বিনোদ ঘোষাল
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দুপুরে দমকা হাওয়া দিল আর ধু ধু প্লাটফর্মের ওপর ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো সেই হাওয়ার তোড়ে এগিয়ে গেল খানিকটা পথ। কৃষ্ণচূড়া গাছের কয়েক হাত দূরেই রয়েছে আরেকটি রাধাচূড়া গাছ। তার শরীরও এখন হলুদ। লালে হলুদে প্লাটফর্মটা ভরে রয়েছে। লাল সুরকির প্লাটফর্ম। দুই প্রান্তে দুটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা রয়েছে রঙিনপুর হল্ট। স্টেশনের নাম রঙিনপুর। এমন নাম শুনলেই যেকোনও অনুভবী মানুষ প্রেমে পড়ে যাবে। আর কেউ যদি স্টেশনের নাম দেখে ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে পৌঁছে যায় রঙিনপুর গ্রামে, তাহলে সে বুঝবে এই জায়গার এমন নাম সার্থক। রঙিনপুরে সারাবছর রঙ লেগে থাকে।
সারাদিনে এই লাইনে ট্রেন চলে মাত্র চারটে। দুটো এক্সপ্রেস আর দুটো প্যাসেঞ্জার। সকাল সাতটায় একটি আপ প্যাসেঞ্জার ট্রেন এই হল্টে থামে আর সন্ধে সাতটায় একটা ডাউন দাঁড়ায়। আসলে এই জায়গাটা এমনই এখান থেকে কোথাও যাওয়া যায় না, কোথাও পৌঁছনো যায় না। রেলকোম্পানির অলৌকিক দয়ায় এখানে কোনও এক কালে একটি হল্ট স্টেশন হয়েছে ঠিকই তবে তা নামেই স্টেশন। স্টেশনমাস্টার নিতাই মাল সারাদিন বসে ঝিমোন, কখনও এমনই উদাসভাবে বাইরে তাকিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকেন। অবশ্য তার একজন রিলিভার রয়েছেন সুজন রাই। বিহারি ছেলে। সে আবার সর্বক্ষণই বেজায় অসুস্থ। মাঝেমাঝেই লম্বা ছুটি নিয়ে সাউথে ট্রিটমেন্ট করাতে যায়। আর পোর্টার হারু, দিনের বেশিরভাগ সময় দেশি মদ খেয়ে এখানে ওখানে পড়ে থাকে। ডিউটিতে আসে কখনও সখনও। ফলে বাস্তবে নিতাইবাবুকে একাই এই স্টেশন সামলাতে হয়। অবশ্য সামলানোর তেমন কিছুই নেই। দিনের মধ্যে কয়েকবার রেল কোম্পানির কন্ট্রোলফোন এ্যাটেন্ড করা আর ট্রেন এলে সিগনাল ক্লিয়ার দেখানো ব্যাস, কাজ শেষ। তিনি কবে তার ট্রান্সফার অর্ডার আসবে তার আশায় দিন গুনতে থাকেন। আর মাঝেমাঝে হাঁক দেন ও নবীন…নবীইইইন, চা খাবে নাকি?
নবীন তখন প্ল্যাটফর্মের কাঠের বেঞ্চে শুয়ে বা বসে থাকলে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে ওঠে জয় নিতাই হরিবোল হরিবোল। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় স্টেশনমাস্টারের ঘরে। নিতাইবাবু ততক্ষণে চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছেন। নিতাইবাবুর সুগার রয়েছে তিনি চায়ে চিনি-দুধ কিছুই খান না, গরম জলে স্রেফ এক চামচ সিটিসি পাতা। ওতেই চা তৈরি। নবীনও ওই চায়েতেই অভ্যস্ত। নিতাইবাবুর এখানে প্রায় দুইবছর হয়ে গেল আর নবীন রয়েছে বছর খানেক। ওরা দু’জন একে অপরের বন্ধু। নিতাইবাবুর জন্য নবীন আর নবীনের জন্য নিতাইবাবু। নিতাইবাবু আর নবীনের মধ্যে বেশ কিছু মিল রয়েছে তবে সবচেয়ে বড় মিলটি হল দু’জনেই গান-পাগল। নিতাই মাল কীর্তন গাইতে ভালবাসেন আর নবীন গায় বাউলাঙ্গের গান, কীর্তনও জানে। দুজনে গান গেয়ে সময় কাটায়। আর সময় কাটে খেলে।
সকাল সাতটায় একটি ট্রেন এসেছিল আবার সন্ধে সাতটায় ট্রেন আসবে, তারপর শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক। রাত ন’টা নাগাদ নিতাইবাবু হাঁক দেন ও নবীন!
নবীন এসে হাজির হয়। নিতাইবাবু খানিক ভাত তরকারি যাইই বানান তার থেকে নবীনকে কিছুটা দেন। নবীন সেইটুকু চেটেপুটে খেয়ে আবার চলে যায় প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চিতে শুতে।
এইভাবেই দিনের পর দিন মাসের পর মাস চলছে।
নবীন এসে বসল নিতাইবাবুর ঘরের মেঝেতে। প্লাটফর্ম থেকে নেমে বিশ কদম গেলেই স্টেশনমাস্টারের ঘর। ওটাই টিকিটকাউন্টার। অবশ্য টিকিট কেনা-বেচা আর হয় কই? সকাল সাতটা নাগাদ কয়েকজন আসে প্ল্যাটফর্মে, কেউই টিকিট কাটে না, কারণ তারা সকলেই ট্রেনে ওঠে সারাদিন ভিক্ষা করবে বলে। শুধু হাত পেতে ভিক্ষা নয়, গান গেয়ে ভিক্ষা করে তারা। এই রঙিনপল্লিতে যে কয়ঘর মানুষ আছে তারা শুধুই গান করে। গানই তাদের জীবিকা। কেউ ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করে কেউ আবার পালা কীর্তনের দলে রয়েছে, কেউ শখের বাউল। রঙিনপুর এমনই এক জায়গা সেখানে সবাই সুরের রসে ডুবে থাকে। তাদের চাষজমি নেই, গোলায় ধান নেই, গরু-ছাগল নেই, তবে হাঁস-মুরগি আছে। স্টেশন থেকে নেমে কোনও রিকশা বা ভ্যান কিছুই পাওয়া যায় না, কারণ এখানে বাইরের কেউ আসে না। কেনই বা আসবে? কী আছে এখানে? যতদূর চোখ যায় শুধু বিরান। গাছগাছালি কিছু আছে। দুটো পুকুরও আছে, বাকি আর রয়েছে রুখাসুখা জমি আর মাথার ওপর চওড়াছাতিওলা আকাশ।
নিতাইবাবু নবীণের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বললেন, আজ মনে হয় সন্ধের দিকে বিষ্টি হবে, কী বলো?
নবীন চায়ের কাপে চুমুক দিল। কিছু বলল না।
নিতাইবাবু নবীনের উত্তর না পেয়ে কিছু মনে করলেন না, আসলে দিনের পর দিন এই দুজন মানুষ এত কথা বলেছে যে ওদের বিশেষ আর কথা বাকি নেই, তাই কেউ কারও কথার উত্তর না দিলেও কিছু এসে যায় না।
ঘরের কোনে ভাতের হাঁড়ি রাখা। নবীন বুঝল নিতাইবাবু এখনও ভাত খাননি।
নবীনের মনের কথা নিতাইবাবু বুঝে গেলেন। বললেন, আজ তেমন খিদে পাচ্ছে না, পেটটা ভার হয়ে আছে সকাল থেকে। ভাতটায় ভাবছি জল ঢেলে রাখি, রাতেই খাব। তুমি খাবে নাকি একটু?
চা খাচ্ছি যে।
সে খাও না, চায়ের পর ভাত খেলে ক্ষতি কী?
নবীন ওর ঘন গোঁফ-দাড়ির ফাঁক থেকে দাঁত বার করে মৃদু হাসল, তারপর বলল জয় নিতাই জয় নিতাই!
নিতাইবাবু মৃদু হাসলেন। বললেন, চা টা খেয়ে নাও তারপর ভাত দিচ্ছি।
নবীনের আসলে খিদে-তেষ্টা বরাবরই খুব কম। ও একটানা দুইদিনও কিচ্ছুটি না খেয়ে দিব্বি কাটিয়ে দিতে পারে। খেলেও হয় না খেলেও হয়। একবেলা নিতাইবাবু দেন, আর সকালে যে দুই-একজন রঙিনপল্লীর যাত্রী ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে আসে তাদের কেউ না কেউ নবীনের জন্য মুড়ি অথবা খানিকটা ভাত এনে দেয়। জীবনে নবীনের কোনও চাওয়া নেই। ওর সম্পত্তি বলতে একটি একতারা। ব্যাস।
বুঝলে নবীন, জীবন বড় বিচিত্র। আপনমনেই বললেন নিতাইবাবু। মাথায় কয়েকগাছি মাত্র কাঁচা-পাকা চুল। পাঁচফুটের বেশি হাইট নয়। রোগা-দুবলা চেহারা। মাঝেমাঝে দাড়ি কামান। গালে বেশিরভাগ সময়েই বিজবিজে সাদা দাড়ি থাকে। সর্বসাকুল্যে খান তিনেক শার্ট আর প্যান্ট। নবীনের যেমন চালচুলো কিছুই নেই, মাথার ওপর ছাদ বা ব্যাঙ্কে টাকা কিছুই না, নিতাই মণ্ডলের কিন্তু পাকা সরকারি চাকরি, ব্যাংকে টাকা রয়েছে, কিন্তু ঐটুকুই। মাইনের টাকা প্রতিমাসে এ্যাকাউন্টে জমা পড়ে ঠিকই কিন্তু সেই টাকার ব্যাপারে নিতাই মালের কোনও মাথাব্যথা নেই। জীবনে চাহিদা তার বড়ই কম। মাসে ঠিক একদিন নিতাই মাল সকালের ট্রেনে চেপে চলে যান এই রঙিনপুর থেকে সাত মাইল দূরের স্টেশন দাসপাড়া রেলস্টেশনে। দাসপাড়া মোটামুটি জনবহুল। ব্যাংক, পোস্টঅফিস বাজার-দোকান সবই আছে। ওখানে নেমে তিনি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলেন তারপর সারামাসের মুদি-টুকিটাকি যা দরকার তা একবারে কিনে একটা ভ্যানরিকশা ভাড়া করে দুপুরের ট্রেন রঙিনপুরে পৌঁছনোর আগেই চলে আসেন। ব্যাস। আরও একটা কাজ তিনি করেন, মোবাইলটি রিচার্জ করিয়ে নেন। যদিও নিতাইবাবুর ফোনটি মান্ধাতার আমলের বোতামটেপা ফোন। ইন্টারনেটের কোনও বালাই নেই, আর রঙিনপুরে মোবাইলের টাওয়ারও নেই। নিতাইবাবু ওসবের ধারও ধারেন না। ওর টিভি ইন্টারনেট বইপড়া কোনও শখই নেই, শখের মধ্যে শুধু দুইটি। একটি হল গান আর আরেকটি শখ বড়ই অদ্ভুত। তা শুধু নবীনই জানে।
নবীন আর নিতাইবাবু চা শেষ করলেন। কয়েকদিন ধরে বিশ্রী গরম পড়েছে। রঙিনপুর রাঢ় অঞ্চলে, এখানে গরমকালে তীব্র গরম পড়ে আর শীতে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। নবীনের ঠান্ডা-গরমের অনুভব বিশেষ নেই, জীবনের অনেকটা সময় পথে-ঘাটে থাকতে থাকতে সবরকম আবহাওয়া সহ্য হয়ে গেছে। শরীরও বিশেষ খারাপ হয় না।
নবীন, আজ চান করলে আরাম পাবে। করবে নাকি?
নাহ থাক। দাড়ি চুলকে বলল নবীন। ওর দাড়ি বেশ লম্বা। চুলও কাঁধ ছাপিয়ে গেছে। বয়স তিরিশ পার করেছে কিন্তু দেখে তিরিশ না চল্লিশ তা বোঝা যায় না। অযত্নের ফলে চেহারা দড়িপাকানো চুল রুক্ষ। নবীনের গায়ের রঙ ঝলসানো গাছের মত। ওকে দেখলে বোঝা যায় শরীরে কোনও রোগ নেই। নবীন যখন খোলা গলায় গান ধরে তখন গলার শির মোটা কেঁচোর মত কিলবিলিয়ে ওঠে।
আমার মা বলতেন রোজ চান করলে শরীর ঠান্ডা থাকে, আর ওতে মন শুদ্ধ হয়। বলতে বলতে নিতাইবাবু হাঁড়ি থাকে খানিকটা ভাত থালায় ঢাললেন। ভাতের মধ্যে একটা আলু আর একটা ডিমসিদ্ধ ছিল, দুটোই থালার একপাশে রেখে, শিশি থেকে একটু ঘি ঢালতে গিয়েও দিলেন না, শিশিটা আবার রেখে দিয়ে, সামান্য নুন আলুর ওপর ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, খেয়ে নাও, নবীন।
নবীনের হাত-মুখ ধোওয়ার বালাই নেই। গপাগপ খেতে শুরু করল। ঘরে একটা সিলিংফ্যান ঘুরে চলেছে। ওতে হাওয়া কম শব্দ বেশি।
নিতাইবাবু নবীনের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন, নবীনের চোখে-মুখের গরম ভাতের তৃপ্তি ফুটে উঠছে দেখে তিনি এই মওকায় বলে ফেললেন, নবীন অনেকদিন আমাদের খেলা হয় না, আজ হবে নাকি?
হাতের দলা ধরা হাত থেমে গেল নবীনের। তারপর কোনও উত্তর না দিয়ে আবার আপনমনে খেতে থাকল।
দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে কী খেলা হতে পারে? তাস, দাবা? জুয়া? ক্যারাম? না নবীন আর নিতাই মাল মাঝেমাঝে এক ভয়ংকর খেলা খেলে, তা শুধু জানে ওরা দু’জন এবং এই শূন্য রঙিনপুর।
# # #
আজ সকালের ট্রেনটা ঢুকল কুড়ি মিনিট লেট করে। নবীন অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকার অভ্যাস তার কোনওকালেই নেই। ঘুম থেকে উঠেই প্লাটফর্মের শেষপ্রান্তে টিউকল থেকে পেট ভরে জল খায় তারপর যায় পায়খানা করতে। ফাঁকা জায়গার কোথাও একটা বসে পড়ে। তারপর ফিরে এসে ওর একতারাটা হাতে নিয়ে শুরু করে গান। আপন মনে একের পর এক গান করতে থাকে। আজও তাই করল। এই ট্রেনটা যখন রঙিনপুরে এসে থামে তখন যে কয়জন যাত্রী নামে তারা সকলেই গাইয়ে বাজিয়ে। কেউ গেছিল পালা কীর্তনের আসরে, কেউ বা যাত্রাদলে। তাদের কারও পিঠে হারমোনিয়াম বা শ্রীখোল কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকে। আর যারা ট্রেন ধরে তাদেরও বেশিরভাগ ওই গানের আসরেই যায়। বিশেষ বিশেষ মাসগুলিতে পালা কীর্তনের ডাক আসে বেশি।
আজ ট্রেন থেকে নামল ব্রজগোপাল আর ওর স্ত্রী মুক্তারানি। ওরা দুজনেই গান করে। মুক্তার গলায় যেন সাক্ষাৎ মা সরস্বতী বিরাজ করেন, এত মধুর কন্ঠ। আর ব্রজগোপাল শ্রীখোল বাজায়।
ট্রেনটা দাঁড়াল ঠিক কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপরেই হুইসেল দিয়ে চলে গেল। মুক্তা আর ব্রজগোপাল দুজনেই পান খায়। দুজনেই খুব রসিক। নবীনকে দেখে মুক্তা একগাল হেসে বলল কী গো নবীনঠাকুর, একটা পান খাবে নাকি?
নবীন সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠল-
ললিতা বিশাখা সঙ্গে সেবন করিব রঙ্গে
মালা গাঁথি দিব নানা ফুলে
কনক সম্পুট করি কর্পুর তাম্বুল পুরি
যোগাইব অধর-যুগলে
আহা হরিবোল, হরিবোল বলে উঠল ব্রজগোপাল। নবীনঠাকুরের কাছ থেকে এবারে কীর্তন না শিখলেই নয়। কিছু লীলা আমাকেও দাও, গো।
নবীন বলল আমি ভিখিরিমানুষ আমার আছে কী যে দেব?
ব্রজগোপাল বলল, তা বললে হবে না নবীনঠাকুর। তোমার ঝুলিতে যা পদ রয়েছে তার খানিক পেলেও আমরা উতরে যেতাম গো, দাদা।
মুক্তারানি ওর ঝোলা থেকে স্টিলের চৌকো কৌটো থেকে অতি যত্নে বার করল একটি সাজানো পান। সেটা নবীনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল নাও গো, নবীনঠাকুর, পান খাও। তোমার দাদার অনুরোধ তো তুমি রাখবে না, কত করে তোমাকে বলি আমাদের দলে এসো। কিন্তু এই রঙিনপুরের প্ল্যাটফর্মে যে কী মধু পেয়েছ তুমি এখান থেকে আর নড়বে না।
নবীন হেসে বলল আমি হলাম রঙিনপুরের পাহারাদার। আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে যেন কোনও বেরসিক অসুর রঙিনপুরের সুরের আঙিনায় না ঢুকে পড়ে তাই সারাদিন বসে থাকি।
এই শূন্যপুরীতে অসুর-দেবতা কেউ কখনও আসবে না গো, ঠাকুর। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। বলে শরীর দুলিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মুক্তারানী। ওর কপাল আর সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর গোটা রাত জাগার ফলে খানিক অবিন্যস্ত। চোখদুটি ছলছলে, রক্তাভ।
নবীন দেখল মুক্তারানির সেই হাসিটিও যেন আস্ত একটা শরীর হয়ে উঠেছে-
ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি অবনী বহিয়া যায়।
ঈষৎ হাসির তরঙ্গহিলোলে মদন মূরছা পায়।
নবীনের গলায় এই দুই কলি শুনে আবারও ব্রজগোপাল হরিবোল হরিবোল বলে উঠল আর মুক্তারানী পানের রসে রাঙা ঠোঁটদুটি প্রসারিত করে আবারও শরীরে কাঁপন ধরিয়ে হেসে উঠল।
নবীন পান মুখে দিয়ে চিবোতে থাকল।
যাই নবীন, আচ্ছা শোনো পরশু আসছ তো অষ্টপ্রহরে?
