novel-giridhari-jage-nari

গিরিধারী জাগে নারী
জয়ন্ত দে

এক


চায়ের কাপটা রেখে অদ্ভুতভাবে মুখ মুছলেন জেলাসভাধিপতি গিরিধারী সামন্ত। তাঁর চোখে মুখে হঠাৎ যেন কেমন একটা অস্বস্তি। আসলে স্বস্তিতে তিনি নেই। সত্যিই নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই এই শান্তি স্বস্তি কথাটা তাঁর ডিকশনারি থেকে হাওয়া। এটা নাটক নয়। বানানো কিছু নয়। এসব যাঁরা করেন, তাঁরা আগে সিবিআই বা ইডির হাতে ধরা পড়েন। তারপর শরীর খারাপের নাটক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। কিন্তু তিনি এখনও ধরা পড়েননি। পড়বেন পড়বেন করছেন। যে কোনও সময় ডাক এসে যাবে।

যাঁরা তাঁকে আগে দেখেছেন, তাঁরা একটু দেখলেই বুঝবেন, কিছুদিন আগেও যতটা দাপটে তিনি পার্টি এবং জেলা সামলেছেন, এলাকায় বাঘ হয়ে ছিলেন— সেটা যেন হঠাৎ উধাও।

এই কিছুদিন ঠিক দিন নয়, মাস। কয়েক মাস হল এমনটি হয়েছে। আসলে, প্রতিদিন কানাঘুষো চলছে, এবার তাঁকে সিবিআই বা ইডি ডাকবে। ডাক তাঁর এল বলে। তাঁর বাড়ির দরজায় যেন অপেক্ষা করছে সিবিআই, ইডি। যেকোনও সময় হুমদুম করে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়বে।

পার্টির দোর্দণ্ডপ্রভাবশালী জেলাসভাধিপতি গিরিধারী সামন্তকে ঘিরে এখন সর্বক্ষণ হিন্দি সিনেমার একটাই গান বাজছে— চিঠি আয়ি রে আয়ি রে চিঠি আয়ি…।

তিনি শুনেছিলেন, প্রথমে চিঠিতে ডাক আসবে। কলকাতায় যেতে হবে। ওরা নাকি সব ইংরেজি আর হিন্দিতে কথা বলে। পাশ যে বসে থাকে সে বাংলা তর্জমা করে দেয়। ঘনিষ্ঠ এক উকিল আছে তার সঙ্গে কিছু শলাপরামর্শও করে রেখেছেন।

চিঠি এলে যেতে হবে। না গেলে কোমরে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে।

প্রথম প্রথম যখন কথাটা উঠেছিল, তখন পার্টির ওপরমহলের একজন আশ্বস্ত করেছিল—

‘ধুসস মশাই, চিন্তা করবেন না। চিকেন হার্ট নিয়ে পলিটিক্স করতে এসেছেন। আপনার বাড়ি পর্যন্ত চিঠি এসে পৌঁছাবে না। তার আগেই কেস সালটে দেবে ওপরমহল। আপনি তো মশাই বাল, মানে চুল। এরপর কান। তারপর মাথা। মাথার কি চিন্তা নেই, যে আপনাদের টানলে তারও টান পড়বে। তাই অহেতুক টেনশন নেবেন না।’

শুনে ভয় কেটে গিয়েছিল গিরিধারী সামন্তর। তবে একেবারে কি কেটে ছিল? কাটেনি। চাপা ভয় ছিল, কিন্তু বাইরে বাঘের মুখোস পরেই বের হতেন।

কিন্তু তারপর দ্রুতলয়ে টপাটপ রথী মহারথীরা জেলে ঢুকছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন গিরিধারী সামন্ত। এক ওপরমহলকে একান্তে ফোন করে বলেছিলেন, ‘কী বুঝছেন?’

‘আপনি কী বুঝছেন?’

‘ভালো তো কিছু বুঝছি না।’

‘আমিও না।’

‘সব হেবিওয়েট।’

‘হ্যাঁ, হেভিওয়েট।’

‘কিন্তু আমি তো চুনোপুঁটি। তবে আমি কেন দাদা?’

‘কে বলল?’

‘শুনছি, ওদের খাতায় আমার নাম নম্বর লেগে গেছে।’

‘তাই!’

‘হ্যাঁ দাদা। কে যে আমাকে জড়ালো?’

‘দেখুন, কাঠ খেলে আঙরা হাগবেন। কাঠ খেয়েছিলেন—।’

‘কী বলছেন। পার্টির জন্যই তো সব— আপনি তো জানেন।’

‘না, আমি কিছু জানি না। আসলে কীভাবে খেয়েছেন? পুড়িয়ে, না সেদ্ধ করে? ভেজে, না অম্বলে? খাওয়াটা জানতে হয়। না জেনে খেলে হয় পেট কামড়াবে, নয় আঙরা হাগতে হবে!’

‘কী করব?’

‘যা শুনছেন— ওপর মহলকে জানান। কতটা সত্যি মিথ্যে খোঁজ নিন।’

‘আপনিই আমার ওপর মহল।’

‘এতদিন এ-কথা আমি জানতাম না। আমি তো জানতাম তরুণ প্রধান, অজিত মাইতি তারা আপনার ওপর মহল। দেখুন, আমি আপনার কেউ নই। শুনুন, আর ফোন করবেন না। সাফসুফ হয়ে ফিরুন, বুকে ভাই বলে টেনে নেব।’

সেই সেদিন থেকেই হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল গিরিধারী সামন্তের। বুঝেছিলেন, তাঁর একার লড়াই তাঁকে একাই লড়তে হবে।

কেননা ততদিনে চিঠি ফিটি দেওয়া নয়, আত্মীয় কুটুম্বের মতো ওরা বাড়ি চলে আসছে। বলা নেই, কওয়া নেই ভোররাতে ঠক ঠক করে ঘরে ঢুকে পড়ছে। গুছোনোর সময় দেবে না। হাঁড়ি থেকে, কুলুঙ্গি থেকে, রান্নাঘরের মশলার কৌটো নেড়ে, গোয়ালের গোবর কাঠি দিয়ে ঘেঁটে দেখছে। মোবাইল পুকুরে ফেললে জাল মেরে তুলছে। ডেঞ্জারাস ব্যাপার সব।

গিরিধারী সামন্ত ঠিক করলেন, আগেভাগেই তিনি নিজের মতো করে সাফসুফ করবেন। তিনি সাফাই অভিযানে নামলেন। নিজের ঘরের কাগজপত্তর যা ছিল সব পুড়িয়ে দিলেন। শুধু কিছু খুব জরুরি নম্বর, টাকার লেনা দেনা লেখা একটাই ছোট্ট ডায়েরি বাগানে গিয়ে কবর দিলেন। ওপর ফুল গাছ বসিয়ে জল দিলেন। মোবাইল থেকে খুঁজে খুঁজে হোয়াসঅ্যাপে কথা, এসএমএস, ফোন নম্বর ডিলিট করে দিলেন। দুটো মহিলার গোপন কিছু ছবি ছিল, না, না, ব্ল্যাকমেল করার জন্য নয়। সুখস্মৃতি। অবসর সময়ে দেখতেন। তাও ফেলে দিলেন। খুব শান্ত মাথায় ভাবলেন, ব্যাঙ্কের বই। সেটা আর কারও কিছু করার নেই। ফেলে দিলেও ওর ঠিক হদিশ পেয়ে যাবে। বরং কিছু দলিলপত্র ছোট্ট একটা স্টিলের বাক্সে ভরে, সেই বাগানে। হিমসাগরের আম গাছের তলায় ঠাঁই দিলেন। খুব শান্ত মাথায় তিনি সব করছিলেন। কিন্তু বাদসাধল এসে এই জ্যান্ত মানুষগুলো।

অন্যসময় হলে মেরে হাপিস করে দিতেন। কিন্তু এখন চাঁটিমারাও বাড়াবাড়ি বলে সাব্যস্ত হবে। বিশেষত সাতজন ছেলে। যাদের কাছ থেকে চাকরি দেবে বলে বারো থেকে কুড়ি লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন, তারাই গলার কাঁটা হয়ে বসে। এরা‌ই দল পাকিয়ে দিনরাত আসছে। টাকা ফেরত চাইছে। টাকা ফেরতের জন্য এরাই দিন রাত চিৎকার করছে। অন্য দলে গিয়ে ভিড়েছে। এই সাতজনের মধ্যে দু’জন নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাকি পাঁচজনবোবা হয়ে সঙ্গে থাকছে, জোরে ধমক দিলে পালাবে।

কিন্তু গিরিধারী সামন্ত এখন ধমক দিতে পারছেন না। আগে হলে অবহেলা করতেন। যা ছেঁড়ার ছেঁড়— বলে হটিয়ে দিতেন। এখন দিনকাল ভালো নয়। এখন এদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তাই, প্রথমে সাতজনের প্রতিনিধিকে আটকে চারজন করেছিলেন। সেই চারজন থেকে ছেঁটে এখন দুজনকে এনেছেন। এই দুজনকে যদি ঠিক করে ভয় দেখানো যায় তাহলে বাকি গোরুগুলো এদিকমুখো হবে না।

কিন্তু ওই যে ধমক দিতে পারছেন না, গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা। এখন তিনি দুজন থেকে একজনকেই ওদের প্রতিনিধি হিসেবে সামনে রেখেছেন। এই একজন হল খোকন। আগে তাঁর সঙ্গেই পার্টি করত। পার্টির হয়ে অ্যাকশন করত। অনেক কিছুর সাক্ষী। এই খোকনই গলার কাঁটা।

খোকনই এখন সাতজনের প্রতিনিধি। তার সঙ্গেই গিরিধারী কথাবার্তা চালাচ্ছেন। তাকে বার বার ঝোঝানোর চেষ্টা করছেন, বার বার বলছেন—ওই টাকা নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। এক কানাকড়িও আমি পাইনি রে খোকন। এখন আমাকে শোধ করার কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। আমাকে ঘটি বাটি বেচতে হবে। আমি চাষি ঘরের ছেলে, অন্যের বাড়িতে সিঁধ দিতে পারি?

গিরিধারী সিঁদ দিতে পারেনি। ডাকাতি করেছেন। কিন্তু ওই ছেলেটা খোকন, সে সিঁদ দিয়ে দিল। গিরিধারী তাকে একান্তে ডেকে বলেছিল, ‘খোকন তুই পার্টির ছেলে। একসঙ্গে দল করেছি। এত বছর মার খেয়ে ক্ষমতায় এসেছি। তুই বুঝবি, আর কেউ বুঝবে না। তোরা যা ডিমান্ড করছিস সেটা অন্যায্য। বিজনেসে লাভ ক্ষতি থাকে। এই বিজনেসে আমি লস খেয়ে গেছি। ওপর মহলের যাকে টাকা দিয়েছিলাম, সে জেলে। শুনছি, জেল থেকে ছাড়া পেল বলে। ওপর মহল আমাকে বলেছে, তোরা এখন একটু চুপ মেরে থাক। ইডি সিবিআই কদিন এই বিদেশ বিঁভুয়ে পড়ে থাকবে। ওদের খুব খাওয়ার কষ্ট হচ্ছে। সবার পেটের অসুখ ধরে গেছে। ইলেকশন মিটলেই চলে যাবে। কিন্তু পার্টি তো যাবে না। পার্টি আবার পাঁচ বছর থাকবে। আবার ক্ষমতায় আসবে। তোদের কজনকে ঠিক চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। আমি কথা দিলাম।’

‘কিন্তু সেই চাকরি তো থাকবে না গিরিদা। আবার ইডি সিবিআই এসে কানে চড় মেরে হাইকোর্টে নিয়ে যাবে। তখন আমও যাবে ছালাও যাবে। আপনি বরং টাকাটা দেন।’

‘টাকা কোথায় পাব?’

‘যাকে দিয়েছিলেন, তাকে ধরেন।’

‘সে জেলে?’

‘তাহলে আপনার প্যাডে একটা লিখে দেন, কে টাকা নিয়েছে। তার নাম লিখে দেন।’

‘আরে লিখে দেওয়ার কী আছে? তার নাম কি তুই জানিস না, কে আমার গডফাদার? তিনি কি ডাইরেক্ট নিয়েছেন, তার আমচা-চামচারা টাকা নিয়ে গেছে। বল, তাদের নাম লিখে কী হবে? ওরা পিওন—’

‘গিরিদা আমরা তোমাকে চিনি? তুমি কাগজে লিখে টাকা নিয়েছি। সে কাগজ আছে। এখন বলছ— টাকা অন্য জায়গায় গেছে। এসব বাহানা আমরা শুনব না। আমাদের টাকা দাও। আমরা সরে যাচ্ছি।’

গিরিধারী আলত কাশলেন, বললেন, ‘খোকন, তুই আমার পার্টির ছেলে। তুই সরে যা। বাদবাকিটা আমি বুঝে নেব। আমি তোর টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তুই বারো লাখ দিয়েছিলি। কবে নিবি বল— ওগুলোকে লাথ মেরে হাটা আমি তোকে কাল পরশু করে দু লাখ দিচ্ছি। পনেরো দিন সময় দে, একটা জমি বেচে তোর টাকা শোধ করে দেব।’

‘তুমি ঠিক বলছ গিরিদা, আমারটা শোধ করে দেবে—?’

‘এই তোকে ছুঁয়ে বলছি। যা, আর পাগলামি করসি না। পরশু এসে দু লাখ বউদির কাছ থেকে নিয়ে যাবি। বড় মেয়েটার নামে একটা জমি ছিল— সেটা বেচে দেব। দিয়ে দেব তোর টাকা। তুই পার্টির ছেলে। তোর বাবাকে আমি কাকা বলতাম। উপকার করতে গিয়ে ফেঁসে গেলাম রে খোকন। বিশ্বাস কর। মা কালীর দিব্যি, এক টাকাও আমি নিইনি। শোন, ওদের জন্য একটা বুদ্ধি করতে হবে, একটু ভেবে নিই। ওদের খালি হাতে ফেরাব না। কিছু করে দেব। টাকা না পারি জমি দিয়ে দেব। পুষিয়ে যাবে—। কিছু সরকারি খাস জমি আছে— হয়ে যাবে।’

‘তাহলে ওদের কী বলব?’

‘এখন কিছু বলবি না। তাহলে তুইও আমার মতো ফেঁসে যাবি। দিনকাল ভালো না। সময়টা খারাপ যাচ্ছে, নইলে ভেড়ার দল আমাকে হুমকি দেয়। মেরে আমি পাট ক্ষেতে পুঁতে দিতাম। কিন্তু, ওদের যদি ভয় পেয়ে কিছু দাবিদাওয়া শোধ করি, ওরা কি করবে জানিস বাইরে রটিয়ে দেবে। তখন আমার বাড়ির সামনে সত্তরজন লাইন দেবে। আমাকে সবাই মিলে উলটে দেবে। আমি গিরিধারী সামন্ত। গিরি মানে জানিস পাহাড়। সময় আসুক আমি দেখিয়ে দেব, বগলে পাহাড় চেপে নাচব।’

এই কথাগুলোই সিঁদ দিল আর এক চাষির ছেলে খোকন। পুরো কথা সে ভিডিওরেকর্ড করে রেখেছে। তারপর তা টুকরো টুকরো কেটে গিরিধারী হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাচ্ছে! এই কথাগুলোই এখন বার বার গিরিধারী শুনেছেন। বুঝেছেন, তিনি উলটে গেছেন। তাঁর ঘরে সিঁদ দিয়েছে খোকন।

এ জিনিস সিবিআই বা ইডির হাতে পড়লে আর দেখতে হবে না। গর্ত খুঁচিয়ে তাকে বের করবে। পার্টিও পিছনে লাথি মারবে। যেভাবেই হোক এটা চাপা দিতে হবে। কিন্তু খোকন আর আড়ালে কোনও মিটিং সেটিং করতে চাইছে না। বরং সে একবার শুনিয়ে দিয়েছে, ‘আমি বারো দিয়েছি। গিরিদা ইচ্ছে করলে আমি ইন্টারেস্টও পেতে পারি। কিন্তু আমি চাইছি না।’

আসল! তারওপর সুদ!

গিরিধারী চুপ করে বসে থাকেন। অনেক ভেবেছেন, টাকা ছাড়া আশা দিয়ে কার্যউদ্ধার করতে হবে। গিরিধারী ভাবেন, খোকন তুই আদপে চাষি, তোকে আশা দেব। কিন্তু কীভাবে দেব?

তখনই তাঁর মাথায় বুদ্ধিটা এসেছিল। খোকনকে নিয়ে তাঁর বাড়িতেই মিটিং করবেন। সেখানে স্ত্রী মেয়েকে রাখবেন। পুরো নাটক সাজাতে হবে। সেই নাটকে এমন কাউকে রাখবেন, যাকে দু পক্ষই মানবে। কে? কে হতে পারে?

খোকনকে ফোনে মিটিংয়ের কথা বলেছিলেন। খোকন আর একা যেতে চাইছে না। সে যাবে সাতজনের একজন হয়ে। গিরিধারীও খোকন ছাড়া আর কারও সঙ্গে বসবেন না।

তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘খোকন তুই থাকবি, আর তুই ওদের প্রতিনিধি। আর একজনকে রাখবি, যে কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। পার্টি পলিটিকসে নেই, এমন কেউ। যে দু পক্ষের কথা বুঝবে।’

খোকন বলেছিল, ‘সে নিশ্চয়ই আপনার পেয়ারের লোক হবে। আপনার দিকে ঝোল টানবে।’

‘না রে ভাই, আমি একটা সমাধান চাইছি। তুই লোক খুঁজে নিয়ে আয়। কিন্তু কোনও পার্টির লোককে আমি বাড়িতে অ্যালাউ করব না। সে যে পার্টিরই হোক।’

সেই নিরপেক্ষ লোকটি খুঁজেছিল খোকন।

এখন সকাল সাড়ে আটটা।

চা শেষ করেই, বিনবিন করে ঘাম দিচ্ছিল গিরিধারী সামন্তের। একটা অস্বস্তি— আজ একটা হেস্তনেস্ত হবে ধরে নিয়েই হাজির হয়েছিল সবাই।


দুই


কে কতখানি নিরপেক্ষ হবেন? এই খোঁজে খোকন তার সঙ্গী ছ’জনকে নিয়ে মিটিংয়ে বসেছিল। দু’জনের নামও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু গিরিধারী সামন্তের নাম শুনেই তাঁরা পিছিয়ে আসেন। তখন একজন পরামর্শ দিয়েছিল নতুন দিদিমণিকে বল। সে বেশ সাহসী। গিরিধারী সামন্তকে মিটিং-এ কচলে দিয়েছিল।

শাকম্ভরী ভট্টাচার্য।

খোকন বলেছিল তিয়াসাকে। ‘তোমার সঙ্গে তো নতুন ম্যামের খুব ভাব। ওকে নিয়ে চল তোমাদের বাড়ি। ঝামেলাটা মিটুক।’

‘শাকম্ভরী ম্যাম! রাজি হবেন? বাবার সঙ্গে তো খিঁচ। বাবারও ম্যামের নাম শুনলে রাজি হবে না।’

‘গিরিদাকে রাজি হতেই হবে। নতুন ম্যামই নিরপেক্ষা হবে। তুমি প্রস্তাব দাও।’

খোকন আর তিয়াসা গিয়েছিল প্রস্তাব নিয়ে। শাকম্ভরী রাজি হয়নি। তিয়াসা বলেছিল, ‘ম্যাম আপনি থাকলে প্রবলেমটা মিটে যায়।’

‘তোমার বাবা কি মেটাবেন? মেটাতে চান, যা শুনলাম তা তো উনি নিজেই মিটিয়ে দিতে পারেন। এর জন্য মিটিং ডাকা কেন?’

‘সেটাই তো ম্যাম। আপনি থাকলে, বাবা পিছলে বেরিয়ে যেতে পারবে না। আমার বাবার কথায় খুব ভাঁজ। এমন আশা ভরসার কথা বলে দেবে, খোকনদারা আবার গাড্ডায় পড়ে যাবে। আমি বা মা চাই খোকনদারা টাকা ফেরত পাক। খোকনদার মা আমার মায়ের চেনা। আপনি খোকনদার জন্য চলুন ম্যাম—। ওদের আর কিছু নেই।’

শাকম্ভরী তবু রাজি হয়নি। চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য কেউ টাকা নিয়েছে, তার মধ্যস্ততাকারী কি হওয়া উচিত?

তবু শেষ পর্যন্ত শাকম্ভরী রাজি হয়েছিল।

সকাল আটটায় মিটিং। খুবই গোপনীয়তায় আয়োজন করা হয়েছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত হবে। হাজির ছিলেন গিরিধারী সামন্ত, তাঁর স্ত্রী ইন্দুলেখা, মেয়ে তিয়াসা, খোকন আর শাকম্ভরী। মোট পাঁচজন। সামন্ত পরিবারের বাইরের মানুষ দু’জন।

ঠিকে কাজের মাসিকে বলা হয়েছিল, দশটার পর আসতে। তবে সর্বক্ষণের পরিচারিকা কমলামাসি ছিলেন।

মিটিং-এর জন্য সবাই হাজির হলেও গিরিধারী ঘুম থেকে ঠিক সময়ে উঠতে পারেননি। ইদানীং তাঁকে ঘুমের ওষুধ খেতে হয় ঘুমানোর জন্য। তাতেও নাকি ঘুম আসে না। সেদিন রাতে তিনি সাড়ে দশটার সময় শুয়েছিলেন। কিছুতেই ঘুম আসেনি। তখন রাত দুটো হবে (এটা সকালেই গিরিধারী সবাইকে বলেছিলেন) তিনি আবার একটা ঘুমের ওষুধ খান।

মিটিং শুরু হয় দেরিতে। প্রায় সাড়ে আটটা।

তার আগেই পরিচারিকা কমলামাসি সবাইকে চা দিয়েছিলেন। সবাই চা খেয়েছিল। গিরিধারী চা ওঁর বসার টেবিলেই ঢাকা দেওয়া ছিল। উনি উঠে সেই চা-ই খান। তখন কোনও সমস্যা ছিল না।

গিরিধারী প্রস্তাব দিয়েছিল, তিনি আটজনকে এককালীন এক লক্ষ টাকা করে ফেরত দেবেন। তারপর তাঁকে, ছ মাস সময় দিয়ে হবে, তিনি কিছু জমি বিক্রি করবেন। সেই জমি ওঁর বড়মেয়ের নামে আছে। সেই জমির পুরো টাকা তিনি আট ভাগে ভাগ করে দেবেন।

শাকম্ভরী বলল, ‘সেটা কত টাকা?’

‘দেখতে হবে দিদিমণি। অভাবী বিক্রি তো। দেখতে হবে— জমিটার কত দাম পাওয়া যায়?’

‘আনুমানিক?’

‘চোদ্দো পনেরো লক্ষ টাকা হবে।’

‘তাহলে ছ মাস পরে জমি বিক্রি করে— ওরা প্রত্যেকে আরও দু লক্ষ টাকার কম পাবে। এক একজন, আপনাকে বারো থেকে ষোলো, একজন কুড়ি লক্ষ টাকা দিয়েছিল। তার বদলে ছ মাসে মাত্র তিন লক্ষের কম টাকা ফেরত দিচ্ছেন? এটা কী করে হবে?’

‘এটাই হবে। এর বেশি কিছু আমি দিতে পারব না।’ গিরিধারী রুখে ওঠে।

‘তাহলে মিটিং ডেকেছেন কেন?’ খোকন বলল।

গিরিধারী বললেন, ‘তাহলে এক কাজ করো, একজন একজন করে টাকা নিক। নিজেদের মধ্যে প্রথমে লটারি করুক। প্রথমজনকে আমি আট লক্ষ টাকা দিয়ে দেব।’

‘আর সাতজন আঁটি চুষবে?’ খোকন উত্তেজিত ভাবে বলল।

গিরিধারী বললেন, ‘তাহলে আমি কী করব?’

