আসবে অপরাবউদির বাড়ি। আমিও চলে যাব তার আগেই। তারপর…! আজ অপরাবউদির বাড়ি যেতেই ইচ্ছে করছে না। অনীকের ওই কথা শোনার পর বউদির মুখের দিকে তাকাতেই পারব না আর।

আমার তো আর অফিসটফিস নেই। ঢু ঢু কোম্পানি। সারাদিন ঘুরে বেড়াই। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় মেতে থাকি মেসি আর নেইমারকে নিয়ে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট হলে ধোনি, গম্ভীরদের নিয়ে পাড়ার আড্ডায়। বাড়ি ফিরলে কখনও মা বকেন, “আর কতদিন এমন করে ঘুরে-ঘুরে বেড়াবি? এবার একটা কিছু দ্যাখ। ওই তো টপাস করে বিন্টু ঢুকে পড়ল চাকরিতে?”

আমি মাকে বলি, “মা, অমন টপাস করে আমিও কোথাও ঢুকে পড়তে পারতাম, যদি ওর মামার মতো আমারও একজন মামা থাকতেন। এবং তিনি পার্টির চাঁই হতেন। এবং তিনি অনেক বাঁ হাতের খেলা জানতেন। এবং তিনি যদি মানুষ-টানুস খুন করতে পারতেন। তখন দেখতে! কী করব বলো? চেষ্টা তো কম করছি না।”

আজ বিকেল থেকে আমার মাথায় চাকরিটাকরি কিচ্ছু নেই। অপরাবউদির বাড়ির দিকে যেতে আমার পা একদম উঠছে না। রোজ সন্ধে থেকে আমাদের জমাটি আড্ডা বসে অপরাবউদিকে ঘিরে, অপরাবউদির বাড়িতেই। বউদিদের বেশ বড় দোতলা বাড়ি। ঘিয়ে রঙের। বেশ একটা বৈরাগ্যের ভাব আছে রংটার মধ্যে। গ্রিল-ঢাকা বারান্দা। বউদির খুব চোরের ভয়। তাই সব ঢেকে দেওয়া। বাড়ির বাঁ দিক দিয়ে একটা ঝাঁকড়া মাধবীলতার গাছ মাটি থেকে দোতলার মাথা পর্যন্ত উঠে গেছে। মায়াবী মাধবীলতা অনেকটা অপরাবউদির মতো বাড়িটাকে আলাদা একটা সৌন্দর্য দিয়েছে। বর্ষা নামলে দূরের কদম গাছটা যখন ফুলে-ফুলে ভরে যায়, তখন মাধবীলতার গাছটা বলে, ‘আমাকে দেখছ না? আমিও ফুল ফোটাতে জানি!’ মাধবীলতার কথা বাদ দিলে, বাড়িটা একদম নির্জন, একলা! পাড়ার অনেকে অপরাবউদির বাড়িকে বলে ‘নির্জন বাড়ি’। বাড়িতে কেউ নেই, শুধু অপরাবউদি ছাড়া। বিকেলবেলা বাড়িটা থেকে একটি মেয়ের গলায় গান ভেসে আসে। তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করেন। তিনিই কি অপরাবউদি? সেই কিছুক্ষণের জন্যে বাড়িটার নির্জনতা ভাঙে।

অপরাবউদির বর পুলকেন্দুদা, থাকেন দুবাইতে। বছরে দু’ বার বাড়ি আসেন। এটা পুলকেন্দুদার পৈতৃক বাড়ি। কিন্তু পুলকদাকে কখনও এ পাড়ার মানুষ বলে মনে হয় না। ছোট ছিলেন যখন, মা নেই বলে পুলকদার বাবা ছেলেকে বাইরে হস্টেলে রেখে পড়াশুনো করিয়েছেন। পাশ করার আগেই বাবাও চলে গেলেন। তারপর পাশ করেই বোকারোতে চাকরি। আমরা পুলকদাকে কখনও পাড়ার লোক বলে মনে করি না। এ পাড়ায় পুলকদার একজনও বন্ধুও নেই। যখন বাড়ি আসেন, তখন চুপচাপ থাকেন। একা এদিক-ওদিক ঘুরে তারপর ফের চাকরিতে চলে যান। তারপর তো বিয়ে। অপরাবউদির সঙ্গে। নির্জন বাড়িটা যেন অনেক দিনের পর ধ্যান ভেঙে মাথা তুলেছিল।

বিয়ের পর বছর খানেক অপরাবউদি বোকারোতে ছিল। তারপর ফিরে এল। অত রুক্ষ দেশ পছন্দ হল না বউদির। বলল, “নিজের বড়িতে থাকার আনন্দই আলাদা। কী নরম আর সুজলা!”

আমরা এরকমই জানতাম। লোকমুখে শোনা। ক’দিন পরে শুনলাম, আসল কথা তা নয়। পুলকদা দুবাইতে একটা ভাল চাকরি পেয়ে চলে গেছেন। এক্ষুনি সেখানে বউদিকে না নিয়ে গিয়ে সব বুঝে তবে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সেটাই ঝামেলার হয়ে গেল। বউদির পছন্দ হয়ে গেল নিজের বাড়িটা। এই মাধবীলতার গাছটা। এ পাড়ার আর একটা জিনিস ভাল লেগে গেল অপরাবউদির। সে হল, আমরা।

আমরা একদিন পাড়ায় বাড়ি-বাড়ি চাঁদা চেয়ে বেড়াচ্ছিলাম। দলে অনেকে ছিল। আমিও ছিলাম। বেল বাজাতে একজন সুন্দরী মেয়ে দোতলার বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন, “কী দরকার?”

আমি বললাম, “আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী করব, চাঁদা চাই।”

উনি নীচে নেমে এসে দরজা খুলে আমাদের বসালেন। শুনলেন সব। আমি বললাম, “রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করবে ছোটরা। পাড়ার মেয়েরা গান গাইবে। আমরা নাটক করব, রবীন্দ্রনাথের ‘মালিনী’। আমাদের স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু বলবেন।”

উনি বললেন, “ ‘মালিনী’ না করে ‘ডাকঘর’ করলেই পারতে?”

ওঁর কথায় আমার খুব রাগ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

উনি একটু মুচকি হাসলেন, “তোমাদের ডাকঘর করারই তো বয়স!”

অভ্রনীল বলল, “না, আমরা কলেজ পাশ করছি এ বছর। আমরা ছোট নই।”

উনি আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন, “তুমি একদমই ছোট। তুমিও কলেজ পাশ করবে? বাঃ! কী নাম তোমার?”

আমি বললাম, “আমি অর্ক। দিন, কত দেবেন বলুন!”

উনি সেরকমই হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের বাজেট কত?”

অনীক বলল, “ওই সব মিলিয়ে কুড়ি হাজার টাকা।”

উনি মৃদু হেসে বললেন, “আমি তোমাদের সব খরচটাই দেব। খুশি তো? তবে একটা কন্ডিশন আছে। সেটা মানতে হবে।”

আমরা ভাবতেই পারছি না। কিন্তু আবার কন্ডিশান কী? এ কথা শুনে অবিশ্বাসী মুখে তাকালাম ওঁর দিকে। উনি বললেন, “আমার চাঁদার কথাটা কাউকেই বলা চলবে না। এ তোমাদের প্রতি আমার ভালবাসা! এসব কথা আবার বলতে আছে নাকি? কাল তোমাদের কেউ এসে নিয়ে যেও, কেমন?”

আমাদের উনি মিষ্টি খেতে দিলেন। পরের দিন বিকেলবেলা ক্লাবে বসে বন্ধুরা বলল, “তুই যা অর্ক। চাঁদাটা নিয়ে আয়।”

আমি বললাম, “হ্যাঁ রে, ওই বাড়িটা থেকে তো বিকেলবেলা গান শুনতে পাই। বাড়িতে তো আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। মনে হয়, উনিই গান করেন। বেশ মিষ্টি গলা! তা হলে আমাদের যখন অতখানি চাঁদা দিচ্ছেন, তখন ওঁকে আমাদের অনুষ্ঠানে গান গাইতে বললে কেমন হয়?”

দেবাঙ্কুর বলল, “না, উনি আমাদের নাটকে মালিনীর চরিত্রটা করুন। সেটাই বল। বউদি যা সুন্দরী দেখতে! দারুণ মানাবে। আর আমাদের পাড়ায় মালিনী ঠিকঠাক কে করতে পারবে বল তো?”

অনীক হাঁটু গেড়ে বসে দু’ হাত জড়ো করে বলল, “ ‘প্রজাদের পুরাও প্রার্থনা। মহাক্ষণ/ এসেছে নিকটে। দাও মোরে নির্বাসন/ পিতা।’ ওঃ, উনি যদি মালিনী চরিত্রটা করেন পুরো ফেটে যাবে রে!”

আমি ওঁর বাড়ি যাওয়ার পথে অনিকেতকে টানলাম। অনেক গাঁইগুঁই করে শেষে অনিকেত আমার সঙ্গে এস। অনেক বার ভেবেও যখন কিনারা করতে পারলাম না, তখন অনিকেতকে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে, ওঁকে কীসে পার্টিশিপেট করার অনুরোধ করব, গান না নাটক?”

ও যা মুখচোরা, “বলল, তোর যা মনে হয়।”

আমরা গিয়ে বেল বাজালাম, উনি আজ আর জিজ্ঞেস না করেই নীচে নেমে এলেন। টাকার খামটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। একবার ভাবলাম, গুনে দেখব? তারপর ভাবলাম, যিনি অত টাকা দিতে নিজে-নিজে রাজি হয়ে যান, তিনি কি আর কম দেবেন? আমি রসিদ দেওয়ার আগে বিনয়ী গলায় বললাম, “কী নাম লিখব?”

উনি বললেন, “অপরাবউদি।”

“পদবি কী?”

“লাগবে না! আমি তোমাদের কাছে শুধুই অপরাবউদি।”

আমি তাই লিখে অপরাবউদির হাতে দিয়ে বললাম, “একটা অনুরোধ ছিল?”

“আবার কী?”

“আমি আপনার বাড়ির নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় বিকেলবেলা আপনার গান শুনি। আমাদের অনুষ্ঠানে যদি গান করেন, তা হলে খুব ভাল হয়।”

অনিকেত মিহি গলায় বলল, “তা না হলে, আপনি যদি আমাদের নাটকে মালিনী চরিত্রটায় অভিনয় করেন, তা হলে দারুণ হয়। মালিনী করার মতো আমাদের কেউ নেই।”

অপরাবউদি বললেন, “আমাকে ‘আপনি’ করে বলবে না, ‘তুমি’! কাল বিকেলবেলা তোমরা সব্বাই এসো, কাল বলব।”

এত টাকা চাঁদা হাতে পেয়ে আমরা সকলেই টগবগ করে ফুটছি। ক্লাবে ফিরে আসতেই শুভ্রকান্ত একটা ডিগবাজি খেয়ে বলল, “অপরাবউদি একা গোটা অনুষ্ঠানের সবটাতেই যদি অংশগ্রহণ করেন, তাতেও আমার আপত্তি নেই।”

পরের দিন আমরা বিকেলবেলা অপরাবউদির বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। বউদি মনে হয় আমাদের জন্যে অপেক্ষাই করছিল। অপেক্ষার মুখ যেমন দেখতে হয়, বউদির মুখটা সেরকমই দেখাচ্ছিল। আমি, দেবাঙ্কুর, অনীক, অভ্রনীল, অনিকেত, শুভ্রকান্ত, সব্বাই গেছি। বউদি প্রথমে আমাদের রাজভোগ খেতে দিল। তারপর শিঙাড়া। তারপর চা। দারুণ মজা করে কথা বলে। আমাকে বলল, “তুই নাটকে কোনটা করবি শুনি?”

আমি সাহস পেয়ে গেছি বউদির কাছে। বললাম, “তুমিই বলো না, আমাকে কোনটা মানাবে? তুমি যে চরিত্রটা করতে বলবে, আমি সেটাই করব।”

অপরাবউদি বলল, “তুই? তুই সুপ্রিয়র চরিত্রটা কর। ওটা দারুণ পারবি তুই! ওই যে নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে রাজ-উপবনে মালিনী আর তার পরিচারিকারা আছে, সেই দৃশ্যে ক্ষেমংকরের কথার উত্তরে সুপ্রিয় বলছে: ‘বন্ধু এক আছে/ শ্রেষ্ঠতম, সে আমার আত্মার নিশ্বাস,/ সব ছেড়ে রাখিয়াছি তাহারি বিশ্বাস/ প্রাণসখে-ধর্ম সে আমার’। তুই ভাবতেই পারছি না রে অর্ক, দারুণ!”

আমি বললাম, “ওঃ, তোমার তো গোটাটাই মুখস্থ? তা হলে বউদি, তুমি মালিনী করো?”

বউদি বলল, “না রে! আমি মালিনী না, গান না, আবৃত্তি না, কিচ্ছু না। আমি শুধু তোদের সঙ্গে থাকব দূরে থেকে। তোরা জানবি, অপরাবউদি তোদের সঙ্গে আছে।”

তারপর রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়ে গেল। সকলেই খুব প্রসংশা করল। কিন্তু অপরাবউদি আমাদের অনুষ্ঠানে পর্যন্ত এল না। সারাক্ষণ খোঁজ নিল বাড়ি থেকে। তবে তারপর থেকে অপরাবউদি আমাদের বন্ধু হয়ে গেল। অপরাবউদির ওই ঘিয়ে রঙের বাড়িটা হয়ে গেল আমাদের বন্ধুর বাড়ি!

তারপর থেকে অপরাউদির বাড়িটা আমাদের সন্ধেবেলার সন্ধ্যামণি ফুল! আমাদের যখন আড্ডা বসে সন্ধেবেলা, আমি তো থাকিই। থাকে অভ্রনীল, দেবাঙ্কুর, অনিকেত, শুভ্রকান্ত। মাঝে-মাঝে এসে জুটে যান কিংশুকদা। আসলে অপরাবউদি কিংশুকদারই সমান বয়সি হবে। আমাদের সকলের চেয়ে অপরাবউদি বয়সে বড়। কারও চেয়ে পাঁচ বছরের বড়, কারও চেয়ে তিন বছরের। আমার চেয়ে অপরবাউদি মনে হয় বছর দুয়েকের বড়। তার কমও হতে পারে। তাতে আমাদের আড্ডা দিতে একটুও অসুবিধে হয় না। আমরা সকলেই বউদিকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করি। আর অপরাবউদি, বন্ধু মানে একদম বন্ধুই। কখনও কখনও আড্ডার সময় মনে হয়, বউদি বুঝি আমার চেয়েও ছোট। যেন অতসীদের উঠোনের সবুজ ঘাসফড়িং। সারাক্ষণ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। বউদি আমাদের ‘তুই’ করেই কথা বলে।

বউদির বাড়িতে এমন একটা আড্ডা গড়ে তুলেছি আমরা। এর কারণ আর কিছুই নয়, অপরাবউদির গান! দারুণ সান্ধ্যভোজন! মন ভাল করে দেওয়া নির্মল আড্ডা! অনেক অনুরোধ করলে এক-আধটা গান গাওয়ানো যায় বউদিকে দিয়ে। তাও অনেক সাধ্যসাধনার পর। অপরাবউদি পুলকেন্দুদার বউ। পুলকেন্দুদা এখন থাকেন দুবাইতে। কী যেন একটা বিরাট অঙ্কের মাইনের চাকরি করেন। আমরা অনেক দিন বউদিকে জিজ্ঞেস করেছি, “আচ্ছা বউদি, দাদা কী চাকরি করেন গো? অত বিশাল মাইনে পান?”

অপরাবউদি ঠোঁটটা সপ্তমীর চাঁদের মতো করে বলে, “আমাকে কি তোদের দাদা দুবাই নিয়ে গেছে যে, আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি? তোদের ডেকে-ডেকে বলব? তবে, দুবাইতে যখন থাকে, তখন কিছু একটা তো করেই! না হলে তো ঘরে এসেই থাকত! আর মাসে-মাসে অতগুলো টাকা যখন পাঠায়, নিশ্চয়ই মিনিমাগনা কেউ টাকা দেয় না? আর সে টাকায়ই তো তোদের চা-শিঙাড়া খাওয়াই।”

তবে আমরা দেখতাম, পুলকেন্দুদা বছরে একবার আসেন, কখনও দু’বার। অনেক জিনিস আনেন বউদির জন্যে। দারুণ-দারুণ চুড়িদার, রাতপোশাক, শাড়ি, হিরের নেকলেস, কানের ঝুমকো। এখন যে ডায়মন্ডের নাকছাবিটা বউদি সারাক্ষণ পরে থাকে, সেটাও তো বছর দুয়েক আগে আনা। কত রকমের যে প্রসাধন কিনে আনেন, সেসবের নামই আমরা জানি না, শুনিওনি কখনও। আমাদের জন্যেও যে এক-আধবার এক-আধটা টি-শার্ট আনেননি তা নয়। সে বউদি বলে দেয় কি না জানি না। তবে হিসেবে আমিই বেশি টি-শার্ট পেয়েছি, তিনটে। আমাদের জন্যে আফটার সেভ, সেভিং ক্রিমও আনেন কখনও-কখনও। কখনও আবার শুধুই দামি চকোলেট আনেন। দারুণ-দারুণ বিস্কুটও আনেন।

অপরাবউদি দেখতে খুব সুন্দরী। আমার তো যে-কোনও মেয়েকেই সুন্দরী মনে হয়। আমি এ পর্যন্ত একজনও অসুন্দরী মেয়ে দেখিনি। মেয়েরা এরকমই। যেমন-তেমন হলেও কেমন একটা শ্রী থাকে। আর অপরাবউদি সুন্দরী মানে সত্যিই সুন্দরীই। এক মাথা কোমর-ছাড়ানো লম্বা কালো চুল, গায়ের রং ফ্যাটফ্যাটে ফরসা নয়, যাকে বলে কাঁচা হলুদ রং। এই উপমাটা আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাসে পড়েছি। যতটা লম্বা হলে মেয়েদের সুন্দর দেখায়, অপরাবউদি ঠিক ততটাই। লম্বা তালগাছও নয়। লম্বা মেয়েদের কবিরা যে উপমাই দিন, আমার তো মনে হয় যেন সবুজ লতা। হিলহিল করে হেঁটে যায়। বউদি বেঁটেও নয়। বেঁটে মেয়েদের আমার একদম ভাল লাগে না। যেন ন্যাড়া টগর গাছ। যেমন স্লিম হলে মেয়েরা ছেলেদের চোখ টানে, অপরাবউদি একদম ঠিক তেমনটাই। নাকটা একদম সুচিত্রা সেনের মতো। অভ্রনীল অবশ্য বলে, “না, অপরাবউদির নাকটাক নয়, চাউনিটা সুচিত্রা সেনের হারানো সুর ছবির মতো।”

ও-ও তো আমার মতো একালের ছেলে। কবে আবার সুচিত্রা সেনের ছবি দেখল কে জানে? মনে রেখেছে তাঁর নাকটা? সুচিত্রা সেন মারা যাওয়ার পর টিভিতে কয়েকটা ছবি দেখাচ্ছিল বটে! আমিও তখন দেখেছি। অভ্রনীলও হয়তো তখনই দেখেছে। কিন্তু সুচিত্রা সেনের চাউনিটার কথা মনে রেখেছে।

এ নিয়ে আমাদের মধ্যে আড়ালে কম তর্ক হয় না। কিংশুকদা বলেন, “অপরাবউদির থুতনিটা মেরিলিন মনরোর মতো!” আমরা মেরিলিন মনরোর বা সোফিয়া লোরেনের কোনও ছবিই দেখেনি কখনও। এক-আধটা পোস্টার হয়তো কখনও দেখেছি, মুখটা ঠিকঠাক মনে নেই।

অনীক বলে, “না, একদম নয়। অপরাবউদি দীপিকা পাড়ুকোনের মতো দেখতে।” আমরা অপরাবউদিকে যে যেমন তুলনা করি না কেন, কিংশুকদা ছাড়া সকলে আমরা আড়ালে অপরাবউদিকে ‘বিউটি বউদি’ বলেই ডাকি। তবে সামনাসামনি কখনও ও নামে কেউ ডাকিনি। পাছে বউদি ক্ষুন্ন হন, তাই। কেননা, বিউটি বউদি কথাটার মধ্যে কেমন যেন একটা সেক্সের ঝাঁঝ আছে। একদিন এরকমই ব্যাখ্যা করেছিল দেবাঙ্কুর। তবে আমি অপরাবউদিকে তুলনা করি একমাত্র অপরাবউদির সঙ্গেই। আমি বলি, “অপরাবউদি ,অপরাবউদির মতোই সুন্দরী! বউদির সঙ্গে আর কারও তুলনা চলতে পারে না।”

ওরা সকলেই বলে, “অর্ক, তোর সঙ্গেই অপরাবউদির পটে ভাল! তোকে কত কিছু কিনে আনতে টাকা দেয়। বউদির বাজারহাটের সিংহভাগই তো তোকে করে দিতে হয় কিনা! তুই আসলে বউদির বাজার সরকার!”

কথাটার মধ্যে একটা নিরীহ খোঁচা থাকলেও, কথাটা সত্যি বলে আমি প্রতিবাদ করতে যাই না। বউদি আমাকে মাঝে-মাঝে কিছু জিনিস কিনে আনতে দেয় বটে! আমাকে দেবে না তো কাকে দেবে? আমার মতো টোটাল বেকার আমাদের দলে আর কে আছে? যাকে ডাকলেই হাজির?

হ্যাঁ, অপরাবউদি এমন কিছু-কিছু জিনিস কিনতে অর্ডার করে, দেখে আমি ঘারড়ে যাই। আমার নাকের পাটায় ঘাম জমতে থাকে। আমার কান চুলকোতে শুরু করে। চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন এক্ষুনি আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। আমি আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মারা যাব।

একদিন আমি অপরাবউদির বাড়ির পাশ দিয়ে আমাদের ক্লাবে যাচ্ছিলাম। তখন দশটা-টসটা হবে। যারা চাকরি করে, তারা উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে অফিসের দিকে। বউদি জানলা দিয়ে হাত নেড়ে ডাকল। আমার তো মোবাইল নেই। আমি বউদির বাড়ি না এলে আমাকে পাবে কী করে? অবশ্য আমিও বউদির জানলার দিকে তাকিয়েছিলাম। কেউ সেদিকে না তাকালে কি হাত নাড়া দেখা যায়? কিন্তু কেন যে তাকিয়েছিলাম, জানি না। কিন্তু এদিক দিয়ে গেলে আমার চোখ চলে যায় বউদির বাড়ির দিকে। ঘরের মধ্যে যেতেই বউদি চেয়ারে খাতির করে বসাল। একটা ইয়াব্বড় রাজভোগ চলে এল প্লেটে করে আমার সামনে। ভাবলাম, আজ দিনটা তা হলে ভালই যাবে। চাই কি, হয়তো আজ চাকরির একটা ইন্টারভিউ লেটারও এসে যেতে পারে বিকেলে। কিন্তু বউদির রাজভোগ মানে গভীর কিছু একটা কাজ করে দিতে হবে, এ আমি বুঝতেই পারছি। তবু ও নিয়ে না ভেবে রাজভোগটা আয়াস করে খেলাম।

অপরাবউদি বলল, “অর্ক, তুই আমার একটা জিনিস কিনে এনে দিবি? জানিস তো, আমার বাজারে যেতে একদম ভাল লাগে না। দোকানদারগুলো যেন হাঁ করে গিলতে থাকে!”

আমি বললাম, “আহা, সুন্দরী বলেই না দেখা?”

বউদি হেসে বললেন, “সুন্দরী না হাতি! তোর তৃণার মতো না?”

আমি বউদিকে তৃণার কথা বলেছি। তৃণা আমার কলেজে পড়ত। আমার নীচের ক্লাসে। দু’-চারবার কথাও হয়েছে তৃণার সঙ্গে। কিন্তু আসল কথাটা বলতে পারিনি। বউদির খোঁচায় তৃণার মুখটা মনে পড়ে গেল। তবে তৃণা, অপরাবউদির চেয়ে সুন্দরী কিনা, সে নিয়ে দীর্ঘ ডিবেট হতে পারে। কে জিতবে জানি না। বললাম, “অত কথার কী? বলোই না। আমি কখনও তোমার কোনও জিনিস কিনে দিইনি, যা তুমি অর্ডার করেছ? কোনও দিন হয়েছে? তুমি কখনও আমার অনুমতি নিয়ে তবে জিনিস কিনতে দাও নাকি?”

“তুই এনে দিস বলে তো আমার আর কাজ আটকায় না। তবে আজ কী কিনতে হবে, এটা আমি মুখে তোকে বলতে পারব না। এই খামের মধ্যে একটা কাগজে লেখা আছে। আর খামের মধ্যে টাকাও আছে। তুই একটা হোসিয়ারি দোকানে গিয়ে দেখালেই হবে। দোকানদার যা দেবে নিয়ে চলে আসবি। রাস্তায় কেউ যদি বলে, ‘অর্ক, কী কিনতে গিয়েছিলি?’ তুই আবার প্যাকেট খুলে দেখাতে যাস না! তুই যা হাঁদা!”

আমি হাঁদা এই কথাটা পাড়ায় আমার সমবয়সি মেয়েরা বলে। তারা আমার হাঁদামির কী দেখেছে জানি না। গত বছর পুজোর প্যান্ডেলে ঘুরছিলাম একা।

কণা আমাদের পাড়ায় থাকে। সবে নাইনে উঠেছে। বলল, “অর্কদা, তুমি একা ঘুরছ যে? বন্ধুরা দলে নেয়নি?”

আমি বললাম, “আমার একলাই ঘুরতে তো ভাল লাগে। কেন?”

কণা বলল, “তোমার মোবাইল নম্বরটা দেবে?”