হ্যাঁ যাব।
চলে এসো। যাই তাহলে রাধে রাধে!
নবীনও বলল রাধে রাধে।
মুক্তারানি বলল যাই গো নবীনঠাকুর। পরশু তোমার গান শুনব প্রাণভরে।
নবীন মাথা ঝাঁকাল।
ওরা দুজন চলে গেল। ওদের চলে যাওয়ার দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে রইল নবীন। রঙিন দৃশ্যটা ধীরে ধীরে সাদা-কালো হতে শুরু করল, ও দেখল বহুদিন আগের একটা দৃশ্য। একটা ঘিঞ্জি বস্তির ঘর। ঘরের সামনে এক বারো বছরের বালক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার নাম হারু মণ্ডল। পরনে ময়লা স্যান্ডোগেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। তার চোখে টলমল করছে অশ্রু, গালে শুকিয়ে রয়েছে জলের ধারা। সে দেখছে তার মা চলে যাচ্ছে। সনাতনকাকুর সঙ্গে মা চলে যাচ্ছে! ছেলেটি বিশ্বাসই করতে পারছে না, মা তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। চলে যাওয়ার আগে মা ছেলেটির কপালে চুমু খেয়ে শেষবারের মত নিজের বুকে জাপটে ধরে বলেছে আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা, আমি তোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারলাম না, আমি ভাল মা নই, কিন্তু আমি তোকে ভালবাসি। তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস বড় হয়ে এখান ছেড়ে পালাস বাবা। আর গানটা ছাড়িস না, তুই একদিন অনেক বড় গায়ক হবি। আমার হারমোনিয়ামটা তোকে দিলাম, ওটাকে আগলে রাখিস, বলে মা চলে গেল। হারু তাকিয়ে দেখছে। মা গলির শেষমুখে তারপরেই আর মাকে কখনও দেখতে পাবে না, হারু একবার পিছন ফিরে ঘরের ভেতরে দেখল। আধো অন্ধকার ঘরের ভেতর বাবা নামের একটা কংকাল হয়ে যাওয়া শরীর চৌকির ওপর লেটকে পরে রয়েছে, অচেতন। ঘরের ভেতর বমির টক গন্ধ। মেঝেতে উলটে পড়ে রয়েছে দেশীমদের খালি বোতল আর বমি। হারুর মনে হল মাকে ছাড়া এই নরকে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না। ঘর ছেড়ে সে দৌড়ল মা মা চিৎকার করতে করতে। ততক্ষণে গলির মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে ওর মা। হারু প্রাণপণে দৌড়ে যখন গলির মোড়ে পৌঁছল, দেখল মেইন রাস্তায় মা আর সনাতনকাকু বাসে উঠছে। হারু চিৎকার করে উঠল, মা আ আ আ বলে। মা একবার পিছন ফিরে ছেলেকে দেখে থমকে গেল। সনাতনকাকু মাকে এক ঠেলা দিয়ে বাসে তুলে দিয়ে নিজেও উঠল। আর বাসটা ছেড়ে দিল, বাসের পিছনে লেখা ‘৮০ বন্ধু আবার দেখা হবে’।
হারু একবার ভাবল বাসের পিছনে ছুটবে। কিন্তু গেল না। ওর ভেতরে কান্না গজরাচ্ছে, দুঃখকে ছাপিয়ে উঠছে রাগ। বঞ্চনার কষ্ট আগ্নেয়গিরির লাভার মত ফেটে বেরোতে চাইল ওর ভেতর থেকে। ইচ্ছে করল একটা মশাল হাতে নিয়ে গোটা পৃথিবীটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে।
হারু দাঁড়িয়ে রইল। নিঃশ্বাস দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। রাগের সঙ্গে প্রচণ্ড একটা ভয় ওকে জড়িয়ে ধরছে। মাকে ছাড়া ও কীকরে বাঁচবে? কে খেতে দেবে ওকে? স্কুলে যাবে কীভাবে? কে গান শেখাবে? বাবা তো মানুষ নয়, মাতাল, পকেটমার। মাঝেমাঝেই পুলিশে ধরে নিয়ে যায়, হাজতে থাকে। কখনও পাবলিকের মারধোর খেয়ে চোখমুখ ফাটিয়ে ঘরে ঢোকে। হাতে মদের বোতল। এসেই মায়ের ওপর চোটপাট মারধোর, কখনও ছেলেকেও দুই ঘা দিয়ে দেয়। বাইরের রাগ ঘরে এসে ঝাড়ে। হারু জ্ঞান হওয়া ইস্তক এমন অবস্থা দেখে বড় হয়েছে। ঘরের ভেতরে ওর অসহ্য লাগত, একমাত্র মুক্তি ছিল মা আর গান। মায়ের একটা হারমোনিয়াম আছে, অনেক পুরনো। মা বিয়ের পর তার বাপের বাড়ি থেকে এটা এনেছিল। বাবা অনেকবার সেই হারমোনিয়াম বিক্রি করে মদ কেনার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি, ওই হারমোনিয়ামে হাত দিলেই সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করা মা আচমকাই বাঘিনির মত ফুঁসে উঠত। হারমোনিয়ামটাকে নিজের সন্তানের মত দুইহাতে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে বলে উঠত খবরদার তুমি এটায় হাত দেবে না, আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দিয়েছি, কিন্তু এটা আমি তোমাকে ছুঁতে দেব না।
বাবা থমকে যেত। একবার জোর করে কেড়ে নিতে গেছিল মা বাবার হাতে এমন কামড় দিয়েছিল সে মাংস বেরিয়ে গেছিল হাতের। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য। বাবা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আর মায়ের মুখময় বাবার রক্ত লেগে। হারু ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। অভিশপ্ত একটা জীবন কাটাচ্ছিল হারু। মা এমনিতে কিন্তু মাটির মানুষ, কোনও অভিযোগ নেই, পালবাজার বস্তির আর পাঁচজন মাসি-পিসি-কাকিমাদের মত ছিল না। চুপচাপ, নিজের মনে থাকতেই ভালবাসত। মায়ের জীবনে কোনও চাহিদা ছিল না, একটাই শখ ছিল গান। মায়ের একটা গানের খাতা ছিল, সেখানে অনেক গান স্বরলিপি সমেত লেখা ছিল। মা মাঝে শাড়ির ফলস পাড়, পিকো, ব্লাউজ বানানোর কাজ শুরু করেছিল। অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়ে একটা রেডিও কিনেছিল, ওটার সঙ্গে মা প্রায় সারাদিন থাকত। গান শুনত। কিন্তু বাবা সেটা একদিন নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে মদ খেয়ে নিল। তারপর মা আর রেডিও কেনেনি। শুধু হারুকে একবার বলেছিল, হারু তুই বড় হয়ে যখন চাকরি করবি তখন আমাকে একটা রেডিও কিনে দিস।
হারু বলেছিল দেব মা। কিন্তু মা অপেক্ষা করল না, হারু বড় হওয়ার আগেই সনাতনকাকুর সঙ্গে চলে গেল। হারুর কথা ভাবল না! হারু ভেবেছিল মা ওর একমাত্র আশ্রয়, মা ওকে ছেড়ে থাকতেই পারবে না, ঠিক পরেরদিন মা চলে আসবে, হারু অপেক্ষা করল, আরও অপেক্ষা করল, একদিন- দুইদিন-পাঁচদিন-সাতদিন…মা এল না। হারুর কষ্টটা যেমন তীব্র হচ্ছিল ভেতরে জমাট বাঁধছিল আরও আরও ঘৃণা। মা ওর ভেতরে গান ভরে দিয়েছিল, তাই নিজের মনকে শান্ত করার জন্য হারু গান গাইত। মায়ের ডায়েরিটা খুলে হারমোনিয়ামের ওপর বসিয়ে হারু নতন নতুন গান তুলত। ডায়েরিতে অনেকরকমের গান লেখা ছিল, আধুনিক থেকে কীর্তন, বাউল। এতগানের মধ্যে বাউল আর কীর্তন গান হারুকে বেশি টানত। দেহতত্ত্বের ওই আলো-আঁধারি ইঙ্গিত ওকে আকর্ষণ করত। কিছু বুঝত, বেশিরভাগটাই থাকত না বোঝা। আর ওই না বোঝাটাই হারুকে টানত বেশি। হারু নিজেকে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে ফেলছিল মা আর ফিরবে না। এই বোঝানোর পালা যখন চলছিল তখন ওকে সবথেকে বেশি সাহায্য করছিল গান। এই সংসার যে আসলে একটা মায়া, সংসারে আসলে কেউ কারও নয় সেটা উপলব্ধি করছিল। বাবা আর ও একটা ঘরের মধ্যেই থাকছিল। কেউ কাউকে ঘাঁটাত না, কেউ কারও খবরও রাখত না, কথাও বলত না। তবে মা চলে যাওয়ার পর বাবা তার জীবনে একটা পরিবর্তন এনেছিল, সেটা হল একবেলাও হারুকে অভুক্ত রাখেনি। নিজে রান্না করত না ঠিকই, কিন্তু বস্তির মুখে যে পাঁচুদার ভাতের হোটেল রয়েছে সেখানে খেয়ে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মা চলে যাওয়ার পরদিন দুজনের কেউ কিছু খায়নি, তারপর বাবা বলল, শোন হারু, তোর মা চলে গেছে তো কী হয়েছে আমি তো আছি, তুই পাঁচুর দোকানে গিয়ে সকালে আর রাতে খেয়ে আসবি। আমি টাকা দিয়ে দেব। যা মন চায় তাই খাবি।
পাঁচুর হোটেলে অবশ্য যা মন চায় তা খাওয়ার উপায় নেই। এই বস্তির বেশিরভাগ লোকেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। বিচিত্র পেশা তাদের। শুধু পুরুষ নয় এই বস্তির অধিকাংশ মহিলাও নানারকম কাজ করে। বসে খাওয়ার লোক খুব কম। জীবন এখানে অনেক কঠিন। তবু তারমধ্যেও ঝগড়া হয়, ভালবাসা হয়, বিচ্ছেদ হয়, উৎসব হয়, মারামারি হয়। বস্তির সব খবর রাখে পাঁচু। ওর হোটেলে সকালে পাঁউরুটি ঘুগনি, আলুর দম আর চা, দুপুরে ভাত, ডিমের ঝোল আর রাতে রুটি-তরকারি ব্যাস এই মেনু। ভাতের সঙ্গে থাকে ট্যালটেলে ডাল, একটা লাবড়া। অবশ্য পেট ভরানোর জন্য যথেষ্ট। হারুর তখন বেড়ে ওঠার বয়স। পেটে প্রবল খিদে। যা পেত তাইই গোগ্রাসে গিলত। কোন খাবারের কী স্বাদ তা নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না। বস্তিতে অনেকেই জানত হারু ভাল গান গায়। গড়পড়তা মানুষের গানের প্রতি সহজাত আকর্ষণ থাকে। প্রায় প্রতিটি মানুষই নিজের খেয়ালে বা বেখেয়ালে কখনও না কখনও একবার-দুবার কোনও গান গুনগুনিয়ে উঠবেই। আর বাউল-কীর্তন এই গান সাধারণ মানুষকে টানে বেশি। মাটির গন্ধ আছে বলেই মাটির খুব কাছে থাকা মানুষগুলো এইসব গানে বেশি তৃপ্তি পায়। হারুকে পাঁচু মাঝেমাঝে বলত, হারু রে একটা গান শোনা।
হারু জিজ্ঞাসা করত, কী গান?
তোর যা খুশি।
হারু কখনও গাইত লীলাকীর্তন কখনও বাউল। হোটেলের বাকি খদ্দেররাও খাওয়া ফেলে চুপ করে হারুর গান শুনত। হারু গাইত চোখ বন্ধ করে। উঁচু স্কেলে ওর কোনও অসুবিধাই হত না, মাছ যেমন জলের মধ্যে মনের আনন্দে সাঁতার কাটে হারু তেমন সুরের মধ্যে ঘুরত। একই গানকে ও প্রতিবার নতুন নতুনভাবে আবিষ্কার কত। হারু বুঝতে পারত মায়ের পর ও একমাত্র গানকেই ভালবাসে, মা চলে যাওয়ার আগে ওকে গান দিয়ে গেছে। পাঁচু সবাইকে বলত ছেলেটা ওর বাপের মত অমানুষ হবে না। সুযোগ পেলে বড় আটিস হবে।
হারুর এই বস্তিতে কয়েকজন বন্ধু ছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল বুলু। বুলুর বাবা ছিল কলমিস্তিরি। বাবার সঙ্গে বুলুও প্রতিদিন কাজে বেরোত। সন্ধের পর ফিরে এলে বুলু আর হারু আড্ডা দিত। বুলু গাইতে পারত না, কিন্তু ওর সহজাত তালজ্ঞান ছিল। বুলুর স্বপ্ন ছিল পুলিশ হওয়ার। বস্তিতে প্রতিবছর বড় করে বিশ্বকর্মাপুজো হত, পুজোয় বুলু চমৎকার ঢাক বাজাত। শুনলে মনে হত ও বুঝি কোনও ঢাকির ছেলে। হারু কখনও গাইলে বুলু সঙ্গে বাজাত টিনের কৌটো। একবার একটা টিনের কৌটো ফুঁটো করে সরু তার বেঁধে হারুকে একটা একতারা বানিয়ে দিয়েছিল বুলু। চমৎকার আওয়াজ হত সেটায়। বুলু বলত তুই গানটা ছাড়িস না হারু, একদিন বড় গাইয়ে হবি। নব গাইয়ে হওয়ার স্বপ্ন দেখত না ঠিকই কিন্তু গান ছাড়া ওর জীবনে আর কোনও অর্থ ছিল না। বাবা বেরিয়ে যেত সকালে। ফেরার কোনও ঠিক-ঠিকানা থাকত না, কখনও এতই মদ খেয়ে ফেলত পথে-ঘাটেই উলটে পড়ে থাকত। মা চলে যাওয়ার পর বাবা আরও বেপরোয়া হয়ে গেছিল। একদিন বুলুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাতে পাঁচুর দোকান থেকে খেয়ে ঘরে ফিরে হারু দেখল খাটের তলায় ওর মায়ের হারমোনিয়ামটা নেই। বুকের ভেতরে যেন আচমকা ঝড় উঠল। কোথায় গেল হারমোনিয়ামটা। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকল। বাবা এসেছিল ঘরে? হয়ত এসেছিল কিন্তু এলেও ওই হারমোনিয়ামে হাত দেবে না, তাহলে…???
ঘরের বাইরে বেরিয়ে হারু আগে ছুটল বুলুর কাছে। বুলু আমার হারমোনিয়ামটা পাচ্ছি না রে! আর্তনাদ করে উঠল হারু।
বুলু আর হারু মিলে বস্তির এদিক থেকে ওদিকে ছোটাছুটি করতে থাকল। শেষে বুলু বলল, ওটা মনে হচ্ছে বস্তিতে নেই।।
কে নেবে বল?
তোর বাবাকে জিজ্ঞাসা কর।
হারু ঘরে ফিরে এসে অপেক্ষা করতে থাকল বাবার জন্য। বাবা ফিরল অনেক রাতে টলতে টলতে। হাতে আবার একটা চাউমিনের প্যাকেট। হারুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল এই নে চাউমিন খা।
হারু সেটা না ছূঁয়েই জিজ্ঞাসা করল আমার হারমনিয়ামটা কোথায়?
বাবা চুপ।
হারমোনিয়ামটা কোথায়? আবারও জিজ্ঞাসা করল হারু।
আমি কী করে জানব? ওসব ফালতু জিনিসে আমি মুতিও না।
ওটা আমার মায়ের হারমোনিয়াম। কোথায় নিয়ে গেছ তুমি? কোথায় বেচেছ?
হুহ মা! শালা খানকি মাগি, তোর পোঁদে লাথ মেরে কেমন নাং এর এর সঙ্গে চলে গেল…মা!
হারু ওর বাবার কথা শেষ করতে দিল না। খাটের তলা থেকে হাতুড়িটা বার করল। কিছুক্ষণ পর জামা-প্যান্ট বদলে ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল। গলির মুখে বুলুর সঙ্গে দেখা। কী রে পেলি?
না।
কোথায় যাচ্ছিস?
জানি না, বলে হারু হন হন করে এগিয়ে একটা বাসে উঠে পড়ল। বুলু হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
# # #
এতক্ষণের সাদা-কালো ছবিটা ধীরে ধীরে আবারও রঙিন হয়ে উঠল নবীনের চোখে। বিকেল নামছে। এই সময়টা ভারি মনোরম। আকাশের রঙ বদলাতে থাকে। রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাওয়া বইতে শুরু করে। নবীনের তখন গান পায়। প্রথমে গুনগুন করে তারপর খোলা গলায় গান শুরু করে। হাওয়ার সঙ্গে গান ভেসে ভেসে যায়।
নবীন গান ধরল-
মনের কথা বলব কারে।
মন জানে আরে জানে মরম
মজেছি মন দিয়ে যারে।
একতারার সঙ্গে নবীনের কন্ঠ মিলেমিশে একাকার। নবীন গাইতে গাইতে এমন ডুবে যায় সেই গানের ভেতর যে ওর আর কোনও হুঁশ থাকে না। আজ এত বছর পরেও নবীনের মাঝেমাঝেই মনে পড়ে মায়ের মুখখানি। মায়ের চোখদুটি আধবোজা, তেলচুপচুপে কালো চুল খোঁপা করা। সিঁথিতে আর কপালে দগদগে সিঁদুর। মা আর বাবার মধ্যে আন্তরিক ঘৃণার সম্পর্ক ছিল কিন্তু মা কোনওদিন সিঁদুর আর শাঁখা-পলা ছাড়েনি।
মনের তিনটি বাসনা
নদীয়ায় করব সাধনা
নইলে মনের বিয়োগ যায় না
তাইতে ছিলাম এ হাল মোরে…
নবীন যখনই গান করে ওর মনে হয় মা যেন সামনে এসে বসেছে। প্রথম লাইনটি মা গাইছে দ্বিতীয়টি ও। প্রতিটি সুর যেন মা তুলে দেয়। আচ্ছা এতগুলো বছর হয়ে গেল নবীনের বয়স এখন তিরিশ পার করেছে অথচ মনের ভেতর থেকে মা-কে মুছে ফেলা গেল না! মা কি এখনও সনাতনকাকুর সঙ্গেই থাকে? নিশ্চয়ই বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছে। তারা সব নবীনের ভাই-বোন, তারা কোনোদিন জানবেই না তাদের একজন দাদা আছে পৃথিবীতে।
যে দায়ের দায় একা মোর মন
রসিক বিনে বুঝবে কোনজন
গৌর হয়ে নন্দের নন্দন
লালন কয় তাই বিনয় করে।
কতদিন হয়ে গেল নবীন পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, প্রতিবার ওকে অচেনা জায়গা খুঁজে বার করতে হয়, সেখানে কিছুদিন থাকে তারপর আবার চলে যেতে হয় সেখান থেকে। উপায় নেই। বাড়িছুট হওয়ার পর আজ পর্যন্ত প্রায় দশ-পনেরো বার ঠাঁই বদল করেছেন নবীন। তা শুধু এই রাজ্যেই নয়, ভিনরাজ্যেও আস্তানা গেড়েছে। তারপর আবার ছুট। গানের টানে নয়, প্রাণের দায়ে। কারণ, নবীন যেমন সুরকে খোঁজে তেমনই বহুদিন ধরে পুলিশ খোঁজে নবীনকে, সেই কথা কেউ জানে না। আর সেইজন্যই নবীন কখনও গোঁফদাড়ি কামিয়ে পবন গোঁসাই, কখনও গোঁফদাড়ি রেখে নবীন। বাংলার তো বটেই ভারতের বহুপ্রান্তে ঘুরেছে নবীন, অনেক বাউল-ফকির-কীর্তনীয়ার সঙ্গ করেছে। কিন্তু কোথাও স্থায়ীভাবে থাকতে পারেনি, কখনও আবার ঘটিয়েছে অঘটন কখনও বা আগাম বিপদ বুঝেই পালিয়েছে সেখান থেকে। তবে এই রঙিনপুর সবথেকে নিশ্চিন্তির জায়গা। এখানে বাইরের কেউ আসে না, হয়ত বাকি জীবনটুকু এই প্লাটফর্মে শুয়ে বসে, গান গেয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে এল, তারপর রাত। শেষট্রেনটা এসে থামল প্ল্যাটফর্মে। কয়েকজন নামল। সকলেই নবীনের চেনা। কারও পিঠে হারমোনিয়াম কারও দোতারা, কারও শ্রীখোল। অন্যকাঁধে ঝোলা। একে অপরকে জয়গুরু সম্বোধন করে প্ল্যাটফর্মের মৃদু আলো ছেড়ে অন্ধকারে মিশে গেল। আকাশে একে একে ফুটে উঠল তারা। ঝিঁঝির ডাক শুরু হল। নবীন বসে রইল চুপ করে। ওর নিজস্ব সম্পত্তি বলতে একটা একতারা ছাড়া রয়েছে একটা পুঁটুলি, সেটায় একটা ময়লা গামছা, একটা কম্বল আর একটা লুঙ্গি এবং গেঞ্জি। আর ঝেরেঝুড়ে দেখলে কিছু খুচরো টাকা পাওয়া যেতে পারে। নবীন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল। দীর্ঘবছর ধরে খড়কুটোর মত ভাসতে ভাসতে জীবন কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে। তবে নবীন একটা জিনিস বোঝে ও নিজেকে চেনে না, ওর ভেতরে যেমন সুর রয়েছে তেমনই রয়েছে ভয়ংকর এক অসুর। আর সেই অসুরের সন্ধান খুব কম মানুষই জানে। একমাত্র যারা নবীনের সঙ্গে খেলেছে তারা জানে নবীনের এক ভয়ংকর পরিচয়।
রাত ন’টা নাগাদ নিতাইবাবু ডাক পাড়ল, নবীইইইন। ও নবীন চলে এসো।
মানে ভাত তৈরি। আজ খাওয়া-দাওয়ার পর নবীন আর নিতাইবাবু বেরোবে খেলতে। এই খেলা নবীনেরই আবিষ্কার। ওর মাথায় অদ্ভুত সব খেলা আসে। যা খেলে তার নেশা লেগে যায়।
নবীন উঠল। গেল নিতাইবাবুর ঘরে। স্টেশনমাস্টারের ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ক্ষীণ হলদে আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘরের ভেতরে একটা মিটমিটে টিউবলাইট জ্বলছে। ঘরময় ম-ম করছে গরম ভাতের গন্ধ।
নবীন আজ তোমাকে ডিমমাখা খাওয়াব। আলু-পেঁয়াজ আর নুন দিয়ে মাখা। স্পেশাল মেনু। হে হে হে।
নবীন বুঝল আজ নিতাইবাবু ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত রয়েছেন কারণ আজ রাতে উনি নবীনের সঙ্গে নতুন খেলাটা খেলতে বেরোবেন। সেই উচ্ছ্বাস তিনি চেপে রাখতে পারছেন না।
নবীনের জন্য একটা আলাদা থালা রয়েছে। সেটায় তিনি ভাত ঢাললেন, হাঁড়ির ভেতর থেকে একটা আস্ত ডিম এবং একটা আলু হাতায় করে তুলে দিলেন। একপাশে দিলেন একটা পেঁয়াজ, দুটো কাঁচালঙ্কা এবং খানিকটা নুন। নিজের থালাতেও ভাত-ডিম ইত্যাদি নিলেন তারপর আলুসিদ্ধ ডিম পেঁয়াজকুচো সব একসঙ্গে মাখলেন। অর্ধেক নবীনের থালায় দিয়ে ভাত খেতে শুরু করলেন। নবীনও হাপুস হুপুস খাচ্ছে, নিতাইবাবুও। আজ বেশ হাওয়া দিচ্ছে। নিতাইবাবুর পরনে স্যান্ডোগেঞ্জি আর পায়জামা। তার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমে উঠছে গরম ভাতের উত্তাপে।
খেতে খেতে নিতাইবাবু বলে উঠলেন, বুঝলে নবীন, জীবন বড়ই বিচিত্র।
এই কথাটা নিতাইবাবু দিনের মধ্যে অন্তত চার-পাঁচবার বলেন। নবীন থাকলে নবীনকে, কেউ এলে তাকে অথবা কেউ না থাকলে নিজেকেই বলেন। জানি না কেন…মনে হচ্ছে জীবনটা আমার এখানেই কেটে যাবে। আর কোনওদিন নিজের বাড়ি ফেরা হবে না।
নিতাইবাবুর মা মারা গেছেন অনেকদিন। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার নিতাইবাবু ফোনে বাবার সঙ্গে কথা বলেন। ফোন কখনও আসে না, নিতাইবাবুই কল করেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন। তারপর তৃপ্ত হয়ে ফোন রেখে দেন।
আজও খেয়ে দেয়ে উঠে মোবাইলে ফোন করলেন তিনি, হ্যালো বাবা, কেমন আছ এইবেলা? কী করছ? ইত্যাদি আরও টুকিটাকি কথা। নবীন চুপ করে বসে রইল। এই কথোপকথন পর্ব নবীন সামনে থাকলে একটু বেশিক্ষণ ধরে চলে। নিজের বাবাকে নিয়ে নিতাইবাবু একটু বেশিই আদিখ্যেতা করেন। নবীন ভাবার চেষ্টা করে এখন নিতাইবাবুর বয়স যদি পঞ্চাশ -বাহান্ন হয় তাহলে ওর বাবার বয়স কমকরে পঁচাত্তর তো হবেই। কিন্তু নিতাইবাবু তার বাবার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেন যেন কচি খোকাটি তিনি। ওর নিজের বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা যেহেতু শেষদিন পর্যন্ত খুবই খারাপ ছিল তাই অন্যকেউ বাবাকে নিয়ে বেশি আবেগ দেখাচ্ছে সেটা ওর ভাল লাগে না।
ফোনাফুনি পর্ব শেষ হওয়ার পর নিতাইবাবু বললেন, চলো হে, এবার খেলায় বসে পড়া যাক।
নবীন নিজের গালে হাত বুলিয়ে বলল, বেশ।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে দুজনে খোলা মাটিতে মুখোমুখি বসল। তারপর নিতাইবাবু বললেন, আজ তাহলে আমি শুরু করি।
বেশ করুন।
নিতাইবাবু গলা খাঁকড়ে গান ধরলেন-
আজু বিরহভাবে গৌরাঙ্গসুন্দর
ভূমে গড়ি কান্দে বলে কাঁহা প্রাণেশ্বর।
পুন মুরছিত ভেল অতি ক্ষীণ শ্বাস
দেখিয়া লোকের মনে বড় হয় ত্রাস।
চারটি পংক্তি দুইবার গেয়ে থামলেন নিতাইবাবু। নবীন ততক্ষণে স দিয়ে কী গান গাইবে ভেবে ফেলেছে। নিতাইবাবু থামামাত্র ও গান ধরল-
সরল হয়ে ভজ দেখি তাঁরে
তোরে যে পাঠায়েছে এ ভব সংসারে
ঠিক ভুলো না মন রসনারে
সেই রকম করো, যোগাও
এবার অমূল্য ধন দিয়েরে…
র প্রথম অক্ষর দিয়ে গান ভাবতে শুরু করলেন নিতাইবাবু। ইসস মনে পড়ছে না! পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না। এদিকে সময় মাত্র দশসেকেন্ড। নবীন গুণছে। আট…নয়…দশ! বলার সঙ্গে সঙ্গেই সপাটে এক থাপ্পড় এসে পড়ল নিতাবাবুর গালে। মাথা পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠল নিতাইবাবুর। নবীনের আঙুলগুলো খুব শক্ত। কিন্তু এটাই মজা। এই খেলার এটাই নিয়ম। দশ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে না পারলে অপরজন সপাটে থাপ্পড় মারবে। এবং থাপ্পড় মারার পরে তাকেও সেই অক্ষর দিয়ে গান গাইতে হবে নচেৎ তাকেও থাপ্পড় খেতে হবে। এবং খেলা আবার নতুনভাবে শুরু হবে। কিন্তু নবীনের গানের স্টক অফুরান। নিতাইবাবুর গালে থাপ্পড়টা মারার সঙ্গে সঙ্গে ওর ভেতরে ঝিমিয়ে থাকা অন্য একটা সত্তা যেন ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসল। এবারে পাশে রাখা একতারাটা হাতে নিল গাইবে বলে। নিতাইবাবু কিন্তু থাপ্পড় খেয়ে মোটেও ক্রুদ্ধ নন, বরং থাপ্পড়ের জ্বালাটা চেটেপুটে উপভোগ করতে করতে নবীনকে বললেন, নবীন ভাই উঠে দাঁড়িয়ে গাও।
নবীন তাই করল। একতারাটা তুলে ধরে উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকল আর গাইতে থাকল-
রাইসাগরে তরঙ্গ ভারি
ঠাঁই দিতে পারবেন কি শ্রীহরি
ছেড়ে রাজস্ব প্রেমের উদ্দেশ্য ছিন্ন কাঁথা উড়ে গায়…
মাথার ওপর তারায় ভরা খোলা আকাশ, মৃদুমন্দ হাওয়া আর দুটো সম্পূর্ণ একা মানুষ রাত যত বাড়তে থাকল গানের এক অদ্ভুত খেলায় বুঁদ হয়ে ডুবে যেতে থাকল।
জীবনে বহু বিচিত্র সঙ্গ করেছে নবীন। ও বাউল-কীর্তন গান গায় বটে কিন্তু ও নিজে বাউল-বা কীর্তনীয়া অথবা ঠাকুরভক্ত কোনওটাই নয়। একমাত্র সুরের প্রতি ওর অমোঘ টান। কারণ গানের মধ্যে, সুরের মধ্যে ওর ছেলেবেলা, ওর মায়ের গন্ধ খুঁজে পায়। এই নবীন কোমল, অনুভবী, স্মৃতিমেদুর আবার তারই বিপরীতে নবীন ভয়ংকর, ক্রুর, ধূর্ত। কিন্তু এই পরিচয়টা ও নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। নাহ কেউ জানে না বলা ভুল। পালবাজার থানার খাতায় আজও নাম রয়েছে।
গান শেষ হওয়ার পর নবীন আর নিতাইবাবু মিলে গল্প করতে শুরু করল।
নবীনভাই একখানা মোক্ষম খেলা বার করেছিলে ভাই তুমি। ছোটবেলা থেকে গানের লড়াই খেলেছি কিন্তু তোমার শেখানো এই খেলার কোনও জবাব নেই। বিশ্বাস করো ভাই যদি সরকারি চাকরি না থাকত তাহলে হয়ত সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যেতাম। কিন্তু বাবার মুখ চেয়ে পারিনি। বড়ই টান। বুঝলে নবীনভাই আমি যখন কলেজে উঠলাম বাবা আমাকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল জীবনে আমি যেন কোনও নেশার দ্রব্য স্পর্শ না করি। আমি আজও সেই কথা রেখেছি। মদ-সিগারেট কিচ্ছু খাই না, চা একটু খাই কিন্তু সেটা নেশা নয় তুমিও জানো। মা চলে গেল শেষসময় মাকে দেখতে পারিনি। বাবার কাছে শুনেছি মা আমাকে দেখতে চাইছিল, সেই অপরাধবোধ আজও আমাকে তাড়া করে নবীন। মুখাগ্নি করতে এসেছিলাম প্রায় দুইদিন পর। মা মারা যাওয়ার পর বাবা…এইটুকু বলে থামলেন নিতাইবাবু। তারপর নবীনকে বললেন, জীবন বড় বিচিত্র হে, নবীন। আমরা আসলে সবাই ছদ্মবেশী।
নবীন বলল হুঁ।
এই যে তুমি, তোমার সঙ্গে এত খোলামেলা গল্প করি। আজ এতগুলো দিন প্রায় একসঙ্গেই আছি আমরা তবু বলো তো আমরা কি একে অপরকে চিনি? আমি তবু নিজের জীবনের কিছু কথা তোমাকে বলি অথচ তুমি নিজের সম্পর্কে কিছুই বলো না।
আমার জীবনে বলার মত কিছুই তো নেই, নিতাইবাবু।
তাই আবার হয়, নবীন? এই জগতে সবার একটা গল্প আছে। সবারই বলার মত কিছু আছে।
নবীন বলল হয়ত আছে, কিন্তু তা শোনার মত যদি না হয়, তাহলে তা না বলাই ভাল।
কিন্তু মানুষের কৌতুহল তাই বলে চুপ করে থাকে না, নবীন। আমি যতদিন না তোমার কথা জানতে পারব ততদিন আমার শান্তি নেই। তুমি কেন ঘর ছাড়লে, কেন এইভাবে ঘুরে বেড়াও?
আমার ঘর ভাল লাগত না।
সে কথা তুমি অনেকবার বলেছ। কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হয় তুমি সবটা বলো না। তোমাকে যেমনটা দেখি তুমি কি পুরোটাই তেমন? আমার তা মনে হয় না।
তাহলে আমাকে কেমন মনে হয়, নিতাইদা? খুনে? ডাকাত?
আরে না না। তা কেন হবে! বলে হেসে উঠলেন নিতাইবাবু। বললেন, যার গলায় এমন গান, সে তো সাক্ষাৎ সরস্বতীর বরপুত্র। সে কী কখনও চোর-ডাকাত খুনে হতে পারে?
পারে না, তাই না?
না। পারে না, জোর গলায় বললেন নিতাইবাবু। তবে তুমি যে রঙিনপুরের মানুষদের মত নেহাৎ সরলসিধে নও তা বুঝি।
নবীন জিজ্ঞাসা করল কী করে বুঝলেন?
এই যে তোমার নিজেকে আড়াল করে রাখা। এখানে কেন এলে কোথা থেকে এলে কেনই বা থেকে গেলে তা যেমন আজও জানলাম না।
কেন সেই কথা তো বলেছি আপনাকে।
আহা সে তো বলেছ, তুমি অনেকবছর ভবঘুরে। যখন খুশি যেখানে খুশি যাও, পছন্দ হলে থেকে যাও। একদিন ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলে, সেই ট্রেন এখান দিয়েই যায়। তুমি স্টেশনের নাম আর কৃষ্ণচুড়া-এবং রাধাচুড়া গাছটা দেখে এমন প্রেমে পড়লে যে নেমে গেলে। তারপর এক-দুইদিন থাকলে এই প্ল্যাটফর্মে। একদিন হাঁটতে হাঁটতে গেলে রঙিনপুর গ্রামে। সেখানে দেখলে সবাই গান গায় তোমার ভাল লেগে গেল। ভাবলে এখানেই থেকে যাবে যতদিন মন চায়। তাই করলে। তারপর তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হল। তুমি একটা একলা মানুষ আমিও একটা একলা মানুষ। আমরা দিনের পর দিন রাতের পর রাত একা। এই একাকীত্ব কাটানোর জন্য আমি আর তুমি বন্ধু হলাম। অনেক গল্প করতে শুরু করলাম। তারপর একদিন সব গল্প ফুরিয়ে গেল। কিন্তু কথা ফুরোলেও গান আর সুর তো ফুরোয় না, নবীন, এক কথা তিনবার বললে পুরনো লাগে অথচ একই গান একশোবার শুনলেও তা নতুন মনে হয়। আর সেই গানের গায়ক যদি তোমার মত সাধক হয় তাহলে তো কথাই নেই। তুমি আসার আগে পর্যন্ত আমি একটা সময় প্রতিদিন ভাবতাম আমি আত্মহত্যা করব। আমার বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই, আমার কেউ নেই। এই নির্বাসনের জীবন আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল নবীন। কিন্তু তারপর তুমি এসে আমাকে কেন জাগিয়ে তুললে। গানের শখ আমার কোনও এককালে ছিল কিন্তু তা কবে যেন মরে গেছিল তুমি খুঁচিয়ে সেই আগুন আবার জাগিয়ে দিলে। গানের সঙ্গে জুড়ল তোমার অদ্ভুত সব খেলা। যে খেলা ছোটবেলায় একরকম ভাবে খেলেছি সেই খেলাকে তুমি পুরো নতুনভাবে সাজালে। জানো নবীন তুমি যখন প্রথমবার বললে গানের লড়াইকে আমরা এবার থেকে সত্যি লড়াইতে নিয়ে আসব, আমি বুঝিনি। তুমি বললে না পারলেই গালে সপাটে থাপ্পড়। আমি ভেবেছি তুমি পাগল। তারপর তুমি বললে দেখবেন নিতাইবাবু থাপ্পড় খেয়ে গালটা যখন চিরবির করে জ্বলবে অদ্ভুত একটা শিরশিরে আনন্দ হবে। তোমার কথায় এমন জাদু ছিল আমি রাজি হলাম। প্রথম থাপ্পড়টা অবশ্য আমিই মেরেছিলাম তোমার গালে। তবে আস্তে। তুমি বললে, আস্তে নয়, গায়ের জোরে মারুন। দেখবেন ভেতরের সব রাগ, কষ্ট ভক করে বেড়িয়ে আসবে।
আমি তাই করলাম, সত্যিই তাই হল। সেই রাতে উত্তেজনায় আনন্দে আমার ঘুম হল না। আমি কোনওদিন নেশাভাং করিনি নবীন কিন্তু তোমার এই গানের লড়াই আমাকে কী এক নেশায় ফেলে দিল, এখানে মেরেও সুখ, মার খেয়েও সুখ। এমন কেন হয় নবীন?
নবীন বলল, আমরা একা থাকি নিতাইদা। একা মানে মড়ামানুষ। আধমড়াদের বাঁচানোর জন্য শুনেছি ইলেকট্রিক শক দেয়। এই থাপ্পড়টা হল ইলেকট্রিক শক, আমাদের বাঁচিয়ে তোলে।
তা হবে, কিন্তু শুধু বাঁচায় না নবীন, কী অদ্ভুত একটা শরীরী তৃপ্তি দেয় এই বয়সেও জোয়ান মরদের মত পুলক জাগে শরীরে। তুমি একটা জাদুকর। কোনও সাধারণ মানুষ নয়।
নবীন হা হা করে হেসে উঠে বলল, যান নিতাইদা শুয়ে পড়ুন অনেক রাত হল।
# # #
আজ রঙিনপুরে উৎসব। প্রতিবছর চৈত্রমাসের শেষদিনে রঙিনপুরে বাউল-কীর্তনের আসর বসে। গ্রামের মানুষরা মিলেই এই উৎসব করে অনেক বছর ধরে। বাইরের কোনও মানুষ আসে না, রঙিনপুরের মানুষ বাইরের লোকেদের কাছে নিজেদের জায়গা সম্পর্কে কিছু বলে না, ওরা চায় নিজেদের মত গান-বাজনা নিয়ে থাকতে। এই গ্রামে সব মিলিয়ে খান কুড়ি মাটির বাড়ি। অভাব রয়েছে কিন্তু সেই অভাব কখনও এই মানুষগুলোর চোখে-মুখে বা ঘরের চেহারায় প্রকট নয়, প্রতিটি ঘর বড় আদরে যত্নে সাজানো। চকচকে উঠোন, অনেক ফুলের গাছ, সামান্য আসবাবও সুবিন্যস্ত। বাসনকোশন উজ্জ্বল। এই গ্রামে কেউ কারও সঙ্গে ঝগড়া করে না, কেউ কাউকে ঈর্ষা করে না, এ গ্রামের মানুষ গান গেয়ে আর গান শুনিয়েই সুখে রয়েছে। এ যেন পৃথিবীর বাইরে এক গ্রাম। ওদের ভোটারকার্ড, আধারকার্ড, রেশনকার্ড সবই রয়েছে, তবে ভোটের আগে কোনও জনপ্রতিনিধি এখানে ভোট ভিক্ষা করতে আসে না, এই জায়গাটাকে তারা ম্যাপের বাইরেই ভাবেন, এখানে বিদ্যুৎসংযোগ রয়েছে তবে বেশিরভাগ সময়েই লোডশেডিং, টিউকল আছে মাত্র একটি। মুদির দোকান দুইটি, ডাক্তারখানা নেই। কারও অসুখ হলে অনেকদূর যেতে হয় চিকিৎসার জন্য। তবে অদ্ভুত ব্যাপার রঙিনপুরের মানুষদের অসুখবিসুখ কম হয়। জটিল ব্যাধি প্রায় কারোরই নেই। মোদ্দাকথা হল জগতের যেমন রঙিনপুরকে নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই, রঙিনপুরের মানুষও বাইরের জগতে শুধু প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্য মেশে, স্রেফ অর্থরোজগারের জন্য। এর বেশি আর কিছু নয়। তারা নিজেদের নিয়ে বেশ ভাল আছে। এমন আজব জায়গা হয়ত শুধু রূপকথাতেই থাকে, কিন্তু রূপকথাও তো আসলে পৃথিবীরই আরেক রূপের কথা।
আজ মহোৎসব। রঙিনপুরে কারও ঘরে রান্না হবে না। গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটি হরিসভা রয়েছে। সেখানে রাধা-মাধবের মূর্তি স্থাপিত। নিত্যপুজো হয়। সন্ধ্যারতি ভোগ হয়। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় অন্তত একঘন্টা কীর্তন এবং তারপর ভাগবতপাঠের আসর বসে। আর প্রতিবছর আজকের দিনটায় হয় মহোৎসব। গ্রামের লোকেরাই সকলে মিলে চাঁদা দিয়ে ভোগের আয়োজন করে। উদয়-অস্ত নাম-গান হয়। রঙিনপুরে কোনও ব্রাহ্মণঘর নেই। দাস, মণ্ডলই বেশিরভাগ পদবী। তবে পুজোর জন্য বাইরে থেকে কোনো পুরোহিতকে ডাকা হয় না। নিজেরাই পুজোআচ্চা ভোগ দেয়। শালগ্রামশিলা নেই, তাই কোনও সমস্যাও নেই। তবে ভক্তি রয়েছে ভরপুর। আজ ভোরবেলা থেকেই শুরু হয়েছে নাম-গান। কোনও মাইক্রোফোন নেই, তাই সেই গান বেশিদূর থেকে শোনা যায় না। নবীন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বেঞ্চে বসেছিল। সকালবেলার ট্রেনটা সঠিকসময়েই এসে থামল প্লাটফর্মে। আজ এই স্টেশন থেকে কেউ ট্রেনে ওঠার নেই। আজ সকলেই উৎসবে। শুধু নামল একজন লোক। লোকটা অচেনা। নবীন ভুরু কুঁচকে তাকাল। এ কে? এখানে কেন নামল? এখানে তো কেউ কখনও নামে না। নবীন বিরক্ত হল। শালার ট্রেন আজই কোনও কারণে সিগনাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটার হাতে মোবাইল। তাই দিয়ে প্ল্যাটফর্মের ছবি তুলছে। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া গাছের ছবি তুলছে। নবীন চায় না এই রঙিনপুরে কোনও অচেনা লোকের পা পড়ুক। অচেনা লোকের ভিড় মানেই বাজে লোকের ভিড় বাড়বে, আর লোকজন বেশি হলে সেখানে নিজেকে আড়াল করে রাখা সমস্যা হবে। গত কুড়ি বছর ধরে নবীন ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। যেখানেই সামান্য বিপদের আঁচ বুঝেছে সতর্ক হয়েছে, আর দেরি করেনি। ছেড়ে চলে গেছে। অবশেষে এই রঙিনপুরে একদিন আচমকাই পৌঁছে গিয়ে এখানেই ডেরা বেঁধেছিল, তখনও ভাবেনি এখানে এতদিন থেকে যেতে পারবে। একটাই কারণ বাইরের উটকো লোকের ভিড় নেই। ভিড় মানেই নজরদারি এবং বিপদের আশংকা। এই বুঝি কেউ চিনে ফেলল ওকে।
এই প্ল্যাটফর্মে খুব কমই সিগনাল না পেয়ে ট্রেন দাঁড়ায়। আর দাঁড়ালেও লোকজন নামে না, কারণ একটা চায়ের দোকানও প্ল্যাটফর্মে নেই। লোকে খামোখা নেমে কী করবে? কিন্তু এই লোকটা নামল কেন?
ছবি তুলে সে এগিয়ে এল নবীনের দিকে। বলা কওয়া নেই ওর ছবি তুলতে গেল, নবীন সঙ্গে সঙ্গে মারমুখী হয়ে তেড়ে গেল লোকটার দিকে। লোকটা সভয়ে পিছিয়ে গেল।
নবীন চোখ পাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল ব্যাপার কী? ছবি কেন তুলছ?
লোকটা বলল, এমনি। আপনাকে এই প্ল্যাটফর্মে বেশ ভাল লাগছে।
নবীন আবারও ইশারায় ছবি তুলতে বারণ করল। তারপর ট্রেনে উঠে যেতে বলল।
লোকটা জিজ্ঞাসা করল কেন উঠে যাব?
নবীন আবারও ইশারায় ওঠার কথা বলল। ও কথা বলতে চাইছিল না। অচেনা মানুষের সঙ্গে নবীন চট করে কথা বলে না। রঙিনপুরে নতুন মানুষের আগমন ওর অসহ্য লাগছিল।
ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে না। নবীন দেখল নিতাইবাবু ট্রেনের গার্ডসাহেবের সঙ্গে কথা বলছে।
লোকটা নবীনকে জিজ্ঞাসা করল এখানে দেখার মত কিছু আছে?
নবীন আবারও ইশারায় বলল, না কিছু নেই। ট্রেনে ওঠো। লোকটা যেন নবীনের এই কথা বিশ্বাস করল না। নিতাইবাবুকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। নবীন আরও বিরক্ত হয়ে উঠল। দেখল লোকটা নিতাইবাবুর সঙ্গে কীসব কথা বলছে। নিতাইবাবু কথা বলতে বলতে হাত তুলে রঙিনপুর গ্রামের দিকে ইশারা করে কী যেন বলল। মাথা গরম হয়ে উঠল নবীনের। নিতাইবাবু কী বলছে? লোকটা সহজসরল তাতে নবীনের একদিকে সুবিধা ঠিকই, কিন্তু বড্ড বেশি কথা বলে। বেশি কথা বলা খুব খারাপ।
লোকটা মাথা নেড়ে নেড়ে হুঁ হাঁ করল তারপর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে নবীনের দিকে তাকিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে নেমে পড়ল। হাঁটতে শুরু করল। অদ্ভুত তো! এ তো রঙিনপুরর দিকে যাচ্ছে। নিতাইবাবু কি লোকটাকে রঙিনপুরের ঠিকানা দিল নাকি? কেনই বা যাচ্ছে! নিতাইবাবুর দিকে নবীন হন হন করে এগোতে থাকল জিজ্ঞাসা করার জন্য। আর ঠিক তখনই ট্রেনটা সিগনাল পেয়ে হুইসেল দিল। হারামজাদা তোকে এখানে এতক্ষণ থামতে কে বলেছিল বলে একটা বগির গায়ে লাথির মারল নবীন। ওর কান্ড দেখে ট্রেনের ভেতরে বসে থাকা কয়েকটা লোক ওকে পাগল ঠাওরে হেসে উঠল। তাতে নবীনের কিছু এসে যায় না। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ধীরে ধীরে ট্রেনটা চলে গেল।
নবীন তুমি যাবে কখন? আমি চানটা সেরে ফেলি চট করে।
নিতাইবাবুর কথার উত্তর না দিয়ে নবীন জিজ্ঞাসা করল ওই লোকটা কে?
তা চিনি না, জিজ্ঞাসা করল এখানে কী আছে? বললাম তেমন কিছুই নেই, একটা গ্রাম আছে, সেখানে লোকে গান-বাজনা করে। আজ মোচ্ছব আছে। তা শুনে লোকটা বলল সে দেখতে যেতে চায়।
আপনি না জেনেশুনে একটা অচেনা লোককে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন!
নবীনের কথা শুনে নিতাইবাবু বললেন, আরে আমি বললাম ওখানে দেখার কিছুই নেই, শুধু কয়েকঘর কীর্তনীয়ার বসবাস, গান-বাজনা করে পেট চালায়। আজ ওখানে মহোৎসব। তাই শুনে ভদ্রলোক বললেন জায়গাটা বেশ সুন্দর। আমি একবার ঘুরেই আসি। লোকটার কীসব চ্যানেল ট্যানেল আছে বলল, রিপোর্টার মনে হয়। কীসব টিউব চ্যানেল না কী একটা নাম বলল…
রিপোর্টার শুনে আরও সজাগ হয়ে উঠল নবীন। খুব বিরক্ত হয়ে নিতাইবাবুকে বলল আপনি এত কথা জানালেন কেন? কেমন লোক কোথা থেকে আসছে কিছু না জেনেই রঙিনপুরের ঠিকানা দিয়ে দিলেন। কোনও খারাপ উদ্দেশ্যও তো থাকতে পারে।
নিতাইবাবু গুম হয়ে গেলেন। কথাটা তুমি ভুল কিছু বলোনি নবীন। কিন্তু এবার কী করা যায় বলো দেখি।
নবীনের ভীষণ রাগ হচ্ছে। ও চায় না, কোনও অচেনা লোক এখানে আসুক। অচেনা লোক মানেই ওর কাছে সন্দেহজনক। এই লোকটা এখানে কেন এল? কী চায়? নবীনকেই খুঁজতে এসেছে নাকি? নবীনের মনে হয় বহু মানুষ ছদ্মবেশে ওকে খুঁজছে। সারাক্ষণ একটা আতঙ্ক মনের ভেতর ঘুরে বেড়ায়। এই বুঝি পিছন থেকে কেউ এসে ওকে চেপে ধরল। নবীন মাঝেমাঝেই স্বপ্ন দেখে ওকে কারা যেন চেপে ধরেছে। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে অনেক জোর করে ঢুকিয়ে দিচ্ছে অন্ধকার একটা কুঠুরিতে। নবীন প্রাণপণে চিৎকার করছে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। কে যেন এসে ওর গলায় পরিয়ে দিচ্ছে ফাঁস। দম আটকে আসছে নবীনের। মরে যাচ্ছে। তখনই ঘুম ভেঙে গিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেছে। এই স্বপ্ন ওকে দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর জ্বালিয়ে মারছে, তিলে তিলে মারছে। কখনও নিজের হাতের তালুর দিকে আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। এই হাতেই একতারা বেজে ওঠে আবার এই হাতেই…! নিতাইবাবু ঠিকই বলেন জীবন বড় বিচিত্র হে!
মনের ভেতর অস্থির লাগছে। ওই লোকটা কে? কেন এসেছে ওকে জানতে হবে। এখানে কোনও বাইরের লোককে আসতে দেওয়া যাবে না। নবীন আর দেরি করল না। নিজের একতারাটা হাতে নিয়ে হাঁটা লাগাল। রঙিনপুর তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে।
# # #
নবীন যখন পৌছল তখন হরিসভার নাটমন্দিরে শিবু নন্দী গৌরবন্দনা গাইছে।
গোরা মোর গুণের সাগর
প্রেমের তরঙ্গ তায় উঠে নিরন্তর
গোরা মোর অকলঙ্ক শশী
হরিনাম সুধা তায় ক্ষরে দিবানিশি।
শিবু নন্দীর গানের গলা অপূর্ব! রঙিনপুরের সেরা কীর্তনীয়াদের মধ্যে একজন। অতি বড় বেরসিকও শিবুর গান শুনলে মুগ্ধ হয়ে যাবে। যেমন গানের গলা তেমনই হারমোনিয়ামের হাত। পুরনো একটা হারমোনিয়াম, সাদা রিডগুলো সব লালচে হয়ে হয়ে গেছে, কয়েকটা রিড ভালভাবে সুরেও লাগে না। কিন্তু শিবুর আঙুলের এমনই জাদু যে বেসুরও সুরে ঠেকে। শিবুর কাঁধ পর্যন্ত কুচকুচে কালো কোঁচকানো চুল। দাড়ি-গোঁফ কামানো চোখদুটি ঢুলুঢুলু। পান খেয়ে খেয়ে দাঁতগুলো তরমুজের বিচির মত রঙ। ঠোঁট আর জিভ সবসময় লাল। গলায় টাইট করে বাঁধা তুলসীর মালা। রঙিনপুরের প্রায় সকল নারী-পুরুষেরই গলায় কন্ঠি রয়েছে। নাটমন্দিরে সতরঞ্চি বিছানো হয়েছে। তার মাঝে বসেছে কীর্তনের আসর। শিবুর পাশে গৌর বাঁশি বাজাচ্ছে আর ব্রজগোপাল শ্রীখোল। সকলের গলায় লিকলিকে গাঁদার মালা। কপালে চন্দন। ওদের তিনজনকে ঘিরে বসে রয়েছে শ্রোতারা। সকলেই এই গ্রামের বাসিন্দা। গানের আসর জমে উঠেছে। রাধা-মাধবকে সাজানো হয়েছে নতুন বস্ত্রে। এই গ্রামের সবাই গরিব। তাই রজনীগন্ধার গোরের মালার সামর্থ্য নেই, গাঁদার মালা দিয়েই সাজানো হয়েছে যুগলকে। কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া ফুল দিয়েও চারিদিকে সাজানো। মনোহর মূর্তি। এদিকে কীর্তন চলছে আর মন্দিরের বাঁ-পাশে চলছে ভোগরান্নার আয়োজন। খিচুড়ির ডালভাজার গন্ধ আসছে। কয়েকজন মহিলা কুটনো কুটছে। দুজন পুরুষমানুষ মাটিতে খোদা উনুনে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে তার ওপর বড় কড়াই চাপিয়ে বড় খুন্তি দিয়ে মুগডাল ভাজছে। আজ খিচুড়ি আর লাবড়ার মোচ্ছব। সঙ্গে খুব সামান্য পায়েস। গ্রামের কারও ঘরে আজ উনুন জ্বলে না। দুইবেলাই এখানে ভোগপ্রসাদ খাওয়া হবে।
আজ বেশ গরম। হাওয়াতেও ছ্যাঁকা লাগছে। নবীন এসে চারদিকে চোখ ঘোরাল। নতুন লোকটা কোথায়? দুই-একজন নবীনকে দেখতে পেয়ে আসরে বসার অনুরোধ করল। আসরে নবীনকেও গাইতে হয়। গতবছরও গেয়েছিল। নবীন ইশারায় জানাল একটু পরেই বসছি। ওর চোখদুটো বনবন করে এদিক ওদিক ঘুরছে। কোথায় গেল লোকটা। পৌঁছতে পারেনি? ভুলদিকে চলে গেছে। এই গ্রামটুকু ছাড়া বাকি সবটাই ধু-ধু মাঠ আর উঁচু নিচু ঢিবি। মাইলের পর মাইল ফাঁকা। কোথাও জনবসতি নেই। তাই পথ ভুললে কপালে বিপদ আছে। স্টেশন থেকে নেমে খানিকটা এগোলে একটা বটগাছ রয়েছে তার ডানদিকের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে রঙিনপুর গ্রামের দিকে আর বামদিকের রাস্তাটা এমনই চলে গেছে ধু-ধু মাঠের দিকে। সেই মাঠের আয়তন প্রায় আট-নয় কিলোমিটার। বাঁদিকে চলে গেলে কপালে দুঃখ রয়েছে। মাঠটা পেরোলে তারপর ন্যাশনাল হাইওয়ে পাওয়া যায়। নবীন এই গ্রামের প্রায় সকলের মুখই চেনে। আর হাফহাতা সাদা শার্ট পিঠে ব্যাগ, মোটা গোঁফ মাথার সামনে টাকওলা লোকটাকে খুঁজে বার করতেই হবে। নবীন বসল না। মন্দিরের চারিপাশে ঘুরে দেখতে থাকল। নাহ নেই! তারমানে এখানে পৌঁছতে পারেনি! তাহলে গেল কই? লোকটা কি পুলিশের চর? নবীনের খোঁজ পেয়ে এখানে এসেছে? নবীনকে চিনতে পেরেছে? কিন্তু রঙিনপুরে আসার আগে নবীনের গোঁফদাড়ি লম্বা চুল কিছুই ছিল না, প্রতিবারই ও এমন করে। এক জায়াগা ছেড়ে যখন অন্যত্র যাওয়ার সময় হয়েছে আন্দাজ করে তখনই ও নিজের হুলিয়া বদলে ফেলে, নইলে কুড়ি বছর ধরে ও এখনও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খোলা হাওয়ায় গান গাইছে তা স্রেফ নিজের বুদ্ধির জোরে। নবীন আত্মবিশ্বাসী কিন্তু কখনই অতিরিক্ত নয়, সেইকারণে সদাসতর্ক। ও জানে এক মুহূর্তের অসতর্কতা ওকে চরম বিপদে ফেলতে পারে। যদিও এই পালিয়ে বেড়ানো এক এক সময় ওর অসহ্য লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই।
নবীন হরিসভার আশপাশ ঘুরে দেখল। না, লোকটা নেই। তারমানে এখানে পৌঁছয়নি। নবীনপল্লী গ্রামে পৌঁছনোর বদলে নিশ্চয়ই হাইওয়ের দিকে চলে গেছে। অবশ্য হাইওয়েতে কোনও আনাড়ি লোকের পক্ষে পায়ে হেঁটে পৌঁছনো খুব কঠিন। এবড়োখেবড়ো জমি, তারপর মাথার ওপর চড়ারোদ। ত্রিসীমানায় কোনও জনপ্রাণী নেই। একবার ওই গোলকধাঁধায় পড়লে রাস্তা খুঁজে পেতে যা নাকানিচোবানি খেতে হবে, যে জীবনে আর রঙিনপুর আসার কথা স্বপ্নেও ভাববে না।
নবীন নিশ্চিন্ত হয়ে নাটমন্দিরের একপ্রান্তে বসে পড়ল। একটি বাচ্চা ছেলে এসে ওর কপালে চন্দনপাত্রে গাঁদাফুল ডুবিয়ে লেপে দিল। গান চলছে গানের মাঝেই কেউ কেউ আবেগাপ্লুত হয় জয় নিতাই জয় নিতাই বলে উঠছে। সকলেই কীর্তনরসে ডুবে। নবীন জীবনে অনেকজায়গায় থেকেছে কিন্তু রঙিনপুরের মত সুন্দর গ্রাম আর মানুষ কোথাও দেখেনি। আরও একটা বড় ব্যাপার এই গ্রামের ত্রিসীমানায় কোনও মোবাইল টাওয়ার নেই। তাই কারও মোবাইল ফোন নেই। নবীন এই বস্তুটিকে খুব ভয় পায়, আজকাল মোবাইলের মাধ্যমে সবকিছু সবজায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া যায়। গোপন বলে কিছু থাকে না। ইন্টারনেট কী তা নবীন খুব ভালভাবে জানে।
শিবু নন্দীর গানের পর এবারে গান ধরেছে অজয় সাঁপুই।
ললিতা বলে অমনি কেন যাবি গো রাধে
ছি ছি শ্যাম নাগর দেখলে কী বা বলবে
কেন বনে যাবি গো একাকিনী
রাধে আমরা যে তোমার চিরসঙ্গীনি
অজয় একটি লাইন গায় বাকি দুজন ধুয়ো দেয়।
সকলে প্রেমরসে বিভোর। ওদিকে খিচুড়ির গন্ধ উঠেছে। নবীনও তার একতারাটিতে কীর্তনের তালে আঙুলের টোকা দিচ্ছে। মুক্তারানি সামনের দিকে বসেছিল। সেও গলা মেলাচ্ছিল গানে। নবীনকে দেখতে পেয়ে ডাকল সামনে। নবীন মুক্তার ওই ডাক উপেক্ষা করতে পারল না। মুক্তাকে বড় ভাললাগে নবীনের। যদি এমন বাউন্ডুলে জীবন না কাটাতে হত তাহলে মুক্তার মত একটি মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করত নবীন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ইচ্ছেটা মরে যায়নি। নবীন উঠে গিয়ে মুক্তার পাশে বসল। লাল ডুরে শাড়ি, মাথায় ঘোমটা। সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর, কপালে চন্দনের ফোঁটায় কী অপরূপ লাগছে আহ কী সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে মুক্তার চারিপাশে। মনে ভরে গেল নবীনের। কামনা জাগল। অজয় গাইছে
চম্পক বরণী বয়সে তরুণী
হাসিতে অমিয়া ধারা
সুচিত্র বেণী দুলিছে যনি
কপিলা চামর পারা
সখী যাইতে দেখিনু ঘাটে।
বলো হে বলতেই সকলে গেয়ে উঠল সখী যাইতে দেখিনু ঘাটে এ এ এ
মুক্তারানির সঙ্গে গলা মিলিয়ে নবীনও গেয়ে উঠল সখী যাইতে দেখিনু ঘাটে…
আহা গানের মেজাজে ডুবে যাচ্ছে নবীন। পাশে মুক্তারানি আর এমন সুরের আমেজ, সঙ্গে খিচুড়ির ঘ্রাণ আবেশে চোখ বুজে আসছে। আজ অনেকদিন পর একটু সুখাদ্য মুখে পড়বে।
ফুলের গেরুয়া লুফিয়া ধরয়ে
সঘনে দেখায় পাশ
উঁচু কুচযুগ বসন ঘুচায়ে
মুচকি মুচকি হাস…
সখী মুচকি মুচকি হাস…হরিবল হরিবল…সখী মুচকি মুচকি হাসওওও…
শ্রীখোলের ঠেকা, বাঁশির টান মুহুর্মুহু হরিধ্বনি আহা সে এক অপূর্ব পরিবেশ! অজয়ের গান শেষে ব্রজগোপাল বলল এবার নবীন তুমি ধরো। আমরা একটু উঠি। নবীন বিনাবাক্যব্যয়ে এগিয়ে এল। এবার নবীন গাইবে, এতক্ষণ যে কীর্তনীয়ারা গাইছিলেন তারা একটু চা-বিড়ি-পান ইত্যাদি খাবে বাথরুম করবে।
নবীন একতারার তারে টোকা দিল। মুক্তারানির দিকে মৃদু হেসে গান ধরল-
রাইসাগরে ডুবল শ্যামরায়
তোরা ধর গো হরি ভেসে যায়…
রাইসাগরে তরঙ্গ ভারি
ঠাঁই দিতে পারবেন কি শ্রীহরি
ছেড়ে রাজস্ব প্রেমের উদ্দেশ্য
ছিন্ন কাঁথা উড়ে যায়…
হরিবোল হরিবোল…ধ্বনি উঠল। নবীন একতারা ধরা হাতটি ওপরে তুলে ঘুরে ঘুরে গাইতে থাকল। পরনে মলিন বেশ, একমুখ উস্কোখুস্কো দাড়িগোঁফ আর মধুর কন্ঠে লালনসাঁইয়ের গান পরিবেশটিকে মধুরতর করে তুলল। শ্রোতারা ঘনঘন হরিধ্বনি দিতে থাকল। পরপর তিনটি গান গাইল নবীন। তারপর যখন বসল সটান চোখ পড়ল সেই লোকটার দিকে। গানের ঘোরে এতক্ষণ খেয়াল করেনি, লোকটাকে দেখেই ওর মাথা গরম হয়ে গেল। সবথেকে বেশি রাগ হল লোকটা মোবাইল বার করে হাত উঁচু করে ধরে রয়েছে। মানে ছবি অথবা ভিডিও তুলছে। হারামজাদাটা নিশ্চয়ই নবীনের ভিডিও তুলেছে। এটা ও কখনই চায় না কেউ ওর ছবি তুলুক। নবীন রঙিনপুরে ভিখিরির মত পড়ে থাকে ঠিকই কিন্তু আধুনিক দুনিয়ার হালহকিকত ওর দিব্বি জানা। ওর নিজের কোনও ফোন নেই, কিন্তু স্মার্ট ফোন কী, ইন্টারনেট কী এসব ও জানে। নবীনের ইচ্ছা করল লোকটার সামনে গিয়ে ওকে বেদম মারতে। কিন্তু সেটা করা যাবে না। এমনকি ধমকানোও যাবে না। তাহলে রঙিনপুরের মানুষ উলটে ওকে সন্দেহ করতে পারে। অন্যভাবে খেলতে হবে। নবীন মুক্তারানির পাশে আর বসল না। উঠে গিয়ে লোকটার পাশে বসল। আগে একে ভালভাবে জানতে হবে।
লোকটি নবীনকে ওর পাশে বসতে থেকে মৃদু হেসে বললেন আপনাকে তখন ওই স্টেশন প্ল্যাটফর্মে দেখলাম না?
হ্যাঁ ভাই। ওখানেই থাকি। নবীন বলল। কী সুন্দর গাইলেন, মন ভরে গেল। ভাগ্যিস এখানে এসেছিলাম।
এখানে বুঝি আপনার চেনা কেউ থাকেন?
না না কেউ চেনা নেই, এমনই চলে এসেছি।
এমনি মানে?
এমনই মানে…হে হে হে আসলে আমার একটা স্বভাব রয়েছে, আমি একটু এলোমেলো ঘুরতে ভালবাসি। মানে ইচ্ছা হল বেড়িয়ে পড়লাম, তারপর যেখানে খুশি পৌঁছে গেলাম। আমি রঙিনপুর নামে কোনও স্টেশন আছে তাইই জানতাম না! এই লাইনের ট্রেনে কোনওদিন যাইনি, বা হয়ত গেছি খেয়াল করিনি। আজ নেমে গেলাম। আর এমনই কপাল আমার দেখুন এলাম তো এলাম একেবারে উৎসবের দিনে। নইলে এমন গান কি শোনার সুযোগ পেতাম বলুন!
নবীন অল্প হাসল, বলল তা তো বটেই।
মুক্তারানি এবার গান ধরেছে। সঙ্গে আরও দুজন মহিলা রয়েছেন। খোল-কর্তাল, হারমোনিয়ামে জমজমাট ব্যাপার। মুক্তার কন্ঠে সত্যিই মুক্তা ঝরে।
গৌরাঙ্গ বলিতে হবে পুলকশরীর
হরি হরি বলিতে নয়নে বহে নীর
আর কবে নিতাইচাঁদ করুণা করিবে
সংসারবাসনা মোর কবে তুচ্ছ হবে।
লোকটা আবারও মোবাইল তুলে ধরল। নবীন আড়চোখে দেখে বুঝে নিল ভিডিও করছে।
আপনি ভিডিও করছেন? জিজ্ঞাসা করল নবীন।
লোকটা সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইশারায় একটু চুপ করতে বলল নবীনকে।
অদ্ভুত লোক তো!
লোকটা মোবাইল ঘুরিয়ে সামনে বসে থাকা শ্রোতাদেরও ভিডিও তুলতে থাকল, নবীনের সামনে মোবাইল আসার আগেই নবীন মুখটা পুরো অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল, কোনওভাবেই এত কাছ থেকে নিজের মুখ দেখানো যাবে না। নাহ লোকটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, এ বিপদজ্জনক। নবীনের ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলল, এ বাইরে যেমন নিজেকে দেখাচ্ছে ভিতরে তেমনটি নয়। লোকটা পুলিশ অথবা পুলিশের চর, নবীনকে খুঁজতেই এসেছে। নবীনের সন্দেহপ্রবনতা অতিরিক্ত। অনেকক্ষেত্রেই তা অমূলক, যে কোনও অচেনা মানুষ বা চেনা মানুষের আচরণের নূন্যতম তারতম্যও ওর নজরে আসে তাহলেই নবীন সজাগ হয়ে যায় হয় নিজে সরে যায় অথবা সেই লোকটিকে সরিয়ে দেয়। নবীন খুব দ্রুত মনের ভেতর প্ল্যান করে ফেলল। অপেক্ষা করতে থাকল লোকটার কতক্ষণে এই ভিডিও তোলা বন্ধ হয়। মুক্তারানির দিকে আর ওর নজর নেই।
মিনিট কয়েক পর লোকটা মোবাইল নামিয়ে নিল। তারপর নবীনকে বলল হ্যাঁ দাদা বলো কী বলছ?
আপনার নাম কী? জিজ্ঞাসা করল নবীন।
আমার নাম বুলু সাঁতরা। বুলু? বুলু সাঁতরা! নামটা যেন…মনের ভেতর বুজকুড়ি দিয়ে উঠল সুদূর অতীত।
হ্যাঁ দাদা, বুলু। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ ডাকনাম কেন বলছি, কিন্তু সত্যি বলতে আমার এই একটিই নাম। বাপ-মায়ে আর ভাল নাম রাখার সুযোগ পায়নি। তা দাদার নামটা কী?
আমি ভিখিরি মানুষ আমার কোনও নাম নেই, যে যা খুশি নামে ডাকে।
হে হে করে হেসে বুলু বলল, সত্যি বলব প্ল্যাটফর্মে তোমাকে ওইভাবে বসে থাকতে ভেবে আমিও প্রথমে পাগল বা ভিখিরিই ভেবেছিলাম ঠিকই কিন্তু এখন বুঝেছি তোমাকে যেমন দেখতে তেমন তুমি নও?
তাহলে কেমন আমি? চোয়াল সামান্য শক্ত করে জিজ্ঞাসা করল নবীন।
এসো না দাদা, এদিকে, দুটো কথা বলি। নবীন আপত্তি করল না। এই বুলু আসলে কে সেটা জানতে হবে। নবীনের নিজের ওপর কনফিডেন্স আছে আজ পর্যন্ত ও মানুষ চিনতে ভুল করেনি। আগে তিন-তিনবার ধরা পড়তে পড়তে শেষমুহূর্তে নিজের বুদ্ধি আর আগাম সতর্কতার জন্য পালাতে পেরেছে, এবারেও ঠিক পারবে।
ওরা দু’জন মন্দির থেকে কিছুটা সরে এল। বুলু সাঁতরা শার্টের বুকপকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল। প্যাকেটের মুখটা খুলে সেটা নবীনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল চলে?
নবীনের সিগারেট খাওয়ার নেশা নেই, তবে কেউ বিড়ি-সিগারেট অফার করলে সাধারণত ফিরিয়ে দেয় না। নবীন একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে ঝোলাল। আরেকটা সিগারেট বুলু নিয়ে লাইটার দিয়ে দুটো সিগারেটই ধরাল। অনেকদিন হ্যাঁ অনেক অনেকদিন পর সিগারেটে টান দিল নবীন। নিতাইবাবু কোনও নেশা করেন না, তাই তার কাছে বিড়ি-সিগারেট কিছুই পাওয়া যায় না, রঙিনপুরের কয়েকজন ধুমপান করে ঠিকই তবে সিগারেট কেনার মত টাকা কারও নেই, বিড়ি খায়। এই গ্রামে একটিই মুদির দোকান আছে। রুইদাসের দোকান। সেখানে মুদি থেকে চাল, কেরোসিন তেল সংসারের টুকিটাকি সবই মোটামুটি পাওয়া যায়। পান এবং বিড়িও রাখে রুইদাস। প্রতিসপ্তাহে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে করে সদরে যায় রুইদাস, দোকানে যা যা লাগবে তা কিনে রাতের ট্রেনে ফেরে। সপ্তাহে ছয়দিন দুইবেলাই দোকান খোলা থাকে। আজ অবশ্য উৎসবের জন্য বন্ধ।
সুখটান দিতে বেশ লাগছিল নবীনের। ঝিমিঝিমে আবেশ।
তা দাদার নাম নবীন?
হুঁ।
পদবী?
আমি পথের ভিখিরি, আমার আবার পদবী!
তা বেশ বেশ। গানের গলাখানি সত্যিই সরেস। গান কোথায় শিখেছ? বাউল আখরায় ছিলে নাকি কখনও?
নবীন আরও সতর্ক হল। এত প্রশ্ন কেন করছে? ও বুলুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল নিতাইবাবু বলছিলেন আপনি রিপোর্টার, আপনি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার?
নিতাইবাবু মানে? ওই যে স্টেশনমাস্টারসাহেব।
ওহ উনি…না না আমি কোনও নিউজচ্যানেলের রিপোর্টার নই, উনি বুঝতে একটু ভুল করেছেন।
তাহলে? সিগারেটে টান দেওয়া থামিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল নবীন।
আসলে আমার নিজের একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে। মানে ভ্লগিং করি। উনি চ্যানেল শুনে ভেবেছেন টিভির নিউজচ্যানেল।
নবীন এতটাও আপডেট নয় যে ইউটিউব চ্যানেল, ভ্লগিং এসব জানবে। তাই বলল আসলে আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, তারপর এই পাড়াগাঁয়ে থাকি চ্যানেল বলতে ওই টিভিই বুঝি, আর কী যেন বললেন ভলিং…ওসব কী তা জানি না।
হা হা হা ভলিং না, ভলিং না ভ্লগিং। মানে আমি হলাম গিয়ে একজন শখের ভ্লগার। ব্যাপারটা বোঝাই আপনাকে, আমার আসলে অল্পবয়স থেকেই খুব ঘুরে বেড়ানোর শখ, ছোটবেলায় যেখানে বড় হয়েছি সেটা খুব খারাপ জায়গা ছিল, আর পরিবারের অবস্থাও তেমন ছিল না যে বেড়াতে নিয়ে যাবে তাই আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে মাঝেমাঝেই এদিক ওদিক ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম, তারপর সংসারের চাপে আরও নানাকারণে সেটা বন্ধ হয়ে গেছিল। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তারপর চাকরি পেলাম পুলিশে।
আপনি পুলিশে চাকরি করেন? চমকে উঠল নবীন।
হ্যাঁ ভাই, আমার স্বপ্নই ছিল পুলিশে চাকরি করার। অনেক কষ্ট করে চাকরি পাবার পর আবার বেরানোর নেশা চাগিয়ে উঠল। আবারও এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করলাম। এই মোবাইলে টুকটাক ভিডিও করতাম। একদিন সেগুলো দেখে একজন বলল একটা ইউটিউব চ্যনেল করতে। ইউটিউব চ্যানেল কিন্তু খবরের চ্যানেলের মত না, এখানে তুমি যা খুশি ভিডিও দিতে পারো। গান, বেড়ানো খাওয়াদাওয়া যা খুশি। তো সেই দাদা বলল ইউটিউব চ্যানেল খুলে সেখানে বেড়ানোর ভিডিও দিলে অনেক লোকে দেখবে, আর বেশি লোক দেখলে সেখান থেকে টাকাও রোজগার হতে পারে। তো দাদা আমিও এসব ব্যাপারে কিছুই তেমন জানতাম না। আমি একটু এমন জায়গায় ঘুরতে ভালবাসি যেসব জায়গাগুলো লোকে চেনে না, যায় না। তো সেইসব ভিডিও আমি আমার চ্যানেলে পোস্ট করতে থাকলাম, বললে বিশ্বাস করবে না দাদা, বছর দেড়েকের মধ্যে আমার চ্যানেল জমে গেল, এখন আমার প্রায় তিরিশহাজার সাবস্ক্রাইবার। এক একটা ভিডিও লাখের ওপর ভিউ। মানে লাখের ওপর লোক আমার ভিডিও নিয়মিত দেখে।
সবাই দেখে?
হ্যাঁ যার ইচ্ছা সেইই দেখে। বেড়ানোর ভিডিওর এখন হেব্বি ডিমান্ড। সবথেকে মজার ব্যাপার হল এখান থেকে আমার একটু চেনাজানাও বেড়েছে আর ইউটিউব থেকে টাকা পাওয়াও শুরু করেছি। খুবই সামান্য কিন্তু যা পাওয়া যায়। বেড়ানোও হচ্ছে আবার পকেটেও কিছু আসছে। হে হে হে। দাঁড়ান আপনাকে আমার চ্যনেলটা দেখাই বলে মোবাইলে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাটি করে বুলু সাঁতরা বলল ধুর এখানে তো নেটওয়ার্কই নেই। যাইহোক।
ইউটিউব ভ্লগিং ইত্যাদি ব্যাপারগুলো নবীন যে খুব বুঝল তা নয়, তবে ওর প্রখর বুদ্ধি, কিছুটা আন্দাজ করে ফেলল লোকটা কেমন। তবে বিশ্বাস করার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু বুলু নামটা…মনের ভেতরে খচখচ করছে। খুব ভালভাবে তাকাল নবীন বুলুর দিকে। চেনা লাগছে কি? উঁহু…আবার মনে হচ্ছে কোথাও যেন দেখেছি।
কী এমন করে দেখছ ভাই?
নাহ কিছু না। নবীন এড়িয়ে গেল। দেখল নিতাইবাবু সাইকেল চালিয়ে আসছেন।
ওদের দুজনকে দেখে একগাল হেসে বললেন, এই তো এসে গেলাম। তা দাদা রঙিনপুর কেমন লাগছে বলুন?
দারুন! ভাগ্যিস নেমেছিলাম। অসাধারণ লাগছে।
কিন্তু আপনার ফেরার ট্রেন সেই সন্ধেবেলা। তার আগে চাইলেও ফিরতে পারবেন না।
তা নিয়ে কোনও অসুবিধা নেই। এখানেই থেকে যাব। আমার সেসব অভ্যাস আছে।
নবীন বলল এখানে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। আপনাকে ফিরতে হবে।
সে দেখা যাবে, তেমন হলে তোমার সঙ্গে প্ল্যাটফর্মেই থেকে যাব রাতটা। গল্পগুজব করে কেটে যাবে। নবীন কোনও উত্তর দিল না। বুলু কি নবীনকে আরও জানার চেষ্টা করছে? কেন?
নিতাইবাবু ঘেমে গেছেন। এখন চড়া রোদ। হরিসভার সামনে খানিকটা কাপড় দিয়ে ঢাকা হয়েছে কিন্তু তা সামান্যই। রোদ আটকাচ্ছে না। দুপুরে ভোগ খাবার ব্যবস্থা ওই নাটমন্দিরেই হবে। দুপুর গড়িয়ে এসেছে। খিচুড়ি, লাবড়া বানানো শেষ। এবার ভোগারতি হবে। বড় থালা করে খিচুড়ি আর লাবড়া এনে রাখা হল বিগ্রহের সামনে। আরতির ব্জন্য পঞ্চপ্রদীপে সলতে বসাচ্ছে একজন। পুজোর দায়িত্বে রয়েছে বাদল গোঁসাই। অনেক বয়স। এখন আর বাইরে যান না, এই মন্দিরেরই পুজো আচ্চা নিয়ে থাকেন। ভারি ভালমানুষ। ভোগ হবে বলে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল আর নাটমন্দিরে যারা কীর্তন করছেন এবং শুনছেন সকলেই উঠে দাঁড়ালেন। ভোগারতির কীর্তন শুরু হল এবারে। সকলে দুই হাত তুলে গাইতে থাকল-
শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু কর অবধান।
ভোগ মন্দিরে প্রভু করহ পয়ান॥
বামেতে অদ্বৈত প্রভু দক্ষিণে নিতাই।
মধ্যাসনে বসিলেন চৈতন্য গোসাঞি॥
বুলু সাঁতরা আবার মোবাইল বার করে ভিডিও করতে যাচ্ছিল, নবীন বারণ করল, বলল ভোগের ছবি তুলতে নেই। এমনি দেখুন।
ও সরি সরি…বলে বুলুও উঠে এল নাটমন্দিরে।
ভোজনের দ্রব্য যত রাখি সারি সারি।
তাহার উপরে দিলা তুলসী মঞ্জরী॥
শাক সুকুতা নানা উপহার।
আনন্দে ভোজন করেন শচীর কুমার॥
কীর্তনের সুরে কথায় একটা আলাদা মাদকতা রয়েছে, ঈশ্বরে ভক্তি-বিশ্বাস না থাকলেও এমন একটা পরিবেশ যেখানে সকল মানুষ কৃষ্ণপ্রেমে গদগদ হয়ে মনের সুখে গাইছে সেখান পৃথক থাকা যায় না, অতিবড় নাস্তিকও পৃথক থাকতে পারে না।
নাহি জানি পরিপাটি না জানি রন্ধন।
সুখা রুখা একমুষ্টি করহ ভোজন।।
ভোজন করেন প্রভু কত কুতূহলে।
প্রেমানন্দে ভক্তগণ হরি হরি বলে।।
হরিবোল হরিবোল…ধ্বনি উঠল, সঙ্গে মহিলারা উলু দিলেন। মন্দিরের দরজা খুলে গেল, শুরু হল আরতি। খোল করতাল হারমোনিয়ামের সঙ্গে ঘন্টা, কাঁসরের শব্দ মিশল।
ফুলের পাঁপড়ি যত উড়ে পড়ে গায়।
তার মধ্যে মহাপ্রভু সুখে নিদ্রা যায়।।
স্বেদ ঝরে বিন্দু বিন্দু শ্রীগৌরাঙ্গের গায়।
নরহরি গদাধর চামর ঢুলায়।।
আরতির শেষদিকে বাদল গোঁসাই যখন চামর দুলিয়ে যুগলকে হাওয়া করছেন তখন নাটমন্দিরের সকলে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য শুরু করল। সকলেই কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর। নবীন আর নিতাইবাবুও বাদ রইলেন না, নৃত্যের মধ্যে যে অকৃত্রিম উন্মাদনা রয়েছে, আনন্দ রয়েছে তা শরীর আর মনকে সবথেকে বেশি তাজা করে দেয়। অনেক শোক-তাপ ভুলিয়ে দেয় ব্যাকরণহীন নৃত্য। নিতাইবাবু ইশারায় বুলু সাঁতরাকেও ডাকলেন। বুলুরও ইচ্ছা করছিল, ডাক পেয়ে আর কালক্ষয় না করে সেও মিশে গেল দলে।
খোল-কর্তালের বোল সঙ্গে গান-
আনন্দে বল হরি ভজ বৃন্দাবন
শ্রী গুরু বৈষ্ণব পদে মজাইয়া মন
শ্রী গুরু বৈষ্ণব পদ পদ্ম করি আশ
নাম সঙ্কীর্ত্তন কহে নরোত্তম দাস
সকলেই গাইছে, নৃত্য করছে। হরিধ্বনি উঠছে মুহুর্মুহু। অপূর্ব পরবেশ।
নিতাই গৌর হরি বল গৌর হরি বল
নিতাই গৌর হরি বল গৌর হরি বল…
থামল কীর্তন নৃত্য। তারপর শ্রীগুরু প্রেমানন্দে হরি হরি বোল বলে কীর্তন শেষ হল। এবারে ভোগের পালা।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। চড়া রোদ বাইরে। দমকা গরম হাওয়া দিচ্ছে মাঝেমাঝে। কিন্তু তারজন্য রঙিনপুরের মানুষদের উৎসাহে মোটে ভাঁটা পড়েনি। বুলু সাঁতরা এখানে নতুন লোক। অনেকেই এসে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কে? তারপর পরিচয় পেয়ে বললেন ভোগ খেয়ে যাবেন।
শালপাতার থালায় গরম খিচুড়ি আর লাবড়া, আহা যেন অমৃত! বুলু সাঁতরা এখানে অতিথি বলে সকলে একটু বেশিই খাতির করল। এখানে তো বাইরের লোকজন কেউই আসে না তাই একজন অতিথিকে পেয়ে সহজসরল মানুষগুলো খুব খুশি। নবীন পুরো সময়টা কড়া নজর রাখল বুলুর ওপর। ওকে বোঝার চেষ্টা করছিল। বুলু সাঁতরা…নামটা খুব চেনা লাগছে। টাকমাথা মোটা গোঁফের আড়ালে থাকা মানুষটাকে মনে করার চেষ্টা করছিল।
বিকেলে রঙিনপুর ছেড়ে নবীন, নিতাইবাবু আর বিলু পায়ে হেঁটে ফিরছিল স্টেশনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে বুলু অনেক কথাই বলছিল। এখানে এসে ওর যে কী আনন্দ হল তা বারবার বলতে থাকল। কথার ফাঁকে নবীন আচমকাই জিজ্ঞাসা করল আপনার বাড়ি যেন কোথায় বললেন?
আমি এখন থাকি শাকিলপাড়া, ওটা টিটাগরের কাছে।
এখন থাকেন? তাহলে আগে কোথায় থাকতেন?
বিলু বলল আসলে আমার ছোটবেলাটা কেটেছে বস্তিতে। শান্তিপুরে পালবাজার নামে একটা বস্তি ছিল…মানে এখনও আছে হয়ত আমি জানি না, ওখানেই আমার বড় হয়ে ওঠা। আমার বাবা ছিলেন কলমিস্তিরি…
নবীনের কানে আর কিছু ঢুকছিল না, ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে, নাকের পাটা ফুলে উঠছে। আর বাকিটুকু না শুনলেও হবে।
# # #
কিন্তু জানো ভাই তোমাকে কিন্তু আমার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে, আমাদের কি আগে কখনও দেখা হয়েছিল? স্টেশন পৌঁছে নিতাইবাবুর ঘরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নবীনকে জিজ্ঞাসা করল বুলু।
হতেও পারে আবার নাও হতে পারে, আপনিও ঘুরে বেড়ান। আমিও ভবঘুরে। কোথাও হয়ত দেখা হলেও হতে পারে, দুনিয়া তো খুব ছোট।
না সে ঠিক কথা, কিন্তু আমি বলছি আমার কেন জানি না তোমাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আচ্ছা তোমার ছোটবেলা কোথায় কেটেছে?
নবীন জানত এই প্রশ্ন ওকে শুনতে হবে। ও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল নবদ্বীপে।
নবদ্বীপের কোথায়?
শ্রীবাসঅঙ্গনের ঠিক পাশের গলিতেই ছিল আমাদের বাড়ি। আমার বাবা ছিলেন শ্রীবাসঅঙ্গনের একজন সেবাইত। পোড়ামা তলার ওখানে বাবার একটি ফুল-মালার দোকান ছিল।
ওহ আচ্ছা। আসলে…বলে থেমে গেল বুলু।
কী আসলে? বলুনই না।
আমি যেখানে বড় হয়েছি সেই বস্তিতে আমার এক বন্ধু ছিল তার নাম ছিল হারু। ওর গানের গলা ছিল অসাধারণ, মায়ের কাছে গান শিখেছিল, আমার খুব বন্ধু ছিল…
নবীন স্থির হয়ে তাকিয়েছিল বুলুর দিকে। আর বুঝতে বাকি নেই। নবীন চিনে ফেলেছে ওর বন্ধুকে। কিন্তু এতদিন পর পুরনো বন্ধুকে আচমকা কাছে পেয়ে খুশি তো নয়ই বরং আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত পেল। বুলু আর নবীন দুজনেরই অনেক বয়স হয়েছে, প্রায় কুড়িবছর পর আচমকা এইভাবে দেখা, বুলুর মাথায় টাক আর নবীনের মাথাভরা চুল এবং দাড়িগোঁফ। আচরণ, কন্ঠস্বর সবই বদলে গেছে তাই দেখে চেনার উপায় নেই, একমাত্র পুরনো কথা স্মরণ করিয়ে দিলেই তখনই চেনার কথা। বুলু সেই চেষ্টা করছে আর নবীন বারবার পিছলে যাচ্ছে। ওর মাথায় ঘুরছে অনেক চিন্তা। বুলু এখানে পৌঁছেছে কীভাবে? পুরোপুরি কাকতালীয় নাকি পিছনে কোনও গল্প আছে? কেউ পাঠিয়েছে ওকে? বুলু যে বলছে ওই টিউব চ্যানেলফ্যানেল ওগুলো কি সত্যি নাকি ও এসেছে নবীনের ছবি তুলতে। বুলু পুলিশে চাকরি করে। ও একসময় বলত বড় হয়ে পুলিশে চাকরি করার ইচ্ছা, সেই ইচ্ছা পূরণ করেছে। ও কি নবীনকে ধরার জন্যই এসেছে? সন্ধে সাতটা নাগাদ ট্রেনটা আসে। সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ নিতাইবাবু বললেন, তবে বুলুবাবু আপনার সেই বন্ধু কেমন ছিলেন তা আপনিই জানেন তবে আমি এইটুকু বলতে পারি নবীন না থাকলে আমার লাইফে বড় ক্ষতি হয়ে যেত। মানে দেখছেন তো এই শ্মশানে একা দিনের পর দিন পড়ে থাকি, নবীনভায়া ম্যাজিক জানে, এমন সব কান্ড ওর মাথায় আসে যে একাকীত্বকে টেরই পেতে দেয় না। বলে তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার তো ট্রেন আসার সময় হয়ে গেল।
ম্যাজিক! তুমি সত্যিই ম্যাজিক জানো নাকি ভাই?
নবীন বলল, না না ওসব কিছু জানি না।
তাহলে নিতাইবাবু কী বলছেন?
উনি একটু বেশিই বলেন। তা আপনি আজই বাড়ি ফিরবেন তো?
হ্যাঁ তেমনই তো ইচ্ছা ছিল।
ছিল মানে? বাড়ি নাও ফিরতে পারেন?
মানুষের জীবন খুব অনিশ্চিত, বিশেষ করে আমার। কখন ফিরি, আদেও ফিরব কি না তা কে জানে?
আপনি বুঝি বিয়ে থা করেননি?
না না করেছি। আমার একটি আটবছরের ছেলেও আছে। ক্লাস সিক্সে পড়ে।
বাহ খুব ভাল। বললেন নিতাইবাবু।
আর আপনার পরিবারে কে আছেন?
আমার তেমন কেউ নেই ভাই। বিয়ে থা করিনি, মা মারা গেছেন অনেকবছর আগে। বাবা…এই যে আমার হাতে ফোনটা দেখছেন সারাদিনে কয়েকবার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলি, এইটুকুই শান্তি।
ওহ তাহলে আপনার মোবাইল টাওয়ার ধরে। আমার তো নো নেটওয়ার্ক হয়ে রয়েছে। রঙিনপল্লিতে তো পুরো নো নেটওয়ার্ক ছিল এখানে কখনও ধরছে কখনও ছাড়ছে।
নিতাইবাবু মৃদু হাসলেন। একবার নবীনের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন নবীনের কৃপায় আমার জীবনের সব নেটওয়ার্ক ওপেন হয়ে গেছে। সবসময় ফুল নেটওয়ার্ক।
তাই! কী করে?
নবীন বলল নিতাইবাবুর কথা ছাড়ুন, উনি আমাকে একটু বেশিই ভালবাসেন। আপনি ট্রেন মিস করলে আর ফিরতে পারবেন না।
তা ঠিক, তবে সত্যি কথা বলব একটা?
হ্যাঁ বলুন।
আমার আজকের রাতটা এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছা করছে। মানে আপনাদের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করতে ইচ্ছা করছে। আপনারা বিরক্ত হলে অবশ্য আমি অবশ্যই থাকব না। আসলে কী জানেন আমার এত ভাল লেগে গিয়েছে…
নবীন কিছু বলার আগেই নিতাইবাবু ফস করে বলে ফেললেন, তা ইচ্ছা হলে থেকে যান, আমাদের সঙ্গে রাতে দুমুঠো ভাত খেয়ে নেবেন। এতে আর কী আছে? নতুন মানুষ পেলে আমরাও একটু গল্পগাছা করতে পারি।
নবীন হাড়ে চটে গেল নিতাইবাবুর ওপর। লোকটা সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি করে। একদিকে সহজসরল মনে কোনও সন্দেহ প্যাঁচ ইত্যাদি নেই বলে নবীনের অনেক সুবিধা হয়েছে, কখনও নবীনের ব্যাপারে অতিরিক্তি কৌতুহল দেখান না, কিন্তু এই যে অচেনা সন্দেহজনক একটা লোককে ফস করে থাকতে বসতে দেওয়ার কোনো মানে হয়!
আচ্ছা নিতাইবাবু এই স্টেশন আপনি একাই সামলান?
হ্যাঁ বলতে পারেন একাই। একজন পোর্টার আর রিলিভার আছে তবে সেটা নাম কে ওয়াস্তে। খুব কমই টিকি পাওয়া যায় তাদের। বলতে পারেন একাই। তবে এই যে নবীন রয়েছে। সময় ভালই কেটে যায়।
বাহ। আমারও আপনাদের দুজনকে খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে জানেন। যদি অনুমতি করেন তাহলে রাতটা থেকে যেতে পারি, কথা দিচ্ছি বেশি বিরক্ত করব না।
বেশ তো থাকুন না। বলে নিতাইবাবু নবীনের দিকে তাকালেন।
নবীন এবার কিছুটা কড়াভাবেই জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে থাকতে কেন চাইছেন? আপনি কে?
আচমকা এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল বুলু। বলল, আমার নাম আর ঠিকানা তো আগেই বলেছি, বুলু সাঁতরা। আমি সঙ্গে আমার আধারকার্ড নিয়ে ঘুরি, তাই চাইলে দেখে নিতে পারেন, আর থেকে যাওয়ার কারণটাও বললাম, তবে আপনাদের অসুবিধা হলে কেনই বা থাকব। বেশ তাহলে উঠি, পরে আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে। বলে উঠে দাঁড়াল বুলু।
আরে মশাই আপনি রাগ করলেন নাকি? নিতাইবাবু বললেন, ও নবীনের কথায় কিছু মনে করবেন না, ও ছেলের বাইরেটা একটু শক্ত হলেও ভেতরটা নরম। আপনি চাইলে একরাত্রি থেকেই যান না আমাদের সঙ্গে। তিনজনে মিলে একটু গল্পগাছা হবে। আর নবীন চাইলে কোনও নতুন খেলাও খেলা যাবে।
নবীনের রাগ বাড়ছিল। ও চাইছিল বুলু এখান থেকে চলে যাক। বুলু হয় বুঝে গেছে নবীন কে অথবা এখনও বোঝেনি। যদি বুঝে গিয়ে থাকে তারপরেও চুপ করে রয়েছে মানে ভেতরে অন্য অভিসন্ধি রয়েছে, আর যদি সত্যিই এখনও না চিনে থাকে তাহলে আরও বেশিক্ষণ থাকলে কথায় কথায় ঠিক একসময় চিনে ফেলতে পারে। ছোটবেলার বন্ধুদের চিনে নিতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগে না। নবীন বারবার খেয়াল করছিল বুলু ওর দিকে একটু অন্যরকমভাবে তাকাচ্ছে, সেই তাকানোর মধ্যে কৌতুকময় জিজ্ঞাসা, যেন মুখে না বলেও বলতে চাইছে আমি তোকে চিনে ফেলেছি রে।
ওরা তিনজনে প্লাটফর্মে গেল। রাতের রঙিনপুর প্লাটফর্ম যেন অন্ধকার আকাশে একটা হলদেটে ম্রিয়মান তারা। দিনেরবেলা যে প্রচণ্ড গরম ছিল তা এখন উধাও, বরং মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। মন উদাস করে দেওয়া হাওয়া।
প্ল্যাটফর্মে এসে বুলু বলল আর জানি না এখানে আসা হবে কি না, তবে আপনাদের মনে থাকবে। জানো নবীনভাই, আমি ছোটবেলায় যে বস্তিতে কাটিয়েছি সেখানে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু ছিল কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল হারু। আমি আর ও কত যে সুন্দর সময় কাটিয়েছি, ভাবলে আমার আজও মনে ভরে ওঠে।
নিতাইবাবু জিজ্ঞাসা করলেন তা আপনার সেই বন্ধুর সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ নেই?
বুলু নবীনের দিকে তাকিয়ে বলল, নাহ সে অনেকদিন আগেই বস্তি ছেড়ে চলে গেছিল। অবশ্য যাওয়ার আগেও আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার, কিন্তু সে যে বরাবরের মত চলে যাচ্ছে সেটা তখনও বুঝিনি। অবশ্য ভালই করেছে। ও যা করেছে ঠিকই করেছে।
কী করেছিল? জিজ্ঞাসা করলেন নিতাইবাবু। তখনই অনেক দূর থেকে ট্রেনের আলো দেখা গেল।
নবীন চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ওই যে আমার ট্রেন আসছে বলেই বুলু আচমকা অদ্ভুত একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করল, আচ্ছা এই যে তেপান্তরের মাঠ। এর কি কোনও শেষ নেই? মানে রঙিনপুরর পর কী আছে? অন্তহীন মাঠ তো হতে পারে না।
নিতাইবাবু বললেন, হে হে তেপান্তর তো রূপকথায় রয়েছে, আমি অবশ্য এই মাঠটাকে তেপান্তরের ভাই দীপান্তর বলি। ট্রেনটা অনেক কাছে চলে এসেছে। আর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই প্ল্যাটফর্মে চলে আসবে। নিতাইবাবু বললেন, রঙিনপুরের পাশ দিয়ে যদি সোজা নাকবরাবর প্রায় আট-নয় কিলোমিটার হাঁটতে পারেন তাহলে ন্যাশনাল হাইওয়ে পাবেন।
পায়ে হেঁটে? এমনি কোনও গাড়ি বা বাইকটাইক।
না দাদা কিচ্ছু চালানো যাবে না। যা এবড়োখেবড়ো যাই চালাবেন উলটে পড়বেন। একমাত্র পায়ে হাঁটা। আর সেটাও খুব কঠিন। পুরো মরুভূমির মত। একবার দিশা হারালে মাঠের মাঝেই চক্কর কাটতে হবে।
ট্রেন এসে গেল। আজ কেউই নামল না। বুলু সাঁতরা বলল, আচ্ছা আসি, তারপর আচমকাই নবীনকে জড়িয়ে ধরে বলল, আসি ভাই, ভাল থেকো।
নবীন যেন ঝটকা খেল। কী যে হল, বুলু সবে ট্রেনে উঠতে যাবে নবীন বলে উঠল, আপনার খুব ইচ্ছা হলে আজ থেকেও যেতে পারেন, কাল সকালের ট্রেনে চলে যাবেন।
থমকে গেল বুলু। নবীনের দিকে তাকাল। নিতাইবাবু বললেন, হ্যাঁ ভাই থেকে যেতে পারেন।
বুলু ট্রেনে উঠে পড়েছে, ট্রেন হুইসেল দিল।
নবীন ঠান্ডাগলায় বলল, রাতে আমাদের সঙ্গে খেলতে চান তো চলে আসুন।
ট্রেনটা সবে ছেড়েছে, ইয়ে হুই না বাত- বলে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল বুলু। ওর চোখ-মুখে প্ল্যাটফর্মের ফ্যাকাশে আলো পড়েছে।
# # #
প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চেই বসেছিল তিনজন। তুমুল গল্প হচ্ছিল। অনেক গল্প। তবে নবীন প্রায় চুপ। ওর মাথায় অন্য প্ল্যান ঘুরঘুর করছে। নিতাইবাবু হঠাৎ বললেন, ওহো দেখুন দেখি, রাত আটটা বেজে গেছে এখনও বাবাকে ফোন করা হল না, এরপর বাবা শুয়ে পড়বে। বুড়ো মানুষ সারাদিন আমার অপেক্ষা করে বসে থাকে। বলেই নিতাইবাবু তার পকেট থেকে বোতামটেপা ফোনটা বার করে পিঁকপিঁক শব্দ করে কোনও একটি নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যালো বাবা, সরি বাবা একটু দেরি হয়ে গেল। আজ আমাদের এখানে একজন এসেছেন, তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল। তোমার খাওয়া হয়ে গেছে? ওষুধ খেয়েছ?
বুলু একটু অবাকই হল নিতাইবাবু কেমন যেন গড়গড় করে কথা বলে যাচ্ছেন ওইদিকে বাবা কী বলছেন তা শোনার যেন সময়ই নেই তার। ভারি অদ্ভুত তো। নবীনের দিকে তাকিয়ে বুলু দেখল নবীন গুনগুন করে কী একটা গান গাইছে।
হারু ভাই।
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ ভাই।
আমার নাম হারু নয়, নবীন।
সরি সরি…হ্যাঁ হ্যাঁ নবীন, নিজের বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে বেখেয়ালে ওর নামের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি। যা হোক বলছি আজ গান শোনাবে তো?
শোনাব। কী গান শুনতে চান বলুন?
বলছি, তার আগে আমাকে আপনি বলাটা ছাড়ো। আমি তো দিব্বি তুমি করে বলছি, তুমিও সেটাই বলো। বলে একটু চুপ থেকে বুলু বলল, চাইলে তুইও বলতে পারো।
নবীন এই কথার কোনও উত্তর দিল না।
ওদিকে নিতাইবাবু কথা বলে চলেছে, আজ দুপুরে গেছিলাম রঙিনপুরে মোচ্ছবে। খুব চমৎকার ভোগ খেলাম। না না বেশি খাইনি। রাতে এই আলু, আর ডালসিদ্ধ দিয়ে ভাত বানাব। হ্যাঁ বাবা এবারে পুজোর সময় আমি যাবই, তোমার জন্য এবার একটা নীলরঙের পাঞ্জাবি কিনব। না না তুমি এখনও ইয়ং, তোমাকে দারুণ মানাবে। হ্যাঁ বাবা এবারে আমি আসবই। আমি রাখি। তুমি শুয়ে পড়ো আর রাত কোরো না। বলে ফোন কেটে দিলেন নিতাইবাবু। বুলুর কাছে এসে একগাল হেসে বললেন, আসলে মানুষটা সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে আমি কখন ফোন করব।
কিন্তু আপনি তো বাবাকে প্রায় কথাই বলতে দিলেন না, নিজেই বলে গেলেন দেখলাম। ওরও তো কিছু বলার থাকতে পারে।
বুলুর এই কথা শুনে নিতাইবাবু বললেন, নাহ বাবার আর কিছু বলার নেই, আমারই অনেক কথা বলা বাকি রয়ে গেছে বাবাকে।
বুলু একটু অবাক হল।
জানেন বুলুবাবু, আমার মা যখন মারা গেলেন তখন আমি ক্লাস সেভেন। বাবা কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি করতেন তখন। একদিকে অফিস অন্যদিকে আমি। বাবাকে অনেকে বলেছিল আরেকটা বিয়ে করে আমার জন্য মা নিয়ে আসতে, নইলে আমাকে দেখবে কে? বাবা কিন্তু রাজি হয়নি, একা সবদিক সামলেছে বাবা। নিজের চাকরি আমার লেখাপড়া, আমার যত্ন নেওয়া। দেখুন বুলুবাবু মায়ের বিকল্প কেউ নেই, তার স্নেহ তার যত্নের কোনও তুলনাই হয় না, তাই আমি একথা বলতে পারব না যে বাবা আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি, কিন্তু এই কথাও ঠিক বাবা সবসময় আমারকে আগলে রাখত, আমি কখনও একা বা অসহায় বোধ করিনি, সবসময় টের পেয়েছি বাবা সঙ্গে আছে। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না বুলুবাবু, আমি এখনও বিশ্বাস করি আমার বাবা এখনও আছে, আমাকে এখনও প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করে ঠিকমত খেয়েছিস? মনখারাপ করে থাকবি না, আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না তোফা আছি।
বুলুর ভুরু কুঁচকে গেল। বিশ্বাস করি এখনও আছে মানেটা ও ঠিক বুঝতে পারল না। বিশ্বাস-অবিশ্বাস করার ব্যাপার এখানে আসছেই বা কেন?
নিতাইবাবু সম্ভবত বুঝতে পারলেন বুলু সাঁতরার মনের প্রশ্নটা। তিনি মৃদু হেসে বললেন, আমি নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি কেন বললাম আমি বিশ্বাস করি বাবা এখনও আছে, তাই তো? বলে বুলুর উত্তরের অপেক্ষা না করে নিতাইবাবু বললেন, আমার বাবা আসলে গত ছয়মাস হল চলে গেছেন। বুঝলেন বুলুবাবু, ছয়মাস হয়ে গেল বাবা আর নেই। আমি বিয়ে থা করিনি, করার ইচ্ছেও নেই, তাই বাবাই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। আমার ট্রান্সফারের চাকরি আর বাবা অনেকদিন আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টের কারণে চলাফেরা বিশেষ করতে পারত না, বাড়িতেই থাকত। বীনাদি বলে একজন ছিলেন, তিনিই বাবার দেখাশোনা করতেন অনেকবছর ধরে। এখানে তো দেখতেই পাচ্ছেন মোবাইলের নেটওয়র্ক প্রায় থাকেই না, তাই আমি এমারজেন্সির জন্য পরের স্টেশনের আমার এক সহকর্মীর নাম্বারটা বাড়িতে দিয়ে রেখেছিলাম। একদিন সকালে সেই সহকর্মী বাইক চালিয়ে এসে আমাকে খবর দিল বাবার অবস্থা খারাপ। সে খারাপ বলেছিল ঠিকই কিন্তু বাড়ি পৌঁছে জানলাম বাবা চলে গেছিল। বিশ্বাস করবেন না বুলুবাবু, শ্মশানে বসে ঠিক করলাম চাকরি ছেড়ে দেব। আর কী হবে এসব করে। বাবার এই অনুপস্থিতি আমাকে পাগল করে তুলত। এমন নয় বাবার সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হত, কখনও নেটওয়ার্ক পেলে আমি আর বাবা কথা বলতাম। কিন্তু বাবা আছে, আমার কথা ভাবছে আমি সেটা ভেবেই আশ্বস্ত থাকতাম। আমি বিশ্বাস করুন পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন এই নবীন আমাকে বাঁচিয়ে দিল। আমার মোবাইলটা দেখে বলল, দেখুন নিতাইবাবু আপনার বাবাও ডেড আর আপনার এই মোবাইলটাও ডেড, একজন ডেড আরেকজন ডেডের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ করতে পারবে। আপনি বাবার নাম্বারে ফোন করুন, উনি ঠিক আপনার সঙ্গে কথা বলবে। আমি প্রথমে এমন উদ্ভট ছেলেখেলা করতে চাইনি, কিন্তু কী যে হল, মানুষ শোকে তাপে একলা থাকলে মরিয়া হয়ে যে কী না করতে পারে তার উদাহরণ হচ্ছি স্বয়ং আমি। নবীনের কথা শুনে আমি সত্যিই একদিন বাবার নাম্বারে ফোন করলাম। বাবা নেই, ফোন রিসিভ করার কেউ নে, নেটওয়ার্কও নেই, অথচ বাবা ফোনটা তুলল, আমরা দুজনে অনেক কথা বললাম।
আমরা?
হ্যাঁ আমরাই। মানে আমিই একা বলে যাচ্ছিলাম অথচ আমার মনে হচ্ছিল বাবা শুনছে, আর বলছেও। প্রথমে আমারই বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিন্তু জানেন তো বুলুবাবু, নবীন আমাকে বুঝিয়ে ছেড়েছে এই সংসারে বিশ্বাস অবিশ্বাস বলে শেষপর্যন্ত কিছুই হয় না। আমি আজন্ম যা অবিশ্বাস করে এসেছি তা এক মুহূর্তে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে যেতে পারে আবার চিরকালের বিশ্বাস একপলকে অবিশ্বাসের হয়ে উঠতে পারে। প্রথম দুইএকদিন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, ভাবছিলাম কী ছেলেমানুষী করছি, কিন্তু মানুষ চিরকালই ছেলেমানুষ। একটু খোঁচা খেলেই আচ্ছা আচ্ছা বড় মানুষের ছেলেমানুষী বেরিয়ে আসে। আমার একেবারে নেশা লেগে গেল বুঝলেন। এখন নিয়মিত বাবার সঙ্গে যখন খুশি কথা বলি, আমি জানি এটা পাগলামো, এটা ছেলেমানুষী, কিন্তু আমি আমার বাবাকে নিয়ে হ্যাপি, দ্যাটস অল। এন্ড অল ক্রেডিট গোজ টু নবীন। ও না থাকলে যে কী হত!
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন নিতাইবাবু। তারপর বললেন, জানেন এই নবীনের মাথায় এমন কত খেলা যে আসে। একা আছি বলে বুঝতেই পারি না।
নবীন নিতাইবাবুর কথায় মিটিমিটি হাসছিল।
বুলু বলল আপনি ঠিকই বলেছেন নিতাইবাবু, আমরা আসলে বড় হলেও মনের ভেতরে ছোটবেলাটাকে পুষে রেখেই দিই। এই যে আপনার কথা শুনে আমার ছোটবেলাটা মনে পড়ে যাচ্ছে। বস্তিতে আমার যে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর কথা বলছিলাম হারু, ওর মাথাতেও এমনই অদ্ভুত সব খেলার আইডিয়া আসত। ওর বানানো খেলা আমরা বন্ধুরা মিলে খেলতাম। একবার ও একটা খেলা বানাল রাতে যেদিন লোডশেডিং হবে সেদিন ঢিল-ঢিল খেলা হবে।
ঢিল ঢিল খেলা? সেটা কেমন? জিজ্ঞাসা করলেন নিতাইবাবু।
বুলু আবার তাকাল নবীনের দিকে। আশ্চর্য ভাবলেশহীনভাবে নবীন তাকিয়ে রয়েছে যেন এইসব কথা কিছুই ওর কানে ঢুকছে না।
বুলু বলল, আমাদের বস্তির বাইরে একটা ফাঁকা জমি ছিল। সেখানে বাড়ি হবে বলে বালি স্টোনচিপস ইত্যাদি ফেলে গেছিল প্রোমোটাররা। হারু বলল সবাই পকেটে স্টোনচিপস ভরে নে। আমরা সবাই অন্ধকারে লুকিয়ে থাকব যে যাকে দেখতে পাবে তার নাম ধরে স্টোনচিপস ছুঁড়ে মারবে। যদি নাম মিলে যায় স্টোনচিপস তার গায়ে লাগে সে খেলা থেকে আউট। দারুণ খেলা। লোডশেডিং হলেই আমরা পুরো বস্তি জুড়ে ওই খেলা খেলতাম। ছোটছোট পাথরের টুকরো কিন্তু জোরে ছুঁড়লে বেশ লাগত। তবে মজা হত খুব।
বাহ আপনার বন্ধু তো খুব গুণধর। বেশ ইনোভেটিভ। বলে হো হো করে হাসলেন নিতাইবাবু।
ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। চরাচর জুড়ে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার আর সেই অন্ধকারে একফোঁটা আলোর নিচে বসে তিনজন পুরুষ বিচিত্র গল্পে মশগুল।
হ্যাঁ সত্যিই গুণধর। ওর গলায় যে কী অপূর্ব বাউল গান ছিল দাদা সে কী বলব! আমরা শুনতাম আর মুগ্ধ হয়ে যেতাম। কাকিমার কাছ থেকে শিখেছিল হারু। ও যদি গানের চর্চাটা চালিয়ে যেত আজ মস্তবড় শিল্পী হত। আমি হারুকে বলতাম আমি বড় হয়ে পুলিশ হব আর তুই হবি গায়ক।
হারু হেসে বলত নাহ আমি হব ডাকাত। তুই আমাকে ধরবি।
আপনার সেই বন্ধুর আর কোনও খোঁজ নেই?
নাহ…একটা বাজে ঘটনা ঘটেছিল, তারপর হারু উধাও হয়ে গেল। তবে আমি মনে করি হারু হয়ত ঠিকই করেছিল…আমি নিজে পুলিশ হয়ে বলছি সবকিছু আইন দিয়ে মীমাংসা করা যায় না।
কেন কী ঘটেছিল আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন নিতাইবাবু।
বুলু আবারও নবীনের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর বলল, নাহ বাদ দিন সেসব পুরনো কথা। তবে মজা কী জানেন এই দুনিয়াটা গোল। সবকিছু যতই দূরে যাক একদিন না একদিন আবার দূরে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া জিনিস বা মানুষকে ঠিক খুঁজে পাওয়া যায়।
তা ঠিক বলেছেন। পৃথিবীটা গোল…গোলই বটে। আবার গোলমেলেও বটে। হে হে হে বলে হেসে উঠলেন নিতাইবাবু তবে আপনার বন্ধুর সঙ্গে আমাদের নবীনের বেশ মিল আছে। তা নবীন বুলুবাবুর ঐ ঢিল-ঢিল খেলাটা কিন্তু বেশ মজার। কী বলো?
হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ল নবীন। দেখুন বুলুবাবু আপনাকে একটা কথা বলি, আমি আর নবীন এই রঙিনপুরে কিন্তু এখনও রঙিন রয়েছি, আমাদের ছেলেবেলা এখনও হারায়নি। আমরা দুজনে এখনও ছোটদের মতই অনেক খেলা খেলি। এখানে কেউ আমাদের ব্যঙ্গ করার নেই, কেউ কিছুই বলার নেই। তাই আমাদের যা মন চায় তাই করি। আপনার মনের ভেতরের ছোটবেলাটাও মনে হয় সবটা মরে যায়নি, তাই যদি জীবনে আরেকবার ছোটবেলা ফিরিয়ে আনতে চান তাহলে এইরাতে আমাদের সঙ্গে খেলতে রাজি হয়ে যান। এমন সুযোগ কিন্তু আর আসবে না বুলুবাবু।
নিতাইবাবুর কথায় কী যেন একটা ছিল বুলু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি রাজি। ভাই নবীন, তুমি কি আমাকে তোমাদের খেলায় নেবে?
নবীন মুচকি হেসে বলল, চলুন তাহলে আজ আপনার সেই বন্ধুর খেলাটাই খেলা যাক। বলে ও নিজের একতারা আর ঝোলাটাও সঙ্গে নিয়ে নিল।
এগুলো আবার নিচ্ছ কেন?
নবীন হেসে বলল এমনই।
আর কালবিলম্ব না করে ওরা তিনজন প্লাটফর্ম ছেড়ে নেমে পড়ল মাঠে। বেশ খানিকটা এগোল, এদিকে আর কোনও আলো নেই, আজ আকাশে চাঁদ নেই, তাই ঘন অন্ধকার। আকাশের ঘষাটে আলোয় যেটুকু সামান্য অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। নিতাইবাবু বললেন এই হল আমাদের খেলার জায়গা। এখানে লুকোনোর জন্য কিছু ঝোপঝাড় আর গাছ পাওয়া যাবে কিন্তু স্টোনচিপস তো পাওয়া যাবে না, মশাই। তাহলে কী হবে?
নবীন বলল, তাতে কী? মাটির ছোটখাটো ঢেলা তো আছে, ওতেই হয়ে যাবে।
তা ঠিক তবে সেই ঢেলা বেশি বড় না হয়ে যায়, তাহলে আবার খেলার বদলে অন্য ঠেলা সামলাতে হবে। তাই ছোটখাটো নিলেই ভাল।
বুলু বলল, হ্যাঁ সেটাই ঠিক। তবে খেলা শুরুর আগে যদি নবীনের গলায় এই খোলা মাঠে একটা গান শুনতাম তাহলে বেশ হত।
বাহ খুব ভাল প্রস্তাব।
নবীন বলল, বেশ তো কোন গান শুনতে চান বলুন?
উঁহু আপনি আজ্ঞে করলে হবে না। অন্তত তুমি করে বলো ভাই।
বেশ, তাই হোক, কোন গান শুনতে চাইছ বলো।
ওই গানটা কি তোমার মনে আছে নবীন? তোমায় ভজে সব হারালাম হলাম ভিখারি।
হ্যাঁ আমি জানি গানটা।
বাহ তাহলে শোনাও।
নবীন ওই ফাঁকা অন্ধকার মাঠে খোলা গলায় গান ধরল-
গৌর তোমায় ভজে সব হারালাম হলাম ভিখারি
আমার ধন কুল মান জীবন যৌবন সব নিল গৌরহরি…
নবীনের সঙ্গে গলা মেলাল নিতাইবাবু আর বুলু।
তোমায় ভজে সব হারালাম হলাম ভিখারি।
গাইতে গাইতেই তিনজনে মাঠ থেকে কুড়োতে থাকল ছোটছোট মাটির ঢেলা।
ওহে ব্রজের চোর তোমার সকলই গোচর
ব্রজগোপীর মনহরা রাধার চিত্ত চোর
চুরি করতে করতে তোমার জনম গেল
তবু স্বভাব গেল না চুরির
হলাম ভিখারি…
নবীনের মনে পড়ছিল অল্পবয়সে বুলুর মুখটা কেমন ছিল…মনে পড়ছিল বস্তির দিনগুলোর কথা, কত খেলা, কত গল্প কত স্বপ্ন দেখা একসঙ্গে। নবীনের মনে পড়ল মায়ের মুখখানা। আর পরক্ষণেই মনে এল বাবার থ্যাতলানো মাথাটা। বাবার একটা চোখ বেরিয়ে এসেছিল। একমাত্র সেদিনই খুব খুঁটিয়ে মন দিয়ে বাবার মুখের দিকে দেখেছিল নবীন। হাতের মুঠোয় তখনও শক্ত করে ধরে রেখেছিল রক্তলাগা হাতুড়িটা। বাবার মাথায় প্রথমবার সপাটে আঘাত করার ঠিক আগের মুহূর্তে ও সংশয়ে ছিল আদৌ পারবে তো? কিন্তু যখন থপ করে একটা ভোঁতা শব্দ করে হাতুড়িটা বাবার মাথার পিছনে আঘাত করল, সেই শব্দটার মধ্যে একটা তীব্র ভয় মেশানো আনন্দ ছিল। বাবা তখনই লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। মদ খেয়ে থাকার কারণে নিজেকে বাঁচানোর ক্ষমতাও বাবার ছিল না। তারপর নবীন বাবার ওপর চেপে বসে ওই হাতুড়িটা দিয়ে মনের সুখে মুখে মাথায় পরপর অনেকগুলো আঘাত করে গেছিল। একটানা। রক্ত ঘিলু ছিটকে ছিটকে পড়ছিল, থপ থপ করে শব্দ হচ্ছিল প্রতিটি আঘাতে। বাবার মুখটা আর চেনার মত ছিল না। কতদিনের জমে ওঠা রাগ, ঘেন্না সেদিন টক বমির মত হড়হড় করে বেরিয়ে আসছিল। কী আরাম কী আরাম! নবীনের জামা, হাত, মুখে রক্তের ছিটে। হাতুড়িটা ফেলে দিয়ে একসময় উঠে দাঁড়িয়েছিল ও। ঘেমে স্নান। গায়ের জামাটা খুলে সেটা দিয়েই নিজের মুখ হাত মুছল, প্যান্টেও রক্ত লেগে রয়েছে দেখে প্যান্টটাও খুলে ফেলল, সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে নবীন নিজের লিঙ্গটাকে মুঠোয় ধরল। ওর প্রচন্ড পেচ্ছাপ পেল। ওখানে দাঁড়িয়ে বাবার গায়ে, মুখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেচ্ছাপ করল। রক্তে পেচ্ছাপে ভেসে গেল মেঝে। আহ কী আরাম! তারপর ঘরের ভেতরে রাখা খাবার জলের বোতল থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে হাত-মুখে জল ছিটিয়ে একটা শার্টপ্যান্ট পরল। বাবার পকেট হাতড়ে কিছু খুচরো পেল। সেটা পকেটে ভরে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে এল। হন হন করে হাঁটতে শুরু করল। এখান থেকে পালাতে হবে। অনেক দূর পালাতে হবে। বস্তির শেষে রাস্তার ঠিক মুখে বুলুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
ও গৌর হরি আমি উপায় কী করি
তোমায় ভজে তোমায় না পাই এই দুখে মরি
এ কুল যাবার নয় আর যাবে না হে
গৌর না হলে কৃপা তোমারি
হলাম ভিখারি…
গান শেষ হতেই তিনজন মানুষ মুঠোভর্তি ঢেলা নিয়ে তিনদিকে ছুট লাগাল। বুলু ভাবছিল হারু কী করে সেদিন ওর বাবাকে এতটা নৃশংসভাবে খুন করতে পেরেছিল! কত রাগ জমিয়ে রেখেছিল ছেলেটা! পুলিশ এসেছিল পরেরদিন। বডিটা ভরা হয়েছিল বস্তায়। পুলিশ অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। বুলুকেও করেছিল। বুলু বলেছিল ও কিছুই জানে না, হারুকে দেখেনি। বন্ধু হিসেবে ওর এটাই সঠিক মনে হয়েছিল। যে বাসে হারু উঠেছিল সেটা দেখেছিল বুলু। ওর মন খারাপ হয়েছিল আর কোনোদিন হয়ত হারুর সঙ্গে দেখা হবে না এই ভেবে। মনে মনে চেয়েছিল পুলিশ যেন কোনওদিন হারুকে খুঁজে না পায়। হারুর জন্য অনেকদিন মন খারাপ ছিল বুলুর। ওদের ঝুপরিটা দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে পড়েছিল তারপর আবার সেই ঝুপরিতে নতুন লোক এল। সবকিছু আগের মত স্বাভাবিক হয়ে এল। বুলু বন্ধুবিচ্ছেদ ভুলে পুলিশ হওয়ার স্বপ্নে এগোল। স্কুল পাশ করেই পুলিশের পরীক্ষা দেওয়া শুরু। তিনবারের চেষ্টায় লেগে গেল কনস্টেবলের চাকরি। তারপর বস্তি থেকে চলে যাওয়া, নতুন জায়গায় ঘর নেওয়া, বিয়ে, সন্তান। আজ সবমিলিয়ে বুলু ঘোরতর সংসারী একজন মানুষ, তবে মনের ভেতরে সেই এলোমেলো বেড়ানোর ইচ্ছেটা আজও পুষে রেখেছে। হারুর সঙ্গে একসময় কত যে এখান-ওখান গেছে ও। হারিয়েও গেছে বেশ কয়েকবার। কতকাল আগের কথা!
নিতাইবাবু লুকিয়েছেন একটি গাছের আড়ালে। নবীন একটা ঝোপের পাশে লুকিয়ে বসে ভাবছিল সেদিনের কথা। বাবাকে খুন করে কোথায় পালাবে বুঝতে পারছিল না। বাসে করে অনেকটা পথ যাওয়ার পর ওর মনে হল এখনই বুঝি বাসে পুলিশ উঠবে। বুলু কি বলে দেবে পুলিশকে ও কোন বাসে উঠেছে? বুলু দেখেছে। মাঝপথে নেমে গেছিল নবীন। বেশ খানিকটা পথ পায়ে হেঁটে ঘুরেছিল। খালি মনে হছিল পিছনে পুলিশ ধাওয়া করেছে। একটা ট্রাক দাঁড়িয়েছিল রাস্তার পাশে। তার ডালায় উঠে বসেছিল। ওখানে বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই। ঘুম ভেঙেছিল পরদিন সকালে। ট্রাকটা তখনও চলছে। একটা ধাবায় যখন দাঁড়াল সেখান থেকে নেমে পড়েছিল। জায়গাটা কোথায় কিছুই জানা নেই। এলোমেলো ঘোরাঘুরি। তারপর টুকটাক এখানে ওখানে ফাইফরমাস খাটা। একদিন এক কীর্তনের আসরে গিয়ে বসল। লীলাকীর্তনের আসর। চেনা পদ। নবীনও গলা মেলাল। মূল গায়েন নবীনের গলা শুনে কাছে ডেকে বললেন, কোথায় শিখেছিস এই পদ? গা তো ভাল করে। সেই আসরে নবীন পর-পর গোষ্ঠলীলার গান গেয়েছিল। দলের অধিকারী কেষ্টবাবু বললেন, আমাদের দলে চলে আয়। থাকা খাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। আবার শুরু গানের জীবন। তখন ওর নতুন নাম পবন। কেষ্টবাবুর কাছে নতুন করে কীর্তনের তালিম। একদিন এক দারোগার বাড়িতে অষ্টপ্রহরের বায়না এল। নবীন বলল আমি যাব না। কেষ্টবাবু চেপে ধরলেন, তুই শালা পুলিশ দেখলে এত ভয় পাস কেন? চোর-ডাকাত নাকি রে তুই? কী করেছিস সত্যিকথা বল? নইলে আমিই তোকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। নবীন সেইরাত্রেই দল ছেড়ে পালাল। পালানোর আগে হারমোনিয়াম দিয়ে আফিম খেয়ে ঘুমোনো কেষ্টবাবুর মাথাটা থেতো করে দিয়েছিল। নবীনের মনে হয়েছিল কেষ্টবাবু বুঝি সব জেনে গেছে। এই ভয় ওকে আজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। আজও বেড়াচ্ছে। কোথাও গিয়ে শান্তি পায় না নবীন। খালি মনে হয় এই বুঝি ধরা পড়ে গেল। পুলিশ বুঝি আজও ওকে খুঁজছে। এই বুঝি ওকে কেউ চিনে ফেলল!
শুরু হল খেলা। যে যাকে দেখতে পাবে সে কে সেটা আন্দাজ করে তার নাম বলে তার গায়ে ঢেলা ছুঁড়ে মারতে হবে। যদি আন্দাজ মিলে যায় এবং ঢেলা গায়ে লাগে, তাহলে সেই ব্যক্তি আউট।
তিনজনই লুকিয়ে একে অপরকে খুঁজছে। বুলুর একটু অসুবিধা হচ্ছিল। এত এবড়োখেবড়ো জমি! ও হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকল। নিতাইবাবুও একটু কুঁজো হয়ে খুঁজছে। বুলু নিজেকে আড়াল করার জন্য একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। আচমকাই টের পেল ওর পিছনে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে।
বুলু পিছনে ফিরল, তারপর এই অন্ধকারময় খোলা মাঠে ওর ছোটবেলার পুরনো বন্ধুকে এত কাছে পেয়ে বর নরমভাবে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছিস হারু?
নবীন বলল, ভাল আছি। বলেই ওর হাতে ধরা ইঁটের মত শক্ত মাটির বড় চাঁইটা সটান বসিয়ে দিল বুলুর মাথায়। বুলুর মুখ থেকে মৃদু ওঁক করে শব্দ হল। লুটিয়ে পড়ল মাঠে। মাটির চাঁইটা দিয়ে আরও কয়েকবার বুলুর মাথায় আঘাত করল নবীন। যখন বুঝল বুলু আর নেই তখন হাঁটতে শুরু করল। এখন ওকে প্রায় আট-দশ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। তারপর হাইওয়ে। সেখান থেকে কিছু একটা পেয়ে যাবে। আবার নতুন কোনও জায়গার সন্ধান। বুলুর জন্য মন খারাপ করল নবীনের। এখানে ও না এলেই ভাল করত…
নিবিড় অন্ধকারে নবীন পা চালাতে থাকল। আর নিতাইবাবু একা একা ওই অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে ডাকতে থাকলেন ও নবীন কই গেলে…বুলুবাবু…ও বুলুবাবু…
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
Onobodyo