শাকম্ভরী বলল, ‘সবাইকে ফিফটি পারসেন্ট টাকা ফেরত দেবেন। কী ভাবে দেবেন, তা আপনি দুদিনের মধ্যে জানাবেন।’

খোকন বলল, ‘ফিফটি পারসেন্ট। ছ মাসের মধ্যে পুরো কমপ্লিট করে দিতে হবে। গিরিদা কেউ না জানুক, আমি জানি— এই টাকা তোমার হাতের ময়লা। তুমি নিউটাউনের ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিলেই ষাট সত্তর লাখ পেয়ে যাবে। টাউনে মালতী নার্সিংহোমের ওপরে যেখানে স্বপ্নাকে নিয়ে যাও— সেই ফ্ল্যাটটার দাম কত? নার্সিংহোমের মালিকই ওটা নেওয়ার জন্য হাঁ করে বসে আছে। একবার বললেই নিয়ে নেবে। অন্তত পঞ্চাশ পাবে। আর বলব— জয় মা রাইসমিলে তোমার টাকা খাটে— সে সব আমাদের টাকা। আমরা জানি না, কত টাকা তুমি মেয়েদের পিছনে ওড়াও—’

খোকনের কথার মাঝেই ইন্দুলেখা উঠে চলে গেলেন।

শাকম্ভরী বলল, ‘খোকন বাজে কথা বন্ধ করো।’

‘আমাকে ক্ষমা করে দেবেন দিদিমণি। আমরা যখন টাকা দিচ্ছিলাম, তখন গিরিদা ওই সব সম্পত্তি কিনছিল। ঘুণাক্ষরে বুঝিনি, সব আমাদের টাকা।’

গিরিধারী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘খোকন বড্ড বেড়ে খেলছিস।’

‘হ্যাঁ, খোকনদা বেড়ে খেলছে, আর তুমি ঘুড়ির প্যাঁচ খেলছ।’ তিয়াসা ঠিকরে ওঠে।

‘মেয়ে মেয়ের মতো থাকবি?’ গিরিধারী গর্জে ওঠে।

‘নাহলে কী করবে মুখে ফলিডল ঢেলে দেবে?’

‘পেটে একটা লাথি মারব! বাপের খেয়ে বাপকে বাঁশ দিচ্ছো!’

‘আঃ!’ শাকম্ভরী বিরক্ত গলায় তিয়াসাকে বকল। ‘তুমি যাও। তোমার কমলামাসিকে বলো, আমি চা খাবো। সবার জন্যই একবার চা করতে বলো।

তিয়াসা উঠে যায়।

‘আমি খেলছি না গিরিদা। বিশ্বাস করো। কিচ্ছু নেই আমাদের। আমি চাইনি। মা কী করে জেনেছিল। হয়তো কমলা মাসির কাছ থেকেই শুনেছিল। মা-ই জমি বেচার ব্যবস্থা করে তোমাকে টাকা দিয়েছে। আমাদের খাবার টাকা নেই। আমরা মরে যাব।’

গিরিধারী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি কথা দিচ্ছি, তোর এক টাকাও মার যাবে না। তুই প্রথম আট লাখ নিয়ে নে। কেউ জানতে পারবে না। ওদের হটিয়ে দে। পরে ওদেরটা দেখব।’

শাকম্ভরী বলল, ‘কেন? তা হবে না।’

‘না, না, আমি এই শর্তে রাজি নই। তাতে আমি এক টাকাও না পেলে, না খেতে পেয়ে মরবো। তবু বেইমানি করব না।’

গিরিধারী সামন্ত গর্জন করে উঠল, ‘তাহলে আপাতত আমার কিছু করার নেই।’

‘কিছু করার নেই বললে আমি শুনব না। আপনাকে কিছু করতেই হবে গিরিধারীবাবু।’

‘আমি সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে দেখব—। এর বেশি আমার কাছে কিছু হবে না। আমাকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। দেশে আইন কানুন কিছু নেই না কী?’ গিরিধারী বললেন।

‘সব আছে। তাই জন্যেই তো আপনি ওদের টাকা ফেরত দেবেন। আমি আপনার ভিডিওটা দেখেছি। ইনফ্যাক্ট সেটা আমার কাছেও আছে। আপনি ভয় দেখিয়ে কজনকে থামাবেন। বরং ভাবুন। ভেবে বলুন— কবে কীভাবে টাকা দেবেন। ততক্ষণে আমি এই কাজু বাদামের প্যাকেটটা রান্নাঘরে দিয়ে আসি।’

শাকম্ভরী এক প্যাকেট সলটেড কাজু বাদামের প্যাকেট দুদিন আগেই এনেছিল কলকাতা থেকে, সেটা ব্যাগ থেকে বের করে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

চা দিয়েছিলেন কমলা। তার পাশেই ছিল ইন্দুলেখা। তিয়াসা আর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মিটিংয়ের ঘরে ফেরেনি। চা খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই। গিরিধারী সামন্তের শরীর হাঁসফাঁস করে। বিনবিন করে ঘাম হয়। তাঁর কথা জড়িয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে যান। সবার ধারণা হয় অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফল।

তাকে খোকন আর শাকম্ভরী ধরে ধরে নিয়ে যায় পাশের শোওয়ার ঘরে।

ওদিক থেকে তিয়াসা চিৎকার করে, ‘জেলে গেলেই ন্যাতাগুলো শরীর খারাপ হয়! এ তো জেলে যাওয়ার আগেই অ্যাক্টিং করছে! এটা পুরনো জিনিস, এতে তোমরা ভুলো না।’

কিন্তু গিরিধারী সামন্তের শরীর ক্রমশ যেন আরও খারাপ হয়। তখন ড্রাইভার সনৎকে খবর পাঠানো হয়। সবাই মিলে তাঁকে গাড়িতে তোলে।

কাছেই ছিল একটা গ্রামীণ হাসপাতাল। সেখানে চিকিৎসক দেখেন। বলেন, অবস্থা ভালো নয়, সদর হাসপাতালে নিয়ে যান।

সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন— কী হয়েছে?

তখন ডাক্তারকে ইন্দুলেখা বলেন, ‘ওনার ঘুম আসছিল না, কাল রাতে বেশ কটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। তারওপর খুব টেনশন চলছিল, আরও কী সব ওষুধপত্তর খেতেন।’

চিকিৎসক মেডিকেল রিপোর্টে লিখলেন, ‘রোগি স্লিপিং পিল পয়জনের শিকার’।

গিরিধারী সামন্ত মারা গেলেন পরেরদিন। চিকিৎসক ডেথ সার্টিফিকেটে লিখলেন : কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেলিওর ডিউ টু স্লিপিং পিল পয়েজন।

যেহেতু অস্বাভাবিক মৃত্যু তাই বডি পোস্টমর্টেম হতে গেল। ফরেনসিক মেডিসিনের ডাক্তার পোস্টমর্টেম করলেন, কিন্তু রিপোর্ট দিলেন না। প্রবল সন্দেহ নিয়ে ভিসেরা পাঠিয়ে দিলেন ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। পুলিশকে তাঁরা সেটা জানিয়ে দিলেন।

ফরেনসিক ল্যাবরেটরির রিপোর্ট এল, দেখা গেল সেই ডাক্তারের অনুমান ঠিক। স্লিপিং পিল পয়েজন নয়। মৃতের শরীরে পাওয়া গেছে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক। অরগ্যানো ফসফরাস কম্পাউন্ড।

কেসটা আর জেলার অন্দরমহলে থাকল না। লালবাজার পাঠাল আক্কেল বসুকে। তাকে বলা হল—

এক, মৃত ব্যক্তি ক্ষমতাসীন পার্টির জেলাসভাধিপতি।

দুই, তাঁর বাড়ির অন্দরে কাণ্ডটি ঘটেছে।

তিন, গ্রামীণ হাসপাতালের ডাক্তার এবং বিশেষ করে সদর হাসপাতালের তিনজন ডাক্তার কেসটিতে ফেঁসে গেছেন— স্লিপিং পিল পয়েজন লিখে। অতএব, ঠান্ডা মাথায় সবকিছু দেখতে হবে।

আক্কেল বসু পাঁচজনের নাম বুকে করে স্থানীয় থানায় এলেন।

প্রথম নাম: গিরিধারী সামন্তের স্ত্রী— ইন্দুলেখা সামন্ত। উনিই চা করেছিলেন। দিয়েছিলেন। ডাক্তারদের বলেছিলেন, স্লিপিং পিলের কথা।

দ্বিতীয় নাম: মেয়ে— তিয়াসা সামন্ত। বলেছিলেন: বাবা ঘুমের ওষুধ বেশি খেতে পারেন। আগেও উনি বেশ কয়েকবার এমন কাণ্ড (নাটক) করেছেন।

তৃতীয় নাম: শোভন মাইতি, ওরফে খোকন। তার সঙ্গেই মিটিং ছিল।

চতুর্থ নাম: শাকম্ভরী ভট্টাচার্য। শিক্ষিকা। নিরপেক্ষ। মধ্যস্ততাকারী।

পঞ্চম নাম: কমলা দাস। পরিচারিকা।


তিন


‘আপনি শাকম্ভরী ভট্টাচার্য।’ কথাটা বলে আক্কেল হাত তুলে শাকম্ভরী ভট্টাচার্যকে নমস্কার জানাল। শাকম্ভরীও হাত তুলে পালটা নমস্কার জানাল। হাসল আক্কেল, বলল, ‘আমিই আক্কেল বসু। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম— দেখা করার জন্য।’

‘হ্যাঁ, আমি আপনাকে স্কুলেই আসতে বলেছিলাম। স্কুলে এলেই ভালো হতো।’

‘দেখুন, স্কুলে যেতেই পারতাম। কিন্তু সেটা ভালো হতো না, আমি কে, কী ব্যাপার, পাঁচজন পাঁচ কথা বলত। জানতে চাইত। তাছাড়া আপনার ক্লাস থাকে। কাছাকাছি আরও অনেক লোকজন থাকে। যাই বলেন, আমি দেখেছি, কাজের জায়গায় সেই কাজ ছাড়া অন্য কাজ হয় না। আর আমার তো অন্য কাজ নিয়ে আসা—।’

‘আপনার আসার কারণটা আমি জানি। কিন্তু আমি কেন— সেটা আমি জানি না।’

আক্কেল তার ভুবনজয়ী হাসিটা হাসল। বলব, ‘আমি আসলে আপনাকে দিয়েই শুরু করতে চাইছি। তাই আপনিই প্রথম—। শীর্ষে পৌঁছাতে একটু সময় লাগে, তবে যাব, আমি সবার কাছেই যাব। পর পর, একে একে যাব—। আপাতত তাহলে আপনার ঘরে গিয়ে বসি।’

‘সরি, সরি, আসুন, আসুন।’ শাকম্ভরী প্রথমে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। তারপর নিজেই ঘরের ভেতর এগিয়ে গেল। আক্কেল সিঁড়ির নীচেই জুতো খুলে এসেছিল, সরাসরি সে ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘আপনার বাড়িওয়ালা আমার কাছে জানতে চাইছিল, আমি কে? কী ব্যাপারে এসেছি। ওঁকে কিন্তু আমি আমার সত্য পরিচয়ই দিয়েছি। এবং কারণটাও উনি বুঝেছেন। তবে একটু ঘুরিয়ে বলেছি, স্কুলের পরিচালন সংক্রান্ত ব্যাপারে গিরিধারীবাবুর কথা জানব—।’

‘কী সত্যি সেটা আমি জানি না। তবে সত্যিটাই বলতে পারতেন। আমার কোনও অসুববিধে হতো না। থানা থেকে তো আগেও আমার কাছে এসেছিল। সব কথা নোট করে নিয়ে গেছে।’

ওপর তলায় একটু ঢুকেই সামনে তিনটে সুদৃশ্য বেতের চেয়ার, সোফা বলা যাবে না। তবে বসার আয়োজন বেশ পরিপাটি। আক্কেল বসল। সামনে বেতের টেবিল।

‘আপনি বসুন। আমি একটু আসছি।’

শাকম্ভরী জল নিয়ে আসতে যাচ্ছিল, কিন্তু আক্কেল বেআক্কেলের মতোই বলে উঠল, ‘আমার কিন্তু শুধু লিকার। নো মিল্ক, নো সুগার।’

‘চা খাবেন? তাহলে আরও একটু বসতে হবে।’ ভেতর থেকে উত্তর এল।

‘অসুবিধে নেই। অফুরন্ত সময়, এখন এই কদিন আমাকে এ এলাকাতেই ঘোরাঘুরি করতে হবে। অপরাধী খুঁজতে হবে—’

আক্কেল যাকে উদ্দেশ্য করে বলল, সে কোনও জবাব দিল না। তার বদলে, চায়ের কাপ প্লেটের টুংটাং শব্দ শোনা গেল।

আক্কেল ঘরের দিকে তাকিয়েছিল। মেয়েটার মারাত্মক ব্যক্তিত্ব। মেয়েটা ভেবেই তার মণিমার মুখ মনে পড়ল আক্কেলের। কাছাকাছি থাকলে নির্ঘাত ভ্রু কোঁচকাত। পরে ঠিক ভ্রমসংশোধন দিতে হতো— মেয়ে নয়, বল—মহিলা। কত বয়েস হবে, পঁচিশ থেকে তিরিশ। না, আর একটু কমিয়ে দেওয়া যায়। পঁচিশ থেকে সাতাশ এটা দেখতে। কিন্তু আসল বয়েস তেত্রিশ।

চা এল। সঙ্গে বিস্কিট।

চায়ে চুমুক দিয়ে আক্কেল বলল, ‘আপনার নামটা কিন্তু ভেরি আনকমন।’

শাকম্ভরী মাথা নাড়ল। সম্মত হল কিনা বোঝা গেল না।

‘কে রেখেছেন? বাবা?’

‘না, আমার ঠাকুর্দা। উনি সংস্কৃতের অধ্যাপক ছিলেন।’

‘বাহ্‌, তাহলে আপনিই শুধু নন, আপনার ঠাকুর্দাও শিক্ষাদান করতেন।’

‘হ্যাঁ, উনি কলেজে পড়াতেন, আমি স্কুলে।’

‘শুধু স্কুলে নয়। বলুন, গ্রামের স্কুলে। শহরের স্কুল হলে অন্যরকম হতো—।’

‘শহরেই তো ছিল আমার আগের স্কুল। তবু এখানেই চলে এলাম— গ্রামে থাকব বলে।’

‘যা জেনেছি, আপনি এসেছেন এগারো মাস। এখানে সব ঠিকঠাক—’

‘হ্যাঁ, ঠিকঠাকই তো আছে।’

‘আরে ঠিকঠাক থাকলে কি লালবাজার থেকে ঠেলে আমাকে এখানে পাঠায়? না, আমাকে আসতে হয়? ঠিক নেই, ঠিক নেই। খুব গণ্ডগোল।’ আক্কেল নাটকীয়ভাবে মাথা নাড়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে।

ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে শাকম্ভরী। তার কোলের ওপর হাতদুটো জড়ো করা। বিকেল হয়ে সন্ধের মুখে। জানলা দিয়ে লাল আভা নিয়ে দিনের শেষ আলো ঘরে ঢুকছে। ওদিকে বারান্দা। বেশ খোলা। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।

‘এটা আপনার দ্বিতীয় স্কুল। প্রথম স্কুলের সঙ্গে গোলমাল। তারপর এখানে—।’

‘হ্যাঁ, ওই স্কুলটা আসলে চোরচিটার ভরা। চিটার কখন টিচার হতে পারে না। তাই এখানে চলে এলাম—। প্রতিবাদ করতেই নানা কুৎসা। চলে এলাম এখানে।’

‘ঠক বাছতে গাঁ উজার হবে।’

‘গাঁ-ই তো বেছেছি। প্রয়োজন হলে আবার অন্য কোথায় যাব। কোথাও না কোথাও ঠিক সেট করে যাব।’

‘আপনার বাড়িওয়ালা শ্যামাকান্ত বারুই নীচে থাকেন—।’

‘হ্যাঁ, আসার সময় তো আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে বললেন—।’

‘একটা জিনিস বুঝলাম না, উনি দোতলার এমন চমৎকার ঘরদোর ছেড়ে কেন একতলায় নামলেন?’

‘ওঁর স্ত্রীর হাঁটুর খুব সমস্যা, প্রায় সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা করতেই পারেন না।’ ‘এই দেখুন। আপনি ওঁর স্ত্রীর হাঁটুর সমস্যার কথা বললেন। আর গ্রামের একজন বলল— নতুন দিদিমণির কাছ থেকে বেশি টাকা খিঁচবে বলে তাকে ভালো ঘরদোর ছেড়ে দিয়েছে। বেশ অনেকগুলো টাকাই ভাড়া দেন।’

‘হ্যাঁ, যা চেয়েছে, তাই দিই। বেশি কম জানি না।’

‘নাকি গিরিধারী সামন্তই শ্যামাকান্তবাবুকে রিকোয়েস্ট করেছিল, শহরের মেয়ে, মানে দিদিমণি, তাকে ভালো ঘরটা দাও।’

‘এমন কোনও কথা আমি শুনিনি। সত্যি বলতে কি আমার সঙ্গে গিরিধারীবাবুর তেমন ভাব ছিল না।’

‘আমিও শুনিনি। আর শুনলেই বা কি? শোনা কথা আমি বিশ্বাস করি না। আজ সকালে কলকাতা থেকে এসেছি। কত কিছু শুনছি— দেখা যাক।’

ঠিক এই সময় দোতলার সিঁড়ির মুখে শ্যামাকান্ত বারুই। ‘দিদিমণি একটু শুনবেন।’

ভ্রু কুঁচকে উঠে গেল শাকম্ভরী। সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়াল, বলল, ‘এ কী?’

‘আমার স্ত্রী পাঠাল— স্যার আমাদের বাড়িতে এসেছেন, তাই স্যারের জন্য। আপনি যদি একটু এগিয়ে দেন।’

‘আমি কেন? আপনি নিয়ে এসেছেন, আপনি দিয়ে যান।’ কথাটা বলে কঠিন পায়ে শাকম্ভরী এসে আগের জায়গায় বসল। আর তার পিছনে পিছনে শ্যামাকান্ত বারুই। তাঁর হাতে একটা মিষ্টির প্লেট। প্লেটটা রেখেই তিনি উধাও হয়ে গেলেন।

প্লেটটা দেখে আক্কেল হাসল। বলল, ‘বাহ্‌, আপনার বাড়িওয়ালাটা ভারী ভালো তো। আপনি ওঁর ওপর একটু রেগে গেলেন বটে, কিন্তু উনি কাজটা খারাপ করেননি। দুপুরে আজ যেখানে খেলাম, মোটেই ভালো না। থানা থেকেই রাতে একটা থাকার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আমি থাকছি না। গাড়ি আছে টাউনের একটা হোটেলে চলে যাব। আশাকরি সেখানে খাওয়াটা ভালোই হবে।’

কথাটা বলে আক্কেল প্লেটটা টেনে নিল। ছটা রসগোল্লা। পর পর দুটো খেল। বলল, ‘পরে খাচ্ছি। একটু জল দিন।’

শাকম্ভরী একটা বোতল আর এক গ্লাস জল নিয়ে এল।

আক্কেল বোতলের দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, ‘আপনি বোতলটা নিয়ে এসে ভালো করেছেন। এখনও চারটে রসগোল্লা আছে। ওগুলো যখন খাব, তখন দফায় দফায় জল লাগবে। বোতলটা আমাদের শহরের সংস্কৃতি।’

শাকম্ভরী বলল, ‘আপনার কী প্রশ্ন আছে করুন। কী জানতে চান?’

‘ঠিক বলেছেন। আমি কাজ করতে এসে বেআক্কেলের মতো নানা হাবিজাবি কথা বলছি, খেয়ে যাচ্ছি, এবার কাজের কথায় আসি। আসলে, আপনি আমার নামটা দেখেছেন তো, আক্কেল, আক্কেল বসু। না, কোনও ছদ্মনাম নয়। সারাজীবন আক্কেল দেওয়ার আমার পিতৃদেব আমার এই নামকরণটা করেছেন। কেন জানেন? আমি জন্মানোর সময় উলটো হয়ে জন্মেছিলাম। এই বেআক্কেলে কাণ্ডের ফলে আমার মা মারা যান। কিন্তু দেখুন, আমার এখনও আক্কেল হল না।’

আক্কেলের কথা শুনে শাকম্ভরী হঠাৎ যেন একটু সোজা হয়ে বসল।

আক্কেল বলল, ‘না, না, দুঃখ পাবেন না। আমি ছোটবেলায় খুব পেতাম। এখন পাই না। তবে হ্যাঁ, বাবার জন্য দুঃখ পাই, বড্ড অল্প বয়েসে উনি স্ত্রী হারিয়েছেন। না, আর বিয়ে করেননি। আচ্ছা, গিরিধারী সামন্তের তো এই স্ত্রী দ্বিতীয় পক্ষ। তাতেও শুনলাম সন্তুষ্ট না। ওঁর একটু— একটু না বেশ বেশি মহিলার দোষ ছিল। তা আপনাকে কোনওদিন ডিস্টার্ব করেননি?’

‘না।’

‘এককথায় উত্তর দিলেন। কিন্তু আমি শুনেছি করেছিলেন। উনি তো আপনাদের স্কুল পরিচালন সমিতির মাথা। আপনার এক ভাই এসেছিল, উনি ভাই বলে বিশ্বাস করেননি। উনিই নাকি একজনকে আড়ি পাততে পাঠিয়েছিলেন— পুরুষমানুষটা কে বলে? সে আপনার কাছে ধরাও পড়ে। আর আপনি জেনে যান, গিরিধারীবাবুই তাকে পাঠিয়েছেন, শুনে স্কুল মিটিংয়েই নাকি আপনি গিরিধারীবাবুকে বেশ কড়া ভাষায় কথা বলেন— এই দেখো, আপনার উত্তর আমিই দিয়ে যাচ্ছি।’

‘সে ব্যাপারটা সেদিনই মিটে গেছে। আর আমার এক ভাই নয়। আমার নিজের একটা ভাই। সেই এসেছিল।’

‘হ্যাঁ, মিটে গেলেই ভালো হতো। কিন্তু সবাই জানে গিরিধারীবাবুর ওপর আপনি খুব খাপ্পা। তাই ওঁর বিরোধীরা আপনার সঙ্গে খুব যোগাযোগ রাখত।’

‘একদম বাজে কথা। সে বাড়িটির একতলায় থাকতাম, তারপরে আমি এই বাড়ির দোতলায় ভাড়া নিই।’

‘আমারও তাই মনে হয়। উনি ক্ষমতাসীন দলের পঞ্চায়েতের জেলাসভাধিপতি আর আপনি একটা স্কুলের দুদিনের টিচার!’

‘ঠিক বলেছেন। আমি জাস্ট ওঁকে বলেছিলাম— যাকে আমি ধরেছি, সে আপনার নাম বলেছে। বলেছে, আপনার সন্দেহ, ও আমার ভাই নয়, অন্য কেউ। কথাটা শুনে মিটিঙেই উনি মাথায় হাত দিয়ে বসলেন, বললেন, মূর্খ! মূর্খ! এদের ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। আমি বলেছিলাম, মেয়েদের ইস্কুলে একটা ব্যাটাছেলে ঘুরে ঘুরে কী দেখছিল? তাতেই ওরা উৎসাহী হয়ে আপনার ঘরের জানলায় উঁকি দেয়। এই অসুবিধে বুঝলেন। একতলায় থাকলে বড্ড লোকের চোখে পড়ে। দাঁড়ান আমি শ্যামাকে বলে দেব, শুনলাম ও দোতলাটা ভাড়া দেবে।’

‘হ্যাঁ, আপনি প্রথম বাড়িতে মাত্র দু’মাস ছিলেন, তারপরই এই শ্যামাকান্তবাবুর বাড়ি। উনিই বলে দিয়েছিলেন—। কিন্তু আমি যা শুনেছি, আপনি ওর পক্ষের লোক ছিলেন না। না থাকারই কথা, বাজে লোক— কিন্তু ওঁর মেয়ের সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক ছিল। খুবই ভালো সম্পর্ক। ও দিনরাত এখানে আসে। খায়, থাকে।’

‘মেয়েটি ডানপিটে, কিন্তু ভালো। খুব ভালো সম্পর্ক আমার সঙ্গে।’

‘আবার এককথায় উত্তর দিয়ে দিলেন। আমার সংক্ষিপ্ত কোনও প্রশ্ন নেই। সব প্রশ্নই যতটা পারেন বিস্তৃত করে বলুন। একটু ডিটেলস চাই। কীভাবে এক ডানপিটে ছাত্রীর সঙ্গে আপনার ভাব জমল?’


চার


এ মেয়েটা খুব বজ্জাত। শাকম্ভরী শাড়িটা টানে। কিন্তু অত কি হুঁশ থাকে। একটু পরেই যেন মনে হয়, মেয়েটা আবার একটু সরে বসেছে, আরও কোণাকুনি। পরিষ্কার একটা অ্যাঙ্গেল নিয়েছে। আশ্চর্য! কী বদমাইশ মেয়ে রে বাবা!

এটা ক্লাস নাইন। শাকম্ভরী ম্যাথসের টিচার। রোজই ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে তাকে অঙ্ক করতে হয়। অঙ্ক করানোর সময় কি অত হুঁশ থাকে? কে কোন সময় তার শরীর নিয়ে অঙ্ক কষছে। তাও যদি কো-এড হতো, বা বয়েজ হতো, তাহলে সে নিশ্চয়ই বেশি সর্তক থাকত। কিন্তু একটা গার্লস স্কুলে। এ কী আপদ! শাকম্ভরী এটা আগেও দেখেছে। গত দুদিন ধরে বেশি করে দেখছে। ওর মনে হল, চকটা ছুঁড়ে মেয়েটার চোখে মারে।

অঙ্কটা শেষ করে মেয়েটার দিকে ঘুরে সরাসরি তাকাল শাকম্ভরী। বলল, ‘অঙ্কটা বুঝেছ?’

মেয়েটা হ্যাঁ-না-এর মাঝে একটা বোকা ঘাড় নাড়ল। মাথার পিছনে পনিটেলটা চলকে উঠল। একবার পেনটা ওপর দিকে তুলল, যেন কিছু বলবে, আবার নামিয়ে নিল।

শাকম্ভরী বলল, ‘তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে কিচ্ছু বোঝোনি। কী নাম তোমার?’

এই কী নাম তোমার— আজ নিয়ে ওকে শাকম্ভরী তিনদিন জিজ্ঞাসা করল। এ জিজ্ঞেস করাটা ইচ্ছে করেই। ওর নাম তিয়াসা, তিয়াসা সামন্ত সেটা প্রথম দিন থেকেই শাকম্ভরী জানে। তবু এটা সে ইচ্ছে করেই জিজ্ঞাসা করল, যেন এ মেয়েকে তার আলাদা করে মনেই নেই।

‘আমার নাম তিয়াসা।’

তিয়াসা শুনেই ঝাঁঝিয়ে উঠল শাকম্ভরী, ‘পুরো নাম বল। উঠে দাঁড়াও। কীভাবে নাম বলতে হয় জানো না? পুরো নাম বলো?’

‘তিয়াসা সামন্ত ।’

‘তুমি কি অঙ্কটা বুঝতে পেরেছ? স্পষ্ট করে বলো।’

‘না, মানে—।’

‘কোনও মানে নেই— অঙ্কে কোনও মানে হয় না। হয় বুঝতে পেরেছ, নয় বুঝতে পারোনি।’ তিয়াসার দিক থেকে মুখ সরাল শাকম্ভরী, এবার সে পরবর্তী মানসিক গেমটা খেলল, বলল, ‘আর কে কে বুঝতে পারোনি?’

কথাটা বলেই শাকম্ভরী অপেক্ষা করতে শুরু করল। চোখের চাউনি কঠিন। যেন কেউ ‘না’ বললেই তাকে খ্যাক করে ধরবে। ওর মন বলছে, সবাই বলুক বুঝতে পেরেছে। সবাই বলুক বুঝেছে। ওকে আলাদা করে দিতে হবে। ওর বদমাইশি ঘুচিয়ে দিতে হবে। একমাত্র ও-ই বুঝতে পারেনি, এটাই ওকে বোঝাতে হবে।

কেউ কোনও কথা বলল না। সবাই চুপ। শাকম্ভরী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, বুঝুক না-বুঝুক কেউ না বলেনি। শাকম্ভরী আবার বলল, ‘হ্যাঁ, কী নাম বললে— তিয়াসা। তিয়াসা তো? তা তিয়াসা এত অন্যমনস্ক হলে হয়?’ সে গলার স্বর নরম করল, ‘আমি বোর্ডে অঙ্ক করাচ্ছি, আর তুমি অন্যদিকে চেয়ে আছো। তোমার চোখ কোন দিকে? আবার বলছ, বুঝতে পারনি। ক্লাসে যতক্ষণ থাকবে মনটা ক্লাসে রাখো? একটু মন দিয়ে দেখো, টিচার কী করছেন।’

‘আমি তো আপনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম ম্যাম।’

‘আবার মুখে মুখে কথা বলছ— আমার দিকে তাকাতে বলিনি, বোর্ডের দিকে তাকাবে। আর দেখছিলে যদি বুঝতে পারলে না কেন? নাও, আমি এই রকমই আর একটা অঙ্ক করছি, খুব ভালো করে মনটা দাও।’

শাকম্ভরী বোর্ডে আবার একটা অঙ্ক শুরু করল। অঙ্কের প্রতিটি স্তরে থেমেই সে তিয়াসার দিকে তাকাল। না, তার মনে হল, এ মেয়ে এখনও তাকে দেখছে, অঙ্ক নয়। অঙ্ক শেষ করতে না করতেই ক্লাস শেষের বেল বেজে গেল। অঙ্কটা শেষ করে, শাকম্ভরী সোজাসুজি ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আশাকরি কারও আর অসুবিধা থাকল না।’

জোর করে সবাইকে বুঝতে পারার মানসিক গেমটা খেলেছিল সেটা দ্বিতীয়বার অঙ্কটা করিয়ে পাপস্খালন করল। তার মনে হল, যারা বুঝতে পারেনি, এবার নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পারবে।

ক্লাস থেকে বেরুতেই শাকম্ভরীর মনে হল তিয়াসাও ঝাড়া মেরে উঠে দাঁড়িয়েছে। ক্লাস থেকে বেরিয়েই সে দেখল তিয়াসা ঠিক তার পিছনে।

বিরক্তিকর।

করিডর দিয়ে কয়েক পা এগতেই পিছন দিক থেকে হালকা গলায় উড়িয়ে দেওয়া কথার মতো কেউ একটা বলল, ‘ম্যাম আপনার শাড়িটা খুব সুন্দর!’

ঝটিতি ঘাড় ঘুরিয়ে শাকম্ভরী দেখল তিয়াসা। একবার মনে হল, ঘুরে দাঁড়িয়ে এক প্রস্থ ঝাড় দেবে। না, সে নিজেকে সামলে নিল। নতুন স্কুল। মাত্র ন দিন এসেছে। এরমধ্যে করিডরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করা উচিত হবে না। যা করার ক্লাসেই করতে হবে। সে দাঁতে দাঁত টিপে টিচার্সরুমে ঢুকল। এই পিরিয়ডটা তার অফ।

টিচার্সরুম ফাঁকা। হঠাৎ তার নজরে পড়ল লম্বা টেবিলে একটা কাঠবিড়ালি মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখেই তার মনটা ভালো হয়ে গেল। মনে হল চেয়ার সরালে কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে যাবে। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। টেবিলে খাতা বই, তার ব্যাগ কিছুই রাখল না, পাছে শব্দ হয়। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই মনে হল কাঠবিড়ালিটা জেনে গেছে, কেউ একজন ঘরে ঢুকে তাকে দেখছে। আর মনে হতেই নিমেষে সে খোলা জানলা দিয়ে হাওয়া।

টেবিলে খাতা বই, ব্যাগ রেখে শাকম্ভরী এসে দাঁড়াল জানলার সামনে। আর তখনই দেখল তিয়াসা স্কুলের পিছন দিকে দুটো ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। একটা ছেলের সাইকেলের প্যাডেলে বেশ বেয়াড়া ভাবে তার এক পা তোলা। আশ্চর্য! শাকম্ভরী বেরিয়ে আসতে আসতে দেখেছে জিওগ্রাফি টিচার প্রশান্তবাবু ওদের ক্লাসে ঢুকছে। মেয়েটা ক্লাস না করে ছেলে দুটোর সঙ্গে আড্ডা মারছে। হঠাৎ একটা ছেলে জানলার দিকে তাকাল।

শাকম্ভরী সরে এল। না, এত নজর সে দেবে না। মাত্র ন দিন এই স্কুলে তার বয়েস। আর একটু সময় চাই। সে সরে আসতে গিয়ে দেখল, ওর পাশে এসে তপতীদি এসে দাঁড়িয়েছে। তার নজরও জানলার বাইরে। বলল, ‘কী দেখছো দিদি?’

‘ওই একটা কাঠবিড়ালি, টেবিলে ঘুরছিল। আমার পায়ের শব্দ পেয়েই পালাল।’

‘ও তাই বলো, আমি ভাবলাম সামন্তবাবুর মেয়েকে দেখছো। তা দেশগ্রামে চাকরি করতে এসেছ, অনেক কাঠবিড়ালি দেখবে, বেঁজি দেখবে। গত বছর বর্ষার সময় টিচার্সরুমে একটা সাপও ঢুকে পড়েছিল।’

‘সাপ!’

‘হ্যাঁ, জলঢোড়া। বিষাক্ত নয়। তবে আমরা ভয় পাব না, তোমরা পাবে। স্যারেরা সব দেখে ক্লাস করতে চলে গেল। শেষে ওই সামন্তবাবুর মেয়ে তো হাতে ধরে বাইরে ছুঁড়ে ফেলল।’

‘ও ধরল কেন?’ বিস্মিত গলায় শাকম্ভরী প্রশ্ন করল।

‘আমি রজককে অনেকে খুঁজেছি। সে ব্যাটাও নেই। তবে, ওকে ধরতে বারণ করেছিলাম, বিষ নেই ছোবল মারবে না, ঠিক কথা। কিন্তু কামড়ে দিলে জম্মের ঘা হয়ে থাকবে।’

শাকম্ভরী কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকল। বিড়বিড় করল,‘খুব সাহস তো—।’

‘খুব সাহস ওর, ব্যাটাছেলের বাপ! ওই যে দেখছো না, ক্লাস না করে কেমন ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। ওর জন্য কত ছেলে এখানে ঘুরঘুর করে জানো। ওর একটা ছোটখাট গ্যাং আছে। বাপের ধারা পেয়েছে।’

শাকম্ভরী জানলার বাইরে তাকাল। আসলে সে তাকাতে চাইনি। কিন্তু তপতীদির কথায় তার চোখ চলে গেল। তখনই তার সঙ্গে তিয়াসার চোখাচুখি হল। বেশ তীব্র স্বরে একটা পাখি ডেকে উঠল। কী পাখি? অনেকটা যেন শিসের মতো সুর।

তপতী বলল, ‘যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে হয়েছে। হয় একদিন বাপ জব্দ হবে, নয় মেয়ে!’

‘কেন কী করেছে ও?’

‘কী করেনি বলো। তুমি তো ইস্কুল ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছ না, দেখবে।’

শাকম্ভরী হাসল, ‘পালাব কেন? তুমি তো পালাওনি।’

‘আমি আর কোথায় যাব। তুমি মরতে কেন যে এই ইস্কুলে এলে, কে জানে? ভালো ইস্কুল আর পাওনি নাকি? দেখো বাবা এখানে আবার বিয়ে সাদি করে থেকো যেও না। তালে হাড়ে কালি ধরে যাবে।’

হেসে ফেলল শাকম্ভরী। ‘বাপ রে তোমার যে ইস্কুলের ওপর খুব রাগ।’

‘ইস্কুল কেন, আমার এখানে সব কিছুর ওপরই রাগ। এখানে সব কটা হারামি!’

‘অ্যাই! একদম বাজে কথা নয়।’ চোখ পাকাল শাকম্ভরী।

‘সেই বাজে কথা বলব না। কিন্তু মুখে যে ভালো কথা আসে না। তুমি দেখো না, কদিন পরে তোমার মুখে কী বাক্যি আসে। অবশ্য তুমি মুখ ফুটে বলবে না, আমি জানি, মনে মনে গজরাবে।’

‘না গো, আমার অসুবিধে হলে আমি মুখ ফুটেই বলব।’

‘এক হপ্তা তো হয়ে গেল, এখানে তোমার ভালো লাগছে? আমার যদি সুবিধে থাকত, এক কাপড়ে ছেড়ে পালাতাম।’

‘আমার কিন্তু খারাপ লাগছে না। তবে হ্যাঁ, দিদিমণিদের বাথরুমটা বড্ড খারাপ। এসেই হেডস্যারকে বলেছি। উনি বলেছেন, সামনে পর পর তিনদিন ছুটি আছে, মিস্ত্রি লাগিয়ে ঠিক করে দেবেন।’

‘ভালো! হেডস্যার ভালো মানুষ। কিন্তু ভোমরা। যে যা বলে তাতেই ঘাড় নাড়ে।’

‘আবার বাজে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি।’

তপতী চুপ করে শূন্য চেয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। শাকম্ভরী আবার জানলার দিকে তাকাল। তপতী বলল, ‘ওকে দেখো না, যত দেখবে ও মেয়ে তত দাঁড়িয়ে থাকবে। ও খুব ঢ্যাঁটা।’

‘ক্লাস না করে ও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে কেউ কিছু বলবে না।’

‘কার ঘাড়ে মাথা আছে ওকে বলবে। ও সামন্তবাবুর মেয়ে। তার ওপর বাপের এক কাঠি বাড়া। তুমি দরদ দেখিয়ে বললে না, ও কেন সাপ ধরবে। আমিও ওকে বলেছিলাম। যেও না তিয়াসা। বিষ না থাকলেও খুবলে মাংস তুলে নেবে। ঘা হয়ে মরবে। ও কী বলল জানো?’ কথাটা বলে তপতী থামল। বেশ কিছুক্ষণ থেমে থাকল, তারপর চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ওকে ওর বাপ বলেছে— বুকে পা দিয়ে তোর মুখে ফলিডল ঢেলে দেব। সেটা আমাকে বলে বলল, তোমার গিরি আমার বুকে পা দিয়ে মুখে ফলিডল দেবার হুমকি দিয়েছে, আমি ভয় পাইনি। আর ও আমার এক খাবলা মাংস তুলে নেবে বলে ভয় দেখাচ্ছ।’

‘গিরি মানে?’

‘গিরিধারী সামন্ত। আমাদের সভাপতি গো। বুঝে দেখো, অমন বাপকে ও মেয়ে চমকায় না।’

‘তিয়াসা গিরিধারী সামন্তের মেয়ে। ওঁর তো বেশ বয়েস হয়েছে।’

‘বয়েস হয়েছে তো কী হয়েছে। এটা দ্বিতীয়পক্ষের মেয়ে। তুমি তো আছ, সব শুনতে পাবে। একদিনে আর কত রামায়ণ – মহাভারত বলব। সব শুনবে আস্তে আস্তে, কান পচে যাবে। আর জানলার দিকে তাকাওনি।’

‘না, না, আমি দেখছি না। একটা পাখি ডাকল— সে জন্যেই তাকালাম।’

‘ওটা কোন পাখির ডাক? তুমি দেখছিলে বলে শিস ছুঁড়ল ও মাগি।’

‘আবার, আবার তুমি বাজে কথা বলছ।’

‘ও ছাত্রী হয়ে দিদিমণিকে শিস দিল ওর দোষ নেই, আমি গাল পাড়লাম বলে আমার দোষ!’

‘না, তোমার কোনও দোষ নেই। দয়া করে এখন মুখটা একটু বন্ধ করো।’


পাঁচ


‘আমার আর হারাবার কিছু ছিল না। তাই আমাকে যেতেই হয়েছিল ওর কাছে।’

‘পার্টির জেলার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্ষমতাশালী একজন মানুষের সঙ্গে লড়তে চলে গেলেন, আপনি কি এতটা বোকা!’

‘হ্যাঁ, আমি বোকা! বোকা!’ কথাটা বলে খোকন মাথা নিচু করে বসল।

আক্কেল চুপ করে ওর নেমে আসা মাথার দিকে তাকিয়ে থাকল। বলল, ‘আপনার ভালো নাম শোভন। ডাক নাম খোকন। খোকন মানে একটু খোকা খোকা ভাব, তাই বলে আপনি খোকা-বোকা এটা মানতে পারলাম না।’

মুখ তুলে তাকাল খোকন, ‘সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন, আমার আর হারাবার কিছু ছিল না। তাই আমাকে বাধ্য হয়েই ওর কাছে যেতেই হয়েছিল। সেটা লড়াই ঝগড়া ছিল না, আবেদন ছিল। হাতে পায়ে ধরেছি। অন্য কিছু ভাবিনি।’

‘অন্যকিছু মানে? খুন টুন?’

‘বিশ্বাস করুন, এ আমার দ্বারা হবে না।’

‘কী করে বিশ্বাস করব। এর আগে আপনি বনমালি নস্করের কেসে ছিলেন—।’

‘আমি ছিলাম না, আমার নাম জড়িয়েছিল। ওটা পলিটিক্যাল ব্যাপার ছিল। বনমালি সিপিএম করত। ওই মারতে এসেছিল, তখনই আমরাই পালটা দিই… আমি জাস্ট স্পটে ছিলাম। তাই আমার নাম জড়িয়ে ছিল—। যারা করেছিল তারা সব আমার বন্ধু।’

‘আপনি যতই বলুন শুধুই শোভন, তা কিন্তু নয়! এবারও আপনার নাম জড়িয়েছে। এবার আর বিরুদ্ধ পার্টির কেউ নয়। নিজের পার্টির। আর আপনি সেই স্পটে।’

‘আমি আর পার্টি করি না। সব শালা চোর। চাকরি দেব বলে, আমাকে জমি বিক্রি করিয়েছে, তারপর আমি চাকরি পাইনি। আমি পার্টির কেউ নই, পার্টিও আমার নয়।’

‘পার্টি পার্টি বললে ব্যাপারটা বায়বীয় হয় না, খোকনবাবু। বলুন ক্ষমতাসীন পার্টির সঙ্গে আর আপনার সংস্রব নেই। আসলে এখন আপনি অন্য পার্টি করেন।’

‘আমি একা থাকলে, একা একা গিয়ে পাওনা টাকার ডিমান্ড করলে ওই গিরিধারী সামন্তই আমাকে মেরে দিত। মিথ্যে নানা কেস দিয়ে দিয়ে ফাঁসাত। তাই পিছনে একটা রাজনৈতিক দলের ব্যানার চাই। আমি সেই ব্যানারটুকু নিয়েছি। আর কিছু না, বিশ্বাস করুন।’

‘এই বিশ্বাস করুন, বিশ্বাস করুন, বার বার বলবেন না তো। আমি বিশ্বাস করব না। ওই মিটিঙে আপনারা যারা যারা ছিলেন, তাদের মধ্যেই একজন বা একাধিকজন মিলে একটা খুন করছেন। সেটা ঠান্ডা মাথায়। মেরেছেন, মেরেছেন, মেরেছেন, আমি নিশ্চিত। কিন্তু ধন্দ একটাই সবার চোখের সামনে কীভাবে মারল? তারপর কে মারল?’

খোকন আবার মাথা নিচু করল।

‘আপনি রগচটা। আপনি রাজনৈতিকভাবে অনেক মারপিট, গন্ডগোলে ছিলেন। বনমালি নস্করের কেসে আপনি প্রত্যক্ষভাবেই ছিলেন— হ্যাঁ রাজনৈতিক খুনোখুনি হলে আপনারা সাধু। ব্যক্তিগত হলে খুনি। এমন তো নয়, অন্য পার্টির ব্যানার দিয়ে আপনি গা ঢেকে গিয়ে গিরিধারী সামন্তকে ভয় দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, টাকা না পেলে আমি ছাড়ব না। শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়ব। এই শেষটা কী? সেটা বলুন—’

‘আমি গিরিদাকে ভয় দেখিয়েছিলাম সেটা ঠিক কথা। কিন্তু খুন টুন নয়। এত ক্ষমতা আমার নেই। তবে মিডিয়ার কাছে যাব বলে ভয় দেখিয়েছিলাম। গিরিধারী সামন্তের নামে অনেক অভিযোগ সিবিআইয়ের ঘরে জমা আছে। আমার কাছে প্রমাণ আছে। শুধু আমি একা নই, আমরা মোট সাতজন। আমাদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়েছে। সব প্রমাণ আছে, আমাদের কাছে। সেই সব প্রমাণ নিয়ে সিবিআই, ইডির কাছে গেলে, ওই শালাও ফাঁসত। মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। কম টাকা করেছে? কটা মেয়েমানুষ পুষত জানেন—?’

‘জানি না। আচ্ছা, ওই নতুন দিদিমণি নিশ্চয়ই ওনার পোষা মেয়েমানুষ ছিলেন না?’

‘না, না, একদম নয়। উনি গিরিদাকে সহ্য করতে পারতেন না। স্কুলের মিটিঙে নাকি বার দুয়েক মুখের ওপর নানা কথা বলেছেন। সেটা নিয়ে গিরিদার খুব রাগ ছিল। কিন্তু এখন পার্টিতে উনি বেকায়দায়। যে কোনওদিন চাকরি পাইয়ে টাকা নেওয়ার কেসে সিবিআই তুলে নিতে পারে। তাই সতর্ক ছিলেন।’

‘আচ্ছা, আপনি কেন ওই দিদিমণিকে গিয়ে ধরলেন? এটা একটু ক্লিয়ার করুন তো? আপনাদের টাকা মিটিয়ে দেওয়ার মিটিংয়ে ওঁর ভূমিকা কী?’

একটু চুপ করে থাকল খোকন। বলল, ‘গিরিদা চেয়েছিল একজন মধ্যস্থতাকারী। আমরা চেয়েছিলাম নিরপেক্ষ কেউ। কিন্তু কেউ সেটা রাজি হচ্ছিল না। আসলে সবাই জানে, গিরিদার বিপক্ষে কোনও মত গেলেই তাকে গিরিদা ছাড়বে না। আজ না হোক কাল ঠিক তার সর্বনাশ করবে।’

‘আচ্ছা, সেই মধ্যস্থতাকারী হয়ে মিটিঙে গিয়েছিলেন শাকম্ভরী ভট্টাচার্য। আপনি একটা মেয়েকে সেই গিরিধারীর মুখে ঠেলে দিলেন। আসলে তাঁর ওখানে থাকা, এই গন্ডগোলে জড়ানোর কথাই নয়, ওক্কে। আর একটা প্রশ্ন, উনি কি প্রথম এই ভূমিকায় গেলেন? নাকি আগেও গেছেন? গেলে কেন গেলেন? এই অল্পদিন এসেই সাপের সঙ্গে খেলতে গেলেন, কেন?’

‘সত্যি কথা বলব, দিদির কাছে আমরাই হেল্প চেয়েছিলাম। তিয়াসার কাছে দিদিমণি আমাদের কথা সব শুনেছিল, জেনেছিল। আমি যে বাবার জমি জায়গা বিক্রি করে পথে পড়ে আছি, দিদি শুনে কষ্ট পেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, টাকা ফেরত পেলে আমি সাইকেলের দোকান দেব। তিয়াসাই দিদিমণিকে রাজি করিয়েছিল।’

‘কেন চাষ করবেন না? আপনি তো সবার সামনে হুমকি দিয়ে চাষির বেটার জমি কেড়ে নিয়েছেন— ওই জমির মাটিতে পুঁতব, আরও কী সব?’

‘সবই রাগের মাথায়, অসহায় হয়ে।’

‘যাইহোক, তাহলে দাঁড়াল, আপনাদের হয়ে ওই মিটিঙে সমর্থক ছিল শাকম্ভরী দিদিমণি, গিরিধারী সামন্তের মেয়ে তিয়াসা। তিয়াসা যদি আপনাদের সমর্থক হয়, তাহলে তার মাও নিশ্চয়ই আপনাদের সমর্থন করবেন।’

‘দেখুন, আপনি থাকলে আপনিও আমাদের সমর্থন করবেন?’

‘আমি কাউকেই সমর্থন করব না। ক্ষমতা থাকলে আপনাদের মতো যারা টাকা দিয়ে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চিত করেছেন, তাঁদের এবং গিরিধারী সামন্তদের মতো লোককে ফেলে উল্টো করে প্যাঁদাতাম। আপনারা সবগুলো হারামজাদা। শুনুন ভাই, ওই রকম একটা বিষ মালকে যে সরিয়েছে, সে একটা কাজের কাজ করেছে। এতে আমার কোনও দুঃখ নেই। শুধু সরকারের সঙ্গে সঙ্গে আমার কৌতূহল আছে, খেলাটা খেলল কীভাবে? একজন? নাকি সবাই মিলে? করল কে? করাল কে? পুলিশে চাকরি করি, জানার সুযোগ আছে। তাই আমি জেনে ছাড়ব। সে আজ, নাহয় কাল— এবার সত্যিটা বলুন, আপনি নয় তো কে করল?’

খোকন মাথা নাড়ে, ‘সত্যি আমি কিছু জানি না।’

‘কে জানে মনে হয়?’

‘বলতে পারব না। আমি ভাবতে পারছি না। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, ওকে কেউ মারেনি। ও এমনি মারা গেছে। ঘুমের ওষুধ খেত বেশি বেশি, তাতেই মরেছে। এটাই তো শুনেছি।’

‘তারপরে আর কিছু শোনেননি?’

‘শুনেছি।’

‘কী শুনেছেন?’

‘কীটনাশক খাওয়ানো হয়েছে।’

‘আপনি চাষির বেটা। কীটনাশক তো আপনার হাতের কাছে থাকে—।’

কথাটা শুনেই ঠিকরে উঠল খোকন, ‘আমি অন্য পার্টি করি তাই আপনারা পলিটিক্যালি আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন, স্যার। গ্রাম দেশে সবার হাতের কাছে কীটনাশক আছে। আপনি শহর থেকে এসেছেন, তাই আপনি জানে না। এটা দুর্লভ বস্তু নয়।’

‘আপনাকে আমি ফাঁসাব কেন? আপনি নিজে নিজেই ফেঁসে গেছেন। সবকিছুই আপনার বিপক্ষে যাচ্ছে। শুধু আমি পর পর ঘটনাগুলো সাজিয়ে দেব। ব্যস। আপনার ফাঁসি আটকায় কে?’

কথাটা শুনেই কেঁদে ফেলল খোকন। ‘ওই গিরিধারী সামন্ত আমার সব শেষ করেছে,আপনি বাদ বাকিটা করুন।’

‘এই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবেন না। লাভ হবে না। যা সত্য তা চাপা দিয়ে রাখা যাবে কি? সত্যিটা বলুন।’

‘আমি মারিনি।’

‘দলে ছিলেন। বনমালি নস্করকে মারার সময় যেমন ছিলেন, টিমে? একটু দূর থেকে। বুদ্ধি আপনার, হাত অন্যের। তেমন ছিলেন?’

‘আমি সত্যি সত্যি মিটিং করতে গিয়েছিলাম।’

‘গিয়ে বুঝলেন আজ বাড়ির ভেতরই গিরিধারী বলি হবে। কে করবে?’

‘সত্যি কিছু জানি না। গিরিধারীবাবুর চা খাওয়ার পরেই শরীর খারাপ করে। শরীর খারাপ করতেই উনি ভেতর ঘরে চলে যান।’

‘চায়ের সঙ্গেই বিষ ছিল। কীটনাশক। ডোজ বেশি—এতখানিই বেশি ছিল তিনজন মারা যেতে পারত। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন হয়েছে।’

‘কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ঘুমের ওষুধ থেকে এটা হয়েছে।’ খোকন বলল।

‘পোস্টমর্টেম বলছে—কীটনাশক। চায়েই ছিল—’

‘তাহলে আমাকে ধরছেন কেন? চা দিয়েছিল বউদি। গিরিধারীবাবুর স্ত্রী। এখানে আমি কী করে এলাম?’

‘এটাই তো আমার প্রশ্ন? ম্যাজিক নাকি? এতগুলো লোকের চোখে ধুলো দিয়ে—।’

মাথায় হাত দিয়ে খোকন চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বলে, ‘স্যার একটা কথা বলি, কীটনাশকের খুব উৎকট গন্ধ স্যার। চায়ের কাপে দেবে, আর গিরিধারীবাবুর মতো লোক খেয়ে নেবে, এটা কি ঠিক স্যার?’

‘এটাই তো আমার প্রশ্ন? উৎকট ঝাঁঝাল গন্ধ পেলেন না! আশ্চর্য! গিরিধারীও একজন চাষি ছিলেন, কিছুদিন আগে পর্যন্ত। ওর দল ক্ষমতায় আসতে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। সে এত ভুল করবে, গন্ধ চিনতে পারবে না।’

‘আপনাকে একটা কথা বলব?’

‘একটা কেন যা যা মনে আসবে, সব বলবেন? আপনি বরং ভাবুন। কী কী যুক্তিতে আপনি নিজেকে বাঁচাবেন? আপনাকে কিছুক্ষণ সময় দিলাম। ততক্ষণে চা আসুক। আপনি চা খাবেন? না, না, চায়ে বিষ দিয়ে আপনাকে আমি মারব না। দাঁড়ান চা আনাই।’

আক্কেলের কথা শুনেই লাফিয়ে বেরিয়ে গেল শীতল পাল। চা আনাতে। আক্কেলও বেরিয়ে গেল। থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের মাথায় হাত বোলায় আক্কেল। দূরে যেন পঞ্চচুল্লি। কোন চুল্লিতে রান্না হয়েছে? সব থেকে পরিষ্কার কোনওটা? গিরিধারী সামন্তের স্ত্রী? ইন্দুলেখা!

আক্কেল নিজের মাথায় হাত বুলিয়েই চলে। তার সব সন্দেহই গিরিধারী সামন্তের স্ত্রীর দিকে যাচ্ছে। একবার গিয়েছিল বাড়িতে। শরীর খারাপ জেনে স্রেফ দেখা করেই ফিরে এসেছে। খুব সাদামাটা মহিলা। তাহলে?

চা এল। তিনজনে বসে চা খেল। চা খেয়ে আক্কেল আবার বাইরে যাবে সিগারেট ধরাবে। একটা সিগারেট এগিয়ে দিল খোকনের দিকে। বলল, ‘এখানে বসেই টানুন। আমার সঙ্গে যদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানেন তাহলে কাল আপনাদের জেলা কাগজে ঠিক খবর বেরুবে— খুনির সঙ্গে পুলিশের ধূমপান!’

বারান্দায় আসতেই একজন এগিয়ে এলেন। স্থানীয় কাগজের সাংবাদিক। বলল, ‘স্যার, কিছু কি পেলেন?’

‘হ্যাঁ, এক কাপ আর এই সিগারেট?’

‘না, স্যার খুনির হদিশ?’

‘না।’

‘তাহলে যে শোভন মাইতি, মানে খোকনবাবুকে তুলে নিয়ে এসে অ্যারেস্ট করলেন?’

‘তুলেও নিয়ে আসিনি, অ্যারেস্টও করিনি। সবকিছু প্রাথমিক পর্যায়ে। ভালো খবর থাকলে এই থানার ওসি সায়েব দেবেন। তিনি আপনাদের ডেকে বলে দেবেন।’



আক্কেল ঘরে ঢুকল। তাকাল খোকনের দিকে, বলল, ‘বাইরে রটে গেছে, আপনাকে খুনের সন্দেহে তুলে এনেছি। অ্যারেস্ট করেছি। বাইরে বের হলে কি ঠ্যাঙানি খাবেন? মানে ঠ্যাঙানি খাওয়ার চান্স আছে? তাহলে আপনার পার্টির লোকজনকে ডেকে নিন।’

‘আমার কোনও লোকজন নেই।’

‘ভালো, একা একা মরে যাবেন? যান। আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন, যা আমার সঙ্গে মিলছে। কীটনাশকে খুব গন্ধ থাকে। মানে দুর্গন্ধ। তাহলে আপনাদের গিরিদা চাঁদমুখ করে খেল কী করে? ঠিক ঠিক?’

‘এটাই তো আমি বলতে চাইছিলাম। আর কথাটা আমি বলিনি, কথাটা প্রথম বলেছিল তিয়াসা, প্রথম যে হাসপাতালে গিয়েছিলাম সেখানে নয়। পরের সদর হাসপাতালে। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।’

‘কী বলেছিল?’

‘নাটক।’

‘মানে?’

‘শরীর খারাপের নাটক। সিবিআই ইডির হাতে ধরা পড়লে সব নেতারা যেমন করছে।’

‘তারা কেউ বিষ খাচ্ছেন না।’

‘গিরিদা কিন্তু আগেও করেছে, তিয়াসা বলেছিল ডাক্তারবাবুদের। ওকেই জিজ্ঞেস করবেন। ও ভালো বলতে পারবে। আপনি স্যার তিয়াসার সঙ্গে একবার কথা বলুন—’

‘ঠিক আছে, আপাতত আজকের মতো আপনাকে ছেড়ে দিলাম। গ্রামের বাইরে যাবেন না। যাওয়ার চেষ্টাও করবেন না। আমি এদিক ওদিক থেকে উত্তর খুঁজি। তারপর আবার আপনাকে ডাকব। কেউ পেটাতে এলে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেবেন, বেঘোরে প্রাণ দেবেন না।’

খোকনের চলে যাওয়া পথের দিকে আক্কেল তাকিয়ে থাকল। থানার মেজবাবু শীতল পাল আক্কেলের জুটি হয়েছে। আক্কেল বলল, ‘শীতলবাবু একবার গিরিধারী সামন্তের বাড়ি যেতে হবে।’

‘হ্যাঁ, স্যার, ওর বউটিই মনে হচ্ছে—।’

‘আপনি শিওর। ওঁকে ধরে নিয়ে আসব। আপনি কেস সাজাতে পারবেন। আপনি তো মশাই গ্রামের ছেলে, জানেন না কীটনাশকে কেমন গন্ধ থাকে?’

‘একটা কথা বলব, স্যার। যদি এমন হয়—’

আক্কেল তাকাল, ‘কেমন?’

‘উনি সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর ঘরে গেলেন—। তারপর ওঁর স্ত্রী গিরিবাবুর মুখে কীটনাশক ঢেলে দিল। ওনার মেয়েরও তো এমন কাণ্ডই হয়েছিল— লোকে বলে—’

‘অ্যাঁ!’ লাফিয়ে ওঠে আক্কেল। ‘আগে বলেননি, এমন একটা খবর। আপনি ইমিডিয়েট পুরনো ফাইলপত্র বের করুন।’

‘কী পাবেন স্যার, ফাইলে কিচ্ছু লেখা নেই। ওঁর ক্ষমতা জানেন না, লেখা আছে দুর্ঘটনা।’

আক্কেল স্থির চোখে তাকাল, বলল, ‘সুইসাইডও নয়, একেবারে দুর্ঘটনা। কি ভুল করে খেয়েছে?’

‘হ্যাঁ, কাফ সিরাপ।’

‘না, আপনারা পারেনও বটে—! ডিপার্টমেন্টই না বিক্রি করে দেন।’


ছয়


অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়েছিল খোকন।

তিয়াসা বলল, ‘বড্ড অন্যায় করেছো খোকনদা। তোমরা সবাই চাকরি পাওয়ার লোভে এমন লোভী হয়ে গেলে!’

তিয়াসা স্বপন তপন পূর্বা মিন্টু জগনরা বসে ছিল কালভার্টের পাশে। একটু দূরে জগনের বাবার চায়ের দোকান। সেখানে ছোটখাট ভিড়। এরা ভিড় এড়াতেই চা নিয়ে চলে এসেছিল কালভার্টের পাশে। তখনই তিয়াসার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিন খোকন। বলেছিল, ‘তিয়াসা তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।’ অবাক হয়ে তিয়াসা বলেছিল, ‘বলো।’ চুপ করে ছিল খোকন। তিয়াসা বলল, ‘আমি জানি, তুমি কী বলবে? আমি কেন সবাই জানে। তাই তুমি সবার সামনেই বলতে পারো।’

খোকন শূন্য চোখে সবার দিকে বলল, ‘জানি আমি অন্যায় করেছি…।’

‘অন্যায় তুমি অনেক করেছ, আগেও করেছ, এবার এটা তোমার পাপের শাস্তি। আমি ভাবতে পারছি না, শয়তানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের সরিয়ে ব্যাকডোর দিয়ে চাকরি নিচ্ছিলে— বাহ্‌! এখন ফেঁসে গেছ।’ ‘চাকরিটা আমার খুব দরকার ছিল। এখন টাকাটা ফেরত পেলে ভেবেছি সাইকেলের দোকান দেব।’

জগন বলল, ‘সত্যি খোকনদা— বাগানচাষের সব জমি তুমি বিক্রি করে দিয়েছ, বাবা বলছিল-।’

‘তখন ভাবলে না কেন? আশ্চর্য তো। এখন তুমি আমাকে বলতে এসেছ—।’ তিয়াসা বলল।

খোকন বলল, ‘তোমাকে বলছি— আসলে আমি অসহায় হয়ে বলছি। আমার আর কোনও দিক খোলা নেই, কিচ্ছু করার নেই। টাকা না পেলে সুইসাইড করতে হবে।’

‘সে তোমার ইচ্ছে, মরবে না বাঁচবে—। জানত, এসব ফালতু কথা আমি পাত্তা দিই না।’

‘ফালতু কথা নয়—।’ ‘তাহলে যাও, গিয়ে মালটার কলার চেপে ধরো— টাকা আদায় করো।’

‘তুমি তো তোমার বাবাকে চেনো, আমার কি সে ক্ষমতা আছে, গিরিদার সঙ্গে ঝামেলায় যাব?’

‘তাহলে আমি কেন আমার বাবার সঙ্গে ঝামেলায় যাব? তুমি আমাকে বলছ কেন?’

‘তোমার কথা গিরিদা শোনে, আমি দেখেছি—।’

‘বলো বাবা আমাকে চমকায়— আর আমি চমকে তোমার পাপের টাকা বের করে দেব।’

‘আমার পাপের টাকা নয় তিয়াসা। বিশ্বাস করো পুরোটা জমি বিক্রির টাকা। তুমি কমলামাসি, তোমার মাকে জিজ্ঞেস করবে, ওরা জানে।’

তিয়াসা একটু থমকে যাওয়া গলায় বলল, ‘এরমধ্যে মা, কমলামাসিকে টানছ কেন?’

‘কমলামাসি, তোমার মা—।’ উচ্চারণ করে চুপ করে গেল খোকন।

খোকন সবার সামনে একটু ইতস্তত করল, ঠিকমতো বলতে পারল না। এইজন্যই সবার সামনে তার কথা পাড়া উচিত হয়নি। সে তো চেয়েছিল একান্তে বলতে। কিন্তু তিয়াসা সব সময়ই দলবল নিয়ে থাকে। ওর এত বন্ধু-বান্ধব। দু দিন চেষ্টা করেছে ওর স্কুলে যাওয়ার পথে কথা বলতে, পারেনি। আজ ওকে কালভার্টের পাশে বসে থাকতে দেখে খোকন নিজেকে সামলাতে পারেনি। তিয়াসা জানে না, খোকনের মা আর তাদের বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের মাসি কমলা একই সঙ্গে পুরনো এক নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করত। এই কমলামাসির কাছ থেকেই প্রথমে খবরটা পায় খোকনের মা। সেই বলেছিল, গিরিবাবু নাকি সরকারি চাকরি দিচ্ছে। ওপরমহলে টাকা দিলে চাকরি মিলবে। তোমার ছেলে তো গিরিবাবুর পার্টি করে, ওকে বলো আড়ালে গিরিবাবুকে বলতে।

খোকনকে বলেছিল, ওর মা। খোকন উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর কমলামাসি আবারও খবর আনল। কমলা বিষয়টা ইন্দুলেখাকে বলেছিল। ইন্দুলেখা ঠিক ঠিক জানতেন না। বললেন, কেন? ঠিক আছে জিজ্ঞেস করব। ইন্দুলেখা জিজ্ঞেস করতে, গিরিবাবু নাকি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, কেন তুমি চাকরি করবে? তাহলে পার্টি ফান্ডে টাকা দাও। কত দিতে পারবে বলো? ইন্দুলেখা সে কথাটাই বলেছিলেন কমলাকে। কমলা আবার খবর দিয়েছিল খোকনের মাকে। আসলে খোকনের মা, কমলামাসি, ইন্দুলেখার অনেকদিনের চেনাজানা। তাই, খোকনের মায়ের কথায় ইন্দুলেখা একটু বেশিই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কমলা তাঁকে বলেছিল, খোকনের কথা। খোকনের মা বলেছে জমি বেচে দেবে, যদি খোকনের চাকরি হয়। কিন্তু কত টাকা? ইন্দুলেখা আবার জানতে চেয়েছিলেন গিরিধারীর কাছে। গিরিধারী চুপ করে ছিল, বলেছিল, ‘কে?’

‘কমলামাসির একজন চেনা।’

‘অত টাকা কি তারা দিতে পারবে লাখ লাখ টাকার ব্যাপার।’

‘কত?’

‘অন্তত কুড়ি লাখ। নিজেদের চেনাশোনা ছেলে হলে পার্টিতে বলে কয়ে ষোলো পর্যন্ত করা যায়।’

সে-কথাই ইন্দুলেখা— কমলা হয়ে চলে গিয়েছিল খোকনের মায়ের কাছে। খোকনের মা স্থির করে ফেলল জমি বিক্রি করবে। সে কমলাকে বলল, আমি টাকা দেব। চাকরি করলে অমন জমি অনেক কেনা যাবে। একদিন সে যাবে সরাসরি গিরিধারীর সঙ্গে কথা বলতে, কমলা থাকবে, ইন্দুলেখা থাকবে। বিএ পাশ তার ছেলে। একটা চাকরি তাকে করে দিতেই হবে। সে সাধ্যমত টাকা দেবে।

খোকন বলল, ‘তুমি চুপ করো। গিরিবাবু আমার পার্টির নেতা। আমি সুযোগমত তার সঙ্গে কথা বলব।’

দিন যায়, উতলা হয়ে ওঠে খোকনের মা। কমলা খবর দেয়— কথা বলে নে। কথা বলে ঠিক করলে তবে তো জমি বিক্রি। টাকা তোলা। অবশ্য তার বাগানচাষের ফলন্ত জমি। পাশে গোবর্ধন, জনার্দন দুই ভাই-ই হাঁ করে আছে। খোকনের মা কথা একবার তুলতেই, তারা টাকা নিয়ে বায়না করতে দৌড়ে এল। খোকনের মা বলল, একটু সবুর করো।

মায়ের তাড়া খেয়ে বাধ্য হয়েই একদিন সাতসকালে খোকন হাজির হয়েছিল গিরিধারীর বাড়িতে। গিরিধারী ঘুমাচ্ছেন। তাঁর ঘুমের বড় ব্যারাম। সারারাত জেগে কাটান, আসে ভোররাতে। এবার যদি সকালবেলা ঘুমিয়ে কাটান তাহলে কাজকর্ম শিকেয় উঠবে। সেদিন সকালে গিরিধারীর বাড়িতে হাজির হতে ইন্দুলেখা বলেছিলেন, সাড়ে আটটার আগে উঠবে না। তুমি বরং বসো।

কমলামাসি বলল, বসো। চা আনছি। আঁতকে উঠেছিল খোকন। না না, আমি চা খেয়ে এসেছি। খাব না।

সাতটা থেকে সাড়ে আটটা ঠায় বসেছিল খোকন।

তিয়াসা আগেই চিনত খোকনকে। ছেলেটা বছর তিনেক আগে খুব ঘন ঘন আসত। বনমালি নস্কর খুনে নাম জড়িয়েছিল, এদের পাঁচ ছ জনের। তারাই রাতের বেলা এসে এসে মিটিং করত। তখন কমলামাসি চা করে একদিন দিতে যাচ্ছিল এদের দলবলকে। তিয়াসা চিৎকার করেছিল, এইসব খুনে ক্রিমিনালগুলো বাড়িতে এসে চা খাবে? এটা কি চায়ের দোকান পেয়েছে? খোকন সেদিনই চিনেছিল তিয়াসাকে ক্লাস সেভেন এইটে পড়া একটা মেয়ের কী দাপট! গিরিধারী সামন্তের মতো লোক ভড়কে গিয়েছিল। চিৎকার করে থামানোর চেষ্টা করেছিল, কে, কে বলেছে, এরা ক্রিমিনাল? তোর কি, তোর পয়সায় চা খাচ্ছে! কিন্তু তিয়াসাকে থামানো গেল না, সে হঠাৎ উড়ে এসে কমলামাসির হাতের থালায় রাখা চায়ের কাপগুলো এক ধাক্কায় উলটে দিয়ে গেল। গিরিবাবু জুতো খুলে দমদমাদ্দম লাগিয়ে দিল মেয়েকে। সেদিন পালিয়ে বেঁচেছিল খোকনরা। সেই থেকে ওরা চেনে গিরিবাবুর মেয়েকে। এলাকার লোকও চেনে। তারপরেও অনেকবার তিয়াসাকে দেখেছে। টুকটাক কথাও হয়েছে। পাক্কা হারামি মেয়ে।

সে হারামি মেয়ের সামনে এসে আজ ভিখিরি মতো দাঁড়িয়েছিল খোকন।

তিয়াসা বলল, ‘আমি কী করব, খোকনদা? তোমরা তো শুনছি সাত আটজন।’

খোকন কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই জগন বলল, ‘আরে এরা সাত আটজন। হাঁড়ি থেকে কত বেরুবে তুই জানিস। সব সরকারি চাকরি করবে বলে কাউকে জানাইনি। চুপচুপি লটারি লাগিয়ে দিয়েছে।’

মিন্টু বলল, ‘শুনেছি, কজন পেয়েওছে— হাসপাতালে। তারা নাকি কাজে লেগে গেছে।’

খোকন বলল, ‘আমার কোনও চাকরি চাই না, টাকা ফেরত চাই।’

‘যাও পার্টিকে গিয়ে বল।’ তিয়াসা হ্যাঁচকা গলায় জবাব দিল।

‘গিরিদাই আমাদের কাছে পার্টি, পার্টির নেতা। এমএলএ, এমপিরা ভোটের সময় আসে। আর উৎসব পার্বণে। তারা আমাদের কথা শুনবেই না।’

‘বাড়িতেই ঢুকতে দেবে না। এখন যে এই কেসে জড়াবে সেই ফাঁসবে।’ একজন বলল।

‘গিরিধারীও যাবে।’ তিয়াসা মুখ বেঁকিয়ে বলল। সবাই তিয়াসার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তিয়াসা বলল, ‘আমি বাবাকে বলব। বললেই জুতো দিয়ে মারবে— লাঠি ছুঁড়বে, তবু বলব। দেশের কাজ। বলব খোকনদা। তুমি যাও।’

খোকন যেমন মাথা নীচু করে এসেছিল, তেমন চলে গেল। তিয়াসার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল— তার মা আর কমলামাসির কথা। খোকনদা হঠাৎ কেন ওদের দুজনের নাম বলল। পরে জেনেছিল, কীভাবে সবাই জড়িয়েছে, পাকে পাকে।


সাত


শীতল পালের বাইকেই চড়ে বসল আক্কেল। গিরিধারী সামন্তের বাড়ির দিকে গাড়ি চলছে। আজ সকালে খোকন থানায় আসার কিছুক্ষণ পরেই ফোন করেছিল শাকম্ভরী। শুনলাম, ‘আপনারা নাকি শোভনবাবু, মানে খোকনকে অ্যারেস্ট করে তুলে এনেছেন। ও কি কোনওভাবে জড়িত, আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না মিস্টার বসু। আমি যেটুকু জানি, উনি অসহায় হয়ে হয়তো কিছু উলটোপালটা মন্তব্য করেছেন, কিন্তু অপরাধ করার মতো মানুষ নন।’

শাকম্ভরী থামলে, আক্কেল বলল, ‘আপনার কথা শেষ হয়েছে মিসেস ভট্টাচার্য। এবার আমি বলি, নম্বর ওয়ান। শোভনবাবুকে অ্যারেস্ট করা হয়নি, তুলেও নিয়ে আসা হয়নি। এত বড় থানায় সবেধন নীলমণি একটা গাড়ি— তাতে বর কিম্বা বরযাত্রী কাউকেই আনা যাবে না। ওনাকে ডাকা হয়েছে। উনি এসেছেন। কথা হচ্ছে। দেখা যাক সাপ ব্যাঙ কী বের হয় গর্ত থেকে। নম্বর টু, শোভনবাবু কতটা ভালোমানুষ, আমি জানি না। তবে এ থানায় ওঁর নামে একটা ক্রিমিনাল রেকর্ড হয়েছিল। কেস এখনও চলছে। আর সেটা অল্পস্বল্প কিছু নয়, খুনের কেস। বনমালি নস্কর হত্যাকাণ্ড। সেই কেসে খোকন জড়িত ছিল, এটা পাক্কা। কিন্তু পার্টির হয়ে কিছু করলে সবাই সতী হয়, উনিও তাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নইলে জেলে থাকতেন। ’

শাকম্ভরী ভট্টাচার্য বলল, ‘আমি এত কিছু জানি না।’

‘আপনি কী করে জানবেন— আপনি তো আমার মতো পুলিশ নন। আর কিছু বলবেন—?’

‘আর একটা কথা বলার ছিল—’

‘বলুন।’

‘আপনি নিশ্চয়ই তিয়াসার সঙ্গে কথা বলবেন। প্লিজ, ওকে থানায় ডাকবেন না। প্রয়োজনে আমার বাড়িতে ওকে আমি ডেকে নিয়ে আসব। তিয়াসা খুব উলটো পালটা কথা বলে। ওর কথায় যে কেউ ভুল মানে করবে। তাই ওকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, যদি আমি থাকি কোনও অসুবিধে হবে?’

‘খুব অসুবিধে হবে। আমি তো চাই সবাই উলটোপালটা কথা বলুক। তবে হ্যাঁ, থানায় ওকে ডাকব না। আপনার বাড়িতেও নয়। ওদের বাড়িতেই আমরা যাব।’

গিরিধারী সামন্তের বাড়ির সামনে এসে বাইক থামল। শীতল পাল বলল, ‘স্যার ডাকি।’

ডাকতে হল না। ওদের বাইক থামতেই একটা লোক এগিয়ে এল। শীতল পাল পুলিশের ড্রেসে। থানাতেই আক্কেলের মনে হয়েছিল, শীতল পালকে বলবে সিভিল ড্রেসে যেতে। পরে মনে হল, না, পুলিশের ড্রেসে কাউকে দেখলে ওদের মনে একটা ধাক্কা দেওয়া যাবে। আসলে আক্কেলের মন বলছে, সব রহস্য এই বাড়ির ভেতরই আছে।

‘আপনারা নিশ্চয়ই থানা থেকে আসছেন? কিন্তু বউদির তো শরীর খারাপ কালই আপনাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একটু সুস্থ হলেই আপনাদের জানান হবে।’

আক্কেল বলল, ‘তাহলে আর কী! এক গ্লাস জল দিন। খেয়ে চলে যাই। তিয়াসা আছে?’

‘হ্যাঁ, দিদি আছে।’

‘আপনার দিদির সঙ্গে একটু আলাপ করে যাই।’ কথা বলতে বলতেই আক্কেল বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। ওর পিছনে শীতল পালের বুট থেকে গট গট আওয়াজ উঠছে নিঃস্তব্ধ সামন্তবাড়ির শান বাঁধানো মেঝেয়।

বসতে হল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিয়াসা হাজির।

আক্কেল জানে ওর ক্লাস টেন। মানে পনেরো ষোলো। তবে বয়েসের তুলনায় মেয়েটাকে বেশ শক্তপোক্ত লাগল। বেশ বড়। ঘরে ঢুকেই বলল, ‘শুনলাম, আপনি নাকি লালবাজার থেকে এসেছেন?’

‘হ্যাঁ, লালবাজার হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট।’

‘স্রেফ পুলিশ, নাকি গোয়েন্দা, ডিটেকটিভ।’

আক্কেল হেসে ফেলল, ‘ওই যে বললাম হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট।’

‘সেটা আপনি বলেছেন বটে, কিন্তু আমি বুঝিনি।’

‘হোমিসাইড। মানে একজন মানুষ যখন অন্য একজন মানুষকে হত্যা করে। মানে নরহত্যা। সেই নরহত্যা বিষয়ক যে দপ্তর আছে লালবাজারে, আমি সেই দপ্তর থেকে এসেছি।’

‘আচ্ছা, এবার বুঝলাম। এসেছেন, কারণ আপনারা মনে করেছেন গিরিধারী সামন্তকে খুন করা হয়েছে। তাই, সেই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতেই এই থানায় এসেছেন। এখন এই বাড়িতে। ভালো করেছেন, এই থানা ভোঁ-বা এরা কিস্যু পারবে না, খুনি পালিয়ে যাবে। নয়, ওরা টাকা খেয়ে ছেড়ে দেবে। বলুন— আমি খুনিকে চিনি কি না?’

‘আপনার তো ক্লাস টেন। এ বছর মাধ্যমিক—’ কথা শেষ করে আক্কেল একটু মাথা নাড়াল। একটু খারাপ লাগা অভিব্যক্তি।

‘হ্যাঁ, ক্লাস টেন। ম্যাম বলছে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে। দেখি—।’

‘কেন তৈরি হননি?’

‘আমার তো এটা সেকেন্ড বছর। আগের বছর টেস্ট দিইনি। এবছর না দিলে ক্লাস টেনে থেকে যাব। কিন্তু ম্যাম আদা-জল খেয়েই লেগেছে, মনে হচ্ছে টেস্টে বসতেই হবে।’

‘আপনার ম্যাম বলতে—?’

‘শাকম্ভরী ভট্টাচার্য। অনেকে নতুন ম্যামও বলে।’

‘ও হো, হ্যাঁ, উনিও তো ওই মিটিঙে ছিলেন।’

‘হ্যাঁ, আপনারা তো ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ওপেনিং করেছেন। ভালো—। শুরু করার কথা ছিল আমার মাকে দিয়ে। কিন্তু মা যেই শুনেছে, চা খেয়েই তার স্বামী মারা গেছে, চায়ের বিষ ছিল, উনি নিজেকে খুনি ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। আপনারাও তেমন ভাবছেন শুনেছি। গিরিধারী সামন্তের হত্যাকারী তাঁর স্ত্রী ইন্দুলেখা সামন্ত, তাই তো?’

‘না, তা কেন? সবকিছুই প্রমাণসাপেক্ষে। খুনি যে কেউ হতে পারে? আসলে কারণটা খুঁজছি। বাঁশি পেলেই শ্যাম পেয়ে যাব।’

‘আপনারা সিওর যে আমার বাবা খুন হয়েছে?’

‘ফরেনসিক মেডিসিন এক্সপার্টরা এমনটাই মনে করেছে। তারা সিওর হওয়ার জন্য ফরেনসিক ল্যাবে ভিসেরা পাঠিয়েছিল। সেখান থেকেও রিপোর্টে তাই এসেছে— কীটনাশক। অরগ্যানো ফসফরাস।’

‘তাহলে তো আপনারা সিওর। এবার আপনাদের খুনি বের করতে হবে। খুব কঠিন কাজ—।’

‘তা একটু হবে। অঙ্কের মতো প্রথম দিকে কঠিন মনে হয়, তারপর একবার জট খুললে জলের মতো সোজা।’

‘বাহ্‌।’ একটু নড়ে বসে তিয়াসা। ‘চা খাবেন?’

চায়ের কথায় প্রায় লাফিয়ে উঠল শীতল পাল, বলল, ‘না, না, চা খাব না।’

আক্কেল বলল, ‘আমি খাব।’

কিন্তু শীতল পালকে দেখে তিয়াসা হেসে উঠল, বলল, ‘আরে, গিরিধারী কেসের দুজন এখানে আছে বটে। কিন্তু আপনাকে আমরা বিষ দেব না।’

শীতল পালের চোয়াল শক্ত। আক্কেলের দিকে তাকাল। ততক্ষণে তিয়াসা গলা তুলে চিৎকার করল, ‘মাসি, ও মাসি, সবাই চা খাবে।’

আক্কেল বলল, ‘চায়ের অর্ডারটা তোমার মাসি আগেই পেয়ে গেছেন, উনি দরজার বাইরেই ছিলেন। আর হ্যাঁ, এ বাড়িতে বর্তমানে খুনের সন্দেহভাজন দুজন নয়, তিনজন আছেন।’

‘তিনজন? তৃতীয়জন কে?’অবাক হওয়া গলায় তিয়াসা জানতে চাইল।

‘তিনজন— তুমি, তোমার মা, আর কমলামাসি।’

‘কমলামাসি!’ হি হি হি হি করে হেসে উঠল তিয়াসা। ‘দারুণ খবর, তাহলে তো কমলামাসির প্রোমোশন হয়ে গেল।’

আক্কেলও হাসল, বলল, ‘সরকারি কাজ এমনই— মুড়ি মুড়কি খই বাতাসা— সব সমান। তাই তোমার পরে মাসির সঙ্গে এখানে বসেই একটু কথা সেরে নেব। প্রথমে তোমার পড়াশোনার কথাই শোনা যাক।’

‘পড়াশোনার কথা ওই যে বললাম, ম্যাম বলেছে, মাধ্যমিকটা এবছর দিতে। দেব ঠিক করেছি।’

‘তোমার কি দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না!’

‘তেমন নয়, আমি আসলে এইটে দুবছর থেকেছি, নাইনে দুবছর থেকেছি, টেনেও দুবছর হল—। আরও একবার থাকার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ম্যাম—।’

দু’বছর থাকার কথায় শীতল পাল একটু কাশল।

আক্কেল বলল, ‘কেন? পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না? আমারও অবশ্য লাগত না। আমার বাবা চেয়েছিল আমি আইএএস হবো। হলাম পুলিশ—’

‘আমার কিন্তু পড়াশোনা করতে খুব ভালো লাগে। এই যে এইট নাইন টেন শুনলেন— এই বছরগুলোতে আমি অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিইনি। কারণ— এমনি।’

‘এমনি!’

‘সম্পূর্ণটা এমনি না। তবু এমনিই—।’

চা এল। সামনে কমলা। তিয়াসা বলল, ‘মাসি আমার পরে এই হটসিটে তোমাকে বসতে হবে।’

‘অ্যাঁ!’

আক্কেল বলল, ‘সেদিনের ওই ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।’

‘বলুন।’

‘ওর সঙ্গে কথা বলে নিই। তারপর— আমি ডেকে নেব।’

‘বউদি বলল— কাল ঠিক কথা বলবে।’ কথাটা বলে কমলা চলে গেল।

তিয়াসা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে খেতে শুরু করে দিল। আক্কেল কাপ হাতে নিল। আর একটা চায়ের কাপ আছে। তিয়াসা বলল, ‘স্যার, আপনার জন্যও দিয়েছে। আপনি নিয়ে নিন। আপনার কাপে আমি একটা চুমুক মেরে দেখিয়ে দেব?’

আক্কেল ইশারা করল শীতল পালকে। সেও চায়ের কাপ তুলে নিল।

‘পরীক্ষা দিলে না কেন? ঝামেলা করা সঙ্গে?’

‘বাবার সঙ্গে—।’

‘কেন?’

‘আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি আমার দিদি মারা যায়। দিদি আমার থেকে পাঁচ বছরের বড় ছিল। কলেজে পড়ত। দিদি সুইসাইড করেছিল, সবাই বলে—।’

‘সবাই বলে মানে?’

‘পুলিশও বলেছে। আমি মনে করি, দিদিকে মারা হয়েছে। মেরেছে আমার বাবা। নাহলে দিদি পালিয়ে যেত সাবিরদা সঙ্গে। বাবা খুব পিটিয়েও দিদিকে আটকাতে পারছিল না। তারপর একদিন সাবিরদাকেও খুব মারল। তারপরই ওরা ঠিক করেছিল পালিয়ে যাবে। তার পরের দিন পালাত। ব্যাগ ট্যাগ সব গোছান। ব্যাগের ভেতর সব সার্টিফিকেটও ছিল। ভোটার কার্ড, আধার কার্ডও ছিল। কিন্তু হঠাৎ গেল না, সকালে মরে গেল ফলিডল খেয়ে। ঘরে পড়ে ছিল। ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যেত। ঠিক সময়ে বাবা নিয়ে গেল না। হাসপাতালে গেলে সব ফাঁস হয়ে যেত।’

‘বিষ কি নিজে খেয়েছিল? পুলিশের কাছে লেখা আছে দুর্ঘটনা। কাফ সিরাপ ভুল করে—’

‘বাবা যা বলেছে, পুলিশ তাই লিখেছে। আমার মনে হয়, জোর করে দিদির গলায় ঢেলে দেওয়া হয়েছিল।’ চুপ করে থাকল তিয়াসা। বলল, ‘বাবা ওকে বলেছিল— আমার আর একটা মেয়ে আছে। তুই মরলে আমার কিছু আসবে যাবে না। আর একটা মেয়ে মানে আমি— আমি মেয়ে নই বাবার বাঁশ! বাবা এখন বুঝেছে।’

‘এভাবে কেউ নিজের ক্ষতি করে?’ আক্কেল মাথার পিছনে দু’হাত শরীর এলিয়ে বসে।

‘গিরিধারীর সঙ্গে লড়াই করা সহজ না। আর একটা মেয়ে বলেছিল, তাই আমিই আমার মতো করে টাইট মারতাম। কেউ কলার ধরে পেটালে— বাজি ফাটাতাম। জানি এখন হবে না। কবে দল হারবে। গদি উলটাবে। তখন যদি অন্য দলে গিরিধারী ডিগবাজি না খায় তবে মার খাবে।’

শীতল পাল বলল, ‘কখনো খুন করতে ইচ্ছে করেছিল নাকি?’

‘খুন! একবার নাকি অনেকবার। সাহসও ছিল, কিন্তু ঠিক ব্যাটে বলে হচ্ছিল না। হলে মেরে দিতাম।’

তিয়াসার কথায় শীতল পাল চমকে উঠল, আরও কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল। আক্কেল হাত তুলে থামাল। বলল, ‘সাবির এখন কোথায়?’

‘জানি না। সাবিরদা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। কলকাতার এনআরএস মেডিকেল কলেজে পড়ত। সেখানে থেকে বাবার ভয়ে হায়দরাবাদ চলে গেছে। বাবা ওকে নাকি মেরে দিত। কলকাতায় লোক পাঠিয়েছিল— সব আমার শোনা কথা। কিন্তু দিদিরটা জানি— উঃ কী অসহ্য ছিল সেই রাত!’

তিয়াসা চুপ করে যায়। চুপ করেই থাকে। একটু পড়ে আক্কেল বলল, ‘কী হল?’

‘এটা আপনাদের ওদিনকার ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। বলুন, আমার কাছে কী জানতে চান?’

আক্কেল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভীষণ কঠিন তিয়াসার মুখমণ্ডল। বলল, ‘কী হয়েছিল সেদিন—?’

‘আমি, মা, ম্যাম আর খোকনদা ছিলাম। ঘুম থেকে ডেকে ডেকে বাবাকে তোলা হল। আরও একটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল নাকি মাঝরাতে। মিথ্যে কথাও হতে পারে। বাবা খুব মিথ্যে বলত। খোকনদা বারো লাখ টাকা দাবি করছিল। বাবা টাকা দেবে না। হঠাৎ কী একটা কথায় আমি কিছু বলি। বাবা আমাকে মেয়েছেলে বলে গালাগালি করে। আমিও কিছু বলি। কী বলি মনে নেই। ইনফ্যাক্ট মেয়েছেলেরা কথা বলবে না ছাড়া আর কিছু মনে নেই। আমি রেগে উঠে চলে যাই। নাকি ম্যামই আমাকে চলে যেতে বলেন। ও ম্যাম চা করতে বলেন। আমি কমলামাসিকে চা করতে বলে নিজের ঘরে চলে যাই। একটু পরে শুনি বাবার শরীর খারাপ করছে। বাবাকে ভেতর ঘরে নিয়ে যায়। তখনও আমি আসিনি। আমার মনে হয়, বাবা নাটক করছে। ড্রামাবাজি করে সবাইকে চুপ করিয়ে দেবে। দিদির সময়ও এমন করেছিল। দু পাঁচটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল। যেন মরতে চাইছে। তারপর সেটা সবাইকে বলেও দিল। পরে জেনেছিলাম, অত অল্প ঘুমের ওষুধে কেউ মরে না। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে মা পেট ওয়াশ করিয়েছিল। এবার কী হয়েছিল জানি না। যখন সদর হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে, তখন মায়ের ফোন পেয়ে আমি বাবলু কোলের বাইকে করে হাসপাতালে যাই। আমি বাবার জন্য যাইনি, আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম মায়ের জন্য। আর একটা কথা, আমার বাবা যেভাবেই মরুক, আমার কোনও দুঃখ নেই। আর, হ্যাঁ, যদি আমি মারতে পারতাম, আমি সবচেয়ে খুশি হতাম।’

আক্কেল বলল, ‘তারমানে তুমি খুন করোনি। গিরিধারী সামন্তের চা খাবার সময় তুমি ছিলে না। তুমি বলছ তোমার নাম বাদ দিতে। তাহলে রইল বাকি দুই।’

‘না, না, আমার নাম আমি বাদ দিতে বলিনি। ধরে রাখুন। শুধু আপনাকে অঙ্ক মেলাতে হবে, কীভাবে? সাক্ষী কে?’

আক্কেল হাসল, ‘কীভাবে জানলেই সাক্ষী জুটে যাবে।’

‘বেস্ট অব লাক।’

শীতল পাল বলল, ‘বেস্ট অব লাক! তোমাকে যেন না রান্নাঘরে আবিষ্কার হয়।’

‘সিসি ক্যামেরা এ বাড়িতে নেই। খুব মুশকিল! তবে একটা কথা বলতে পারি, গিরিধারী হত্যা রহস্য শেষ হলেই কেউ না কেউ গল্প লিখবেন। তা স্যার আপনি লিখবেন নাকি?’

‘আমি ওসব লেখা-টেখাই নেই।’

‘নেই! তাহলে শিরোনামটা আমি দিয়ে দিতাম—গিরিধারী জাগে নারী!’

‘নারী!’ আক্কেল অস্ফুটে বলল।

‘হ্যাঁ, নারী। যদি সত্যি সত্যি খুন হয়। কেন সত্যি সত্যি বলছি জানেন, আগের বার আমার দিদিকে খুন করা হয়েছিল, কিন্তু পুলিশ কেস সাজাল সুইসাইডও নয়, অ্যাক্সিডেন্ট। এবার হয়তো সুইসাইড, বা দুর্ঘটনা। পুলিশ বলল— খুন।’

‘ফরেনসিক ল্যাব নিশ্চিত খুন।’

‘ওরা যেমন নিশ্চিত, আমিও তেমন নিশ্চিত, এটা স্লিপিং পিল পয়েজন। যা হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা লিখেছিলেন। এখন খুন বলা হচ্ছে, সেটা কোনও পলিটিক্যাল গেম। এই গেমটা খেলার জন্য আপনাকে পাঠানো হয়েছে। এই থানার মাথামোটাগুলো পারবে না। তাই কলকাতা থেকে আপনি এসেছেন।’

‘অ্যাই মেয়ে ভালোভাবে কথা বলো। তোমার বাবা আর বেঁচে নেই। যে তোমাদের হয়ে কেউ চমকাবে।’ শীতল পাল চাপ গলায় বলল।

আক্কেল বলল, ‘শীতলবাবু আপনি কথা বলবেন না, প্লিজ। হ্যাঁ, যদি খুন নিশ্চিত হয়— ধরে নাও খুন, তাহলে?’

‘তাহলে গিরিধারী জাগে নারী! ওই মিটিঙে খোকনদা একটা ভেঙে পড়া মানুষ ছিল। মানুষ ছিল না, কুত্তা ছিল। একবার খ্যা খ্যা করছে, একবার কেঁউ কেঁউ করে কাঁদছে। যে এমন করে সে আর যাই করুক, খুন করতে পারে না। খোকনদা বসেছিল বাবার দক্ষিণ কোণের মুখোমুখি, সেখান থেকে বাবার চায়ের কাপের দূরত্ব অন্তত তিনহাত। বাবার পাশে ছিল মা আর আমি। ওদিকে ম্যাম। আর খোকনদা রান্নাঘরের দিকেও যাবে না। যাইওনি। তাহলে খোকনদা ছাড়া, বাদবাকি সবাই ছিল— মেয়েছেলে। গিরিধারী জাগে নারী!’

আক্কেল বলল, ‘হ্যাঁ আমি কাল এসে কে কোথায় বসেছিল দেখে গেছি।’

‘কে দেখিয়েছে মা? তারপরেই মায়ের শরীর খারাপ হয়। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি।’

‘ঠিক আছে, নো প্রবলেম। কাল তো বলবেন।’

‘তাহলে কমলামাসিকে ডাকি।’

‘আজ থাক, আমরা কাল আসব। তোমার ম্যাম বলেছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় উনি থাকবেন। নাহলে তুমি অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলবে।’

‘হ্যাঁ, ম্যাম আমাকে খুব ভালোবাসেন।’

‘ম্যামকে দেখা হলে আমি বলে দেব, তুমি যথেষ্ট সেয়ানা, একটাও উল্টোপাল্টা কথা বলোনি। বরং কায়দা করে নিজেকে বেশ বাঁচিয়ে রেখেছ।’


আট


তিয়াসাই ধরেছিল শয়তানটাকে। ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসেছিল শাকম্ভরীর কাছে। শাকম্ভরী অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘কে এ? কী করেছে?’

‘এ কে, কী করেছে? একেই প্রশ্ন করুন ম্যাম উত্তর পেয়ে যাবেন। আর না বললে, আমি ওষুধ দেব।’

শাকম্ভরী এই স্কুলে এসেছে মাস খানেক। ভালো করে সব কিছু চিনে উঠতে পারেনি। তবে বুঝেছে, আর পাঁচটা জায়গার মতোই এটাও একটা অন্ধকূপ। সবাই কোন এক প্রাচীন যুগে পড়ে আছে। যেন আধুনিকতার কোনও হাওয়া এখানে এসে পৌঁছায়নি। শুধু জিন্স আর মোবাইল ছাড়া। সব সময় পরচর্চা পরনিন্দা। নানা খবর পায় স্কুলের তপতীর কাছে। তবে হেডস্যারটি ভালো। মানুষটা সবদিক সামলে চলতে চান। শাকম্ভরী দিদিমণিদের লেডিজ টয়লেট নিয়ে বলার পরই, একটা ছুটি দেখে তিনি সারিয়ে দিলেন। শাকম্ভরী অন্য দিদিমণিদের বলেছিল, ‘তোমরা আগে বলোনি কেন?’ সকলেই কেমন যেন নৈর্ব্যক্তিক। একজন উত্তর দিল, ‘তুমি তো বলেছ। হয়ে গেছে।’

এদের কারও মুখ থেকে এই একটা মাসে তিয়াসাকে নিয়ে খারাপ কথা ছাড়া ভালো কথা শোনেনি। ওর কথা উঠলেই সবাই কেমন একটা নীরবতা অবলম্বন করে।

তিয়াসা ফেল করে না, ইচ্ছে করে এইটে একবার, নাইনে একবার, এবং ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষা দেয়নি শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল শাকম্ভরী। এ কেমন রোগ! কোনও মানসিক সমস্যা আছে। ভয় পাচ্ছে পরীক্ষা দিতে? তাহলে পরের বছর পরীক্ষায় বসছে কেন? সবাই বলল, পড়াশোনায় খারাপ নয়। খুব বুদ্ধিমতী। কিন্তু খুব শয়তান।

একমাসে এটুকুই জেনেছিল শাকম্ভরী। খুব বেশি জানার ইচ্ছেও ছিল না। পালটা শাকম্ভরীও কাউকে বলেনি, তিয়াসা সেদিন ওকে ঠিক কীভাবে দেখছিল। সেটা সত্যিই ও দেখছিল, না তার নিজের মনে হয়েছিল, সেটাও বুঝতে হবে। তার কোনও ভুল নয়তো। আপাতত শাকম্ভরী এটায় মাথা গলাবে না। এসব ভাবলে তার মাথার ভেতর দপদপ করে। কিন্তু আজ হইচইয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে শাকম্ভরী দেখল, একটা লোকের জামার কলারটা ধরে তিয়াসা দাঁড়িয়ে আছে।

শাকম্ভরী বলল, ‘কী হয়েছে?’

‘কী হয়েছে? কী করছিল? একে জিজ্ঞাসা করুন, ম্যাম।’

‘এঁকে আমি চিনি না, আমি জিজ্ঞাসা করব না। তুমি বলো কী হয়েছে?’

‘আপনার ঘরে উঁকি দিচ্ছিল।’ তিয়াসার জবাব মুখের ভেতরই যেন ছিল, ছুঁড়ে দিল।

‘উঁকি দিচ্ছিল— কেন চুরি করবে? কী আছে আমার ঘরে? সোনাদানা টাকাপয়সা দামি তেমন কিছু তো নেই। তবে?’

‘ওই তো, আপনি এখানকার পাবলিকদের চেনেন না! এরা খুব নোংরা। টাকা পয়সার জন্য এ উঁকি দিচ্ছিল না। আপনার ভাই এসেছে আজ সকালে। উনি গিয়ে স্কুল টুল দেখেছেন। সেই তখন থেকে আপনার ভাইয়ের পিছনে লোক লাগানো হয়েছে। আর সেই লোক ইনি। আপনার এটা সত্যি ভাই, না অন্য কেউ সেটা ইনি ইন্সপেকশন করতে এসেছেন।

এদের কথার মাঝেই আদিত্য এসে দাঁড়িয়েছে শাকম্ভরীর পাশে।

শাকম্ভরী থরথর করে কাঁপছিল। ‘কী বলছ তুমি?’

‘আমি ঠিকই বলছি, ম্যাম। দেখবেন, একে দুটো থাবড়া মেরে আমি সত্যি কথা বের করছি। আবার দিচ্ছি ওষুধ।’ কথা বলতে বলতেই তিয়াসা লোকটার গালে পর পর খান তিনেক চড় কষিয়ে দিল। লোকটা অদ্ভুত গলায় বলল, ‘আমি তো সব তোমাকে বলেছি। কে পাঠিয়েছে সেটাও বলেছি। আবার মারছ কেন?’

থরথর করে কাঁপছে শাকম্ভরী। ওর পাশে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আদিত্য।

তিয়াসা বলল, ‘ম্যাম, জিজ্ঞাসা করুন কে পাঠিয়েছে? নামটা শুনে রাখুন কাজে লাগবে?’

কে পাঠিয়েছে? কী তার নাম শুনে শাকম্ভরীর কী হবে। না, না, নাম শুনতে চায় না। লোকটার দিকে তাকাতে তার গা ঘিনঘিন করছিল, মুখ থেকে নাম শোনা তো দূরের কথা।

‘কী ম্যামকে বল, কে পাঠিয়েছে, কোন মহাপুরুষ?’ তিয়াসা আবার মারার জন্য হাত তুলল, কিন্তু মারল না।

ততক্ষণে এ-বাড়ির মালিক, আরও দু’চারজন দাঁড়িয়ে গেছে। বাড়িওয়ালার বিব্রত মুখ। কিন্তু বাদবাকি সবার চোখেমুখে বেশ একটা রগড় দেখার ভাব।

তিয়াসার তোলা হাতের দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, ‘নাম তো আগেই বলেছি—।’

‘ম্যামকে বল, ম্যাম জেনে রাখুক।’

লোকটা কথা বলল, না। মাথা নামিয়ে নিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘তোমাকে বলেছি তো বলেছি, আর কাউকে বলতে পারব না। আমাকে এবার মারলে মারো। পুলিসে দাও। জেলে দাও। আমি আর কিছু বলব না।’

তিয়াসা বলল, ‘তাকে এত ভয়? সে তোদের নেতা। মেরে দেবে, পুঁতে দেবে, তাই তো— তার নাম বলবি না। দেখ আমি বলছি। শুনুন ম্যাম, একে পাঠিয়েছে আপনাদের স্কুলের সভাপতি শ্রী গিরিধারী সামন্ত।’

শাকম্ভরী অবাক হয়ে তাকিয়েছিল তিয়াসার দিকে।

তিয়াসা বলল, ‘একে কী করব ম্যাম, কান ধরে ওঠ-বস করাব, লাঠি পেটা করব? পুলিশে ফোন করুন ম্যাম, একে একদিন লকআপের ভাত খাওয়ান, নইলে এরা শায়েস্তা হবে না।’

শাকম্ভরী শান্ত গলায়, ‘কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি একে ছেড়ে দাও।’

‘ছেড়ে দেব? আমি জানতাম, তক্কে তক্কে ছিলাম। আমি একে হাতেনাতে ধরেছি। একে আমি ফেলে মারব। আপনি বললেই একে ছাড়ব না।’

‘না, তুমি ছেড়ে দেবে। আমি বলছি, তুমি একে ছেড়ে দাও।’

শাকম্ভরীর কথা শেষ হওয়ার আগে তিয়াসা লোকটাকে ছেড়ে দিল, আর মুহূর্তের মধ্যে ক্যাত করে একটা লাথি মারল লোকটার পেটের কাছে। লোকটা ছিটকে পড়ল। তিয়াসা বলল, ‘যা, চলে যা। লাথি খেয়েছিস, এবার চলে যা। একটু দেরী করলেই মুখে লাথি মারব।’ লোকটা পড়িমড়ি করে ছুটতে শুরু করল।

সেই শুরু।

পরেরদিন তিয়াসা স্কুলে এল কপালের কাছে ফোলা, মুখ-কানের কাছে কালশিটে দাগ নিয়ে। ক্লাসে দেখেছিল ওকে শাকম্ভরী। কী করে হল ওকে প্রশ্ন করেনি। কিন্তু অন্য ক্লাসে যাওয়ার সময় তিয়াসাকে দেখেই ডাকল শাকম্ভরী। বলল, ‘মুখে কপালে কী হয়েছে এসব? পড়ে গেছো?’

‘না, আমার বাবা, গিরিধারী সামন্ত মেরেছে। তার হাঁড়ি আমি হাটে ভেঙে দিয়েছে, তাই।’ তিয়াসা হাসল।

শাকম্ভরী বাকরহিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল তিয়াসার সামনে।

তিয়াসা বলল, ‘কাল গিরিধারী সামন্ত নামটা শুনেই আপনি ভয় পেয়ে ওকে ছেড়ে দিলেন, তাই তো? এটা ঠিক করলেন না ম্যাম, পুলিসে না দেন, অন্তত জুতো পেটা করতে পারতেন।’

‘জুতোপেটা আমি করব না। আর ভয় আমি কাউকে পাই না।’ শাকম্ভরী চাপা গলায় বলল।

‘আপনার ভাই কাল খুব ভয় পেয়ে গেছে, না? তার একটু পরেই দেখলাম ব্যাগ নিয়ে চলে গেল। আর কোনওদিন নিশ্চয়ই আসবে না। মনে মনে বলছে, কী ছ্যাঁচড়া জায়গা। আর আগে কী ভেবেছিল? গ্রাম মানে শান্ত শিষ্ট ছায়া সুশীতল, গাছপালা, সরল মানুষ, তরতর করে বয়ে যাওয়া নদী। একটা কেসেই সব হাওয়া।’

শাকম্ভরী বলল, ‘তুমি সন্ধেবেলা আমার বাড়ি এসো। এখন ক্লাসে যাও। আমারও ক্লাস আছে।’

সন্ধেবেলা তিয়াসা চলে এল শাকম্ভরীর কাছে। এখান থেকেই দ্বিতীয় পর্বের শুরু।

শাকম্ভরীই জানল, কেন তিয়াসা এইট থেকে পর পর তিন তিনটে ক্লাসে একবছর করে পরীক্ষা না দিয়ে থেকে গেল। শাকম্ভরী ওকে বোঝাল— পরীক্ষা ওকে এবার দিতেই হবে। সেইসঙ্গে ভালো রেজাল্টও করতে হবে। ভালো রেজাল্টেই ওর মুক্তি। নাহলে সারা জীবন এই খাঁচায় ওকে আটকে থাকতে হবে। ও পড়াশোনা করে চাকরি করলে, মাকেও নিয়ে চলে যেতে পারবে। আরও অনেক অনেক কথা। গিরিধারী সামন্তর উলটো দিকে দাঁড়িয়ে এটাই সঠিক কাজ।

তবে ছাড়েনি শাকম্ভরী। স্কুল মিটিঙে সরাসরি জিজ্ঞেস করল গিরিধারী সামন্তকে। কেন তিনি লোক পাঠিয়েছিলেন? গিরিধারী সামন্ত পাক্কা পলিটিশিয়ান, তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ম্যাডাম আপনার ভাই একটা মেয়েদের স্কুলে ঢুকে ফোটো তুলছিল। সেটা দেখেই আমি বলেছিলাম, কে কী ব্যাপার খোঁজ নাও তো। এরা সব অশিক্ষিত, ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। আপনার একতলার ঘর। দিল উঁকি মেরে। ঠিক করেনি। আমার মেয়েই ওকে হাতেনাতে ধরে চড়চাপড়া দিয়েছে। আমি শুনে জুতো পেটা করিয়েছি। আর কী করব? বোকাসোকা মানুষ ফাঁসি তো দিতে পারি না। তবে, আপনার ভাই কাজটা ভালো করেনি, মেয়েদের স্কুলে ঢুকে পটাপট ছবি তুলে— যাইহোক সব নিজেদের ব্যাপার মানিয়ে গনিয়ে নিয়েন। আর ওই একতলার বাড়িটা ছাড়ুন। দোতলায় চলে যান। কেউ উঁকি মারতে পারবে না। শুনেছি, তারপর থেকে আপনি জানলাই খোলেন না। না, না, এটা ভালো কথা নয়।

শাকম্ভরী উঠে এসেছিল শ্যামাপদ বারুইয়ের বাড়ি। আগের বাড়ির থেকে ঢের ঢের ভালো। শোনা কথা, টাকার লোভেই নাকি শ্যামাপদ দোতলা থেকে একতলায় নেমে এসেছে। কিন্তু শাকম্ভরী দেখেছে, সত্যিই শ্যামাপদবাবুর স্ত্রী ভালো করে হাঁটতে পারেন না। আর্থ্রাইটিসে পা বেঁকে গেছে। কেউ কেউ বলে, অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে। তবু এখানে শাকম্ভরী বেশ আছে।

প্রতিদিনই তিয়াসা আসে। শাকম্ভরী ওর কাছ থেকে নানা কথা, নানা গল্প শোনে। এভাবেই একদিন শুনেছিল খোকনদের কথা। সাত-আটটা ছেলে নাকি নিত্য আসছে ওর বাবার কাছে। চাকরির জন্য যে টাকা দিয়েছিল তা ফেরত নিতে। শুনেছিল, অন্যসময় হলে এই ছেলেগুলোর লাশ পাওয়া যেত পাটক্ষেতে নয় হাইওয়ের ধারে। এসব কথা শুনত। কত কথাই তো শোনে।

কিছুদিন আগে রাতে ফোন করেছিল তিয়াসা। শাকম্ভরী তখন কলকাতায়। বলল, ‘ম্যাম, আপনি কবে আসবেন। আপনার সঙ্গে খোকনদা একটু দেখা করবে। ওরা আমার বাবার সঙ্গে মিটিংয়ে বসবে। আমাদের বাড়িতেই মিটিং হবে। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একজন থাকবেন। আমার বাবাই চেয়েছে, একজন ননপলিটিক্যাল বাইরের লোক থাকুক। কে থাকবে সেটা খোকনদারাই ঠিক করবে। খোকনদারা চাইছে আপনি থাকুন।’

‘আমি এসব ব্যাপারে কী জানি?’

‘সত্যিটা শুনুন, ম্যাম। তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন। আসলে ননপলিটিক্যাল যে লোকই আসুক সে কোনও না কোনও ভাবে বাবাকে ভয় পাবে, সমীহ করবে। বাবার কথার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাবে। এটা বাবার একটা চাল। তাকে দিয়ে বাবা যদি তার মনের মতো একটা সমাধান সূত্র বের করে নিতে পারে, তাহলে বাবা কিছুদিন সময় পেয়ে যাবে। খোকনদারা লোক জোগাড় না করতে পারলে মিটিং হবে না। আসলে বাবা কিছুদিন সময় চায়। একবার সময় পেয়ে গেলে ইডি সিবিআই ঠান্ডা হলেই গিরিধারী বগলে পাহাড় নিয়ে নাচবে— ওরা জানে। বাবাকে এই সময় দেওয়া যাবে না। মিটিং আমাদের বাড়িতেই হবে। আমি, মা থাকব। দুটো ফ্ল্যাট বিক্রি, জমি বিক্রি করে ওদের টাকা ফেরত দেওয়াব। প্লিজ ম্যাম, আপনি একটু ওদের সঙ্গে থাকুন। আপনি ফিরলেই খোকনদা আপনার সঙ্গে দেখা করবে।’

খোকন দেখা করতে এসেছিল তিয়াসা সঙ্গে নিয়ে। তারপরই হয় মিটিং।


নয়


শীতল পাল বলল, ‘স্যার, ওই ইন্দুলেখা কিন্তু স্যার বাহানা দিচ্ছে। আজ যদি বলে শরীর খারাপ কাল আসুন, আপনি শুনবেন না, স্যার। বলবেন, আজই কথা বলতে হবে।’

আক্কেল মন দিয়ে ফাইল দেখছিল। তিয়াসা সম্পর্কে বিস্তারিত খবর সে জোগাড় করেছে। খোকনেরও সব ডকুমেন্টস এখন তার টেবিলে। শাকম্ভরীর এখানকার স্কুলে পড়ানো বা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেউ কোনও বিরূপ কথা শোনা যায়নি। কোনও পার্টি পলিটিক্সের সঙ্গে যুক্ত নয়। স্কুলে পরিবর্তনের বিষয়টিও একদম নিয়ম মেপে। কোনও বেনিয়ম নেই। এখানে থাকেও খুবই সাধারণ ভাবে। প্রায় প্রতিমাসে একবার কলকাতায় যায়। আছে বলতে ভাই। বাকি ইন্দুলেখা আর কমলা। এরমধ্যে কিন্তু অদৃশ্য একটা পোকা এসে কামড়েছে আক্কেলকে। তার নাম— সাবির।

সাবির মেডিকেল পড়তে পড়তে প্রাণের ভয়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে গেল হায়দ্রাবাদ। তাকে খুন করে দিত গিরিধারী। নিজের মেয়েকে যখন মেরেছে, তখন কি সাবিরকে ছাড়ত? ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। সাবির কি ছাড়বে? গিরিধারী সামন্তের জন্য তার প্রেমিকা আর কেরিয়ার দুটোই গেল— বদলা নেবে না? নিলে কীভাবে? তার অস্ত্র কে?

সাবির তো মিটিংয়ে ছিল না। কিন্তু তার কোনও প্রতিনিধি কি ছিল? হলে কে? তিয়াসা—?

তিয়াসার মোবাইল ফোনের কল লিস্ট চেক করেছে। সেখানে সাবির বলে কেউ নেই। তাহলে সাবিরের সঙ্গে জড়িত তেমন কি কেউ আছে? আক্কেল বুঝছিল, সাবির নামের শক্ত পাহাড়টা তার রাস্তা আটকে দিচ্ছে।

শীতল পাল বলল, ‘আচ্ছা স্যার, ইন্দুলেখা যদি গিরিধারী সামন্তের ওয়াইফ না হতো ওঁকে এত সময় দিতেন? তুলে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন না? উনি কিন্তু সময় নিয়ে সব কিছু গুছিয়ে ফেলছে।’

আক্কেল ফাইল থেকে মুখ তুলে শীতল পালের দিকে তাকাল, ‘ওঁর থেকে বেশি গুছিয়েছেন তো আপনারা, শীতলবাবু। যখন প্রথম শুনলেন— গিরিবাবুকে চায়ের সঙ্গে কীটনাশক দেওয়া হয়েছে। গিয়েছিলেন চায়ের কাপ খুঁজে বের করতে? এই ধরনের লোকেরা বাড়িতে একটা কি দুটো নির্দিষ্ট কাপেই চা খায়। আমি যখন গেলাম, রান্নাঘর থেকে ওঁর চায়ের কাপটাই পাওয়া গেল না। এটা কিন্তু ঘটনা ঘটে যাওয়ার এগারোদিন পর। আপনারা কেস ডায়েরিতে লিখেছেন, বাড়িতে কোনও কীটনাশক পাওয়া যাইনি। তাহলে, আপনারা কি বাদবাকি অন্য যে তিনজন আছে, খোকন-শাকম্ভরী-কমলা— তাদের বাড়িতে কীটনাশক আছে কি না খোঁজ করেছিলেন? করেননি। এমনকী আশপাশের কীটনাশক বিক্রেতাদের থেকেও খোঁজ নেননি, ঘটনার আগের কয়েকদিন, তাদের দোকান থেকে কে কে কী ধরনের কীটনাশক কিনেছে। এই এগারো দিনের যা কিছু প্রমাণ ছিল তা সব পায়ে পায়ে বহুদূর চলে গেছে। অথচ আপনারা ঘটনার ছদিনের মাথায় জানতে পেরেছিলেন, গিরিধারী সামন্তের মৃত্যু হার্ট অ্যাটাক, বা স্লিপিং পিল পয়জনে নয়, বিষ প্রয়োগে। আপনারা মাঝের কদিনে শুধু খোকন এবং পাওনাদারদের তুলে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। গিরিধারী সামন্তের বাড়ি গেছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু করেননি। যে কেসটা দুদিনে শেষ করে ফেলা যায়। আমি এখানে এসে তিনদিন একই জায়গায় চক্কর কাটছি। সবকিছু একটা একটা করে আমাকে খুঁজে বের করতে হচ্ছে। আর একটা কথা শুনে রাখুন, ইন্দুলেখাদেবী আজ কথা বলবেন। আজ ওঁর শরীর খারাপ থাকবে না। আপনি এদিকে না দেখে, যাকে সাবিরের খোঁজ খবর নিতে বলেছেন, তাকে চাপ দিন। সাবিরের ফোন নম্বরটা কলকাতায় পাঠিয়েছি। ওর কললিস্টটাও এসে যাবে আজ। আর দু একদিন আমি এখানে থাকব। আমার রেজাল্ট চাই। ওপর থেকে প্রতিনিয়ত ফোন আসছে।’

আক্কেলের কথাই ঠিক হল। ইন্দুলেখা তৈরি হয়েই বসেছিলেন। এমনকী কমলাও যেন প্রশ্ন উত্তর মুখে নিয়ে রেডি। একটু বাঁকা চোখে দেখলে মনে হবে, তিয়াসা যেন ওদের পাখি-পড়া করে শিখিয়ে হাজির করিয়েছে।

কিন্তু এখানেও একটা মানসিক খেলা খেলে গেল তিয়াসা।

ওরা যেতেই আক্কেল আর শীতল পালকে বসতে দিয়ে, এবং ইন্দুলেখাকে ওদের সামনে বসিয়ে দিয়ে তিয়াসা বলল, ‘আমি এখন বাড়ির বাইরে যাচ্ছি। কারণ, ম্যাম চেয়েছিলেন, আমি উল্টোপাল্টা কথা বলব, তাই উনি হাজির থাকবেন। কিন্তু তিনি থাকতে পারেননি। তাতে আমার ভালোই হয়েছে। আমি মনের সুখে খোলাখুলি সব কথা বলতে পেরেছি। আমি চাই মাও খোলাখুলি সব কথা বলুক। আমার দিকে না তাকিয়েই।’

তিয়াসা চলে গেল।

আক্কেল ইন্দুলেখার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আগে আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলি, তারপর ওঁকে ডাকব।’

শীতল পাল এগিয়ে এসে কমলামাসিকে বলল, ‘তুমি অন্য ঘরে গিয়ে ওয়েট করো। আমি তোমাকে ডেকে নেব। পারলে একটু চা করে দাও।’

কমলামাসি চলে গেলেন।

আক্কেল সরাসরি তাকাল ইন্দুলেখার দিকে। ‘আপনি সেদিন গিরিবাবুর পাশেই বসে ছিলেন। সবচেয়ে কাছে। চা কমলামাসি বানিয়েছিলেন, কিন্তু চা দিয়েছিলেন আপনি। চা খেয়েই— চায়েই বিষ ছিল। কিছু বলবেন, আপনার কী মনে হচ্ছে? এটা কার কাজ?’

ইন্দুলেখা পাথর।

‘আপনাদের বিয়ে হয়েছে কত বছর?’

‘বিয়ে? উনিশ বছর হবে, ওইরকম।’

‘বাপের বাড়ি যান?’

‘বিয়ের পর এক দুবার গিয়েছি। এখন ভাইয়েরা আসে—।’

আক্কেল হাসল, ‘আমারও কোনও আত্মীয় বাড়ি যাওয়া হয় না। কাজের চাপ? কোথায় যাব। এই যে বাড়ি ছেড়ে তিনদিন এখানে পড়ে আছি। খাওয়ার খুব কষ্ট। আবার টাউনে গেলে— যাক গে। আপনি তো গিরিবাবুর দ্বিতীয়পক্ষ।’

মাথা নাড়লেন ইন্দুলেখা।

‘আপনার উনিশ বছর বিয়ে বললেন— তাহলে বড়মেয়ে, তিয়াসার দিদি?’

‘ও আগের পক্ষের।’

‘আপনি তাহলে সৎমা। সৎমা মানেই জানেন তো খুব খারাপ হয়— মানে সবাই তাই বলে। গল্প উপন্যাস সিনেমাতে দেখবেন—।’

‘আমার সঙ্গে কিন্তু পায়েলের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি বলছি না, আপনি যে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’

‘ভালো যদি সম্পর্ক, তাহলে আপনি কেন জানতে পারলেন না, সাবিরের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা?’

‘না, আমি জানতে পারিনি। সাবির পড়াশোনায় খুব ভালো। পায়েলকে খুব সাহায্য করে। ভালোবন্ধু— এটুকু জানতাম। তারপর—।’

‘তারপর—?’

কমলা চা নিয়ে এলেন।

শীতল পাল একদৃষ্টিতে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে। আক্কেল বলল, ‘দু কাপ কেন? এক কাপ। উনি চা খাবেন না।’

কমলা একটু ইতস্তত করে এককাপ চা নিয়ে চলে গেলেন।

‘তারপর সবাই যখন কানাঘুষো করছিল, আমি একদিন জিগ্যেসও করেছিলাম। ও হেসে উড়িয়ে দিল। তারপর তো ওর বাবা সাবিরকে মারল। তারপর সব কেমন, এলোমেলো হয়ে গেল। মেয়ের কী জেদ। পরিষ্কার বলে দিল—।’

‘কী?’

‘এই ভালোবাসার কথা। ওর বাবাও ছাড়বে না। ওর বাবার একটাই কথা মুসলমান। উনি রাজনীতি করেন, এদিকে খুব মানসম্মান। পায়েলকে আমি অনেক বুঝিয়েছিলাম। বলে দিয়েছিলাম, তোর বাবা ভালোমানুষ না, তোর জন্য ছেলেটার প্রাণ যাবে। একটা মায়ের কোল খালি হবে। কিন্তু মেয়ে কথা শুনল না। পালিয়ে যেত— ঠিক করেই ফেলেছিল, কিন্তু পারল না। আগের দিন ওর বাবা যেন কীভাবে জেনে গিয়েছিল—’

‘তাইজন্যে গিরিধারীবাবু ওর মুখে ফলিডল ঢেলে দিল? আপনি জানতেন? ওর মুখে ফলিডল ঢেলে ওকে ঘরে আটকে রেখেছে?’

চুপ করে থাকলেন ইন্দুলেখা।

‘সেদিনই আপনাদের জেল হওয়ার কথা—প্রভাব খাটিয়ে উনি বেঁচে গেলেন, আপনিও—’ আক্কেল চোয়াল শক্ত করে তাকাল।

‘পায়েল মরে যাবে আমি জানতাম না।’ অস্ফুটে বললেন ইন্দুলেখা। ‘ভেবেছিলাম, উনি ফলিডলের শিশি হাতে নিয়েছেন মাত্র, হয়তো চিৎকার চেঁচামেচির সময় দু ফোঁটা মেঝেতে ফেলেও দিয়েছেন। কিন্তু মেয়ের মুখে ঢেলে দেবেন, এটা বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি, কথার কথা। ফলিডলের ভয়—। কিন্তু উনি সত্যি সত্যি খাইয়েছিলেন।’

‘বাহ্‌! চমৎকার যুক্তি আপনার। আপনার নিজের সন্তান হলে তিয়াসাকেও ইদানীং গিরিবাবু ভয় দেখাতেন— মুখে ফলিডল ঢেলে দেব বলে—।’

‘না, উনি তিয়াসাকে মারতেন। চিৎকার করতেন। কিন্তু একথা উনি বলতেন না, বলত তিয়াসা— তিয়াসাই বলত— কী করবে? কী করবে? আমার মুখে ফলিডল ঢেলে দেবে!’

‘তাহলে পায়েলের ব্যাপারটা আপনি ভেবেছেন নাটক। উনি করেছেন সত্যি— তাই তো দাঁড়াল। এবার ওঁর সময় আপনার মেয়ে ভেবেছে নাটক। ডাক্তারকে তাই বলেছে। হয়েছে—সত্যি!’

ইন্দুলেখা মাথা নীচু করে ছিলেন, মাথা তুললেন, আস্তে আস্তে বললেন, ‘উনি তখন জেলার এত বড় নেতা নন। অনেকদিন আগের কথা। ওদের দলের একটা ছেলে হাসপাতালে এসেছিল গুলি খেয়ে। ডাক্তারবাবুরা খুব চেষ্টা করেছিল বাঁচাতে। পারেনি। পরেরদিন তুলকালাম কাণ্ড, সারা হাসপাতাল ঘিরে ধরল পার্টির ছেলেরা। উনি হাতে কেরোসিন তেলের পাঁচ লিটারের একটা জ্যারিকেন সুপারের ঘরে তাণ্ডব করলেন। তারপর জ্যারিকেন উপুর করে সেই তেল ঢেলে দিলেন সুপারের ঘরে। হাতে দেশলাই নিয়ে হুঙ্কার দিলেন, এই আগুন দেবেন, আগুন দেবেন করে। দেশলাই কাঠি নিয়ে ঘুরলেন। আগুন দিলেন না। ঝামেলা মিটলে সুইপাররা যখন পরিষ্কার করছিল, তারা বলল, উনি জ্যারিকেন করে যা এনেছেন তা কেরোসিনই নয়। আর যদি থাকে সে দুধে চোনা ফেলার মতো। সবটাই নাটক করেছিলেন। উনি এমন করতেন। অনেকবারই করেছেন।’

‘উনি শুনেছিলাম, পায়েল মারা যাওয়ার পর ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন? সেটাও তো আইওয়াশ—’

‘কটা খেয়েছিলেন জানি না, বলে দিয়েছিলেন, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আমি পেট ওয়াশ করিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।’

‘ভালো, ভরপুর নাটুকে নেতা। তা এবারও কি এমন কোনও নাটকের স্ক্রিপ্ট ছিল। ডোজ বেশি হয়ে মারা গেলেন?’

‘আমি জানি না।’

‘কে জানে?’

‘বলতে পারব না।’

‘আপনি বলতে না পারলে, সব সন্দেহ আপনার দিকে যাচ্ছে। খোকন নয়। সে হাতের নাগালের মধ্যেই ছিল না। আর একজন তো বাইরের লোক। তাহলে আপনি আর আপনার মেয়ে— এ বাড়ির কোথাও কি ভালোবাসা নেই!’

আক্কেল চায়ের কাপটা তুলল। তারপর নামিয়ে রাখল। ‘থাক।’

ইন্দুলেখা জড়ানো গলায় বললেন, ‘চা খাবেন না? ভয় পাচ্ছেন?’

‘না, ঘেন্না হচ্ছে। পুলিশের চাকরি করি, তাই এসব জায়গায় আসি, আসতে হয়। আর হ্যাঁ, গিরিবাবুর চা খাওয়ার দুটি কাপ ছিল। আপনারা পুলিশকে বলেছেন। তারমধ্যে একটা নেই। সেটা কিন্তু কোথায় আছে আমি জানি। বলে দেব? আপনাদের বাড়ির খিড়কি দরজা খুললে যে পুকুরটা আছে— সেখানে। আমি ওই পুকুরে জাল দেব। জাল দিয়ে কাপটা তুলব আনব। আজ না হোক কাল আপনাকে সব বলতে হবে। আপনি জানেন, কে করেছে? আপনি যান, কমলামাসিকে পাঠিয়ে দেবেন।’

ইন্দুলেখা উদাস চোখে উঠে যান। কমলা আসেন প্রায় কাঁপতে কাঁপতে। তিনি বসতে না বসতেই আক্কেল বলল, ‘গিরিবাবু যে আর একটা কাপে চা খেতেন সেই কাপটা বাড়িতে নেই। পুকুরে আছে— তাই তো— কাপটা তুলি, তারপর বলব, কে ফেলল।’

কমলা ধপ করে বসে পড়লেন।

‘বলুন, সেদিন চা আপনি করেছিলেন?’

কমলা মাথা নাড়ান।

‘কত বয়েস আপনার?’

‘ষাট হবে, সত্তর হবে—।’

‘বাড়ি কোথায়?’

‘আমি এখানেই থাকি।’

‘চা আপনি করেছিলেন, আপনিই দিয়েছিলেন, রান্নাঘরে কে কে ছিল?’

‘আমি আর বউদি।’

‘কেন দিদিমণি যে এসেছিল—।’

কমলা মাথা নাড়ে, ‘দিদিমণিকে দেখিনি।’

‘দেখেননি কেন? দিদিমণি কাজু বাদামের প্যাকেট দিয়েছিল।’

‘হবে। হ্যাঁ, সবাই বাদাম খেয়েছিল।’

‘কতদিন চেনেন গিরিবাবুকে।’

‘আমি হাসপাতালে আয়ার কাজ করতাম। বউদি আমাকে দিদি হওয়ার সময় নিয়ে এসেছে।’

‘আপনিই খোকনের মাকে চাকরির কথা বলেছিলেন?’

‘হ্যাঁ, বউদি জানে। বউদিও তো বলল, তুমি বলো— হয়ে যাবে।’

‘এখন কী হবে, গিরিবাবু তো মরে গেল? খোকন এসে যদি আপনার কাছে টাকা চায়? তাকে কী বলবেন? চায়ে বিষ কে দিতে পারে? কাউকে দেখেছিলেন— কিছু মেশাচ্ছে?’

‘না, তো। বিষ আসবে কোথা থেকে?’

‘বিষ তো এসেছে, সেটা চায়ের কাপে। আর কিছু কি খেয়েছিলেন?’

‘না তো।’

‘আমাকে নিয়ে চলুন তো, রান্নাঘরটা আর একবার দেখি।’ আক্কেল উঠে দাঁড়ায়। আক্কেল শীতল পালকে বলল, ‘আপনি বরং একবার দরজা খুলে পুকুরের ধারটা ভালো করে দেখে আসুন। কাল ওই পুকুরে জাল দেব। জেলে ডাকবেন— চলুন রান্নাঘরে।’

সামনে কমলা পিছনে আক্কেল।

রান্নাঘরে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল আক্কেল। বলল, ‘মোটে দু তিনটে কাপ দেখছি। আর কাপ-পত্তর কোথায়?’

‘এগুলো তো দাদাবাবু, বউদি, দিদির কাপ। আমারটা ওই যে, ওই কোণে। আর বাইরের লোক এলে তাদের কাপ আলাদা।’

‘তাদের কাপ কোথায়?’

‘বাইরে, ওঘরের শোকেসে।’

‘তারমানে লোকজন এলে তুমি ওই ঘরে গিয়ে কাপ বের করে নিয়ে আসো।’

‘হ্যাঁ, বউদি বলে দেয়— কোন কাপ আনতে হবে, ছোট কাপ, নাকি সাদা কাপ, নাকি ভালো কাপ।’

‘ও লোকের দর বুঝে কাপ বের হয়। তা সেদিন কোন কাপে চা দিয়েছিলেন—?’

‘সাদা কাপে।’

‘আজ আমাকে কোন কাপে চা দিলেন?’

‘ভালো কাপে?’

‘ও আমি উচ্চগোত্রের। চলুন দেখি কোথায় আপনার কাপের শোকেস।’

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তারা এসে পাশের ঘরে একটা সুদৃশ্য শোকেসের সামনে দাঁড়ায়। আক্কেল বলে, ‘নিন, তিনটে সাদা কাপ বের করুন।’

‘কী হবে?’

‘আমি তিন কাপ চা খাব— বের করুন।’ ‘বউদি বলেছে, আপনাকে ভালো কাপে চা দিতে।’

‘আমি সাদা কাপে খাব।’

কমলা তিনটি কাপ বের করে। আক্কেল একটা কাপ নিয়ে পকেটে ঢোকায়। বলে, ‘এই দুটো কাপ তুলে রাখুন।’

অবাক হয়ে কমলা আর দুটি কাপ তুলে রাখে।

‘ঠিক আছে, আমরা কাল যে কোনও সময় আসব, ওই পুকুরে জাল দেব। ওখানে আপনার দাদাবাবুর কাপটা আছে তা তুলে আনব। আচ্ছা, ভেবে দেখুন তো, চা করে রান্নাঘর থেকে আপনি গেলেন শোকেসে কাপ বের করতে। সেইসময় কেউ দাদাবাবুর চায়ের কাপে বিষ মিশিয়ে দিল। কী হতে পারে তো—’

কমলা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

বাইরে বেরিয়ে শীতল পাল বলল, ‘স্যার কাল কখন জেলে নিয়ে আসব।’

‘কাল সকালের দিকে করুন। আপনি নিজে থাকবেন। ভালো করে জাল টানাবেন।’

‘আপনি সিওর, ওখানে চায়ের কাপটা পাওয়া যাবে।’

‘হ্যাঁ, ওই পুকুরেই আছে। চায়ের কাপ তুলে কাজের কাজ কিছু হবে না, কিন্তু কাপটা তুলতে হবে। কাপটা তুললে কেউ কেউ ভয় পাবে। চলুন আমরা এখন খোকনের বাড়ি যাব।’

‘ওর বাড়ি যাবেন কেন? ওকে ডেকে পাঠালেই সুড়সুড় করে আসবে।’

‘আমার খোকনের সঙ্গে দরকার নেই। ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলব।’

শীতল পালকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন খোকনের মা। বসতে দিয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছেন। বললেন, ‘খোকন বাড়ি নেই। ওকে কি আবার যেতে হবে।’

তার আগেই ওদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামতে আক্কেল শুনেছিল, আশপাশের ফিসফিসানি— এবার ধরে নিয়ে যাবে। তখনই শুনল, খোকন বাড়ি নেই। অবলীলায় কেউ একজন বলে দিল— পালিয়েছে।

শীতল পাল বলল, ‘আপনিই তো খোকনের মা। কী নাম আপনার? স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’

নাম বললেন— বৈশাখী।

আক্কেল বলল, ‘আমি খোকনকে ধরতে আসিনি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।’

বৈশাখী যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

আক্কেল বলল, ‘কমলামাসি আপনাকে খোকনের চাকরির জন্য গিরিধারীবাবুকে টাকা দেওয়ার কথা বলে, উনি সেটা গিরিধারীবাবুর স্ত্রীর কাছ থেকে জেনেছিলেন। তাই তো।’

‘হ্যাঁ, আমি কমলাদির কথা বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু ইন্দুদি যখন বলল—।’

‘ইন্দুদি মানে ইন্দুলেখা? গিরিধারীবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আপনার আগেই আলাপ ছিল।’

‘ইন্দুদির সঙ্গে আমার কমলাদির আগেই চেনাজানা। আমি অনেক আগে সরকারি হাসপাতালে আয়ার কাজ করতাম। ইন্দুদি সেখানে নার্স ছিল। তারপরে সামন্তবাবুর সঙ্গে বিয়ে হয়। আমি সব জানি।’

‘জানি বলতে?’ আক্কেল সোজা হয়ে বসে।

‘না, জানি মানে, ইন্দুদিকে আমি সামন্তবাবু, কমলাদি— সবার আগে চিনি। তারপর তো নার্সিংহোমে বাচ্চা হতে গিয়ে ইন্দুদির সঙ্গে কমলাদির চেনাশোনা হয়। ইন্দুদিই ওকে বুঝিয়ে এই বাড়িতে বাচ্চাকে দেখার কাজে নিয়ে আসে। কমলাদির কেউ নেই। কেউ নেই, আবার ভাই টাই থাকতেই পারে, তবে আমি কখনও শুনিনি। বাচ্চা বড় হওয়ার পরে ইন্দুদি কমলাদিকে বলে থেকে যেতে। কমলাদি থেকে যায়।’

‘আপনার সঙ্গে কমলামাসির কবে পরিচয়?’

‘আমি কিছুদিন ওই রিলিফ নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করেছি। সেখানে। তারপর ইন্দুদির মেয়ে হতে সাহস করে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন কমলাদিকে দেখি।’

‘তারপর, আর কোনওদিন যাননি?’

‘না, খোকন বারণ করেছিল। সামন্তবাবু ওদের পার্টির নেতা তো। আমি আর যাই না। তবে মাঝেমাঝেই কমলাদি আমাদের বাড়ি আসে। আমি সব খবরাখবর পাই।’

‘ওদের বাড়ির খবর বলতে?’

ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেন বৈশাখী।

আক্কেল বলল, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। গিরিবাবু নেই। ওদের বাড়ির কেউ যে আপনাকে কিছু বলতে আসবে, সে ক্ষমতা ওদের নেই। আমরা ওদের বড়মেয়ে পায়েল কীভাবে মারা গেছে, সব খবর জানি। সাবিরের সঙ্গে প্রেম ছিল পায়েলের, সে আপনাদের সামন্তবাবুর কথা শোনেনি। সামন্তবাবু ওর মুখে ফলিডল ঢেলে দিয়েছে। বলেছে, সুইসাইড বা কাফসিরাপ ভেবে ভুল করে খেয়ে নিয়েছে— এসব কথাও জানি?’

ঘাড় নাড়ে বৈশাখী।

‘আর কী কথা?’

‘এসবই—।’

‘দেখুন, যা যা জানেন, সব বলুন। আপনি সব বললে আপনার ছেলে বাঁচবে। নইলে, খোকন ফেঁসে যাবে। বেচারা কিছু না করেই খুনের কেস খেয়ে যাবে, সেটা কি ভালো হবে?’

‘সামন্তবাবুর সঙ্গে দু মেয়েরই খারাপ সম্পর্ক। বড়মেয়েটা অবাধ্য, কথা শুনল না। সামন্তবাবু হাতে পায়ে ধরেছিল। আমাকে কমলাদি সব বলেছে। আর ছোট মেয়ে শুধু ওর মাকে মানে। আর কাউকে মানে না। বাপ কিছু বললেই তেড়ে আসে। এমনকী বাপ মারলে, ওই মেয়ে হাতের কাছে যা কিছু পায় ছুঁড়ে বাপকে মারে। ও মেয়ে ব্যাটাছেলের বাবা। সবাই বলে যেমন বাপ তেমন মেয়ে। কমলাদি আমাকে বলেছে, একদিন বাড়ির ভেতর ঠিক খুনোখুনি হবে। ওই মেয়ে খুব খারাপ। অমন মায়ের কী মেয়ে হল! মায়ের গুণ কিছু পাইনি, সব বাপের দোষ পেয়েছে।’

‘আপনি ওই মেয়েটাকে খারাপ বলছেন— ওই মেয়ে কিন্তু আপনার ছেলে যাতে টাকা ফেরত পায় তার জন্য বাপের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিল।’

‘হ্যাঁ, এই বুদ্ধিটা আমাকে কমলাদি দিয়েছিল, আমিই তখন খোকনকে পাঠাই। হ্যাঁ, ওরজন্য মিটিং হচ্ছিল।’ ‘আর টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য আপনার ইন্দুদি কোনও বুদ্ধি দেয়নি?’

‘ইন্দুদি কী করবে— ও কী করে সামন্তবাবুকে ঠেকাবে। তাহলে তো বিয়েই করত না।’

‘মানে? সামন্তবাবু কি জোর করে বিয়ে করেছেন?’

‘হ্যাঁ জোর করেই বিয়ে করেছে। ইন্দুদি তো বিয়ে করতে চায়নি। অনেক চেষ্টা করেছে ঠেকাতে। পারেনি। বিয়ে না করলে চাকরি বাঁচাতে পারত না।’

‘বিপত্নীক গিরিবাবু তাহলে ইন্দুলেখার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল—।’

শীতল পাল হাসে। বলে, ‘ও স্যার, এদিকে একটা রেওয়াজ ছিল জানেন। অবিবাহিত মেয়ে এসে এখানে হাসপাতাল স্কুলে চাকরি করলে এখানকার কাউকে বিয়ে করতে হবে। করতও। না করে উপায় থাকত না। এখানকার লোকেরা সরকারি চাকরি করা বউ পেত।’

‘আর না করলে?’

‘না করলে গোলমাল হতো।’

‘গিরিবাবু তো ইন্দুদিকেও হুমকি দিয়েছিল— আমাকে না বিয়ে করলে জমাদারদের দিয়ে রেপ করাব। গিরিবাবু ইচ্ছে করলে করাতেও পারত। রাক্ষস ছিল।’ বৈশাখী বলে চলল। ‘ইন্দুদির পিছনে দুজন তিনজন লেগেছিল। কিন্তু দোজবরে সামন্তবাবুকেই বিয়ে করতে হয়।’

বৈশাখীর কথায় সম্মতি জানায় শীতল পাল। ‘ও হামেশাই হতো।’

‘এখন সম্পর্ক কেমন ছিল? কমলাদি কী বলেছেন?’

‘বড়মেয়েটা তো ইন্দুদির প্রথম পক্ষের মেয়ে ছিল। কিন্তু মেয়েটা মারা যেতে সামন্তবাবু পার্টিকে বলেছে— বোঝেনই তো সৎমা। আমি বাড়ি থাকি না, সারাদিন পার্টি পার্টি করে ঘুরে বেড়াতে হয়। কোথায় কার মনে কী ঠোক্কর লেগেছে আমি টের পাইনি। এটা শুনে, ইন্দুদি নাকি খুব চুপ মেরে গেছে। কিন্তু আমরা সবাই জানি ইন্দুদি অমন মানুষ না। কমলাদি বলেছে— ইন্দুদি নিজের মায়ের থেকেও বেশি ছিল। ইন্দুদি খুব ভালোমানুষ। সামন্তবাবু মারা যেতে, মেয়েকে বলেছে, পাপের টাকা সব শোধ করে দিবি।’

‘এবার বলুন তো? সামন্তবাবু মারা যেতে খোকন কী বলল?’

‘কী বলবে? ও তো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সবসময় আতঙ্ক। ওকে নাকি মারার জন্য সব তাল করছে।’

‘খোকন কী বলল— খুনটা কে করেছে?’

আবার কাঁপতে শুরু করল বৈশাখী। ‘ও কারো নাম বলেনি। বলেছে, এটা পলিটিক্স। পার্টি থেকেই এটা করাচ্ছে। খুন খুন বলে সব টাকাটাই হাপিস করে দেবে। মা ওই টাকা আর পাব না। টাকা চাইতে গেলে জেল খাটতে হবে। আমি ওকে বলেছি পুলিশ তো পার্টির নয়—।’

আক্কেল উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘কে বলল পুলিশ পার্টির নয়? পুলিশ পার্টির। বনমালি নস্কর খুনের কেসে আপনার ছেলের নাম ছিল। পার্টি ওকে বাঁচিয়েছে। ও ঠিক বলেছে, টাকার জন্য হুজ্জতি করতে গেলে এবার জেল খাটবে। চলুন শীতলবাবু।’

থানায় ফিরেই দেখল, স্থানীয় পার্টির লোকজন এসেছে। বড়বাবু তাদের দুজনকে নিয়ে এল আক্কেলের কাছে—স্যার, এঁরা এসেছেন। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলবেন।

‘আপনারা নাকি আজ গিরিধারীবাবুদের বাড়ি গিয়েছিলেন?’ একজন বলল।

অপরজন বলল, ‘আপনারা কি গিরিবাবুর স্ত্রীকে সন্দেহ করছেন? এটা মনে হয়, ঠিক করছেন না। উনি ভালোমানুষ। আমরা সবাই জানি।’

প্রথমজন বলল, ‘কাল পাশের পুকুরে জাল ফেলবেন শুনলাম। এটা কী কোনও দরকার ছিল? খোকনকে অ্যারেস্ট করে— বাটাম দিন। সব সত্যি বেরিয়ে যাবে।’

‘খোকন আগে আমাদের পার্টি করত— মারাত্মক খুনে প্রকৃতির ছেলে।’

‘জানি, খোকন তো আগে আপনাদের পার্টির হয়ে বনমালি নস্করকে পিটিয়ে মেরেছে।’ কথা বলতে বলতে আক্কেল একটা কাগজ এগিয়ে দিল। বলল, ‘একদম ঠিক বলেছেন— আমি আপনাদের সঙ্গে এক মত। কিন্তু কী করব বলুন তো, ইন্দুলেখাদেবী তো নিজেই বলে দিলেন— গিরিধারী সামন্ত আপনাদের স্বর্গত নেতা নিজের বড় মেয়ের মুখে ফলিডল ঢেলে দিয়েছিলেন। সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। একথাগুলো উনি যদি বাইরে বলে দেন, তাহলে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। উনি বেঁচে যাবেন, কিন্তু যা চুনকালি সব আপনাদের গায়ে। আচ্ছা, আপনারা তো গিরিধারী সামন্তের তদন্ত নিয়ে অনাস্থা আনছেন— আপনারদের নাম ঠিকানা একটু লিখে দিন, লালবাজারে পাঠিয়ে দেব।’

দু’জনেই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আমরা অনাস্থা আনব কেন? আপনার কাজ আপনি করবেন। আমরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করে গেলাম।’

দুজনেই চলে গেল। ওদের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল শীতল পাল।

আক্কেল ডাকল, ‘শীতলবাবু অনেকক্ষণ কিছু খাননি। কিছু খেয়ে নিন। অনেকসময় পেটে গ্যাস জমলে সব কথাই ভুরভুর করে বেরিয়ে আসে। কথা আর পেটে থাকতে চায় না। যান কিছু খাবার দিয়ে কথা ঢাকা দিন।

রাতে আক্কেলের কাছে ফোন এল, ‘স্যার, পুলিশ ক্ষমতাসীন পার্টির পোষা আমরা জানি। কিন্তু এতটা নির্লজ্জ হয়ে গেছে জানতাম না। একজন নির্দোষ বেচারার বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে এলেন— টাকা চাইতে গেলে জেল খাটতে হবে। জানেন, এটা নিয়ে জেলার লোকজন দারুণভাবে রিয়্যাক্ট করেছে। কাল থেকে যদি মিটিং মিছিল শুরু হয় কিছু বলতে পারবেন না—।’

‘কিছু হলে আমি খোকনকে বনমালি নস্কর খুনের কেসে তুলে নেব। তারপর বেদম ঠ্যাঙাব। মারের চোটে গিরিধারী সামন্তকে খুন না করলেও ওকে স্বীকার করতে হবে, খুন করেছে। আর আমি সাক্ষী জোগাড় করে নেব। মা মেয়ে তো আছে—ওরা সাক্ষী দেবে।’

‘ঠিক করছেন না, স্যার। রক্ষকই ভক্ষক হয়ে গেলেন। সবাই জানে ওর মেয়েই খুন করেছে। আর আপনি ওই নষ্ট নোংরা মেয়েকে তাস করছেন। ওর ইতিহাস আপনি জানেন! আমরা ক্ষমতায় এলে—।’

‘আগে ক্ষমতায় আসুন।’ আক্কেল ফোন কেটে দিল।


দশ


সকালে একটা মর্মান্তিক খবরে ঘুম ভাঙল আক্কেলের। শীতল পাল ফোন করেছিল— স্যার গিরিবাবুর ওয়াইফ ইন্দুলেখাদেবী সুইসাইড করেছে। দড়ি দিয়েছে স্যার।

‘মানে?’ চমকে উঠেছিল আক্কেল।

‘হ্যাঁ, স্যার এই তো থানা চত্বরে চারজন জেলে এসে গেছে। আমি বেরুনোর তোড়জোর করছি। এমন সময় খবর এল।’

‘কে খবর দিল?’

‘মনে হয় বড়বাবুর কাছে শাকম্ভরী দিদিমণি ফোন করেছিল। পার্টির লোকজনও খবর দিয়েছে। কনফার্ম খবর স্যার।’

আক্কেল দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আজ আর যেতে হবে না, জেলেদের ফেরত পাঠিয়ে দিন।’

‘আমিও তাই ভেবেছিলাম, স্যার।’

আক্কেল চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। ‘ডেডবডি কি নামানো হয়েছে? আমি যাব।’

বড়বাবু এক্সট্রা ফোর্স চেয়ে পাঠিয়েছে। ফোর্স এলেই আমরা যাব। ‘একটা কথা বলব স্যার— আপনি কাল আমাকে গালাগালি দিলেন। আসলে ওদের খবর দিয়েছিলেন বড়বাবুই। এই তো আজ থানায় বসে বসে ননস্টপ বলে যাচ্ছেন— আতঙ্কে বেঘোরে একজনের প্রাণ গেল। আরে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে এসে কড়কা। বাইরে থাকলে আসামি পালাবার চেষ্টা করবেই, পালাতে না পারলে মরবে।’

‘আপনার বড়বাবু নিশ্চিত ইন্দুলেখাদেবীই খুন করেছেন?’

‘তাছাড়া কে, স্যার? নইলে অহেতুক মরবে কেন?’

‘তাই তো, মরিয়াই উনি প্রমাণ করলেন, ওঁর কৃতকর্ম। কোনও সুইসাইডাল নোট রেখে গেছেন?’

‘আমরা কেউ যাইনি, স্যার। আপনি আসুন।’

না, কোনও গোলমাল হয়নি। আসলে চারদিকেই রটে গিয়েছিল গিরিধারী সামন্তকে খুন করেছে তার স্ত্রী। উনি বুঝতে পেরেছিলেন, আর মুক্তি নেই। আক্কেল যখন বাড়ি গেল, দেখল, বডি তখনও ঝুলছে। পাখার সঙ্গেই গলায় ফাঁস দিয়েছে। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। প্রাথমিক নজরেই নিশ্চিত হওয়া যায় আত্মহত্যা। প্রথম দেখেছিল কমলা। সে-ই তিয়াসাকে ডেকে জানায়। তিয়াসা শাকম্ভরী দিদিমণিকে। উনি এসে থানায় খবর দেন। কোনও কিছু লিখে যাননি।

বড়বাবু নিজে ছিলেন, বুঝিয়ে দিলেন, বডি পোস্টমর্টেমে যাবে। আজ বডি পেতে পেতে বিকেল হয়ে যাবে।

তিয়াসা পাথর হয়ে বসে।

শাকম্ভরীকে ডেকে আক্কেল বলল, ‘কোনও কিছু লিখে রেখে যাননি তাহলে?’

‘আমি তো খবর পেয়েই এসেছি। কিছু লিখে রেখে গেলে ঠিক আমার নজরে পড়ত। আমি সঙ্গে সঙ্গেই থানায় খবর দিয়েছি।’

‘লিখে রেখে গেলে ভালো হতো। যাই হোক, তিয়াসা কী বলছে? ঠিক আছে?’

‘ঠিক কী করে থাকে? আসলে গিরিধারীবাবুর মৃত্যু নিয়েই ওর কাছে কনফিউশন ছিল। ওর মনে হয়েছিল, এটা কোনও পলিটিক্যাল গেম হচ্ছে— কাউকে বাঁচানোর জন্যই এটা করা হচ্ছে।’

‘বাঁচানোর জন্য, না ফাঁসানোর জন্য?’

‘প্রথম প্রথম বলছিল, খোকনদাকে ওরা ফাঁসাতে চাইছে। কিন্তু কদিন পর থেকেই বলছিল, ফাঁসানোর জন্য নয়, যা হচ্ছে সেটা বাঁচানোর জন্য। আসলে, ওর বাবা অনেক টাকা আত্মসাৎ করেছে। একা তো করেনি। নিশ্চয়ই পিছনে অনেক অনেক বড় মাথা ছিল। যদি আত্মহত্যা হয়, তাহলে পরেরজনের খোঁজ চলবে। গিরিবাবুর টাকা কোথায় কোথায় যেত। কিন্তু খুনের গল্প শুরু হতে সবার ফোকাস অন্যদিকে ঘুরে গেল। টাকার ব্যাপারটাও ধামাচাপা পড়ে গেল। আড়ালের লোকও আড়ালেই থেকে গেল। কিন্তু—।’ ‘কিন্তু?’

‘কিন্তু আজ ও আমাকে দুচারটে কথাই বলছিল—।’

‘কী কথা?’

‘ওর বিশ্বাস নড়ে গিয়েছে। আজ ওর মনে হল, ওর বাবাকে খুনই করা হয়েছে। খুন নাহলে ওর মা মরবে কেন? আর সেটা—।’

‘সেটা?’

‘ও বলছিল, মা প্রায়শ্চিত্ত করল।’

আক্কেল চুপ থাকল। তারপর, বলল, ‘আমি শুধু আপনাকে বলি, ওকে বলবেন— গিরিধারী সামন্তকে খুনই করা হয়েছে। আর এটা নিয়ে কাউকে ফাঁসানো বা বাঁচানোর কোনও ব্যাপার ছিল না। ইন্দুলেখাদেবীর মৃত্যুতে হয়তো তদন্তের যবনিকা পড়ল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছানো গেল না। একটা কাঁটা থেকে গেল মনে— কীভাবে? চাষির ব্যাটা কীটনাশকের ঝাঁঝাল গন্ধ পেল না! আশ্চর্য! জানতে পারলাম না সত্যিই কী হয়েছিল, কীভাবে? আচ্ছা আসি। আমার এখানকার কাজ মনে হয় ফুরল। আজ বা কাল আমাকে ডেকে নেবে। আমি যা রিপোর্ট করার করে দেব। আপনাকে বলি— মেয়েটা একা হয়ে গেল, ওকে দেখবেন।’

‘হ্যাঁ, ও বড্ড একা। পরীক্ষার জন্য মন দিয়ে তৈরি হচ্ছিল। মাঝে মাঝে রাতে আমার কাছে থেকেও যেত। ওর বাড়ির বাইরে থাকা নিয়েও ওর বাবার আপত্তি ছিল। সেটাও কম অশান্তি হয়নি। ওকে পড়াতেই হবে। কী করে করাব জানি না।’ শাকম্ভরী অস্থির গলায় বলল।

থানায় ফিরে শীতল পালকে ডেকে আক্কেল বলে দিল, পুকুরে আর জাল ফেলার দরকার নেই।

শীতল পাল বলল, ‘কেস ক্লোজ তাই তো, স্যার। ব্যাপারটা জলের মতো ক্লিয়ারই ছিল। তবে আগে ধরে নিলে কেসটা জমত।’

আক্কেল পাশের ঘরে সব কাগজপত্র খুলে বসে থাকল। মাঝে শীতল পাল চায়ের অর্ডার দিয়ে এসে আক্কেলের মুখোমুখি বসল, বলল, ‘স্যার, জেলেদের বারণ করে দিয়েছি। বড়বাবু বলছিলেন, তুমি তো জেলেদের বারণ করে দিলে, তোমার স্যার কিন্তু এখনও পুকুরে জাল টানছেন!’

আক্কেল বলল, ‘রিপোর্ট লিখে ফেলেছি। কাল একেবারে সঙ্গে নিয়ে চলে যাব।’

‘কেস ক্লোজের ফোন কি এসে গেছে, স্যার?’

‘হ্যাঁ। কাল সকালে এখানকার পাঠ গোটাব।’

‘স্যার, সাবিরের খবর এসেছিল। বছর তিনেকের মধ্যে এদিকে কেউ কোনওদিন দেখেনি। বেচারা মেডিকেল পড়া ছেড়ে ওষুধ বেচচ্ছে। ওপেল কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ।’

‘হ্যাঁ, ওর ডিটেলস কল লিস্ট চেক করে এসেছে। সেখানে তাই আছে। আর কোনও যোগসূত্র নেই—।’

আক্কেলের মনটা খারাপ লাগছিল।

রাত্রিবেলায় ফোন করেছিল শাকম্ভরী। সব কাজ মিটিয়ে এসে বসেছে। তিয়াসা ওই বাড়িতে। ওর মামার বাড়ি থেকে মামা মামি এসেছেন। ছোটকাকারাও এসেছেন কলকাতা থেকে। আত্মীয়স্বজন ভরা বাড়ি।

শাকম্ভরী খুব স্পষ্ট গলায় বলল, ‘তিয়াসা বলছিল, কাল আপনি কি ওর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারবেন?’

আক্কেল চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ‘কাল সকালেই আমি বেরিয়ে যাব। সত্যি বলতে কি, আজ আমরা ওই পুকুরে জাল দিতাম। জালে যদি কাপটা উঠত, ভেবেছিলাম ওঁকে দুপুরেই থানায় ডেকে এনে আর একপ্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদ করব। কিন্তু বড্ড তাড়াতাড়ি হাতের বাইরে চলে গেলেন। আর এমনভাবে গেলেন, কোনও ছবিই আমার কাছে পরিষ্কার নয়।’

হালকা কাশল শাকম্ভরী। বলল, ‘তিয়াসা কাল আপনাকে কি বলতে চায়, সেটা খুব সংক্ষেপে আপনাকে আমি বলছি। প্রথমত, ও গিরিধারীবাবুর দুটো ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেবে। বিক্রি করে খোকন এবং তার সঙ্গী সাতজনের টাকা শোধ করতে চায়। ও জানতে চাইছিল, ও যদি টাকা দেয় তাহলে, আরও কেউ কেউ এসে কি গোলমাল পাকাতে পারে?’

আক্কেল বলল, ‘ওকে বলুন— আপাতত এসব মাথা থেকে হঠিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিতে। তারপর ধীরেসুস্থে যা করার করবে। সময় আছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে যাক, আমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করব।’

শাকম্ভরী বলল, ‘আর একটা কথা— এ কথাগুলো অনুমান। হয়তো আপনাকে ঘটনার মূলে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আপনি বলছিলেন না, ছবিটা পরিষ্কার নয়, সেটাই। এর আগেও গিরিধারীবাবু একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। উনি যে আত্মহত্যার চেষ্টা করবেন— সেটা আগে থেকেই নাকি জানতেন তিয়াসার মা। আর একবার গিরিধারীবাবু ইন্দুলেখাদেবী আক্রান্ত হন— সেটা নাকি পুরো নাটক। সেই নাটকে গিরিধারীবাবুর সঙ্গে পুরোমাত্রায় অভিনয় করেছিলেন ইন্দুলেখাদেবী। তিনি চারদিন সম্পূর্ণ বিছানা নিয়েছিলেন। তিয়াসা নিজেও ভেবেছিল, ওর মায়ের আঘাত সত্যি। কিন্তু পরে জেনেছিল, দুজনের সবটা মিথ্যে।’

আক্কেল বলল, আপনি কি এটা বলতে চাইছেন— বিষয়টা গটআপ ছিল? কিন্তু কোথাও একটা গড়বড় হয়ে গেছে।’

‘তিয়াসা বলছিল— তেমনই কিছু। গটআপ। হয়তো জাস্ট কাপে এক ফোঁটা কীটনাশক ছিল। গিরিধারীবাবু জানতেন, ওটুকু কীটনাশকে বমি হবে, বাদবাকি অভিনয় করে খোকনকে ঠেকাবেন। খুনের অভিযোগ আনবেন খোকনের নামে। কিন্তু তিয়াসার মা কোনওভাবে পরিমাণে গড়বড় করেন।’

‘সেটা ইচ্ছে করে? না অনিচ্ছেতে?’ আক্কেল বলল।

‘দেখুন সেটা উনিই বলতে পারতেন। তবে তিয়াসার কথা— ইচ্ছে করেই। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলেন! বড়মেয়ের সময় উনি নাটক ভেবেছিলেন। কিন্তু গিরিবাবু সেটা সত্যি করেন। এক্ষেত্রে গিরিবাবুর নাটককে উনি সত্যি করে দেন।’

আক্কেল দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘উনি কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুললেন। ওদিকে চাষির ব্যাটা গন্ধ পেয়েছিলেন। কিন্তু জানতেন, ওই গন্ধে তেমন কোনও বিপদ নেই! এবার আমার হিসেব মিলল—।’

বিমর্ষ হয়ে শাকম্ভরী হাসল, ‘হিসেব কি সব মেলে মিস্টার বসু। হিসেব মেলাতে গিয়ে একই পরিবারের তিনজনকে প্রাণ দিতে হল। আর একটা ছেলে মেডিকেল পড়া বন্ধ করে প্রাণের ভয়ে কোথায় পালিয়ে গেল।’

‘সাবির, ওর খোঁজ আমরা পেয়েছি, মুম্বইতে আছে। একটা ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ।’

‘মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ! আরে আমার ভাইও তো নিওজারে আছে। ও কোন কোম্পানিতে আছে।’

‘ওর ওপেল।’

‘যাক, এটা তিয়াসাকে বলতে হবে। সব খারাপের মধ্যে তো ভালো খবর সাবির জীবনের মূল স্রোতে আছে। আপনি তাহলে কাল চলে যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, সকালে গিয়েই আমাকে রিপোর্ট করতে হবে। থ্যাঙ্ক ইউ শাকম্ভরী—।’

‘কীসের জন্য ধন্যবাদ দিলেন? আপনাকে ওই গন্ধের কাঁটাটা তুলে দিলাম বলে।’

‘হ্যাঁ, নইলে সারাজীবন আমার ওই কাঁটাটা বিঁধে থাকত। ভালো থাকবেন। যেকোনও দরকারে ফোন করবেন।’

আক্কেল ফোন রেখে চুপ করে শুয়ে থাকল।

সে ফোন করল খোকনকে। দু’বার রিং হওয়ার পরেও খোকন ধরল না। তৃতীয়বারে ধরল। বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, স্যার।’

‘শুনুন, পরিষ্কার করে একটা কথা বলে রাখি। তিয়াসা একা। কোনওভাবেই কোনও টাকাপয়সার জন্য এখন ওদের বাড়ি যাবেন না। একাও যাবেন না। দল পাকিয়েও যাবেন না। বনমালি নস্কর খুনের কেসের সব কাগজপত্র আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। মনে রাখবেন, তিয়াসা আপনাকে সাহায্য করার জন্য নিজের বাবার সঙ্গে লড়েছিল। আর সেটা আপনার জন্য।’

আজ রাতে তার ঘুম আসবে না— সে উঠল কাগজপত্রগুলো খুলে আর একবার বসল। ল্যাপটপটা টেনে বসল। কত হাজার কোটি টাকা চাকরি দেওয়ার নামে তোলা হয়েছে। যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় বসে। যদি এই দুর্নীতি সামনে না আসত তবে হয়তো গিরিধারীর মতো মানুষজন আরও দু-চার-দশজনকে চাকরি দিত। আরও কয়েকশো মানুষের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করত। সব, সব যেন ভিড় করে আসে আক্কেলের মাথায়।


এগারো


তবু পাঁচদিনের মাথায় আক্কেল আবার এল। তখন দুপুর। আগের দিন শ্রাদ্ধশান্তির কাজ মিটে গেছে। এর মাঝে সে প্রায় প্রত্যেকদিন ফোন করেছিল শাকম্ভরীকে। আগেরদিন রাতেই বলেছিল, পরেরদিন যাচ্ছি। শাকম্ভরী বলেছিল, ‘কোনও অসুবিধে নেই, যখন খুশি আসুন, আমার স্কুল ছুটি।’

আক্কেল কিন্তু এসে উঠল গিরিধারীবাবুর বাড়িতে। সঙ্গে তারই অফিসের একজন কলিগ। নাম অনুরাধা ভৌমিক। তাকে পরিচয় করিয়ে দিল শাকম্ভরীর সঙ্গে। আক্কেল এসে বলল, ‘আমরা একটু নিজেদের মধ্যে একান্তে কথা বলব। আমি শুনব, অনুরাধাই বলবে। ও কীসব খবর নিয়ে এসেছে।’

তিয়াসা বলল, ‘আর কি কথা— পরীক্ষা হয়ে যাক, আমি চেষ্টা করব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুটো ফ্ল্যাট বিক্রি করে ওদের টাকা দিয়ে দেওয়ার।’

শাকম্ভরী বলল, ‘আমি ওকে বলেছি, নিশ্চয়ই তুমি টাকা দিয়ে দেবে। কিন্তু ওরা অন্যায় করেছে। ওদেরও শাস্তি পাওয়া দরকার। নাহলে আবার ওরা নিজেদের প্রয়োজনে এই কাজই করবে।’

আক্কেল সায় দিল, বলল, ‘ঠিক কথা বলেছেন। আমিও আপনার সঙ্গে একমত, যে অন্যায় করেছে, তার শাস্তি পাওয়া দরকার। সে যে কারণেই করুক।’

তিয়াসা বলল, ‘আমি এখন ঠিক ভাবতে পারছি না, কী করব? কিন্তু খোকনদারা কি আমাদের বাড়ির সামনে এসে টাকার দাবি করে কোনও গোলমাল পাকাতে পারে? ওকে ওর পার্টি যদি সাপোর্ট দেয়—।’

‘খোকনকে আমি যা বলার বলে দিয়েছি। ও কিছু করবে না। করলেই লোকাল থানা ওকে তুলে নেবে— ও গিরিধারীবাবুর সঙ্গে অনেক অন্যায় কাণ্ডে জড়িত, আমি সেই সব ফাইল কপি করে নিয়ে গেছি। ওর বিষ দাঁত আমি ভেঙে দেব। তবে হ্যাঁ, কোনওদিন যদি মনে হয়, ওদের কিছু টাকা, বা সম্পূর্ণ টাকা তুমি ফেরত দেবে। সেদিন আমাকে জানাবে। আমি লিখিত নিয়ে সেই টাকা হস্তান্তর করব।’

‘এটা ভালো ব্যবস্থা। থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার বসু।’ শাকম্ভরী বেশ গুছিয়ে বসল। বলল, ‘আমি তিয়াসাকে বলেছি— কেস ক্লোজ। আর অন্যদিকে মন নয়। এবার তোমার পরীক্ষা শেষ হোক, আমরা কোথাও একটা ঘুরতে যাব। তারপর পরবর্তী ভাবনা।’

আক্কেল হাসল, ‘কী জানেন শাকম্ভরী ম্যাম, পুলিশের ওপর মহল চায় কেস ক্লোজ করতে। আমিও চাই কেস ক্লোজ করতে, তবে সেটা অপরাধী খুঁজে বের করে। তাই— আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে আজ এতদূর দৌড়ে আসতে হল। সেদিন আপনি আমাকে পরিষ্কার করে না বললে ওই কাঁটা আমার গলায় লেগেই থাকত। বিশ্বাস করুন আমি বের করতে পারতাম না।’

‘কোনটা বলুন তো? ওই কীটনাশকের ঝাঁঝাল গন্ধের ব্যাপারটা? ওটা আমি নই, তিয়াসা বলেছে— আমি শুধু আপনাকে কনভে করেছি।’

‘না, না, ধন্যবাদটা আপনার প্রাপ্য। আপনি তো শুনে চুপ করে যেতে পারতেন। আর আমি সারাজীবন ধরে গোলোকধাঁধায় ঘুরতাম। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনি হাসতেন। ভাবতেন, আপনি জানেন, আর আমি জানতে পারলাম না।’

‘না, না, এর সবটুকু প্রাপ্য তিয়াসার।’

‘আমিই ম্যামকে বলেছি—।’ তিয়াসা অস্ফুটে বলল।

আক্কেল বলল, ‘না, না, এটা শাকম্ভরী ভট্টাচার্যেরই প্রাপ্য। তাইজন্যেই তো আমি আপনাকে একটা খবর দিলাম— সাবিরের খবরটা। সাবির ওপেলে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর কাজ করে। আপনি জানালেন আপনার ভাই ওষুধ নাইজারে আছে।’

শাকম্ভরী হাসল, বলল, ‘হ্যাঁ, সেদিন শ্মশান থেকে ফিরে অনেকক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।’

‘হ্যাঁ, তখন থেকেই আমার মনটা হালকা হয়ে গেল। জট ছেড়ে গেল। আমি অনেক রাত পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করলাম। গুগুলবাবাই ভরসা। জানেন, কী আশ্চর্য সেখানে আপনার বেশকিছু লেখাও পেলাম। যৌনতা নিয়ে আপনার ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি। ভালো লাগল লেখাগুলো। খুব স্পষ্ট। এলজিবিটি আন্দোলন নিয়ে আপনি বেশ মুখর। বাহ্‌। আপনাকে কুর্নিশ করি। ক-জন সাহস করে নিজের পছন্দের, মানে নিজের যৌনপছন্দের কথা বলতে পারে। আচ্ছা, শাকম্ভরী আপনার আগের স্কুলে কী নিয়ে সমস্যা হয়েছিল একটু বলবেন?’

‘মানে, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। এ প্রশ্ন এখন হঠাৎ করছেন কেন? আমি তো আগেই বলেছি, ওখানে অর্থনৈতিক দুর্নীতি চলছিল। আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম, ওরা তখন আমার ব্যক্তিজীবন টেনে আনে।’

‘আমি আপনার স্কুলে গিয়েছিলাম।’ অনুরাধা ভৌমিক বলল।

‘আমার ওইধরনের লেখাগুলো নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। মানে সমস্যা ক্রিয়েট করা হয়েছিল।’

‘সত্যিই কি তাই— বনানী বলে একটা মেয়ে, বাদ দিন সে আপনার নামে কোনও অভিযোগ করেনি। তারও মত ছিল আপনার সঙ্গে সম্পর্কে। কিন্তু শকুন্তলা তো আপনার নামে স্পষ্ট অভিযোগ করেছিল। শকুন্তলা আপনার কাছে পড়ত। আপনার বাড়ি যেত। আপনার ব্যবহারে ওর আপত্তি ছিল। আপনি ওকে নাকি আদর করতেন। ওর গায়ে হাত দিতেন। ও ওর অস্বস্তির কথা আপনাকে জানায়। তাসত্ত্বেও ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির দিকে নিয়ে যান। তার থেকে বেশিই ছিল। ওকে ভয় দেখান। ওর পরিবার আপনার নামে লিখিত অভিযোগ জানায়— তারপরই আপনাকে নিয়ে গোলমাল শুরু হয়। শকুন্তলাই বনানীর নাম বলে। আর বনানী তো স্বীকার করেছে— আপনার সঙ্গে ওর ঠিক দিদিমণি – ছাত্রীর সম্পর্ক ছিল না।’

‘আপনি কে? আপনি কেন একথাগুলো আমাকে এখানে বলতে এসেছেন? এর সঙ্গে এই কেসের কী সম্পর্ক?’ শাকম্ভরী চাপা গলায় বলল।

আক্কেল বলল, ‘উনি লালবাজারের হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের অফিসার— আমার কাছে কেউ তো ভেঙে বলেনি, অনুরাধা যেতেই গড়গড় করে সবাই সব বলে দিল। আর আমাদের জট খুলে গেল।’

‘আপনারা অহেতুক জটিলতা তৈরি করছেন আক্কেলবাবু। আপনাকে আমি রেসপেক্ট করি। আমার পারসোনাল লাইফ নিয়ে আপনি এভাবে আলোচনা করতে পারেন না।’

‘আলোচনা করতাম না। যদি না এখানে কোনও জট থাকত। যে জট যা পাকিয়েছে, আমি তা খুলব বলে এসেছি। দেখুন না, পর পর পুরোটাই খুলে যাবে। জানেন তো আর একটা জট খুলে ফেলেছি। গিরিধারী সামন্তকে দেওয়া কীটনাশকে কোনও গন্ধ ছিল না। আসলে গিরিবাবুর চায়ে দেওয়া হয়েছিল অরগ্যানো ফসফরাস। নাইজার কোম্পানি যেখানে আপনার ভাই কাজ করে, তাদের তৈরি জিনিসের তালিকায় এই কীটনাশক আছে। যার মূল উপাদান হল অরগ্যানো ফসফরাস। লেখা আছে শুদ্ধ অরগ্যানো ফসফরাস বর্ণ-গন্ধহীন। কৃষকরা যাতে অন্যকিছুর সঙ্গে এই কীটনাশক না গুলিয়ে ফেলে তার জন্য তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ যোগ করা হয়। আপনি বলেছিলেন, আপনার ভাই নাইজারে কাজ করে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখি, আপনার ভাই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়। ল্যাবে কাজ করে। কাল রাতেই আপনার ভাইকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে। সে স্বীকারও করেছে। কোম্পানির ল্যাব থেকে সে চুরি করে এনেছিল অরগ্যানো ফসফরাস। আপনাকে দেওয়ার কথায়ও বলেছে।’

তিয়াসা চিৎকার করে উঠল—‘কী বলছেন?’

‘ঠিকই বলছি।’

‘ম্যাম আপনি এটা কী করলেন?’

শাকম্ভরী উঠে দাঁড়াতে গেল। আক্কেল চাপা গলায় ধমক দিল, চুপ করে বসুন। শীতল পালরা এই দরজার পাশেই আছে আপনাকে নিয়ে যেতে।

তিয়াসা কাঁপা গলায় বলল, ‘তাহলে আমার মা?’

আক্কেল বলল, ‘আমার অনুমান তোমার মা দেখেছিলেন, কাজু বাদাম দিতে এসে চায়ের কাপে শাকম্ভরী ম্যাম কিছু মেশাচ্ছেন। কমলামাসি তখন গিয়েছিল অতিথিদের জন্য কাপ বের করতে। সেই সুযোগটাই তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক তোমার মা কথাটা কাউকেই বলেননি। হয়তো, উনিও ভেবেছিলেন— এই মহান কাজটা ওঁর করার কথা ছিল, তাঁর বদলে আর অন্য একজন করলেন।’

‘এটা আমরা করতে পারতাম। কেন আপনি করলেন?’ তিয়াসা চিৎকার করে উঠল।

‘হ্যাঁ, গিরিধারী সামন্ত যা মানুষ— তাতে তুমি, তোমার মা, বা যে কেউ এ কাজটা করতেই পারতে। তাহলে উনি করলেন কেন?’

‘আমি তোমাকে বাঁচাতে এটা করেছি, তিয়াসা।’ শাকম্ভরী শান্ত গলায় বলল।

অনুরাধা ভৌমিক বলল, ‘ওকে বাঁচাতে, না ওকে একেবারে নিজের করে পেতে? ওই স্কুলে বনানী বলে মেয়েটি তো আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে—। এর মাঝে আপনি একবার কলকাতায় গিয়ে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বনানীই বলেছে। একদিন আপনার কাছে ও ছিল। ওর বাড়ির লোক ওকে আটকাতে পারেনি। ও আত্মহত্যার ভয় দেখিয়েছে বাবা-মাকে। যাক, এবার হয়তো বনানী বাঁচবে।’

শাকম্ভরী ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে— ‘পরিকল্পনা করে আবার আমার নামে আপনারা সব মিথ্যে অভিযোগ আনছেন।’

শান্ত গলায় আক্কেল বলল, ‘আমি জানি না এই ক-মাসে আপনি তিয়াসাকে কতখানি জড়িয়েছেন, সেটা তিয়াসাই বলতে পারবে। শুধু একটা কথাই বলব, ভাইটাকে জড়ালেন কেন? আপনার ঘরে উঁকিমারার রাগটা ভাইয়ের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে অফিসের ল্যাব থেকে চুরি করালেন। আজ সে-ও অপরাধী।’

‘প্লিজ আমার ভাইকে এরমধ্যে জড়াবেন না।’

‘অলরেডি সে জড়িয়ে পড়েছে। নিজের দোষ স্বীকার করেছে। সে না ভাঙলে, আপনাকে আমরা ছুঁতেই পারতাম না। আমার খারাপ লাগছে, ইন্দুলেখা দেবীর জন্য— উনি নীরবে দোষটা মাথায় নিয়ে চলে গেলেন। উনি বুঝেছিলেন, উনি প্যাঁচে পড়ে গেছেন। মুখ ওঁকে খুলতেই হবে। আর মুখ খুলবেন না বলেই উনি চলে গেলেন—।’

‘মা!’ অস্ফুটে কেঁদে উঠল তিয়াসা।

‘এরপরেও আমি তিয়াসাকে বলব— বাবার হাত থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে আমি জানি না তুমি কার হাতে পড়তে চলেছিলে।’ আক্কেল বলল।

‘আমি তিয়াসাকে ভালোবাসি, যা কিছু করেছি সব ওর জন্য করেছি। আমি যদি বলি, ইন্দুলেখাই আমার কাছে ওই বিষ চেয়েছিল। আমি শুধু এনে দিয়েছিলাম—’ শাকম্ভরী দৃঢ় গলায় কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল।

‘একদম মিথ্যে কথা বলবেন না। আর একটা বাজে কথা বললে আমি আপনার গলা টিপে ধরব।’ তিয়াসা গর্জন করে উঠল।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “novel-giridhari-jage-nari

  1. বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। অসাধারণ

  2. বাস্তব চিত্র নিয়ে লেখা উপন্যাসটি লেখক অসাধারণ দক্ষতায় এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একবার শুরু করে থেমে থাকা যায় না। আর শেষটা অভূতপূর্ব। ভাবা যায় না। খুব ভাল লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *