অমর মিত্র
চম্পার কথা চম্পাই বুঝি তেমন জানে না, যতটা জেনেছিল তার ফেসবুক ফ্রেন্ড রুহিতন বড়ুয়া। হ্যাঁ কিছুটা মাত্র। ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে আর কতটা জানা যায়! তবুও জানত সে। জানত তার আর একটা নাম আছে, ফিরোজা। আর সেই কথাটি বলে, ফিরোজা নামটি দিয়ে রুহিতন কথা বলতে বলতে সেই প্রথম রাতেই আচমকা থেমে গেল। তারপর থেকে চম্পা ক’দিন খুব বিমর্ষ হয়ে আছে। সেই রুহিতন খোলা মাঠে বসে পূর্ণিমা রাতে তাকে নিবেদন করেছিল নিজের মুগ্ধতা। তাকে সে দ্যাখেনি। হোয়াটসঅ্যাপে সে এসেছিল প্রথমে অচেনা এক নম্বর হয়ে। তার নম্বর সে জেনেছিল যে করে হোক। গভীর রাতে এল ফোন। সেদিনই হয়েছিল প্রথম কথা। সে ছিল ভিনদেশী পুরুষ এক।
ভিনদেশী পুরুষ দেখি চাঁদের মতন
লাজরক্ত হইলা কন্যা পরথম যৈবন।
কথায় দেখতে পেয়েছিল তাকে। যখন কথা জমে দুধ উথলে উঠতে লাগল, তখনই সে চুপ। সেই জোছনা রাতে শিকারী ব্যাধ বেরিয়ে পড়েছিল গঞ্জে গঞ্জে নগরে ও গ্রামে। এই অবধি জানে কুসুম। সেই রাতে কোথায় গ্রামের পর গ্রাম পুড়েছিল, ধর্ষণের পর এক বালিকাকে মাটিতে কবর দিয়ে গিয়েছিল কারা। এক হতভাগ্যকে মোষ চোর বলে পিটিয়ে মেরে দিয়েছিল কারা। আসলে নাকি টাকা আদায় করতে বেরিয়েছিল কালীর ভক্তরা। মোষ বলি হয় সেখানে। মরেই গেছে সে। নামটা অবশ্য রুহিতন নয়। সনাতন। আর এই ঘটনা ঘটেছিল ভূষণ্ডি নামে এক গ্রামের বাইরে একটি খোলা মাঠে। সেখানে বসে জোছনা রাতে ফোন করছিল সনাতন পুরকায়েত। আর রুহিতন বড়ুয়া ছিল হলদি নদীর ধারে। রুহিতনের বাড়ি রূপনারায়ণের কুলে। রুহিতন কবিতা লেখে। মেলেনি অনেক কিছুই, তবু কুসুমের ভয় করছে। সনাতন পুরকায়েতের মৃত্যুও তো মৃত্যু। রুহিতন না হলেও মৃত্যু। রুহিতন আর ফোন করছে না। ফোন টাওয়ার নট অ্যাভেলেবল হয়েই আছে।
-চুপচাপ যে? বাবা জিজ্ঞেস করে।
-জানি না বাবা। চম্পা উত্তর দেয়।
-তোর মেগা সিরিয়ালে অভিনয়ের কী হলো ?
-চম্পা বলল, ওদের দরকার হলে ডাকবে।
-হয়েই তো গেছিল।
-কী জানি হয়েছিল কী হয়নি আমি জানতাম না। বলল চম্পা। আসলে এমনিই হয়। হয়েও হয় না। আবার হবে না ধরে নিলে হয়ে যায়। মধ্যবর্তিনী সিরিয়ালে ওইভাবে হয়েছিল। একজন করবে ঠিক হয়ে গিয়েছিল, আচমকা সে বলল, পারবে না। তার হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে আপত্তি করেছে। ইন্টারনেটে করা সম্বন্ধ, তারপর মেলামেশা। হবু স্বামী না করেছে। তাদের মতেই তো মত দিতে হবে। চম্পা ঢুকে গিয়েছিল তার জায়গায়। আসলে সুযোগ পাওয়া মানে অনিশ্চিত এক প্রবাহে থাকা। চম্পা বলল, মিঃ রাকেশ রায় আঙ্কেল ফোন করেছিল।
-নতুন কোনো ফোটোশ্যুটের কন্ট্র্যাক্ট হয়েছে হয়তো।
-হবে হয়তো, আমি ঠিক জানি না, আমি ধরিনি, আচ্ছা বাবা, আগে তো ফিল্ম রোল দিয়ে ছবি তোলা হতো।
-হুঁ, তুই দেখিসনি সিনেমার বড় বড় ফিল্ম রোল, চাকা ঘুরে রিল বের হতো।
-আমার খেলার বাক্সে একটা লম্বা রোল ছিল, নষ্ট ছবি, কে দিয়েছিল জানি না, আমি খুলতাম আর গোটাতাম। বলতে বলতে চম্পা শূন্য হাতে ফিল্মের রোল গোটাতে থাকে যেন, বলে, ফিল্ম নষ্ট হওয়ার ভয়ে কত সাবধানে ফোটো তুলতে হতো বলো।
-হ্যাঁ। মোবাইল ক্যামেরা ওপেন করে মেয়েকে তাক করছে সুমিত্রভূষণ।
চম্পা এখন লাল কালো চেক লং স্কারট, শাদা শার্ট। হর্স টেল। ঘুরছে ঘরের ভিতর। সুমিত্রভূষণ তার মোবাইল ক্যামেরায় ক্লিক করে। চম্পা বলছে, ফিল্ম রোলই সব ছিল বাবা, নেগেটিভ, পজিটিভ, কাগজে পড়ছিলাম মুক্তি ছবির রিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ক্যান ভর্তি অনেক সিনেমার রিল নষ্ট হয়ে গেছে।
সুমিত্রভূষণ বলল, ওটা তোর দাদুর যৌবনকালের সিনেমা, বড়ুয়া কাননবালা।
-জানি, ডিজিটাল এসে আর ফিল্ম নেই, আর ছবিরও শেষ নেই বাবা।
-হুঁ, শেষ নেই।
চম্পা বলল, এখন ছবি অবিনশ্বর।
সুমিত্রভূষণ হাসল, বলে, ইয়েস, পোড়ে না, মোছে না, হারায় না, নানা জায়গায় লিঙ্ক রেখে দিলেই হয়, সিনেমাটা গুগল ড্রাইভে রেখে দে, মেইল কর, থেকে গেল।
চম্পা বলল, বাবা আমার ফোটোগ্রাফার নেপাল জেঠুর ছবিই ভাল, তোমার রাকেশ রায়ের ইন্ট্রোডিউস করার ক্ষমতা বেশি, আমার কিন্তু আর তার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না, কী হবে ওঁর ফোটোশুটে গিয়ে, রেমুনারেশনই সব!
-ওর যোগাযোগ আছে ভাল, এই তো সেদিন স্বাস্থ্য ম্যাগাজিনে তোর ছবি বের হলো।
-জানি, প্রথমেই এটা হলো, নেপাল জেঠু এমন পারে না, তবে পারে না যে তাও বলি কী করে, আসলে রাকেশ লোকটাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না বাবা, আমার কিছুই ভাল লাগছে না, তোমাকে ফোন করলে আজ যাব না বলে দিও।
-আজ তাহলে বের হবি না, রেস্ট নে বাড়িতে, বলে দেব শি ইজ টায়ার্ড, টেকিং রেস্ট।
-না, চলো বিকেলে থিয়েটার দেখে আসি, নতুন একটা দলের নাটক।
-টিকিট?
-থাকবে, অনিমেষদা আছে মূল চরিত্রে।
-অ্যাক্টর অনিমেষ বসু?
-হ্যাঁ বাবা, অনিমেষদা ফোন করেছিল, দুটো টিকিট কাউন্টারে থাকবে।
সুমিত্রভূষণ চুপ করে থাকল। মেয়ে মডেলিং করে। অভিনয় করে। পাড়ার লোক ফটোগ্রাফার নেপাল মল্লিকের সঙ্গে ওর অসুবিধে হয় না, কিন্তু রাকেশ রায়ের সঙ্গে খিটিমিটি লাগছে। মেগা নিয়ে, থিয়েটার নিয়ে কি? নেপাল যেমন চায় না কুসুম মেগা করে করে নিজেকে ব্যস্ত না করে যেন, কিন্তু আপত্তিও করে না। নেপালের মত ওসব করলে চম্পার রূপে কালি পড়বে, কিন্তু মেয়ের মত অন্য। সে তো অভিনয়ই করতে চায়। অভিনেত্রী হবে। রাকেশ রায় কী বলছে জানে না সুমিত্র। মেয়ে কিছু বলে না। শুধু বলে, নো নো, নো আর আর। রাকেশকে দিয়েছে তার কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিক সুজন চট্টরাজ। তার শ্যালক রাকেশ। মডেলিং লাইনে অনেক যোগাযোগ তার। ভালো পেমেন্ট। কিন্তু চম্পা না করছে। পাঁচ বার ডাকলে এক বার যায়। আর নেপাল মল্লিক ডাকলে, আনন্দে যায়, যাই সুইট হার্ট যাই। নেপাল বলে, হাই ডাল্লিং, আমার চোখ আর ক্যামেরা তোমাকে ছাড়া ক্লিক করতেই চায় না। রাকেশ চল্লিশ বিয়াল্লিশ, নেপাল ষাটের উপরে। নেপাল বলে, এমন ফোটোজিনিক ফেস খুব কম পাওয়া যায় সুমিত্র, চম্পাকলি বিজ্ঞাপন জগতের অ্যাসেট হবে। রাকেশের সঙ্গে মেয়ে নিয়ে কথা হয়নি সুমিত্রর। অনিমেষ অবশ্য চম্পার কন্ঠস্বরের প্রশংসা করেছিল এ বাড়িতে এসে। এ বাড়িতে অনেক কষ্টে একবার ওই অনিমেষকে নিয়ে এসেছিল চম্পা। অনিমেষের সঙ্গে আর একজনও ছিল। সে নাকি অনিমেষের অনুরাগিনী। চাবুক চেহারা অনিমেষের। একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিন দেখেছিল সুমিত্রভূষণ। চম্পাই এনেছিল। বৈশাখে বিয়ের সিজিনে বিখ্যাত বস্ত্রালয়ের বিজ্ঞাপন। ধুতি পাঞ্জাবি পরা অনিমেষ। সে যে কী সুন্দর! পুরোনো বাংলা সিনেমার উত্তমকুমার। সেই শাপমোচন ছবির শেষ দৃশ্য। চম্পা আগে সালঙ্কারা বিয়ের কনের ছবি তুলেছে অনেক। খুব ভাল লাগে ওকে। বালিকা বধুর মৌসুমী। নেপাল তুলেছিল কতদিন ধরে কত ছবি। বনেদি বাড়ির বউ। তাদের ছাদে এসে তুলেছে নেপাল। সুমিত্রভূষণও তুলেছে নিজের ক্যামেরায়। ছবিতে নিজেকে দেখা যেন সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল ওর। রূপ তো আছে। কিন্তু রূপ ঝরে যেতে সময় লাগে না। টের পাওয়া যায় না কীভাবে দিনে দিনে জল হাওয়া রোদ বাতাসের ভিতর ক্ষয়ে যায় রূপ। চম্পা জিজ্ঞেস করল, তুমি যাবে তো?
-আমি কেন? সুমিত্রভূষণ বলল, তুই যা।
-নাটকটা ভালো, তুমি কি দেখতে চাও না?
-তোর কোনো বন্ধুকে নিয়ে যা, আমাকে তাহলে আগে বেরোতে হবে অফিস থেকে।
হা হা করে হাসে চম্পা, ওই তো অফিস, বেরিয়ো, ক’টাকা দেয় বলো, অনিমেষদা তোমাকে যেতে বলেছে, তোমার কথা শুনে খুব ভালো লেগেছিল ওর, তুমি আগে থিয়েটার করতে, পুরোনো গানের অনেক স্টক, এইসব শুনে বলেছে এই নাটকটা দেখতে।
সুতরাং যেতে হবে। মূল চরিত্রে অনিমেষ। সুমিত্রভূষণ যাবে। আগের দিন আর এইদিন এক নয়। আগেরদিনে কি একটি মেয়ে তার পুরুষবন্ধুর নাটকের কথা বাবাকে বলত এইভাবে? এখন সকলে সকলের বন্ধু। সে অভিনয় করছে, তাই যেতে হবে মেয়ের সঙ্গে তাকে।
চম্পা আবার বলল, আসছ তো বাবা, কাউন্টারে টিকিট থাকবে, না গেলে টিকিটটা নষ্ট হবে।
-উফ আর কেউ নেই, আমার না গেলে হবে না?
-নাটকটা দারুণ বাবা, হারিয়ে যাওয়া গান আর রেকর্ড নিয়ে।
-আচ্ছা, যাব। সুমিত্রভূষণ নিচে নেমে এল। অফিসে যাবে। অফিস তেমন কিছু না। আগে ছিল সিনেমা কোম্পানিতে। এখন কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে। ফ্ল্যাট বুকিং ইউনিটে তার কাজ খুব দায়িত্বের। কিন্তু দরকারে বসকে বলে আগে বের হতেও পারে। সওয়া পাঁচটায় বের হলে, ছটার ভিতরে গিরিশ মঞ্চ। তার মাইনে তেমন নয়। চলে যায়। কষ্ট করতে হয়। বুড়ো বাবার পেনশন আছে। মেয়ের হাতে কিছু টাকা আসে অভিনয়, মডেলিংয়ে। নেপাল দেয় ছবি তুললে। রাকেশ দিয়েছে ভাল টাকা দুবার। রাকেশ বলেছে চম্পাকে সে মডেলিংয়ের জগতে দাঁড় করিয়ে দেবে। চম্পা টিউশনিও করে। পড়াতে তার ভালো লাগে। সেই মাধ্যমিক পাস করার পর থেকেই টিউশনি করছে। সব কিছুই ম্যানেজ করে অদ্ভুত দক্ষতায়। না বলে না কোনো কাজে। এক একবার নেপালের সঙ্গে যে মতান্তর হয়নি তা নয়। কিন্তু তা মিটিয়েও নিয়েছে মেয়ে। নেপাল এ বাড়িতে এসে ডাল্লিং বলে ডাক দিতেই মেয়ে গলে জল। অফিসে গেল সুমিত্রভূষণ। দুপুরে রাকেশ রায় তাকে ফোন করল। এই ভয়ই পাচ্ছিল সে।
রাকেশ জিজ্ঞেস করল, কী হলো চৌধুরীবাবু, চম্পাকলি ফোন ধরছে না।
-সাইলেন্ট করে রাখে, খেয়াল করেনি হয়তো।
-এল না কেন, আজ ফোটোশ্যুট ছিল।
-শরীর ভালো না বলছিল, বাড়িতেই রয়েছে।
-বেশি স্ট্রেস নিচ্ছে আপনার মেয়ে, আরে ওর একটা ভালো পেমেন্ট আছে, এইট থাউজান্ড, আমি ক্যাশই দিয়ে দেব, অফিসের পর আপনি বরং নিয়ে যান টাকাটা।
-না, মানে বিকেলে আমার একটা কাজ আছে। আজ থাক।
-আরে নিয়ে যান, আমাকে সাইন্ড ভাউচারটা পাঠিয়ে দিতে হবে ওদের, চম্পা এসে সই করবে কবে, আপনি কাল ওকে ভাউচারটা দিয়ে যেতে বলবেন।
টাকাটা তার কাছে অনেক। এক সঙ্গে এত টাকা কি আগে পেয়েছে চম্পা? রাকেশের ক্ষমতা আছে। কিন্তু থিয়েটার! চুপ করে থাকে সুমিত্রভূষণ। তখন রাকেশ বলল, এমনিতে এত পেমেন্ট দেয় না, ও এবার কাজ বেশি করে পাবে, আসুন নিয়ে যান।
-না মানে…? কথা শেষ করে না সুমিত্র।
-কোথায় যাবেন আজ, খুব ইমপরট্যান্ট?
হু, ওর সঙ্গেই যাব। বলেই বুঝল ভুল করে ফেলেছে সে। রাকেশ খুব জোর করে তা বুঝতে পারছে সে। চম্পা এই জন্য পছন্দ করে না লোকটাকে। রাকেশ তাকে বলছে নতুন মডেল কেউ এত পায় না। রাকেশ অনেক কাজ দিতে পারবে। তার ক্যামেরা জার্মানি থেকে আনা। এই ক্যামেরা কলকাতার আর কোনো স্টিল ফোটোগ্রাফারের কাছে নেই। চম্পা তা জানে। রাকেশ জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন, সিনেমা দেখতে?
উফ, লোকটা তার গলার স্বরে আন্দাজ করেছে কিছু। মেয়ে যে অসুস্থ নয় তাও ধরতে পেরেছে। পারবেই ধরতে। তাহলে সে তো প্রথমেই বলে দিত চম্পাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। সে কেন ইতস্তত করছে। তার কী ? সে বলল, না থিয়েটারে।
-থিয়েটার, কোথায়?
সুমিত্র বলতে রাকেশ জিজ্ঞেস করল, ফাদার অ্যান্ড ডটার, সঙ্গে কি নেপাল মল্লিক?
-না শুধু মেয়েই যাবে। সুমিত্র বিরক্ত হলো এই অনাবশ্যক কৌতূহলে। কিন্তু তা প্রকাশ করবে কীভাবে? লোকটা তার কোম্পানির মালিকের শ্যালক। লোকটা আট হাজার টাকা দিচ্ছে ফোটো শ্যুটের জন্য। এই মাসে আগে একবার দিয়েছে পাঁচ। সুমিত্রকে তার কোম্পানি দেয় দু ক্ষেপে মাসে দশ হাজার। থিয়েটারের কথায় রাকেশ বলল, সেও যেতে পারে, অনেক দিন নাটক দেখা হয়নি। অদ্ভুত! সুমিত্র হেসে বলল, আসুন।
-যাই তো আপনাকে ফোন করব।
-আচ্ছা। সুমিত্র জানে রাকেশ রায় থিয়েটার দেখার লোক নয়। চম্পা বলে লোকটা ব্লান্ট। তবে ক্যামেরার চোখ ভালো। ছবি ভালোই তোলে কিন্তু এমন সব অ্যাঙ্গেল বেছে নেয়, তখন মনে হয় না খুব ইডিয়ট।
অফিস থেকে বেরিয়ে সুমিত্র সোজা গেছে গিরিশ মঞ্চে। গিয়ে দ্যাখে মেয়ে টিকিট নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সময় হয়নি তখনো। চা খেতে খেতে সুমিত্র বলল, তোর প্রাপ্তি যোগ হয়েছে, কাল যাবি।
-কী হয়েছে বাবা?
সুমিত্র বলতে চম্পা বলল, আমার কি বাকি আছে ওঁর কাছে, প্রথম দুবার তো কিছু দেবে না বলেছিল, অ্যাকসেপ্ট হলে দিতে আরম্ভ করবে, একটা হয়েছে, আমি তো পেলাম, তাহলে আবার হয়তো নিয়েছে কোনো কোম্পানি।
হুঁ। আচমকা চঞ্চল হয়ে পড়েছিল সুমিত্র। মনে হতে লাগল রাকেশ এসে যাবে মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে। চম্পা খুব রেগে যাবে তার উপর। রাকেশ কী করে জানল সে গিরিশে এসেছে। সে বলল, চ ঢুকে পড়ি।
-দেরি আছে পনের মিনিট।
সুমিত্র বলল, ভিতরে ঠান্ডায় গিয়ে বসি, বাইরে এত গরম!
সুমিত্র খুব ভয় পাচ্ছিল, রাকেশকে দেখে চম্পা না প্রত্যাখ্যান করে দেয় টাকাটা। থিয়েটার হলে হানা দেবে কেন ফটোগ্রাফার? সুমিত্র বলল, রাকেশ কিন্তু তোকে দাঁড় করিয়ে দেবে।
চম্পা বলল, আমি তো আর যাবই না ওর ক্যামেরার সামনে।
-কেন, কী হলো?
-সে তো বলা যাবে না বাবা, ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখে যে সে ভাবে সেই শুধু দেখতে পায় অবজেক্ট, মানে আমাকে, কিন্তু অবজেক্ট মানে আমি কি লেন্সের উলটো দিকে থেকে অন্ধ বাবা?
কথা আর এগোয় না। সিট নিয়ে বসেছে তারা। ফোন কি সুইচড অফ করে রাখবে সে? তাহলে রাকেশ এলেও…। কী মনে করে ফোন সাইলেন্ট করে রাখে। রাকেশ তো টাকা নিয়ে আসবে। হল অন্ধকার হলো, নিশ্চিন্ত হয়ে নাটকে নিবিষ্ট হলো পিতাপুত্রী। সে এক হারানো রেকর্ড নিয়ে নাটক। গুনগুন করতে লাগল পুরোনো সব গান। বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা……মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে। আহা মন ভরে যায় পিতা-পুত্রীর। অনিমেষ কী চমৎকার অভিনয় করছে। গানের রেকর্ড খুঁজতে খুঁজতে কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে সে। ইন্টারভাল হতে না হতে সুমিত্রর সাইলেন্ট মোডের ফোন কাঁপতে থাকে। সে উঠে হল থেকে বেরিয়ে এসে দ্যাখে রাকেশ রায়, হেসে তার দিকে এগিয়ে এল, নাটকের সময় দুবার কল দিলাম, ফোন সাইলেন্ট করা?
রাকেশ মিনিট পনের বাদে ঢুকেছে। পেছন দিকে এম রো-তে তার টিকিট। বলল, খামটা নিন সুমিত্রদা, ফোর আছে, পকেটে ভরে নিন।
-এইট বললেন যে?
-শ্যুটের দিনে বাকিটা, এটা অ্যাডভান্স পেমেন্ট, আপনার ওটা বি রো?
-হুঁ, আপনি দেখেছেন?
-ইয়েস, সাইডের সিট তো?
হুঁ। সুমিত্র টাকার খামটা ধীরে ধীরে জিন্সের পকেটে ভরে নিয়েছে। রাকেশ লোকটা কেমন যেন! কিসের ফোটোশ্যুট হবে? এক স্টুডিও নুড শ্যুট করতে চেয়েছিল। প্লে-বয় ম্যাগাজিনে ছাপবে নাকি? অনেক অফার করেছিল। ফ্যাশন ম্যাগাজিন সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সেরা করে কলকাতা, মুম্বই হয়ে সেলেস দ্বীপে পাঠাবে বলেছিল। স্টার হোটেলে এক রাত্রি বেড শেয়ার করতে হবে বিউটি কম্পিটিশনের সিইও-র সঙ্গে। চম্পা তাকে সব বলে। তার মা জানে না। জানলে ভয় পেয়ে তাকে বেরোতে দেবে না। সব বন্ধ করে দেবে। মাঝে মাঝেই তো বলে লাইনটা পিচ্ছিল। বন্ধ করো অভিনয়। সুমিত্রর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
চম্পা তার বাবার কাছে পরামর্শ চায়। প্রেক্ষাগৃহের খোলা দরজা দিয়ে আচমকা ঝাপ্টে এল হিমেল বাতাস। ধেয়ে এল যেন তুষার ঝড়। তার গায়ে হিম স্রোত বয়ে গেল। চশমার কাচে কুয়াশা জমে গেল বুঝি। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সামনে দাঁড়ানো রাকেশ তার চশমা খুলে মুছতে লাগল। সেই, আগে মনে হয়নি, আজ মনে হচ্ছে। লেন্সের উল্টোদিকে থেকেও দেখা যায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যামেরাম্যানের চোখ। ঝাপসা করে দেওয়া যায়। রাকেশ চাপা গলায় বলল, আচ্ছা, আটই রাখুন, আপনার মেয়ের ভবিষ্যৎ ভালো, ভালো ছবির কত ক্লায়েন্ট আছে, জাস্ট কাছে রেখে দেবে, অবশ্যই ব্রেভ ফোটোগ্রাফি, কয়েকজন কালেক্টর চেয়েছে, লন্ডনে থাকে, মিলানে থাকে, সানদিয়েগোতে থাকে, ফরেন।
কথা শুনতে ভয় করে সুমিত্রর। বাকি টাকাও ব্যাগে ঢুকে গেল। বেল পড়ে গেছে। আবছা অন্ধকারে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে রাকেশ আচমকা ফিসফিসিয়ে বলল, আপনি আমার সিটে বসুন, আমি ওর সঙ্গে ফোটোশ্যুটের কথাটা বলে নিই, মন্দারমনিতে হবে, ডেট ফিক্স করতে হবে তো।
-আমি এখানে বসব? অসহায় সুমিত্র জিজ্ঞেস করে।
-ইয়েস, এই যে সিট, এখান থেকে ভালই দেখা যাবে, আমি তো নাটক দেখতে আসিনি, টাকাটা সাবধানে রাখবেন। বলতে বলতে রাকেশ এগিয়ে যায়। চরম নাটকীয় হলো নিশ্চয়। দম বন্ধ করে বসে থাকে সুমিত্র। ইস, চম্পা লোকটাকে এড়াতে চাইছে, সে টাকাটা নিয়ে ওকে কুসুমের কাছে পাঠিয়ে দিল? অন্ধকারে লোকটা চলে গেল কুসুমের দিকে। খুঁজে বের করবে ঠিক। খুঁজতেই এসেছে তো। সিটে বসে মোট আট হাজার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল সুমিত্র। দু’হাতে ব্যাগটা ধরে সামনের অন্ধকারে তাকিয়ে অন্ধ হয়ে যায়। মঞ্চ, আলো সবই মুছে যায় চোখের সামনে থেকে। চম্পা চম্পা, তোর নাম চাঁপাফুল, আমি তোর অন্ধ পিতা! তুই চক্ষুষ্মতী। লেন্সের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে লেন্সটা অন্ধ করে দে চম্পা। ঝাপসা করে দে, সে যেন তোকে দেখতে না পায়। শিকারী বেরিয়েছে শিকার করতে।
ভুল করে কত কিছু হয়। রজ্জুতে সর্প ভ্রম হয়। উল্টোও হতে পারে। সর্পকে রজ্জু ভেবে বসা। কাছের জনকে অন্য কেউ ভেবে বসা। অচেনা লোকের হাত ধরে ফেলা চেনা মানুষ ভেবে। কিন্তু এই বিভ্রম তো চম্পার হয়নি। সে তো বসেই আছে তার সিটে, তার ডান পাশের যিনি, ছোট এক নাট্য দলের প্রধান অভিনেত্রী, তিনিও আছেন, বাঁ পাশে এখন একজনের বদলে আর একজন। সিট নম্বর কি বদলে গেল বিরতির সময় নিজে নিজেই! আলো আঁধারে এমন হতে পারে নাকি? নাটকের বিরতির পর হলের আলো নিভলে তার বাবার সিটে কে যেন এসে বসল, বাবা নয়, চম্পা জিজ্ঞেস করল, কে আপনি, এটা তো আপনার সিট নয়?
নাটক এখনো আরম্ভ হয়নি। অন্ধকার হয়েছে সবে। ভুল করে বসেছে কেউ, আড়চোখে আবছা আলোয় যাচাই করে নিল চম্পা। একটা বুনো বুনো গন্ধ। ঘামের নয়, এক ধরণের ডিও বেরিয়েছে নাকি পুরুষদের জন্য। মেয়েরা নাকি সেই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে আসে। বলেছিল তাদের এম.এ ক্লাসের সহপাঠী অনীক ঘোষ। সেই গন্ধ কি এই গন্ধ? বাঘের গন্ধে নাকি চিতল হরিণী এগিয়ে যায়! ইস, কে এসে বসল? এমন গন্ধ নিয়ে কেউ তো নাটক দেখতে আসে না। আর এলেও এখানে বসবে কেন? বাবার তো এসে যাওয়ার কথা। বাবা কোথায় গেল? বাবার তো দেরি করা অভ্যেস নয়। নাটক নিয়ে বাবা খুব সিরিয়াস। সে আবার বলল, এই সিটটা আপনার নয়, লোক আছে, ভুল করেছেন।
লোকটা বসেই আছে। করতলে মোবাইল দপদপ করছে। অ্যাকটিভ আছে। সাইলেন্ট আর ভাইব্রেটিং মোড। লোকটা মোবাইলের হিয়ারিং কর্ড কানে দিয়ে আছে। থিয়েটার দেখতে এসেও গান শোনা। কুসুম অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না। পর্দা উঠছে, পুরনো দিনের গানের মিউজিক বাজছে, এ শুধু গানের দিন……, পিয়ানো অ্যাকরডিয়ান। চম্পা আবার চাপা গলায় বলল, এখানে লোক আছে।
-না, নেই। ভারি আর কর্কশ কন্ঠ বলল। চেনা মনে হলো। সে চাপা গলায় প্রতিবাদের সুরে বলে উঠল, নেই মানে?
-নেই মানে নেই, আমাকে তিনি এখানে বসতে বললেন। ভারি কন্ঠস্বর।
-কে আপনি, কী বলছেন কী?
-ইয়েস চম্পাকলি, সুমিত্রদা পেছনে বসেছেন।
গায়ে রোঁয়া কাটল, যা আন্দাজ করেছিল, কন্ঠস্বর রাকেশ রায়ের। কুসুম চুপ করে গেল। পর্দা উঠে গেছে। মঞ্চে অনিমেষ বসু আর তিতির সেন। তিতির সেন নতুন অভিনেত্রী। তার চেয়ে বছর দুই সিনিয়র হবে। খুব ভালো রোল পেয়েছে। এই রোল পেলে সেও মঞ্চ আলো করে দিত। কিন্তু এও সত্যি, মেয়েটা জানে অভিনয়। ওর মা নামী অভিনেত্রী, রক্তেই অভিনয়। ওর দাদা মশায় ছিলেন নামী চিত্রকর। বাবা চিনত মাধব চন্দকে। তার বাবা কত কিছু করতে চেয়েছে অল্প বয়সে। মাধব চন্দের কাছে গিয়েছে বাবাদের পত্রিকা একাল-এর কভার করাতে। তিনি ছিলেন আলাভোলা মানুষ। বিনা পয়সায় চারবার পত্রিকার কভার করে দিয়েছিলেন। সেই ১৯৮৪-৮৫-র কথা। কুসুমের জন্মের কত আগের কথা। তখন বাবা মায়ের বিয়ে হয়নি। মায়ের সঙ্গে বাবার আলাপও হয়নি। মাধব চন্দের স্পন্ডিলিসিস ছিল। ঘাড় নাড়াতে পারতেন না, কিন্তু ছবির স্টাইল কী? বাবা তাকে সেই পত্রিকা দেখিয়েছে। চারটি সংখ্যার পর আর বের হয়নি। বাবার কাছে সব যত্ন করে রাখা আছে। অনিমেষ বসুর বাবাও গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা ছিলেন। কম বয়সে চলে গেছেন। বাবা তাঁর অভিনয় দেখেছে। অনিমেষ যেদিন তিতির সেনকে নিয়ে তাদের বাড়ি এসেছিল, তার বাবা বিমল সেনের অভিনয় নিয়ে অনেক কথা শুনেছিল সুমিত্রভূষণের কাছে। তিতিরের মায়ের অভিনয় শুরু চোদ্দ বছর বয়সে, তখন ক্লাস এইট। প্রথম অভিনয়েই তিনি সুখ্যাত। বাবা সেই নাটক দেখেছে। তাদের আহিরিটোলার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে বিডন স্ট্রিটের মিনার্ভা, বাগবাজারের গিরিশ মঞ্চও খুব দূর নয়। এখন অটো সার্ভিস হয়েছে গঙ্গার ধার দিয়ে, আগে তো গঙ্গার হাওয়া খেতে খেতে আসা হতো। কিন্তু বাবা যে পিছনে বসল! কেন? অদ্ভুত ব্যাপার। ভাল লাগছে না তার, নিশ্চয় জোর খাটিয়েছে লোকটা, চম্পা বলল, আপনি গিয়ে বাবাকে পাঠিয়ে দিন।
-সুমিত্রদা নিজেই পাঠিয়ে দিল কথা বলতে, জরুরি আছে। বলল সে।
আর কিছু বলা যাবে না। নাটক আরম্ভ হয়ে গেছে। চম্পা নাটকে মন দিল। দিতে চেষ্টা করতে লাগল। পাশের লোকটা রাকেশ তার ফটোগ্রাফার। যাবে বলেও আজ ওর স্টুডিওতে ফোটোশ্যুটে যায়নি সে। লোকটা অনেকবার ফোন করেছিল। কুড়িটা মিসড কল হবে। লাল হয়ে রয়েছে মোবাইল ফোনের কল লিস্টের একটি রেখা। সে মনে মনে উদ্বিগ্ন হলো। বাবার বসের ব্রাদার ইন ল। ইস, কেন যে সে গিয়েছিল ওর ওখানে? লোকটা খুব জোর করে। কতবার যে শট নেয়। ইচ্ছে করেই নেয়। ক্যামেরার লেন্সে চোখ দিয়েই থাকে। তাকে দেখতেই থাকে। আর এক মডেল সম্পূর্ণা বলে, যে ফটোগ্রাফার বেশি লেন্সে চোখ লাগিয়ে রাখে, সে আসলে চাটে। সম্পূর্ণা নিজেকে অনেকটা নষ্ট করেছে নানা ঘাটে জল খেয়ে। তার খুব রাগ! বলে ওরা তাকিয়েই থাকে যেমন কি না নধর হরিণের দিকে তাকিয়ে থাকে বাঘ। চম্পা সরে বসল তার ডানদিকে। সম্পূর্ণার সব কথা সত্যি নয়। নেপাল মল্লিক, মল্লিক জেঠু? তিনি কি অমন করেছেন কখনো? কী স্নেহময় মানুষ তার সুইট হার্ট। নেপাল মল্লিক কত ভালো মানুষ! কুসুমের ডানদিকের অভিনেত্রী তার দিকে ফিরেই আবার মঞ্চে মন দিলেন। আমি রাকেশ আঙ্কেল। কুসুম তার কানে শুনল। চুপ। সে অস্ফুট গলায় তাকে নির্দেশ দিল।
নাটক চলছিল। হারানো রেকর্ড খুঁজে বেড়াচ্ছে মধ্যবয়সী একটি মানুষ। অনিমেষদা সেই চরিত্রে। আসলে এ এক আশ্চর্য ট্রাজেডি। রেকর্ড খুঁজতে গিয়ে যে মেয়ের কাছে পৌঁছয় সেই লোকটি, সেই মেয়ের প্রেমিক নিহত হয়েছে হিংস্র কিছু মানুষের হাতে। মেয়েটির বাবা ছিল সেই গায়ক। মেয়েটি তার প্রেমিকের কথাই শুধু বলে যেতে থাকে। খুব দুঃখের সেই কথা বুঝি মাড়োয়া রাগের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে অন্ধকার অডিয়েন্সের ভিতর। তিতির সেন অপূর্ব অভিনয় করছে। রোলটা কত ভালো। অনিমেষদা অভিনীত আলাভোলা চরিত্রটি ঠিক যেন সুমিত্রভূষণ, তার বাবা। বাবা পুরোন গান ভালবাসে। বাবার কাছে কত সিডি আছে! কত পুরোন পুরোন রেকর্ড আছে। ছবিও তুলত বাবা। এখন শুধু চাকরি করে। বাবাই এই লোকটার স্টুডিওর সন্ধান দিয়েছিল তাকে। প্রথম দর্শনে কেমন যেন মনে হয়েছে। দু সেশন শ্যুট করে আর যাবে না মনে মনে ভেবেই নিয়েছে। ফোটোগ্রাফার যেমন লেন্সের ভিতর থেকে দ্যাখে মডেলকে, মডেল কি তাকে দেখতে পায় না? তার চোখ? লোকটার হাত খারাপ না ভালো তা সে বোঝে না, তবে তার মনে হয় এই রাকেশ একটা ঝুঁকি নেয়। আসলে তেমন পারে না। অনেক ছবি তুললে কয়েকটা ভালো হয়ে যায়ই। ক্লিকের পর ক্লিক। কিন্তু টাকার জোর খাটায়। টাকা দিচ্ছি করে দাও। খোলামেলা শ্যুট করে দাও, অনেক পাবে। ফটোগ্রাফার যেমন চায়, তেমন করতে হবে তো। আমি তো সব কিছু ঢাকা ব্রাইডাল ফোটোশ্যুট করি না। অত রাখাঢাকা ছবি কেউই পছন্দ করে না গয়না আর শাড়ির দোকান ছাড়া। আমি চাই অন্য ছবি। ইন্টিমেট ফোটো, ফ্যাশন ম্যাগাজিনে যাবে। ডিও কিংবা হেয়ার রিমুভারের বিজ্ঞাপনে যেমন থাকে। বড় বড় বিজনেস টাইকুনরা ছবি কালেক্ট করে। যত ওপেন করবে তত টাকা। সিক্রেসি থাকবে। সে যাবে না আর তা ঠিকই করে নিয়েছে। এই লোকটার মুখে একটা ক্রুরতা আছে। অথচ নিবোর্ধ মুখ। কী রকম হাসে। কী রকম তাকিয়ে থাকে? কীভাবে কথা বলে!
দৃশ্য বদল হচ্ছে, তখন লোকটা জিজ্ঞেস করল, কবে যাবে চম্পা, দামী কাজ আছে?
-আপনি নাটক দেখতে দেবেন?
-তুমি বলে দাও, ফোনে কন্ট্যাক্ট হচ্ছে না তো, ধরছ না।
-সময় হবে না। চম্পা বলল।
-সময় করতে হবে একটু, আমি একটা বড় জায়গার অর্ডার পেয়েছি, তুমি সব শোনো আগে, তোমাকেই করতে হবে।
নাটক আরম্ভ হয়ে গেল। বড় জায়গা মানে? কুসুম মনে মনে কথাটা চালাতে লাগল। বড় জায়গা বলে আসলে কোনো জায়গাই হয় না। মিথ্যে কথায় চারপাশটা ভরে আছে। ছোট জায়গাই বড় জায়গা হয়ে যাচ্ছে। চান্দ্রেয়ী সেদিন ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছে, কী ভয়ানক সব মানুষ, পৃথিবীটাকে নোংরা করতে একদল বসেই আছে।
উত্তর দিনাজপুরের মেয়ে চান্দ্রেয়ী নতুন এসেছে ফোটোশ্যুটে। আর নতুন কারো সন্ধান পেলে ছোট ছোট স্টুডিও তাকে ডাক দেয়। দালাল লেগে আছে। নতুন মুখের কদর আছে, তাদের নিয়ে ফটোগ্রাফার এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে। সে তো তেমন কিছু জানে না মডেলিংয়ের জগত, ফ্যাশন ম্যাগাজিনের বিউটি কমপিটিশনে জিতিয়ে আনার লোভ দেখায়। মুম্বই থেকে মিয়ামি অবধি স্বপ্ন দেখায়। শোনা যাচ্ছে সেই স্টুডিও তাদের চেঞ্জিং রুমে গোপন ক্যামেরা ফিট করে রেখে চান্দ্রেয়ীর এমন ছবি তুলে নিয়েছিল যে ভয় পেয়ে মেয়েটা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল। আসলে ওই ছবি দেখিয়ে তাকে ডেয়ারিং ছবি শ্যুট করতে বলছিল স্টুডিও। অনাবৃত উরু, অনেকটা ক্লিভেজ। পরিষ্কার বলেছিল, ওপেন ইওর বুবস। অনেক পাবে। বিদেশে চলে যাবে। পর্ণতে রুচি চলে যাচ্ছে। তারা নতুন কিছু দেখতে চাইছে। ফ্রেশ ফ্রম দ্য গার্ডেন। ব্যক্তিগত সংগ্রহ, অনেক দাম দিয়ে কেনে। কেউ জানবে না। মেয়ের কান্নায় রুখে দাঁড়িয়েছিল তার বাবা মা। পুলিশে যাওয়ার ভয় দেখাতে তবে রক্ষে। ছবি নাকি তাদের সামনেই ডিলিট করেছে। কিন্তু ডিজিটাল ফোটো সত্যি কি ডিলিট হয়? জানে না কেউ। ডিজিটাল ছবি অবিনশ্বর। কোথাও একটা লিংক থেকে গেলে তা আবার ছড়িয়ে যেতে পারে ভাইরাসের মতো। আগেকার দিন ভালো ছিল, ছবির নেগেটিভ নষ্ট করে দিলে সব শেষ। ছবির কপিও উদ্ধার হতো। ডিজিটাল ছবি তো বাতাসে ভাসে। চম্পার ছবি বাতাসে মিশে আছে চম্পা জানে। সেই চান্দ্রেয়ীই বলছে তার ছবি বেঁচে আছে মনে হচ্ছে। ভয়টা লেগে আছে মনে। কোথায় ভেসে আছে কে জানে। একটা অদ্ভুত লোক তাকে ফেসবুকের ইনবক্সে মেসেজ করেছিল, সুন্দরী, তোমার ছবি দেখবে?
রাকেশ চাপা গলায় বলল, ছবি দেখেই তো তোমাকে দিয়ে কাজ করাতে বলছে।
চুপ করুন। ফিরোজা বলল। চম্পা বলল।
-নাটক ফাটকে কী হবে, আমার ভাল লাগছে না, বলে দাও। লোকটা তার দিকে ঝুঁকে এল। নিঃশ্বাস ফেলল তার গায়ে। ইস! সে যে গিরিশ মঞ্চে নাটক দেখতে এসেছে কে জানাল? বাবা? বাবার পেটে কথা থাকে না। বাবা খুব ভীতুও। অনিমেষ বসু বাবাকে নাটক দেখতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, আহ্লাদ করে বলেছে বোধ হয়। নাটক আরম্ভ হলো আবার। লোকটা স্থির। হাতে মোবাইল জ্বলে আছে। মঞ্চে ওর চোখ নেই, মোবাইলে মেসেজ দেখছে। সরে এল রাকেশ। মনে হচ্ছে তাকে টাচ করতে চাইছে। তাই কি? বুঝতে পারছে না চম্পা। দুই ক্ষেপে চারদিন ওর স্টুডিওতে শ্যুট করেছে সে। লোকটা শুধু সময় নষ্ট করে। ছবি তোলে আর মুছে দেয়। সন্দেহ আছে মুছে দেয় কি না। লেন্সের ভিতর দিয়ে দেখেই যায়। অদ্ভুত লাগে তার। তার অন্য ফটোগ্রাফার নেপাল মল্লিক জেঠু কিন্তু জাস্ট একবারই দেখে নেয়। তারপর ক্লিক। ক্লিক করতে এত ভ্যানতাড়া করে না। শো আরম্ভের মিনিট পাঁচ সাত পর থেকে বাবার ফোন বারবার কেঁপে উঠছিল যে তা চম্পা দেখেছিল। বাবা কেটে দিয়ে দিয়েও যখন দেখল এসেই যাচ্ছে কল, তখন মেসেজ করল। মেসেজ চলছিল। নাটক দেখবে না মেসেজ করবে? মানে এই লোকটাই পেছন দিকে বসে নাটক না দেখে বাবাকে ডিস্টার্ব করে গেছে এক নাগাড়ে। বাবা তাই ইন্টারভালের সময় তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। তারপর সে বাবাকে পিছনে বসিয়ে নিজে চলে এসেছে এখানে। বাবা কেন রাজি হলো? বাবার মুখটা ভেসে উঠল চম্পার সামনে। বাবাকে এই রাকেশ ইন্টারভালের আগে দেখতে দেয়নি নাটক, এখন কি বাবা দেখতে পারছে রাকেশ তার পাশে এসে বসায়? ফিরোজা ফিরোজা ফিরোজা তার নাম দিয়েছিল সেই রুহিতন বড়ুয়া। তাকে চোখে দ্যাখেনি সে। ফেসবুক থেকে হোয়াটস অ্যাপে এসেছিল সে। সেদিন হলদি নদীর ধারে মাঠের ভিতর বসে কত রাত অবধি ছিল তার কথা। চম্পা তার আহিরিটোলার ঘরে। সেই কথা আচমকা গেল থেমে। তারপর কী হয়েছে আন্দাজ করতে পারে মেয়ে। মদ্যপ কালীভক্তরা বেরিয়েছিল বলির পশুর খোঁজে। তাকে পিটিয়ে মেরেছে টাকা আদায় না করতে পেরে। খবরের কাগজে এমন একটা খবর এসেছিল। হায় ভগবান! বাঘেরা অন্ধকারে শিকারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। এই লোকটা নাটক দেখছে না, ফোনে খুটখুট করছে। মেসেজ করছে। ফোন ঘাঁটছে। হোয়াটস আপ, ফেসবুক কি মেসেঞ্জার। প্ল্যাটফর্ম আছে, আরো কত কমিউনিকেশনের অ্যাপস আছে। অদ্ভুত, এমন সুন্দর নাটক, হল স্তব্ধ হয়ে আছে, মুগ্ধ হয়ে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে সকলে, কিন্তু এই লোকটা দেখছেই না। মোবাইলে যেন কাদা পাঁক ঘেঁটেই যাচ্ছে। মনে হয় তার বাবাকেই মেসেজ পাঠিয়ে যাচ্ছে। বাবা কি মোবাইল বন্ধ করেনি এখনো? বন্ধ করলে লোকটা মেসেজ পাঠানো বন্ধ করত। নিশ্চয় উত্তর পাচ্ছে। সে কি উঠে যাবে এখান থেকে? মোবাইল নিয়ে খুটখুট খুব ডিস্টারবিং। একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। আলোটা তো চোখে পড়ছে। তার চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। সে নাটকে মন দিতে চাইছে, অথচ লোকটা হতে দিচ্ছে না।
দৃশ্যান্তর হলে লোকটা বলল, ডেটটা বলো, দেরি করলে হবে না।
সে জবাব দিল না। মুখটা ঘুরিয়ে নিল। লোকটা বলল, তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কর।
-নাটক শেষ হোক। চম্পা বলল।
-মেসেজ করো। ভারি গলায় আদেশের সুর।
-না, চুপ করুন।
-তোমার বাবা তোমাকে মেসেজ করেনি?
সে জবাব দেয় না। সে মোবাইল সুইচড অফ করে রেখেছে। বাবা তা জানে, বাবা কেন মেসেজ করবে? লোকটা বলল, ফোনটা দ্যাখো, সুমিত্রদা লিখেছে মেসেজ দিয়েছে।
-আচ্ছা আপনি চুপ করে থাকতে পারছেন না? বিরক্ত হলো চম্পা।
-আমার এত সময় নেই যে আড়াই ঘন্টা নষ্ট করব, কাজ আছে।
চুপ করে থাকাই ভালো। কথা বললে রাকেশ উৎসাহিত হয়ে পড়ছে। নাটক আবার আরম্ভ হয়ে গেল। জাদুকর ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ম্যাজিকে অতীত সামনে চলে আসছে। সেই ছেলেবেলার বন্ধু। বন্ধু হারিয়ে গেছে। সেই বন্ধু গানের ভিতর দিয়ে ফিরে আসছে। আহা! লোকটা অস্ফুট মন্তব্য করল, বোগাস!
মনে হচ্ছে ঠাটিয়ে একটা চড় কসিয়ে দেয়। চাবকে চামড়া ছাড়িয়ে নেয়। যেমন লিখেছিল বনগ্রামের দোয়েল ফেসবুকে। দোয়েলের মতো রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু কিছু করার উপায় নেই। লোকটা বাবার বসের আত্মীয়, তার উপর বড় স্টুডিওর মালিক। ক্ষমতাবান ফটোগ্রাফার। অনেক যোগাযোগ। মডেলিং করতে হলে এদের সামলে চলতে হয়। সে শুধু মডেলিং তো করবে না, থিয়েটারের অভিনেত্রী হবে। সিনেমায় হলে হবে, কিন্তু থিয়েটার তার টার্গেট। নটী বিনোদিনী থেকে কেয়া চক্রবর্তী। কেয়াকে নিয়ে সে গবেষণা করবে। লোকটা বলে উঠল, ধুস, আমি চলে যাই, বাবার মেসেজটা পড়বে?
-হ্যাঁ তাই ভালো। বলল চম্পা।
সে জবাব দিল না। বাবা যে কেন লোকটার কথায় সায় দিল। তাকে না বলে বাবা তার পাশে লোকটাকে কী করে পাঠিয়ে দিল? নাটক শেষের দিকে। লোকটা চাপা গলায় বলল, মেসেজ দিলাম তোমাকে, জবাব দাও।
চম্পা বলল, চলে যাবেন বললেন যে।
-না, পুরোটা দেখে যাই। বলে আবার ঘাড় নিচু করে সে মোবাইল খুটখুট করতে থাকে। চম্পা শক্ত হয়ে বসে থাকে। তার মনে হচ্ছে একটা হাত এবার তাকে স্পর্শ করবে। নাকি করবে না? ও লেন্সের ভিতরে চোখ রেখেই……উহু, মিঃ জয়সোয়াল তার অনেক ছবি তুলেছিল প্রণয়িনী ম্যাগাজিনের বিউটি কমপিটিশনে। চিফ একজিকিউটিভ অফিসার জয়সওয়াল অফার দিয়েছিল, অফার অ্যাকসেপ্ট করলেই সে পর পর মুম্বই হয়ে চলে যাবে সেসেলস আইল্যান্ড, মিস ইউনিভার্স। অফার দেওয়ার সময় তার কাঁধে হাতররেখেছিল। সরাসরি তার স্তনের প্রশংসা করেছিল। বুবস আর টু অ্যাপেলস। লেগস এবং হিপস তোমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। সেদিন ওপেন শোল্ডার ফোটোশ্যুট হয়েছিল। কস্টিউম চেঞ্জ হয়নি। তাকে ডেকেছিল মিঃ জয়সোয়াল। জাস্ট দুদিনের ট্যুর গোপালপুর অন সি, ছবি তুলবে তার। সে একা যাবে জয়সোয়ালের সঙ্গে। কোনো ভয় নেই। তখন মনে হয়েছিল, সে বাঘের খাঁচায়। পরে শুনেছিল, অমন অফার নাকি পাওয়া সহজ নয়। সকলে অফার পেতে মুখিয়ে থাকে। মিঃ জয়সোয়াল নাকি খুবই কো-ওপারেটিভ। খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, হে হে হে। তবে অফার অ্যাকসেপ্ট করেও কিছুই না পেয়ে ফেসবুকে রাগ প্রকাশ করেই শান্ত হয়েছে অনেকে। দোয়েল এখন আর ফেসবুকে আসে না। দূরে চলে গেছে বিয়ের পর। নাটক শেষ, পর্দা নেমে আসছে। হাততালিতে গমগম করছে হল। রাকেশ উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, চল, কথাটা সেরে নিই।
-ওয়েট, আমি গ্রিন রুমে যাব।
রাকেশ যেন দাঁতে দাঁত ঘষল। আবার পর্দা উঠছে। হতবুদ্ধি রাকেশ দেখল কেউ বের হচ্ছে না। কিন্তু সে দাঁড়াবে কেন, নাটকের পরও আবার কেন? চম্পা মঞ্চের দিকে তাকিয়ে। সে ক্রুদ্ধ চোখে তাকায় চম্পার দিকে? চম্পা নয় ফিরোজা। সেই নিহত রুহিতনের দেওয়া নাম। মঞ্চে অভিনেতা অভিনেত্রীরা। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে অনিমেষ বসু। হাততালিতে হল ভেঙে পড়ছে। রাকেশ জিজ্ঞেস করল, দেরি হবে?
-হুঁ, আপনি চলে যান।
-সময় নষ্ট করলাম, টেল মি দ্য ডেট। চাপা গলায় গরগর করল যেন লোকটা। চম্পা জবাব দিল না। ওক্কে… রাকেশ বেরিয়ে যেতে থাকে। চম্পা ঘুরে তাকায়। ওই তো বাবা। বাবাও হাততালি দিচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিল চম্পা। সুমিত্রও মাথা নামিয়ে নিল মেয়ের দিকে তাকাতে না পেরে। সে বেরিয়ে এল সিট থেকে। গ্রিন রুমে গিয়ে তিতিরদি আর অনিমেষদাকে অভিনন্দন জানাবে। তখন গজরাতে গজরাতে সুমিত্রভূষণের হাত ধরে টানল রাকেশ, আরে মশায়, আপনি বলেননি ওকে, কিছুই তো জানে না।
-রাতে বাড়ি গিয়ে বলব। সুমিত্রভূষণ বলল।
-মেসেজ দেননি? জিজ্ঞেস করে রাকেশ, গলার স্বরে চাপা রাগ।
বাইরে এসে সুমিত্র স্বাভাবিক হতে চায়, সিগারেট ধরায়, দিয়েছি তো।
-আপনার মেয়ে কি মেসেজ দ্যাখেনি?
-বাড়ি ফিরে দেখবে হয়তো, সুইচড অফ করে নাটক দ্যাখে তো। সুমিত্র নরম গলায় বলল।
-টাকাটা কি এমনি দিলাম বলুন। রাকেশ গরগর করে।
-আপনি বরং নিয়ে যান টাকা, ও কী করবে জানি না। সুমিত্র বলল।
-নো, ওকে দিয়েই করাতে হবে কাজটা, মুখটা সুন্দর যে, অ্যাট্রাক্টিভ ফিগার, মডেলিং করে যখন আমার কাজ করবে না কেন? বলতে বলতে রাকেশ তার কিং সাইজ দামী সিগারেট বের করে মুখে নিয়ে বলে, গ্রিন রুমে গেল, অদ্ভুত মেয়ে, আপনার মেয়ে এত অহঙ্কারী!
-না না, ও অহঙ্কারী নয়। বলল সুমিত্র কোনো রকমে।
-কী ভাবে বলুন দেখি। রাকেশ বলল, রাস্তায় কত সময় দাঁড়াব?
-এখুনি আসবে। বলল সুমিত্রভূষণ, চলে আসবে।
-বিশ্বাস হয় না, সকাল থেকে ফোন রিসিভ করেনি, এখন গ্রিন রুমে, আচ্ছা থিয়েটার নাটক এসব কেন করে লোকে? রাকেশ বলল, চম্পা একটা কথা বলল না, বোরিং, ওকে চেঞ্জ করতে হবে, নইলে ও অসুবিধেয় পড়বে, কাল যেতে বলবেন, আমি যাই।
-আর একটু দাঁড়ান, চা খাই চলুন।
-না, সানসেটের পর আমি চা খাই না, আপনি ড্রিঙ্ক করেন?
-মাঝে মধ্যে।
-আমার টাইম পেরিয়ে গেছে, মাথা ব্যথা করছে, যাই। বলে রাকেশ তার গাড়ির দিকে হাঁটে, ঠিক তখনই চম্পা বেরিয়ে আসে রাস্তায়, ডাক দেয়, বাবা, ও বাবা।
চম্পার গলার স্বরে রাকেশ ঘুরে এল, হলো, উফ, থিয়েটার করে কি টাকা হবে, মডেলিং আর থিয়েটার এক হতে পারে?
রাকেশকে দেখেই চম্পাই এগিয়ে এসে বাবার হাত ধরে, বলে, অনিমেষদা ডাকছে তোমাকে, শুনবে, কেমন লাগল।
-আমি পরে বলব। সুমিত্র যেতে চায় না।
-না না বাবা এখনই চলো, হি ইজ ওয়েটিং ফর ইওর কমেন্ট, পুরোন গান তুমি জানো, এনি সাজেশন।
রাকেশ হতভম্ব। চম্পা টানছে বাবাকে। আজ চম্পা দারুণ সেজেছে। লাল শাদা চুড়িদার, পোড়ামাটির গয়না। কপালে লাল টিপ। ও এখন বাইশ। বাইশের যৌবনে মেয়ে ঝলমল করছে। কী দীপ্তিময়ী। রাকেশ তার এই রূপ দেখে যেন কুঁকড়ে গেছে। স্টুডিওয় তো সেজে যায় না। অর্ডিনারি কুর্তি, লেগিন্স, কস্টিউম তো স্টুডিওর। ওর এমন সাজ সে দ্যাখেইনি। এই মেয়ের পাশে বসেছিল সে সওয়া ঘন্টা। বুঝতেই পারেনি। শুধু সুগন্ধ পেয়েছিল। তাতে তার শরীরে উত্তেজনা হয়েছিল এক একবার। কিন্তু চুপ করে থাকা ব্যতীত উপায় ছিল না। মেয়েটার ভিতরে আগুন আছে। রাকেশকে চম্পা বলল, বাবাকে ভিতরে ডাকছে, আপনি বরং চলে যান, পরে কথা হবে।
রাকেশ কোনোক্রমে বলে উঠল, কথা আছে।
-তাহলে ওয়েট করুন।
রাকেশ কেমন যেন হয়ে গেল, বলল, আচ্ছা ওয়েট করছি।
-ওক্কে, মিনিট পাঁচের ভিতরে আসছি, বাবা এস। সুমিত্রভূষণকে টেনে নিয়ে যায় চম্পা। রাকেশ সরে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়ায়। সুমিত্র যেতে যেতে বলল, নাটকটা আমি ভাল করে দেখতেই পারলাম না চম্পা, সারাক্ষণ মেসেজ আর মেসেজ, জবাব দিতে হয়েছে, ফোনও করেছে, ভাইব্রেট করে গেছে ফোন, নাটক দেখব কি মা, ও নিজে দ্যাখেনি, আমাকে দেখতে দেয়নি, আমি ভেতরে যাব না।
-আমি জানি বাবা, ডিস্টার্বিং, সারাক্ষণ মোবাইল খুটখুট…।
-তাহলে নিয়ে এলি কেন?
চম্পা হাসে, ওপাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে যাব বলে তোমায় ডেকে আনলাম, ও দাঁড়িয়ে থাকুক, টাকাই সব না, তা আমায় তো বুঝিয়ে দিতে হবে বাবা।
গুটিয়ে গিয়ে সুমিত্র চুপ করে যায়। চম্পা কি টের পেল? নাকি ও নাটক দেখতে দেখতে বলে দিয়েছে সব? তা ব্যাগে সব আছে। টাকাটা নিয়ে ফেলেছে যে। মেয়ে জানে না। সে জিজ্ঞেস করে, ও কি কিছু বলল তোকে?
-কী বলবে, নাটক দেখার সময় কথা বলতে দিইনি!
-চুপ করে বসে থাকল?
-ইয়েস বাবা, কিন্তু এসব জিজ্ঞেস করছ কেন?
চুপ করে গেল সুমিত্র। চম্পা ওকে অপছন্দ করছে কেন বোঝে না। শেষে জিজ্ঞেস করে, ও কি খারাপ ব্যবহার করে তার সঙ্গে?
-না, বেশি ভালো ব্যবহার করে, বাবা।
সুমিত্র বলল, চুক্তি করতে এসেছে।
-আসুক, কিন্তু এখানে কেন?
-তুই কথাটা বলে আয়।
চম্পা বলল, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি চলে যেতে, আজ কথা হবে না। বলে সে মোবাইলে যোগাযোগ করল রাকেশের সঙ্গে, আমাদের দেরি হবে, থিয়েটার নিয়ে আজ কথা হবে অনিমেষ বসুর সঙ্গে, আমি পরের নাটকে থাকব, আপনি চলে যান স্যার, কী! ওয়েট করবেন, ওক্কে, করুন, খুব তাড়াতাড়িই আসছি।
লোকটা দাঁড়িয়ে থাকল। মেয়ে তার বাবাকে নিয়ে অটোয় চাপল গঙ্গার ধারে গিয়ে। ওপারে শহরের আলো, এপারের শহরের মেয়ে দ্যাখে। আকাশে মেঘ এসেছে কদিন ধরে। শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেঘের দল। এখন যদি নামত জল! সুমিত্র কিছু বলতে পারছে না। টাকাটা সে কী করবে? মেয়ে গুনগুন করছে লতা মুঙ্গেসকরের গান, রহেনা রহেনা হম ……। ভাইব্রেট করছে সুমিত্রর ফোন। মেয়ে গান গেয়ে গেয়ে ফিরছে। কী করবে সুমিত্র? ফোনটা রিসিভ করবে কীভাবে, চম্পা যে গেয়েই যাচ্ছে। কী মধু ওর গানে। গিরিশ মঞ্চের রাস্তায় লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। খুব জেদি, একরোখা। সঙ্গে তিন চারটে ফোন। একসঙ্গে সব চালিয়ে দেয়। দুকানে ফোন নিয়ে কথা বলে। কুসুম গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার ওই ইডিয়ট রাকেশ?
-হ্যাঁ। বলতে গিয়ে গুঙিয়ে ওঠে সুমিত্র। তারই লোক তো। সে পাঠিয়ে দিল মেয়ের কাছে। ব্যাগে টাকা। ব্যাগ বুকে চেপে ধরল সুমিত্র। স্পর্শ করল সেই জায়গাটা। ঘাড় হেট করে বসে আছে সুমিত্র। সে কি বলবে মেয়েকে? মেয়ে কি শুনবে তার কথা? তার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে রাকেশ গিয়ে বসল চম্পার পাশে। ইস! ভাবতেই খারাপ লাগছে! তার মাথা হেট হয়ে গেল। চম্পাকে কি টাকার কথা বলবে, না কি কাল ফেরত দিয়ে আসবে…? চম্পা এত টাকা অগ্রিম পায়নি কখনো। আর এত…!
চম্পা জিজ্ঞেস করল, আমি পারব বাবা?
– কী? চমকে ওঠে সুমিত্রভূষণ।
-এই নাটকে যে রোলটা তিতির সেন করেছে, সেইটা।
-তুই, কী করে হবে?
চম্পা বলল, তিতির মেগা করছে, তিন মাস করতে পারবে না, অনিমেষদা বাদ দিয়ে দিয়েছে তিতির সেনকে, থিয়েটার নিয়ে কোনো রকম সমঝোতা নয়, অনিমেষদা আমাকে দেখাতেই ডেকেছিলেন, প্রস্তাব দিলেন, বাবা পারব আমি?
তুই! হ্যাঁ হ্যাঁ পারবি মা। আনন্দে চোখে জল এসে গেল সুমিত্রর। টাকাটা ফেলে দেবে রাস্তায়। ভিখিরি নাকি তারা? কাল সে ফেরত দিয়ে আসবে।
চম্পা আবার গান শুরু করেছে, কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস, বাবা বাবা, গানটা কার গো, কে গেয়েছিল গো? তাদের অটো ছুটছিল গঙ্গার ধার থেকে ঘুরে অলি গলি দিয়ে পুরোন কলকাতা ভেদ করে। রাত হয়েছে, রাস্তা নির্জনতায় ছেয়ে গেছে। আহিরিটোলা লাঙলপোতা বাস পর পর বিশ্রামে দাঁড়িয়ে। অটো থেকে নেমে গলির দিকে এগোতে যেতেই চম্পা দাঁড়ায়, বাবা সেই লোকটা।
-কই? আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছে সুমিত্র।
-ওই যে বাবা। চম্পা তার হাত ধরেছে শক্ত করে, বলে, আরে আমি তিতিরের রোল করব, ফোটাও রাকেশ, কুকুর লেলিয়ে দিতে পারি, পালিয়ে পথ পাবে না।
-কোথায় সে, টাকাটা দিয়ে দেব।
চম্পা বলল, আমি জানি লোকটা টাকায় সব কিনতে চায়, আমি বুঝেইছি এমনি কিছু হয়েছে, আমার বাবা সিম্পল, কিছু বলতে পারেনি।
-কিন্তু সে কোথায় গেল? সুমিত্র জিজ্ঞেস করে।
-গলির ভিতরে ঢুকে গেল, একা নয়, মনে হলো জয়সওয়াল লোকটাও, আরও কেউ…। তার হাতের মোবাইল কাঁপছে, এই যে। চম্পা বাবাকে ত্র্যস্ত মোবাইল ফোন দেখায়। ভীত প্রাণীর মতো থিরথির করছে।
তাহলে? সুমিত্রর হাত ব্যাগের গায়ে। তাদের ঈশ্বর মল্লিক গলি। গলির ভিতরে গলি আছে। তার ভিতরে লুকিয়ে গেছে, ঘ্রাণ নিচ্ছে। চম্পা বলল, চলো।
-লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল?
-না, আছে, ওই যে বাবা, ওই। বলতে বলতে ইনকামিং কল কেটে দিয়ে চম্পা তার বাবার হাত ধরে টানতে থাকে। তখন সুমিত্রর মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করতে থাকে। কী ভীষণ কাঁপুনি তার। সুমিত্র বলল, এই যে আবার।
কেটে দাও, গলির ভিতরে আছে মনে হয়। তখন কুকুর ডাকল তাদের গলির ভিতরে। পরপর। রাস্তায় লুটিয়ে থাকা ঘুমিয়ে থাকা কুকুর জেগে উঠতে লাগল। তারা টের পেয়েছে কিছু। ঘ্রাণ পেয়েছে তাদের গলির প্রাণীকুল। চম্পার মনে পড়ে হলদি নদীর তীর। মোবাইলে তার কথা হয়েছিল একদিন। সেখান থেকে তারা মোবাইল রেখা ধরে ধরে চলে এসেছে এতদূর। সুমিত্রর ফোন কাঁপছে। সুমিত্র বলছে সে কল করেই যাচ্ছে। চম্পার ফোনও তাই। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে মেয়ে বলে উঠল, মা মা, তোমার ফোন বাজছে, শুনছ?
মা বলল, সে তো সন্ধে থেকেই বেজে যাচ্ছে এক একবার, চেনা না হলে আমি ধরি না রে, বাজুক, সাইলেন্ট করে দে।
আজ সমস্ত রাত মোবাইল ফোনগুলি ত্র্যস্ত হয়ে কাঁপবে। সেই কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। কুকুর ডেকেই যাচ্ছে। আজ সারারাত তারা ঘুমোবে না। তখন মেঘ ডাকল। মেঘ আর সারমেয়কুল আজ চম্পাদের গলি পাহারা দেবে সমস্ত রাত।
মুছে গিয়েও সে ফিরে এল এই রাতে। এমন এক রাতেই তো এসেছিল সে দিন পনের আগে, সেদিন পূর্ণিমা ছিল। আজ অমানিশি। তার উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কোথাও কোনো আলো নেই নদীর কূলে, কিংবা প্রান্তরে। শহরের পথের বাতি ঝিমঝিম করছে নিস্তব্ধ প্রহর গুনে গুনে। ঘুমিয়ে পড়ছিল চম্পা। মোবাইল টিং করলে সে হোয়াটস আপ দ্যাখে। হ্যাঁ, সে। রুহিতন আবার। এত রাতে জেগে উঠেছে সে। সে ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, এতদিন কোথায় ছিলে?
রুহিতন বলল, কত কষ্ট করে আবার এলাম ফিরোজা চম্পা।
-এলে কই? ঘুম কাটতে লাগল চম্পার, একে কি আসা বলে?
-এই তো আমি। রুহিতন বড়ুয়া বলল, ও চম্পা, স্বর্ণচাঁপা ফুল।
-বলো গো।
-আমি কত কষ্ট করে এলাম আবার।
-না রুহিতন না। কুসুমের গলায় অভিমান।
-না কেন চম্পা? রুহিতন জিজ্ঞেস করে।
মেয়ে বলল, শুধু মোবাইল, হোয়াটস আপ, ফেসবুকে হবে না, রক্ত মাংসের তুমি এস একবার, দেখি তুমি সত্যিই তুমি কি না।
-আমি তো অনেক গিয়েছি চম্পা, তোমাদের বাড়ির গায়ে লেখা ১৯১২, রবীন্দ্রনাথ তার পরের বছর নোবেল প্রাইজ পান, বাড়ির নাম সপ্তগ্রাম ভবন, শাদা পাথরের ফলকটা ফেটে গেছে, বাবাকে বদলে দিতে বলো।
-জানি, বাবা বলেছে বদলে দেবে ফলকটা, আর সেই ১৯১৩-য় আমার প্রপিতামহ বারণচন্দ্র পাড়ায় পান্তুয়া বিলি করেছিলেন রবি ঠাকুরের নোবেলের খবরে, সাররাত ধরে পান্তুয়া বানানো হয়েছিল।
-তুমি তা লিখেছিলে ফেসবুক স্ট্যাটাসে। বলল রুহিতন।
-এ বাড়ি তো তাঁর করা, আমাদের বাড়ি থেকে জোড়াসাঁকো পায়ে হাঁটা পথ, কত লোক যাচ্ছে সেইদিকে সেদিন, কিন্তু কবি ছিলেন তখন শান্তিনিকেতনে মনে হয়। চম্পা বলে, টেলিগ্রাম শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল, আর কলকাতায় খবর এল দুদিন বাদে।
-হুঁ, সব আমি জানি, তুমি কী পোস্ট করো ফেসবুকে তা আমি ফলো করি চম্পা, সেই জেনেই তো প্রথম গেলাম ওপাড়ায়, পঁচিশে বৈশাখের কথা। বলল রুহিতন।
-তুমি এসেছ কি না সে তুমিই জান, আমি জানি না। চম্পা বলে, না এলেও এসেছ, এলেও আসনি, এতদিন কোথায় ছিলে রুহিতন?
-নাটোরের পুরোন সেই পথে, বহুদূর গিয়েছে যে পথ। মগ্ন গলায় বলল রুহিতন।
-ওহ, তুমি যে কী একটা। বলল চম্পা।
রুহিতন বলল, হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি আমি, সিংহল সমুদ্র হতে নিশীথের মালয় সাগরে…।
-আমি সাধারণ, আমার নাচের দলের নাম সাধারণী, আমি নাটোরের বনলতা সেন নই রুহিতন, আমি তেমন কিছু নই, তুমি খুব সুন্দর কথা বলো।
-কথাগুলি সুন্দর নয়, তুমিই সুন্দর। বলল রুহিতন।
-তুমিই দ্যাখো সুন্দর, আর কেউ না। চম্পা হাসল। রূপের স্তুতি শুনতে কার না ভালো লাগে। কে না ভালোবাসে?
কথাটা এড়িয়ে গিয়ে রুহিতন বলল, নাটোরে বনলতা সেন আছে কি না জানি না, আমি তোমাদের রাস্তা চিনি, চম্পাদের গলি, ফিরোজার গলি, বারণচন্দ্রের পথ, বারণচন্দ্র এভিনিউ, সপ্তগ্রামের পথ, এ গলি থেকে সে গলি, সব রাস্তা।
চম্পা বলল, তুমি ফিরোজাই বলো, আমাকে কুসুম ডাকত কৌশিক, তার আর এক নাম মিল্টন, সে নাম মুছে গেছে।
রুহিতন বলল, সেও আমি জানি কুসুম।
-আমি কুসুম নই ফিরোজা।
আশ্চর্য! এই তো, এক পক্ষ আগে, পূর্ণ চাঁদের রাতে রুহিতন তাকে ফিরোজা বলে ডাকতে সে তীব্র আপত্তি করেছিল। তার নাম চম্পা, সে কেন রুহিতনের দেওয়া নামে সাড়া দেবে? কে রুহিতন? তাকে সে দ্যাখেইনি কোনোদিন। এমন হতে পারে তো ও আসলে ফেক আইডেন্টিটি। যুবক না হয়ে বৃদ্ধ হতে পারে, এমন কি অসুস্থ মানুষ হয় তো, রাতে ঘুম হয় না, মোবাইলে ফেসবুক, হোয়াটস আপ তার আশ্রয়, সেই অসুস্থ বৃদ্ধ কিংবা মধ্যবয়সীই হয় তো নিজের নতুন নাম নিয়েছে রুহিতন। ফেক ছবি লাগিয়ে অল্প বয়সী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে। এমন কি হতে পারে না? কে জানে? রুহিতনের সবটাই হয় তো মিথ্যে। প্রথমে তাই মনে হয়েছিল, এখন এই কৃষ্ণপক্ষ ধরে সে শুধু ভেবেছে কী হলো সেই রুহিতনের? আর তাকে ডাকে না কেন? ফেসবুকে তার প্রোফাইলে গিয়ে দেখেছে একেবারে নিশ্চুপ। কোনো পোস্ট নেই। সেই পূর্ণিমার আগে লিখেছিল, সপ্তগ্রাম থেকে নৌকোয় সরস্বতী নদীর উজানে সে যাচ্ছে রূপনারায়ণের কুলে। গন্তব্য মীরপুর। পর্তুগীজ গ্রামে গিয়ে দেখা করবে বুড়ো নাবিক পেদ্রুর সঙ্গে, পেদ্রু ১৮২২ সালে লিসবোঁয়া থেকে নৌকোয় করে সুন্দরবনে এসেছিল আটলান্টিক পার হয়ে একদল কাছিমের পিছু পিছু। কেউ বলে কাছিমের পিঠে চেপেই এসেছিল সে। অদ্ভুত! সে যেন সপ্তদশ শতকের মানুষ। তারপর আর পোস্ট নেই। কেউ খোলেনি ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। সেই রুহিতন আবার এই অমানিশি রাতে, কোনো এক নদীর কূল থেকে যোগাযোগ করেছে তার সঙ্গে। আর আজ চম্পা বলছে ফিরোজা বলে ডাকতে। রাত এখন অনেক। হোয়াটস আপে মেসেজে মেসেজে কথা হচ্ছে দু’জনের ভিতর। চম্পা মাঝে মধ্যে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছে, বদলে তার লিখন আসছে। মায়াবী বাংলা। রুহিতন বলল, তোমাদের বাড়ি, ব্যালকনি, রাস্তার উল্টোদিকের বন্ধ সাইরেন পিসির বাড়ি, ব্যালকনি সব আমার চেনা কুসুম। তোমাদের গলি মানে চম্পার গলির সারমেয়রা আমার চেনা, আমি যদি মাঝরাতেও যাই, তারা গন্ধ শুঁকে শুয়ে পড়বে আবার। টুঁ শব্দটি করবে না। জানে আমি তোমার জন্য এসেছি।
চম্পা বলল, তাই এস রুহিতন, আমি তোমায় সামনা সামনি চিনব।
রুহিতন বলল, চেনা তো হয়েছে আমাদের চম্পা-ফিরোজা।
-সে তো মোবাইল ফোনে চেনা, এ চেনা চেনা নয় রুহিতন।
রুহিতন বলে, তুমি আগের সপ্তাহে হলুদ শাড়ি আর লাল ব্লাউজ, বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলে তাই তো?
-তুমি দেখেছিলে? সে অবাক।
-আকাশ দেখছিলে বার বার, মেঘ করেছিল খুব, মনে আছে তোমার? -তাও জানো তুমি রুহিতন? চম্পা জিজ্ঞেস করে।
-হ্যাঁ কুসুম জানি, তুমি চাইছিলে জল নামুক, কিন্তু বৃষ্টি এল না।
-হ্যাঁ, এখনো তো বৃষ্টি নামেনি।
-কিন্তু আকাশ ভরা মেঘ, নামবে জল। রুহিতন লিখল। আর সেই বার্তা আসতেই যেন গুরু গুরু গরজে মেঘ দূর আকাশের কোথাও।
রুহিতন রুহিতন। চম্পা ভয়েস পাঠাল।
রুহিতন বলল, সেদিন বৃষ্টি ছিল না, নিদয়া আষাঢ়! খুব গুমোট, তবু সেই রাতে ঝিরঝির বাতাস হচ্ছিল আমাদের আলাপের প্রথম দিন।
-হ্যাঁ, যেদিন তুমি প্রথম সাহস করে ফোন করলে, আমি তোমার কথা জানতামই না, কেউ আমাকে অনুসরণ করে জানতাম না, কেউ আমার গলি দিয়ে আমার অজ্ঞাতে হেঁটে গেছে আমারই জন্য, জানতাম না।
রুহিতন বলল, সেদিন হাওয়াতেই আমি বেরিয়েছিলাম রাস্তায়, গেলাম মাঠের দিকে, নদী আর কতটা, কুসুম আমি আর তুমি সেদিন মনে মনে হলদি নদীর কূলে চলে গেলাম, বড় বড় নৌকো যাচ্ছিল সারি দিয়ে, সওদাগরের নৌকা।
চম্পা বলল, তুমি কী সুন্দর কথা বলো।
-তুমি খুব সুন্দর।
-ইস, আমার চেয়েও সুন্দর আছে।
রুহিতন বলল, না নেই।
-নেই, কী যে বলো তুমি! চম্পা যেন গলে যায় মোমের মতো। কী ভালো যে লাগছে!
-তুমি খুব ভালো।
-মোটেই না, তুমি নিজে ভালো, তাই সবাইকে ভালো দ্যাখো। চম্পা বলে।
-না, সবাই তো ভালো নয়। রুহিতন বলে, চম্পা তুমি গডেস অফ লাভ।
-কী যে বলো তুমি, অমন করে বলতে নেই রুহিতন।
রুহিতন বলল, গডেস আফ্রোদিতি, তুমি কুসুম কুসুম রঙের রাত্রিবাস পরেছ, তাই তো?
-তুমি যা বলবে তাই। চম্পা অন্ধকারে মোবাইল ফোনকে বলল, সেলফি দাও রুহিতন।
-এত অন্ধকারে সেলফি হবে না। রুহিতন বলল, খুব মেঘ, আলো নেই এক ফোঁটা।
-মোবাইলে কোনো ছবি নেই? চম্পা জিজ্ঞেস করে বিছানা থেকে নামতে নামতে।
– সব নষ্ট হয়ে গেছে যে, পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছিল যে। বলল রুহিতন।
-তাহলে কাল দুপুরে এস, আমি ব্যালকনি থেকে তোমায় চিনব আন্দাজে। চম্পা বলে।
-এখন ব্যালকনিতে ফোন হাতে ঘুরছ চম্পাকলি? রুহিতন জিজ্ঞেস করে।
-হ্যাঁ গো, এই আমি ঘর থেকে অন্ধকারে ব্যালকনিতে এলাম, আমাদের গলি একেবারে নিস্তব্ধ, পথের আলো কেমন নিঃসঙ্গ, নিঃঝুম, ও রুহিতন, কুকুরগুলো সবাই লুটিয়ে আছে পথের উপর, গভীর ঘুমে ঘুমিয়েছে পাড়া।
রুহিতন বলল, আমি জানি, প্রত্যেকটা রাতে এমন করে ঘুমিয়ে যায় তোমাদের গলি।
চম্পা জিজ্ঞেস করে, তুমি কোথায় আজ এখন?
রুহিতন বলে, সেই মাঠের ভিতর।
-হলদি নদীর কাছে?
রুহিতন বলে, হ্যাঁ, হলদি নদীর কাছে।
-আমি ফোন করব তোমাকে?
রুহিতন বলল, না চম্পা, ফোন আমি ধরব না, ধরতে পারব না।
-কেন, তোমার গলার স্বর শুনতে পেতাম।
রুহিতন বলল, না গো, তাহলে সেদিনের মতো হবে।
সেই যে যেদিন প্রথম ফোন আসে এই রুহিতনের, তার আগে চম্পা এর নামই জানত না। ফেসবুক থেকে তার অনেক কথা জেনে, তার পিছনে পিছনে নিঃশব্দে হেঁটে, তাকে চিনে, এই চম্পার গলি চিনে, এই একশো বছরের পুরোনো বাড়ি চিনে রুহিতন তাকে পাগলের মতো ফোন করেছিল। চম্পা যতবার ছেড়ে দিতে গেছে, পারেনি। কী মধুর কথা বলে রুহিতন। টান তৈরি হলো ঘন্টা দুই মেসেজ আর কথায়। কত রাত হলো, কথা যখন গাঢ় হয়ে আসছে, ভেসে আসতে লাগল কুকুরের কান্না……! আচমকা বন্ধ হয়ে গেল ফোন। তার পরের দিন খবর হলো ভয়ঙ্কর। সে চাঁদের আলোয় মাঠে বসে কথা বলছিল। সনাতন তার নাম। তাকে পিটিয়ে মেরেছে কারা। কিন্তু সে-ই যে রুহিতন তা না হতে পারে। আবার সেই যেন রুহিতন তাইই ভেবে চম্পা মন মরা হয়ে আছে এক পক্ষের উপর। পুরোন চাঁদ ডুবে গিয়ে আজ চন্দ্রহীন রাত। নতুন চাঁদের শুরু নতুন পক্ষে আগামী কাল। আজ আবার হোয়াটস আপে মেসেজ। চম্পা জিজ্ঞেস করল, সেদিন কী হয়েছিল রুহিতন, না বলে যে অফ হয়ে গেলে, আর সাড়া নেই।
রুহিতন বলল, কী জানি কী হলো শেষে, ফোনটা বুট পরা পা পিষে দিল মনে আছে।
-তারপর?
-আমার কাছে টাকা চাইলো, তিন হাজার, দিতে পারিনি তাই মোষ চোর বলে পেটাতে লাগল।
-তারপর কী হয়েছিল রুহিতন, বলো রুহিতন, এতদিন চুপ হয়ে থাকলে!
-আমি জানি না চম্পা। গোঙানি শোনে সে, মের না, মের না ওকে, আমার ছেলে, আমার কাছে নেই অত টাকা।
ফোন অন্ধকার। অন্ধকারে চম্পার ঘুম ভাঙে। কী নিস্তব্ধ। কুকুর ডাকছে শুধু। কোথাও নিশ্চিত কিছু ঘটে যাচ্ছে। আবার সেই কুকুরের কান্না, এক নাগাড়ে হয়েই যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে। সেই রুহিতন মহাব্রহ্মান্ডে মিশে গেছে বুঝি। চম্পা এক মৃতের ফেসবুক খুলতে থাকে মোবাইল ফোন সার্ফ করে। কত রুহিতন। তাদের ভিতরে কে ছিল সেই জন, কী করে চিনবে সে, চোখে দ্যাখেনি কোনোদিন। চম্পার বুক উথলে চোখ ভিজে যেতে যেতে মনে পড়ল মল্লিকাদির কথা। আমিও পারব মল্লিকাদি। তোমার মতো পারব, শুধু ভালো একটা রোল চাই। পেয়ে গেছি। আমি সব ছেড়ে দেব থিয়েটারের জন্য। আমি সব ছেড়ে দেব রুহিতনের জন্য। আমি জানি মঞ্চে পা রাখলেই রুহিতন তাকিয়ে থাকবে অন্ধকার অডিয়েন্স থেকে। থেতলান মুখ, রক্তাক্ত রুহিতন আমাকে দিয়ে অ্যাকটিং করিয়ে নেবে। অভিনয় অভিনয়। কেউ চায়নি সে অভিনয় করুক, শুধু রুহিতন। রক্তাক্ত রুহিতন। মৃত রুহিতন। আমি পারবই পারব। তোমার জন্য পারতেই হবে আমাকে, ও রুহিতন।
চম্পাকলির দাদু নাকি কবিতা লিখতেন। জিজ্ঞেস করলে লজ্জা পান, ও কিছু না। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবসে জোড়াসাঁকো থেকে তাঁর শবযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন একটি স্বর্ণচাঁপা তাঁর পায়ের কাছে রাখবেন বলে। শ্রাবণ মাস ছিল তো। কিন্তু তিনি পারেননি। ঠাকুরদা বলেন, খুব ভীড় আর বিশৃঙ্খলা, রবি ঠাকুরের নাগালই পাননি। আশ্চর্য, সেই স্বর্ণচাঁপা গাছটি রবিবাবুর প্রয়াণের পর শুকিয়ে গিয়েছিল আপনা আপনি। দাদুর কথা শুনে চম্পার চোখে জল। তারপর চম্পা জন্মালো পঞ্চাশ বছরেরও তিন বছর পরে। দাদু একটা স্বর্ণচাঁপা আবার নিয়ে এসে তাদের বাড়ির সমুখে পুতেছিলেন। সেই গাছও শুকিয়ে গেছে। স্বর্ণচাঁপা ফুল নিয়ে চম্পা কতদিন কৌশিককে দিয়েছে, এই ফুলের গন্ধ নাও, ফুরোয় না।
কতদিন আগের কথা তা। এখন এই দম আঁটা অফিসে বসে মনেও করতে পারে না তা কতদিনের। চম্পা যে কারণে ছেড়েছে কৌশিককে, অফিস তা ঘটিয়ে দিচ্ছে। আমার একদম ভাল লাগে না বাবা, আমার সমস্ত স্বপ্ন শেষ করে দেবে এরা।
জয়েন করার আগে বলেছিল, ১০টা থেকে ৬টা, আট ঘন্টা ডিউটি। শনি রবি ছুটি। অফিস ক্যামাক স্ট্রিটে। তাহলে তার রিহার্সালে কোনো অসুবিধে হবে না। আর শো-এর দিনে সে একটু আগে বেরোবে, পরের দিন সেই সময়টা পুষিয়ে দেবে বেশিক্ষণ থেকে। কিন্তু আটটা – সাড়ে আটটার আগে অফিস শেষই হয় না। সাড়ে পাঁচটা থেকেই যেন কাজের পাহাড় এসে জমা হয়। নিউ অ্যারাইভাল ডাটা এনট্রি কমপ্লিট করো, নেটে দেখে নাও ফলতা রায়পুরে হোটেল র্যাসিডনের রিভার ফেসিং এক্সিকিউটিভ রুম, টু রুমস, বুক করে দাও মিঃ এস কুলকারনির নামে, ১৫ আর ১৬-ই ফেব্রুয়ারি। আহমেদাবাদের একটা মেইল ছিল, রিপ্লাই করো। ড্রাফট আমার কাছে প্লেস করো। বড় একটা অর্ডার আসবে রামমোহন ফাউন্ডেশন থেকে, খোঁজ নাও অনলাইন…… এমনি কত কাজ। আর ক্যালকুলেশন তো আছেই। কুসুমের একদম ভাল লাগে না। কিন্তু ছেড়ে দেওয়াও কঠিন। ছমাস বাদে কনফার্ম হলে কুড়ি হাজার হয়ে যাবে স্যালারি। এরা ইংরেজি বইয়ের ব্যবসা করে। শো-রুম বন্ধ হয় রাত আটটায়। আটটা অবধি তাই ছলে বলে আটকে রাখে অফিসে। বুক শপ এবং পাবলিশিং বলে চাকরিতে ঢুকে দেখছে বস কেন অফিসের বাকি দশজনেরও বই নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। বই নয়, সিনেমা নয়, নাটক তো নয়ই। সকলেই চেষ্টা করে যাচ্ছে একে অন্যকে ঝামেলায় ফেলতে। কেউ যদি ভুল করে, বিশেষত চম্পা যদি ভুল করে তখন নন্দিতা, সৃজনী, বলাকারা তাই নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে দেয়। চম্পা নাটক করে, অভিনেত্রী, তা শুনে সকলেই বলেছে, এখানে কাজ করে অভিনয় হবে না। ওসব ছেড়ে দাও। ধুর, অভিনয় করে কী করবি তুই, মধুবালা হবি, নাকি রিয়া সেন হবি। ইস, থিয়েটার বলে যে অভিনয়ের আর একটা জায়গা আছে, তা ওরা জানেই না। থিয়েটার করিস, পাড়ায় কি থিয়েটার হয় আজকাল। উঠেই গেছে। শখের থিয়েটার করে তোর কী হবে, কাজ কর মন দিয়ে আর মস্তি কর। চ ডায়মণ্ডহারবার ঘুরে আসি, হুইস্কি খেয়েছিস কোনোদিন?
অটো বায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন অ্যাক্ট্রেস, মারাঠী থিয়েটারের এক অভিনেত্রীর আত্মকথা, সে বসকে বলেছিল, স্যার, বইটা আমি কত পাবো?
-বই, এই বই, কেন, কী করবে?
-নিজের কাছে রাখব। চম্পা বলেছিল।
-নিজের কাছে রেখে কী হবে? স্যার জিজ্ঞেস করেছিল, অফিসে বসে বই পড়বে?
-নো, নো স্যার, তা কেন, বাড়িতে, আমি তো অভিনয় করি।
স্যার, দিবাকর ভট্টাচার্য চুপ করে ছিলেন। আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করেননি। তাঁর মুখ দেখে মনে হয়েছিল খুব সন্তুষ্ট হননি। অভিনয়! বই সে অফিসে পড়বে কেন? পড়বে না। কিন্তু নেটে পড়লে স্যার কি বুঝতে পারবেন? নেটে সৃজনী, নন্দিতারা পানু পড়ে। হি হি করে হাসে। আরে বাংলা পানু, ইংলিশ সেক্স স্টোরিজ, এই তুই কি মেরিলিন মনরো হতে পারবি?
ওরা কিছুই জানে না। জানে কি মেরিলিনের মৃত্যুর কথা? মৃত্যু না হত্যা। হত্যা না আত্মহত্যা? বোকার মতো কথা বলে। হ্যাঁরে, থিয়েটার করে তুই কত রোজগার করবি?
হি হি করে হেসেছিল সৃজনী। সে এই চাকরি ছেড়ে দেবে। নন্দিতা বেশি তাচ্ছিল্য দেখায় তার অভিনয়ের কথায়। বসের কানে তুলেছে। তারপর থেকে ছটার আগে থেকে স্রোতের মতো কাজ আসে। বাইরে বুক শপ। বই বই আর বই। বইয়ের আলো। আরো বাইরে পার্ক স্ট্রিট। ঝলমলে আলো। হাঁটতে হাঁটতে মেট্রো। গিরিশ পার্ক। সেখান থেকে অটো বা বাসে করে মানিকতলা পেরিয়ে খালপোলের আগে নেমে এক বন্ধ হয়ে যাওয়া থিয়েটার হল, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ। অনেক বছর আগে ওই মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেখানে রিহার্সাল। তারপর রাত নটায় অটোয় উঠে আবার গিরিশ পার্ক। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে বিডন স্ট্রিট ক্রসিং। আবার অটো। শীতলাতলা। তারপর তাদের গলি। নিজেই গলিটার নাম দিয়েছে সে ওই রকম। তারপর শীতলা লেন। সাইরেন পিসির বাড়ি। পিসিকে সে দ্যাখেনি। বাবা বলে অতি বড় সুন্দরী ছিল পিসি। তার মতো রূপ চম্পারও নয়। এখন বাড়িটা যেন প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে। কোন প্রমোটার নিয়েছে, কিন্তু শরিকি গোলমালে ভাঙতে পারছে না। সাইরেন পিসি, সাইরেন পিসি, আমি অফিস ছেড়ে দেব।
প্রেতের বাড়ি থেকে সুরেলা কন্ঠস্বর ভেসে এল, অভিনয় করবি তো?
-এই অফিস করতে দেবে না।
-আমাদের কেউ কিছুই করতে দেয় না, আমি তাই বাপের বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
-জানি তো।
-কিন্তু বাবা বলল, না আমাকে ওখানেই ফিরে যেতে হবে।
-তাও জানি, সাইরেন পিসি, আমার বাড়ি থেকে কিছুতেই মত দেবে না, চাকরি ছাড়তে দেবে না।
পিসির বাড়িটাকে পেছনে রেখে সে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। আসলে এই কথোপকথন তার বানানো। সাইরেন পিসি আর পিসেমশায় ওই বাড়িতেই থাকতেন। ঘর জামাই হয়ে পিসে মশায় সাইরেন পিসির মনোঃপীড়ার কারণ হয়েছিলেন। বাবা তাই বলে। কিন্তু দাদু বলেছিল অন্য গল্প। সাইরেন বাপের বাড়ি ফিরে এসে এক মাস বাদে গায়ে আগুন দেয়।
অফিস সে ছেড়ে দেবে। কৌশিককে ছেড়েছে যে কারণে, অফিস ছাড়বে সেই একই কারণে। অফিস তার অভিনয় বন্ধ করে দেবে। কৌশিকও চাইত না সে অভিনয় করে। বাড়ির বউ অভিনেত্রী, তা হয় নাকি? বাড়ি পৌঁছে চম্পা শুনল, কৌশিকের বাবা ফোন করেছিল। কী সাঙ্ঘাতিক! কেন মা?
মা বলল, কথা বলতে আসবে।
-আমার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই মা। সে বলল।
-আমি জানি না, তোরা বুঝে নে।
চম্পা বলল, আমি কী বুঝব, আমি আর জড়াতে চাই না।
ওর বাবা বলল, তোদের রেজিস্ট্রি করা আছে। মা ইন্দ্রাণী বলল।
-লায়ার, রেজিস্ট্রি কে করেছে, আমি? চম্পা রেগে গেল।
-আমি তো অবাক, আমাদের না বলে তুই এতটা করলি!
চম্পা বলল, একদম মিথ্যে মা, আমার চাকরির খবর পেয়ে গেছে কৌশিক, বাবা কাকাকে বলবে বাড়িতে না ঢুকতে দিতে। আমি সান ডে সকালেই রিহার্সাল দিতে চলে যাব, সারাদিন হবে, নতুন নাটক নামছে। ফিরতে সাত-সাড়ে সাত। কী লোভী কৌশিক!
শীত এখন যাওয়ার মুখে। বসন্তের আবির্ভাব এই শহরে ধরা যায় না তাপমাত্রার পরিবর্তন ব্যতীত। এই শহরে পলাশ নেই, মাদার নেই, শিমুল নেই। চম্পা চেঞ্জ করে টেলিভিশনের সামনে বসে। সে কয়েকটা সিরিয়াল করেছে। তখনই খুব আপত্তি করেছিল কৌশিক, রবি ঠাকুরের মানভঞ্জন। সে ছিল দাসীর ভূমিকায়। কাঁধ অনাবৃত ছিল। উনিশ শতকে তো দাসীর ব্লাউজ থাকত না। প্রথম দিন দেখেই কৌশিক ফোনে বলেছিল, ছিহ! মঞ্চের কথা শুনে বলেছিল অপচয়, সমস্তটাই অপচয়। কম্পিটিটিভ এগজামের জন্য তৈরি হতে পারে চম্পা। চম্পা কী করবে তা বলে দেবে তার প্রেমিক। প্রেমিকের এত অধিকার বোধ থাকলে কি প্রেম বেঁচে থাকে? সে তার অ্যানড্রয়েড ফোনে নেট অন করল। চুপ করে বসে থাকল অনলাইন হয়ে। যদি রুহিতন এসে হাই করে? রুহিতন শর্মা। সে ছিল তার ভারচুয়াল ফ্রেন্ড। এখন আর আসে না। আসে না, কেন না সে হয়তো……। চম্পা জানে রুহিতন নেই। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পড়েই আছে একা একা। মৃতের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তো পড়েই থাকে। অন্য কারণেও পড়ে থাকতে পারে। হয় সে ফেসবুকে আগ্রহ হারিয়েছে। সে জানে, এক জোছনা রাতে হলদি নদীর তীরে একা বসে রুহিতন যখন মোবাইলে অনলাইন হয়ে তার সঙ্গে কথা বলছিল, ঘাতকের দল এসে তাকে শেষ করে দিয়ে গেছে। একটা অমন ঘটনা ঘটেছিল, তার নাম রুহিতন ছিল না। রুহিতনও নিশ্চয় নাম লুকোনো নাম। ভারচুয়াল জগতে এমনি হয়। বাবা সুমিত্রভূষণ কাকা সুচিত্রভূষণ এক সঙ্গে এল তার ঘরে, কী বলছিস তুই, রেজিস্ট্রি করিসনি?
-না বাবা না।
-ওর বাবা যে বলল, করেছিস?
-মিথ্যে, কৌশিক এখন দু’বছর বাদে আবার আমাকে মেসেজ করছে, আমি ওকে ব্লক করে দিয়েছি, আমি কিছুই করিনি, বিয়ের জন্য ও খুব চাপ দিচ্ছিল, আমি সরে এসেছি, বই আর অভিনয়, ও কোনোটাই পছন্দ করে না, একবার আমাকে দখল করতে পারলেই সব বন্ধ করে দেবে, ইস, আমি যে কী করি, অফিসও আমাকে পিষে দিচ্ছে, মনে হয় ও অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, বইয়ের কোম্পানি, অথচ আমার বই পড়া পছন্দ করে না, কেন বলো দেখি।
কাকা সুচিত্রভূষণ বলল, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি আসতে হবে না, মিথ্যে কথা বলে বাড়ির মেয়েটাকে নিয়ে যাবে, ওই পরিবারে আমরা মেয়ে দেব না, মেয়ে শান্তিতে থাকবে না।
চম্পার সামনে দাঁড়িয়েই কাকা সুচিত্রভূষণ ফোন করল কৌশিকের বাবাকে, আমি চম্পার কাকা বলছি, আপনারা আসবেন না, আমরা মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছিই না, আর আমাদের মেয়েও চায় না বিয়ে করতে, সে কোনো রেজিস্ট্রি করেনি।
কৌশিকই জবাব দিল, কথা হয়েছিল রেজিস্ট্রির, আমি তখন ট্রেনিংয়ে তিন মাস ইউ.এস গেলাম।
-কথা হওয়া আর কাজটা হয়ে যাওয়া কি এক হলো?
-আঙ্কেল, আই লাভ হার, ওকে ফোনটা দিন।
চম্পা ফোন ধরে না, বলল, বলে দাও চম্পাকলি অভিনেত্রী, অভিনয় করেছিল।
কৌশিক বলল, আঙ্কেল প্লিজ।
-ও কথা বলতে চায় না, ডোন্ট ডিস্টার্ব হার।
কৌশিক বলল, আমার মা বাবা কথা বলবে আপনাদের সঙ্গে।
-না, আসতে হবে না। বলল সুচিত্রভূষণ।
কথা শেষ হলো। কাকা নিচে চলে যেতে বাবা বলল, যা করবি ভেবে করবি, এই সময়ের এক একটা সিদ্ধান্ত তোর সমস্ত জীবনে ছায়া রেখে দেয় না যেন।
চম্পা বলল, আমি ওকে প্রত্যাখ্যান করেছি বাবা, আমি পারি, আমার মনে সেই জোর আছে।
সুমিত্রভূষণ অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতটা জীবনে কোনো মেয়েকে প্রত্যাখ্যানের কথা বলতে শোনেনি সে। প্রত্যাখ্যান করে বাড়ি ফিরে এসেছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া সাইরেন দিদি। মুখুজ্জ্যে বাড়ির বিজয়া সান্যাল। তারপর গায়ে আগুন দিয়ে মরেছিল। গায়ে আগুনের কথাই সত্য। মেয়েকে সে বানিয়ে অন্য কথা বলেছিল। আত্মজাকে কি বলা যায় সামনের বাড়ির সুন্দরী মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি থেকে ক্রমাগত অপমানিত হয়ে চলে এসেছিল বাপের বাড়ি। কিন্তু বাড়িতে সায় না পেয়ে গায়ে আগুন দিয়ে পুড়েছিল। মেয়েদের প্রত্যাখ্যান কে সহ্য করতে পারে? গা ছমছম করে ওঠে সুমিত্রর। খবরের কাগজে কত খবর বের হয়, প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক অ্যাসিড দিয়ে প্রেমিকার মুখ পুড়িয়ে দিয়েছে। লোক পাঠিয়ে রেপ করিয়ে দিয়েছে। সময় খুব খারাপ রে, চম্পা। মেয়ে তো জানে না, সাইরেনদিদির বাবা মেয়ের ‘না’ শুনে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দিয়েছিল। এখনো রাতে মানুষ পোড়া গন্ধ পাওয়া যায় যেন। সুমিত্র বলল, সাবধানে থাকিস।
অফিস, রিহার্সাল আর বাড়ি। এর বাইরে কোনো জগত নেই যেন। ঘুমের আগে রাতে সে অন লাইন হলো আবার। কৌশিককে ব্লক করা আছে। নানা নোটিফিকেশন আর কবিতার ভিতরে ঘুরছিল কুসুম। কে গিয়েছিল আঙ্কোরভাট। ছবি দিয়েছে প্রাচীন সভ্যতার। ছবি দেখতে দেখতে চম্পার চোখ জড়িয়ে আসছিল, কৌশিকের কথা মনে পড়ল একবার। বিরক্তি এল। তারপর আবার ছবি, নায়াগ্রা ফলস-এর। তার চোখ জড়িয়ে এল জল্প্রপাতের শব্দে। মেসেজ এল, কে?
-হ্যাপি ভালেনটাইন ডে, হাই চম্পা।
তার নামটাও জানে, ইস! কী করে জানল, কে তুমি? আমি তো ২২শে শ্রাবণ। তার নতুন ফেসবুক পরিচয় ২২শে শ্রাবণ। সেই আইডিতে এসে চম্পা বলে ডাক দিল কে? রুহিতন শর্মা? রুহিতন তুমি ফিরে এলে? তুমি আস না বলে আমি খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি রুহিতন, কিছুই ভালো লাগে না, অফিস আমাকে শেষ করে দেবে, আর সেই লোভী কৌশিক, আমি চাকরি পেয়েছি শুনে ছুটে এসেছে আবার, রুহিতন রুহিতন।
-ভালবাসা নাও চম্পা। রক্ত গোলাপ দিল রুহিতন।
-এত মন খারাপ ছিল আমার রুহিতন, এই নাও স্বর্ণচাঁপা। চম্পা হাত বাড়িয়ে দিল সুগন্ধ।
রুহিতন বলল, ফাগুন মাস পড়ছে, আজ মাঘের সংক্রান্তি, এখন সাধু ভ্যালেন্টাইনের জন্মদিন শুরু হলো চম্পা, এই সময় স্বর্ণচাঁপা তো ফোটে না।
চম্পা বলল, হাত ভরে নাও রুহিতন, ছ’মাস বাদে শ্রাবণে ফুটবে, ২২শে শ্রাবণ ফুটবে রুহিতন, ভালোবাসা ফুটে উঠতে সময় তো দিতে হয়।
বাহ চম্পা, ফুটলে আমি আবার মেঘের নিচে বাঁশি নিয়ে বসব, ফিরোজা চম্পা।
ঘুমের ভিতরে ডুবে যেতে যেতে মেয়ে স্বর্ণ চাঁপার গন্ধ পায়। তাদের বাড়ির গাছটি মরে গেছে বটে, কিন্তু গন্ধটি রেখে গেছে। রাতে পাওয়া যায় সারা বছর। সেই সুগন্ধ নিয়ে তার অনন্ত দিন যাপন।
এই অফিসের জানালা আছে। বন্ধ। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এর সবটাই। বাইরের আলো নেই। সব এল.ই.ডি ল্যাম্প। এই হলো চম্পার অফিস। সেক্সপিয়র বুক কোম্পানি। অফিসে বই আনা নিষেধ। নিউজ পেপারও বারণ। কিন্তু ইন্টারনেটে সব দেখা যায়। বস টের পায় না। কোথাও না কোথাও জানালা আছেই। উইন্ডোজ-টেন। গুগল সার্চ করলেই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড। অনন্ত আকাশ। নদী পাহাড় সমুদ্রেরও অতীত তা। অফিস চায় না চম্পা জানালা খুলুক। একদিন সে খুলতে গিয়েছিল, সকলে হা হা করে উঠেছিল, না না না না। একদম না। এসি রয়েছে। বাইরের বাতাসে ঘর তেতে যাবে।
তাদের নাট্যদলের শো আছে শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ নাট্যোৎসবে। ছুটির দরখাস্ত নিয়ে চম্পা গেল বসের কাছে। চারদিন ছুটি চাই। বছরের আরম্ভ। তার কি চারদিন হবে না? শীতকাল উৎসবের ঋতু। বইমেলা, নাট্যমেলা, শিল্পমেলা, গানমেলা, লিটল ম্যাগাজিন মেলা……কত মেলা লেগেছে পরপর। বইমেলাতে তাদের অফিসও স্টল দেবে। তখন সেখানে চম্পা ডিউটি নেবে। এখন তার ছুটি চাই। দরখাস্ত পড়ে বস মিঃ গোলদার বললেন, ও মাই গড, দিল্লি থেকে মিঃ কুলকারনির আসার কথা, কী করে ছুটি নেবে, কেনই বা নেবে ?
চম্পা বলল, আসুন না কুলকার্নি সায়েব, আমি সব গুছিয়ে রেখে যাব, সাইট খুললেই সব পেয়ে যাবেন উনি, স্যার আমার ছুটিটা খুব দরকার।
অমিত গোলদার বললেন, অফিসের ইন্টারেস্ট তো দেখতে হবে তোমাকে, দিল্লি থেকে সায়েব আসবেন, তখন একজন ছুটিতে, ঠিক হবে না, অফিসের ডিসিপ্লিনের একটা ব্যাপার আছে।
চম্পা বোঝে না ডিসিপ্লিনের সঙ্গে তার ছুটি নেওয়ার সম্পর্ক কী? একজন অসুস্থ হতে পারে, তার বাড়িতে খুব অসুবিধে হতে পারে, ছুটি নেবে না? কুলকার্নির শ্বশুরবাড়ি কলকাতায়। সঙ্গে অফিস ভিজিট। দুটো কাজ একসঙ্গে হয়। সবাই তা জানে। তার মানে কুলকার্নি শ্বশুরবাড়ি আসবে, ফ্যামিলি নিয়ে রায়চকে হোটেল র্যাডিসন ইন্টারন্যাশানালে ফ্যামিলি নিয়ে থাকবে দুদিন, তাই তাকে অফিসে থাকতে হবে। রায়চক থেকে কুলকারনি ভিডিও কনফারেন্স করতে পারে, তাই তাকে অফিসে থাকতে হবে। তার সঙ্গে কুলকার্নি কথাই বলবে না, কিন্তু তাকে অফিসে থাকতে হবে। কুলকার্নি দেখবে সব সিটে লোক আছে। তার মুখ কম্পিউটার মনিটরে এলেই যেন সকলে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে। যতক্ষণ সে ভিডিওতে থাকবে এমপ্লয়িজ রুমে, কেউ বসবে না, দাঁড়িয়ে থেকে নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবে।
চম্পা বলল, স্যার আপনি কনসিডার করলেই হবে।
গোলদার বলল, তুমি কি শো করতে যাচ্ছ?
-ইয়েস স্যার নর্থবেঙ্গল নাট্যমেলা।
-যদি তুমি অসুস্থ হতে কিংবা বাড়ির কেউ, কনসিডার করা যেত, তুমি ছুটি চাইছ থিয়েটার করার জন্য, হয় নাকি, অফিস তো তোমার যাত্রা-নাটকের সুবিধে দেখতে পারে না, ওসব ছাড়ো।
চম্পা বলল, আমি যে প্রধান চরিত্রে আছি, আপনি একদিন দেখতে আসুন স্যার, ফেব্রুয়ারিতে শো আছে একাডেমিতে।
গোলদার একটু কঠিন গলায় বলল, আমার অত সময় নেই, আমরা বাঙালিরা অকাজেই সময় নষ্ট করি বেশি, চাকরি না অভিনয়, কোনটা করবে তা ঠিক করে নাও।
চম্পা বাড়ি ফিরে বাবাকে বলল, কী করি বলো দেখি, অফিস আমায় ছুটি দেবে না, আমার বস ঠিক কৌশিকের মতো, আমাকে অভিনয় করতে দেবে না।
বাবা বলল, তুই চলে যাবি, মাইনে কেটে নিক না ক’দিনের।
-পাই পনের, একদিনের তো পাঁচশো হবে, আমি তাতে খুব রাজি তিনদিনের যদি না পাই।
বাবা বলল, সিদ্ধান্ত তোর, আমি কী বলব ?
-কিন্তু বাবা, ওরা ডাকবে ফোনে, পারমিশন ছাড়া স্টেশন লিভ করা যায় না, আমি ছুটির কথা বলেই ভুল করেছি।
মা বলল, যেতে হবে না শিলিগুড়ি, অভিনয় করতে হবে না, চাকরি আগে, ওসব এখন ছাড়।
কাকা সুমিত্রভূষণ বলল, আর তিন মাস বাদেই এপ্রিলে তোর স্যালারি কুড়ি হয়ে যাবে, এখন অফিসের কথা শোন, অফিস যা বলবে তা করতে হবে, তোর সম্পর্কে অফিস নিশ্চিত হলেই তো পারমানেন্ট করবে।
এখনো পনের দিন আছে। চম্পা ভাবছিল কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেবে। তার অভিনয়ের প্রশংসা হয়েছে খুব। কন্ঠস্বরের প্রশংসা হয়েছে। স্যার মানে নির্দেশক শমীক রায়চৌধুরী নতুন নাটকের মহলা আরম্ভ করবেন শিগগির। তাকে ভেবে রেখেছেন প্রধান চরিত্রে। শিলিগুড়ির পর তাদের যাওয়ার কথা আছে দিল্লি। মনে হচ্ছে অফিস ছুটি দেবে না। পরেরদিন সে আবার বসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, বলল, স্যার আপনি একটু দেখুন, ছুটি আমার নিতেই হবে।
গোলদার বললেন, অফিস তো থিয়েটারের জায়গা নয় চম্পা, তুমি ডিসিশন নাও কী করবে ?
-স্যার আমি চাকরি তো করতে চাই।
-চাকরি করতে হলে অফিসের মতো করে চলতে হবে।
-ইয়েস স্যার। চম্পার ভয় করছিল বসের সামনে দাঁড়িয়ে বাক্য বিনিময় করতে। চাকরি যদি চলে যায়? চলে যেতে পারে নাকি? বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুতানটি-শোভাবাজার স্টেশনে মেট্রোয় ময়দানে নেমে একটুখানি হাঁটা। পনের হাজার তো কম নয়। বাবাকে সাপোর্ট দেওয়া হয়। চম্পা বলল, আমি জানি স্যার।
-নিজের ডেস্কে গিয়ে বসো। স্যার অমিত গোলদার নির্দেশ দিলেন। উনি খুব বেশি সময় দেন না। সময় না দিলে সে নিজের কথাটা বলে কী করে? পাশের ডেস্কের বিজন সাহা বলল, সব এক সঙ্গে হয় না চম্পা, তুমি এখানে চাকরি করে তা পারবে না।
আমি চারদিন ছুটি পাব না? চম্পা বলল।
বিজন সাহা বলল, ছুটি কিন্তু তোমার নিজের ইচ্ছেয় হবে না, অফিস যদি চায় ছুটি নাও দিতে পারে।
-বাহ, আমার দরকারেই তো আমি পাওনা ছুটি নেব।
বিজন মাথা নাড়ে, নো, লিভ ইজ নট ইওর রাইট, অফিস দয়া করে তোমাকে ছুটি দেয়, পাওনা বলে কিছু হয় না।
চম্পা চুপ করে থাকে। বস তাঁর চেম্বারে বসে সব দেখতে পান। অফিসের সবটা ক্লোজড সারকিট টিভির আওতায়। বিজন মুখ ঘুরিয়ে নিল। চম্পা কম্পিউটারের মনিটরে তাকিয়ে। আপডেটিং তার কাজ। কিছুই ভালো লাগছে না। পনের হাজার পায় বলে কৌশিক যোগাযোগ করতে চাইছে। কৌশিক বলছে, যা হয়েছে ভুলে যাও চম্পা, আমি আবার ফিরতে চাই, আমরা এবার বিয়ে করতে পারি, খুব মন দিয়ে চাকরি কর, সেক্সপিয়র বুক কোম্পানির ব্রাঞ্চ দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বাঙ্গালুরু আছে, অ্যাব্রডেও, ইংল্যান্ডে আছে শুনেছি, তুমি অনেক উপরে উঠতে পারবে, ডিসট্যান্ট লারনিংয়ে ম্যানেজমেন্ট করে নাও, পুনের সিমবায়োসিসের ডিগ্রির খুব দাম।
চম্পা তার কাজে মন দিতে চাইল। কিন্তু মন বসছে না। সে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল,
“আমি দেখতে পাচ্ছি, রাজার ডাক-হরকরা পাহাড়ের উপর থেকে একলা কেবলই নেমে আসছে— বাঁ হাতে তার লন্ঠন, কাঁধে চিঠির থলি। কত দিন কত রাত ধরে সে নেমে আসছে। পাহাড়ের পায়ের কাছে ঝর্ণার পথ যেখানে ফুরিয়েছে সেখানে বাঁকা নদীর পথ ধরে সে কেবলই চলে আসছে— নদীর ধারে জোয়ারির ক্ষেত, তারই সরু গলির ভিতর দিয়ে দিয়ে সে কেবলই চলে আসছে—রাতদিন একলাটি চলে আসছে।
তার নির্দেশক স্যার বলেছেন, সুযোগ পেলেই সে যেন নিজে নিজে সংলাপ বলে। যে কোনো সংলাপ, যে কোনো সময়ে। সময় পেলেই। চম্পা তা করে। স্নান ঘরে, একা ঘরে, ঘুমের ঘোরেও। মা বলে, ঘুমের ভিতরে সে নাকি কথা বলে। কী কথা? মা প্রথমে বুঝতে পারেনি অমন কথা বলছে কেন মেয়ে? কে কবিরাজ, কে-ই বা পিসেমশায়, তারপরই মনে পড়েছিল, ডাকঘরের অমল। এই চম্পা, কী বলিস?
“না, না, পিসেমশায়, তুমি কবিরাজকে কিচ্ছু বলো না। এখন আমি এইখানেই শুয়ে থাকব, কিচ্ছু করব না কিন্তু যেদিন আমি ভালো হব সেইদিনই আমি ফকিরের মন্ত্র নিয়ে চলে যাব—নদী পাহাড় সমুদ্রে আমাকে আর ধরে রাখতে পারবে না।”
তাদের নাটকের ভিতরে নাটক আছে, চম্পা ‘ডাকঘর’ নাটকের অমলের সংলাপ উচ্চারণ করতে থাকে নিজ মনে। যখন তার নয়-দশ, তাকে দিয়ে ডাকঘরের অমল করিয়েছিল বাবা পাড়ার রবীন্দ্র জয়ন্তীতে। বাবা এখনো বলে, সে একটি সংলাপও ভুল বলেনি, ভুলে যায়নি। তাদের এই নাটকের ভিতর ‘ডাকঘর’ আছে। আর সেই সংলাপ তারই। বন্দী অমলের কথা আসে নাটকের প্রধান নারী চরিত্রে। চম্পা ঘাড় ঘুরিয়ে বিজনকে জিজ্ঞেস করল, তুমি ডাকঘর দেখেছ, বিজনদা?
এই প্রশ্নে বিজন হকচকিয়ে গেল, মানে?
-রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর, পড়েছ?
বিজন ম্লান হাসে, নারে, ইস্কুলের বইয়ে একটুখানি অংশ ছিল, ‘ অমল ও দইওয়ালা’, ওইটুকু।
চম্পা বলল তা দশ বছরে অমলের ভূমিকায় অভিনয়ের কথা। শুনতে শুনতে বিজন বলল, এ জীবনে আর ওসব হবে না, তুই কী করবি?
ভাবছি। চম্পা বলল, আমাকে তো যেতেই হবে শিলিগুড়ি।
-এই চাকরি করে পারবি না। বিজন বলল।
চম্পা বলল, আমাদের কোম্পানি ‘ডাকঘর’ অনুবাদ ছেপেছে, ‘পোস্ট অফিস’ জানো তা?
বিজন বলল, জানি, বেস্ট সেলিং বুক, আমার কাছে হিসেব আছে।
-আমি কী করব বল দেখি, বিজনদা? চম্পা মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আমার স্বপ্ন ভালো অভিনেত্রী হওয়া, একটু সুবিধে হলেই চাকরি ছেড়ে দেব।
-আর যদি সুবিধে না হয়? বিজন জিজ্ঞেস করল।
-তার মানে? চম্পা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
বিজন বলল, তুই কি সিনেমায় চান্স পাবি, সিরিয়াল করতে পারবি টিভিতে?
চম্পা বলল, আমি থিয়েটারই করব, আর যদি ভালো ছবি পাই, মনের মতো রোল পাই…বলতে বলতে ঢোক গেলে চম্পা, কবে তা হবে, হবে কি না বুঝতে পারছে না, সকলেই পেডিগ্রি চায়, অমুকের ছেলে, অমুকের ভাইপো, তমুকের মেয়ে, তাহলে সেই পরিচয়ে খুব তাড়াতাড়ি সুযোগ এসে যায়, নতুবা ঘষতে হয় খুব, কিন্তু স্ট্রাগলের দাম আছে, তার স্যার বলেন, একটি দুটি ভাল রোল পেয়ে যদি সে লোকের নজর কাড়তে পারে তখন আর দেখতে হবে না, তরতর করে এগিয়ে যাবে। ভালো কাজের দাম আছে ইন্ডাস্ট্রিতে। থিয়েটারও ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠছে। এক অভিনেতা নানা দলে অভিনয় করছে। আর সব দলই ভালো অভিনেতা অভিনেত্রীকে পে করে। অনিমেষ বসু সাতটি নাটক করছে এখন সাত দলে। এমন হয়েছে ম্যাটিনিতে এক নাটকে বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করে সন্ধের শো-তে অন্য নাটকে প্রেমিক। দুই নাটক দুই দলের। চম্পা তেমনিই করবে একদিন।
বিজন বলল, স্যার যদি না বলে, হ্যাঁ করাতে পারবি না, সব অফিসের বস অমন হয়।
সে চুপ করে থাকে।
বিজন বলে, তার বাবার কাছে গল্প শুনেছে, বাবার বস অকারণে অপমান করতেন তার বাবা কবিতা লিখত শুনে, কোনো কারণ ছিল না, তবুও।
চম্পা বলল, থিয়েটারে অমন হয় না বিজনদা, তবে ভুল করলে বকুনি খেতে হয়, আর ডিসিপ্লিন ভাঙলে, দেরি করে রিহার্সালে গেলে, শো-এর দিন আগে না পৌঁছলে ডিরেক্টর ছেড়ে কথা বলেন না।
-একই ব্যাপার বলতে পারিস। বস অপমান করবেই। তার হাতে যে অনেক ক্ষমতা।
-না, ঠিক এক রকম নয় বিজনদা, ডিরেক্টর যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন, অভিনয় শিখতে হয়, তিনি তো শিক্ষক। চম্পা বলল।
বিজন মাথা নাড়ে, বসও শিক্ষক, ভুল হলে দেখিয়ে দেন।
চম্পা চুপ করে থাকে। তখন বিজন বলে, বস যা বলে তা শুনতে হয়, এতে সার্ভিস সিকিওরড হয় চম্পা, আবার বস যদি অবিচার করেন, তার বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না যে তাও সত্যি।
চম্পা কথা বাড়ায় না। সে যদি শিলিগুড়ির শো না করতে পারে, তার বদলে রিমি দাশগুপ্ত ঢুকে যাবে, রিমি একবার ঢুকে গেলে পরের নাটকে কাস্টিং কী হবে জানে না চম্পা। রিমি খুব আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে চলে। চম্পা শুধু তার অভিনয় গুণে স্যারের আনুকুল্য পেয়েছে। শিলিগুড়ির পর কলকাতায় এক দিন ডাকঘর পাঠ আছে সুরম্য পালিতের বাড়িতে। অনেক বিশিষ্টজন আসবেন। চিত্র পরিচালক সুবর্ণ দত্তর আসার সম্ভাবনা আছে। সুরম্য পালিত বিখ্যাত লেখক এবং সম্পাদক। তিনি এমন আয়োজন করেন মাঝেমধ্যে। তাদের নাটক ‘বন্দিনী’র ভিতরে ডাকঘরের অংশ বিশেষ আছে সংলাপে, তা শুনেই তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তার জায়গায় রিমি ঢুকে যাবে। ইস, রিমির হাস্কি গলায় ডাকঘর পাঠ কেমন লাগবে? আর সুরম্য পালিত শুনবেন সে আর অভিনয় করে না, অফিসের হিসেব দ্যাখে। চম্পার চোখে জল এসে গেল। সে হোয়াটস আপে মেসেজ পায়, কৌশিক লিখেছে। কৌশিককে সে লিখেছিল, আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয় কৌশিক, সে অভিনয় ছাড়তে পারবে না। কৌশিক লিখেছে, চাকরি পেয়েছ, আবার অভিনয় কেন, কী হবে ঐশ্বর্য রাই? সে সিমবায়োসিসের ফর্ম অন লাইনে ফিলাপ করে কুসুমকে মেইল করছে। যে সমস্ত তথ্য সে জানে না তা যোগ করে কুসুম যেন মেইল করে সিমবায়োসিস স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টকে। ম্যানেজমেন্ট তাকে পড়তে হবেই। তাহলে ভবিষ্যত সুরক্ষিত হবে।
চম্পা মেসেজটি মুছে দিয়ে কৌশিককে ব্লক করল। কৌশিক আর গোলদার একই ব্যক্তি মনে হয়। গোলদারের সঙ্গে কৌশিকের যোগাযোগ আছে মনে হয়। মনে হচ্ছে মেসেজটি গোলদারের। গোলদার এক দিন বলেছিল, ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি থাকলে চম্পা দ্রুত উপরে উঠতে পারবে। সে তার চাকরির আরম্ভের কথা। ন’মাস আগের কথা। চম্পা আবার জিজ্ঞেস করল বিজনকে, কী করা উচিত তার?
বিজন হাসে, বলে, আমার বাবাকে সেই বস, ডি.এন বসু, কত ব্যঙ্গ যে করতেন, বাবার কলিগরাও শেষে তা করতে আরম্ভ করল। বসের উস্কানিতেই তা হতো। বাবাকে কলিগরা এই যে পোয়েট বলে ডাকত, রাত্তিরে কবতে লিখলে পোয়েট?
তারপর? চম্পা জিজ্ঞেস করে।
বাবার মনে হয়েছিল সুইসাইড করে, আচ্ছা জীবনানন্দ দাসের মৃত্যু হয়েছিল কেন বলো দেখি?
চম্পা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিজন সাহার দিকে। মনেই হয় না বিজনদা জীবনানন্দর কথা জানে। কোনোদিন গল্প উপন্যাস কবিতা নিয়ে একটি কথাও বলেছে বলে শোনেনি। সে জিজ্ঞেস করে, তুমি জানো বিজনদা, জীবনানন্দ পড়েছ?
বিজন বলল, সকলেই জানে, রাসবিহারী, ট্রামলাইন, আট বছর আগে এক দিন, কারুবাসনা, জলপাইহাটি।
কৌশিক জানে না, অমিত গোলদার জানে না। চম্পা বলল।
হয়তো জানে, স্বীকার করতে চায় না, চাকরির উন্নতির সঙ্গে ওই জানার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং বিরোধ আছে। নিম্নস্বরে বলল বিজন।
তুমি কি ডাকঘর পড়নি সত্যি? চম্পা জিজ্ঞেস করে।
বিজন চুপ করে থাকে। তারপর কন্ঠস্বর প্রায় গোপন করে বলে, ভুলে গেছি।
ভুলে যাওয়া যায়? চম্পা বলে।
বিজন বলল, এই অফিসে ঢুকেছ, তুমিও আস্তে আস্তে ভুলে যাবে চম্পা, মানে ভুলে থাকতে হবে, আমি যেমন আছি, আমার বাবা একদিন ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দেবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করেছিলেন, আমাকে বলেছিলেন কাজের জায়গায় আত্মগোপন করে থাকলে ভালো থাকা যায়।
-তুমি কবিতা লেখ? চম্পা জিজ্ঞেস করেছে।
-না, বিজন সাহা লেখে না, থাক চম্পা এসব কথা।
-কিন্তু আমি কী করব? সে জিজ্ঞেস করে।
তখন গোলদারের কল এল ইন্টারকমে, গোলদার বললেন, তাঁর কাছে গত তিন মাসের কাজের হিসেব দিতে। তিন মাস চম্পা কী করেছে? তিনি দিল্লি পাঠাবেন।
চম্পা বলল, সাবমিট করেছি প্রত্যেক মাসে স্যার।
-আবার দাও। গোলদার বললেন।
-দিচ্ছি স্যার, কিন্তু আমার ছুটি?
-নট আপ্রুভড, তুমি ছুটির কথা আর তুলবে না, আগামী তিন মাস কোনো ছুটি হবে না।
-স্যার আপনি কৌশিক ব্যানার্জীকে চেনেন?
-কেন বলো দেখি। গোলদার জিজ্ঞেস করলেন।
-কৌশিক ছুটিটা দিতে বলছে আপনাকে। তার মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে এল আচমকা।
-এ কথা কেউ বলতে পারে না যে-ই বলুক। গোলদার লাইন কেটে দিলেন।
চম্পা এবার নিজেই বসের লাইন ডায়াল করল, আমার ছুটিটা চাইই স্যার, প্লিজ।
-থামবে চম্পা, ভবিষ্যতের কথা ভাবো, অভিনয় করে কী হবে, সুচিত্রা সেন? কথাটা যেন ইন্টারকমেই ভেসে এল। বস লাইন কেটে দিয়েছেন।
সে বিজনকে বলল, আমি কিন্তু আসব না এবং পাঁচটার পর চলে যাব, নটা পাঁচটা আমার ডিউটি বিজনদা, পৌনে পাঁচটায় নতুন কাজ এলে পরের দিন হবে।
বিজন বলল, তুমি আত্মগোপন করে থাকলেই পারতে চম্পা, পৃথিবীতে অন্য রকম কিছু করতে হলে কখনো কখনো আত্মগোপন করতে হয়, আমার কথা ভাবো চম্পা।
তুমি! সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
বিজন বলল, বাবা আমাকে বলে গিয়েছিলেন, থাক চম্পা, তুমি ভাব কী করবে, গোলদার তোমায় অতিষ্ঠ করে দেবে, ইউউউ অ্যাক্ট্রেস, কাম অন, অফিস অভিনয়ের জায়গা নয়।
-কিন্তু বিজনদা, তোমার কি অন্য কোনো নাম আছে আমার মতো, যা অফিস জানে না।
বিজন বলল, আমি তো বলব না চম্পা।
চম্পা অবাক হয়ে বিজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আত্মগোপন করা কবি! দেখে কিছুই মনে হয় না।
বিজন চুপ করে নিজের কাজে মগ্ন হয়। ক্লোজড সারকিট টিভিতে সব দেখছেন বস। শুধু শুধু বিব্রত হয়ে কী লাভ। অফিসের পরে কথা হবে। চম্পা একা হয়ে গেছে। অফিসের অন্যরা এত সময় তার কথা শুনে নিজেদের ভিতর হাসাহাসি করে কম্পিউটারে মগ্ন হয়েছে। সে আবার সেই দশ বছর বয়সের অমল হয়ে গেল। বাইরের বাতাস ঢুকবে সেই কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অমলের ঘরের জানালা। সে স্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করতে থাকে,
“পারব, আমি পারব। বেরোতে পারলে আমি বাঁচি। আমি রাজাকে বলব, এই অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারাটিকে দেখিয়ে দাও। আমি সে তারা বোধ হয় কতবার দেখেছি কিন্তু সে যে কোনটা সে তো আমি চিনিনে।”
বলতে বলতে চম্পার দুচোখ ভিজে গেল কখন তা সে জানে না। কলকাতায় এখন সন্ধে নেমেছে। উত্তর আকাশের তারা উত্তর আকাশে ফুটে উঠেছে। জানালা খুললে দেখা যায়। অথবা বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে। সে নতুন চিঠির মুসাবিদা করতে থাকে কম্পিউটারে। একটির পর একটি অক্ষর, আলোর ফুল, ধ্রুবতারার মতো ফুটে উঠতে থাকে কুসুমের আকাশে।
চম্পাকে চাকরি ছাড়তে হবে এবার। সে ছুটির দরখাস্ত দিয়ে শিলিগুড়ি চলে গেল শো করতে। শিলিগুড়ি থেকে ফেরার পর তার দাদাই, দাদু চলে গেলেন। চম্পা শুনেছিল দাদু আর বাঁচবেন না। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে। একটা লোক চলে যাচ্ছে, তার সমুখে থাকতে হবে তো। দাদাইয়ের কোলে কোলে সে বড় হয়েছে। দাদাই চলে যাচ্ছে, সে কী করে অফিস যাবে? আচ্ছন্নের মতো মানুষটা শুয়েছিল বিছানায়। চম্পা তাঁর ফুলদিদি। ফুলদিদির ডাকে তিনি সাড়া দেননি। ফলে সে আরো কদিন অফিস যেতে পারেনি। মেইল করে ছুটির প্রার্থনা পাঠিয়েছিল। অফিস জয়েন করে জানল ইওর সারভিস ইজ নো লংগার রিকোয়ার্ড। তার চাকরিই নেই। তাকে ডেকেছিল বস। বলেছিল, এভাবে চাকরি করা যায় না। ইচ্ছে মতো ছুটি, অফিস কামাই, যাত্রা থিয়েটার…হয় না, কাল থেকে আর আসতে হবে না।
মুখের কথায় তার চাকরি গেল। সে বেরিয়ে এসে তার চেয়ারে কিছু সময় বসে থাকল। তারপর বিজনকে বলল, তাহলে যাই বিজনদা।
-যাই মানে? বিজন জিজ্ঞেস করল, দাদুর কত বয়স হয়েছিল?
-ঊননব্বই, বস বলেছেন আর না আসতে। চম্পা তার ড্রয়ার খুলে দেখল নিজের কী আছে। কয়েকটা পেন। নতুন ডায়েরি। আর নিভিয়ার ছোট একটা কৌটো। বিজন বলল, বললেই হলো, যাবি কেন?
চম্পা বলল, নাহ, অফিস তো আর আমার নেই।
চুপ করে বস। বলল বিজন, আমি কি স্যারের কাছে যাব?
চম্পা বলল, মনে হলো আমি ওঁর বাড়ির কাজের লোক, জবাব দিয়ে দিলেন, কাল থেকে আর আসতে হবে না।
-লিখিত দিয়েছেন?
কুসুম বলল, না।
-তাহলে চাকরি গেল কীভাবে, ছুটি স্যাংশন না হতে পারে, মাইনে কাটা যেতে পারে, কিন্তু চাকরি কি যেতে পারে? বিজন জিজ্ঞেস করল।
-এইভাবে যদি জবাব দিতে পারে কোম্পানি, সে তো বড় ভয়ের। চম্পা বলল।
বিজন চুপ করে থাকে। কথাটা ওকে স্পর্শ করেছে।
চম্পা বলল, উনি তো বলেই দিয়েছেন, তুমি গিয়ে কী করবে, দাগিয়ে দেবে তোমাকে।
বিজন বলল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে তো ঢুকেছিলি?
হ্যাঁ। ঘাড় কাত করল চম্পা, বলল, কিন্তু পিওরলি টেম্পোরারি, এক বছর হলে চাকরি পাকা করে এরা।
-তাহলেও চিঠি ছাড়া চাকরি যায় কী করে, লিখিত জানাতে হবে তো ?
তখন চন্দ্রিমা এল তাদের সামনে, এইভাবেই চাকরি যায় বিজনদা, তুমি জান না?
বিজন বলল, না, আইনত তা হয় না।
আইন কিসের? চন্দ্রিমা হাসে, বসই আইন।
চম্পা বলল, আলোচনা করে কী হবে, উনি আমাকে জবাব দিয়ে দিয়েছেন, সিসিটিভি রয়েছে, তোমাদের দেখতে পাচ্ছেন বস।
বস বেরিয়ে গেছেন। চন্দ্রিমা চেয়ার টেনে বসল, বলল, দ্যাখো এই অফিসে আসলে চাকরি যায় না, লিখিত কেউ পায়নি, সকলেই চাকরি ছেড়েছে।
বিজন চুপ করে থাকে। কথাটা মিথ্যে নয়। অরূপ দত্তকে বলা হয়নি তোমার চাকরি নেই। অরূপের ছিল শুধু চেয়ার আর টেবিল। কোনো কাজ ছিল না। কম্পিউটার সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কোনো ফাইল তার টেবিলে আসেনি সেই এক-দেড় মাস। সেই সময়ে অরূপ বসের কাছে কাজ চেয়েছে কয়েকবার। বস বলেছিল, কাজ নেই। থাকলে দেওয়া হবে অফিস যদি মনে করে। এমন থাকার পর অরূপ অফিসে নিয়মিত আসা বন্ধ করল। সারাদিন চুপচাপ। মোবাইল খুটখাট। বই পড়া নিষেধ। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, সে করবে কী ? ঘুম পেয়ে যায় বসে বসে। কিন্তু ঘুমনো যায় না। ঘুম খুব সংক্রামক। চোখ বন্ধ করা নিষেধ। তার স্যালারি হয়নি সেই মাসে। কী এক জটিলতায় আটকে গিয়েছিল। পরে বিল হবে বলা হয়েছিল। এসব বসের পরিকল্পনা মতোই হয়েছিল। এমন হয়েছিল যে কেউ অরূপের সঙ্গে কথা বলতে সাহস পেত না। এইভাবে বেতন আটকে থেকে কাজ না পেয়ে অরূপ রেজিগনেশন দেয়। চম্পার কি তাই হবে? অফিস দেবে না টারমিনেশন লেটার। চম্পাকেই দিতে হবে পদত্যাগ পত্র। দিতেই হবে না হলে তার দায় থেকে যাবে অফিসে। অফিস তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলে তার দায় থাকবে না। পরে অফিস তাকে অভিযুক্ত করতে পারবে না যে কোনো সূত্রে। চম্পা বলল, কাল আমি চাইব আমার টারমিনেশন লেটার, আজ যাই।
-যদি অফিস না দেয়? চন্দ্রিমা জিজ্ঞেস করে।
লিখিত ভাবে চাইব। বলল চম্পা।
-জবাব পাবে না।
-মেইল করব।
চন্দ্রিমা বলল, জবাব দেবে কে?
চম্পা বলল, অদ্ভুত তো।
বিজন তখন জিজ্ঞেস করল, তুমি কি অভিনয়ই করবে ঠিক করলে?
চম্পা বলল, কতদিনের বাসনা আমার, স্বপ্ন, আমি থিয়েটার করব, আমি এখানে চাকরি করতে পারতাম না, আমাকে শো করতে দিতেন না বস, কিন্তু থিয়েটার আমার প্রাণ।
-তাহলে রেজিগনেশন দিয়েই যাও।
সে বলল, আজ নয়, কাল, আমি তাহলে accept করিয়ে নিয়ে যাব।
চম্পাকলি বেরিয়ে পড়ল। বাইরে পার্ক স্ট্রিটের ব্যস্ত রাস্তা। ঝলমলে সব শো রুম। দেশি বিদেশি মানুষজনের কৌতুহলী চোখ। চম্পার পরণে জিনস আর লম্বা কুর্তি, তার উপর জিন্স-জ্যাকেট। গলায় সরু হার। চুলে খোঁপা। হাঁটছিল একা একা। সে এখানে চাকরিতে আসত। প্রতিদিন ঠিক নটার মেট্রো। পার্ক স্ট্রিট মিনিট পনের। সাড়ে নটার ভিতরে অফিস। চাকরি করা মানে নিয়মবদ্ধ হয়ে ওঠা। ন’মাসে কতজনের সঙ্গে চেনা হয়ে গেছে নটার মেট্রোয়। ফেরার ঠিক থাকত না। রিহার্সালে যেতে হতো। অফিস থেকে দেরি করে বের হতে হতো। কিন্তু ন’টার মেট্রোর সুদীপ্তা, রঞ্জিতা, অলক্তিকা, কিংবা অধীপ, নির্মাল্যদের সঙ্গে তো নটার মেট্রোতেই পরিচয়। তারা কেউ ওঠে দমদম থেকে, কেউ বেলগাছিয়া, কেউ শ্যামবাজার। চম্পার শোভাবাজার সুতানটী। পনের বিশ মিনিটের জার্নি। তাতেই বন্ধুতা গভীর। একজন না এলে অন্য সকলে উৎকণ্ঠিত হয়। ওরা দল বেঁধে একদিন গিরিশ মঞ্চে তার শো দেখে এসেছে টিকিট কেটে। সে যে অভিনয় করে এতে সকলের সমর্থন। অফিস না এলে ওদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। ওরা তো ওই মেট্রোরই। তার এখন কোথাও যাওয়ার নেই। রিহার্সাল নেই। থাকলেও তা হতো সন্ধে বেলায়। এখন বেলা আড়াইটে। যাবে কোথায়? একা একা সিনেমা? কিংবা কফি হাউস? কফি হাউসে গেলে কারোর দেখা পাবে? সে বাড়ি যাবে ঠিক করল। চাকরি চলে যাচ্ছে। আবার দুপুরে বাড়ি থাকতে হবে? মাঝে মধ্যে এ চ্যানেল ও চ্যানেল গিয়ে খোঁজ নিতে হবে কাজ আছে কি না। কুসুম পার্ক স্ট্রিটের ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সকলেই উদ্দেশ্য নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এখান থেকে সেখানে। কাজ নিয়ে ছুটছে। কত রকম কাজ আছে এই শহরে। অলক্তিকা একটা অফিসে কাজ করে যাদের কাজ হলো হিরে জহরত একজামিন করা। তারপর তাদের রিপোর্ট দেওয়া। রঞ্জিতা যে অফিসে কাজ করে তারা বিশ্ব ভ্রমণ করায়। রঞ্জিতার কাজ ক্লায়েন্টকে বোঝানো যে তাদের কোম্পানি কত অচেনা পৃথিবীতে ঘুরিয়ে আনতে পারে। কত সুখকর হতে পারে সেই ভ্রমণ। রঞ্জিতার আশা কোম্পানি একবার তাকে কোম্পানির প্রতিনিধি করে আঙ্কোরভাট কিংবা চিনের প্রাচীর দেখতে পাঠাবে ভ্রমণকারীদের সঙ্গে। কিন্তু সে আশা পূরণ হবে কি না সন্দেহ আছে। অধীপ কাজ করে বিখ্যাত এক বেসরকারী হাসপাতালের অফিসে। খুব চাপ। তবে অফিস ডিউটি বলে সাড়ে নটা থেকে ছ”টা। বেরতে দুয়েকদিন দেরি হয় বটে, কিন্তু ঠিকই থাকে মোটামুটি। সুদীপ্তা একটি প্রাইভেট স্কুলে করে। ক্লাস সিক্স অবধি সেই ইস্কুলেরই বা চাপ কত। চম্পা এই সব ভাবতে ভাবতে বুঝল, এই চাকরিগুলির কোনোটাই তার পছন্দের নয়। স্কুলের চাকরি বাদে। সুদীপ্তার চাকরিতে অভিনয় করা যায়। কিন্তু অবাঙালি মালিকের স্কুলে হয়তো আপত্তি হতো তা নিয়ে। টিচার অভিনয় করে, আপত্তি উঠতে পারতই। তাদের নাট্যদলের তনিমাদির কলেজে শুনতে হয়েছে এই নিয়ে। টিচার জিন্স পরতে পারবে না। শালোয়ার কামিজেও আপত্তি হতে পারে। শাড়ি ছাড়া চলবে না। খবরের কাগজে এই খবর তো প্রায়ই দেখতে হয়। চম্প মেট্রোয় চেপে শোভাবাজারেই নামে। তখন সওয়া তিন। এই সময়ে সে কখনো বাড়ি ফেরেনি সেই কলেজ জীবন ছাড়া। তাও কোনো কোনো দিন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফিরতে দেরিই হতো। পাঁচ-সাড়ে পাঁচ। দুপুরে বাড়ি ফিরল কেন, তার চাকরি গেছে। বস বলল, কাল থেকে আর………, সে চলে এল! তার মানে সে চলে আসতেই চাইছিল। অটোয় চেপে আহিরিটোলায় নেমে দেখল কুকুরের দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমোচ্ছে। রোদ পড়ে আসছে, পশ্চিমের সাধুখাঁ বাড়ির ছায়া পড়েছে রাস্তায়। রাস্তা পার হয়ে ছয় হাত চওড়া গলিতে ঢুকে পড়ল সে। এই সঙ্কীর্ণ গলি তার খুব প্রিয়। দাদুর কোলে চেপে এই গলি দিয়ে সে চলে আসত বড় রাস্তা আহিরিটোলায়। দাদু বলত এইটা ছোট্ট ফুলদিদির ছোট্টচ রাস্তা। লিটল ফুল লিটল লেন। চম্পা একা সেই তার গলি দিয়ে ওপারে হেঁটে যাচ্ছে তার বাড়ির সামনের রাস্তায়। সেই রাস্তাও এখন নিঝুম। দাদু চলে গিয়ে এমনি নিঝুম করে দিয়ে গেছে যেন সব। বাড়ির দরজা খুলল মা। এত তাড়াতাড়ি এলি যে?
চম্পা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, চাকরি নেই।
-তার মানে?
চম্পা ঘরে গিয়ে পালঙ্কে ছুড়ে ফেলল ব্যাগ। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সাইরেন পিসির বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। বাড়িটা ভেঙে ফেলবে প্রমোটার কিন্তু এক শরিক মতিলালের দুই ছেলের একজন উঠছে না। তাকে হয় তো গাড়ি চাপা দিয়ে দেবে, কিংবা আগুন লাগিয়ে দেবে তার ঘরে। কিন্তু তারা স্বামী স্ত্রী খুব ঠেঁটা। অত সহজে সব হচ্ছে না। তাদের বাড়ি প্রমোটিং হবে হয়তো এবার। দাদু নেই। কী জানি কী হবে? মা আবার জিজ্ঞেস করল, বললি না।
-কী বলব, জবাব দিয়ে দিল।
বাবা কাকারা ফিরল। তারা শুনে বলল, চিঠি দেয়নি, চাকরি গেলেই হবে?
মা বলল, থিয়েটার ছাড়, কাল গিয়ে মাপ চেয়ে নে।
-কী বলছ মা, মাপ চাইব কেন? চম্পা রেগে গেল। কিন্তু রাগ করে কার কাছে আশ্রয় নেবে? দাদু নেই। বাবারও ওই মত। চিঠি তো দেয়নি। বসেরা অমনি হয়। বকাবকি করে। তার মানে কি চাকরি গেল? মা বাবা বলে না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা, তার মানে কি সত্যিই বেরিয়ে যেতে বলে? মায়েরা বলে না, মর তুই মর। তার মানে কি সত্যিই মরতে বলে? চম্পা শুনতে শুনতে মুখ অন্ধকার করে। তাকে চাকরিতে যেতে হবে। বাড়িতে বলছে তার চাকরি আছে। বরখাস্তের চিঠি দেয়নি যখন আছে। বসের কাছে মাপ চেয়ে নেবে। আর হবে না স্যার। চম্পা রাতে একা একা কেঁদে ফেলল। মোবাইলে ফেসবুক খুলে বহুদিন থেকে, সেই জুলাই থেকে ইন-অ্যাকটিভ রুহিতন বড়ুয়ার প্রোফাইলে গেল। রুহিতন আর সক্রিয় হবে বলে মনে হয় না। মৃতের অ্যাকাউন্ট কী করে সক্রিয় হবে? কিন্তু দাদুর মৃত্যুর পর এখন সে কোন মানুষকে নিজের কথা বলবে? বরং রুহিতন বড়ুয়ার টাইম লাইনে লিখে দেবে। রুহিতন রুহিতন আমি এখন কী করব? বাড়িতে বলছে যা, তা শুনলে তো, আমি এখন কী করি? তুমি ছাড়া আমার কথা শুনবে কে?
মধ্যরাতে রুহিতন জাগে। মৃতের ফেসবুক সক্রিয় হয়ে ডাক দিল, চম্পাকলি, ফিরোজা।
-বলো রুহিতন। ঘুমের ভিতর সে সাড়া দেয়।
-ভয় পেয়ো না, আমারও ভালো সময় আসবে, সেদিন তুমিও দেখবে আনন্দ ফিরে এসেছে।
-আনন্দ!
-হ্যাঁ, সুখ, আনন্দ সব, আমিও ফিরব, শোনো মৃতেরও দিন আসে, অন্ধকার ফুরোয়।
রুহিতন অন্ধকারের ভাষায় কথা বলতে লাগল। ঘুমন্ত চম্পা তা শুনতে পায়। শুনতে শুনতে বলে, রুহিতন, আর একবার বলো। এই সব বলার মতো, সাহস দেওয়ার মতো আর কেউ নেই আমার। অন্ধকার আর ঘুমের ভিতরের কথা আমি যেন দিনের আলোয় মনে রাখতে পারি। রুহিতন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
শিল্পের জন্য মেয়েদের লড়াই করতে হয় বরাবরই। পুরুষশাসিত সমাজে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও একমাত্র অধিকার পুরুষদেরই। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের সকল নারীদের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধার্ঘ্য এই আখ্যান। একজন মেয়ের গল্প নয়, শিল্পমনস্ক সমস্ত সংগ্রামী মেয়েদের লড়াকু আখ্যান–এই উপন্যাসিকা।শিল্প সংস্কৃতিই মেয়েদের সাহসী করে। শিল্পের এটাও একটা জোরের জায়গা।
এই অভয়া আবহে পড়তে গিয়ে অন্য এক রকম অনুভূতি হল।