আমি বললাম, “আমার মোবাইল নম্বর নিয়ে তোর কী কাজে লাগবে? আমার তো মোবাইলই নেই!”

অমনি ফোঁস করে ওঠার মুখের ভঙ্গি করে বলল, “প্রোপোজ করা বোঝো? হাঁদা কোথাকার! হাঁদাগোবিন্দ!” মুখ ঘুরিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল কণা।

আর আমার মা হাঁদা বলেন। মা বলেন, কারণ, এখনও আমি একটাও চাকরি জোটাতে পারলাম না বলে। মা বলেন, “তোর মতো হাঁদা ছেলেকে চাকরি দিয়ে সেই অফিস কি বিপাকে পড়বে নাকি?”

আর এখন অপরাবউদিও আমাকে হাঁদা বলল। খামটা নিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, যাচ্ছি!”

বউদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে পা দিতেই মনে হাজার প্রশ্ন ভিড় করতে লাগল। চাকরির ইন্টারভিউয়ের পড়াশোনার সময় এত প্রশ্ন মনে এলে, উত্তরগুলো প্র্যাকটিস করে হয়তো এতদিনে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলতেও পারতাম।

প্রথমে মনে হল, বউদি যে জিনিসটা কিনতে দিল, সেটা কী, বলল না কেন? কী এমন জিনিস যে নাম বলা আমার কাছে বারণ? নাকি নামটা বলতে বউদি লজ্জা করছে? দেখব খামটা খুলে? আচ্ছা, বউদি কী বোকা! মুখে নাম বলল না বটে, কিন্তু এক্ষুনি খামটা খুলে আমি তো দেখেই নিতে পারি? এ কথাটা কি বউদির মাথায় আসেনি? তা হলে আর অত লুকনোর কী আছে? তারপর ভাবলাম, না, বউদি বিশ্বাস করে, অর্ককে যদি না বলা যায়, তা হলে অর্ক সে কাজ করবে না। বউদি যখন জিনিসটার নাম বলেনি, আমিও খামটা খুলে দেখব না। আমার মনে একটা অভিমানও মাথা তুলতে লাগল একটু-একটু করে। আমার চেয়েও কি দোকানদার বেশি বিশ্বস্ত নাকি বউদির কাছে? দোকানদার জানলে দোষ নেই, আর আমাকে নামটা বললেই দোষের? বউদি আমাকে একটুও ভালবাসে না।

হঠাৎ দেখি আমি কখন চলে এসেছি ‘বিনোদিনী হোসিয়ারি হাউস’-এর একদম সামনেটায়। আমাদের এই শহরতলিতে এটাই বড় হোসিয়ারি দোকান। বড়-বড় ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র রাখে। আজ দেখি দোকানে বসে আছে একটি মেয়ে। দেখে মনে হল আমারই বয়সি, নয়তো আমার চেয়ে এক-দু’ বছরের বড়টড় হবে হয়তো। আমি খামটা মেয়েটির হাতে দিলাম। মেয়েটি ভাবল, আমি বুঝি তাকে আমার মনের ভাললাগা জানিয়ে প্রেমপত্র দিচ্ছি। মনে-মনে মেয়েটিকে বললাম, ‘আরে বাবা, আজকাল কেউ প্রেমপত্র লেখে নাকি? আর যদি প্রেম জানাতেই হয়, তা হলে তোমার মোবাইল নম্বর জোগাড় করে এস এম এস করে দিতাম মনের কথাটা। নয়তো ফেসবুকে…। এটা কি জানো না, তুমি এমন কিছু সুন্দরী নও যে, আমি তোমাকে প্রেম নিবেদন করতে এসেছি এই সকালবেলায়? তুমি তৃণা হলে একটা কথা ছিল!

মেয়েটি একটু দ্বিধা নিয়ে খামটা খুলে কাগজটা বের করতে গিয়ে দেখলাম, তার হাতটা একটু কেঁপে গেল যেন। তখনও হয়তো মেয়েটি ভেবেছিল, এটা প্রেমপত্র না হয়েই যায় না। খামটা খুলতে-খুলতে একবার আমার মুখের দিকে তাকালও। তারপর কাগজের লেখাটা পড়েই ফিক করে হেসে ফেলল মেয়েটা।

তারপর দেখি একটা নামী কোম্পানির ব্রা-র প্যাকেট বের করে নম্বর দেখে একটা ব্রা কাগজের খামে ভরে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি তখন লজ্জায় একেবারে যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছি! ফেরত টাকা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “নিন, ফেরতটা নিন।”

আমি অপরাবউদির বাড়ি ফিরতে গিয়ে রাস্তার পাশে একটা রকে ধপাস করে বসে পড়লাম। অপরাবউদি এমন একটা জিনিস আমাকে কিনতে দিল কেন? এবার আমি বউদির সামনে দাঁড়াব কী করে? ইস, কী লজ্জা! আমার এখনই তো লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার কান গরম হয়ে উঠছে। নাকের পাটায় ঘাম জমতে শুরু করেছে। চোখের পাতা থরথর করে কাঁপছে। পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগায় কেমন দপদপ করতে শুরু করছে।

দেবাঙ্কুর ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। দৌড়চ্ছে ব্যাঙ্কের দিকে, মনে হয় দেরি করে ফেলেছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখের ইশারা করে গেল। ওর যদি হাতে সময় থাকত, তা হলে আমার হাতের প্যাকেটটা না দেখে ছাড়ত না। আমি ধরা পড়ে যেতাম। তারপর আমার হাতের প্যাকেটে যা দেখত, গোটা পাড়াময় করে বেড়াত। বিশ্বাসই করত না যে, ওটা অপরাবউদির জিনিস। সকলেই ভাবত, এটা তাকেই দেব, যাকে আমি ভালবাসতে চাই। যাক, এ যাত্রায় বাঁচা গেল!

আমি উঠে পড়ালাম। জিনিসটা বাড়ির নীচ থেকে দিয়ে চলে যাব। দোতলা থেকে ঝোলানো ব্যাগে জিনিসটা রেখে বউদিকে ডেকে সোজা বাড়ি চলে যাব। আজ এখন আর ক্লাবে যাব না। বউদির বাড়িতে এখন আর ঢুকব না। ঢুকতে পারব না। এর পরেও কি পারব?

দূর থেকে দেখলাম, বউদি দোতলার বারান্দায় তোয়ালে মেলছে। আমাকে দেখল উপর থেকে। হাসল। বউদির এই হাসির সঙ্গে আমার এর আগে পরিচয় হয়েছে। এটা থ্যাঙ্কয়ু দেওয়ার হাসি, তবে অনুরাগ মেশানো। বউদি চটি ফটর-ফটর করতে-করতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে আসছে, সেই শব্দ পেলাম। আমি আর পালাতে পারলাম না। মুখোমুখি হতেই হবে। বউদি নীচে নেমে দরজা খুলে বলল, “পেয়েছিস? বাঃ, গুড বয়!”

আমি প্যাকেটটা বউদির দিকে বাড়িয়ে ধরলাম মুখ নিচু করে। অপরাবউদি দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে বলল, “ওঃ, লজ্জায় মরে যাচ্ছিস! তোর বিয়ে হলে বউয়ের জন্যে ওসব কিনতে হবে না? তারই একটা ট্রেনিং করিয়ে নিলাম।”

আমি কথা বলতে পারছি না। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। বউদি বলল, “দাঁড়া, আরও একটা রাজভোগ পাওনা হয়ে গেল রে। চট করে খেয়ে যা! আয়, উপরে আয়।”

বউদি ডাইনিংয়ের দিকে এগোতে, আমি একবার ভাবলাম, এবার পালাই! না, আর কোনও দিন অপরাবউদির বাড়ি আসব না। ছুটতে গিয়েও আমার পা জড়িয়ে গেল আর-এক লজ্জায়। যেন বুনো লতায় আমার পা আটকে গেছে। আমি কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।

অপরাবউদির আসতে দেরি হচ্ছে কেন? বউদি কি আরও কিছু আনতে গেল? নাকি এমন কিছু, যা আরও লজ্জার, যা আমাকে এক্ষুনি মরে যেতে এগিয়ে দেবে? আমি ভয়-লজ্জায় লাল হয়ে উঠছি।

আমি খুব ছেলেবেলায় মাঝে-মাঝে একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখতাম ভোররাতে। আমি ফাঁকা মাঠের মাঝে অশ্বত্থ গাছের খুব উঁচু সরু ডালের একটা পাতা ধরে ঝুলছি। পাতাটা ছিঁড়ে যাবে যে-কোনও মুহূর্তে, আমি পড়ে যাব। ভয়ে কাঠ হয়ে আছি। খুব ঘামছি। পাতাটা বাতাসে দুলছে। আমি নীচে তাকিয়ে দেখছি, যদি পড়ে যাই, তা হলে কোথায় গিয়ে পড়ব। তখন দেখছি, অশ্বত্থ গাছের নীচে একটা মেয়ে, তার নীচের দিকটা দেখতে একটা জন্তুর মতো। আমাকে খাওয়ার জন্যে উসউস করে ঘুরছে। যখন ঘুম ভেঙে যেত, দেখতাম, মা আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বলছেন, “কী রে, স্বপ্ন দেখে কেউ অমন করে চেঁচায়? উঃ, বড্ড ঘেমে গেছিস!”

দেখতাম, আমার মাথার বালিশ ঘামে ভিজে গেছে। এখনও এমন স্বপ্ন যে দেখি না তা নয়। এখনো সেই স্বপ্নের মতো আমি ঘামতে শুরু করছি। হাওয়াই চটি-পরা আমার পায়ের তলায় পি সি সরকারের ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার মতো কোথা থেকে যে অমন করে জল ঝরে আসছে!

আমি কিছু না ভেবে দৌড়তে শুরু করলাম। পালালাম! অপরাবউদি, অপরাবউদির বাড়ি, ঝুঁকে-পড়া মাধবীলতা, আমার কান গরম হয়ে ওঠা লজ্জা, সব নিয়ে কতক্ষণ যে দৌড়েছি, মনে নেই। যেখানে এসে থামলাম, সে একটা নদীর পার। যখন ভাল করে তাকালাম, ও মা, এ তো আমাদের বসুধারা নদী। ওই তো নদীর ধারের সেই দুটো লম্বা আকাশনিমের গাছ। এখন শীতকাল নয়। তা হলে নলের মতো দেখতে সাদা ফুল তিরতির করে ঝরে পড়ত নীচে। যখন সব গাছের ফুল না ফোটার সময় হয়, তখন আকাশনিম অকাতরে ফুল ফোটায়। আমি এর আগেও এখানে অনেকবার এসেছি শীতকালে। আমি, অনীক, দেবাঙ্কুর।

অনীক তর্ক জুড়েছিল, “এ আকাশনিম নয়, বাজি ধর! এর নাম সোনাঝুরি!”

অনীক কথায়-কথায় বাজি ধরতে পছন্দ করে। সব সময় যে জেতে, তা নয়। তবু, এটা ওর খেলা।

ওর এক গাছকাকু আছেন। ভবঘুরে, নানা দেশ দেখে বেড়ান, আর গাছ চিনে খাতায় নোট করেন। তিনি নাকি অনীককে বলেছেন, “ও আকাশনিম কে বলেছে? ও হল সোনাঝুরি।”

আমার আকাশনিম নামটাই পছন্দ। আর বসুধারার ডাকনাম, সানাই। আমাদের ছোট্ট সানাই নদী! আমরা সকলে ওকে সানাই নামে ডাকি! ওখানে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল, আমি পালাব। আর কোনও দিন অপরাবউদির সামনে গিয়ে দাঁড়াব না।




বিকেল গড়িয়ে আমি বাড়ি ফিরতেই এক কাণ্ড! দেখলাম, মা রেগে কাঁই। বললেন, “পিলু, তোর আর এখানে থেকে কাজ নেই।”

পিলু আমার ডাকনাম। মা শুধু একাই আমাকে এ নামে ডাকেন। এখন আবার অপরাবউদিও পিলু নামে ডাকতে শুরু করেছে আমাকে। প্রথম-প্রথম আমার ভাল লাগত না, রাগ হত। এ নামটায় শুধু মা-ই ডাকবেন, আর কেউ না। কিন্তু এখন বউদিও মাঝে-মাঝে যখন ডাকে, আর আগের মতো রাগ হয় না। মা যখন আমার কাজে খুব দুঃখ পান, তখন মায়ের গলার স্বরে কেমন একটা মায়া ঝরে পড়ে, সে আমি নিজে ঠিক টের পাই, কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারি না। তখন মা আমাকে ‘পিলু’ বলে ডাকেন। আদর করেও ডাকেন কখনও-কখনও।

এখনও তা-ই হল। মা ‘পিলু’ বলতেই আমি বুঝে গেলাম মা আমার দেরি করে বাড়ি ফেরার জন্যে খুব দুঃখ পেয়েছেন। কিন্তু আমি তো দোষের কিচ্ছু করিনি? শুধু লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম বলে এত দেরি হয়ে গেল বাড়ি ফিরতে। সে কথা কি মাকে বলা যায় নাকি? তা হলে আর-একবার আমার মরে যেতে ইচ্ছে করবে। এক্ষুনি!

আমি বললাম। “আমি তা হলে কোথায় থাকব মা?”

“তুই মামার কাছে দুর্গাপুরে চলে যা। ওখানে নাকি এখন চাকরির পরীক্ষার কোচিং খুলেছে। মামা তোকে ভর্তি করে দেবে। এখানে তো সারাদিনই টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! তোর বাবার সামান্য পেনশনে কত আর চলে বল?”

“আমি মামার কাছে চলে যাব? দুর্গাপুরে? তুমি আমাকে ছেড়ে একলা থাকতে পারবে তো? তোমার মন খারাপ করবে না? আমাকে ছুঁয়ে বলো!”

“করবে না কেন? তুই আজ যদি বেঙ্গালোরে চাকরি পাস, তোকে কি আমি ধরে রাখব নাকি? মানুষকে নানা মন খারাপ নিয়েই তো বাঁচতে হয়।”

আমি বললাম, “না মা, তুমি পারলেও, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।” মাকে কিন্তু আমি সবটা সত্যি বললাম না। মা’র জন্যে মন খারাপ করবেই। সেই সঙ্গে আমাদের এই পাড়া, আমাদের ‘আগমনি সংঘ’, অনীক, অভ্রনীল, দেবাঙ্কুর, অনিকেত, শুভ্রকান্ত, অপরাবউদি, অপরাবউদির বাড়ির আড্ডা, মাধবীলতার গাছ, সানাই নদী, নদীপারের সেই দুটো আকাশনিমের গাছ, তার সাদা-সাদা ফুল, এসব ছেড়ে থাকব কী করে? এসবের চেয়ে কি চাকরির পড়া বড়?

মাকে বললাম, “তা হলে মামাকে বলে দাও, আমি চলে যাই দুর্গাপুর। কবে যাব? তুমি যখন চাইছ, তাই যাব।”

মা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “পিলু, তোর বুঝি রাগ হল? শোন, তোর এই ভবঘুরের মতো সারাদিন কাটানো আমার ভাল লাগে না। তারপর অপরার বাড়ির রোজ সন্ধেবেলার আড্ডা ভাল না। সে একটা বাড়ির বউ। তার তো নানা কাজ থাকতে পারে। তোরা দল বেঁধে রোজ তাকে সন্ধেবেলা ব্যতিব্যস্ত করিস। মনে-মনে হয়তো রাগই করে অপরা, মুখে কিছু বলতে পারে না।”

আমি হা হা করে হেসে উঠলাম, “ধুর, অপরাবউদি একদমই কারও বাড়ির বউ না। সে যে ক’দিন পুলকেন্দুদা আসেন, সে ক’দিন। তারপর তো বাচ্চা মেয়ে। আমাদের বন্ধু। খুব বন্ধু!”

মা মাথা নেড়ে বললেন, “না, অত বন্ধুগিরিত্ব করে কাজ নেই। তোদের এই আড্ডা নিয়ে পাড়ার লোকে নানা কথা বলছে। তুই তো আর বড় হবি না! কী দরকার? অপরা, অপরার মতোই থাকুক। তোরা তোদের মতো থাক। সন্ধেবেলা আগমনিতে গিয়ে আড্ডা দে, গল্প কর, কেউ কিছু বলবে না। আর তোর জন্যে তো একজন অপেক্ষা করে। যা, তার কাছে যা!”

আমার বুক গুড়গুড় করে উঠল। আবার নাকের পাটায় ঘাম, আবার চোখের পাতায় তিরতির করে কাঁপুনি। মা কি তাহলে তৃণার কথা জেনে গেছেন নাকি? যাঃ, এবার তো মা’র কাছ থেকেও পালাতে হবে? তা হলে থাকব কোথায়? কার কাছে?

আমি মুখ না তুলেই বললাম, “তুমি কার কথা বলছ মা?”

মা হাসলেন, “কেন, বসুধারা নদী? তোর সানাই? সে তোর জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।”

আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে মনে-মনে ঠিক করলাম, একদিন, এক পূর্ণিমা রাতে মাকে

ছাদে ডেকে নিয়ে যাব। তারপর তৃণার কথা মাকে সব বলব।

আমি বললাম, “সানাই যে আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে, তুমি জানতে কী করে?”

“আমি সব জানতে পারি রে পিলু। তুই আমার ছেলে না? আমার মধ্যে বেড়ে উঠেছিস!”

আমি মাকে বললাম, “অপরাবউদির বাড়ির আড্ডা ভেঙে গেলে লোকে খুশি হবে, না মা? কেন, তাদের কী?”

“দ্যাখ, কার কী, এ নিয়ে তর্ক করে তো লাভ নেই? একটা সমাজ নিয়ে মানুষকে থাকতে হয়।”

“আমাদের আড্ডাটা কি কোনও অসমাজের মধ্যে নাকি? অপরাবউদির মতো মানুষ এ পাড়ায় খুব কমই আছে। জানো মা, অপরাবউদির হৃদয়টা ঠিক যেন সমুদ্রের মতো! মনে এতটুকু হিংসা নেই?”

“না থাক, তোরা এবার ওই আড্ডাটা বন্ধ কর। তা ছাড়া তোর বন্ধুরা সকলে চাকরিতে ঢুকে পড়ল। তুই আর কতদিন টো টো করে বেড়াবি?”

“ঠিক আছে মা, এবার আমি চাকরির পড়ায় মন দেব। তা হলেই হল তো? এখনকার চাকরি পেতে গেলে অনেক খারাপ হার্ডলস পেরোতে হয়।”

মা গলাটা গম্ভীর করে বললেন, “না, কিছুই হল না। অপরাকে নিয়ে তোদের অমন করে মাতামাতি একটু বাড়াবাড়িই হচ্ছে রে।”

অপরাবউদির সম্পর্কে আমার খারাপ কিছু শুনতে ভাল লাগে না। আমি কথা পালটে বললাম, “মা, আমার কি খিদে পায়নি? খেতে দেবে না? বড্ড খিদে পেয়েছে গো!”

মা মুখ ভার করে চলে গেলেন রান্নাঘরে। আমি কথা ঘোরানোর জন্যে এ কথা বললাম মাকে। আমি চান করে বেরোতে না-বেরোতে মা ডাকলেন, “আয়, খেতে আয়।”

খাওয়ার পর বারান্দায় বসে ভাবছিলাম, নাঃ, সকালে অপরাবউদির কাছে অমন লজ্জার ব্যাপার হল। পাড়ার লোকের সমালোচনা। তারপর আজ সন্ধেবেলা অনীক অপরাবউদিকে…! না আজ আর যাব না সন্ধেবেলার আড্ডায়। আজ না, আর কোনও দিন যাব না। কী দরকার? মা যখন বলছেন, পাড়ার লোক…। তারপর বউদি সকালবেলা আমাকে দাঁড়াতে বলে ঘরে কী যে আনতে গেল, চট করে এলই না। তখনই আমি তো পালিয়ে এলাম। বউদি কী ভাবল কে জানে? এসে দেখেছে, আমি নেই। এরকম কখনও হয়নি, বউদি দাঁড়াতে বলেছে আর আমি না বলে চলে এসেছি। আসলে বউদিকে আমার বড়দির মতো মনে হয়। আমার তো বড় দিদি নেই। ছোটবেলায় খুব ভাবতাম, মাকে বলতামও, “মা, আমার একটা বড়দি থাকলে বেশ হত!” আমি ভাবি, আমার বড়দি থাকলে মনে হয়, ঠিক এরকমই হত। আমার খিদে পেলে মুখ দেখে এরকমই বুঝতে পারত। কিন্তু আজ পালিয়ে এলাম অপরাবউদির কাছ থেকে, আমার অমন মরে যাওয়ার মতো লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এলাম।

অনীক এমন কেন আমি জানি না। ও আজ যে কাণ্ড করতে যাচ্ছিল, ওতে আমার সায় নেই। কতদিন আমি সকলের সামনেই অপরাবউদির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছি। বলেছি, “বউদি, বড্ড মাথা ধরেছে গো।”

বউদি মজা করতে ছাড়েনি, “মিথ্যে! ওসব তোর অভিনয়। মাথা ধরেছে না ছাই! মেয়েদের কেউ মাথা টিপে দিলে সব ছেলেরই ভাল লাগে।” একটুখানি মাথা টিপে দিয়েই বলেছে, “যা! আর চোখ বন্ধ করে মিচকের মতো পড়ে থাকতে হবে না! ওঠ।” তখন ওরা সকলে নানারকম বায়না ধরেছে।

অনিকেত মুখচোরা। একটা কী বলতে গিয়েও বলতে পারেনি। চুপ করে গেছে।

শুভ্রকান্ত বলেছে, “বউদি , আমারও খুব মাথা টিপটিপ করছে। দাও না গো! একটুখানি মাথাটা টিপে দাও!”

বউদি হেসে বলেছে, “যা, কান ধরে দাঁড়িয়ে একশো গোন, এক্ষুনি মাথা টিপটিপ সেরে যাবে।”

দেবাঙ্কুর বলেছে, “বউদি, আমার কিন্তু মাথা ধরেনি। আমার চোখের পাতা দুটো চিনচিন করছে। দাও না, চোখের পাতা একটুখানি টেনে দাও না!”

বউদি চট করে সোফা থেকে উঠে এসে দেবাঙ্কুরের কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, “ওঠ! জানিস তো, কান ধরলে চোখের ব্যায়াম হয়। চিনচিন করা সেরে যায়। শুনিসনি, লোকে বলে, কেন টানলে মাথা আসে? তেমনি এ কথাটাও জেনে রাখ!”

অনীক মহাপাজি! বলেছে, “বউদি, আমার না কী যেন একটা হচ্ছে, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। কিন্তু, তুমি যদি একটু…”

বউদি হাত দুটো প্যাঁচানোর ভঙ্গি করে বলেছে, “এসো, কাছে এসো মানিক! বুঝিয়ে দিচ্ছি কী হয়েছে।”

এরকমই মজা চলে আমাদের মধ্যে। আজ থেকে আর মজা নয়, আগমনি সংঘও নয়। আমি শুধু একজনের সঙ্গেই মিশব। তারই কাছে যাব। তার পারে ঘাসের উপর মাথা পেতে শোব। সে হল আমাদের সানাই, মানে বসুধারা। সেও আমাকে খুব ভালবাসে, অনেকটা দিদির মতো। ও মা, সানাইকে দিদি মনে হল কেন? আচ্ছা, নদী কি কারও দিদি হতে পারে? নদী যখন মা হতে পারে, তখন দিদি হতে পারবে না কেন? আমাদের সুজলা-সুফলা দেশকে বলে নদীমাতৃক দেশ। দিদি হতে গেলে অনেক ক্ষমা শিখতে হয়, সহনশীলা হতে হয়। অপবাদ গায়ে মাখতে নেই। এ সবই আছে অপরাবউদির মধ্যে। সানাইয়ের মধ্যেও আছে নিশ্চয়ই।

বিকেল নিভে আসছে। একটু পরেই অনীক ছটফট করবে, আমার সঙ্গে বাজি জিতবে বলে। কিন্তু ওকে তো বাজি ধরতেই দিইনি। একা-একা কি আর বাজি ধরা যায়? অনীক, তোকে আজ আমি বাজি জিততে দিলাম না। ওই সব বাজি অপরাবউদির সঙ্গে জেতা যায় না রে! আমি চুপ করে বারান্দায় বসে আছি দেখে মা বললান, “কী রে পিলু, অমন মন-মরা হয়ে বসে আছিস কেন? যা, সানাইয়ের পার থেকে ঘুরে আয়।”

সানাই আমার বাড়ি থেকে দু’ কিলোমাটার। হেঁটে যেতে হয়। পাশের বাড়ির কণাদের সাইকেলটা নিয়ে মাঝে-মাঝে সানাইয়ের কাছে যাই। কণাদ না বলে না। না বলবেই বা কেন? ওটা তো আসলে আমারই সাইকেল। বাবা কিনে দিয়েছিলেন, আমি যখন ক্লাস নাইনে উঠি। দূরে-দূরে টিউশন পড়ে যেতে-আসতে খুব কষ্ট হত। বাবা তাঁর অফিসের স্টাফ কো-অপারেটিভ থেকে লোন নিয়ে কিনে দিয়েছিলেন সাইকেলটা। আমার কলেজ পড়া শেষ হয়ে যেতে একদিন মিলিকাকিমা বললেন, “অর্ক, তোর সাইকেলটা কাল সকালে কণাদকে দিবি, ওর পরীক্ষা আছে, আবার টিউশনও আছে। বেচারা হেঁটে-হেঁটে পারবে না।”

আমি এককথায় রাজি। তারপর সন্ধের সময় যখন সাইকেলটা ফেরত দিতে এল, মাকে বললাম, “মা, যে ক’দিন কণাদের পড়ার চাপ চলবে, সে ক’দিন সাইকেলটা কণাদের কাছেই থাক না, কী বলো? আমার তো আর এখনই জরুরি কিছু কাজ নেই?”

মা বললেন, “থাক না। সাইকেল কি আর খাওয়ার জিনিস যে, ও খেয়ে ফেলবে? নিয়ে যা কণাদ।”

আমি সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “শুধু সাইকেল চড়লেই হবে না, ভাল করে মুছে পরিষ্কারও করতে হবে।”

ও ঘাড় নেড়ে সাইকেলটা নিয়ে চলে গেল। ওর মুখে তখন পূর্ণিমার চাঁদের ছায়া। পরে মাধ্যমিকে কণাদ যখন আমাদের জেলার মধ্যে হাইয়েস্ট নম্বর পেয়ে পাশ করল। খুব হইচই হল আমাদের পাড়ায় কণাদকে নিয়ে। কণাদ বিকেলবেলা সাইকেলটা ফেরত দিতে এসেছিল। আমি বললাম, “তুই এত ভাল রেজাল্ট করলি, খুব আনন্দ হচ্ছে রে! আমি তোকে আর কী দিই বল? তোকে চিরদিনের জন্যে আমার সাইকেলটা দিয়ে দিলাম।”

মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। আমি বললাম, “মা, ঠিক করেছি তো?”

তখন কণাদের মুখের উপর থেকে পূর্ণিমা চাঁদটা সরে এসেছে মায়ের মুখের উপর। মায়ের শীর্ণ মুখটা জ্যোৎস্নায় টইটই করছে!

আমার দরকার হলে এক-আধদিন কণাদের কাছ থেকে সাইকেলটা ধার নিই। এখন ওটা কণাদেরই হয়ে গেছে। এই তো সেদিন, অপরাবউদি আমাদের পাড়ার অনেকটা দূরে ‘অভিরুচি’ মিষ্টির দোকান থেকে সরভাজা কিনে আনার আদেশ দিল আমার উপর। সন্ধেবেলা সকলেই বসে থাকল। অপরাবউদি আমাকে ডেকে বলল, “অর্ক, তুই কণাদের সাইকেলটা নিয়ে যা না রে! চট করে সরভাজা নিয়ে আয়।”

আমি মনে-মনে বললাম, ‘ওটা আমার সাইকেল ছিল। আমি কণাদকে দিয়ে দিয়েছি।’ আমি কণাদকে সাইকেল দিয়েছি, আর অপরাবউদি কণাদের দু’ বছরের পড়ার খরচ দিয়েছে। বউদি লুকিয়ে-লুকিয়ে কবে যে কণাদকে ডেকে এই কাণ্ড করেছে, আমরা জানতামই না। যেদিন কণাদ ফের হায়ার সেকেন্ডারিতেও জেলার মধ্যে সেরা হল, সেদিন ওর সংবর্ধনা সভায় কণাদই ফাঁস করে দিল কথাটা।

আমরা সেদিন সন্ধেবেলা সকলে গিয়ে ধরলাম অপরাবউদিকে, “তুমি এ কাণ্ড করেছ, কই আমাদের একবারও জানাওনি তো?”

বউদি ,কিংশুকদাকে কিংশুক বলেই ডাকে। বলল, “কিংশুকই করে দিয়েছে যা কিছু যোগাযোগ। আমি ওর মধ্যে নেই!”

আমি বলেছিলাম, “তুমি দু’ বছর ধরে টাকা দিয়ে যাওনি? আর তুমি জানো না বললেই হল? তুমি আমাদের বলবে না বলেই বলোনি।”

অপরাবউদি মুচকি হেসে বলল, “আরে হাঁদা, আজকাল কি আর মাসে-মাসে টাকা দিয়ে আসতে হয়? সব তোদের পুলকেন্দুদাই করেছে। ও ব্যাঙ্কে ফেলে দেয় দুবাইতে, আর এখানে কণাদের স্কুলের অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যায়। আর ওর বই-খাতাগুলো আমি দিয়েছি আমার হাতখরচের টাকা থেকে জমিয়ে। ছাড় তো! ছেলেটা না হলে পড়তেই পারত না।”

অনীক মজা করেছিল, “তোমার হাতটা খুব লম্বা তাই না? লম্বা হাতের হাতখরচও লম্বা!” অনীক বউদির কাছে উঠে গিয়ে ডান হাতটা ধরে টেনে-হিঁচড়ে সোজা করতে-করতে বলল, “দেখাও না গো বউদি, তোমার হাতটা কতটা লম্বা।”

পাশ থেকে ফোড়ন কেটেছিল অভ্রনীল, “বাবা, বউদি তোমার হাতটা এতটা লম্বা! এ তো মহাভারতের অর্জুনের হাতের মতো। আজানুলম্বিত বাহু!”

অভ্রনীলের মাথায় এক চাটি মেরেছিল বউদি, “যা তো, শুধু বড়-বড় কথা!”

তারপর বউদি এক ধমক দিয়ে অনীককে বলেছিল, “যা, ওখানে গিয়ে চুপ করে বোস। একটু পরে শিঙাড়া পাবি। না হলে বিচ্ছুমি করবি তো ভাগ থেকে সব চলে যাবে অন্যের দখলে।”

অপরাবউদি এরকমই! নিজের এই সব কথা গোপন করে রাখে। কত লোক আছে, কণাদের পড়ার খরচ দেওয়ার কথাটা জনে-জনে ডেকে বলে বেড়াত। বউদির মনটা সমুদ্রে মতো!

কিন্তু এই কথাটা জেনে আমার খুব অভিমান হল। যে আমাকে দিয়ে বউদি সব কাজই করায়, সেই বউদি কণাদকে এই সাহায্যের কথাটা আমাকে বললই না? কেন, আমি কি না বলতাম? তা হলে…?

আমি আজ সানাইয়ের ধারে চুপ করে বসে আছি। আমার মোবাইল নেই। তাই অনীক আমাকে ধরতেই পারবে না। একবার হয়তো আমার বাড়ি খুঁজতে যাবে। পাবে না। সানাইয়ের পারে চলে আসবে নাকি? আমি আকাশনিম গাছ দুটো ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম। রাত নামল। নদীর ধারের ঝোপে জোনাকি উড়ছে। এক-একটা জোনাকিকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন নাচছে। বর্ষাকাল হলে এখন এখানে ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙর করে ব্যাঙ ডাকত। বেশ সুন্দর একটা বাতাস বইছে। মাঠে যখন ধানগাছে ফুল ফোটার সময় হয়, তখন এরকম বাতাস বয়। বাতাস তখন ধানের পেটে ক্ষীরের খবর আনে। এ বাতাস মানুষকে উঠে দাঁড়াতে শেখায়। এ বাতাস মানুষকে দুঃখ ভুলতে শেখায়।

এই বাতাসটাই বলল, “তুই আজ অপরাবউদির বাড়ির আড্ডায় যাবি না? বউদিরও খুব অভিমান হয়েছে। সকালে অমন করে পালিয়ে এলি যে বড়!”

আমি উঠে পড়লাম, যতদিন এ পাড়ায় আছি, ততদিন বউদির মনে কষ্ট দেব না। বউদি খুব কোমল মনের মেয়ে। না, বউদিকে কষ্ট দেব কেন? বউদি তো আমাকে কখনও কষ্ট দেয় না?

হনহন করে হাঁটতে লাগলাম অপরাবউদির বাড়ির দিকে। গিয়ে শুনলাম, অনীক চলে গেছে। আজ কিংশুকদা আসেননি। কিন্তু একটা দারুণ খবর আছে। বউদি বলল, “তুই আজ এত দেরি করলি যে বড়? সকালে দাঁড়াতে বললাম, অমন করে কোথায় পালালি, কেন? আমাকে তোর ভয় করে বুঝি! তখন না চলে গেলে তুইই এই খবরটা সকলের আগে পেতিস!”

সকলে মিটিমিটি হাসছে। বউদি একদম আমার কাছে সরে এল। আমার কাঁধে কনুইয়ের ভর রেখে নিজের মোবাইলের ইনবক্সটা থেকে মেসেজটা খুলতে-খুলতে বলল, “এই দ্যাখ!”

বউদির গরম নিশ্বাস আমার কানের উপর পড়ছে। আমি বললাম, “উঃ, তোমার কনুইটা না বল্লমের মতো!” তারপর মেসেজটা পড়ে লাফিয়ে উঠলাম, “পুলকেন্দুদা কাল আসছেন? দারুণ! হুররে!”

বউদি বলল, “এটা তোদের পুলকদার এক্সট্রা আসা হল আর কী! কাল থেকে আমার বাড়ির ধারেকাছেও কেউ ঘেঁষবি না, এই আমি বলে রাখলাম। শুধু আসবে অর্ক, একজন।”

সকলে হাঁ হাঁ করে উঠল। দেবাঙ্কুর বলল, “কেন, অর্ক আসবে কেন? ওকে তুমি সব সময় পক্ষ করো বউদি।”

“কেন, ও যে আমার সঙ্গে ছয়ার মতো থাকে? তারবেলা? সারাদিন তো তোদের পাত্তাই পাওয়া যায় না।

আমার সব কাজ কে করে দেয় শুনি?”

অভ্রনীল বলল, “আমার স্কুলের ক্লাসগুলো তুমি অর্ককে করে দিতে বোলো। তা হলে আমি তোমার সব কাজ করে দেব।”

বউদি বলল, “ওসব বললে হয় না রে! মন থাকা চাই। অর্কর একটা সুন্দর মন আছে। নেবু ফুলের মতো সে মনটা।”

শুভ্রকান্ত চোখের একটা ইশারা করল দেবাঙ্কুরের দিকে। তারপর বলল, “তা হলে আমরা আর কাল থেকে এ বাড়ির রেডিয়াসের মধ্যে আসব না, বুঝলি? চল, উঠি! তোকে উঠতে হবে না অর্ক। তুই থাক! অনেকক্ষণ থাক।”

বউদি বলল, “বললামই তো, কাল থেকে তোরা কেউ আমার বাড়ির ছায়াও মাড়াবি না।”

বউদির সামনে দাঁড়িয়ে মা’র কথা মনে পড়ছে। পাড়ার লোকে বউদিকে নিয়ে নানা কথা বলছে। অমন কথা উঠলে আমরা রুখে দাঁড়াব। কী কথা বলছে তারা? কেন? মনে-মনে বউদির মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বউদি, তোমাকে এই সব নিন্দুকের থাবা থেকে আমরা জিতিয়ে আনব। তোমাকে জিততেই হবে।’

আমার অবস্থা দেখে বউদি পিঠে হাত রেখে বলল, “অর্ক, যা, বাড়ি যা! ওদের ওই সব ছ্যাঁকা দেওয়া কথায় মন খারাপ করতে নেই! সবই যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি।”

অপরাবউদি আজ খুব খুশি। পুলকেন্দুদা হঠাৎ আসছেন। ক’ দিন থাকবেন জানি না। একবার ভাবলাম, বউদিকে জিজ্ঞেস করি কথাটা। তারপর মনে হল, না, পরে জানলেও তো হবে।

বাড়ি গিয়ে মাকে বললাম পুলকেন্দুদার আসার কথা। মাও শুনে অপরাবউদির মতোই খুশি। বললেন, “তোর তো কাজ বাড়ল রে পিলু?”

মা অমন করে আমার সঙ্গে মজা করেন। সকাল হতেই আমি উসখুস করছিলাম। পুলকদা আসবেন। বউদির ফরমায়েশি বাজার কে করে দেবে, আমি যদি না যাই? এখন মনে হচ্ছে, কাল বউদির সামনে দাঁড়ানোর যে লজ্জা ছিল, আজ আর নেই। ওই যে কাল সকলের সামনে বউদি আমাকে বলল, আমার মনটা নাকি ভাল! ব্যস, অমনি আমি বিন্দাস হয়ে গেলাম। এই আমার এক দোষ। অল্পে খুশি, আবার অল্পে কাতর। মা কাজে ব্যস্ত। ডাকলাম মাকে, “শোনো, একবার কি অপরাবউদির বাড়ি যাব মা? পুলকদা আসবেন, বউদির কী না কী দরকার হয়?”

যে মা কাল অমন করে অপরাবউদির বাড়ির আড্ডা নিয়ে অত কথা বলেছেন, এখন কিন্তু মাও যেন জলতবঙ্গের বাজনা! অপরাবউদি মনে হয় মায়া জানে। অত দূর থেকে আমার মাকে মায়া করেছে। মা বললেন, “যা, একবার ঘুরে আয়।”

আমি বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথে দশ মিনিটও লাগে না অপরাবউদির বাড়ি। গিয়ে বেল বাজালাম। বউদি দোতলার বারান্দা থেকে বলল, “কে?”

আমি কারনিশের নীচ থেকে বাইরের দিকে সরে এসে মুখ তুললাম। বউদি হেসে বলল, “জানতাম তুই আসবি। আয়, উপরে আয়।” বলে চাবিটা দড়ি-বাঁধা ব্যাগে করে নীচে নামিয়ে দিল। আমি দোতলায় উঠছি, শুনতে পেলাম, পুলকেন্দুদার গলা। আমি অবাক, “পুলকদা, আপনি এসে গেছেন? কাল বউদি যে বলল, আপনার আসতে-আসতে দুপুর হবে?”

পুলকদা বললেন, “তোর বউদিকেও লুকিয়ে ছিলাম। এসে ঘুম ভাঙিয়েছি, জিজ্ঞেস কর বউদিকে?”

বউদি বলল, “দ্যাখ না, ঘরটর কেমন হয়ে আছে। আর উনি তার মধ্যে এসে হাজির!”

আমি বললাম, “বেশ হয়েছে। আমাকে কী করতে হবে বলো?”

পুলকেন্দুদা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “ছেলেটা তো সারা বছরই তোমার বাজারহাট করে দেয়। আজ অর্ককে ছুটি দাও। আমিই বাজারে যাব।”

আমি বললাম, “না পুলকদা। আপনি অত দূর থেকে এসেছেন, বিশ্রাম নিন। আমি যাচ্ছি! কাল আপনার জন্যে বাজার করার কাজটা রেখে দেব।” অপরাবউদির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মুখটা সকালের শিউলি ফুলের মতো সতেজ আর ঝলমলে। বললাম, “কই, লিখে দাও কী কী আনতে হবে? কাজে মন নেই মনে হচ্ছে!”

বউদি বলল, “ওসব কাল রাতে লিখে রেখেছি। তোরই জন্যে। দাঁড়া, মনে করি, কোথায় যে রেখেছি!”

“তুমি তো কাল সকলকে বলে দিলে, আজ থেকে কেউ যেন তোমার বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসে। তা হলে আবার আমার জন্যে ফর্দ লিখে রেখেছ কেন? আমার আসতে বয়েই গেছে। আমি আসতে চাইওনি! দেখো, আর আসবই না তোমার বাড়ি। আজ মা বললেন, তাই এলাম। আমি আসব তা কি তুমি জানতে নাকি?”

“আমি তোকে চিনি রে অর্ক। তোর মনটা খুব নরম। তুই বড় হোসনি! আমি জানি, সকলেই আমার কথা মানবে, আমার বাড়ির ধারেকাছেও আসবে না। কিন্তু তুই? জানি তুই মানবি না। একটা অবাধ্য ছেলে কোথাকার!” বলে আমার মাথায় আদরের চাটি মারলেন।

পুলকদা বললেন, “আহা, ও তোমার বাজারও করে দেবে, আবার তোমার হাতের চাটিও খাবে? এ তো ঠিক নয়।”

আমি ফর্দ হাতে নিয়ে দেখতে-দেখতে ছুটলাম বাজারের দিকে। পিছন থেকে অপরাবউদির গলা শুনতে পেলাম, “ফিরে এলেই তুই একটা দারুণ খবর পাবি। এই খবরটা শুধু তোর জন্যে!”

আমি পিছন ফিরে তাকালাম। বউদি দোতলার বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে বলল, “উঁহু, এখন নয়। এলে তখন বলব। এখন নয়।”

বউদির বাড়ির তিনটে বাড়ির পরে থাকেন উপেনদাদু। তিনি পাশ দিয়ে ফিরছিলেন বাজার করে। একবার চশমার নীচ দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন বউদিদের বারান্দার দিকে। বাঁ হাতে চশমার ডাঁটি ঠিক করতে-করতে বাড়ির দিকে চললেন।

ফর্দে লেখা, ফুল কিনতে হবে তিন রকমের। মনে হয় ফুলদানি সাজানো হবে। অপরাবউদি ফুল খুব ভালবাসে। ধূপ কিনতে হবে, ধুনো ধূপ। কত ওজনের কী কী সবজি কিনতে হবে, সব লেখা আছে। মাংস আর ডিম আনতে হবে। চিনি, ভাল দার্জিলিং পাতা-চা। সুন্দর নোনতা বিস্কুট। টক-ঝাল-মিষ্টি ভাল চানাচুর।

ফর্দ মিলিয়ে কিনে ফেললাম সব। দু’ হাতে ব্যাগ, উপচে পড়ছে জিনিসে। আজ আমারও বেশ আনন্দ হচ্ছে। কেন কে জানে! অপরাবউদির বর এসেছেন, তাই বউদি আজ শিউলি ফুল। কিন্তু আমি কেন যে অমন খুশি বলতে পারব না। অপরাবউদির খুশির কিছুটা আমারও।

বাড়িতে ঢুকতে যাব, বউদি দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। আমার হাত থেকে একটা ব্যাগ নিতে-নিতে বলল, “বউদির জন্যে ছোট্ট ছেলেটা আর কত করবে? দে দে, আমাকে একটা ব্যাগ দে!”

আমি মজা করলাম, এতটা ব্যাগ দুটো টেনে আনতে পারলাম, সিঁড়িটুকুও পারতাম বউদি। কখনও তো নীচে এসে ব্যাগ কেড়ে নাও না হাত থেকে? আজ পুলকদা এসেছেন বলে লোক দেখানো হচ্ছে?”

“বেশ, লোক দেখাচ্ছি তো দেখাচ্ছি! লোক তো তোদের পুলকদা। তোর দাদার কাছ থেকে নাম কিনতে হবে না? দাদা ভাবে, আমার আদেশের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে অর্ক। আমাকে কিছুই করতে হয় না। কথাটা যে ঠিক নয়, সেটা তো প্রমাণ করতে হবে?”

পুলকদা বললেন, “আগে অর্ককে কিছু খেতে দাও।”

আমি বললাম, “না, পুলকদা, আমি খেয়ে এসেছি।”

বউদি মুখঝামটা দিয়ে উঠল, “আর বলতে হবে না। সন্ধেবেলা যে তোদের জন্যে অত আয়োজন করি, সেগুলো কে খায় রে পাজি?”

বউদি প্লেটে করে দুবাই থেকে আনা বিস্কুট, কালো রঙের খেজুর, অদ্ভুত দেখতে চকোলেট আমার দিকে এগিয়ে দিতে-দিতে বলল, “এক্ষুনি খাবি না কিন্তু! তোর জন্যে একটা জিনিস আছে। পুলকেন্দুদার উপহার!”

আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই টি-শার্টটার্ট হবে! অপরাবউদি বেডরুমের দিকে চলে গেল। তারপর একটা প্যাকেট শাড়ির আঁচলে জড়িয়ে আমার কাছে এসে বলল, “তুই আগে চোখ বন্ধ কর। একদম দেখার চেষ্টা করবি না কিন্তু!” তারপর দু’ হাত দিয়ে আমার চোখ দুটো পাতা টিপে ধরে বলল, “ম্যাজিক দেখানোর মতো চুরি করে আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখবি না।”

আমি চোখ বন্ধ করলাম। বউদির হাতে আমার দু’ চোখ বন্ধ। মনে-মনে বললাম, ‘বউদি, কেন যে তুমি আমার বড়দি হলে না! এর পর বউদি বলল, “এবার দু’ হাত পাত আমার সামনে। একদম অঞ্জলি পাতার মতো করে!”

আমি তাই করলাম। বউদি কিছু একটা প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে এক ধমক দিল, “কী রে, হাঁ হয়ে গেলি যে?

দ্যাখ, প্যাকেটটা খোল। রংটা তোর পছন্দ কি না বল?”

আমি অবাক হয়ে বউদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বউদিকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা আমার? কী দরকার ছিল বউদি? আমার তো মোবাইল দরকারই হয় না।”

বউদি বলল, “তোর দরকার হয় না জানি। কিন্তু আমার তো দরকার। তোর কাছে মোবাইল নেই বলে যখন তোকে আমার খুব দরকার পড়ে, তখনও চুপ করে থাকতে হয়। পাই না তোকে। এবার থেকে যখনই দরকার হবে, তখনই কল করব। মোবাইলটা আসলে তোর জন্যে নয়, আমারই জন্যে, বুঝলি?”

আমি প্যাকেটটা খুললাম। একটা লাল টুকটুকে দেখতে মোবাইলটা। বললাম, “পুলকদা, দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে। কিন্তু কেন এত টাকা খরচ করে আনলেন বলুন তো? সত্যিই আমার কোনও কাজেই লাগবে না! আমি কি আর চাকরি করি নাকি যে আমার মোবাইল দরকার?”

“তোর অপরাবউদি বায়না ধরল যে, তাই তো আনতে হল। তোর না কাজে লাগুক, তোর বউদির খুব কাজে লাগবে। তোরা বউদিকে অমন করে ঘিরে থাকিস বলেই না মেয়েটা একা এমন করে থাকতে পারে? না হলে কবেই এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলত!” বলে মজার চোখে পুলকেন্দুদা তাকালেন অপরাবউদির মুখের দিকে। একটু থেমে বললেন, “এখন আমি যখন তোদের বউদিকে বলি, ‘চলো, এখানে একা-একা এমন করে পড়ে থাকতে হবে না। দুবাই চলো!’ শুনে এখন কী বলে জানিস, ‘এখানে আমি একা কে বলল? অর্ক আছে, দেবাঙ্কুর, অভ্রনীল, অনিকেত, শুভ্রকান্ত আর ওই বিচ্ছুটা, অনীকও। এতজন আছে, আমি একলা হতে যাব? আমি ওই মরুদেশে গিয়ে থাকতে পারব না। আমার এই দেশ অনেক ভাল!’ তা হলেই বোঝ!”

আমি মাথা চুলকে বললাম, “আমি হলে কিন্তু পুলকদা, দুবাই চলেই যেতাম। কত আধুনিক দেশ, কত টাকা, কী আভিজাত্য!”

বউদি আমার গায়ের কাছে এসে এক হাঁকাড় দিলেন, “তুই এখন বাড়ি যাবি অর্ক? না, এখানে বসে-বসে পাকামি করবি? তা হলে তোকে কান ধরে বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেব, এই আমি ভালয়-ভালয় বলে রাখলাম। যা কেটে পড়! পুলকদার সঙ্গে অমন তাল ঠুকতে হবে না।”

আমি বললাম, “সে না হয় আমিই চলে যাচ্ছি! তোমাকে আর কষ্ট করে আমার কান ধরতেও হবে না, আর আমাকে বাড়ির বাইরে পাঠানোর জন্যে মেহনতও করতে হবে না। কিন্তু বউদি, মোবাইলটা তুমিই রেখে দাও। এ আমি নেব না। মোবাইল নিয়ে আমি কী করব বলো?”

বউদি বলল, “কী করবি, সে না হয় তোর পুলকদা চলে গেলে তোকে শিখিয়ে দেব, হল তো? যা, এখন এখান থেকে কেটে পড়!”

আমি কুণ্ঠার গলায় বললাম, “ওরা শুনলে কী বলবে বলো তো? এমনিতেই বলে, তুমি নাকি ওদের সকলের চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসো।”

আমার মুখের কথা ফুরোতে না-ফুরোতেই বউদি বলল, “হ্যাঁ, বাসিই তো! সকলের চেয়ে তোকে আমার বেশি ভালো লাগে। ব্যস, তাতে কার হলটা কী? একজনকে আর একজনের ভালো লাগতেই পারে। তাতে দোষের কী হল বল? তা লুকবোই বা কেন?”

আমি তখনও আমতা-আমতা করে বললাম, “ঠিক আছে, বউদি এটা তুমি তোমার কাছেই রাখো। আমি কথা দিচ্ছি, পরে এসে নিয়ে যাব।”

বলে মোবাইটা বউদির হাতে ধরিয়ে দিয়েই দৌড় শুরু করলাম। দুমদুম করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি, বউদি আর পুলকদার গলা একসঙ্গে শুনতে পেলাম, “অর্ক, মিষ্টিটা খেয়ে যা রে! না খেয়ে যাস না! প্লিজ!”

তখন কে শোনে কার কথা? আমি তখন একছুটে রাস্তায়। তারপর সোজা বাড়িতে। আমাকে হাঁফাতে দেখে মা বললেন, “কী রে, পিলু, অমন করে হাঁসফাঁস করছিস কেন? তোর পুলকদা কী বলল রে? ভাল আছে তো?”

আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম, ভাল আছে। তখনও কথা বলার দম আমার নেই। একটু জিরিয়ে নিয়ে বললাম, “জানো মা, এবার পুলকদা আমার জন্যে কী এনেছেন?”

মা হাসলেন। মা যখন হাসেন, তখন মায়ের মুক্তোর মতো দাঁতগুলো আরও ঝকঝকে, আরও সুন্দরী মনে হয় মাকে। আমি তখন মনে-মনে বলি, আমার মায়ের দাঁতের মতো অমন সুন্দর দাঁত পৃথিবীতে কোনও মেয়েরই নেই।

মা বললেন, “তোর তো টি-শার্টটাই বরাদ্দ হয়ে আছে। এবার পুলককে বলে দিস, যেন তোর জন্যে কিছুই না আনে। সববারেই আনবে, এটা ভাল দেখায় না। এ কি বিনে পয়সায় পাওয়া যায় যে, পিলুর জন্যে একটা নিয়ে যাই বলে নিয়ে এলেই হল? মানুষটা অত দূর দেশে থেকে রোজগার করে! তুই কিন্তু বাবা, এবার বলে দিস। না পারলে আমার কথা বলে বলিস, ‘মা বলেছে।’ কেমন?”

আমি বললাম, “জানো মা, এবার পুলকদা আমার জন্যে কী এনেছে?”

মা ঘাড় নাড়লেন, “না। কী এনেছে?”

আমি বললাম, “একটা মোবাইল, খুব সুন্দর দেখতে! লাল টুকটুকে!”

মা চড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “নিসনি তো?”

আমি বললাম, “না মা, আমি নিইনি। অপরাবউদিকে ফেরত দিয়ে এসেছি।”

“বেশ করেছিস! এই না হলে তুই আমার ছেলে?” মায়ের গলায় গর্ব ঝরে পড়ল।

কিন্তু আজ বিকেলে অপরাবউদির বাড়ি গেলে, তখন আবার মোবাইলটা নিতে বলবে। কী বলব তখন? বউদিকে এড়ানো খুব মুশকিল। অনীক হয়তো পারে, কিন্তু আমি তো পারি না। সেদিন সন্ধেবেলা বউদি বলল, “অনি, তুই চট করে আমার জন্যে কিছুটা পেঁয়াজ কিনে দে তো! এক্ষুনি পেঁয়াজি করব তোদের জন্যে। অর্কর জ্বর, তাই ওকে যেতে বলছি না।”

অনীক কী করে যে বউদিকে বলল, “ও তুমি অন্য কিছু করো না বউদি। পেঁয়াজিই করতে হবে এমন কী কথা আছে? চা আর চানাচুরই খেতে পারি আমরা?”

বউদি বলল, “সে কী খেতে পারিস আর না পারিস, সে তো পরের কথা। আগে বল তুই যাবি কিনা?”

ততক্ষণে কিংশুকদা এসে গেছেন। আজ কিংশুকদা অফিস থেকে সোজা আমাদের আড্ডায় চলে এসেছেন। বউদি কিংশুকদাকে বলল, “তুমি একটু বলে দাও না গো কিংশুকদা। তুমি তো বড়, ও তোমার কথা ফেলতে পারবে না।”

কিংশুকদা বললেন, “অনীক, রোজ তো অর্কই যায়, আজ তুই যা।”

কিন্তু অনীক যাবে না। বলল, “আচ্ছা কিংশুকদা, পেঁয়াজি যে করতেই হবে তার মানে কী? আজ অন্য কিছু হোক।”

কিংশুকদা বলল, “যার বাড়ির অতিথি, এটা তার পছন্দ। তুই তো আর গৃহকত্রীর ইচ্ছেকে ডিকটেড করতে পারিস না। যা, যা, অত কথার কী? এতক্ষণে পেঁয়াজি ভাজা হয়ে চলে আসত আমাদের সামনে।”

অনীক নিরুপায় হয়ে বলল, “উঃ, গা-হাত-পা কী ব্যথা! এই যা না রে অর্ক, প্লিজ!”

বউদি বলল, “না, অর্ক যাবে না। তুই যদি না যাস না যাবি. ওকে ঠেলছিস কেন?”

এত কথার পরেও অনীক গেল না। এ শুধু অনীকই পারে, আমি পারি না। বউদির মনে কষ্ট হলে আমিও কষ্ট পাই। বউদি গোমড়া মুখে রান্নাঘরে চলে গেল। একটু পরে আমি বিড়াল-পায়ে রান্নাঘরে বউদির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বউদির গা ঘেঁষে। মিষ্টি শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে বউদির গা থেকে। এই গন্ধটা আমি মাঝে-মাঝে বউদির গা থেকে পাই। যখন বউদির খুব কাছে যাই, তখন। বললাম, “দাও তো বউদি, আমিই যাচ্ছি। অনীক বড়দের কথার মর্যাদা দিতে শেখেনি। দাও, আমাকে দাও!”

বউদির মুখ ভার। আমার দিকে তাকালই না। যেন আমিই যেতে রাজি হইনি। বললাম, “প্লিজ বউদি, একটু আমার মুখের দিকে তাকাও। প্লিজ!”

বউদি যেই চোখ তুলল, আমি মুখের ইঙ্গিতে বললাম, দাও। বউদি আমার কথা ফেলতে পারে না। আমিও কি বউদির কথা ফেলতে পারি? বউদি টাকা আনতে ঘুরে দাঁড়াতে ফের শিউলি ফুলের গন্ধটা পেলাম। মনে-মনে বললাম, ‘এখন তো শিউলি ফোটার সময় নয়। তবে?’

বউদি টাকা এনে দিতে আমি জ্বর গায়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেলাম, আর ফিরে এলাম। বউদির ইচ্ছেকে আমি মর্যাদা দিই। আমার ভাল লাগে।

বউদিকে খুব খুশি লাগছে। খুশি হলে বউদি ঘাসফড়িং। লাফাতে থাকে যেন।

কিন্তু আজ মোবাইল থেকে বউদিকে ফেরাব কেমন করে? বউদি খুব অভিমানী। পুলকদা থাকে না বলে আরও বেশি অভিমানী। প্রিয়জন দূরে তাকলে অভিমান বাড়ে।

আমাকে বউদি একদিন বলেছে, “জানিস অর্ক, তোরা কেউ, আমি কষ্ট পাব এমন কথা বললে আমার দু’ চোখ ঝেঁপে বন্যা আসে। ওই যে অনীক বলে মাঝে-মাঝে। আমার খুব অভিমান হয়। ওর যদি নিজের একটা বউদি থাকত, ও কি তার সঙ্গে ওরকম করে কথা বলতে পারত? আর তুই কিছু বললে তো কথাই নেই। রাগ, অভিমান, দুঃখ, সব একসঙ্গে!”

আমি বলেছিলাম, “অনীক সব পারে বউদি। ওর কিছুতেই আটকায় না।” আমার মনে পড়ে গেল অপরাবউদিকে নিয়ে অনীকের সেই বিচ্ছিরি বাজিটার কথা। ছিঃ!

“তুই কিন্তু ওরকম কষ্ট দেওয়া কথা আমাকে বলিস না কখনও। আমি তা হলে বাঁচব না।”

তা হলে আজ বউদি যখন মোবাইলটা আমার হাতে ফের দিতে আসবে, আমি না নিলে রাগ করবে, কষ্ট পাবে? কী করব? মা তো না-ই বলে দিয়েছেন। আমিও না-এর পক্ষে। অন্য কেউ দিলে কক্ষনো নিতাম না। কিন্তু অপরাবউদি? তাকে ফেরাব কী করে? আজ আর বউদির বাড়ি যাব না। তা ছাড়া এখন ক’দিন আমাদের আড্ডার মুলতবি। পুলকদা যাতদিন থাকবেন, বউদি কাউকে ডাকবেই না। এবার ছোট ছুটি নিয়ে এসেছেন পুলকদা, মাত্র দশদিন। দশদিন আমাদের আড্ডা বন্ধ। আমরা কেউ-কেউ চলে যাব সানাইয়ের পারে। ওখানে আড্ডা হবে। তবে অনীক যাবে না, ও যা কুঁড়ে। অতটা হাঁটবে না। অভ্রনীল যাবে হয়তো। ওর স্কুলের চাকরি। চারটেয় ছুটি। বাড়ি ফিরেই বেরিয়ে পড়বে। দেবাঙ্কুর আসবে না, এ আমি জোর গলায় বলতে পারি। ব্যাঙ্কের চাকরি। এখন আবার ওকে নাকি ক্যাশ কাউন্টারে বসিয়েছে। টাকার হিসেব মিলিয়ে জমা দিয়ে ফিরতে দেরিই হবে। তারপর আর আসবে বলে মনে হয় না। অনিকেত একদিন লাজুক-লাজুক মুখে এসে বলবে, ‘অর্ক, কাল-পরশু আর আসব না রে সানাইয়ের পারে। বাড়িতে কাজ আছে।’

আমি জানি অনিকেত বাড়িতে একজন সাহেব। রাজপুত্রের মতো থাকে। কিচ্ছুটি করতে হয় না ওকে। এখনও জ্বর হলে মা ওকে খাইয়ে দেন। আমি বুঝতে পারি, এটা ও বানিয়ে বলছে। কিচ্ছু কাজটাজ না। ও এতটা পথ আসবেই না। নেহাত অপরাবউদির বাড়িটা কাছে। না হলে ও রোজ অপরাবউদির বাড়িও আসত বলে মনে হয় না।

শুভ্রকান্ত আসবে। তোমন মনে হলে ঠোঙায় করে ফুলুরি কিনে আনতেও পারে। আমরা ঘাসের উপর বসব। মাথার উপর আকাশনিম গাছ। সামনে সানাই, তার পুঁচকি-পুঁচকি ঢেউ এসে আহ্লাদি মেয়ের মতো ভেঙে পড়বে পাড়ে। আকাশনিম পাতা ঝরাবে পুটুস পুটুস করে। অনেকক্ষণ গল্প-আড্ডা হবে। কিন্তু তবু যেন খুব খালি-খালি লাগবে। খালি লাগবে অপরাবউদির নেই বলে। উঃ, বউদি যে কী জমিয়ে রাখতে পারে আমাদের!

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কণাদের বাড়ি গেলাম সাইকেলটা চাইতে। গিয়ে দেখলাম, কণাদ বাড়ি নেই, সাইকেল নিয়ে কোথাও যেন গেছে, ওর মা বললেন। কী আর করি? একাই পা পা করে এগোতে লাগলাম সানাইয়ের দিকে।

একবার মনে হল, যদি অপরাবউদির কিছু দরকার হয়? পুলকদা আছেন। আমি না গেলে বউদি আর কাকেই বা পাবে হাতের কাছে যে বাজারে পাঠাবে? তা না হলে তো পুলকদাকেই যেতে হবে। দুর, মানুষটা অত দূর থেকে এসেও যদি বাজার ছোটেন, সে কি দেখতে ভাল লাগে নাকি? তবে পুলকদা বাড়ি এলে আমি কিন্তু পারতপক্ষে অপরাবউদির বাড়ি যেতে চাই না। কেন? মানে… ওই আর কী! তবে বউদিকে একটানা ক’দিন না দেখলে আমারও একটা কষ্ট হয়, আমি টের পাই। শুধু মনে হয়, এই দশটা দিন শিউলি ফুলের গন্ধটা একবারও পাব না। তবে এই শিউলি ফুলের গন্ধের কথাটা আমি আড্ডার কাউকে বলিনি। কে কী মানে করবে? একদিন মাকে প্রায় বলেই ফেলেছিলাম মুখ ফসকে। এ মা, এই কথা মা শুনে কী বলতেন? দুর, এসব কথা মাকে বলতে আছে? বড় হলে অনেক কথা মাকেও বলতে নেই। তবে একদিন বউদিকে একা পেলে কথাটা বলব। বউদির গায়ের কাছে নাক নিয়ে গিয়ে শুঁকতে-শুঁকতে বলব, “বউদি, তোমার গা থেকে না শিউলি ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। এটা কি কোনও পারফিউমের গন্ধ?”

বউদি তখন কী বলবে, ভাবার চেষ্টা করি। বউদি বলবে, “আয়, আমার কাছে আয়, দেব মাথায় এক গাট্টা! বাড়িতে কেউ গায়ে পারফিউম ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়? তোর মাথাটা গেছে রে! মাসিমাকে বলব, ডাক্তার দেখাতে।”

আমি প্রতিবাদ করব, “না বউদি, সত্যি বলছি! তুমি নিজে পাচ্ছ না। আচ্ছা বউদি, কখনও পুলকদা এই গন্ধটার কথা বলেনি? এই শিউলি ফুলের গন্ধটার কথা? তোমার গা থেকে?”

বউদি নাক কুঁচকে বলবে, “না বলেনি! তোর পুলকদার অত গন্ধ চেনার সময় কোথায়? ওই তো মাত্র ক’টা দিনের জন্যে আসে!”

আমি হেসে বলব, “তুমি বেশ তো বউদি? ক’টা দিন আর অনেক দিনের জন্যে গন্ধ কি আর আটকায় নাকি? গন্ধের কাজই বল ভেসে বেড়ানো। আসলে পুলকদা নিশ্চয়ই বলেন। ও কথা আমাকে বলতে তুমি লজ্জা পাচ্ছ! জানো বউদি, আমি তোমার বাড়ির পাশের যে এক চিলতে জায়গা আছে, ওই যে লম্বা জানলাটার পাশে, ওখানে একটা শিউলি ফুলের চারা এনে লাগিয়ে দেব। এবারের রথের মেলা বসলে কিনে আনব। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না।”

বউদি বলবে, “না করব কেন? ও কি অন্য লোকের জায়গা নাকি? তুই নিয়ে আসিস। তা হলে শিউলি ফুটলে তখন না হয় গন্ধটন্ধ পাস।”

আমি কখন যে সানাইয়ের পারে চলে এসেছি, খেয়ালই করিনি। দেখি, তখনও আমাদের আড্ডার কেউ আসেনি। দুর, একলা আজ একদম বসতে ইচ্ছে করছে না। আজ বরং হাঁটি। তিরতির করে সুন্দর বাতাস বইছে। সূর্য ডুবল বলে! আকাশ ভরা এত রং! কই সূর্য ওঠার সময় এত রং ছড়ায় না তো? যত রং ছড়ায় অস্ত যাওয়ার সময়। আসলে চলে যাওয়ার সময় তো মানুষ তার জীবনের সব না-বলা উজাড় করে দিতে চায়। সূর্যও তাই! আমার কিন্তু সানাইকে বেশ ভাল লাগে। কী মিষ্টি যে নদীটা! আমার দিদির মতো বলে মনে হয় সানাইকে। দিদি কেমন হয়, তা আমি অবশ্য জানি না। না, আমার তো দিদিই নেই!

অনেক ঘুরলাম সানাইয়ের পার ধরে। চাঁদ উঠল আকাশ আলো করে। তারা ফুটল কত। আমি সপ্তর্ষিকে খুঁজলাম আকাশে। কালপুরুষকে খুঁজলাম। ওই তো সন্ধ্যাতারা! একটা প্যাঁচা উড়ে গেল সানাইয়ের ওপারের দিকে। আরে, ও অতটা উড়তে পারবে কি? নাকি নদীর মাঝবরাবর গিয়ে হাঁপিয়ে পড়ে ফিরে আসবে। না গেলেই পারত! নদীর ওপাশের ভেরেন্ডা, আকন্দ গাছের ঝোপে জোনাকি উড়ছে। ওদের আর কাজ কী? সন্ধে হলেই ওড়া! সারারাত উড়বে। আমি ফিরে যাব বাড়িতে, খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। মাও সব কাজ সেরে শুতে চলে যাবেন। তখনও জোনাকির উড়নপর্ব ফুরোবে না। অনেকটা মহাভারতের অষ্টাদশ পর্বের মতো। পড়তে শুরু করলে কি আর চট করে ফুরোয়? কত যুদ্ধ চলে, কত বীরের মৃত্যু হয়, পাণ্ডবদের কত কষ্টে দিন কাটার কাহিনি। সে চট করে ফুরোবে কী করে?

আমি বাড়ি ফেরার পথে উলটো দিক নির্বাচন করলাম। আজ আর অপরাবউদির বাড়ির সামনে দিয়ে যাব না। যদি মোবাইল নিতে ডাকে বউদি? বেশ হাঁটছিলাম। একা-একা। কখন যে আমার ফেরার পথ বউদির বাড়ির দিকে ঘুরে গেছে, টেরই পাইনি। লোডশেডিং চলছে। অন্ধকার রাস্তাঘাট। এখন বুঝি অমাবস্যার গায়ে-গায়ে। না হলে অত অন্ধকার হবে কেন? মাধবীলতার গাছটা দেখে বুঝতে পারলাম, এ তো অপরাবউদির বাড়ি! হঠাৎ ছাদের উপর থেকে বউদির গলা শুনতে পেলাম, “ অর্ক, দাঁড়া, তোর পুলকদা গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছে।”

এত নিকষ অন্ধকারে বউদি আমাকে চিনল কী করে? বউদি অন্ধকারে এভাবে দেখতে পায়? তা হলে কি বউদি দিনেরবেলায়ও আকাশের তারা দেখতে পায় নাকি? শুনেছি, যাদের চোখের দৃষ্টি খুব ভাল, তারা কেউ-কেউ দুপুরবেলাতেও আকাশের তারা দেখতে পায়। আর যারা আকাশের তারা দেখতে পায়, তারা নাকি বেশিদিন বাঁচে না। কেন কে জানে? অপরাবউদি বেশি দিন বাঁচবে না মনে হতেই আমার দু’ চোখ ঝেঁপে বন্যা এল।

আমি চেঁচিয়ে বললাম, “না, এখন আমি বাড়ি যাব বউদি। এখন আর তোমাদের বাড়ি যাব না।” বলেই আমি ফের দৌড়তে শুরু করলাম। পিছন থেকে শুনলাম, পুলকদা মনে হয় নীচে এসে দরজা খুললেন। সেরকম শব্দ পেলাম। আমাকে না দেখতে পেয়ে পুলকদা হয়তো দু’-একবার “অর্ক, অর্ক” করে ডাকবেন। তারপর ফিরে যাবেন ছাদে।

বউদি জিজ্ঞেস করবে, “কই, অর্ক এল না?”

পুলকদা বলবেন, “না, চলেই তো গেল!”

বউদি একটুখানি বিষণ্ণ হবে জানি, বউদি যা মেয়ে! পুলকদা আছে, তাই রক্ষে! না হলে রাতে চুপটি করে বারান্দায় বসে থাকত অনেকক্ষণ। পরের দিন এসে আমি যেই জিজ্ঞস করতাম, “বউদি, কাল আমার উপর খুব রাগ করেছ তো? কাল খাওনি তো কিচ্ছু?”

বউদি মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে অন্য ঘরে। যেতে-যেতে বলবে, “না খেতে আমার বয়েই গেছে! তোর উপর রাগ করব, আমার কি আর কোনও কাজ নেই? যা তো, মেলা বকিস না!”

আমি পালালাম। পালালাম বউদির অভিমানের হাত থেকে বাঁচতে। রাতে খেতে বসেছি, মা বললেন, “পিলু, তোর মুখ অমন থমথম করছে কেন রে? অপরা মোবাইল নিয়ে কিছু বলেছে?”

আমি বললাম, “আমি তো বউদির বাড়ি যাইনি? ওই ভয়েই তো যাইনি। জানো মা, বউদি আমাকে ফের মোবাইলটা দিতে আসবে, পুলকদার সামনে। তখন যদি না নিই, রাগে কীরকম গরগর করবে, সে যদি তুমি দেখতে! হয়তো কান্নাকাটিও জুড়ে দিতে পারে। বলবে, “তুই নিবি না কেন? আমি অত আহ্লাদ করে তোর পুলকদাকে বলেছিলাম, তার কোনও দাম নেই? তোর গোঁয়ার্তুমিটাই বড় হল রে? কীসের তোর গোঁয়ার্তুমি? আমি কি তোকে কিছু দিতে পারি না? তা হলে আর কোনও দিন আমার বাড়ি আসিস না। কেমন? আজ থেকে। আসিস না কিন্তু!”

মা শুনে চুপ করে থাকলেন। একটু পরে বললেন, “মেয়েটা বড্ড সরল মনের!”

আমি বললাম, “সরল আর বক্র, ওসব থাক না মা। তোমার ছেলেও খুব নরম মনের কিন্তু! তুমি বলো, আমি কী করব?”

“তুই সরল কি না সে কথা আমাকে বলতে হবে না। দেখিস, মোবাইলটা না নিলেই তো ভাল। বলিস, তুমি রাখো বউদি, আমি তোমার কাছ থেকে একদিন চেয়ে নেব ঠিক!”

“অপরাবউদি ওরকম মেয়েই নয় গো, যে ওসব কথা বুঝবে। আর কোনও দিন আমার সঙ্গে কথাই বলবে না।”

“কথা না বলবে তো না বলবে। তুইও বলিস না, ব্যস, হয়ে গেল!”

“অপরাবউদি এমন না মা, রাগ করে থাকা যায় না। আমারই মন খারাপ করে খুব। এক-এক সময় আমার কী মনে হয় তখন জানো?”

“কী?”

“নাঃ, সে কথা তোমাকে বলতে পারব না। তা হলে তুমিও এক্ষুনি কাঁদতে বসে যাবে।”

“তবু কী মনে হয় তোর বল না?”

“আমার না তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে মা।”

“ধ্যাত, বোকা ছেলে! অমন কথা বলতে নেই! অপরা তোকে ভালবাসে!”

আমি আজ তিনদিন অপরাবউদির বাড়ির সামনে দিয়ে যাইনি। দেবাঙ্কুর নাকি কাল অফিস থেকে ফেরার পথে বউদির বাড়ির কাছ দিয়ে আসছিল। কী মনে হতে ডোরবেল বাজিয়েছিল। বউদি তখন ছাদে। পুলকদাও। সন্ধে হয়ে গেছে। পুলকদা ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে দেখে বলেছিলেন, “দাঁড়া দেবাঙ্কুর, আমি চাবি দিচ্ছি।”

অপরাবউদির বাড়ির এটাই নিয়ম। বউদি বলে, “তোদের জন্যে অতবার করে নীচে নামতে-উঠতে পারব না দরজা খুলতে। ব্যাগে করে চাবি ঝুলিয়ে দেব।”

কিংশুকদা বলে, “অপরা, তুমি যতবার সিঁড়ি দিয়ে উপর-নীচ করবে, তত শরীর ফিট থাকবে।”

বউদি বলে, “দরকার নেই আমার শরীর ফিট থাকার। আমি তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি ফিট!”

কাল দেবাঙ্কুর নীচে এসেছে শুনে বউদি ছাদ থেকে চেঁচিয়ে পুলকদাকে বলল, “না না, চাবি দিতে হবে না।” বলে ছাদের রেলিঙে ঝুঁকে পড়ে বলল, “অ্যাই, তোদের আসতে না করেছি না? তাও এসে বেল বাজাচ্ছিস? যা, এখন কেটে পড়!”

এগুলো আমাদের সকলের গা-সওয়া। আমরা কেউ বউদির এমন কথায় কক্ষনো রাগ করি না। পুলকদা চলে যাওয়ার দিন বউদি সকলকে বাড়িতে খাতির করে ডাকবে। দারুণ আপ্যায়ন করবে বউদি। সেদিনই পুলকদা আমাদের জন্যে যেসব উপহার এনেছে, জনে-জনে তুলে দেওয়া হবে সেগুলো। না, সেগুলো কিন্তু বউদি কারও হাতে তুলে দেবে না। পুলকদাকে বলবে, “তুমিই এনেছ তোমার এতগুলো ভাইয়ের জন্যে, তুমিই ওদের নিজের হাতে তুলে দাও! আমি হলে একটা কিচ্ছু আনতাম না।”

আমরা সকলেই জানি, এটা বউদির বানানো কথা। আমরা বুঝতে পারি, বউদি তখন টগবগ করে ফুটতে থাকে ভিতরে-ভিতরে।

“তুমিই পুলকদাকে বলে কার জন্যে কী আনতে হবে সব ঠিক করে দাও। তবু সামনে কত নাটক!” কথাটা বলে অনীক। আমার এই ‘নাটক’ শব্দটার উপর যত আপত্তি। মুখে কিছু বলতে পারি না। মনে হয়, বউদিও রাগ করে না। আর বউদি যখন রাগ করে না, তখন আমার কী?

সানাইয়ের ধারে আমাদের আড্ডায় যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সকলেই বলেছে, কেউ এ ক’দিন বউদির বাড়ি যায়নি। যাবে আর কে? গেলে আমিই যেতাম। একজনেরই তো যাওয়ার অধিকার আছে। সে আমি। যেতাম, মন খারাপ করত বলে। এবারও কি মন খারাপ করছে না? কিন্তু সে মন খারাপ মনের মধ্যে চেপে রেখেছি। মাকেও বুঝতে দিইনি।

দেখতে-দেখতে দশ দিনের ছুটি কাবার হয়ে গেল পুলকদার। কালই কখনও পুলকদার ফ্লাইট। হিসেব মতো কাল বউদি আমাদের ডাকবে। সকলের হাতে উপহার তুলে দেওয়া হবে। আমরা দুবাই থেকে আনা উপহার নিয়ে

আনন্দে বাড়ি ফিরব। সকাল থেকে উসখুস করছি। কিন্তু আমাদের কে খবর দেবে? আমি তো আর যাচ্ছি না। আগে আমি যেতাম বলে বউদি সকলকে খবর দেওয়ার ভার তুলে দিত আমারই উপরে। এবার কী হবে? কই, এখনও তো ডাক এল না? বউদি কি এতটাই রেগে আছে?

দু’বার আমাদের বাড়ির ছাদে উঠে দেখেছি। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে অপরাবউদির বাড়ি দেখা যায় না বটে। তবু কী ভেবে উঠেছি ছাদে, কে জানে? মনে ভাবছি, এ ক’দিন কে করে দিল বউদির বাজারহাট? একবারও তো আমাকে ডাক পাঠাল না। আমার উপর খুব রাগ করেছে নিশ্চয়ই।

আমিও কখনও-কখনও বউদিকে একটা জিনিস উপহার দিই। বউদি বারবার না বলে, কিন্তু আমি শুনি না। সেটা হল, নীললোহিতের লেখা উপন্যাস। বউদির প্রিয় লেখক নীললোহিত। এই নিয়ে অনিকেতের মতো ছেলেও বউদিকে মজা করতে ছাড়ে না। বলে, “বউদি, তোমার ভোটে রবীন্দ্রনাথও হেরে গেলেন। জিতে গেলেন শুধু নীললোহিত!”

সত্যিই তাই। একবার আমরা দল বেঁধে অপরাবউদিকে নিয়ে পঁচিশে বৈশাখে রবীন্দ্রসদনে গিয়েছিলাম। পুলকদাও ছিলেন সঙ্গে। আমরা বসে গান শুনছিলাম মন দিয়ে। হঠাৎ অডিয়েন্সের মধ্যে চঞ্চলতা দেখে পাশে তাকিয়ে দেখলাম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢুকছেন। অমনি চারপাশে ভিড় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে। আমি কানে-কানে অপরাবউদিকে বললাম, “ওই তো তোমার প্রিয় লেখক এসে গেছেন। যাবে নাকি আলাপ করতে?”

বউদি অবাক হয়ে বলল, “যাঃ! আমার সঙ্গে আলাপ করবেন নাকি? তুই যে কী বলিস?”

আমার কথায় পুলকেন্দুদাও বেশ মজা পেয়েছেন। তিনি চোখের ইঙ্গিতে বললেন, যা, নিয়ে যা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে।

আমি আর অনিকেত দু’জনে বউদিকে টানতে-টানতে নিয়ে গেলাম মঞ্চে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। বললাম, “ইনি আপনার নীললোহিতের লেখার ভক্ত। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।”

অপরাবউদি যে অমন মুখরার মতো কথা বলে, তখন দেখি একেবারে থ’। কী করবে ভেবেই পাচ্ছে না। আমি যেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম, অমনি দেখি অপরাবউদিও প্রণাম করল। উনি হা হা করে উঠলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”

বউদি নিজের নামই ভুলে গেছে যেন। বেশ কিছুটা পরে বলল, “আমি অপরা।”

উনি বললেন, “বাঃ, বেশ সুন্দর নাম তো! তুমি নীললোহিতের কোন লেখা পড়েছ?”

বউদি আমার দিকে কটমট করে তাকাল। যেন আমিই জোর করে চাকরির ইন্টরভিউয়ারদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তারপর মনে করে-করে বলল, “নিরুদ্দেশের দেশে’, ‘তোমার তুলনা তুমি’, ‘মনে আছে মনে থাকবে’।”

সুনীলবাবু হেসে বললেন,“বাঃ, তুমি তো আমার অনেক বই পড়ে ফেলেছ? তুমি নীললোহিতের ‘সুদূর ঝরনার জলে’ পড়োনি? ‘দিকশূন্যপুর’?”

বউদি খুব লজ্জিত মুখে দু’ দিকে মাথা নাড়ল, না, পড়েনি। তখন আমাদের অবাক করে দিয়ে সুনীলবাবু বললেন, “দাঁড়াও, আমার একটা ‘নীললোহিত সমগ্র’ তোমাকে লিখে দিই। তুমি কাউকে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটে প্রকাশকের দোকান থেকে আনিয়ে নিও!”

সুনীলবাবু আমার দিকে হাত বাড়ালেন কাগজের জন্যে। আমি পকেট থেকে একটা টুকরো কাগজ ওঁর হাতে দিলাম। উনি লিখে দিতে-দিতে বললেন, “একদিন আমার বাড়ি এসো!”

অপরাবউদি কাগজটা নিয়ে প্রায় লাফাতে-লাফাতে পুলকদার কাছে গিয়ে, সকলকে কাগজটা দেখাল গর্বের সঙ্গে। পরে কলেজ স্ট্রিট থেকে ‘নীললোহিত সমগ্র’ বইটার একটা খণ্ড আমি বউদিকে এনে দিয়েছিলাম। যখনই সুযোগ পাই, মাকে গিয়ে টাকা চাই, বলি, “মা আমাকে কিছু টাকা দাও তো!”

মা বলেন, “কেন, তোর আবার টাকা কী হবে রে পিলু?” মা জানেন, অন্য অনেক ছেলের মতো আমার চা-সিগারেটেরও খরচ নেই। মোবাইল নেই যখন, রিচার্জ করারও টাকার দরকার হয় না। মা মুখ তুলে আমার দিকে তাকান।

আমি বলি, “একটা নীললোহিতের বই কিনব। অপরাবউদিকে উপহার দেব।”

মা হাসতে-হাসতে টাকা দিয়ে দেন। কিন্তু, আমার এসব ভাবনার মধ্যে আমাদের দরজায় কেউ কড়া নাড়াল। মা বললেন, “দ্যাখ তো পিলু, কে এল?”

আমি দরজা খুলে অবাক, “পুলকদা? আসুন, আসুন, ভিতরে আসুন।” চেঁচিয়ে মাকে বললাম, “মা, দ্যাখো, পুলকদা এসেছেন।”

মা রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে বেরিয়ে এলেন, “ও বাবা, পুলক এসেছ? এসো বাবা, বোসো, বোসো! অপরা কেমন আছে? তোমার আর ক’দিন বাকি ছুটি শেষ হতে?”

পুলকদা বললেন, “না মাসিমা, বসব না। বাজারে যেতে হবে। অর্ক তো আমাদের বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। তাই আমাকেই বাজারে ছুটতে হচ্ছে। বলি, একটা লক্ষ্মণের মতো ভাই থাকতে কোনও রামকে বাজারের ব্যাগ হাতে দেখেছেন কি কখনও?”

মা পুলকদা কথায় খুব মজা পেয়েছেন। হাসতে-হাসতে বললেন, “বোসো বাবা, আমি চা করি?”

“না মাসিমা, দেরি হয়ে যাবে।” তারপর আমার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিতে-দিতে বললেন, “এটা অপরা তোকে দিতে বলেছে।”

আমি বুঝে গেলাম, ওটা সেই মোবাইলটা। মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মাও বুঝে গেছেন তখন। বললেন, “ওসব আনতে গেলে কেন বাবা? মোবাইল নিয়ে পিলু কী করবে? ও তো আর অফিস কাছারিতে চাকরি করে না?”

“অফিসে চাকরি করলেই লোকে মোবাইল রাখে, না হলে রাখে না? এখন তো যারা চাকরি করে না, তারাই বেশি মোবাইল ইউজ করে মাসিমা! তুই ধর অর্ক।” বলে পুলকদা আমার হাতে জোর করে গুঁজে দিলেন প্যাকেটটা। আমি জীবনে এত অসহায় অবস্থায় পড়িনি কখনও।

মা বললেন, “নাও! কী আর করবে?”

আমি প্যাকেটটা পুলকদা হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, “আপনার বাড়ি থেকে নেব পুলকদা। আপনারই হাত থেকে বউদির সামনে। আমার ভাল লাগবে।”

পুলকদা বললেন, “ঠিক আছে। তাই নিস। হ্যাঁ, তোকে তো বলাই হয়নি, কাল সকালে তুই সকলকে আসতে বলিস আমাদের বাড়িতে, বউদি বলে দিয়েছে।”

আমি মাথা নাড়লাম। পুলকদাকে বললাম, “আপনি বসুন, চা খেয়ে তবে যাবেন। আমাকে আপনার ব্যাগটা দিন, আমি বাজার করে আনছি।”

পুলকদা বলল, “না, তোকে দিলে যদি তোর বউদি রাগ করে?”

আমি বললাম, “সে আমি ম্যানেজ করে নেব। আপনি ব্যাগটা দিন না!”

বাজারের ব্যাগটা নিয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম। বাজারে যেতে হলে অপরাবউদিদের বাড়ির সামনে দিয়েই যেতে হয়। আমি বউদির বাড়ির সামনে গিয়ে মজা করলাম। ডোরবেল বাজালাম নীচে দাঁড়িয়ে। একটু পরে বউদি দোতলার বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে ‘কে?’ বলতে গিয়ে আমাকে দেখতে পেল। অমনি মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। আমি কিছুই বললাম না। শুধু বাজারের ব্যাগটা উপরে তুলে দেখিয়েই চললাম বাজারের দিকে। বউদি রাগ দেখিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।

যখন বাজার নিয়ে ফিরলাম, বউদির সে কী রাগ, “তোর আনা বাজার আমি ঘরে তুলবই না। ছুড়ে ফেলে দেব। কেন, তুই আমার বাড়ির কাজ করবি কেন? তুই এ বাড়ির কে? কী সম্পর্ক তোর সঙ্গে? নিয়ে যা এসব।”

পুলকদা সামলানোর জন্যে উঠে বউদির কাছে গিয়ে বললেন, “আঃ, বাজারটা ছুড়ে ফেলে দেবে কেন? পারলে অর্ককে ছুড়ে ফেলে দাও না! বাজারের দোষ কী? যত দোষ তো করেছে অর্ক?”

আমি জানি, বউদি রেগে গেলে আগুন হয়ে যায়। আবার একটু পরে গলে জলই শুধু নয়, দরকার হলে বরফও হয়ে যায়। আমি চুপ করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পরেই বউদি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। বলল, “আগে হাঁ কর দিকি! রাজভোগ! ভারী আমার মান-বুঝদার হয়েছেন রে। আমার দেওয়া মোবাইল উনি নেবেন না! মান যাবে! তা হলে, দাও না, যেসব টি-শার্টগুলো বাড়িতে রাখা আছে, যাও, গিয়ে এক্ষুনি ফেরত নিয়ে এসো। ওগুলো আর তেমার বাড়িতে থাকবে কেন? মান চলে যাবে না? আমি গরিব-দুঃখীকে দিয়ে দেব!”

পুলকদা হাত তুলে বললেন, “আঃ, এবার থামো তো অপরা! অর্ক বুঝতে পেরেছে, ও বিরাট অন্যায় করে ফেলেছে। ক্ষমাহীন অপরাধ। হল তো?”

আমার মুখে তখন রাজভোগ। মুখ নাড়তেই পারছি না। বউদি আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, “আরে আমার মানী অর্কবাবু! কাল সকাল-সকাল চলে এসো। না এলে, পেটাব তোমাকে। তখন তো আর তোমার পুলকদা থাকবে না। দেখব, কে তখন তোমাকে বাঁচায়?”

আমি তখনই অপরাবউদির গা থেকে শিউলি ফুলের সেই মিষ্টি গন্ধটা পেলাম। একদম টাটকা, সকালে ফোটা শিউলি ফুলের গন্ধ!




পরের দিন সকালবেলা আমিই প্রথম অপরাবউদির বাড়ির বেল বাজালাম। পুব দিক থেকে সূর্যের আলো পড়েছে মাধবী লতার গাছে। এরও মিষ্টি একটা গন্ধ নাক পাতলে টের পাওয়া যায়। উপরে গিয়ে দেখলাম, পুলকেন্দুদার ব্যাগ গুছনো হয়ে গেছে। ব্যাগগুলো দোতলার বসার ঘরের এক পাশে রাখা।

বউদি বলল, “তোর পুলকদার প্লেন সন্ধে ছ’টায়। তুই কিন্তু আমার সঙ্গে এয়ারপোর্টে যাবি।” আমি ঘাড় নাড়লাম। পুলকদা চলে যাবে, তাই বউদির মনটা বিষণ্ণ। সকাল থেকে লুচি-আলুর দম করেছে বউদি। বউদি কোনও কাজের মাসি রাখে না। কতবার আমি বলেছি। আজও বললাম, “বউদি, একটা লোক রাখলেই তো হয়? তুমি অত খাটো কেন? সকাল থেকে এই এতগুলো লুচি ভাজলে?”

বউদি বলল, “কী করব বল? তোরা সকলে আসবি। তোদের তো না খাইয়ে রাখা যায় না? আর অন্য সময় হলে তো, আমার একা মানুষের খাওয়া, কতটুকু আর কাজ থাকে? না হলে সারাদিন করবটা কী বল? তার মধ্যে তুই আমার কত কাজই না করে দিস।”

আমি বললাম, “আর আমরা যে প্রতিদিন এত উপদ্রব করি? চা করা, কাপ-ডিশ ধোওয়া, এটা-ওটা খাবার আমাদের জন্যে বানানো, এ কি কম খাটুনির? আমি আর কতটুকু করে দিই বলো? তুমি তো কিচ্ছু করতে দাও না।” কথার পিঠে একটু মজাও করলাম, “তা ছাড়া তুমি হলে বড়লোকের বউ! তোমার বর দুবাইয়ের অর্ধেকটার মালিক! তোমার অত কাজটাজ মানায় না!”

পুলকদা শুনছিলেন আমার কথা। হাসলেন মিটিমিটি। বললেন, “তুই একবার বল তো অর্ক, তোর বউদিকে বুঝিয়ে। আমি তো আর বুঝিয়ে পারি না।”

বউদি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খাওয়ার টেবিলে প্লেটগুলো সাজাচ্ছিল। একবার আমার মুখের দিকে তাকাল কটমট করে। মানে, কথাগুলো বলে আমি বুঝি ঝামেলা করে ফেলছি। আমি বউদির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম,

“তা ছাড়া, তোমার অমন গোলাপ কুঁড়ির মতো সুন্দর নখগুলো যে মলিন হয়ে যাবে গো? হারমোনিয়ামের রিডে যে আঙুল খেলা করে, সে আঙুল অমন করে বাসন মাজবে? তবে বউদি, তুমি কিন্তু আর গান প্র্যাকটিস কোরোই না! গান ছেড়ে দিলে?”

“কত কিছু পাওয়ার জন্যে কত কিছুই না ছাড়তে হয়!”

বউদিও কম যায় না। একটু থেমে বলে, “তুই তো কম যাস না দেখি! তুইও কি নীললোহিত হয়ে গেলি? এবার লেখাটেখা শুরু করে দে। মলিন? হয়ে গেলেই বা কী? দেখার মানুষকে পাব কোথায় বল? তিনি তো ব্যাগ গুছিয়ে রেডি! আর তোরাও তো ভুলে আমার দিকে ফিরেও তাকাস না!”

অমন সময় ডোরবেল বাজল। আমি বারান্দা থেকে উঁকি দিলাম, কিংশুকদা এসেছেন। চাবি ফেলে দেওয়া হল নীচে। বউদি চেঁচিয়ে বলল, “কিংশুকদা, তুমি দরজাটা খোলা রেখেই উপরে এসো। সকলে এবার পর পর আসবে তো? ক’বার আর চাবি ফেলব?”

কিংশুকদা উপরে এসে হইহই করে উঠলেন, “পুলকদা, হুট করে এসে আবার পুট করে উধাও হচ্ছেন? আর ক’টা দিন থেকেই যান না! সবাই মিলে একটা পিকনিক করি? আপনার সঙ্গে পিকনিকের মজাই আলাদা।”

“এবার আর সময় হল না গো। পরের বার যাব, এখন থেকে ফাইনাল হয়ে থাকল। তুমি সব অ্যারেঞ্জ করবে। কোথায় যাওয়া হবে, মেনু কী হবে, কে কী রাঁধবে, সব! আমি সেবার তোমাদের গেস্ট হয়ে থাকব। গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব পায়ের উপর পা তুলে।”

পুলকদা কবে আসবে ফের, সে তো ছ’ মাসের আগে নয়। অতদিন পরের আনন্দ, এখন থেকে ভেবে কী হবে? কিন্তু কথাটা আমার মনের মধ্যে গুনগুন করতে থাকল। তক্ষুনি এসে হাজির অনীক আর অভ্রনীল।

অনীক বলল, “বউদি, খেতে দাও, বড্ড খিদে পেয়েছে।” বলেই রান্নাঘরে ঘুরঘুর করতে গেল। অনিকেত এসে গেল একটু পরে। দেবাঙ্কুর আসবে না। কোথায় যেন ব্যাঙ্ক থেকে আউটিংয়ে গেছে। বউদি একবার বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখে এল। আসেনি অনিকেতও। বউদি ফোন করতে গেল অনিকেতকে। যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। আজ ছুটির দিন বলে এখনও অনিকেতের ঘুম-জড়ানো গলা। শুভ্রকানন্তই বা এল না কেন? সে তো সকালে উঠে জগিং করতে যায়। তার দেরি হওয়ার কথা নয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে অনিকেত আর শুভ্রকান্ত চলে এল। আমারও আজ খুব খিদে পাচ্ছে। বললাম, “বউদি, আর দেরি কোরো না। খেতে দাও।”

বউদির রাজভোগ খুব পছন্দ। নলেন গুড়ের রাজভোগ। আজকাল প্রায় সারা বছরই নলেন গুড়ের মিষ্টি পাওয়া যায় দোকানে। বউদি খেতে দিতে-দিতে বলল, “লুচি যে যতগুলো চাইবে পাবে।”

অনীক আঙুল তুলে বলল, “বউদি, তুমি কি বাজি লড়বে? আমি কিন্তু একাই তোমার লুচির স্টক শেষ করে দিতে পারি?”

বাজির কথায় আমি অনীকের মুখের দিকে তাকালাম। ইস, এই অনিকেতই বউদিকে চুমু খাবে বলে আমার সঙ্গে বাজি ধরতে চেয়েছিল। ছিঃ, ছিঃ! কী রকম একটা ঘৃণা হল অনীকের উপর। ছিঃ, অনীক। তুই অমন মায়াময় অপরাবউদিকে… অমন কথা ভাবতে পারলি?

খেতে-খেতে শুরু হল আড্ডা। কিংশুকদা মজা করে বললেন, “বউদিমণি, আজ আলুর দমটা যা বানিয়েছে না অর্ক, জাস্ট ফাটাফাটি।”

মজা করার সময় কিংশুকদা অপরাবউদিকে ‘বউদিমণি’ ‘স্যরি ম্যাডাম’ আরও কত কী যে বলেন! আমরা খুব মজা পাই। বউদিও। বউদি এক হাতা আলুর দম তুলে দিল কিংশুকদার প্লেটে। কিংশুকদার চোখের আকার তখন রাজভোগকেও হার মানায়।

মুখচোরা অনিকেত বলল, “বউদি, আমি কি একটু আলুর দম পাব?”

“ও মা, পাবি না কেন? তোদের জন্যেই তো করেছি!” বউদি তুলে দিল অনিকেতের প্লেটেও।

অনীক নিজে চারটে রাজভোগ তুলে নিয়ে বলল, “বউদি, কম পড়বে না তো?”

পুলকদা বললেন, “তুই ক’টা খাবি? অপরা, দাও তো ওকে আরও দুটো!”

অভ্রনীল মিষ্টি খুব একটা পছন্দ করে না। ওর প্রিয় তেলেভাজা। আমি না মিষ্টি, না তেলেভাজা। অনীক লুচি খেল মনে হয় পনেরোটা। আমি গুনে রাখিনি বটে, ওর মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে।

বউদি বলল, “অর্ক, তুই কী নিবি?”

আমি বললাম, “এই তো এত খাচ্ছি! আরও কত খাব? তুমি তো জানো বউদি, আমি খাওয়ার ব্যাপারে বেশ পিছিয়ে থাকি।” বউদির হাতে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললাম, “এবার তুমি বোসো বউদি। আমি তোমাকে পরিবেশন করি?”

সকলের খাওয়া শেষ হতে আমি বউদির সঙ্গে হাত লাগালাম প্লেটগুলো তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। পুলকদা বললেন, “আহা, তুই কেন রে অর্ক? আমি তো আছি।”

আমি বললাম, “আপনি গেস্ট! আপনি চুপ করে বসে থাকুন।”

বউদি আমার পিঠে হাত রেখে বলল, “এই জন্যে তোকে এত আমার পছন্দ!”

এবার সেই মুহূর্ত। উপহারের পালা। পুলকদা এক-একজনের হাতে তুলে দিচ্ছেন এক-একটা প্যাকেট। বউদির মুখটা যেন দূর আকাশের পরি। সব্বাই তক্ষুনি খুলে ফেলছে প্যাকেটগুলো। কিংশুকদার আফটার সেভ। অনীকের টি-শার্ট। অনিকেতের পার্কার কলম। অভ্রনীলের বডি স্প্রে। দেবাঙ্কুরের টাই, ও যেদিন আসবে, সেদিন পাবে। শুভ্রকান্তের শ্যাম্পু। সকলে আমার দিকে তাকাল। কিংশুকদা বললেন, “অপরা ম্যাডাম, অর্ক কী পেল?”

অপরাবউদি মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “উনি কিছু নেবেন কি নেবেন না এখনও ঠিক করে উঠতেই পারছেন না। তোমরা তো জানো, অর্ক সব সময় এটাই করে। ওঁরটা তোলা থাক।”

প্যাকেটটা বউদির হাত থেকে ছিনিয়ে নিল অনীক। চটপট করে খুলে মুখটা হাঁ করে বলল, “ও মা, মোবাইল! দারুণ দেখতে!”

বউদি মোবাইলটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “আমার তো অর্ককে যখন-তখন দরকার হয়। পাই না। এবার কল করব, আর অর্ক চলে আসবে। এটা আসলে আমার জন্যেই অর্ককে দিচ্ছি।”

পুলকেন্দুদা একধারে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন। অনীক চেঁচিয়ে বলল, “পুলকদা, থ্যাঙ্ক ইউ! পুলকদা, থ্যাঙ্ক ইউ!” আমরাও সমস্বরে বলতে লাগলাম। শুভ্রকান্ত টেবিল চাপড়ে তাল দিতে লাগল। অভ্রনীল এক পাক নেচেও নিল।

অপরাবউদি মুখে নকল অভিমান ফুটিয়ে বলল, “অর্ক, তুই অন্তত আমাকে একবার থ্যাঙ্ক ইউ বল!”

আমি মজা করলাম, “আমার থ্যাঙ্ক ইউ পাবে কী? এতে তো আমার ঝামেলা বাড়ল গো?”

বউদি মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলল, “বেশ, তোকে ফোন করে ডাকবই না। হল তো?”

এটা যে বউদির মুখের কথা নয় তা বুঝে গেলাম! তক্ষুনি অপরাবউদির গা থেকে এক ঝলক টাটকা শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে এল আমার নাকে!

হইহই করতে করতে আমরা উঠে পড়লাম বাড়ির দিকে। সকলে বলল, “পুলকদা, আবার তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আবার আমরা তাড়াতাড়ি অনেক উপহার পাই।”

আমি আসার সময় বললাম, “আসি পুলকদা। আপনার দেওয়া মোবাইলটা খুব ভাল হয়েছে!”

বাড়ি ফিরেই মাকে দেখালাম মোবাইলটা। বললাম, “মা, ফেরানো গেল না। কী করি বলো?”

মা বললেন, “বেশ দেখতে কিন্তু! তোদের অপরার এই উপহার থেকে বেরোতে পারলেই ভাল। দেখিস চেষ্টা করে পারিস কি না।”

মাকে কী করে বোঝাব, উপহার থেকে অনেক দিনই বেরোতে চেয়েছি। পারিনি। অমনি তখন অপরাবউদির মুখটা এমন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে যে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তখন কোথায় যে হাওয়া হয়ে যায় অপরাবউদির অভিমান, কোথায় যে উড়ে যায় সেই টাটকা শিউলি ফুলের গন্ধ!

তক্ষুনি মোবাইলটা বেজে উঠল। রিং-টোনটা কবিতার আবৃত্তির! রবীন্দ্রনাথের, ‘হে মোর সন্ধ্যা, যাহা-কিছু ছিল সাথে/রাখিনু তোমার অঞ্চলতলে ঢাকি।/আঁধারের সাথি, তোমার করুণ হাতে/বাঁধিয়া দিলাম আমার হাতের রাখী।’ কার কণ্ঠে এই আবৃত্তি, গলাটা চিনতে পরছি না। তবে বেশ সুন্দর। ফোনটা ধরলাম।

ওপাশ থেকে অপরাবউদির গলা, “কী রে অর্ক, রিং-টোনটা কেমন?”

আমি চুপ করে থাকলাম। তারপর বললাম, “খুব সুন্দর। কিন্তু মানেটা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।”

“তোর অত মানে বুঝে কাজ নেই। তিনটের সময় তোকে আসার কথা বলতে ভুলে গেছি রে। একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে চলে আসিস। পুলকদাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যেতে হবে না?”

আমি বললাম, “ও হ্যাঁ, যাব তো!”

“তোর মনে ছিল কি? তবু আমি মনে করিয়ে দিলাম। যাক, আমার উপর তোর রাগ কমেছে তো?”

আমি বললাম, “ও মা, তোমার উপর আবার কখন রাগ করলাম? আমি পালাচ্ছিলাম নিজের থেকে। ওসব রাখো। আমি ঠিক সময় ট্যাক্সি নিয়ে তোমার বাড়ি চলে যাব, তোমাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না।”

পুলকদার ব্যাগট্যাগ তুলে ট্যাক্সি যখন এয়ারপোর্টের ফ্লাইওভার দিয়ে ছ’ নম্বর গেটের সামনে গিয়ে থামল, অপরাবউদির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বউদির চোখের পাতা দুটো ভেজা। আমি নেমে ব্যাগগুলো ট্রলিতে চাপিয়ে দিলাম। পুলকদার বোর্ডিংয়ের সময় হয়ে গেছে। বউদির দিকে তাকিয়ে পুলকদা বললেন, “মন খারাপ কেন মেয়ে? আমি তো এবার বাড়তি দেখা করে গেলাম। মন খুশি করো অপরা, না হলে যে আমিও মন খারাপ নিয়ে যাব। অর্ক ভাল থাকিস। এখন তো মোবাইল হল, এক-আধদিন ফোন করিস। আমার কাছে সরে এসে পুলকদা বললেন, “আর শোন, এই মেয়েটাকে ভাল রাখিস!”

বউদি ভেজা চোখে মুখ তুলে তাকাল পুলকদার দিকে। দেখলাম, পুলকদারও মুখটা থমথমে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘দুই বড়ো মানুষের মিলন দৃশ্য বড়োই মধুর।’ কিন্তু এখন দু’জন বড়ো মানুষের মন খারাপের সামনে দাঁড়িয়ে আমিও নিশ্চুপ হয়ে গেছি। পুলকদা গেটে চেকিং সেরে একবার তাকালেন আমাদের দিকে। ভুল বললাম, অপরাবউদির দিকে। সে দৃষ্টিতে মায়া ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। এমন দৃষ্টি খুব কম মানুষের চোখে দেখেছি। পুলকদা এয়ারপোর্টের ভিতরে আড়াল হয়ে যেতে আমি বললাম, “বউদি, চলো।”

বউদি ডান হাতের চেটোর উলটো দিক দিয়ে চোখের পাতা দুটো মুছে বলল, “চল!”

ট্যাক্সি শাঁ শাঁ করে যখন আমাদের নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটছে, তখন আমার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল, বউদি অনেক কষ্ট পুষে রাখে তার মনের মধ্যে। আমরা সে কষ্টের হদিশ রাখি না। সে কষ্টটা গভীর রাতের পূর্ণিমা চাঁদের বিষণ্ণতার মতো। যখন পূর্ণিমা চাঁদকে দেখার মতো লোক কমে যায়, তখন সে অনেক কষ্ট নিয়ে আকাশে ভেসে থাকে। তার যে আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। ভেসে থাকাটাই তার নিয়তি। অপরাবউদিও তেমনি।

বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নামছি, পুলকদার ফোন, “আমি প্লেনে বসে গেছি। তোমরা সাবধানে যাও!”

বউদি নেমে ভাড়া মিটিয়ে বলল, “অর্ক, উপরে আসবি?”

আমি না করতে পারলাম না। বউদির পিছন-পিছন দোতলায় এসে দাঁড়াতে বউদি বলল, “দ্যাখ, কেমন একটা ভ্যাবলা চাঁদ উঠেছে মাধবীলতার পাশে? চল, আমরা ছাদে যাই?”

আমি তখনও বিষণ্ণ মনের বউদির কষ্টের জায়গাটা চিনতে পারিনি। আমি মুখটা একটু বাঁকিয়ে ছিলাম, যাব না বলে। বউদি আমাকে প্রায় হিড়হিড় করে সিঁড়ি দিয়ে টানতে-টানতে ছাদে নিয়ে এল। বলল, “আমরা আজ অনেক রাত পর্যন্ত উল্কা খসে পড়তে দেখব অর্ক, তোর আপত্তি নেই তো? আমরা উল্কা গুনব আজ, অনেক অনেক উল্কা! কী রে রাজি?”

আমি বললাম, “উল্কা খসে পড়লে সঙ্গে-সঙ্গে সাত রকম ফলের নাম বলতে হয় জানো?”

“আমার কথার উত্তর এটা নয় রে অর্ক। তোর সঙ্গে একদিন এক পূর্ণিমা রাতে বসুধারার পারে যাব। আমি তো কখনও রাতের বসুধারাকে দেখিনি। অন্ধকারে অনেক ঢেউ গুনব দু’জনে। কে বেশি গুনতে পারে তার প্রতিযোগিতা হবে সেদিন। আমি জানি তুই হারবি। অবশ্য তোর কাছে তো ওটা বসুধারা নয়, ওটা সানাই নদী! তোর বান্ধবী! আর তোর কাছে জেতা মানে, তোর কাছে আমার হেরে যাওয়া। আমি তোকে জিতিয়ে দিতে পারলে সবচেয়ে খুশি বই রে!” আমার হাতটা বউদি দু’ হাতে টেনে নিয়ে বলল, “বল, যাবি?”

আমি বললাম, “আমি তো প্রায়ই যাই। তুমি কবে যাবে বোলো। তোমাকে নিয়ে যাব।”

“আমি রোজ তোর সঙ্গে বসুধারার পারে যেতে চাই। রোজ!” তারপর বউদি আমার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, “কী রে ভয় পাচ্ছিস তো?”

আমি মাথা নাড়লাম, “না না, তোমাকে আবার কিসের ভয়? তুমি কি রাক্ষসী নাকি যে, তোমাকে ভয় পাব? তুমি তো একটা কুঁড়ে মানুষ। বাজারেই যেতে চাও না। আমাকে দিয়ে সেদিন যে জিনিসটা কিনতে পাঠিয়েছিলে, সেটা তো তুমি নিজেই কিনতে পারতে? আমাকে সেদিন অমন করে লজ্জায় ফেললে কেন?”

অপরাবউদি আজ কেমন যেন রহস্যময়ী। বলল, “বেশ করেছি, তোকে লজ্জায় ফেলেছি। একশোবার লজ্জায় ফেলব। তুই আমার। তোর উপর আমি যা খুশি করতে পারি?”

আমি বউদির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বউদির কালো গভীর চোখের তারায় খুব আবছা কুহকিনী চাঁদের আলো এসে পড়েছে। বউদিকে আজ খুব রহস্যময় লাগছে। অচেনা, দূরের এক মায়াবী মানুষ।

বউদি হঠাৎ আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি আর অপরাবউদি, আমরা মাথায়-মাথায় সমান। তখনই বউদি বলল, “চল, ওইখানটায় বসি।”

বউদি বায়না করেছিল বলে গত বছর ছুটিতে এসে পুলকদা ছাদের মাঝখানে এটা বানিয়েছেন। বাঁধানো গোল বেদির উপর সিমেন্টের ছাতা। আমরা গিয়ে বসলাম। অনেকক্ষণ আমরা কেউ কোনও কথা বলছি না। দূরে সন্ধ্যাতারাটা জ্বলছে-নিভছে। আমি নিচু স্বরে বললাম, “বউদি!”

বউদি কথা বলল যেন দূর নক্ষত্রলোক থেকে, “উঁ? বল! জানিস তো অর্ক, এখন কোনও কথা নয়, চুপকথাদের সময় এখন। এ সময় আকাশের তারাও গুনতে নেই। এখন শুধু ফুল ফোটার সময়। আকাশের নীলে একটা একটা করে তারা ফুটে ওঠার সময়। আয়, আমরা এখন শুধু চুপ করে বসে থাকি!”

বেশ কিছুটা সময় পরে বউদি নীরবতা ভাঙল। হঠাৎ আমার কাঁধে মাথা রাখল। ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। আমি সরে বসতে গেলাম। বউদি বলল, “জানিস, আমরা প্রত্যেকে কত কিছুই না চাই। সব পাই না কেন বল তো?”

আমি চুপ। বাঁশ পাতার মতো তিরতির করে কাঁপছি। বউদি বলল, “এই যেমন ধর, তোর একটা চাকরি চাই। মাসিমার একটা ভাল বউমা চাই। তোর পুলকদার আরও টাকা চাই। আর আমার…?”

আমি কথা বলতে পারছি না। ভিতরে-ভিতরে কাঁপছি। খুব শীত পাচ্ছে আমার। বউদি টের পেল বলে মনে হল। বলল, “কই, তুই তো জিজ্ঞেস করলি না, আমি কী চাই?” আমার কাঁধ থেকে মাথা তুলল না বউদি।

আমি বললাম, “তুমি? তুমি হাতি চাও, রাজহাঁস চাও, হরিণ চাও, রামধনু চাও। আরও কত বলল?”

অপরাবউদি মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই যে দূরের উজ্জ্বল তারাটা দেখছিস, আমার জন্যে ওটা পেড়ে দিতে পারবি?”

আমি হেসে বললাম, “ও তুমি পুলকদাকে বোলো, পুলকদা নিশ্চয়ই পেড়ে দিতে পারবে!”

হঠাৎ আমাকে কিল, চড়, ঘুসি মারতে-মারতে বউদি বলল, “তোর পুলকদাকে সামান্য একটা জিনিস চেয়েছিলাম রে। ছোট্ট, এইটুকুনি একটা জিনিস। সেটাই দিতে পারেনি, আর আকাশের তারা! পারবেও না, কোনও দিন না!”

বউদি আমার শরীরে জিজ্ঞাসাচিহ্ন হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। পাকে-পাকে সাপিনি যেমন করে জড়ায়, অমন সে আহ্বান!

আমার খুব ভয় করছে। আমি মরে যাব মনে হচ্ছে। আমি বললাম, “এবার যাই বউদি? আমি বাড়ি ফিরতে দেরি করলে মা যে ভাববেন বউদি? মা একা থাকলে আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা করেন যে। মা’র তো আর কেউ নেই আমি ছাড়া!”

হঠাৎ বউদি হাউহাউ করে কেঁদে উঠল আমাকে জড়িয়ে ধরে, “আমারও যে কেউ নেই রে! যে আমাকে জড়িয়ে থাকবে পলে পলে, তার হৃৎস্পন্দন টের পাব আমার বুকে হাত রেখে। আমার স্নায়ুতে সে খেলা করবে অনন্তকাল, অন্তহীন সেই খেলা। সে থামতে জানবে না। সে বাতাসের মতো বইবে, নদীর মতো কলকল করে ছুটবে, সে এক মূর্ছনা, তাকে বাজাতে হবে না, সে শুধু বেজে-বেজে যাবে। সে হবে একদম তার নিজের মতো।”

আমি নিশ্চল পাথরের মতো বসে আছি অপরাবউদির পাশে। আমার শরীর ছুঁয়ে আছে বউদির শরীর। আমি বউদির বুকের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। এত কম্পিত, এত স্পষ্ট, এত ছন্দোময়। আমি আঁতিপাতি করে বউদির শরীরের শিউলি ফুলের সেই গন্ধটা খুঁজছি কখন থেকে। যে গন্ধ অপরাবউদি ছাড়া আর কারও শরীরে ভগবান রোপণ করেননি। যে গন্ধ পৃথিবীর এক-আধজন মানুষ পায়। সে পায় অনেক জন্মান্তরের পুণ্য ফলে। বিড়বিড় করে অস্পষ্টে বললাম, “তুমি এক পুণ্যবতী মেয়ে। তোমার আদি আছে, অন্ত নেই। তোমার উৎস আছে, মোহনা নেই। তোমার অঙ্কুর আছে, শাখাপ্রশাখা নেই। তোমার সুর আছে, সংগীত নেই।”

“তুই এ কী বললি অর্ক? এ যে মন্ত্রের মতো শোনাল। বল, জোরে-জোরে আর একবার বল অর্ক। এই রাত্রে আর কেউ নেই পৃথিবীতে। শুধু দু’জন মানুষ। আর একজন উন্মুখ হয়ে উঠছে! আর একবার বল!”

বউদি হাউমাউ করে নিজেকে খানখান করে ফেলছে। ছিঁড়ে কুটিকুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে। বউদি কাঁদতে-কাঁদতে বলল, “আমি ভিক্ষুক, আমি কাঙাল! আমি তোকে যার কথা শোনালাম, সে আমার মধ্যেই মিশে আছে। আমার রক্তে, আমার নিশ্বাসে, আমার নিদ্রায়, আমার স্বপ্নে। তোর পুলকদা পারেনি। তুই…তুই…তুই…?”

আমি আর পাথর নেই। এই মন্দাকিনী জ্যোৎস্নায় আমার মধ্যে হাড় রচিত হতে শুরু করল। হাড়ের সঙ্গে মজ্জা ঘন হয়ে উঠল ধানের ক্ষীরের মতো। ধমনী, শিরা-উপশিরা প্রবাহিত হতে শুরু করল অন্তঃসলিলা নদীর মতো। তারপর আমার মধ্যে মাংসের গরিমা মাথা তুলে গিরিশিখর হয়ে উঠল। কেউ আলোকের উৎস থেকে আমার দিকে ছুড়ে মারল আগ্নেয়গিরির রোমাঞ্চ। একটু দূরে এসে থমকে দাঁড়াল প্রথমরিপু। কেউ অমোঘ ভঙ্গিতে আমার দিকে পাঠাল অভিশাপের মতো রমণক্ষমতা। এবার আমি পালাব। আমাকে পালাতেই হবে। আমি বউদির হাত ছাড়াতে চাইছি গায়ের জোরে। পারছি না। সমুদ্রমন্থনের মতো বাঁধনে আটকে যাচ্ছি, বউদির লম্বা পেলব সুন্দরী হাত দুটো আমাকে কালনাগিনীর মতো পেঁচিয়ে ধরছে।

বউদি আমার হাত দুটো নিয়ে তার বুকের উপর রাখল। বলল, “তুই হাত দিয়ে দ্যাখ অর্ক, সে কত অনন্তকাল ধরে আমার মধ্যে ছটফট করছে! কী রে টের পাচ্ছিস?”

এই নিবিড় অন্ধকারে আমি বউদির অতল দুগ্ধসরোবরে শ্বেতকমলকে পাপড়ি মেলতে দেখলাম। লক্ষ-কোটি উল্কা খসে পড়তে শুরু করল অপরাবউদির ছাদে, আমার কপালে, চোখে-মুখে। তার সে কী উত্তাপ, চোখ ধাঁধানো সে কী বিদ্যুৎ! সে কী শীৎকার তার! অপরাবউদির অধরোষ্ঠে আমি দাউদাউ করে পুড়ছি। আমি কখন আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার অতলে প্রবেশ করছি বুঝতে পারিনি।

যখন চোখ মেললাম, দেখি, বউদি মিহি সুরে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যেমন করে পৃথিবীতে প্রথম নিনাদ সৃষ্টি হয়েছিল, অমন করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছেন দু’জন দেবতা। একজন প্রলয়, আর-একজন সৃষ্টি! পৃথিবীর সমস্ত শিউলি ফুলের গন্ধ আজ অপরাবউদিতে মিশে গেছে। এতক্ষণ তারই গন্ধ পাচ্ছিলাম! আমি বউদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বললাম, “বউদি, দ্যাখো, পৃথিবীর সমস্ত ভূকম্পন থেমে গেছে। ওঠো, অমন করে কাঁদতে নেই! কান পেতে শোনো, দূরে কোনও বাঁশিয়াল বাঁশরি বাজাচ্ছে মায়াময় সুরে। বউদি, তুমি আদি আর অন্ত, তুমি উৎস আর মোহনা, তুমি অঙ্কুর আর শাখাপ্রশাখা, তুমি সুর আর সংগীত!”

বউদির পিছন-পিছন ছাদ থেকে নীচে নেমে এলাম। কোনও কথা বললাম না আমরা কেউ। আমি বাড়ি ফিরে এলাম। ভীষণ শীত করছে আমার।

মা জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে, এত দেরি হল?”

আমি মায়ের কথার কোনও উত্তর দিলাম না। বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলাম। বেরোতেই মা বললেন, “অতক্ষণ ধরে চান করলি? ঠান্ডা লেগে যাবে যে?”

আমি জানি মায়েরা সব বুঝতে পারে। তা না হলে আর মা কিসে? যে মা হতে চায়, সেও! সেও সব জানে। অপরাবউদিও টের পায় একজনের পৃথিবীতে আসার আকুলিবিকুলি। অপরাবউদিও সব বুঝতে পারে।

আমি মাকে বলতে পারলাম না, ‘মা, আমি কোনও দিন পাপ শিখিনি, কোনও দিন পুণ্যও শিখিনি। তোমার হতভাগ্য ছেলে আজ পাপ না পুণ্য, কী করে এল, সে বুঝতে পারছে না। মা, যদি সে পাপ হয়, সেই সব পাপ ধুয়ে ফেলল তেমার ছেলে! তাকে ক্ষমা করে দিও! আর যদি সে পুণ্য হয়, তাও।’ মাকে বললাম, “মা, আজ আর কিচ্ছু খাব না। তুমি খেয়ে নাও!”

মা আমার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন। কেমন যেন অসহায় সে দৃষ্টি। মনে-মনে বললাম, ‘মা, আমি কি পাপ করেছি, নাকি পুণ্য, তুমি বুঝতে পারোনি? জানো তো মা, বায়রন বলেছেন, ‘প্লিজার ইজ সিন, অ্যান্ড সামটাইমস সিন’স প্লিজার।’ তোমার বায়রন বুঝে কাজ কী মা? তুমি যে মা, তোমার ওসব না বুঝলেও চলবে।’

পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে মাকে বললাম, “মা, আলোটা নিভিয়ে দাও না!”

এই মুহূর্তে অন্ধকার আমার খুব ভাল লাগছে। অন্ধকারের এত রূপ এর আগে তো কখনও বুঝতে পারিনি।

খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। চারদিক থেকে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। ওই ফুলের গন্ধই কি আজ আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে? নাকি সারারাত আমি ঘুমোইনি? আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কণাদকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। বললাম, “তোর সাইকেলটা দিবি কণাদ? আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব!”

কণাদ ঘুম থেকে উঠে সাইকেলের চাবিটা দিয়ে বলল, “ওটা তো তোমারই সাইকেল অর্কদা! থাকে শুধু আমার কাছে। বলতে পারো, আমি সাইকেলটার দেখভাল করি।”

কার জিনিস যে কার কাছে গচ্ছিত থাকে? যে গচ্ছিত রাখে, কৃতিত্ব তার, যার জিনিস, তার নয়। দেখভাল করাটাও বড় কঠিন কাজ রে! কণাদকে এসব কিছুই বললাম না। সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিয়ে পকেটে খুঁজলাম, মোবাইলটা নিয়েছি তো? প্যান্টের বাঁ দিকের পকেটে আছে, হাত দিয়ে দেখে নিলাম। সানাইয়ের ধারে গেলাম। আজ সানাইকে ‘বসুধারা’ বলে ডকতে ইচ্ছে করছে। বসুধারার জলে তখন ছোট-ছোট ঢেউয়ের মাথায় সকালের রোদ খেলা করছে। পাখিদের কখন ঘুম ভেঙে গেছে। তাদের ঠোঁটে কুটো জোগাড়ের চঞ্চলতা। আকাশনিমের গাছ দুটো আজ চুপ। ওরাও কি জানে আজ কোন সত্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবী? প্রলয় না সৃষ্টির?

পকেট থেকে লাল টুকটুকে মোবাইলটা বের করলাম। সৃষ্টির রঙের মতো দেখতে! কী সুন্দর রং! হঠাৎ মেসেজ বস্কে টাইপ করতে লাগলাম: ‘কে জিতল, প্রলয় না সৃষ্টি? জানি না! কাল তোমাকে ফেরাতে পারিনি বউদি, ক্ষমা করতে হলে ক্ষমাই কোরো!’ লিখেই সেন্ট করলাম অপরাবউদির নম্বরে। তারপর মেসেজ ডেলিভার্ড দেখানোর পরই গায়ে যত জোর আছে সব এক জায়গায় জড়ো করে বসুধারার জলে ছুড়ে দিলাম বউদির দেওয়া মোবাইলটা। বসুধারা, এ মেসেজটা তোমার কাছেও গচ্ছিত রেখো। দরকার হলে যেদিন পৃথিবী জানতে চাইবে, সেদিন মেসেজটা খুলে সকলকে দেখিও যেন!




আজ তিনদিন হল অপরাবউদির বাড়ি যাইনি। সকলেই আমাকে খুঁজেছে। এ খবর শুনলাম অনিকেতের কাছ থেকে। শীতাংশুদা বলেছেন, “অর্ক কোথায় আছে চল তো গিয়ে ধরে আনি।”

অনীক বলেছে, “ওকে সানাইয়ের পার ছাড়া আর কোত্থাও পাবেন না। সানাই ওর প্রেমিকা যে!”

দেবাঙ্কুর কী কারণে নাকি এই তিনদিন যায়নি। শুভ্রকান্ত শরীর খারাপ নিয়ে বাড়িতে। অভ্রনীল স্কুল ছুটির পর বাড়ি ঘুরে চলে আসে অপরাবউদির বাড়ি। ওরা সকলেই বলেছে, “আমাদের আড্ডা অর্ক না হলে জমে না। চল ওকে কাল ধরে আনি?”

বউদি ওদের কথা শুনে বলেছে, “ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না, ওকে দাও ছেড়ে! তোরা জানিস, আমি ওকে ফোনেও পাচ্ছি না। তবে অর্ক যদি আমার বাড়ি আসতে না চায়, তোরা ওকে জোর করিস না।”

কথাটা শুনে আমার বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠেছিল। সেদিন সানাইয়ের কাছে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত বসে ছিলাম। কেন এমন হল? কেন? কেন? একটা আলো হুট করে আকাশ থেকে খসে পড়ল সানাইয়ের জলে। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম। তারপর তাকিয়ে দেখি, সানাই যে কে সেই। আমার মধ্যে সাহস এল। আর কাউকে না হোক, সানাইকে কথাটা বলি। আমি চোখে জল নিয়ে সানাইকে বললাম, “আচ্ছা বল তো সানাই, প্রলয় বড়, না সৃষ্টি বড়? আমি জানি তুই বলবি সৃষ্টি! কিন্তু এই সৃষ্টি যদি প্রলয়কে ঘিরে থাকে অনাদিকাল ধরে, তবে প্রলয় বাঁচে। আর না হলে তুই বল তো সানাই, প্রলয় কী নিয়ে বাঁচবে? তার তো কিছুই থাকল না। সে একা, তার সঙ্গে থাকল গ্লানি, ঘৃণা, আত্মক্ষয়! এ নিয়ে একজন মানুষের বেঁচে কী লাভ?”

“যে প্রলয়, তার উচিত সৃষ্টিকে ঘিরে রাখা। না হলে সৃষ্টি থাকবে কেমন করে?” কথাটা কে বলল? আমি চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, না কেউ তো নেই! আমি উঠে পড়লাম। বাড়ি ফিরব। আমি আর কোনও দিন অপরাবউদির বাড়ি যাব না। যেতে পারব না। মাকে গিয়ে কী বলব? মা যে আমার কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করেন। মাকে কত মিথ্যে আর বলব? মনে-মনে মাকে বললাম, “মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও! আমি তো

তোমার ছেলে। তুমি একদিন আমাকে বলেছিলে না, ‘তোর দোষটা আমার কাছে কোনও দোষই নয়। ক্ষমা না শিখলে মা হওয়া যায় না রে!’ এবার আমি দেখব মা, তুমি কত বড় ক্ষমাময়ী! একদিন তোমাকে সব বলব। আমার সব শুনে পারবে তো ক্ষমা করতে?”

এখন ফোনে আমাকে কেউ পাচ্ছে না। অনীক, দেবাঙ্কুর, অভ্রনীল, অনিকেত, শুভ্রকান্ত, এমনকী কিংশুকদাও। অপরাবউদি হয়তো আজও ফোনের বোতাম টিপে গেছে সারা বিকেল। বউদির অমন গোলাপকুঁড়ির মতো আঙুল ব্যথা হয়ে উঠেছে।

কাল একবার মা বলেছিলেন, “পিলু, তোর মোবাইলটা দেখছি না তো? কোথায়?”

আমি মাকে মিথ্যে বলেছি, “বাজারের পথে কখন যে পকেট থেকে পড়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি মা।”

“অপরা অত আনন্দ করে মোবাইলটা তোকে দিল, সেটা হারিয়ে ফেললি? তুই কী রে, হাঁদা ছেলে?”

মনে-মনে বললাম, ‘আমি যে কী, সে কি আমি জানি মা?’ মুখে বললাম, “দিলে কী হবে, মন থেকে দেয়নি।”

মা বললেন, “ও কী কথা? মানুষ যখন দেয়, সে মন থেকেই দেয়। এখন হারিয়ে ফেলে হাজার কথা!”

না, মার কথা ঠিক নয়। অনেক সময় মানুষ যা দেয়, সব তার নিজের মন থেকে দেয় না। তার অনিচ্ছায় দেয়। অনেক সময় যাকে দেয়, তার ইচ্ছেতেই সে দেয়। তখন তার নিজের কোনও ইচ্ছে থাকে না। আমার তো মোবাইলের কোনও ইচ্ছেই ছিল না। যে দিয়েছে, সে তার ইচ্ছেতেই দিয়েছে। আমার কী দোষ মা?

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখা মা বললেন, “এখন তো দেখছি, তুই ক’দিন ধরে অপরার বাড়ি যাচ্ছিস না? মোবাইল হারিয়েছিস, তাই ধরা পড়ে যাবি বলে?”

আমি নিজেকে চর্যাপদ করে বললাম, “ধরা কেউ না দিলে কি সে ধরা পড়ে মা? তাকে ধরে কার সাধ্যি?”

“মোবাইল হারিয়েছিস, অপরা শুনে কী বলল শুনি?”

মাকে আর কত মিথ্যে বলব? মাকে মিথ্যে বলতে-বলতে মুখ ব্যথা করছে। জিভ ওলটাতে পারছি না। কোনও ছেলে তার মাকে এত মিথ্যে বলতে পারে নাকি? প্রসঙ্গ পালটালাম। মাকে বললাম, “জানো মা, আজ রাতে আকাশে আলোর দেশের পরিরা নামবে। দেখো তুমি, আমাদের বারান্দায়ও আসবে একবার।”

মা বললেন, “কেন? কেন আসবে শুনি? পরিদের কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই নাকি?”

আমি মজা করে মাকে বললাম, “তোমাকে দেখতে আসবে। এমন ক্ষমাময়ী মা ওরা জীবনে কখনও দেখেনি কিনা, তাই!”

অপরাবউদির বাড়ির সেই আড্ডা এখন ফ্যাকাসে। আমার যে ওখানে একদিন না গেলে পেটের ভাত হজম হত না, সে আমিও আর যাই না। মাধবীলতার গাছটা নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজেছে। আমি অপরাবউদিকে যে বলেছিলাম, একটা শিউলি ফুলের চারা কিনে এনে লাগাব। সেও তো আর লাগানো হল না। তবে আড্ডার লোক কমছে। বউদি নাকি এখন আর অমন হইচই করে না। এ কথা অনিকেত বলেছে।

অপরাবউদির বাড়ির আড্ডার রং পালটে গেল, আমি আর ওই আড্ডায় যাইনি বলে নয়। কয়েকদিন পরে একদিন সন্ধেবেলা আমাদের ক্লাবে এসে হাজির আমাদের পাড়ার বয়স্ক কয়েকজন মানুষ। আমি ছিলাম। অনীক, দেবাঙ্কুর, শুভ্রকান্ত, অভ্রনীল, অনিকেত, আরও পাড়ার কয়েকজন ছেলে তখন ক্লাবে আড্ডায় আর ক্যারমে ব্যস্ত। কেউ-কেউ টিভিতে। ওঁদের দেখে আমরা ঘাবড়ে গেলাম। ওঁরা তো কখনও ক্লাবে ঢোকেন না?

ওঁদের বসতে দেওয়ার জন্যে প্রথমে আমি উঠে দাঁড়ালাম। পরিমলদাদু থাকেন আমার পাশের বাড়িতেই। বাবাকে উনি নাম ধরে আর ‘তুই’ করে কথা বলতেন। গম্ভীর মানুষ। ওঁকে বললাম, “দাদু, বসুন!”

পরিমলদাদু মুখে ব্যঙ্গ ফুটিয়ে না বসেই বললেন, “আর ভাই, অমন সম্মান দেখিয়ে কী হবে? পাড়ার মান-সম্মান তো ধুলোয় লুটোচ্ছে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন দাদু, কী হয়েছে?”

“তোমরা কী করে বেড়াচ্ছ, সে তোমরা ভালই জানো। নতুন করে বললে তোমাদের শুনতে কি ভাল লাগবে?”

মনে-মনে বললাম, ‘আমরা? কী? কী করেছি আমরা?’ চুপ করে থাকলাম। ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিখিলকাকু। ওঁর ছেলে সুজয় আমাদের সঙ্গে মেশে না বটে, কিন্তু দারুণ ক্রিকেট খেলে। অন্য পাড়া থেকে খেলার ডাকও পায়। আমি নিখিলকাকুর বাড়ি কখনও যে যাই না, তা নয়। নিখিলকাকু বললেন, “তোমরা বাবা এমন কাণ্ড করছ, পাড়ায় হাজার কানাকানি হচ্ছে। লোকে আজেবাজে কথার ইঙ্গিতও করছে। এগুলো কি ভাল?”

আমরা কেউই ধরতে পারছি না এঁরা কী বলছেন। অরুণজেঠুর বাড়ি অপরাবউদির একদম পাশে। উনি বললেন, “তা হলে খুলেই বলি, আমার পাশের বাড়িতে যে মহিলা থাকেন, ওঁর সঙ্গে তোমাদের কীসের সম্পর্ক? উনি একা থাকেন। স্বামী বাইরে। তোমরা রোজ অনেক রাত পর্যন্ত ওঁর বাড়িতে থাকো কেন? লোকে তো নানা কথা বলছে।”

আমরা নিশ্চুপ। অপরাবউদি? আমাদের আড্ডা নিয়ে লোকে নানা কথা বলছে? কিন্তু কেন? ফের অরুণজেঠু বললেন, “আজকালকার ছেলেরা একটু ওসব খায়টায়। তা বলে ওই মহিলাও?”

আর একজন পিছন থেকে ফোড়ন কাটলেন। কথা বলতে গেলে তাঁর আটকে যায়। তাঁকে আমি ঠিক চিনি না। বললেন, “শে-শে-শে-ষে আমাদের পাড়ায় ম-ম-মধুচক্র? খ-খ-খবরের কা-কা-কাগজের ভা-ভাষায় আ-আ-আরকি!”

ওঁর কথায় আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। অনীকের চোখ জ্বলছে ভাঁটার মতো। দেবাঙ্কুর বলল, “আপনারা যেসব কথা বললেন, এর কিছুই ঠিক নয় কাকু। আপনারা যে সব নোংরা ইঙ্গিতে কথা বলছেন, আমাদের আড্ডার মধ্যে সেরকম কোনও ব্যাপার থাকে না। আমরা কেউ ড্রিঙ্ক করি না। আমাদের বাড়িতেও জানে। আর যে ভদ্রমহিলার কথা বলছেন, তিনি অত্যন্ত ভদ্র এবং ভালমানুষ। আমার মনে হয়, ওই কথাগুলো বলার আগে আপনাদের উচিত ভাল করে যাচাই করে নেওয়া। যা কিছু বললেই তো হয় না?”

দেবাঙ্কুরের কথায় হঠাৎ খেপে গেলেন পরিমলদাদু, “তোমরা বলছটা কী? ওখানে রাতের দিকে কিছু হয় না? সব ধোওয়া তুলসী পাতা? ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটাকে রোজদিন মদের বোতল ফেলতে হয়। তার সঙ্গে হাজার রকমের খাওয়ার প্যাকেট। সব বলেছে আশেপাশে।এত সব আসে কোত্থেকে শুনি?”

আমি বললাম, “না দাদু, আপনি ভুল শুনেছেন। প্রথমত, অপরাবউদির বাড়িতে কোনও কাজের মেয়ে থাকে না। উনি সব নিজের হাতেই করেন। মদের বোতল তা হলে অন্য কারও বাড়ির কাজের মেয়ে ফেলে। আপনি সে খবরই শুনেছেন। আর…।”

“আর কী? তোমার বাবা কখনও আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে কথা বলত না। তুমি তার ছেলে হয়ে মুখে-মুকে তর্ক করছ?”

আমি খুব জেদের গলায় শান্তভাবে বললাম, “না দাদু, আমি তো কোনও তর্ক করিনি? আপনি যে মিথ্যে অভিযোগগুলো করছেন, আমি শুধু তা যে ভুল, সে কথাই আপনাকে জানিয়েছি। মাথা তুলে না বলার মতো কথা তো নয়?”

উনি প্রায় অট্টহাস্যে বললেন, “বাঃ বাঃ, কত কথাই না শিখেছ? তোমাদের এই সব কীর্তির কথা শুনে পাড়ার লোকে দুচ্ছাই করছে। এমন হলে তো পাড়ায় থাকা দুষ্কর হয়ে যাবে?”

সেই কথা আটকে যাওয়া লোকটা ফের কুৎসিতভাবে বললেন, “দুষ্কর বলে দুষ্কর! ওই মহিলার কথা অন্য পাড়ার লোকও বলছে।” তারপর খি খি করে বেশ কিছুটা হেসে নিয়ে বললেন, “এবার টিকিট কাটার ব্যবস্থা করতে হবে গো অরুণ! এর পর তো ওই মহিলার বাড়িতে লাইন পড়ে যাবে হে?”

আমার মাথার আর ঠিক নেই। আমি তেড়ে গেলাম ওই লোকটার দিকে। অনীক আমকে ধরে না ফেললে…। অনীক বলল, “আমরা ওই বাড়ির ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আড্ডা দেব, গল্প করব, হইচই করব। আপনাদের কিছু করার থাকলে করুন, যান।”

অমলেশ সান্যাল বলে যে লোকটি পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন, উনি এগিয়ে এলেন। বললেন, “এই যে ছেলে, খুব যে বড়-বড় কথা ছোটাচ্ছ? জানো, কী করতে পারি তোমাদের গোটা দলটাকে? তুলে ফেলে দিয়ে আসতে পারি সানাইয়ের জলে? চলো হে, কাল পার্টি অফিসে জানাতে হবে। না, এসব আমাদের পাড়ায় কিছুতেই চলবে না।”

এসব বলে ওঁরা নানা আজেবাজে মন্তব্য করতে করতে চলে গেলেন। ক্লাবের অন্য ছেলেদের সামনে আজ আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেল। অনীক বলল, “এর বদলা নিতে হবে। শীতাংশুদাকে বলতে হবে। বউদি যদি এসব কথা শোনে, কী ভাববে বল তো?”

অনিকেত বলল, “কাদের কী ভাববে? এই লোকগুলো তো লোকের নিন্দে করে বেড়ায়। এদের কথা ছাড় তো।

বউদি আমাদের এত কাছের মানুষ ভাবে, ওদের কথায় কার কী এল-গেল বল? ”

আমরা ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলাম। ক’টা বাজল? রাত আটটা হবে বোধ হয়। আমরা রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। অনীক বলল, “চল, বউদিকে কথাটা এখনই জানানো দরকার।”

দেবাঙ্কুর বলল, “না, এক্ষুনি কিছু বলার দরকার নেই। দেখা যাক না, কী হয়। তারপর…।”

অনীক বলল, “কাল সকলেই অপরাবউদির বাড়িতে যাব। অর্ক, তুইও যাবি। তুই ক’দিন দেখছি গা বাঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। তুই কি আগে এ ব্যাপারে কিছু শুনেছিলি নাকি?”

আমি মনে-মনে ভাবছিলাম, মায়ের কথাটা ওদের বলব কিনা। তারপর আমি বললাম, “দ্যাখ, মা একদিন আমাকে বলছিলেন, অপরাবউদিকে নিয়ে আমাদের সম্পর্কে লোকে নাকি নানা কথা বলছে। এখন দেখছি কথাটা ঠিক। কিন্তু কী আশ্চর্য! মনে হয়, মা যখন শুনেছেন, তখন কথাটা যেভাবেই হোক আমাদের পাড়ায় রটেছে। এখন দেখছি এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।”

অনীক বলল, “কাল সকলে আয়। শীতাংশুদাকেও খবর দিচ্ছি। বউদির ওখানে গিয়ে কথা হবে।”

সকলে যে-যার বাড়ি ফিরে গেলাম। মা আমার মুখ দেখে ঠিক বুঝতে পারলেন। বললেন, “হ্যাঁ রে পিলু, কী হয়েছে রে? তোর মুখখানা অমন থমথম করছে কেন রে?”

আমি মাকে আজকের সব কথা বললাম। মা শুনলেন সব। কোনও উত্তর দিলেন না। শুধু বললেন, “আয়, খাবি আয়, রাত হয়েছে।”

দু’জনে কোনও কথা না বলে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ মা বললেন, “তোকে তো কথাটা আমি আগেই বলেছিলাম। আমার কানেও এসেছে। আসলে কী জানিস, অপরা অমন সুন্দরী মেয়ে, বাড়িতে একা থাকে, স্বামী থাকে বিদেশে। তোরা তাকে ঘিরে থাকিস। পাড়ায় অনেক রকমের লোক থাকে তো! তারা নানা সুযোগ খোঁজে। না পেলেই বদনাম রটায়। আমি জানি অপরা ভাল মেয়ে।”

“তোমার জানাটাই তো শেষ কথা নয় মা। ওরা আমাদের শাসিয়ে গেছে, পার্টি অফিসে যাবে। ছিঃ ছিঃ! কিন্তু মা, আমাদের এই আড্ডা কি সেই আড্ডা?”

“ওসব রাখ। তোদের সংযত হতে হবে। না হলে মেয়েটা এখানে একা থাকতেই পারবে না।”

আমি ভাত খেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। রাত হয়েছে। অনেক বাড়ির আলো নিভে গেছে। আমিও ঘরের আলো নিভিয়ে চুপ করে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যায়, বেশ কিছুটা দূরে একটা রাধাচূড়ার গাছ আছে। মস্ত ঝাঁকড়া গাছটা! তার ডালে একজোড়া প্যাঁচা বাসা বেঁধেছে বেশ কিছুদিন। তাদের বোধ হয় একটা বাচ্চাও হয়েছে। ওই সৃষ্টি আর কী! কিন্তু বাচ্চাটা সারা রাত কাঁদে। রাত বেশি হলে আমাদের বারান্দা থেকে শোনা যায়। এই তো শুরু হল প্যাঁচার বাচ্চাটার কান্না। আমারও একটা কান্না দলা পাকিয়ে উঠে আসছে গলার কাছে। কেন, আমার কান্না আসছে কেন? প্যাঁচা কি মানুষকেও কাঁদায়? তারপর কী যে মনে হল, আমি ভাবলাম, আজ সারারাত আমি কাঁদব। তা হলে কি অপরাবউদি, তুমি ক্ষমা করবে আমাকে? কার যেন একটা কবিতায় পড়েছিলাম, ‘তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই ক্ষমা নেই, অথছ ক্ষমাই আছে, হৃদয়ে আমার কোনও পাপ জমা নেই!’ কবিতাটা ঠিকঠাক মনে পড়ল না হয়তো। কিন্তু এমন সময়ের সঙ্গে বেশ মানায়।

পরের দিন সন্ধেবেলা অপরাবউদির বাড়িতে সকলে হাজির হলাম। অনীক, কিংশুকদা, অনিকেত, দেবাঙ্কুর, অভ্রনীল আর শুভ্রকান্ত। আমি বসেছি সোফায়, বউদির একদম উলটো দিকে। মুখ তুলে বউদির দিকে তাকাতে পারছি না। আমার মাথাটা যেন পাথরের মতো ভারী! আমার চোখের পাতা কাল সারারাত জল ঝরিয়েছে বলে কি এত ব্যথা? পায়ের তলায় পিচপিচ করছে ঘাম। আমি মেঝেতে পা ঘসলাম। পায়ের জলছাপ পড়ল মেঝেতে।

অনীক প্রথম মুখ তুলল বউদির দিকে, “একটা কথা ছিল বউদি। আগে বলো, তুমি কিছু মনে করবে না?”

বউদির সরস মজা আজ অনেক ধীর। অপলকে একবার আমার দিকে তাকাল বউদি। বুঝতে পারছে না অনীক আজ কী কথা শোনাবে। বউদি বলল, “বেশ ক’ বছর আগের সেই রবীন্দ্রজয়ন্তী আবার হবে নাকি? বাঃ, হলে তো বেশ হয় রে! এবার কিন্তু আমি গান গাইব, রবীন্দ্রনাথের গান!”

অনীক বলল, “না, তা নয় বউদি। কথাটা বরং আপনিই বলুন না কিংশুকদা।” অনীক মুখ তুলে কিংশুকদাকে বলল, “ আপনিই বলুন!”

বউদি বলল, “অত ভনিতা কেন রে? তা হলে তুমিই বলো!” বউদি কিংশুকদাকে বলতে বলল।

কিংশুকদা একটু চুপ করে থেকে বলল, “আসলে অপরা, তোমার বাড়িতে আমরা যে দলবেঁধে আড্ডা দিতে আসি, এটা অনেকের পছন্দ নয়। তারা বলছে, আমাদের আড্ডায় নাকি এমন অনেক কিছু হয়, যা নাকি এ পাড়ার পক্ষে মর্যাদা হানিকর।”

কথাটা শুনে বউদির চোখের পাতা ছোট হয়ে এল। কপালে কুঞ্চিত রেখা ভেসে উঠল। কেমন ভ্যাবলা হয়ে গেল বউদি। বাক্যহারা। একবার আমার দিকেও তাকাল। আমি মুখ নিচু করে আছি কেন, বউদি বুঝতে পারছে না। বউদি জানতে চায় আমি এত চুপ কেন? বলল, “কে কী বলেছে কিংশুক? তোমরা খুলে বলো না শুনি?”

অনীক বলল, “না, মানে, আমরা আর তোমার বাড়ি আসব না বউদি। ওরা তোমার নিন্দে করবে? আমাদের জড়াবে? এ আমরা সহ্য করতে পারব না বউদি। তোমার গায়ে ওরা কাদা ছিটোবে, তার আগে আমরা এর একটা বদলা তো নেবই।”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রে অর্ক? তুই কিছু জানিস, বল না খুলে? কে কী বলছে?”

দেবাঙ্কুর পরিমলদাদুদের অভিযোগের কথা সব বলল। আমরা তখন নিশ্চুপ। প্রত্যেকের শ্বাস পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বউদি ওর মুখ থেকে ওই সব কথা শোনার পর দু’ হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢাকল। তারপর নিচু হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। আমি একবার অপরাবউদির দিকে তাকালাম। দেখলাম, বউদি কাঁপছে। একটু পরে স্থির হয়ে গেল বউদি। কোনও শিল্পীর আঁকা পেন্টিং যেন আমাদের সামনে।

চোখে জল নিয়ে বউদি উঠে দাঁড়াল। বলল, “তোরা আজ সকলে চলে যা। আর কখনও আসিস না আমার বাড়ি। এর পর আমার কাছে আসতে পারবি না তোরা। আমিও আর তোদের ডাকব না।”

শুভ্রকান্ত কিছু বলবে বলে হাঁ করতে বউদি বলল, “না রে শুভ্র, সেই যে একটা কথা আছে না, ‘লোকে যারে বড় বলে, বড় সেই হয়।’ এও তেমনি! লোকে আমার সম্পর্কে যা বলছে তাই তো ঠিক রে!”

আমরা সকলে দিশেহারা। অনীক বলল, “বউদি, আমরা ওঁদের কাল আমাদের ক্লাবে ডেকে আনব। তোমাকেও যেতে হবে বউদি। ওঁদের সব অভিযোগ মিথ্যে, এ আমরা প্রমাণ করবই। তুমি না কোরো না বউদি!”

বউদি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “রামায়ণের সীতা বোকা ছিলেন। তাই রামচন্দ্রের কথা রাখতে পাতালে যেতেও দ্বিধা করেননি। কিন্তু আমি অমন বোকা নই রে। নিজেকে প্রমাণ করতে আমি পাতালে যাব না! আমি নিজেকে বিশ্বাস করি! নিজের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ!”

বউদির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। আমি বউদিকে বলতে চাইলাম, “আমিও নিজেকে বিশ্বাস করি বউদি, ঠিক তোমার মতো! বিশ্বাস করো!” বলতে পারলাম না।

বউদি চোখের জল মুছে বলল, “তোরা আজ বাড়ি চলে যা। আজ তোদের কিচ্ছু খাওয়াতে পারলাম না রে! তোরা এক-একজন চাঁদের মতো পবিত্র, আকাশের মতো নির্মল, ভোরের মতো সত্যি, পাখির গানের মতো সুন্দর! তোরা আর আমার কাছে আসিস না। আমি জানব, আমার জীবনে তোরা এক ঝলক রোদ্দুর! এটাই সত্যি। ওঁরা যা বলেছেন, তোরা জানিস আর আমিও জানি, সব মিথ্যে, সব। চল, আমরা এবার নতুন করে বাঁচি!”

আমরা বউদির মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না। সকলে চুপ করে বাড়ি চলে আসছি, হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে অনিকেত বলল, “কিংশুকদা, আমরা কাল ওঁদের ডেকে এনে ক্লাবে মিটিং করব। আমি আসব বউদিকে ডেকে নিয়ে যেতে। সবাই মিলে চেপে ধরব, আমাদের নিয়ে এসব কথা রটালেন কেন ওঁরা?”

কিংশুকদা বললেন, “আমি ভাবছি অন্য কথা। এই লোকগুলো কী চায়? ওরা আমাদের নামে…? এর পিছনে কিছু একটা কারণ আছে।”

অনীক বলল, “দরকার হলে আমরা কাউন্সিলারের কাছেও যাব।”

দেবাঙ্কুর ঠান্ডা মাথার মানুষ। বলল, “আগে আমরা একদিন ক্লাবে ওঁদেরকে ডাকি। বলি “আপনাদের যাঁদের যা যা অভিযোগ আছে সব নিয়ে আসুন!”

একটা দিনও ঠিক করে আমরা ওঁদের খবর পাঠালাম। সামনের রোববার বিকেলে। এখনও চারদিন বাকি। এ খবরও শুধু আমাদের মধ্যেই আটকে থাকল না। ছড়িয়ে পড়ল। কেউ-কেউ কিছুই জানে না এমন ভান করে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে অর্ক, ওই বাড়ির মেয়েটাকে নিয়ে তোদের সঙ্গে কী যেন হয়েছে?”

আমি বললাম, “আপনি জানেন কার সঙ্গে কাদের গন্ডগোল। আর কী নিয়ে গন্ডগোল, সেটাই শোনেননি? বেশ মানুষ তো আপনি? দেখে তো অমন সোজাসাপটা বলে মনে হয় না। যান, নিজের কাজে যান!”

কেউ বলল, “হ্যাঁ বাবা, তোমাদের নিয়ে কী যেন সব কথা শুনছি পাড়ায়?”

আমি বললাম, “কাকু, কথা থাকলে তো কথা শুনতে পাবেন। কথা তো আর পৃথিবী থেকে ফুরিয়ে যায়নি। আপনাদের মতো মানুষ যতদিন থাকবেন, ততদিন কথা ফুরোবে না।”

কী বুঝলেন জানি না। মুখটা বাঁকিয়ে চলে গেলেন অন্য দিকে।

দেখতে-দেখতে বোরবার এসে গেল। আমরা আর অপরাবউদির বাড়ি যাইনি। বিকেলবেলা ওদিক দিয়ে যখন যাই, বউদিন গান ভেসে আসে। বউদি ফের গান ধরেছেন। কতদিন কত অনুরোধ করেছি আমরা, “বউদি গান ছাড়লে কেন? কী সুন্দর তোমার গানের গলা!”

বউদি হেসে বলেছে, “তোরাই তো আমার গান। তোদের এক-একজন গানের এক-একটা রাগ-রাগিণী। কেউ চন্দ্রকোষ তো কেউ মালবকৌশিক। কেউ গৌড়সারং তো কেউ ললিতপঞ্চম। আর অর্ক তো জয়জয়ন্তী কানাড়া!”

আমরা এসব অনেক রাগের নামই শুনিনি। এখন বউদি গানে ডুবে যেতে চাইছে। রোজ বিকেলবেলা গানে ভরে ওঠে বউদির বাড়িটা। সেদিন আমি ওদিক দিয়ে সানাইয়ের পারে যাচ্ছিলাম। বউদির বাড়ির কাছে এসে পা উঠতে চাইল না। হ্যাঁ, তক্ষুনি সেই শিউলি ফুলের গন্ধটা ভেসে এল। তখন একটা লতা পায়ে-পায়ে জড়িয়ে আটকে দিল আমাকে। আমি মাধবীলতার গাছটার পাশে সানশেডের নীচে দাঁড়ালাম। শুনলাম অপরাবউদি একমনে গাইছে-‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, /বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।/ এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর/ জীবন ভ’রে।’ মনে-মনে বলতে চাইলাম, ‘কার কৃপা বউদি? কীসের বঞ্চনা? তোমার পাত্র ভরে উঠুক কানায় কানায়।’

সারা সন্ধেটা এই ক’টা লাইন সানাইয়ের পারে ঘুরেফিরে বেড়াল, নদীর স্রোতে ভাসল, আকাশে উড়ল, তন্ময় হয়ে বসে থাকল আকাশনিমের তলায়।

রোববার ক্লাবঘরে ভিড়। প্রতিবাদিরা এসেছেন। অনেক কৌতূহলী মানুষ উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। কাউন্সিলারকেও আসার জন্যে অনুরোধ করে এসেছিল অনীক। তিনি এসে গেছেন। সকলের মাঝখানে দুটো মুখ আমাদের একদম অচেনা। ছিরিছাঁদহীন পোশাকে মাঝবয়সি একটি মেয়ে, আর একটি লোক। তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন এককোণে। বয়স্কদের কথা শুনলেন কাউন্সিলর। আমাদের কথাও শুনলেন। উনি আমাদের উদ্দেশে বললেন, “তোমরা তো যাও গল্পগুজব করতে? ওঁর স্বামী বিদেশে থাকেন? তোমরা এই ক্লাবেই আড্ডা দাও না! উনিও এখানে আসুন। তা হলে আর বড়দের অভিযোগের আঙুল ওঠে না?”

“কিন্তু, যা হোক কিছু একটা বললেই হল? ওঁরা যা বলছেন, এসব তো আষাঢ়ে গল্প? আমরা তা হলে কি আমাদের পছন্দের কারও বাড়িতে যেতে পারব না? এ কেমন আবদার ওঁদের?” আমি বললাম।আমার কথায় সেই যাঁর কথা আটকে যায়, সে লোকটা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। কাউন্সিলার তাঁকে থামিয়ে দিলেন, “আহা, অত চেঁচিয়ে কথা বলছেন কেন? আস্তে কথা বলুন।”

তবুও লোকটি চেঁচিয়ে বলল, “না, আ-আ-আমরা ওই ম-ম-মহিলাকে এ পা-পা-ড়ায় থা-থাকতে দেব না!”

কাউন্সিলার বললেন, “তা কি হয়? তিনি থাকবেন তাঁর বাড়িতে। আপনি এ কি কথা বলছেন? কাউকে এভাবে বলতে পারেন না আপনি?”

অনেক কথা-বিতণ্ডা চলছে। এমন সময় সেই অচেনা মহিলাটি প্রায় কেঁদে উঠে বললেন, “কাউন্সিলারবাবু, ওই দিদি চলে গেলে আমাদের কী হবে? উনি যে আজ চার বছর ধরে আমার ছেলেকে খরচ দিয়ে পড়াচ্ছেন? তা হলে আমার ছেলের তো আর পড়া হবে না? ওর বাবা নেই।”

গোটা ক্লাবঘর নিশ্চুপ, কারও মুখে কথা নেই। কাউন্সিলার হেসে কথা-আটকে যাওয়া লোকটিকে বললেন, “পাড়া থেকে তাড়িয়ে দেবেন বলছিলেন? দিন, এবার ওঁর ছেলের পড়ার টাকার ব্যবস্থা করে দিন!”

তবুও লোকটা বললেন, “ও-ও-ওসব টা-টা-কা লোকের মু-মুখ আটকে রা-রা-রাখার ধান্দা! বু-বু-বুঝি না নাকি?”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলল, “আমার মেয়েকে উনি ক্লাস ফাইভ থেকে পড়ার সব খরচ দিয়েছেন। উনি বলে রেখেছিলেন, আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে উনি সাহায্য করবেন। বিয়ের যেটুকু গয়না সব উনি দেবেন বলেছেন। উনি চলে গেলে আমার মেয়ের বিয়ের কী হবে? আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন স্যার!” বলে হাত জোড় করে কাউন্সিলারের দিকে কাতর ভাবে থাকল।

কাউন্সিলার এবারও ওই লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বলুন, কী বলবেন? আপনারা কি এসব খবর রাখেন? শুদু মনগড়া কিছু কথা বলে বেড়ালেই হবে? আমি যা শুনছি, তাতে তো ভদ্রমহিলা সম্পর্কে আপনাদের অভিযোগ ধোপে টিকছে না?”

আমরা স্তব্ধ। অপরাবউদি কবে যে এসব করেছেন, আমাদের জানতেও দেয়নি? সেই বউদি সম্পর্কে এই লোকগুলো এ কী বলছে? আমাদের সকলের চোখ ছলছল। আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। কাউন্সিলার আমাদের বললেন, “তোমরা বাবা ওই ভদ্রমহিলাকে আজ ডাকলে না কেন? একবার ওঁকে দেখতাম। আমার এলাকায় থাকেন, অথচ, আমি এরকম একজন মানুষের খোঁজই জানি না?”ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল, “উনি তো আমাদের কণাদের পড়ার খরচ আজ ক’ বছর ধরে দিচ্ছেন। কণাদ এই যে অত ভাল রেজাল্ট করল, তার পিছনে তো উনি আছেন!” আমি কাউন্সিলারকে বললাম, “আমরা ওঁকে আজকের মিটিংয়ে আসতে বলেছিলাম। উনি আমাদের বলেছেন, ‘সীতার সতীত্ব প্রমাণ করার জন্যে পাতালপ্রবেশের দরকার ছিল না। রামচন্দ্র ঠিক করেনি! আমিও অমন পরীক্ষা দিতে যাব না!”

এ কথা শুনে কাউন্সিলার ভদ্রলোক ‘বাঃ বাঃ’ করে উঠলেন! বললেন, “উনি তো খুবই শিক্ষিতা মহিলা! খুব দয়ালু, খুবই বুদ্ধিমতী! না না, আপনারা ওঁর সম্পর্কে যা অভিযোগ, সব ঠিক নয়!”

আমি তখন আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রসঙ্গ টানলাম, যদিও বউদি কাউকে বলতে না বলেছিলেন। আমি বললাম, “আমরা একবার এ পাড়ায় বড় করে রবীন্দ্রজয়ন্তী করেছিলাম। আমাদের চাঁদা ওঠেনি তেমন। আমরা বউদির বাড়ি গিয়েছিলাম চাঁদা চাইতে। উনি সেবার আমাদের অনুষ্ঠানের পুরো খরচটাই দিয়েছিলেন। উনি কাউকে বলতে না বলেছিলেন, তাই আমরা বলিইনি কাউকে সে কথা! আজ আপনার সামনে বললাম।”

কাউন্সিলার ভদ্রলোক অপরাবউদির কথা শুনে অভিভূত। বললেন, “না না, অমন মানুষ পাড়ায় আছেন বলে কত মানুষের উপকার হয়! তোমরা বোলো, একদিন ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে যাব।”

উনি চলে গেলেন। যাঁরা অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন, তারা গজগজ করতে-করতে ফিরে গেলেন। আমরা জিতেছি, এ কথাটা অপরাবউদিকে এক্ষুনি জানানো দরকার। আমি যাওয়ার ছটফট করছি। কিংশুকদা বললেন, “চল, কাল সন্ধেবেলা আমরা অপরার বাড়ি যাই? আজ নয়। তোরা সকলে কাল চলে আসিস!”

সোজা বাড়ি চলে গেলাম। গিয়েই মাকে বললাম, “জানো মা, আমাদের জয়ী হয়েছি। বউদির প্রসংশায় কাউন্সিলার নিজেই পঞ্চমুখ। যাঁরা প্রতিবাদ করতে এসেছিলেন, তারা চুপচাপ ফিরে গেছেন।”

মা বললেন, “তা হোক, তোরা এবার মেয়েটাকে স্বস্তিতে থাকতে দে। মাঝেমধ্যে ওর বাড়ি যাস। রোজদিন না যাওয়াই ভাল!”

মার কথাই ঠিক। রোজই কারও আর যাওয়া হচ্ছে না অপরাবউদির বাড়ি। কোনও দিন দেবাঙ্কুর আর অনিকেত যায় তো, কোনও দিন অনীক আর শুভ্রকান্ত। কোনও দিন কিংশুকদা আর আমি যাই তো, কোনও দিন অভ্রনীল একা। আমি কোনও দিন একা যাইনি।

আমি সেদিন অনিকেতের সঙ্গে গিয়ে হাজির অপরাবউদির বাড়িতে। বেশিক্ষণ থাকিনি। এখন বউদি বাজার করে দেওয়ার জন্যে একটা মেয়েকে জোগাড় করেছে। সে-ই বউদির সব করে দিচ্ছে। তবে বউদি আর আগের মতো হাসিখুশি নেই।

তার দিনদুই পর ঘটল এক কাণ্ড। অপরাবউদির বাজার করে দেওয়া মেয়েটি আমার বাড়িতে এসে বলে গেল, “ম্যাডাম আপনাকে কাল সকালবেলা ডেকেছেন।”




দেখতে-দেখতে প্রায় মাস তিনেক কেটে গেছে। সেই পরিমলদাদু, নিকিলকাকু, অরুণজেঠু, উপেনদাদুরা রাস্তায় দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান। ভুলেও আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। এখন অপরাবউদিকে অচেনা মনে হয়। আমরাও এখন দিকভুল নক্ষত্রের মতো ছত্রখান।

বউদি ডেকে পাঠাল কেন? আমি কি যাব? এই যে এত নিন্দার ঝড় বয়ে গেল, অপরাবউদি কি পুলকেন্দুদাকে সব জানিয়েছেন? কী বলেছেন তিনি? তিনিই কি আমাদের সঙ্গে বউদিকে মিশতে নিষেধ করেছেন? আমি যখন এসব ভাবছিলাম, তখন পৃথিবী ঘুমে অচেতন। বারান্দায় বসে আছি। ঘুম আসছে না চোখে। খুব দূরে একটা রাতপাখি ডাকল। আমার শরীরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কাল সকালে অপরাবউদির বাড়ি যাব কিনা মাকে জিজ্ঞেস করিনি। কেন, মার কাছে লুকোচ্ছি কেন? আমি কাউকে আমার সব বলতে পারতাম, আমি বেঁচে যেতাম।

রাতে ঘুমই এল না চোখে। ভোরের দিকে বিছানায় গেলাম। আমি রাত জেগে বসেছিলাম, পাছে মা জেনে যান, তাই। সেদিন মিটিংয়ে যা কথা হয়েছে, বউদিকে সব বলব।

যখন অপরাবউদির বাড়ির দিকে যাব বলে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, বেলা দশটা হবে মনে হয়। কুরিয়ারের লোক এল। তখন দরজার ইন্টার লক টেনে দিয়েছি। মা চান করে পুজো করতে বসেছেন। এটা মার অনেক দিনের অভ্যাস। সই করে চিঠিটা নিয়ে খামের মুখটা তড়িঘড়ি করে খুলছি। কুরিয়ারের লোকটা বলল, “ভাল খবর আছে বাবু!”

সে চলে গেল। আমি চিঠি খুললাম। অনেকদিন আগে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। এতদিন পরে সেই চাকরিটা আমার হয়ে গেছে! দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে। আমার হাত কাঁপছে। পা টলমল করছে। আমি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলাম। মামার বাড়িতে মা থাকতে বলবে। ওখান থেকেই চাকরি করব। কখনও-কখনও মা হয়তো মামার বাড়িতে গিয়ে থাকবেন। বেশিদিন তো থাকতে পারবেন না। মা পারেন না। নিজের এই বাড়িটা মার কাছে বড় মায়ার। বাড়িটা বাবা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে করেছিলেন। শেষ করে যেতে পারেননি। লোকে বলে, বাড়ি নাকি একবার শুরু করলে শেষ হয় না। হয়তো তাই। এর পর চাকরির পয়সায় আমি বাড়ির কাজে হাত লাগাব।

এখন কি মাকে পুজো থেকে তুলে খবরটা দেব? কেউ ডাকলে মা কিন্তু এসময় পুজো ফেলে ওঠেন না। তবু মনে হল, ডাকি। বাইরে থেকে খুব জোরে চেঁচালাম, “মা, দরজাটা খোলো! প্লিজ মা!”

বেশ কয়েক মিনিট পরে মা দরজা খুলে বললেন, “ওঃ, তোর জ্বালায় পুজোটাও মন দিয়ে করতে পারব না?”

আমি বললাম, “আর পুজো করে কী হবে মা? আমি চাকরি পেয়ে গেছি! এই দ্যাখো চিঠি। ঠাকুর তোমার ডাক ফেলতে পারেননি।”

মা আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে কপালে ছুঁইয়ে চললেন বাবার ফোটোতে ছোঁয়াতে। আমি গিয়ে বাবাকে প্রণাম করলাম। তারপর মাকে প্রণাম করতেই মার দু’ চোখ ছাপিয়ে জল এল। মা জলভরা চোখ নিয়ে হেসে বললেন, “কবে-কবে লুকিয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিস, আমাকে বলিসনি!”

আমি বললাম, “না গো মা, এটা এক বছর আগের দেওয়া ইন্টারভিউ। মনে আছে, সেই যে মামার বাড়ি গিয়ে পরীক্ষাটা দিয়ে এলাম?”

মা হেসে বললেন, “বেশ হল! মামার বাড়িতে থাকতে পারবি। আমার তোকে নিয়ে চিন্তা কমবে। দে দিকি, তোর মোবাইলটা। মামাকে ফোন করে খবরটা দিই।” তারপরেই মনে পড়ে গেল মায়ের। বললেন, “ওঃ, তুই তো মোবাইলটা হারিয়ে ফেলেছিস! এবার তোকে আমি একটা ভাল মোবাইল কিনে দেব, বল! ছেলে চাকরি করবে, তার একটা মোবাইল থাকবে না, তা কি হয়?”

মা বললেন, “যা, অপরার ফোন থেকে মামাকে আগে খবরটা দে। আমি কি যাব রে তোর সঙ্গে?”

আমি মাকে এড়ানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, “তুমি পরে যেওখ’ন। আমি গিয়ে মামাকে খবরটা দিয়ে আসি।”

মা জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, কবে জয়েন করতে বলেছে?”

আমি বললাম, “সামনের সোমবার।”

মা অবাক গলায় বললেন, “ও মা, আর তো দিন নেই! আজ কী বার রে? মনে পড়ছে না।”

আনন্দে মা সব কিছু ভুলে গেছেন। আমি বললাম, “আজ মঙ্গলবার মা। বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র। শনিবার দিন আমরা দুর্গাপুর চলে যাব। তুমিও তো সঙ্গে যাবে?”

মা চোখ ঘুরিয়ে বললেন, “তা যাব না? তোর বাবা থাকলে কত আনন্দ করতেন এখন। যাব তো বটেই!”

আমি চললাম অপরাবউদির বাড়ি। আজ বউদিকে দেওয়ার মতো আমারও একটা খবর হয়েছে। বউদি খুশি হবে কি? নাকি আমি দুর্গাপুর চলে যাব শুনে…? সকালবেলাটা কেমন ভয় আর অস্বস্তি কেটে সুন্দর হয়ে গেল মুহূর্তে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, মাধবীলতাটা আরও ফুল ফুটিয়েছে আজ। অনেক ফুল। নাকি এখন এরকমই অনেক-অনেক ফুল ফোটায়? বাড়িটা তার ঘিয়ে রঙের গাম্ভীর্য সরিয়ে হাসিখুশি!

নীচে গিয়ে বেল বাজালাম। কিছুক্ষণ কোনও সাড়া নেই। তারপর দেখলাম, বাজার-করা সেয়েটি এসে দরজা খুলে দিয়ে ব্যাগ হাতে যেতে-যেতে বলল, “আপনি উপরে যান।”

আমি প্রায় বিড়াল-পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি, দেখি, ড্রয়িং স্পেসে জুঁই ফুল দিয়ে ফুলদানি সাজাচ্ছে বউদি। আমি বললাম, “আজ কেউ আসবে মনে হয়, তাই ঘরটা সেজে উঠছে? আজও কি পুলকদা আসবেন নাকি? কখন?”

“আমার ইচ্ছে হল, তাই! তুই তো শিউলি ফুলের গন্ধ ছাড়া আর কোনও ফুলের গন্ধ পাস না! আজ জুঁই ফুল তোর শিউলি ফুলকে হারাতে পারল কি?” বউদি খুব মিষ্টি করে হাসল।

আমি বললাম, “এখনই পারেনি, একটু পরে হয়তো পারবে। বউদি, তোমাকে তো কখনও আমার কোনো ভাল খবর দিতে পারিনি। আজ তোমাকে আমার একটা ভাল খবর দিই?” বলে খামটা বাড়িয়ে ধরলাম অপরাবউদির দিকে।

বউদি লাফিয়ে এসে খামটা নিতে-নিতে বলল, “তোর চাকরি? বাঃ!” বলে আমার পিঠে আলতো চাটি মেরে বলল, “এবার আর কেউ অর্ককে হাটবাজার করতে বলতে পারবে না! কী বল?”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি খুশি হলে কি বউদি?”

“ও মা! খুশি হব না?”

আমি বললাম, “আমি যে দুর্গাপুর চলে যাব, তোমার মন খারাপ করবে না?”

“এমন ভাল খবরের কাছে মন খারাপ টিকতেই পারবে না।” বউদি বলল।

একটু চুপ করে থাকল বউদি। সত্যি, একবারও তো বউদির শরীর থেকে শিউলি ফুলের গন্ধ পেলাম না এখনও? বউদি জিজ্ঞেস করল, “কবে চলে যাবি? ওখানে মামার বাড়ি থেকেই চাকরিতে যাবি? বেশ হল।”

আমি বললাম, “শনিবার যাব। সোমবার জয়েনিং। মা যাবেন আমার সঙ্গে।” আমার যে কী মনে হল, দুম করে বললাম, “তুমিও চলো না বউদি। বেশ হয়! আমরা তিনজনে দুর্গাপুর যাব। তারপর চাকরির প্রথম দিন তোমাকে আর মাকে আমার অফিস পর্যন্ত নিয়ে যাব। তোমাদের গেটে আটকে দেবে। আর আমি কেমন গটমট করে গেট দিয়ে আমার চাকরির চিঠিটা দেখিয়ে ঢুকে যাব! চলো না বউদি!”

বউদি বলল, “শোন তার আগে তোকে অনেকগুলো কথা বলার আছে। মেয়েটা বাজার থেকে ফিরুক, তোর জন্যে রাজভোগ আনতে বলেছি।” বউদি আমার সামনের সোফায় বসল। বলল, “এই যে আমার গায়ে লোকগুলো কালি মাখাল, কেন জানিস?”

আমি বললাম, “সে আমরা এতগুলো ছেলে রাতে তোমার বাড়িতে আড্ডা দিতে আসতাম, অনেকের সহ্য হয়নি, তাই। তায় তুমি অমন সুন্দরী!”

বউদি সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে আয়েস করে বসে বলল, “শোন, আমি যেমন করে কণাদের পড়ার খরচ দিতাম, তোদের বলিনি, অমন করে ওই যে মেয়েটা সেদিন তোদের মিটিংয়ে বলেছে, আমি ওর ছেলের পড়ার খরচ দিই। ও হচ্ছে মৈনাকের মা। কাউকে বলতে না বলেছিলাম মৈনাকের মাকে। সেদিন অমন করে সকলের সামনে বলে দিল! মৈনাক ক্লাসে ফার্স্ট হয়। আমি আজ পাঁচ বছর ওকে পড়াচ্ছি! মৈনাকের মা অমন সব কথা শুনে, আমাকে এ পাড়ায় থাকতে দেবে না ভেবে ছুটে এসেছিল। আমি পুলকদাকে দিয়ে ওর উঁচু ক্লাস পর্যন্ত পড়ার খরচ ব্যাঙ্কে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আর ওই যে লোকটা, তার মেয়ের কথা বলেছে সেদিন মিটিংয়ে, ও হল দেবলার বাবা। মেয়েটা কী সুন্দর দেখতে! টানাটানা দুটো চোখ, কী সুন্দর নাক, একমাথা কালো চুল, কী মিষ্টি দেখতে! কেমন মিষ্টি করে তাকায়, তুই দেখলে তার প্রেমে পড়ে যাবি! আমি ওর বিয়ের সময় ওকে আমার সব গয়না দেব, ঠিক করে রেখেছিলাম। এখন তো সেসব ভেঙে গেল। আমি ওর বিয়ে পর্যন্ত যদি না-ই থাকি, তাই এর মধ্যে ব্যাঙ্কে মেয়েটার নামে একটা লকার খুলে সব গয়না তাতে রেখে চাবিটা দেবলার হাতে সেদিন তুলে দিয়েছি।”

আমি ফের বউদির গা থেকে সেই শিউলি ফুলের গন্ধটা পেলাম। সকালবেলার শিশির-ভেজা শিউলির গন্ধ!

বউদি বলল, “যে লোকগুলো নিন্দে করতে এসেছিল, ওদের দলের একটা লোক একদিন আমার কাছে এসেছিল একদিন সকালবেলা। ওই যে লোকটার কথা আটকে-আটকে যায়।”

আমি হাঁ হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কবে? কেন?”

“একদিন বেলা এগারোটা নাগাদ লোকটা এসে বেল বাজাল। আমারই ভুল, আমি দরজা খুলে বসতে বললাম। লোকটা অকারণে খি খি করে হাসল খানিকটা। তারপর তোতলাতে তোতলাতে বলল, “তার মেয়েকে নাকি আমার কাছে পড়াতে দিতে চায়। আমি বললাম, আমি তো টিউশনি পড়াই না? সে নাছোড়। বলল, আমি জানি আপনি খুব বুদ্ধিমতী। আর সুন্দরী তো বটেই! মেয়েকে রোজ সন্ধেবেলা আপনার কাছে পড়াতে দিতে আসব। আপনি পড়াবেন, আমি বসে থাকব মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। আমি বললাম, হয়েছে, আপনার বলা হয়েছে? এবার আসুন। লোকটা যেতেই চায় না। বলল, সে অনেকক্ষণ বসবে। তারপর আমার দিকে খি খি করে হাসতে-হাসতে এগিয়ে আসতেই হাতের কাছে একটা ঘরমোছা লাঠি পড়েছিল সোফার নীচে। সেটা দিয়ে মারলাম ওর মুখে। লোকটা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। আমি ভাবলাম, লোকটা মরে গেল নাকি? তারপর দেখি, ঘষটাতে ঘষটাতে দরজার কাছে গিয়ে কোনও রকমে দরজার পাল্লা ধরে উঠে দাঁড়াল। ফের তেড়ে যেতেই লোকটা পালাল রাস্তার দিকে।”

আমি বললাম, “তুমি এসব কোনও কথাই তো আমাদের বলোনি? কেন?”

“তার পরেই তোদের রবীন্দ্রজয়ন্তী এসে গেল। আমি তোদের পেয়ে গেলাম!” বউদি হাসল মিটিমিটি, “আর শুনবি? ওই যে তোদের বন্ধু সুজয়ের বাবা নিখিলবাবু? ওর জন্যেই বাজারে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে আমাকে। কত রকম প্রলোভন-চলুন না, একদিন সিনেমায় যাই? কখনও বলল, জানেন, অ্যাকাডেমিতে খুব ভাল নাটক আছে রবিবার। নন্দীকারের। চলুন! কখনও বলল, শুনেছি আপনি নাকি খেতে খুব ভাল বাসেন। চলুন, একদিন জম্পেশ করে দু’জনে খাই! কত বলব রে? এরা এসেছে তোদের জড়িয়ে আমার গায়ে কালি লাগাতে?”

আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, “তুমি এসব বলোনি কেন? ওরা দল বেঁধে এল। আর তুমি এসব ভাঙলে না কারও কাছে?”

বউদি বলল, “শোন, তোকে আজ এসব বললাম, কাউকে বলবি না বলে। ওরা তোদেরকে আমার বাড়ি থেকে সরাতে চেয়েছিল। ফের কারও কোনও মতলব আছে হয়তো!”

“এসব কথা তুমি কাউকে একবার জানালে না?”

“এই তো তোকে জানাব বলেই তো আজ ডেকেছি! তুই তো জানলি!”

তখনি বাজার করে ঢুকল মেয়েটি। বউদি উঠে গিয়ে আমার জন্যে দুটো রাজভোগ এনে প্লেটটা সামনে রাখল।

বলল, “দুটোই তোর নয় কিন্তু! একটা আমার!”

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “তাই? খুব খিদে পেয়েছে, আমি কিন্তু দুটোই খেয়ে নিতে পারি?”

বউদি বাজার গুছিয়ে এসে সোফায় বসল। মেয়েটির কাজ শেষ। সে চলে গেছে। বউদি বলল, “বল, চুপ করে আছিস কেন?”

আমি বললাম, “বউদি, তোমার ফোনটা দেবে? আমি মামাকে আমার চাকরির খবরটা দেব। বলব, মা আর আমি শনিবার যাচ্ছি!”

“কেন, তোর ফোনটা কোথায় গেল? বাড়িতে রেখে এসেছিস?”

মিথ্যে বলতে ইচ্ছে করল না বউদিকে। বললাম, “সেদিন তোমাকে এস এম এস করে তোমার দেওয়া মোবাইলটা সানাইয়ের জলে ফেলে দিয়েছি।”

বুদি হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আমি বললাম, “রাগ করলে বউদি?”বউদি মাথা নাড়ল, “না। অভিমান! তবে কেউ ভালবেসে কিছু দিলে অমন করে ফেলে দিতে হয়? তোর কাছে কত কিছুই না শেখার আছে!”

আমি তাকালাম, বউদি অনেক বেশি সুন্দরী হয়েছে। গায়ের রং আরও বেশি ফরসা। মুখটা কী কমনীয়! আমি বললাম, “জানো বউদি, তোমাকে আজ কীরকম দেখাচ্ছে বলব?”

বউদি ঝটিতি বলল, “কীরকম?”

“আমাদের বাড়িতে তো তুমি কোনওদিন যাওনি। গেলে দেখতে, আমাদের বারান্দার গায়ে গা লাগিয়ে কতদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা কদম গাছ। বাবা ওই কদম চারাটা রথের মেলা থেকে কিনে এনে লাগিয়েছিলেন। এখন প্রতি বর্ষায় ফুল ফোটে। গন্ধে রাতে ঘুমোতে পারি না। জেগে বসে থাকি! ওই কদম গাছটার ডালে প্রতি বছর বাসা বাঁধে দুটো শালিক। যখন বৈশাখ মাস আসে, কত দূর থেকে যেন দুটিতে উড়ে এসে বাসা বাঁধতে লাগে। মাও চেনেন ওদের। তখন মা করেন কী, হাত বাড়িয়ে কদমের ডালে একটু-একটু করে খড়কুটো রেখে দেন। দু’-এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়ের ছোট্ট টুকরো। ওরা সেগুলোকে টেনে নিয়ে গিয়ে বাসায় জোড়ে। বৈশাখ গড়িয়ে জ্যৈষ্ঠ আসে। তারপর দেখি, এক-একদিন দুটিতে গায়ে গা লাগিয়ে বিভোর হয়ে বসে থাকে। তখন মেয়ে-শালিকটাকে বেশ নধর, তুলতুলে, শ্রীময়ী লাগে দেখতে। তোমাকেও সেরকম লাগছে!”

“বেশ, তোর তাতে কী? শোন, তুই তো একটা সুখবর দিলি? আমিও তোকে একটা সুখবর দেব!” একটু চুপ করে থেকে বলল, “তুই আর মাসিমা শনিবার দুর্গাপুর যাচ্ছিস? নতুন করে তোর জীবন শুরু করবি। আমিও শনিবার যাচ্ছি!”

আমি অবাক গলায় বললাম, “কোথায়?”

“দুবাই!”

“সত্যি? বেশ হবে! কার সঙ্গে যাবে?”

“তোর পুলকদা আসছেন।”

“কবে? আজই কি?”

“বিকেলে। আমরা এখানকার পাট চুকিয়ে চলে যাচ্ছি রে অর্ক!”

“মানে?”

“এই খারাপ লোকেদের নিন্দা, গায়ে কালি ছেটানোর ব্যর্থ চেষ্টা, সব! বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি রে। এমনকী, তোদের স্মৃতিগুলোও সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি না। তোর পুলকদা আজ এলেই কাল রেজিস্ট্রি।”

আমি হতভম্ব।

অপরাবউদি বলে চলেছে, “এই বাড়ি, এই মাধবীলতা, এই চাঁদনি রাত, আমাদের এত দিনের আড্ডা, লাজুক অনিকেত, বিচ্ছু অনীক, গম্ভীর দেবাঙ্কুর, কম কথা বলা কিংশুক, পণ্ডিতি ফলানো অভ্রনীল, পরোপকারী শুভ্রকান্ত, সকলকেই এখানে রেখে গেলাম। তোর মুখ থেকে গল্প শোনা বসুধারা নদী, তোর সঙ্গে মজা আর খুনসুটির টুকরো, তোর অমন আনুগত্য, আমার প্রতি তোর অমন ভালবাসা, আমার বিকেলবেলার গান, সব পড়ে রইল এখানে!”

“তুমি এখান থেকে কি কিছুই নিয়ে যাবে না বউদি? এর কিছুই কি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না? এখানকার সব মিথ্যে হয়ে যাবে তোমার কাছে? ওখানে তা হলে তুমি কী নিয়ে বাঁচবে বউদি? নতুন কিছু?”

বউদি আমার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, “ধর, হাঁ কর! তোকে রাজভোগটা খাইয়ে দিই আজ! হাঁদা কোথাকার! এখান থেকে নবীন এক সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি!”

তক্ষুনি একরাশ শিউলি ফুলের গন্ধ অপরাবউদির গা থেকে ভেসে এল আমার দিকে। আমি মনে-মনে অপরাবউদিকে বললাম, “তুমি আমার জন্যে এই শিউলি ফুলের গন্ধটা রেখে যেও বউদি!”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “novel-aporaboudi

  1. সত্যি এক অন্য ধরনের ভালো বাসার গল্প। আমি একটানা পড়ে শেষ করলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানাই।আরো লিখুন।

    আশীষ কুমার চক্রবর্তী।
    ১৯.১০.২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *