novel-sokhi-songbad

সখী সংবাদ
রাজশ্রী বসু অধিকারী


ঘড়িতে চোখ রেখে একটুক্ষণ বসে থাকে রক্তিমা। রক্তিমা সেনগুপ্ত। কাল পর পর দু’টো শো আছে। অ্যাকাডেমীতে এবং মধুসূদন মঞ্চে। এখন মাথায় শুধু চরিত্রগুলোই থাকা উচিত। ডায়লগ সব ঠোঁটস্থ থাকলেও আবারও স্ক্রিপ্টগুলো নিয়েই দেখা উচিত। কিন্তু উচিত কাজগুলোর কিছুই হচ্ছে না। বারবার চোখ যাচ্ছে ঘড়ির দিকে। আজো সেই ফোনটা এল না। যেটা গত সাত মাস প্রতি রাত্রে এসেছে। যেটা না এলে ওর আর ঘুম আসে না।

মোবাইল বিশেষ সুরে ডেকে ওঠে। অরুণাভ। স্ক্রীনে না তাকিয়েই অলস গলায় বলে রক্তিমা,

“বল, তোমাদের ডিনার হয়েছে? পুপু ঘুমিয়ে পড়ল নাকি পড়ছে এখনো?”

ওপাশে হাল্কা হাসির শব্দ, “এগুলো সব রুটিন প্রশ্ন তাই না? অভ্যাস হয়ে গেছে তোমার দেখেছ?”

“হ্যাঁ … বয়স পাল্টে দেয় অনেক। তাছাড়া তোমাদের রেগুলারের খবর না জানলে ঠিক…”

“সব ঠিক আছে। পুপু তোমাকে মেসেজ করে শুয়ে পড়ল। ভোরে ওর কোচিং আছে। কিন্তু তোমার গলাটা এরকম লাগছে কেন?”

“কি রকম?”

আবার হাসে অরুণাভ, “আরে বাবা আমার কি অত ভাষা আছে নাকি? কাঠখোট্টা ব্যবসায়ী মানুষ। বুঝিয়ে বলতে পারব না। কেমন যেন মনে হচ্ছে তোমার গলার ভেতরে একটা ধূ ধূ মাঠ ঢুকে পড়েছে …”

“সেই মাঠে বুঝি গাছ নেই একটাও? একটুও ছায়া নেই? শুধুই রুক্ষ্ম পাথুরে একটা মাঠ? বল, একটুও ঘাসের ছোঁয়া নেই কোথাও? বল, বল না আর কি মনে হচ্ছে তোমার?”

“নাহ, এই ডায়লগগুলো তোমার মত সুন্দর করে আর কেউ বলতেই পারবে না। আচ্ছা বল, শ্রমণা ফোন করেছিল?”

শ্রমণার নামে মোবাইলের স্ক্রীন ঝাপসা হয়ে আসে। আর গলার ভেতরে ঢুকে পড়া সেই ধূ ধূ মাঠ, যাকে দিল্লি র ফ্ল্যাটে বসেও অরুণাভ দেখতে পাচ্ছে, সেই মাঠটা হঠাৎ গলা থেকে বুক, বুক থেকে সামনের মেঝে জোড়া কার্পেট ঢেকে ফেলে রক্তিমাকেও মুড়ে ফেলতে চায়।

“নাহ, করেনি ফোন। এই এবার যাব খেতে… ভাল লাগছে না কিছু। একা একা ভাল লাগেনা। তুমি তো জান। কি দরকার এসব নাম ডাকের? কেনই যে দৌড়চ্ছি জীবনভোর… ভাল লাগে না আর…”

“খুব খারাপ লাগার মধ্যে আছ আমি জানি। কিন্তু শোন, এটা তোমার জীবন, তোমার স্বপ্ন। অভিনয় ছেড়ে তুমি বাঁচতেই পারবেনা। এত মনখারাপ কোর না। সময়ের ওপরে ছেড়ে দাও। শ্রমণা বুঝবে কোথায় ভুল ছিল। বরং কালকের নাটকের কথা ভাব এখন।”

“ওকে। গুডনাইট। অ্যান্ড…”

“অ্যান্ড?”

“থ্যাঙ্কস …ওয়ান্স এগেইন …” তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার…”

ওপারে হা হা হাসি,

“শত্রুও আমি একজনই তাই তো? কিন্তু ভাল তো তুমি অনেকজনকেই বাসলে আজ পর্যন্ত …”

“এবার কিন্তু আমি রেগে যাব, তুমি কি শ্রমণাকেও হিংসে করবে?”

অরুণাভর গলা সিরীয়াস শোনায়, “হিংসে? এই শব্দটা কি আমি চিনি? তোমার অফুরন্ত ভালবাসার ভান্ডার তুমি যাকে খুশী দাও। তুমি মানুষটাই তো আমার। এখন আর একটুও না বসে থেকে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়বে, ব্যস …” কেটে যায় ফোন।

রক্তিমা কথাগুলো ভাবে। যখনি ও ভেঙ্গে পড়তে যায়, বহুদূর থেকেও এগিয়ে আসে উষ্ণ হাত দু’খানা। ঠিক বুঝে নেয় ভেতরের ভাংচুর। আশ্চর্য ক্ষমতা এই মানুষটার। লোকে বলে লং ডিসট্যান্স রিলেশনশীপের অনেক সমস্যা। আর দূরের দাম্পত্য? সে তো আরোই কন্টকময় নাকি। রক্তিমা ঠিক উল্টোটাই দেখছে জীবনভোর। যখন পুপুর ক্লাস সিক্স, রক্তিমা দিল্লি তে অরুণাভর ফ্ল্যাটে বসে চেষ্টা করে চলেছে ভাল মা ভাল বউ হওয়ার, চেষ্টা করছে গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় ছেড়ে আসার কষ্ট ভুলে থাকার, ঠিক সেই সময় পিপাসার্ত ওকে অরুণাভ হঠাৎ একদিন নিয়ে এল এক সুগভীর প্রশ্রবনের সামনে।

অফিস থেকে ফিরে একদিন খুব চিন্তিত ভাবে বলল, “একটু হেল্প করবে রুকু?”

“কি ব্যাপার?”

“নিউটাউনের ফ্ল্যাটটায় ইনটেরিয়রের কাজ শুরু করাব ভাবছি।”

“করাও না, কে বাধা দিচ্ছে?”

“কাউকে তো থাকতে হবে …”

“কে থাকবে? তুমি যাচ্ছ? কলকাতা?”

“আরে না না, আমি গেলে এদিকে কে সামলাবে!”

“তাহলে?”

“একটা উপায় আছে। তুমি গিয়ে কি কিছুদিন…”

“আমি? এখানে তোমরা, পুপুর স্কুল, তোমার বিজনেস, এই সংসার?”

“আরে দূর তুমিই করবে সব। ভিডিও কল আছে কি করতে? তাছাড়া পুপু এখন বড় হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে কোন চিন্তাই কোর না। আমি পরশু ফ্লাইটের টিকিট বুক করেই এসেছি। প্লিজ, তুমি কিছুদিনের জন্য চলে যাও। আসা যাওয়া তো চলবেই।”

রক্তিমা সন্দিহান হয়েছিল।

“মানে? কতদিন থাকতে হবে আমাকে ওখানে?”

“আপাততঃ তো একমাস। তারপর দেখাই যাক।”

মুখে আপত্তি করলেও সঙ্গোপনে আনন্দের সুর বেজেছিল। দিনকয়েক আগেই ওদের গ্রুপলিডার পলাশদা ফোনে আক্ষেপ করছিলেন, ওদের গ্রুপ সুচারু আবার করছে পলাশদারই লেখা সেই বিখ্যাত হয়ে ওঠা নাটক ‘অবিচল’, যার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারটা বাঁধা ছিল রক্তিমার জন্যই। ডায়লগগুলো এখনো মুখস্থ।

“তোমার এই অবিরাম ভালবাসার ছলে ক্লান্তিহীন ভাল না বাসা আমায় রোজ রক্তাক্ত করে, আমি মরে যাই প্রতি বর্ষা দুপুরে, প্রতি নিঝুম রাত্রে। আবার বেঁচে উঠি এক তীব্র নেশার বিষ গায়ে মেখে, আবার আশায় ভাসি। কেউ নিশ্চই আসবে, আমায় নিবিড় করে বাঁধবে। কিন্তু দিনের পর দিন যায়, না তুমি আস, না আমার প্রার্থিত রাত আসে। জীবনজুড়ে শুধুই রোদে পোড়া বালিয়াড়ি।”

উফফ, কি সব সীন, কি প্যাশন! রক্তিমা ফোন হাতে ফিরে গিয়েছিল বিয়ের আগের বছরগুলোয়। বিয়ের পরেও তো কত নাটক করেছে ও। পুপু হওয়ার পরেও। অরুণাভর উৎসাহেই করেছে। সংসারের জন্য সমস্যা হয়নি। কিন্তু অরুণাভ সাড়ে তিনবছরের পুপুকে নিয়ে দিল্লি আসার প্ল্যান করল। ওর ব্যবসা তখন আয়তনে বাড়ছে। রক্তিমাকে ও জোর করেনি কোন। জোর ব্যাপারটাই নেই ওর চরিত্রে। কিন্তু রক্তিমা কি করে ওর সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষকে ছেড়ে থেকে যাবে কলকাতায়? পারেনি ও। চলে এসেছে দিল্লি।

নতুন করে সংসার পেতেছে। নিজেকে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে নতুন পরিবেশে, নতুন স্রোতে। কিন্তু ভেতরের চাপা দুঃখটা ওকে ছাড়েনি। ছাইচাপা আগুনের মতই জ্বলে জ্বলে ওকে ক্ষয় করেছে নিত্যদিন। বন্ধুদের ফোন পেলে তাই নিমেষে আবার মন গিয়ে ছুঁয়ে আসে ভাঙ্গা রাজ্যপাট। সেখানে ধূলোজমা বন্ধ কপাট জুড়ে শুধু শেষরাতের চলে যাওয়া রেলবাঁশীর শব্দ।

তাই পলাশদা যখন সেদিন ফোনে বলেছিল, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে অবিচলের শ্বেতার ভূমিকায় দেখতে চায়না আমার মন আমার চোখ, কিন্তু কি করব ওটারই বুকিং পাচ্ছি বড় বড় জায়গা থেকে, রক্তিমার বুকের রক্ত ছলকে উঠেছিল। কষ্টে ভেসে গিয়েছিল ও। ভেবেছিল, যদি পারত নিজেকে আবার শ্বেতা করে তুলতে! আর একবার অন্তঃত! কিন্তু জীবনে সবকিছু একসঙ্গে আর কে কবেই বা পেয়েছে! রক্তিমাও বুঝিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। মনকে প্রশ্রয় না দিয়ে স্বান্তনার গলায় বলেছিল, “কেন মনখারাপ করছেন পলাশদা! কেতকীও তো ভালই করে অভিনয়টা। দেখবেন ও আপনার মুখ রাখবে।” পলাশ অস্ফূটে বলেছিল, “কিন্তু আমার শ্বেতা তুমি, একমাত্র তুমি। এখানে আমার মন কোনরকম কম্প্রোমাইজ করতেই চায়না।”

সেদিনের ফোনটা কেটে যাওয়ার পরেও ঘোর কাটেনি অনেকক্ষণ, অনেকঘন্টা। সেই ঘোরের মধ্যে অরুণাভ অফিস গেল, ফিরে এল, পুপু স্কুল গেল, কোচিং নিল, ঘুরে ফিরে এল ব্রেকফাষ্ট লাঞ্চ ডিনার। রক্তিমা সব করেছে, শুধু ওর মন থেকে থেকেই শ্বেতা হয়ে উঠছিল। ওই নাটকটা তো মুখস্থ ওর। মুছতে চায়নি। তাই মোছেওনি।

তারই কয়েকদিন পর অরুণাভর অদ্ভুত প্রস্তাব। রক্তিমা মনখারাপের কষ্ট আর উত্তেজনার ভালোলাগা একসঙ্গে বুকে চেপে আবার কলকাতায় এলো। দেখা করতে গেল গ্রুপে। এবং শ্বেতা হয়ে মঞ্চেও নামল। পলাশদার অনুরোধ ও ফেলতেই পারেনি। তারপর আরো একবার, তারপর আবার, আবার, আবার …। কলকাতার সব বড় বড় স্টেজে শো করেছে ওরা। কখন অরুণাভর দেওয়া একমাস শেষ হয়ে দুই তিন চার পাঁচ সংখ্যাগুলো পেরিয়ে গেছে মন তাকে মনে রাখেনি। এরমধ্যে অরুণাভ কলকাতায় এসেছে প্রায় প্রতিমাসেই। পুপুও এসেছে দু’বার। রক্তিমা গিয়েছে তিনবার। তারপর থেকে কবে কখন যেন এই যাওয়া আসাটাই ওর নিয়তি হয়ে গেল। কিভাবে একের পর এক সফল শো পেরিয়ে রক্তিমা এখন এই শহরের এক নম্বর মঞ্চাভিনেত্রী সে একটা ইতিহাস। শুধু একটাই কথা ওর মনে শেকড় গেঁড়ে থাকে সবসময়, অরুণাভ না থাকলে আজকের রক্তিমাকে চিনতই না পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমী জগত।

অরুণাভর কথামতোই সামান্য কিছু মুখে দিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে ও বহুক্ষণ। চোখও বুজেছে। কিন্তু ঘুম আসে কই! বোজা চোখের তলায় কেন ভীড় করে আসে অজস্র মুখের ছবি! কত কতবার মায়ায় জড়িয়ে নিজেকে দীর্ন করল রক্তিমা, কতবার ভেঙ্গে খান খান হল! আবার অরুণাভ সেই টুকরোগুলো কুড়িয়ে এনে জোড়া দিল অতিযত্নে! এই ভাঙ্গা আর জোড়ার কি কোনদিন শেষ হবেনা! কতবার না রক্তিমা প্রতিজ্ঞা করল কাউকে ঢুকতেই দেবেনা ওর মনের ভেতরঘরে? তাহলে কেন বারবার এক একজন মানুষ ঝড়ের মত এসে দেউড়ী পার করে ভেতরে ঢুকে পরে? ঘুম না আসা রাত্রে এপাশ ওপাশ করে রক্তিমা। নিশ্চুপ মোবাইলটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। আবার ছুড়ে ফেলে দেয় বালিশের পাশে। ঘুম আসছেনা। আসছেনা কারণ গত সাতমাস এইসময়টা ওর কেটে গেছে অনর্গল কথা বলে। রাত একটা দুটো তিনটে…, কত কত নির্ঘুম রাত্রি, কত অজস্র অর্থহীন কথা, হা হা হাসির স্রোত ভরে রেখেছে ওকে একনাগাড়ে গত সাতমাস। নিজেকে ভুলে গিয়েছিল রক্তিমা। ভুলে গিয়েছিল নিজের বয়স, অবস্থান, গাম্ভীর্য্য। শুধু মধ্যরাত্রের এই ফোনটা ওকে একটানে নিয়ে গেছে কোন সুদূর অতীতে, কুড়ি কুড়ি বছর পেছনে, কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায়।

অরুণাভ হয়তো সত্যিই বলে। সত্যিই ওর বুকে রয়েছে ভালবাসার অফুরন্ত ভাণ্ডার। তাই তো বারে বারে উজার করে একূলে ওকূলে অকূলে বিলিয়েও, বারে বারে আঘাতে আঘাতে তছনছ হয়ে যেতে যেতেও তা ফুরোয় না। বারে বারে বিফল প্রতিজ্ঞারা ওকে দেখে হেসে চলে যায় ঘরের বাইরে। রক্তিমার ব্যর্থ ভালবাসার ঝুলিতে এবারে নবতম সংযোজন শ্রমণা। গত সাতমাসে একমুহূর্তের জন্যও ওর মনে হয়নি শ্রমণার কাছ থেকে আসতে পারে ওর একাধিক বিগত ভুলের পুনরাবৃত্তি।

রাত দেড়টা। এপাশ ওপাশ করে ঘুমের সাধনায় অনেকটা সময় গেল। এবার একটা ট্যাবলেট না খেলে কাল শো টাইমে সমস্যা হবে। উঠে পড়ে রক্তিমা। ড্রয়্যার টেনে ট্যাবলেটের স্ট্রিপ হাতে নিয়ে একঝলক তাকায় পাশের সাদা খামটার দিকে। জানে ভেতরে কি আছে, তবু না খুলে পারে না। এক সেকেণ্ডের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে সেই ছবি। শ্রমণা দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রয়েছে ওকে। মুখে ভোরের আলোর মত হাসি, যেন কতই রাজ্যপাট পেয়ে গিয়েছে মেয়েটা! যেন এইটুকুই শুধু চাওয়া ছিল ওর জীবনের কাছে, একবার রক্তিমাকে জড়িয়ে ধরতে পারা, একবার হৃদয়ে হৃদয় যোগ করা।

মাঝরাত্রে একা ঘরে দাঁড়িয়ে গুন গুন সুর আসে গলায়, অবিচল নাটকে শ্বেতার ভূমিকায় এই রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছে কতবার …,

“হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয় / আধোখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয় / লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো বিশ্বাসে / শুধু আধখানি ভালবাসা …”

এটাও কি নাটক ছিল? সবটাই নাটক তবে? আবারও একটা নাটকে জীবন্ত অভিনয় চলল এতদিন মাঝরাত পর্যন্ত? অর্ধেক পরিচয়? অর্ধেক বিশ্বাস? অর্ধেক কথা? কিচ্ছু সম্পূর্ণ ছিল না? সম্পূর্ণ করে পাওয়া তবে কি? সম্পূর্ণ ভালবাসা তবে কাকে বলে? রক্তিমা আবারও ভুল ভালবাসার জন্য নিজেকে খরচ করে ফেলল? আরো একবার? এতটাই ভুল যে সারারাতের এই বিচ্ছিন্নতা ওকে আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দিচ্ছে! এই তীব্র যন্ত্রণা কাকে বলবে ও? কেমন করে বলবে? না শ্রমণা কোনদিন জানবে, না অরুণাভ, না পৃথিবীর অন্য কেউ। শুধু রক্তিমা শেষের দিকে আরো হাজার পা এগিয়ে যাবে।

ভালবাসা তবে কি? সে সারাজীবন ধরে বারে বারে মরীচিকার মায়ায় ভুলিয়ে যাবে? কোনদিন মরুদ্যান হয়ে ধরা দেবেনা? ভালবাসা নারীও নয় পুরুষও নয়, হয়তো ভালবাসা এক লিঙ্গহীন দুর্লঙ্ঘ্য শক্তি যাকে কিছুতেই অতিক্রম করা যায়না, সত্যি করে বাঁধা যায়না বাহুডোড়ে, শুধু ছায়ার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এই তো পেয়েছি, এই তো আমার সারাজীবনের প্রাপ্তি। তারপর কিছুদিনের পরিক্রমণ। কিছুদিন ডুবে থাকা অমোঘ মোহজালে। সেই পথের সঙ্গী হতে পারে যে কেউ। হতে পারে সে আমার সন্তান, হতে পারে সন্তানের পিতা, কিংবা অসংখ্য বিমুগ্ধকারী নারী পুরুষের যে কেউ। তখন কূলকিনারাহীন হয়ে শুধু ভেসে যাওয়া। তখন দিনরাত এক করে শুধু অপেক্ষা, শুধু একটু ছুঁয়ে থাকার জন্য আর্তি।

এমনই এক উত্তাল মুহূর্তে শ্রমণা এসেছিল আমার জীবনে। ঘুমের আশা ত্যাগ করে ট্যাবলেটের বদলে হাতের পাতায় ছবিটা নিয়ে সোফায় বসে দেখতে দেখতে ভাবে রক্তিমা। দেখব না দেখব না ভেবেও না দেখে পারেনা।

এই সেই মেয়ে, যে আমার কুড়ি বছর পরে এই পৃথিবীতে এসেছে। যে আমার মনের শক্ত প্রাচীরে ফাটল ধরানোর খেলায় মেতেছিল। সেই খেলাটা কখন সত্যি হয়ে দাঁড়াল! আমিও কবে যেন দু’আঙুলে ছুঁয়ে দিয়েছিলাম ওর সতেজ হাসিটা। আমার একমুহূর্তের জন্য মনে পড়েনি আমি ওর চেয়ে কুড়ি বছর ধরে বেশী চিনি এই পৃথিবীকে। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে রক্তিমা ফিরে যায় সেই প্রথম দিনটায়, যেদিন শ্রমণা এসেছিল ওর জীবনে।

সেদিন অবিচলের শো ছিল মহাজাতিসদনে। শ্বেতার অপোজিটে বরাবর পলাশদা নিজেই অভিনয় করে এসেছে। নাটক ছাড়াও পলাশদার অভিনয়ের ঝুলিতে আছে বেশ কিছু টেলিভিশন সিরিয়াল এবং কয়েকটা সিনেমার অভিজ্ঞতা। সে ভালরকম পরিচিত মুখ বাঙালি দর্শকের কাছে । কলকাতায় থাকতে শুরু করে, নাটক রেগুলার করার ফলে রক্তিমাও গোটা দুয়েক টিভি সিরিয়ালের অফার পেয়েছে কিন্তু মঞ্চই ওর ভালবাসা, তাই যায়নি। তাছাড়া এত বেশী দৌড় ওর পছন্দও নয়। অরুণাভ এবং পুপুর জন্য এই ব্যস্ত শিডিউল থেকেও সময় বের করতে ও ভালবাসে। সকালের ফ্লাইটে রক্তিমা দিল্লি যাবে। তাই তাড়াতাড়ি মুখের মেকাপ তুলছিল নাটক শেষে। পলাশদা এসে ঢোকে।

“রক্তিমা, তোমার কাছে একজনকে নিয়ে এলাম। আলাপ করতে চায় …”

“এখন? কিন্তু আমি তো এক্ষুনি বেড়িয়ে যাব। কাল ভোরে ওঠা আছে …” বেসিনে মুখ ধুতে ধুতেই বলেছিল ও।

“আরে ও তো চলেই এসেছে। কতক্ষণ আর লাগবে! একটু চা খেয়ে যাও বরং। আমি আসছি …”

পলাশদা বাইরে চলে গেলে পেছন ফিরে তাকিয়ে শ্রমণাকে দেখেছিল রক্তিমা। বছর তিরিশের একটি ছিপছিপে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, মিষ্টি বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার মেয়ে। একটা লাল স্লীভলেস জাম্পসুটের ওপর কালো শ্রাগ চাপানো। সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিল ওর চোখদুট। একমুখ হাসল রক্তিমার দিকে তাকিয়ে। আর রক্তিমার মনে হল আরো দশটা টিউব লাইট জ্বলে উঠল যেন ঘরে। ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, “বাহ…”

“কী?” সে প্রশ্ন করেছিল। ঘাড় নাড়ে রক্তিমা, “নাহ কিছু না।” তারপর নিজস্ব গাম্ভীর্য বজায় রেখে স্মিত হেসে বলেছিল, “তোমার নামটা?”

“আমি শ্রমণা। শ্রমণা চ্যাটার্জী। আমি আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখব?”

রক্তিমা অবাক, “মানে?”

অকপট গলায় নিজের মুগ্ধতা ব্যক্ত করেছিল শ্রমণা, “আপনার সব শো, কলকাতায়, কলকাতার বাইরে, যেখানে যা হয়েছে দেখেছি আমি। কতদিন ভেবেছি হাতদুটো একটু ছুঁয়ে দেখব। কি অপূর্ব আপনার অভিনয় … কি অপূর্ব সুন্দর আপনি… আমি রাত্রে স্বপ্নেও দেখেছি আপনাকে … কোনদিন ভাবতেই পারিনি এই এত কাছে থেকে দেখতে পাব …”

রক্তিমা জানে, এই মুগ্ধতার ধারাস্রোত না থামালে থামে না। বেশ কৌতুক হয় ওর। বাড়ি যাওয়ার তাড়া ভুলে বসেই পড়ে চেয়ার টেনে, “তাই? তাহলে এতদিন আসনি কেন দেখা করতে? এলেই পারতে!”

এবার একটা অন্যরকম আলোর ছাপ লাগে মেয়েটার মুখে। ঠিক লজ্জাও নয় অথচ যেন ভারী আনন্দের একটা পাতলা পর্দা লেগে আছে চোখদুটোয়। তড়বড় করে বলে ওঠে, “এতদিন তো পলাশদার সঙ্গেও আলাপ ছিলনা। অত বড় অভিনেতা! কথাই বলবেন কিনা জানিনা তো! এখন তো…” আরো একটা আলোর আভা এসে ওর মুখে ছড়িয়ে যায়। রক্তিমা হাসি চেপে দেখছিল।

“কি এখন? কথা বলেছে? আমার কাছে নিয়েও এসেছে, তাই তো?”

“এখন তো পলাশদার সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গিয়েছে। এই তো উনি আমাকে এখানে আপনাদের গ্রুপে একটা কাজও দেবেন বলেছেন। পরে কখনো কোন নাটকে রোলও দেবেন। নেক্সট সানডে আসতে বললেন রিহার্সাল রুমে।”

গ্রুপের বেশ ভাল ইনকাম হচ্ছে আজকাল। একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট রাখার কথা হচ্ছে শুনেইছিল রক্তিমা। পলাশদা বোধহয় সেজন্যই একে ডেকেছেন। যাইহোক মেয়েটাকে ভাল লেগে গিয়েছিল ওর। তাই ফোন নম্বর চাইলে না করতে পারেনি। যাওয়ার সময় শ্রমণা সত্যি ওর হাতদুটো ধরেছিল। নিজের চোখে ঠোঁটে ছুঁইয়েছিল সেই হাত। বেশ অবাক লেগেছিল রক্তিমার। ওর অভিনয়ের পর অনেকেই এসেছে অটোগ্রাফ নিতে বা আলাপ করতে। কিন্তু এরকম কেউ করেনি। আর শ্রমণার ওই কয়েক সেকেন্ড চোখের পাতায় হাতটা ধরে থাকার মধ্যে দিয়েই বোধহয় ওদের মধ্যে একটা অলিখিত সম্পর্কেরও সূত্রপাত ঘটে গিয়েছিল।

ফেরার পথে গাড়ীতে মনে পড়ছিল ওর পাহাড়ী ঝর্নার মত হাসি, কথা, তাকানো। কিন্তু একটা কথাই শুধু বোঝা যায়নি, ওর সঙ্গে পলাশদার পরিচয়টা কতদিনের। পলাশদা মাঝে মাঝে এমনভাবে কথা বলে রক্তিমার সঙ্গে, যে কেউ ভেবে নেবে যে গভীর প্রেমের ব্যাপার আছে, কিন্তু ওটা প্রেম নয় তা রক্তিমা খুব ভাল করে জানে। সৃষ্টিশীল মানুষেরা একটু বেশী আবেগী হন। আর যেহেতু ওর নিজেরও কোন প্রেম নেই পলাশের ওপর তাই শ্রমণার সঙ্গে পরিচয়ের দৈর্ঘ্য নিয়ে বারকয়েক ভাবলেও ও বিশেষ চিন্তিত হল না। তবে একটা সুন্দর বন্ধুত্ব তো আছেই পলাশদার সঙ্গে, আছে সেই সম্পর্কজনিত কিছুটা অধিকারবোধ। তাই একথাটা হাল্কা ভাবে মনে এসেছিল, পলাশদা আগে বলতেই পারত শ্রমণার কথা। আজকেও এমনভাবে ওকে নিয়ে এল যেন ও একজন ফ্যান মাত্র। যাকগে, এত ভেবে লাভ নেই। কারো পার্সোনাল স্পেসে ঢোকার অভ্যাস নেই রক্তিমার।

বাড়ি ফিরে হাল্কা লাগেজ প্যাক করে ঘুমোতে যাবে এমন সময় একটা মেসেজ এল।

“আপনি ভীষণ সুইট। আর পেন্ড্যান্টটা জাষ্ট ফাটাফাটি। ইউ লুক অসাম। কিন্তু রেড লিপষ্টিকটা আরেকটু ডার্ক শেড হলে ভাল লাগবে।”

বাব্বা! ওইটুকু মেয়ে কতখানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে ওকে, আবার এত রাত অবধি মনেও রেখেছে। মনে মনে হেসে একটা বয়সোচিত হাফগম্ভীর স্মাইলি পাঠিয়েছিল ও। ওকে অনেকখানি অবাক করে তার উত্তরে এলো তিনটে লাভ সাইন। হয়তো আজকালকার মেয়েরা এইরকমই। কথায় কথায় ছোট বড় সবার ক্ষেত্রেই তারা লাভসাইন ব্যবহার করে। রক্তিমা তো আজ পর্যন্ত দু’তিনজনকে ছাড়া পাঠাতেই পারল না। তাঁদের মধ্যে সেই লাভসাইনের মর্যাদা একমাত্র অরুণাভই রেখে চলেছে আজো পর্যন্ত। বাকীরা তো কবেই কুপোকাত। তবুও এখনো যে কাউকে কাউকে দেখলে লাভসাইন পাঠাতে মন যায়না তা নয়। তাই বলে এই হাঁটুর বয়সী পুঁচকে মেয়েটাকে! কক্ষনো না। মোবাইল বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল ও।

ভোর বেলায় ঘুম ভাঙ্গতেই মেসেজ, হাই সুইটি, গুডমর্নিং। তোমার ফ্লাইট সাড়ে আটটায়, তুমি নিশ্চয়ই সাড়ে ছ’টার মধ্যেই এয়ার পোর্টে পৌঁছে যাব! তারপর বোর হবে বসে বসে! আমি তোমায় ফোন করব ঠিক সাতটায়। তার আগে তুমি তোমার অন্য ফোনগুলো সেরে রেখো। লাভ ইউ। বাই।

অবাক হয়ে লাইনগুলোয় বারবার চোখ বোলায় রক্তিমা। এই মেয়েটা ওর থেকে কুড়ি বছরের ছোট! কেউ বলবে এই মেসেজ দেখে! পাগলী একটা। আচ্ছা দেখাই যাবে ও কি বলে। সময়টা তো কাটবে।

প্রথম ফোনটা এসেছিল ঠিক সাতটায়। তারপরেই খিলখিল হাসি, “বরকে ফোন করে নিয়েছো তো? আমি কিন্তু এখন ছাড়ছি না তোমাকে। অ্যালার্ম দিয়ে উঠেছি আজকে। নইলে আমার টাইম দশটা। আর শোন আমি কিন্তু ওসব আপনি আপনি বলতে পারব না।”

তারপর অনর্গল কথা। ওর ছোটবেলা, স্কুলিং, ফ্যামিলি, বাড়ি, ছোটবেলা ইত্যাদি অনেক কিছুই জানা হয়ে গিয়েছিল রক্তিমার ওই একঘন্টা সময়ে। কখন যেন বয়সের ব্যবধান ভুলে নিজেও বলে ফেলেছিল অনেক কথা, স্কুল, ছেলেবেলা।

সেই শুরু।

রক্তিমা দিল্লি পৌঁছে অরুণাভ আর পুপুকে নানা কথার মধ্যে সোৎসাহে শ্রমণার গল্প করেছিল।

“তোর মাম্মার নতুন বন্ধু শ্রমণা চ্যাটার্জী, বুঝলি পুপু? বুম্বাকাকু, অভিমন্যু, ঋতম, উর্জা সব পেরিয়ে এখন শ্রমণা নতুন বন্ধু।” অরুণাভ খাওয়ার টেবিলে বসে হাসতে হাসতে বলে।

“যাহ, শ্রমণা আমার বন্ধু কি করে হবে? ওইটুকু মেয়ে!” রক্তিমা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল অরুণাভর কথা। কিন্তু রাত্রিবেলায় আবার ফোন আসে শ্রমণার।

“কি গো, কি করছ? কেমন লাগছে এতদিন পর বরের কাছে গিয়ে? আমার কথা মনে পড়েছে একবারও? নিশ্চয়ই না …”

রক্তিমা ওর কথা শুনে হাঁ হয়ে যায়। কথা শুনে যে কারুর মনে হবে ওর সমবয়সী কোন বন্ধু। কেউ বলবে না যে এই মেয়েটা ওর চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট।

“কি গো! এত চুপ কেন? ভিডিও কল করব একবার? তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”

চমকে উঠেছিল রক্তিমা, “ভিডিও কল? এমা না না … শুয়ে পড়েছি তো …”

খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে গিয়েছিল শ্রমণা, “সেজন্যই তো দেখতে চাইছি। তোমাকে রাত্রিবেলায় কেমন দেখায়…”

রক্তিমা চুপ। বলে কি মেয়েটা!

“শোন শোন একটা কথা, আমাকে কিন্তু তুমি লেসবিয়ান ভেবো না। আমি একদম স্ট্রেট। কিন্তু আমি মনে হচ্ছে তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি।”

এবার রক্তিমাও হেসেছিল, “প্রেম? সেটা কি বস্তু?”

“কেন? তুমি কোনদিন কারো প্রেমে পড়োনি? আমি তো পড়েছি। এখন তো দারুউউণ ভাবে প্রেমে পড়ে আছি একজনের। বলব তোমায় সব। ভীষণ ভালবাসি তাকে। কিন্তু সেও কি আমাকে ভালবাসে? আমি জানি না। কনফিউজড লাগছে। কখনো মনে হয় সেও আমাকে খুব ভালবাসে, আবার কখনো…”

রক্তিমা হব না হব না করেও কৌতূহলী না হয়ে পারেনি।

“আমি জিজ্ঞেস করব না সে কে। কিন্তু অবশ্যই আমার জানতে ইচ্ছে করছে …”

“বলব। তোমাকে না বলে তো পারব না …”

“কেন? আমাকে না বলে পারবে না কেন? এই তো দুদিনের আলাপ…”

“এটা না আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। তোমাকে কেন যে মনে হয় চিরদিনের চেনা, সবচাইতে আপনজন! যখন তোমার সঙ্গে আলাপ হয়নি তখনও মনে হয়েছে, এখন তো দিনরাত তোমার কথাই মনে হচ্ছে।”

“এই রে! তাহলে তো তোমার প্রেমিক ইনসিকিওরড হয়ে পড়বে!” রক্তিমা কখন থেকে যেন সমানতালেই ঠাট্টা করতে শুরু করেছিল। শ্রমণা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে, “ই ই ই স …, তা কখনোই হবে না। সেও তো তোমাকে খুবই ভালবাসে। আমি জানি।”

রক্তিমা ভেবে পায়নি কে হতে পারে। কে আছে যে ওকেও ভালবাসে আবার এইটুকু মেয়েটার মনেও এমন শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে! মুখে কিছু জিজ্ঞেস না করে সেদিনের মতো ফোন বন্ধ করেছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জাও যে লাগেনি তা নয়। রাত বারোটা কখন পার হয়ে গেছে। অরুণাভ খুবই ভালমানুষ, তাই কিছুই বলে না। অন্য বর হলে এই রাত জেগে কথা বলা কখনোই সহ্য করবে না।

দিল্লিতে যে ক’দিন ছিল শ্রমণা রোজ ফোন করেছে। বলেছে তাড়াতাড়ি কলকাতা ফিরতে। ওর আর একটুও ভাল লাগছে না। রক্তিমা না থাকলে কলকাতাকে কলকাতাই মনে হয়না। সবকিছু বিস্বাদ লাগে। কিভাবে যে সম্পর্কটা এতো এগিয়ে এসেছে তা বোধহয় দু’জনের কেউই বলতে পারবে না। শুধু রক্তিমা অনুভব করেছে যে দিনের মধ্যে অন্তঃত তিন চারবার, কি গোওওও সুইটি, কি করছো না শুনলে আর রাত্রিবেলার ওই ফোনটা না এলে ওর আর কিছু ভাল লাগে না। কেমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে শ্রমণা। সব ফাঁকা লাগে, সব কেমন বিবর্ণ লাগে। এই অসম বন্ধুত্বের মায়াজালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়েই পড়েছে রক্তিমা।

ফিরে এল কলকাতায়। নাটকের সীজন। ভরপুর ব্যস্ততা। পলাশদার দম ফেলার সময় নেই। আরো তিনটে টিভি সিরিয়ালের শ্যুটিং চলছে একসাথে। কোনমতে এসে নাটকের শোগুলো করে যাচ্ছে। আর সুচারুতে অনেকদিনই জয়েন করেছে শ্রমণা। শুধু অ্যাকাউন্টসই নয়, এখন ওকে গ্রুপের বহু ব্যাপারেই ইনভলভ করে দিয়েছে পলাশদা। শ্রমণার কাজে মন আছে। যেটাই করে নিজের হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে দেয়। কাজেই দলের সবাই ওকে পছন্দও করে। রক্তিমার ভাল লাগে যখন কেউ ওর সামনে শ্রমণার প্রশংসা করে। মনে হয় ওর নিজেরই প্রশংসা হচ্ছে।

একদিন রাত্রে শ্রমণা বলল, “আচ্ছা , বলতো তোমার কি মনে হয়? পলাশদা আমাকে ভালবাসে?”

এই কথাটা আগেও বলেছে ও। ওদের সম্পর্কটা এখন আর রক্তিমার অজানা নেই। মেয়েটা পলাশদার কথায় কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়া নদীর মত কলকল করে বইতে থাকে, দেখে কি জানি কেন, অনেকদিনই রক্তিমার ভেতরে একটা ভয় কাজ করেছে। পলাশদা ওর এই তীব্র আবেগের উপযুক্ত মর্যাদা দেবে তো? মন ভরে গেলে একসময় ছুঁড়ে ফেলে দেবে না তো? শ্রমণার ভেঙ্গে পড়া চেহারাটা কল্পনা করে রক্তিমা নিজেও কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু যে মেয়ে ভালবাসায় এমন ডুবে আছে তাকে কি করে বলা যায় তুমি নিজেকে সংযত কর? তাহলে ওকেই ভুল বুঝবে হয়তো। পলাশদাকে ও নিজেও পছন্দ করে, কিন্তু খুব সত্যি কথাটা হল ভদ্রলোকের মানসিক গভীরতার ওপরে ওর খুব একটা আস্থা নেই। তাহলে এতদিনের সাধনার নাটককে অবহেলা করে কিছু বেশী পয়সা আর হাল্কা খ্যাতির জন্য ওই অন্তঃসার শূন্য টিভি সিরিয়ালগুলোর দিকে ছুটত না। যেদিন থেকে ওর এই হ্যাঙ্কারিংটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, রক্তিমা মন থেকে আর শ্রদ্ধা করতে পারে না পলাশদাকে। তাই ওর ভয় হয় এই মানুষটা পারবে তো শ্রমণার ভালবাসাকে মর্যাদা দিতে?

কিন্তু এসব কি বলা যায়? যার জীবন তাকেই তো প্রতিমুহূর্তের মূল্য চুকিয়ে দিয়ে বুঝতে হয় কোথায় আছে কাঁটা আর কোনখানে ফুল। আজও তাই কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করেই থাকে। কিন্তু আজ শ্রমণার কি হয়েছে! বারবার জিজ্ঞেস করেই যায় একই কথা। ভালবাসে কি পলাশদা ওকে!

“কি হলওওও! কিছু বলছো না কেন? তোমার যা মনে হচ্ছে সেটাই বল। তোমার মতটা আমার দরকার যে! কেন বুঝতে পারছো না!” ফোনের ওপারে অস্থির হয় শ্রমণা।

রক্তিমা ধীরে ধীরে বলেই ফেলেছিল কয়েকটা কথা, “শোন শ্রমণা, ভালবাসা এত সহজ তো নয়! একটা সত্যি ভালবাসা খুঁজে পেতে সারাজীবন লেগে যায়। যার কোম্পানী তোমার ভাল লাগে তার সঙ্গে তুমি ক্যাজুয়াল সময় কাটাও, আনন্দে থাক, ব্যস। এর বেশী কিছু জোর করে পেতে চাওয়াটা বোকামী হবে বলে আমার মনে হয়। যদি ভালবাসা থাকে তবে তুমি নিজেই তাকে চিনে নিতে পারবে। আর না থাকলেও কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।”

“হুমমম… বুঝলাম।” গম্ভীর হয়ে বলে শ্রমণা।

“ঘোড়ার ডিম বুঝেছো” হাওয়াটাকে একটু হাল্কা করতে চেয়েছে রক্তিমা, “আচ্ছা বল, পলাশদার সঙ্গে সেদিন যে ডিনারে গেলে, সে কি কি খাওয়াল? কি বলল?”

শ্রমণা গড় গড় করে বলে গিয়েছিল সারাসন্ধ্যার ইতিহাস। বলতে বলতে একবার এটাও বলে ফেলে, পলাশদা আর ওর মুখে রক্তিমা সম্মন্ধে একটাও কথা শুনতে চাইছেনা। বরং কিছুটা বিরক্তই হচ্ছে বারবার কথা ওঠানোয়। ও বলে যায় আর হাসে।

রক্তিমার ভাল লাগেনি। শুকনো গলায় বলেছে, “কিন্তু তোমাদের মধ্যে আমার কথা আসবেই বা কেন? তোমাদের নিজেদের কথা নেই? কি এত বল তুমি আমাকে নিয়ে?”

“ও আমার গোলু মোলু, তোমাকে নিয়ে কথা না বলে আমি তো থাকতেই পারি না, জান না তুমি? এই তো সামনে তোমার অ্যাওয়ার্ড সেরেমনি আসছে, তার প্ল্যানিং আছে, সব ব্যবস্থা করা আছে …”

“না। আমাকে নিয়ে নিজেদের ডেটিং-এ গিয়ে একটাও কথা বলবে না তুমি। আর শোন, যারা অ্যাওয়ার্ড দেবে তারা প্ল্যান করুক, সেজন্য গ্রুপের কোন প্রোগ্রামিং দরকার নেই। আমাকে নিয়ে কোন হৈ হট্টগোল পছন্দ নয় আমার।”

সদ্য সদ্য খবর এসেছে রাজ্যসরকারের একটি অতি সম্মানীয় পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে রক্তিমাকে মঞ্চাভিনেত্রী হিসেবে। এটা নিয়ে শ্রমণা ভীষণ উত্তেজিত ছিল। ও নিজের মত করে বহুকিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম করেই চলেছে। অরুণাভকেও পার্সোনালি ইনভাইট করে ফেলেছে। পুপুকেও বিশেষ করে আসতে বলেছে। গ্রুপের সকলের কাছ থেকে ক’দিন ধরেই রক্তিমা অজস্র অভিনন্দন ভালবাসা পেয়েই চলেছে। শুধু পলাশদাকে নিয়ে ওর মনে প্রশ্ন জমেছে একটু একটু করে। এখনো পর্যন্ত পলাশদা নিজে থেকে ওকে একবারও কংগ্র্যাচুলেট করেনি। আজ শ্রমণার কথা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় পলাশদা হয়তো কোথাও ইনসিকিওরিটিতে ভুগছে। রক্তিমার চেতনায় স্পষ্ট ধরা পড়ে, ওকে নিয়ে শ্রমণার মুগ্ধতা পলাশদা খোলা মনে নিতে পারছে না। এই পুরস্কারটাও হয়তো পলাশদাকে ওর থেকে আরো কিছুটা দূরেই নিয়ে গেল! আশ্চর্য লাগে ভাবলে। একদিন এই মানুষটাই ওকে বলেছিল, স্টেজগুলো ওর জন্য কাঁদছে, ও ছাড়া স্টেজ প্রাণ পায় না। আজকের রক্তিমাকে তৈরির পেছনে পলাশদার ভূমিকা কতখানি তা যখন ও নিজে ভুলতে পারেনি, সেই বা কি করে ভুলে গেল!

রক্তিমার কথায় রেগে উঠেছিল শ্রমণা। ও ছোট মেয়ে, এখনো অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। গ্রুপের লীডার যদি মন থেকে না চায় তবে কোন অনুষ্ঠান বা অভিনন্দনে যোগ দেওয়াটা সবার পক্ষেই অসম্মানজনক। ওকে বুঝিয়ে বলতে গিয়েও কথাটা এগোয় না। সেসবের ধারে কাছে না গিয়ে পুরো উল্টোমুখে ও বলে উঠল, “একটা খুব আনন্দের কথা তোমায় শেয়ার করব, বলো কাউকে এখন বলবে না?”

“কি?”

“পলাশদা আমায় বলেছে শ্বেতার রোলটা করতে, আগামী নাট্য উৎসবে…, আমি তো শুনেই পাগল হয়ে গেলাম। আমি কি পারব তোমার মত? কোনদিন স্টেজেই নামিনি তো…, প্লিজ প্লিজ প্লিজ তুমি আমাকে একটু গাইড করে দিও। তুমি তো শুনলাম দিল্লি চলে যাচ্ছ আগামী মাসে, বেশ অনেকদিনের জন্য …, তার আগে আমাকে তৈরী করে দেবে তো?” অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল শ্রমণা। আর রক্তিমার কানে ভাসছিল অনেকদিন আগে শোনা সেই কথাগুলো, তুমি ছাড়া আর কাউকে আমি শ্বেতা ভাবতেই পারিনা …।

হ্যাঁ আমার দিল্লি যাওয়ার দরকার। সামনে পুপুর বোর্ড এক্স্যাম। আমি পাশে থাকতে চাই। কিন্তু সেটা তো এই নাট্য উৎসবের পরে যাওয়ার কথা। আমার অবিচল করে দিয়ে পরদিনের ফ্লাইট ধরার কথা। আমায় না জানিয়ে আমার অজান্তে অনুষ্ঠানসূচী, নতুন হিরোয়িন সব ঠিক হয়ে গেল? এটা পলাশদা কি করল? একবার আমায় বলা গেল না এই শোটা শ্রমণাকে দেওয়া হচ্ছে? এই মানুষটার কথায় আমি জীবনটাকে একধারা থেকে টেনে এনে অন্য খাতে বইয়ে দিলাম!

নানা কথা ভেসে যায় বুকে। ওর গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করে। শ্রমণার অজস্র প্রশ্নের কোন উত্তর ওর কাছে ছিল না। গলায় একটা অজানা দমবন্ধ অনুভব। কি নাম এই অনুভূতির? হিংসে? কষ্ট? বঞ্চনা? বোঝেনা রক্তিমা। শ্রমণা এত ছোট, এতটাই ছোট ওর থেকে যে হিংসে করার চিন্তাটাও দুঃস্বপ্ন। ও রাতের পর রাত যে বন্ধুত্বটা তৈরী করে নিয়েছে, সেখানে ওকে পৃথিবীর অনেকটা উজার করে দেওয়া যায়। কিন্তু এই শ্বেতা চরিত্রটা! এটা দিতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? এমনও তো হতেই পারে যে ও অনেক বেশী ভাল করল! তাছাড়া সুচারু গ্রুপের সব সিদ্ধান্ত বরাবর পলাশদাই নিয়ে থাকে। নিজেকেই বারবার বোঝাতে চেষ্টা করে রক্তিমা। তবুও জেগে থাকে কাঁটা, অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে মন।

বাড়ি ফেরার পর ফোন করেছিল শ্রমণা। একবার নয়, বহুবার। কথা বলতেই ইচ্ছে করছিল না ওর। ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছে। নিজের ভেতরের এই রূপটা অজানাই ছিল। কার ওপর অভিমান করল রক্তিমা? পলাশদার ওপর? নাকি শ্রমণার ওপর? শ্রমণার কি দোষ? ও তো একটা ছোট মেয়ে। রক্তিমার বন্ধু হওয়ার যোগ্য কি ও? ওকে বড়জোর স্নেহ করা যায়, বন্ধু তো ভাবা যায় না, ঈর্ষাও করা যায় না। দু’দিন পরে যে রক্তিমা এতবড় একটা পুরস্কার পেতে যাচ্ছে! মন বড় না হলে সেটা নেবে কিভাবে!

ছি ছি! নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে রিং ব্যাক করতে যাচ্ছে এমন সময় ঢুকল মেসেজ,

“ও আমার সুইটি, বড্ড কষ্ট দিলে তুমি আমাকে। কেন দিলে? জান না তোমাকে কত্তো ভালবাসি? হয়তো সত্যিই জান না। জানাবার দায় নেই আমার। তোমার কথাই তোমাকে ফেরত দিচ্ছি। ভালবাসা সত্যি হলে একদিন তুমি নিজেই তাকে চিনে নেবে।

যাই হোক, শোন, আমি পলাশদাকে এইমাত্র জানিয়ে দিলাম যে শ্বেতা আমি করছি না। এবার আমার ফোন আর কাটবে না তো? বল?”

তীব্র লজ্জায় মরমে মরে যায় রক্তিমা। এইটুকু একটা মেয়েকে সে নিজের মন বোঝাবে কী করে! ফোন না ধরাটা ও নিজের মত করেই ব্যাখ্যা করে নিয়েছে নিশ্চই। শ্বেতার রোলটা করবে না জানিয়ে দেওয়া থেকে পরিষ্কার যে শ্রমণা ধরেই নিয়েছে ওকে শ্বেতা দেওয়াতে রক্তিমা রাগ করেছে। রক্তিমার অভিমানটা কি এবং কেন সেটা ও বুঝতেই পারেনি। রক্তিমার সঙ্গে পলাশদার অকারণ ইগোফাইট এবং সেখানে এত ছোট একটা মেয়েকে ঘুঁটি করা, এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে যে একটা আঠালো ঈর্ষার ময়লা লেগে আছে, সেই নোংরামির সঙ্গে যে রক্তিমা কখনো সহাবস্থান করতে পারবে না এই ঠিক ঠিক অনুভূতিগুলো কি বুঝবে ও? শ্রমণা অনেকটা ছোট। এই সম্পর্কের কি নাম! বন্ধুত্ব বলা যায় কি একে! সত্যি বন্ধুত্ব থাকলে কি ভুল বুঝে থাকতে পারবে! কথাগুলো একসঙ্গে বুকের ভেতরে ঠেলাঠেলি করে। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সেগুলোকে গুছিয়ে তুলে বুকের তলায় শ্রমণার ঘরটাতে রেখে দেয়। নিজেকে নিজেই আশ্বস্ত করে। না, শ্রমণা কখনো ওকে ভুল বুঝবে না। কাল ঠিক আবার রাত বারোটায় বেজে উঠবে কলস্বরে, হাই সুইটি …কি করছোওওও। ওকে ছেড়ে থাকতে পারবেনা শ্রমণা। রক্তিমা তো জানে, হাজারটা পলাশদাকে ও মুহূর্তে ত্যাগ করতে পারে ওর সুইটির জন্য।

নীল রাত আলোর দিকে প্রশ্ন ছোঁড়ে রক্তিমা, আমিও কি পারব? ওকে ছেড়ে থাকতে? জীবন শেষের মুখে এসে যখন আর কোন নতুন ভালবাসা পাওয়া বা দেওয়া বাকী নেই, সেইসময় অক্লান্ত শ্রমণাই তো পাহাড়ের পাথর ভেঙ্গে আবার ঝর্না ফুটিয়েছে। নীল রাতবাতির দিকে তাকিয়ে একা ঘরে একথা স্বীকার করতে রক্তিমারও বাধে না, না আমিও পারব না ওকে ছেড়ে থাকতে।

অপেক্ষা পরের দিনের ফোনের জন্য। আজও এই মোবাইল স্ক্রীনে সেই আলোজ্বলা হাসিটা ভেসে উঠল না। রক্তিমা শুয়ে আছে নীরব অন্ধকার গায়ে মেখে, এক এক করে কতগুলো রাত চলে গেল, ওকে হাত ধরে ঘুমের দেশে পৌঁছে দিল না সেই ওর চেয়ে অনেক ছোট মেয়েটা। ঘুম আসছে না। নিজেকে অনেক বয়স্ক লাগছে রক্তিমার, যা গত সাতমাসের একদিনও লাগেনি। আবার কি ও পারবে সেই তিরিশ বছর বয়সটা ছুঁয়ে আলোয় আলোয় ঘুরে আসতে? ও কি অপেক্ষা করেই যাবে? কাল কি সেই ফোনটা আসবে? কিংবা পরশু?




পলাশ দাঁড়িয়েছিল অ্যাকাডেমির সামনে। ওর সেই বিখ্যাত দুই পা ফাঁক করে দাঁড়ানো পোজ যা এতবছরেও পাল্টায়নি। আঙ্গুলের ফাঁকে পুরতে থাকা উদাসী সিগারেট। গায়ের ঘোলাটে হয়ে আসা সাদা কোঁচকানো পাঞ্জাবীটা বিনা প্রশ্নেই বলে দেয় অনেক কথা। এই যেমন এখন আর কেউ পলাশকে ডাকে না টিভির কোন সিরিয়ালের জন্য। পলাশের গ্রুপ থেকে লোকজন চলে যেতে যেতে একসময় গ্রুপটা ভেঙ্গেই গিয়েছে। পুরোনো চেনা পরিচিত বন্ধু বা সহ অভিনেতারা ওকে দেখতে পেলে এখন নিজের রাস্তা বদলে নেয়। না, ধার দিতে হবে এই ভয়ে যতটা না তারও চেয়ে বেশী আতঙ্কের, একবার দেখা হয়ে গেলে ঝাড়া একটা ঘন্টা পলাশ শুধু পুরনো কীর্তির স্মৃতি বর্ণনা করেই কাটিয়ে দেবে। এই ছুটন্ত শহরে কারো সময় নেই অতীত আঁকড়ে স্থবির বসে থাকার। তাই সোজা বাংলায় বলতে গেলে সবাই ওকে এড়িয়ে যায়। একমাত্র পলাশ অন্যরকম। সবার চেয়ে আলাদা সে। আগেও তাই ছিল, এখনো তাইই আছে। এই শহরের সবার চেয়ে আলাদা সে। এটা কারো বলে যাওয়া সাধারণ কথা নয়। বেশ কয়েকবছর আগে পলাশের কনুই ধরে থেকে এলোমেলো পা ফেলে হেঁটে যাওয়া এক মেয়ে এই কথাগুলো বলেছিল এক নাটকভাঙ্গা সন্ধ্যায়। তখন পলাশের গ্রুপ সুচারুর যে কোন নাটক দেখার জন্য এই গেটে এই চত্বরে নামত মানুষের ঢল। সেই জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে সূর্যের চেয়েও বেশী তেজ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই একই ভঙ্গীতে সিগারেটে টান দিত পলাশ। সেই রকম একটা সময়েই ওর কানের পাশে গুন গুন করে উঠেছিল এই কথাগুলো। সে ছিল এক সদ্যযুবতীর অকুন্ঠ আত্মনিবেদন।

সারা পৃথিবীর এত এত পরিবর্তন হয়ে গেল, পলাশের নিজের মধ্যে, ভেতরে বাইরে ঘটে গেল রীতিমত রাসায়নিক বদল কিন্তু কে জানে কেন ওই কথাগুলো ভুলতে পারলনা পলাশ। বরং আরো বেশী বিশ্বাস করে আঁকড়ে ধরল। আর সেই না ভোলা শব্দগুলো পলাশকে সত্যিই আর ফিরে আসতে দিল না নিজের সৃষ্টির ধারে কাছে। এখনো ও নিজেকে সবার থেকে আলাদাই মনে করে। সেই অহংবোধের কাছে হেরে গেল ওর সমস্ত প্রতিভা। এখন আর নাটক তৈরি করতে বা ডিরেকশন দিতে কেউ ডাকেনা ওকে। এমনকি ডাকে না কোন গুরুত্বপূর্ন চরিত্রেও। তবুও প্রতিদিন এইখানে এসে দাঁড়ানো চাই তার। ব্যাঁকাত্যাড়া শেষ সিগারেটটা পকেট থেকে বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে লম্বা টান দিয়ে তাকিয়ে থাকা চাই সামনের ভীড়ে, খোঁজা চাই চেনা মুখ।

আজো তাই করছিল। রক্তিমা খানিকটা পেছন থেকে দেখতে পায় ওকে। ডাকতে গিয়েও ডাকেনা। আসলে এখনো ও নিজের মনকে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে না। এই লোকটাকে আগের জায়গা যে আর দেওয়া যাবে না তাতে সন্দেহ নেই কোন। নিজেকে তন্ন তন্ন করে খুঁড়েও আর সেই শ্রদ্ধা, সেই ম্যাজিকটা টের পায়না। কিন্তু যা ওরা করতে যাচ্ছে সেই কাজ পলাশের চেয়ে আর কেই বা ভাল পারবে! অন্তঃত যে পলাশকে চেনে রক্তিমা সে ছিল সবদিক দিয়ে বেষ্ট চয়েস। কিন্তু যে দাঁড়িয়ে আছে কিছুদূরে সে কি আর আগের মানুষটা আছে? তাহলে কি রক্তিমা ফিরে যাবে? পুরো স্কীমটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করবে?

“কি ব্যাপার! এইখানেই যে স্ট্যাচু হয়ে গেলে! ঐ তো দাঁড়ানো পলাশবাবু। যাও ডাক ওকে” পেছন থেকে এসে অরুণাভ বলে ।

“কোথায় ছিলে তুমি? আমি সেই থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছি …” আনমনা ভাবে বলে রক্তিমা।

“আরে এদিকে তো কোন জায়গাই ফাঁকা নেই। আমি পেছনের লেনে গাড়িটা পার্ক করে এলাম। কিন্তু সময় কেন নষ্ট করছ? এসো …” অরুণাভ এগিয়ে যায়।

“শোন, দাঁড়াও একবার” দুর্বল গলায় ডাকে রক্তিমা। এতদূর এসেও সে কেন এমন নার্ভাস হয়ে পড়ছে, কেন যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও এভাবে মন ঘুরে যেতে চাইছে উল্টোদিকে সেটা নিজেই বোঝেনা ও। মনে হচ্ছে পলাশদাকে ডাকার কোন দরকার নেই আর। দরকার নেই ভেবে রাখা প্রোজেক্টটায় হাত দেওয়ার। এই ভিড়, কোলাহল সব ছেড়ে নিজের ঘরের কোনায় গিয়ে অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তাহলে শ্রমণাকে যে উত্তরটা দেওয়া হবেনা! এতদিন ধরে যা ভেবে রাখল রক্তিমা তা তো কিছুই হবে না। কি করা উচিত ওর? নিজের ভাবনাকে রূপ দেওয়া নাকি সত্যি সত্যিই এখান থেকে ফিরে গিয়ে নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া?

“রুকু ডোন্ট বী সো সেন্টিমেন্টাল। এসো, কুইক …” অরুনাভ এগিয়ে যায় সামনে। ওর স্বভাব রক্তিমার চেয়ে কে আর ভাল জানে এই পৃথিবীতে! একবার চলতে শুরু করলে অরুণাভকে আর থামানো মুশকিল, ঠিক যতটা মুশকিল থেমে থাকা অরুণাভকে নড়ানো। এই প্রোজেক্টের জন্য ও তো রাজি ছিল না, প্রথম যেদিন শুনেছে, হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল। ওর ভাষায় ছাগল দিয়ে হাল টানা হয় না। নানা ব্যবসা করে বলে কি আর সংস্কৃতি নিয়েও ব্যবসা করবে? সেটা কি খুব সহজ? না, মোটেই না। অরুণাভ নানাভাবে জাল কেটে বেরিয়ে যাওয়ার ফিকির খুঁজেছে। তারপর একদিন ঝপ করে রক্তিমাকে অবাক করে দিয়ে রাজী হয়েই গেল। তারপর থেকে ওর উৎসাহ দেখবার মত। আর সব ব্যবসার কাজ ফেলে দিনরাত এই প্রোজেক্টের কাজ নিয়ে পড়ে থেকেছে। পুরো প্ল্যান ওর নিজের। দিনে দিনে অরুণাভ যত সক্রিয় হয়ে উঠেছে রক্তিমা যেন ততটাই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে। আর এই যে আজ ওরা এসেছে এখানে, এটাও অরুণাভ রই প্রোগ্রাম। কোন কাজ ফেলে রাখা ওর অভ্যাস নয়। ঠিক হোক ভুল হোক, ও সবকিছুরই শেষ দেখে তবে ছাড়ে। সেই একই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এখন।

রক্তিমা অনুসরণ করে। হঠাৎ করে কি যে অস্বস্তি এসে ঘিরে ফেললো ওকে! মনে হচ্ছে দৌড়ে পালিয়ে যায় ওই বিস্মৃতপ্রায় মানুষটার চোখে চোখ পড়ার আগে। নিজে সে হাঁটছে না যেন, পা দু’খানাই রক্তিমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অরুণাভর পেছনে।

অবশেষে থামতেই হয়। দাঁড়াতেই হয় সেই একদা বিখ্যাত নাট্যনির্দেশকের সামনে। তাকাতেই হয় তার দুই কোটরাগত চোখের দিকে। কি চেহারা হয়েছে পলাশদার! ইসস! শিউড়ে ওঠে রক্তিমা। চোখের কোণে এভাবে কালি পড়েছে! ক্রিজলেস শার্টের কোণায় লেগে আছে চায়ের না কিসের দাগ, বুকের কাছে কুঁচকে আছে অনেকটা জায়গ। জুতোয় ধূলো ভর্তি। চুলগুলো কতদিন পায়নি ক্রিম শ্যাম্পু বা চিরুনীর আদর। চুল কমে যেতে যেতে কপালের সীমানা কতটা বেড়েছে এই মাত্র কয়েক বছরে! এই চেহারার পলাশদাকে কখনো দেখেনি কেউ। ভীষণ খারাপ লাগে রক্তিমার। নিজেকে সামলে এগিয়ে যায়। অরুণাভ ততক্ষণে পলাশদার সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, “হাই! আমি অরুণাভ…”

পলাশদার মুখে ফুটে ওঠে পরিচিতের মেকি হাসি, বেশ কায়দা করে বলে, “নিশ্চয়ই অবিচল নাটকটার কথা ভুলতে পারেনি, তাই তো? কেউই পারেনা। আমাকেও লোকে তাই ভুলতে পারে না…”

আরো নানা কথা হয়তো বলেই যেত। থেমে যায় অরুণাভর পাশে এসে দাঁড়ানো রক্তিমাকে দেখে। এতক্ষণের অহংকারী রুগ্ন মুখটা কিরকম অবাক হয়ে থেমে থাকে কয়েক মুহূর্ত, তারপর বিস্মিত প্রশ্ন আসে, “তুমি? কতদিন পর…”

“ইনি আমার হাজব্যান্ড পলাশদা। অরুণাভ দিল্লি তেই থাকছে এখন মোষ্টলি …”

“ওহ …, আরে মশাই আপনিও তো বেশ! বলবেন তো আপনি রক্তিমার হাজব্যান্ড! আমি ভাবলাম …”

“আপনার অবিচল নাটকের মুগ্ধ দর্শক, তাই তো?” অরুণাভ হেসে বলে, “তাতে অসুবিধে কিছু হয়নি। আপনার একজন মুগ্ধ ভক্ত তো আমি বটেই। ওরকম নির্দেশনা আর কোথায়! কে দিতে পারবে!”

পলাশ দূরের দিকে তাকিয়ে খানিকটা ম্রিয়মান গলায় বলে, “সেসব দিন কোথায় চলে গেল …, কে আর মনে রেখেছে …”

রক্তিমার মনে হয় এই বাক্যবন্ধে মিশে আছে আসল মানুষটা। তার আগে যা বলছিল সব ওর মিথ্যে বাগাড়ম্বর, জোর করে খুঁটি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা। আবারও মন খারাপ লাগে ওর। সোজা তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছেন, পলাশদা?”

হাতের পুরে যাওয়া ফিল্টারটায় শেষ টান দিয়ে টুসকি মেরে ফেলে দেয় পলাশ। মাথার শুকনো অগোছালো বিলীয়মান চুলে এক ঝটকা দিয়ে বলে, “ভাল আছি, ভাল আছি। অভিনেতাকে কখনো খারাপ থাকতে নেই। অভিনেতার ওপর রয়েছে সারা পৃথিবীকে আনন্দ দেওয়ার, ভাল রাখার দায়িত্ব।”

রক্তিমা জানে পলাশদা এখন আর নির্দেশনা বা অভিনয় কোনটারই দায়িত্ব পায়না বহুদিন থেকে। চেহারাতেই ওর দৈন্যদশা প্রকট। তবু এই ভাল থাকার অভিনয় ওর মনটা দুলিয়ে দিয়ে যায়। মনে পড়ে একসময় এই মানুষটার কি দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল স্টেজের ভেতরে বাইরে, সারা কলকাতার সমস্ত নাটকপ্রেমী দর্শকের মধ্যে। সাফল্য এসেছে, সঙ্গে এসেছে অপরিমিত জীবনযাপনের নানা ঋনাত্মক দিক। এবং অহংকার। নিজের সাফল্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে এই অহংকারী মানুষটা। আজ তাকে দেখে শুধু করুণাই করা যায়। রাগ করতেও ইচ্ছে করে না।

অরুণাভ কাজের মানুষ। রক্তিমার দিকে তাকিয়ে সে পালস বুঝে নেয়। অত্যন্ত আবেগী এই মহিলা। অরুণাভ জানে বউএর মন এখন পুরোনো দিনগুলোর মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আলতো করে রক্তিমার কাঁধে হাত ছুঁইয়ে সে কাজের কথায় আসে “পলাশবাবু, আপনার সঙ্গে একটু কাজের কথা ছিল। যদি এক দেড় ঘন্টা সময় দিতে পারেন …”

“কাজের কথা? আমার সঙ্গে? এখন তো আর আমার সঙ্গে কেউ কাজের কথা বলতে আসেনা।”

“কিন্তু আমরা, আমি আর রক্তিমা এসেছি … একটু বসতে হবে কোথাও। যদি আপনার অসুবিধে না থাকে তো আমরা পার্কস্ট্রীটে কোথাও…”

“পার্ক স্ট্রীট? আ আ আ হ! স্বপ্নের জায়গা, স্বপ্নের যত রেষ্টুরেন্ট! কতদিন যাইনি …” পলাশের চোখ বুজে আসে সুখের আবেশে।

“তাহলে চলুন। এসো রুকু, কুইক …” অরুণাভ সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। কিছুদূরে ওর গাড়ি পার্ক করা আছে। পলাশ তাকিয়ে থাকে হেঁটে এগিয়ে যাওয়া অরুণাভর দিকে।

“কি হল? চলুন!” রক্তিমা তাকায় পলাশের দিকে।

“তোমার সঙ্গে কিছু অন্যায় করেছি আমি রক্তিমা। জীবন আমাকে ক্ষমা করেনি। শূন্য হাতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই অ্যাকাডেমীর সামনে। দু’দিকে দু’হাত ছড়িয়ে বলে পলাশ।

“ওসব কথা থাক পলাশদা। আমাদের অন্য একটা কাজের কথা আছে। আসুন।” রক্তিমা এগোতে শুরু করে। পেছনে না এগিয়ে থেমে যেতে চায় পলাশ।




পলাশ গাড়িতে উঠে এদিক ওদিক তাকায়। রক্তিমার দিকে একবার, বাইরে প্রবহমান জনজীবনে একবার, নিজের হাত পায়ের দিকে একবার। বোঝা যায় সে বেশ অস্থির হয়ে আছে ভেতরে ভেতরে। রক্তিমা মনে মনে হাসে। ওর মনে পড়ে যায় কি বিশাল ব্যক্তিত্বশালী ছিল এই লোক একসময়। সেইসঙ্গে প্রতিকথায় পার্শ্ববর্তী সবাইকে নিজের ইচ্ছেমত ব্যঙ্গ উপহাস করতে বাধেনি ওনার কোনদিন। সেই মানুষের সঙ্গে আজকের পলাশদার আকাশ পাতাল পার্থক্য।

অরুণাভ বেশ নামী একটা রেস্তোঁরার সামনে গাড়ী দাঁড় করায়। দরজা খুলে দিয়ে পলাশদাকে ডাকে, “আসুন …বসা যাক।”

পলাশ নেমে আসে। ভারী সঙ্কুচিত পায়ে থেমে থেমে এগোতে থাকে অরুণাভর পেছনে। ধনাঢ্য পরিবেশে ঝাড়বাতির তলায় দামী কার্পেটের ওপর পা আর চলে না। থেমেই যায়। রক্তিমা বলে, “পলাশদা ওদিকে নয়, এইদিকে …।”

চেয়ার টেনে বসতে বসতে পলাশ হাসে, “এত দামী জায়গায় এলে? বাপরে! এখানে এসেছিলাম দু’বার মাত্র। কিন্তু সে কতবছর আগে…। বুঝলে, এসেছিলাম এক ফিল্ম প্রোডিউসারের সঙ্গে। একটা ছবির কথা হচ্ছিল। কিন্তু সেটা তো ক্লিক করল না শেষ পর্যন্ত। ওই সিনেমাটা হলে হয়ত আজ এই …” কথা শেষ না করে ওয়েটারের রেখে যাওয়া ঠান্ডা জল এক নিঃশ্বাসে শেষ করে পলাশ। রক্তিমার দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে অরুণাভ বলে,

“সে সব কথা থাক। আমরা কেউ জানি না মানুষকে কখন কি অবস্থা ফেস করতে হবে। বরং বেটার উই ডিসকাস টুডে অ্যান্ড টুমরো, নট ইয়েস্টারডে, ওকে?”

রক্তিমা মাথা নেড়ে সায় দেয়। পলাশ হেলান দিয়ে বসে বলে, “অন্ধের কিবা দিন কিবা রাত্রি … আজ কাল পরশু সবই সমান আমার কাছে …”

রক্তিমা এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। এবার তীক্ষ্ণ স্বরে বলে ওঠে, “এই পলাশদাকে তো আমি চিনি না। ছি ছি, এতখানি চেঞ্জ হয়েছে আপনার? এমন ভেঙ্গে পড়ার কি আছে? কি এমন হয়েছে? কয়েকটা নাটক ফেল করেছে, এই তো? তাতে তো মানুষের ভেতরের ক্ষমতাটা কমে যায় না! অন্তরটা কেন দীন হীন হয়ে যাবে? আমি ভাবতে পারছি না …”

রক্তিমা কথা বলতে শুরু করা মাত্রই পলাশ মাথা নীচু করে ফেলেছিল। একটাও বাধা দেয়নি। বস্তুতঃ কি যে সে ভাবছে তা বোঝা যায় না। অরুণাভ হাত তুলে থামায় রক্তিমাকে, “আঃ কি করছো! এত হাইপার হয়ে গেলে চলবে কি করে? আমরা কাজের কথায় আসি।”

রক্তিমা হঠাৎ করে এত কথা বলে ফেলবে, এমন বার্ষ্ট আউট করে যাবে তা নিজেও ভাবেনি। বরং নিজেকে ও বারবার এটাই বুঝিয়ে এনেছে যে কোন কথাই বলবে না। কথা যা বলার সব অরুণাভই বলুক। কিন্তু প্রথমেই নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা নিজেই ভেঙ্গে ফেললো। পলাশদার অনেক চেঞ্জ হয়েছে এটা শোনাই ছিল। কিন্তু তা যে এতখানি সেটা চোখে না দেখলে যেমন বিশ্বাস করা যায় না, তেমন ওই মানুষটাকে আগেকার সময়ে যে কাছে থেকে দেখেছে সে এই পলাশদাকে দেখে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারবে না। কোথায় সেই চূড়ান্ত সফল, মদগর্বী, উদ্ধত, আত্মঅহংকারী পলাশদা আর কোথায় এই নুয়ে পড়া নিজের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসাহীন ন্যাতানো মুড়ির মত পলাশদা। অসহ্য লাগছে রক্তিমার। এক একবার মনে হচ্ছে অরুণাভর কথায় মেতে এই নতুন ভেঞ্চারে না নামলেই ভাল হত। এটা ঠিক যে প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনাটা ওরই ছিল। অরুণাভকে ও নিজেই রাজি করিয়েছে। কিন্তু তারপর তো এসব থেকে সরে আসার কথাও ভেবেছে। বারবার অরুণাভকেও বলেছে কাজ নেই আর এই সব কিছুতে। সেটা আর সম্ভব হয়নি। ততদিনে অরুণাভর মাথাতেও ঢুকে গেছে নতুন এই ব্যবসার চ্যালেঞ্জ। আর পেছনে ফেরানো যায়নি ওকে। তাই রক্তিমার নিজের ওপরেই মাঝে মাঝে রাগ হচ্ছে।

কি দরকার ছিল ধ্বংসাবশেষ থেকে আগুনের কণা খুঁজে ফেরার! ওর নিজেরই বা এই বয়সে এসে আর কি পাওয়ার আছে! যোগ্যতার চেয়েও অনেক বেশী তো পেয়েই গিয়েছে। কিন্তু চিরদিনের একটাই দুর্বলতা রক্তিমার। অরুণাভর কোন ইচ্ছেতেই ও না বলতে পারেনা, এটাও পারেনি। এখন পুরো ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছে যেন এটা অরুণাভরই প্রোজেক্ট আর রক্তিমা শুধু তাতে সঙ্গত দিচ্ছে প্রয়োজনমত। নিজেকে আবার শাসন করে চুপ করে বসে থাকে রক্তিমা। হাতে তুলে নেয় ওয়েটারের দিয়ে যাওয়া রেড ওয়াইনের গ্লাস। একগাদা স্ন্যাক্স বলেছে অরুণাভ। প্লেটে প্লেটে সেইগুলো সার্ভ করে দিয়ে গেছে ওয়েটার। পলাশের দিকে গ্লাস প্লেট এগিয়ে দেয় অরুণাভ। পলাশ সেই থেকে মাথা নিচু করে গা এলিয়ে বসে আছে।

“পলাশবাবু! প্লিজ …আপনার বন্ধুর কথায় যদি এত মনখারাপ করেন তাহলে তো আমাদের কথাই এগোবে না …” অরুণাভ হুইস্কির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে। মুখ তোলে পলাশ। একটু হাসে। ভারী বিষন্ন সেই হাসি। হাতে তুলে নেয় গ্লাস। লম্বা চুমুক দেয়। প্রান ভরে শ্বাস নেয়।

“নাহ …কিছু মনে করিনি। ওর তো বলার জায়গা আছেই। আমিই দিয়েছি সেই জায়গা। কিছু বলার নেই আমার।”

“আচ্ছা, তাহলে এবার কাজের কথাটা বলি …”

“আপনার মনে হয় এই পলাশের সঙ্গে কারুর আর কোন কাজের কথা হতে পারে? কেউ তো বলে না আর। কেউ ডাকেও না কোন অনুষ্ঠানে। অথচ একদিন ছিল যখন মোটা টাকা অ্যাপিয়ারেন্স ফি দিয়েও লোকে দাঁড়িয়ে থাকত এই পলাশকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”

“আমি চাই আপনার সেই দিনগুলো আবার ফিরে আসুক।” অরুণাভ গম্ভীর গলায় বলে। পলাশ এলিয়ে বসে চিকেন স্ন্যাক্স এর টুকরো মুখে তুলছিল। চুমুক দিচ্ছিল গ্লাসে। এবার হাত থামিয়ে সোজা হয়ে বসে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় অরুণাভর দিকে, “মানে? বুঝলাম না। গঙ্গার যে জল বয়ে গেছে তাকে কি ফিরিয়ে আনতে পারবেন আপনি? কেউ পারবে?”

“না, তা পারব না, কিন্তু শুকনো ডাঙ্গায় গঙ্গার জলের মত প্লাবন এনে তাকে ভরে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারব, আর চেষ্টায় কি না হয়?”

“আমি কিছু বুঝতে পারছিনা।”

“রক্তিমা? তুমি বলবে?”

মাথা নাড়ে রক্তিমা, “নাহ, তোমার প্রোজেক্ট, তুমিই বল।”

“বেশ। পলাশ শুনুন, আমি চাই আপনার অবিচল নাটকটাকে ফিল্মে কনভার্ট করতে। আপনি ডিরেক্ট করবেন। অভিনয়ও আপনি এবং রক্তিমা করবেন, ঠিক নাটকে যে যেই চরিত্র করেছেন আপনারা। দিনের পর দিন এই নাটক দিয়ে আপনারা সারা পশ্চিমবঙ্গকে মাতিয়ে রেখেছেন। বাইরের রাজ্যগুলোতেও গিয়েছে এই নাটক। এবার এই সিনেমাটা সেইরকমই টেনে আনবে দেশ বিদেশের সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী দর্শককে। এরজন্য আপনাকে সম্মানজনক পারিশ্রমিক দেব আমি প্রোডিউসার হিসেবে। বাকি সব দায়িত্ব আপনার। ক্যারেক্টার সিলেকশন ইত্যাদি …, এগুলো রক্তিমাকে সঙ্গে নিয়ে আপনি করবেন। সেভাবেই এগ্রিমেন্ট হবে। আই হোপ ইউ উইল নট ডিসএগ্রি …”

একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে থামে অরুণাভ। এবার নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকে পলাশের দিকে। পলাশ খাওয়া পুরোপুরি থামিয়ে দিয়েছে। হাত সরিয়ে নিয়েছে গ্লাস থেকেও। টান টান বসে আছে রুগ্ন সন্ন্যাসীর মত। কঠিন মেদহীন শিঁড়দাঁড়া টানটান এই বসে থাকার ভঙ্গীটা চেনে রক্তিমা। ওর চোখে একঝলক ভেসে ওঠে বহুবছর আগের পলাশদা। যে কোন কঠিন চরিত্র অভিনয় করার আগে বা ডিরেকশন দেওয়ার আগে এইভাবেই শরীর শক্ত করে গ্রীণরুমে বসে থাকত পলাশদা। কারুর সাধ্য ছিল না সেই সময়টায় তাকে ডাকে বা কোন কথা বলে। পলাশদাকে ঐভাবে দেখে রক্তিমার মনে হত যেন কোন একাগ্র সাধক তার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিচ্ছে সফলতার বরমাল্য। সম্পুর্ন ভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতেও সামনে বসে থাকা পলাশদাকে দেখে সেই সব দিনের পলাশকে মনে পড়ে যায় রক্তিমার।

“কি হল? আপনি কিছু বলছেন না? পলাশবাবু …” অরুণাভ একটু যেন অধৈর্য্য হয়। পলাশ তাকায় ওর দিকে। একটু চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলে, “এতবড় দায়িত্ব! আমায় দিয়ে কি আর হবে? আপনার টাকাগুলোই হয়তো জলে চলে গেল।”

রক্তিমার মাথাটা আবার গরম হয়ে উঠতে চায়। পলাশের মুখে এইধরনের নেতিবাচক কথা শুনলেই ওর রিয়্যাকশন হয়ে যাচ্ছে। কিছু বলতে গিয়েও ও অরুণাভর দিকে তাকিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে নেয়। অরুণাভ পলাশের দিকে তাকিয়ে হাসে, “আপনি এভাবে ভাবছেন কেন? এটাও তো হতে পারে আমার টাকা দ্বিগুন হয়ে ফিরে এল! আমি তো সেই ভরসাতেই আপনাকে চাইছি।”

এবার যেন গা থেকে আলগা পোশাকের মত করে পলাশ ওর এতক্ষণের নেতিবাচক ভাবভঙ্গী ঝেড়ে ফেলে। অরুণাভর দিকে তাকিয়ে গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে, “কিন্তু অবিচল কেন? হোয়াই অবিচল? আরো অনেক ভাল গল্প রয়েছে। আপনি নিজে তো বোধহয় কখনো অবিচল নাটকটা দেখেননি!” রক্তিমাকে অবাক করে দিয়ে অরুণাভ বলে, “সরি টু বোথ অফ ইউ, একটু সত্যের অপলাপ হয়েছে আমার দিক থেকে, রক্তিমাকেও কখনো বলা হয়নি। ইটস হাইটাইম টু ডিসক্লোজ। শেষ যেবার একসপ্তাহ ধরে এই নাটকটা আপনি করেছিলেন উত্তর কলকাতায়, আমি পর পর টানা তিনদিন দেখেছি অবিচল। এই নাটক দেখার পর যে ঘোরের মধ্যে চলে যায় দর্শক, সেই ঘোর আমাকে তিনদিন সাউথ থেকে নর্থে টেনে এনেছিল। আপনাদের দু’জনের প্রত্যেকটা সীন আমার মনে লেগে আছে। তারপর ব্যবসার কাজে চলে যেতে হয়েছিল বাইরে। নইলে হয়তো প্রত্যেকদিনই আসতে হত।”

এই তথ্যটা রক্তিমার কাছে সম্পুর্ণ নতুন। অরুণাভ কোনদিন ওকেও বলেনি। ওর দিকে তাকিয়ে অরুণাভ হাসে। এই অরুণাভকে চেনে না রক্তিমা। ওর ধারণা ছিল ওকে সারাক্ষণ উৎসাহ দিয়ে যাওয়া, নিজের কাজের নাম করে ওকে কলকাতায় পাঠানো এগুলো সবই রক্তিমার প্রতি অরুণাভর ভালবাসার প্রকাশ মাত্র। কিন্তু ও নিজেও যে অভিনয়ের এতবড়ো ভক্ত তা এত বছরে কোনদিন জানা হয়নি।

“তুমি অবাক হচ্ছ জানি। কিন্তু কিছু কিছু কথা তো সারাজীবন ভেতরে থেকেই যায় যা বলা হয়ে ওঠে না। এটাও সেরকমই একটা। যাই হোক, এবার আসল কথাটা এগোনো দরকার। পলাশবাবু? তাহলে এগ্রিমেন্ট রেডি করি? টাকাপয়সার কথাগুলো তারপরেই হবে না হয়? সই এর আগে? ফর্ম্যাটটা পাঠাই, আপনি দেখুন, তারপর…”

“পয়সার কথা বললে আমার মত পাষণ্ড লোকও এবার লজ্জা পাব। আমার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন আসছে।” পলাশ অরুণাভর দিকে তাকিয়ে বলে।

“বলুন … আমি তো আপনার বক্তব্যই শুনতে চাইছি।”

“অবিচল অত্যন্ত উচ্চমানের একটি নাটক। আমারই লেখা। কিন্তু একে ফিল্ম করলে যে একই রকম জনপ্রিয় হবে তা লেখক হিসেবে আমি বলতে পারি না। ফিল্ম সফল হওয়ার পেছনে যে যে ফ্যাক্টর কাজ করে তার অন্যতম হল একটি ভাল চিত্রনাট্য বা স্ক্রিপ্ট। যিনি সেটা লিখবেন তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে।”

“সেটা আপনি নিজেই লিখতে পারেন। আপনার নাটক আপনার থেকে ভাল আর কে পারবে!” এতক্ষণে রক্তিমা কথা বলে। পলাশ তার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ে, “আমি কখনো সিনেমার স্ক্রিপ্ট বানাইনি। নাটক আর সিনেমা দুটো মিডিয়া সম্পুর্ণ আলাদা …”

“তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা ভাল কোন স্ক্রিপ্টরাইটারকে হায়ার করতে পারি। আপনি কাউকে সাজেষ্ট করছেন কি?” অরুণাভ বলে। পলাশ চোখ বুজে কপালের রগ দু আঙ্গুল দিয়ে টিপে ধরে কিছু ভাবে। তারপর তাকিয়ে বলে, “সে একজন আছে আমার জানা। প্রথমদিকে সমস্ত রকম কাজ করত। তারপর দুটো একটা স্ক্রিপ্ট দিয়ে শুরু করে সাকসেস পেয়ে গেল। এখন তো পুরোদস্তুর স্ক্রিপ্ট রাইটার। অনেকগুলো ফিল্ম হিট হয়েছে। নাটকের সঙ্গে তার আর কোন সম্পর্কই নেই।”

রক্তিমা বুঝতে পারে না কার কথা বলছে পলাশদা। বেশ কয়েকবছর ও পুরোটাই দিল্লি তে থাকছে। কলকাতায় ভাল ফিল্ম হলে দেখে ঠিকই কিন্তু ডিটেলস খবর রাখেনা আর। অরুণাভর মাথায় এই সিনেমার পোকাটা চাপার পর থেকেই কিছু কিছু চিন্তা করছে। কিন্তু কে কোথায় নাম ডাক করল সেসব জানা হয় না আর।

“আপনি কি শ্রমণার কথা বলছেন?” অরুণাভ জিজ্ঞেস করে। ঐ নামটা কানে যেতেই রক্তিমা আরো একবার অবাক হয়ে তাকায় অরুণাভর দিকে। বুকের ভেতর জমাট বাঁধা কোন একটা যন্ত্রণায় যেন ছুঁয়ে দিল কেউ। টং করে উঠল ধূলোয় পড়ে থাকা সেতারের ছিঁড়ে যাওয়া তার। এখনো যে এই নামটা এমন অনুভূতি আনতে পারে এটাও ওর কাছে একটা নতুন করে জানা বিষয়। আর সেই সঙ্গে রক্তিমা প্রায় স্থবির হয়ে যায় যখন দেখে পলাশদা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলছে অরুণাভকে।

সত্যিই শ্রমণার কোন খবরই রাখে না রক্তিমা এখন আর। কিন্তু অরুণাভ জানে শ্রমণা স্ক্রিপ্ট রাইটারের কাজ করছে! কি আশ্চর্য! রক্তিমা জানে না। কেন জানে না? জানে না কারণ ও জানতে চায়নি। অরুণাভ চেয়েছে? কেন? কারণ অরুণাভর ভিন্ন কোন পরিকল্পনা রয়েছে যা ও এমনকি রক্তিমার সঙ্গেও শেয়ার করেনি। শুধু এইটুকুই বলেছে যে ও একটা ফিল্ম প্রোডিউস করতে চায় যেটা হবে অবিচল নাটকের গল্পটা নিয়ে। বলেছে যে ও রক্তিমার প্রস্তাবে রাজি। সেই সিনেমায় সে পলাশ আর রক্তিমাকেই মেন লিডে চায়। একথাও বলেছে। আর ডিরেকশনেও পলাশই ওর ফার্ষ্ট সেকেন্ড অ্যান্ড থার্ড চয়েস। এইগুলো সবই জানে রক্তিমা। যেদিন প্রথম জানল ও প্রবল আপত্তিও করেছিল। কিন্তু অরুণাভর একটা একটা করে দেওয়া যুক্তির কাছে রক্তিমার ব্যাখ্যাহীন আপত্তি ধোপে টেঁকেনি। অরুণাভ ওকে এটাই বুঝিয়েছে, সে ব্যবসায়ী। যে ব্যবসা করলে লক্ষ্মীলাভ হবে সেটাকেই নিয়ে লড়ে যাবে সে। কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া আর কোন কিছু ভাবছে না সে। সেই ব্যবসার এই নতুন উদ্যোগকে সফল করে তোলার জন্যই কি এতখানি গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে নেমেছে অরুণাভ? নাকি আরো অন্য কোন কারণ রয়েছে ওর শ্রমণার খবর সংগ্রহের পেছনে? রক্তিমা ভেবে পায় না। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সেদিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে বসে থাকে ও।

“যদি এই মুহূর্তে শ্রমণাই বেষ্ট স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়ে থাকে তাহলে তাকেই নেব আমরা। অসুবিধে কি আছে!”

“শুনেছি আজকাল প্রচুর টাকা নিচ্ছে ও। নানারকম হ্যাজার্ডসও আছে ওর। অসময়ে বেশী বেশী সাকসেস পেয়ে গেলে যা হয় আর কি!” পলাশ বলে।

“ও টাকার জন্য আপনি ভাববেন না। ওদিকটা আমি সামলে নেব। আপনি শুধু এটাই ভাবুন এই ফিল্মটাকে সুপার হিট করাতেই হবে। যেমন ছিল আপনার নাটকটা।”

রক্তিমা নিজের প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে কথাগুলো শোনে। হাসি পেয়ে যায় ওর। পলাশদা এই কথা বলছে? “অসময়ে বেশী সাকসেস পেয়ে গেলে …”

রক্তিমার চোখে ভেসে ওঠে সেই সময়কার পলাশদার পৃথিবী তুচ্ছ করা মদগর্বী চেহারা। আরো বহুরকম কথার পর মিটীং শেষ হল। পনেরো দিন পর আবার কলকাতা আসছে অরুণাভ, উইথ ড্রাফট অব এগ্রিমেন্ট।

এরমধ্যে পলাশদা মোটামুটি ক্যারেক্টার অনুযায়ী আর্টিষ্ট সিলেক্ট করে রাখবে নিজের মত করে। সেটা মিটিং-এর পর ফাইনাল হবে। আর শ্রমণাকেও অরুণাভ প্রথমে ওভার ফোন কন্ট্যাক্ট করবে। ও রাজি হলে তারপর কথাবার্তা হবে পরের বারেই।

টেবিল ছেড়ে উঠে আসার আগে অরুণাভ যে কাজটা করল সেটাও বেশ অবাক করার মত। একটা টাকার বাণ্ডিল নিয়ে পলাশদার হাতে গুঁজে দিল। পলাশদা আশা করেনি বোঝাই যাচ্ছে মুখ দেখে। হয়তো বহুযুগ পরেই এত টাকা একসঙ্গে দেখল পলাশদা।

“প্লিজ, এটা রেখে দিন অ্যাজ অ্যান অ্যাডভান্স। এটা আপনার গল্পের দাম তো হবে না, তবে লেখাটা নিচ্ছি সেই বাবদ একটা সম্মান দক্ষিণা।”

পলাশদা হেসে পকেটে ঢুকিয়ে নেয় টাকার বাণ্ডিলটা। রক্তিমার দিকেও তাকিয়ে হাসে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, “চল, নতুনের পথে। নতুন সূর্য আমায় ডাকছে। চল উঠি জয়রথে …”

অবিচলের ডায়লগ। জীবনের বাজি সবদিক থেকে হেরে যাওয়ার পরেও লাইনের পর লাইন মুখস্থ যে বলতে পারে সেই মানুষকে অনেক চেষ্টা করেও প্রতিভাহীন ভাবা যায় না। শুধু সময় আর কিছু ভুল চাল তাকে নিয়ে এসেছে সাফল্যের উঁচু মিনার থেকে ব্যর্থতার অন্ধগলিতে। রক্তিমা নিজেও কি শ্বেতার একটাও ডায়লগ ভুলেছে এতদিনেও! কিছু কিছু ভূমিকা ভোলা যায়না শেষদিন পর্যন্ত। যত মনে থাকে তত সেই ভূমিকাগুলো রক্ত ঝরায়। কিন্তু রক্তিমা সব রক্তের দাগ ধুয়ে মুছে শেষ করে ফেলতে চেয়ে বহুদিন লড়াই করেছে। হয়তো সফলও হয়েছে। অথচ জীবন কত আশ্চর্য, আজ আবার পলাশদার উচ্চারনের সাথে সাথে ওর মন নিঃশব্দে উচ্চারন করে শ্বেতার কথাগুলো।

… আমি তো তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইনি কোনদিনও। তুমি চেয়েছো পালিয়ে যেতে। যত বেশী করে পালাতে চেয়েছো ততই বেশী করে বাধা হয়ে গেছে তোমার আমার বন্ধনহীন গ্রন্থি। তাই তো আজও চৈত্রে পলাশের আগুন জ্বলে। আজও সেই আগুনে ঝলসে যায় পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা দুই বিচ্ছিন্ন কিন্তু চরম সংযুক্ত নর নারী। এই আমি অবিচল আমার বিশ্বাস নিয়ে। এই আমি চিরকালীন আমার ভালবাসায়। যা কিছু আমার বলে জেনেছি আজন্ম, এই আমি ছুঁড়ে দিই প্রস্তরমূর্তিতে। ভাষাহীন পাথরেও অবিচল স্রোত, জানি আমি বয়ে যাবে হবে না কো রোধ …।

“চল দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?” অরুণাভ দরজার কাছ থেকে ডাক দেয়। ওর ডাকে সম্বিত ফেরে রক্তিমার। অবাক হয়ে ও খেয়াল করে কতবছর পর আবার কেমন ডুবে গিয়েছিল শ্বেতার মধ্যে।

রাস্তার ওপরেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। অরুণাভ ড্রাইভিং সীটে বসে পড়েছে। রক্তিমা এগোতে গিয়ে খেয়াল করে পলাশকে। যে পলাশ ঢুকেছিল এই দামী রেস্তোঁরায় সে বেরোচ্ছে না। বেরিয়ে আসছে যেন অনেকটা সেই আগের পলাশ। রক্তিমা দেখতে পায় গেটে দাঁড়িয়ে স্যালুট করা মানুষটিকে পকেট থেকে একখানা কোঁচকানো একশ’টাকার নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দেয় পলাশ। টাকা মানুষকে কতখানি আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়! হয়তো এটাই আজকের মত, এমনকি এই সপ্তাহের মত সম্বল ছিল পলাশদার। কিন্তু সেই সম্বলটুকু অপরকে দান করে দিতে পারে সে এখন হেলায়। কারণ এক খানা মোটা বান্ডিল এসে জায়গা নিয়েছে ওর পকেটে। তাই ওই কোঁচকানো নোটটার আর কোন মূল্য নেই পলাশের কাছে। পলাশকে হাত নেড়ে বিদায় নিল ওরা আজকের মত।

চলন্ত গাড়িতে বসে রক্তিমার মনে অদ্ভুত এক উপমা এসে ছায়া ফেলে। অনেক আগের সেই দিনগুলোয়, যখন শ্বেতার রোলে ও ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না পলাশের কাছে তখন কতটা যত্ন নিয়ে রক্তিমাকে আগলে রেখেছে সে। ঠিক ওই একশ’ টাকার নোটটারই মত। তারপর যেদিন শ্রমণা এলো, কত অনায়াসেই সেই শ্বেতাকে সে বিলিয়ে দিল শ্রমণার কাছে। ঠিক যেন একশ টাকার বান্ডিল এসে গিয়েছে তার হাতে। একাকী একশ টাকার আর কোন মূল্য নেই। কিন্তু সত্যি কি তাই হওয়া উচিত ছিল? রক্তিমা কি কোনভাবেই শ্রমণার সঙ্গে তুলনীয় ছিল? এই একটা ভুলের কারণে সারাজীবন ধরেই কি পলাশকে খেসারত দিতে হয়নি? জীবন কত আনপ্রেডিক্টেবল! রক্তিমা ভাবব না ভেবেও নিজের মনকে আটকাতে পারে না।

অরুণাভ অনেকক্ষণ চুপ করে ড্রাইভ করার পর শুধু বলে, “এত ভাবনার কি আছে রুকু? যে যা করবে, তার ফল তাকে এই জীবনেই নিয়ে যেতে হবে। এই তো নিয়ম।” “কেন? একথা কেন বলছো?”

অরুণাভ তাকায় না। ওর চোখ সামনের রাস্তায়। শুধু ঠোঁটদুটো কেমন একটা হাসিতে বেঁকে যায়, “কেন বলছি বুঝতে পারছো না? এই লোকটা কি করেছিল তোমার সাথে ভুলে গেছ? আমি তো দেখেছি তোমাকে কষ্ট পেতে। তুমি মুখে কিছু বল না বল, আমি তো জানি তোমার কোথায় লেগেছিল সেদিন। আমি কিছুই ভুলিনা রুকু। আমি অকারণ মহান হতেও পারি না।”

“তার মানে? তুমি এতদিন পর প্রতিশোধ নিতে চাইছো? আর যদি তা হয়ও, যে পথটা নিয়েছো তাতে তো পলাশদার বরং ভালই হবে। আবার ও নাম ডাক করবে। আবার অন্ধকার থেকে আলোয় আসবে। এটা কোন ধরনের প্রতিশোধ?” রক্তিমা তর্ক না করে পারে না। আজ অনেকবারই ওর অরুণাভকে অচেনা মনে হয়েছে। যেন অনেকগুলো পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোন এক অচেনা অরুণাভ ঝলকে ঝলকে বেড়িয়ে এসেছে ওর সামনে। নানা কথায় নানা আচরণে নতুন নতুন দিক জেনেছে ও। বিয়ের প্রায় কুড়ি বছর পর একান্ত আপন মানুষের এই নতুন চেহারার আত্মপ্রকাশ মেনে নেওয়া খুব সহজ তো নয়! যাকে আমি হাতের তালুর মত চিনি বলে জানি, যদি দেখি কোথাও গিয়ে সে এখনো অচেনা থেকে গেছে তাহলে রক্তিমার মত মহিলার পক্ষে সেটা খুব স্বাভাবিকভাবে পরিপাক করা সম্ভব হয় না। এই সবকিছু নিয়ে এমনিতেই বেশ ডিষ্টার্বড আছে ও। এখন অরুণাভর কথায় তাই আরো কিছুটা উত্তেজিত হয়েই পরে। এইবার অরুণাভ ওর দিকে তাকিয়ে সেই চিরচেনা হাসিটা হাসে। হাতের পাতাটা গালে ছুঁইয়ে বলে, “যদি তোমার কোন প্রশ্ন থাকে, সব উত্তর দেব। কাল দিল্লি ফিরে যাই আগে। তার আগে একটুও ভুল বোঝাবুঝি নয়। আমি যা ছিলাম তাইই আছি এটা তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে।”




গতকাল অরুনাভ আর রক্তিমা ফিরে এসেছে দিল্লি। পুপু এখন জেন্টল লেডি। সে স্টিফেন্স কলেজে গ্র্যাজুয়েশন করছে ফিজিক্স নিয়ে। বেশীরভাগ সময়েই হোষ্টেলে কাটায়। তাতেই নাকি পড়াশোনার সুবিধে। আই পি এস অফিসার হতে চায় পুপু। এখন থেকেই সেই পরীক্ষার জন্যও তৈরি হচ্ছে একটু একটু করে। মেয়েটা মায়ের স্বভাব একটাও পেলনা। গান কবিতা নাটক সাহিত্য এসব ওকে টানে না। ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, কেরিয়ার। রক্তিমার অতএব এখন অঢেল সময়। বহুবছর অভিনয় নিয়ে কাটানোর পর এখন আর বাইরে বাইরে ঘুরতে ভালও লাগে না। বেশ কিছু ছবির অফার পেয়েছিল। তার মধ্যে দু’চারটেতে অভিনয় করেওছে। এখন একটা নিজের দল করেছে। খুব বেছে শো নেয়। অরুণাভর কল্যানে এবং ওর নিজের নাম ডাকের জন্য পৃষ্ঠপোষকের অভাব কখনো হয় না।

এইটুকু নিয়েই শান্তিতে থাকতে চেয়েছে রক্তিমা। পঞ্চাশ বছর বয়সে আর কোন মাইলস্টোন ওকে লালায়িত করে না। আর কোন দৌড় নেই ওর। কিন্তু অরুণাভ আবার জড়িয়ে দিল নতুন এক ঢেউ এর সঙ্গে। কি যে দরকার ছিল ওর এই সিনেমা প্রোডাকশন ব্যবসায় ঢোকার! আবার পলাশদাকে নিয়েই সেটা করতে হবে! রক্তিমা বোঝে না। পলাশদা মানে শ্রমণা। শ্রমণা মানে আবার সেই ভুলে যাওয়া দিনগুলো। আবার সেই কষ্ট, দমবন্ধ যন্ত্রনা, আবার সেই না ঘুমোনো রাতের মিছিল। কোন দরকার ছিল? রক্তিমা জানলার বাইরে চোখ ছড়িয়ে আকাশের কাছে প্রশ্ন রাখে।

বেশীক্ষণ বসে ভাবনার সময় পায়না ও। হৈ হৈ করে ঘরে ঢোকে অরুণাভ। হাতের একগাদা প্যাকেট সোফায় রাখতে রাখতে বলে, “নাও এবার প্যাকিং শুরু করে দাও। পরশু রাতের ফ্লাইট নিলাম।”

“পরশু? এই তো এলাম …। পায়ে কি চাকা লাগিয়ে রেখেছো?”

“এদিকে তোমার কোন প্রোগ্রাম নেই তো দিন পনেরোর মধ্যে? কোন শো?”

“না তা নেই। তবে কাল এসে আবার পরশুই যেতে হবে এটা কেমন লাগে?”

অরুণাভ হাত পা এলিয়ে সোফাতেই প্রায় আধা শোওয়া হয়ে পড়ে। সিলিঙয়ের দিকে তাকিয়ে কি সব হিসেব করে নেয়। তারপর বলে, “লাগালাগির কি আছে? পুপুও তো এর মধ্যে আসছে না। ও বলেই গিয়েছে কি সব এক্সারশন টন আছে ওদের। মাত্র তো পনেরো দিন পরেই ফিরে আসব।”

“আর তোমার বাকি ব্যবসাগুলো? সব লাটে তুলে দিয়েছো বুঝি?”

অরুণাভ হাসে, “আরে না না, ঘরের সোনা ভেঙ্গে নতুন গয়না বানানোয় আমার মায়ের কোনদিন সায় ছিল না। আমিও ঠিক মায়েরই মত হয়েছি। যেগুলো অলরেডি চালু ব্যবসা সে তো ঠিক রাখতেই হবে। সেখানে কোন ঢিল দেওয়ার পাত্র নই আমি। এত এত টাকা দিয়ে এতগুলো ম্যানেজার রেখেছি কিজন্য? ওরা সব সামলে নেবে। আমি এখন নিউ ভেঞ্চারে টাইম দেব। বুঝেছো রুকুসোনা?” বৌয়ের থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে খুশমেজাজে বাথরূমে ঢুকে যায় ও। রক্তিমা বোঝে এখন আর এই ফিল্মটা বানানো থেকে এই মানুষটাকে কোনভাবেই সরানো যাবে না। ও রান্নার লোককে ডেকে খাবার গরম করতে বলে অলস হাতে অরুনাভর আনা প্যাকেটগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে। প্যাকেট থেকে বেড়িয়ে এসেছে মহামূল্যবান লাল পাড় সাদা তাঞ্চই বেনারসী। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ও শাড়িটার দিকে। অরিজিনাল তাঞ্চই। নাহলেও তিরিশ হাজার টাকার কম হবেই না। বহুদিন আগের একটা কথা বুকের তলা থেকে উঠে এসে নিজেরই কানে প্রবেশ করে অবিশ্বাস্যভাবে।

বিয়ের পর পর, একদিন অবিচল নাটক করে ফেরার পর অরুণাভকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় বলেছিল ও, “জান, লাষ্ট সীনটায় শ্বেতাকে যদি একটা দামী লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়াত পলাশদা, আমার মনে হয় সেটা অনেক অ্যাপ্রুপ্রিয়েট হত। দামী বলতে, খুব দামী …, এই ধর অরিজিনাল তাঞ্চই বেনারসী বা ওই জাতীয়…”

অরুণাভ তখন সদ্য সদ্য ব্যবসায় নেমেছে। বিয়েও করেছে সবেমাত্র। শাড়ির কিছুই বোঝে না। সে ঘুমন্ত গলায় বলেছিল, “পড়ালেই পারত। নাটকটা আরো জমে যেত …”

“ধুসসস, আমাদের গরীব দল, অত দামী শাড়ি কার আছে! অগত্যা তাঁত দিয়েই চালিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ওই সীনটা দামী শাড়িই ডিমান্ড করে …”

অরুণাভ ওকে দুহাতে জাপটে ধরে শুইয়ে দিতে দিতে বলেছিল, “বেশ, কখনো যদি আমার ক্ষমতা হয়, আমি তোমায় ওভাবেই অবিচলের লাষ্ট সিনে প্রেজেন্ট করব।”

তারপর তো কবেই অবিচল নাটকটাই হারিয়ে গিয়েছিল রক্তিমার জীবন থেকে। কিন্তু অরুণাভ সেই আধো ঘুমে বলা কথা এখনো বুকে করে সাজিয়ে রেখেছে! রক্তিমা অবাক হতেও ভুলে যায়। শাড়িটা কোলে নিয়ে বসে থাকে। স্মৃতির ঢেউ দুহাতে ঠেলে ঠেলেও নিজেকে সরিয়ে আনতে পারে না আজকের এই সময়ে।

অরুণাভ খেতে বসে অনেক কথাই বলে যাচ্ছিল । এবার যেন সে আগেরবারের চেয়েও অনেক বেশী উত্তেজিত এই প্রজেক্ট নিয়ে। কলকাতা গিয়ে কার কার সঙ্গে মিটিং করবে, কোন কোন ব্যাপারটা কিভাবে সেটলড হবে সিরিয়ালি, সেই সব নিয়ে সমানেই খেতে খেতে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ চুপ চাপ শুনে যাওয়ার পর রক্তিমা বলে, “আর ইউ শিয়োর যে এই ফিল্মটা তুমি করছোই?”

থমকে যায় অরুণাভ। খাওয়া থামিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, “মানে? এখন এই প্রশ্নটা করবে তুমি? এতসব কিছু হয়ে যাওয়ার পর?”

“কিই বা এমন হয়ে গিয়েছে?”

“কিই বা এমন হয়ে গিয়েছে? বাহ! ডিরেক্টর ঠিক হয়ে গেল, স্ক্রিপ্ট রাইটার স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করে দিল, অর্ধেক ক্যারেক্টার আর্টিষ্ট এর প্রাইমারী সিলেকশন হয়ে গেল …”

“কখন হল এসব? এই তো পরশুও তো কিছু শুনিনি…” অবাক গলায় বলে রক্তিমা।

“আহ, তুমি যে আজকাল কোন রাজ্যে থাকো বুঝি না। সারাক্ষণই তো তোমার সামনেই কথা বলছি ফোনে। কিছুই কি শোন না?” অরুণাভ বিরক্ত গলায় বলে।

“ওহ …ফোনে! তাই বল! তা ওরকম তো কত কথাই হয়। তাকে তো আর ফাইনালাইজেশন বলে না। অজস্র কথার পরেও মানুষ ফিরে আসতে পারে।” রক্তিমা উঠে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে বলে। অরুণাভ চোখ সরূ করে তাকিয়ে বলে, “আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না তুমি কি চাইছো? আর, আমার কোন ব্যবসাতে আজ পর্যন্ত তুমি একটাও কথা বলনি। এই নতুন ব্যবসায় নামার আগে এটাই বা কেন চাইছো যে আমি ফিরে আসি? বল! এক্সপ্লেইন মি।”

রক্তিমা গুছিয়ে বসে পড়ে এক কোণে রাখা রাজকীয় আরামচেয়ারে। অরুণাভর উষ্ণ হয়ে উঠতে চাওয়া গলার আওয়াজকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বলে, “এটা তোমার কাছে শুধুই একটা ব্যবসা হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তো তা আর থাকছে না। তুমিই সেটা রাখতে চাইলে না। পলাশদা বা আমি বা আরো কেউ এর মধ্যে না থাকলে আমি এখানেও কোন কথা বলতাম না।”

অরুণাভ চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে গম্ভীর গলায় বলে, “আর তো ফেরা হয়না রুকু। ফাইনাল হতে আর সামান্যই বাকি। শ্রমণা স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করে দিয়েছে। তুমি জান ও কাজের ব্যপারে কতটা ফাষ্ট। হয়তো আমরা কলকাতা পৌঁছোনোর আগেই শেষও করে ফেলবে।”

“তুমি …! কে ওকে রাজী করালো? পলাশদা? তুমি এত কথা জানলে কখন?”

“পলাশ বাবুর কাছে নম্বর নিয়ে ও আমায় ফোন করেছিল রুকু। সব শুনে ও সঙ্গে সঙ্গেই রাজী হয়েছে। এটা আজ নয়, ওইদিনই রাত্রে যেদিন আমরা পার্ক স্ট্রীটে পলাশকে মিট করলাম।”

রক্তিমা আর একটাও কথা না বলে উঠে বেডরুমে চলে যায়। কিছু ভাল লাগছে না ওর। আজ থেকে দুদিন আগে অরুনাভ শ্রমণার সঙ্গে কথা বলে ওকে স্ক্রিপ্ট রাইটার ফাইনাল করল আর সেটা আজ জানাচ্ছে। সত্যি, ওর এই ফিল্মটা করার ঠিক কি যে উদ্দেশ্য তা রক্তিমার কাছে ক্রমশঃ ঘোলাটে হয়ে উঠছে।

অরুনাভ বোধহয় বুঝতে পারে কি চলছে রক্তিমার মনের মধ্যে। সে পঁচিশ বছর আগের সেই চেনা মানুষটা হয়ে বলে ওঠে, “আমি জানি, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন। আমি কেন এই অবিচল নিয়ে পড়লাম, কেন সেই পুরনো মানুষগুলোকেই টেনে খুঁজে বের করে আনছি, আরো অনেক কিছু। কিন্তু বিশ্বাস কর, যদি সব ঘটে যাওয়া দিন রাত মুছেও ফেলি, তবু একজন বাঙ্গালী হিসেবে আমার বরাবরই মনে হয়েছে এই নাটকটা থেকে খুব ভাল সিনেমা হবে। ব্যস এইটুকুই। আর কোন স্পেশাল উদ্দেশ্য নেই আমার।”

“কি জানি! তোমাকে আমি মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারছিনা …” রক্তিমা নিঃশ্বাস ফেলে বলে।

“বুঝতে হবে না। তুমি শুধু কাজের জন্য মনকে তৈরি কর। এবার আমি সমস্ত গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শেষ করে, মহরৎটাও করেই ফিরব। টানা স্যুটিং চলবে তিনমাস। খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। তারপর …”

“তারপর কি?”

রক্তিমার কৌতূহল ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে অরুনাভ, “তারপর আমরা বুড়োবুড়ি আমেরিকা বেড়াতে যাব।”

রক্তিমা ভ্রূকুটি করে, “সেটাও কি তোমার প্ল্যান করা হয়ে গিয়েছে?”

“নাহ …আর একটি কথাও না। এখন আমায় ঘুমাতেই হবে। তোমার দিকে তাকালেই আমার ঘুম চলে যায় এখনো।” সত্যি সত্যি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ নিয়ে ঘুমের মৃদু আওয়াজ এসে ধরা দেয় রক্তিমার কানে। রাগ করব করব ভেবেও রাগ করে উঠতে পারেনা ও। চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় লাল পাড় সাদা তাঞ্চই বেনারসীর পাগলপারা আঁচলখানা, সেই আঁচল গলায় জড়িয়ে পা ফেলে ফেলে নদীর ঘাটে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে থাকা শ্বেতা, শ্বেতার বুক জুড়ে উঠে আসা হাওয়ায় মিশে যাওয়া চিরকালীন সেই কথাগুলো।

এ পথে ঝড় ছিল জানি / তবুও ভাসালাম ভেলা, জানি তছনছ হব দুর্নিবার টানে / তবুও বাড়ালাম পা। নূপুরের লোভ, আর অগণিত চাঁদ / বিষম ত্রিভুজ সহ শতচ্ছিন্ন মন …

জানা ছিল রাত শেষে চাঁদ ডুবে যায় / যা কেউ জানত না সেই টুকু থাক / লোহার বাসর ঘরে এক বিন্দু ফাঁক ……




খুব ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল রাজারহাট নিউটাউনের স্কাইলাইন। অনেক দূরের আকাশ থেকে প্ল্যানড শহরের ঘরবাড়িগুলোকে দেখাচ্ছিল যেন পুতুলের ঘরের মতোন। বরাবরই ওপর থেকে যে কোন শহর দেখতে রক্তিমার ভাল লাগে। আজ নয়, সেই বহুবছর আগের প্রথম আকাশ যাত্রার দিনটি থেকেই ও এই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। যখন উঠবে আর যখন নামবে জানলার ছোট্ট গহবরটুকু দিয়ে পারলে সারা শরীরটাই যেন বের করে ভাসিয়ে দেয়। কোন প্লেন সিকনেস নেই ওর। শুধু পাগল পাগল লাগে মাটি থেকে এত ওপরে উঠে জনজীবনের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে। ভাললাগায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। আজও তাই গোগ্রাসে চেটে পুটে দুই চোখে ভরে নিচ্ছিল সেই ভাললাগার আবেশটুকু। অরুণাভ জানে ওর এইসব ছোট ছোট পাগলামীর কথা । শুধু আকাশেই নয় , ট্রেনে চাপলেও রক্তিমার এই এক অবস্থা। চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে ছুটে যাওয়া ঘরবাড়ি মাঠ গাছ দেখতে দেখতে পৃথিবী ভুলে যায় ও। এই সব একাগ্র সময়ে মেয়ে বা মেয়ের বাবা কেউ কখনো রক্তিমাকে ডাকাডাকি করেনা খুব দরকার না পড়লে। ওরা ওকে স্পেস দেয় যতটা পারে। আজ অরুণাভ ও তাই একবারও ডাকেনি রক্তিমাকে।

কখন প্লেন দমদম এয়ারপোর্টের মাটি ছুঁল, কখন ওরা নেমে এল বিশাল রানওয়ে পার করে মেইন এক্সিট গেটের বাইরে রক্তিমা কিছুই খেয়াল করেনি। অরুণাভর পাশে পাশে হেঁটে এলেও ওর মন এখানে ছিল না। বিশাল একটা খয়েরী সবুজ পাটকিলে ক্যানভাসে আঁকা ছবিতে যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ওর সাধারণ বাইরের সত্ত্বা। দু’চোখ প্রথম ধাক্কা খেল গাড়ীতে উঠতে গিয়ে। গেটের সামনে থেকেই অরুণাভর লোকজন ওদের মালপত্র গাড়ী ইত্যাদির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। অরুণাভর নেটওয়ার্ক সম্মন্ধে ভালরকম ধারণা আছে রক্তিমার। কোন কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে হয় না। সবটা অত্যন্ত ওয়েল অরগানাইজড অরুণাভর। রক্তিমা আনমনে হেঁটে আসছিল। অরুণাভ এগিয়ে গিয়েছে। গাড়ি থেকে একহাত দূরে থেমে যায় রক্তিমার পা।

শ্রমণা এগিয়ে আসছে। বাজারচলতি জিন্স আর শর্ট টপে লাস্যময়ী চেহারা। চুল একদম ছোট। চেহারায় প্রচণ্ড কেজো ব্যস্ততার ছাপ স্পষ্ট। আগেকার সেই লাবণ্য কোথায় উধাও হয়ে গেছে। এতবছর ধরে এত কম্পিটিভ মার্কেটে লড়াই করে সাকসেস পেতে গেলে সেটা বোধহয় আর এমনিতেও বজায় রাখা সম্ভব নয়। আগেও নিজের কাজ নিয়ে কনফিডেন্ট ছিল। এখনো সেই কনফিডেন্স ফুটে বের হচ্ছে হাবভাবে। হাসি মুখে দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে রক্তিমার দিকে। জড়িয়ে ধরে আলগা হাতে। যাকে আধুনিক সমাজে বলে হাগ করা। কিন্তু রক্তিমা সহজ হতে পারে না শ্রমণার বাহুবন্ধনে। ওর কেবলই মনে হয় শ্রমণা এখানেই আসবে ওদের রিসিভ করতে এটা নিশ্চই অরুণাভ জানত। পুরো জার্নিতে সেটা ও একবারও বলেনি। অভিমান জমতে গিয়েও যুক্তি সাজায় রক্তিমার মন। হয়তো এটাকে আলাদা কোন গুরুত্ব দিতে চায়নি অরুণাভ। অনেকেই এসেছে, আসবে। শ্রমণাও এসেছে। নিজের মনকে সামনে ফিরিয়ে আনে রক্তিমা।

কতবছর পর ও দেখছে শ্রমণাকে। ওকে দেখে মনেই হচ্ছেনা আগেকার সেই মনখারাপ করিয়ে দেওয়া দিনগুলো ওর একেবারেই মনে আছে। হয়তো ধুয়ে মুছে জীবন থেকে সব সাফ করেই নিজের অভীষ্ট পথে এগিয়েছে শ্রমণা। কিন্তু পলাশদা? তাকেও কি একেবারেই মুছে ফেলেছে ও? চট করে রক্তিমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে পলাশকে নিয়ে কত কত বার বলে যাওয়া শ্রমণার সব আবেগের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ওকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না ওর মধ্যে কোন স্মৃতিও আর অবশিষ্ট আছে। তাহলে বোধহয় এত সহজেই পারত না অরুণাভর প্রোজেক্টে জয়েন করতে।

“কি এত ভাবছো বল তো? উফফ … কতদিইইন পরে তোমায় দেখলাম! কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার! তুমি কিন্তু একদম আগের মতোই সুন্দরী আছো। না না, ভুল হল, আগের চেয়েও আরো সুন্দর হয়েছো তুমি। আমি কিন্তু তোমার সব ক’টা ফিল্মই দেখেছি। আরো ফিল্ম করলে না কেন তুমি? নিজেকে যেন সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিচ্ছ। কত সব বড় বড় পুরস্কারও তো পেলে। আমি সব নিউজ কালেক্ট করে রেখেছি। তুমি ভাবছো আমি তোমায় ভুলে গিয়েছি? না, একটুও না। সবসময় তোমাকে মনে পড়ে আমার …”

শ্রমণা চলন্ত গাড়ীতে বসে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। সব বোধহয় রক্তিমার কানেও ঢুকছে না। নিজের গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে ও এই গাড়িতেই উঠল অরুণাভ একবার বলতেই। আর রক্তিমার মনে হচ্ছে কি দরকার ছিল শ্রমণাকে একসঙ্গে যাওয়ার কথা বলার! আসলে ও এখনো শ্রমণাকে সহজভাবে নিতেই পারছে না। এই ওর একটা বড় দোষ। মন থেকে কিছুতেই কিছু কিছু দাগ মুছে ফেলতে পারে না। বহু বহুদিন পরেও না। শ্রমণার জন্য দীর্ঘদিন ধরে যত কষ্ট ও পেয়েছে, এতদিন ভেবেছিল সেসব মন থেকে মুছে গেছে। কিন্তু সেই ধারনাটাই ভুল ছিল। ওকে দেখামাত্রই আবার সব খুঁটিনাটি সমেত মনে পড়ে যাচ্ছে। শ্রমণার কথার তাই কোনই জবাব দেওয়া হয় না ওর। লক্ষ্য করে সামনের সিট থেকে অরুণাভ মেক আপ করছে রক্তিমার চুপ করে থাকাটা।

“ও তো কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ল মাঝখানে। ডক্টরের পরামর্শমত কাজ কমিয়ে দিতে হল। তাই আর কি … অভিনয় বিশেষ করছে না কোনখানেই। মঞ্চ বা পর্দা দুটোই একটু অ্যাভয়েড করে …”,

এইসব কথার কোন প্রতিবাদ না করে রক্তিমা মুখে সামান্য ভদ্রতার হাসি নিয়ে বসে থাকে। কথাগুলো অসত্য নয় আবার পুরোপুরি সত্যিও বলা যায় না। রক্তিমা কিছুই ছাড়েনি। শুধু ও সেটুকুই করে যেটা ওর নিজের ভাল লাগে। টাকা বা খ্যাতির জন্য আর কিছুই করে না।

বাড়ি চলে এল। তাহলে কি শ্রমণাও এখানেই নামবে? অরুণাভ কি বাড়ী আর অফিসের সীমাটা আগেই মুছে দিয়েছে? রক্তিমা প্রশ্ন চোখে তাকায় অরুণাভর দিকে। ফ্লাইটেই খেয়ে নিয়েছে ওরা। লাঞ্চের ঝামেলা নেই। অরুণাভ বরাবরই ওর মন পড়তে পারে। চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে নিজেই জবাব দেয়, আজ বেলা চারটের সময় প্রথম মিটিংটা ফিক্স করেছি। শ্রমণা পড়ে শোনাবে স্ক্রিপ্ট টা। এখুনি পলাশ বাবু এবং আরো দু’চারজন এসে যাবেন। তোমাকেও থাকতে হবে।”

বাহ! মনে মনে আরো একবার অরুণাভ কে প্রশংসা না করে পারেনা রক্তিমা। ও যে ভীষণ অরগানাইজড যে কোন কাজের ব্যাপারে তা জানা আছে। কিন্তু এই ফিল্ম করতে এসে প্রতিদিনই এক একটা নতুন চমক দিচ্ছে যেন। এতক্ষণে শ্রমণাকে এয়ারপোর্টেই আসতে বলার কারণটা বোঝা যায়। বাড়ির কেয়ারটেকার দরজা খুলে অপেক্ষা করছে। অরুণাভকে কিছু না বলে শ্রমণার দিকে তাকিয়ে রক্তিমা বলে, “এসো …”। ড্রয়িংরূমের ভেতরে ঢুকে শ্রমণা চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। ওর উচ্ছ্বাসটা কি বেড়েছে আগের চেয়েও! আগে তো এত উত্তেজিত হয়ে উঠত না কথায় কথায়! ভাবে রক্তিমা। ওদিকে শ্রমণা দুহাত দু’দিকে ছড়িয়ে নানা অঙ্গভঙ্গীতে কথা বলেই যাচ্ছে ,

“ওহ মাই গড! এত্তো সুন্দর ইন্টিরিয়র তোমার! উফফ! আমি পাগল হয়ে যাব। ইচ্ছে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই …”

“বেশ তো। এখানেই বস তুমি। আমি একটু আসছি।”

ওকে বসিয়ে রক্তিমা বিশাল ড্রয়িংরুমের মাঝখান দিয়ে সর্পিল গতিতে উঠে যাওয়া সবচেয়ে দামী মার্বেলের সিঁড়িতে পা ফেলে ফেলে উঠে চলে যায় দোতলায় নিজের বেডরুমে। অরুণাভ রুচিশীল মানুষ। তাতে হাজার ব্যবসা থেকে তার আয়ের কোন শেষ নেই। মনের মতো করে সাজিয়েছে বাড়ি, থাকুক আর না থাকুক। প্রশংসা পেতেই পারে অতিথি অভ্যাগতের কাছে। কিন্তু শ্রমণার সমস্ত এক্সপ্রেশনেই যেন মিশে আছে কি একটা আঠালো চটচটে ভাব। ভাল লাগেনা রক্তিমার। সে ড্রেসপত্র বদলের দিকে না গিয়ে বিছানায় গা ঢেলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমি কি একটু ওভার রিয়্যাক্ট করছি? কেন সবকিছু সহজ ভাবে নিতে পারছিনা আমি? বহুবছর আগে এই বাড়ির পাশেই তো একখানা ফ্ল্যাটের ইন্টিরিয়রের কাজ দেখাশোনা করার বাহানায় অরুনাভ তাকে কলকাতা পাঠিয়েছিল। সেটা কিছু এমন আহামরি ব্যাপার ছিল না। ওটা ছিল আসলে ওকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেওয়া। তার অনেক পরে পাশের জমিটা কিনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই বাড়ি করেছে অরুনাভ। ততদিনে অবশ্য রক্তিমার কলকাতায় একটানা থেকে যাওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। অবিচল থেকে সরে গিয়েছে ও। সরে দাঁড়িয়েছে পলাশদা আর শ্রমণাদের ঘেরাটোপ থেকে।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে বন্ধ জানলার দিকে তাকায় রক্তিমা। উঠে দাঁড়িয়ে কাচের শার্সিগুলো খুলে দেয়। ঐ তো দেখা যাচ্ছে ঐ চারতলা বিল্ডিংটা। ওর দোতলার ফ্ল্যাটটাও দেখা যাচ্ছে বন্ধ জানলা সমেত। ওটা কেন যে অরুনাভ বিক্রি করে দিচ্ছে না কে জানে! কয়েকবার ও বলেওছে। ওর সেই এক কথা। থাক না। ওই ফ্ল্যাটে অনেকগুলো রাত না ঘুমিয়ে কেটে গেছে ওর। শ্রমণার জন্য অনেক চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছে ওই ঘরগুলোতেই। মনে হত শ্রমণা ওকে ভুল বুঝে কথা বন্ধ করে দেয়নি যেন, ওর হৃদপিণ্ডটাকেই মুচড়ে দিয়েছে হাতে ধরে। কি এত ভালবাসা তৈরি হয়েছিল ঐটুকু মেয়ের সঙ্গে! যদি কথা বন্ধই হয় তবে কি এমন ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল ওর! প্রায় দুই দশক পরে নিজের আচরণ বিশ্লেষণ করে কেমন বোকা বোকা লাগছে আজ। একাই হাসে রক্তিমা। জীবন কি আশ্চর্য! যার জন্য ও এত কষ্ট পেল, যাকে একবার দেখার জন্য ও পাগল হয়ে থাকত, আজ সে নিজেই এসে ওর বাড়িতে বসে আছে আর ও তার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে নিজের ঘরে! পাশের ফ্ল্যাটের বন্ধ জানলার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে রক্তিমা। নাহ, আজ আর সেইসব আবেগের বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই ওর মধ্যে। নেই একটুও কষ্ট বা যন্ত্রণা। খুব সত্যি কথা হল অবিচলের শ্বেতার প্রতিও আর কোন আকর্ষণ বোধ করছে না ও। শ্রমণাকে শ্বেতার চরিত্র দিয়ে দেওয়ায় যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছিল বুকের ভেতর আজ আর তার কোন অস্তিত্ব নেই ওর মধ্যে। নিজেকে ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উলটে পালটে দেখে রক্তিমা। নাহ! আর শ্বেতাকে কোন প্রয়োজন নেই তার। অরুণাভ যা জানে তা ভুল নয়। তা সত্যি ছিল একসময়। কিন্তু আজ আর তার জানার মধ্যে বাস্তব সত্যি নেই একটুও। রক্তিমা আর নিজেকে শ্বেতার জায়গায় খাপ খাওয়াতে পারবে না। পারবে না কারণ ও আর চায়না শ্বেতা হতে।

এই উপলদ্ধি একদম নতুন। এক মুহূর্ত আগেও এভাবে ভাবেনি ও, নিজেকে দেখেনি এভাবে বর্তমানের আয়নায়। যদি জানত তাহলে অরুণাভ কে বারণ করত এতদূর এগোতে। নিজেকে নিয়েই ভাবছিল রক্তিমা। আবোলতাবোল ভাবনায় ছেদ পড়ে দরজায় শব্দ হওয়ায়। পাল্লা খুলতে উঁকি মারে কেয়ারটেকার নন্দ, “বৌদি, নিচে আপনাকে ডাকছেন দাদা।”

“কতজন আছে নিচে?”

“অনেকে এসেছে বৌদি। পাঁচ ছ’জন তো হবেই। আর দাদা আছে। আমাকে বললেন আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে।”

রক্তিমা বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। সিঁড়িতে পা রেখে বলে, “ওঁদের জল টল কিছু দেওয়া হয়েছে?”

“হ্যাঁ, দিয়েই এলাম তো। লস্যি দিয়েছি। এখন কেউ ড্রিঙ্ক নিলেন না, শুধু …”

“শুধু?” রক্তিমা পেছনে ঘাড় বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

“ঐ যে মহিলা ঢুকলেন আপনার সঙ্গেই। উনি হুইস্কি নিলেন।”

বাহ! শ্রমণার কত বদল হয়েছে! নিজেকে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিয়েছে বর্তমান জগতের সঙ্গে। রক্তিমার মনে পরে যায় সেই উত্তেজিত গলায় বলে যাওয়া শ্রমণার কথাগুলো।

“জানোওও …রেষ্টুরেন্টে পলাশদা তো আমার জন্য ড্রিঙ্ক অর্ডার করল। আমিও খাব না সেও ছাড়বে না। তারপর আমি এক চুমুক দিলাম …উরি বাবা! তেতোওও! তার পর জানতো কি অসভ্য যে লোকটা …উফফফ…”

রক্তিমা থামিয়েছিল ওকে, “তোমাদের সমস্ত পার্সোনাল কথা আমায় গল্প কোরোনা তো। আমার শুনতে ভাল লাগেনা …”

সেই সেদিনের শ্রমণা, এখন কত স্বাভাবিক ভাবে বসে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করছে। বাহ, খুব ভাল, জীবন তো এরকমই। স্বচ্ছ নদীজলের মত। ঝর্ণার মত। সে নিজের মনে বয়ে চলে পথ থেকে পথে, দিক থেকে দিকে। থামেনা কোথাও। মানুষই শুধু জীবনের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে নিজেকে ভেঙ্গে ফেলে হারিয়ে ফেলে অথবা নতুন করে গড়ে তোলে। কার হিসাবের জমাখরচ কেমন হবে তা জীবনের শেষে হয়তো বোঝা যায়, অথবা সেটাও অজানা থেকে যায়।

“তুমি এদিকে এসো … এঁরা সবাই তোমার জন্য ওয়েট করছেন। তুমি না এলে আমরা স্টার্ট করতে পারছিনা” অরুণাভ রক্তিমার দিকে তাকিয়ে বলে।

“ইসস তা কেন? তোমরা শুরু করে দেবে তো! আমার একটা জরুরী ফোন এসে গিয়েছিল।” সোফায় বসে থাকা মুখগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে রক্তিমা। পলাশদা এসেছে। আগেরদিনের থেকে অনেক ফ্রেশ দেখাচ্ছে ওকে। মুখ চোখ অনেক উজ্জ্বল। হারানো কনফিডেন্স একধাক্কায় অনেকটাই ফিরে পেয়েছে। পাশে বসে থাকা অল্পবয়সী একটি ছেলেকে নাট্যনির্দেশনা কত কঠিন বিষয় তাই বুঝিয়ে যাচ্ছে নিচু গলায়। ওর দিকে তাকিয়ে একটা কৃতজ্ঞতার হাসি দিল। মাঝে মাঝেই তাকিয়ে নিচ্ছে শ্রমণার দিকে। কিন্তু শ্রমণাকে একবারও পলাশদার দিকে তাকাতে দেখলনা রক্তিমা। সে স্ক্রিপ্টটা হাতে নিয়ে পড়ার জন্য রেডি। ব্যাক স্টেজে পলাশদা যখন অন্যদের নিয়ে ব্যস্ত থাকত, সেই সময়টাতেও কিভাবে এই শ্রমণা তাকিয়ে থাকত তার ইষ্টদেবতার দিকে মনে পড়ে যায় রক্তিমার । হাসিও পায়। হায় রে জীবন! তুমি সতত সঞ্চারমান। কখনো উঁচুতে তো কখনো নীচে।

অরুণাভ অনুক্ত অনুমতির অপেক্ষায় রক্তিমার দিকে একবার তাকায়। অর্থাৎ সে চাইলেই পড়া শুরু হবে। কেউ কিছু বলার আগেই পলাশদা বলে ওঠে, “আমি প্রথমেই অবিচল নাটকটা নিয়ে কিছু বলতে চাই …”

শ্রমণা সঙ্গে সঙ্গে সরু ঝাঁঝালো গলায় অরুণাভ কে বলে, “কিন্তু আজ এখানে স্ক্রিপ্টটাই শোনার কথা আগে। আমার অন্য কাজও রয়েছে। এটা পড়ে দিয়েই আমি চলে যাব।”

পলাশ অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে, “আমি যখন লেখক, কনটেন্ট সংক্রান্ত যে কোন বক্তব্য আমাকেই সবার আগে বলতে হবে। স্ক্রিপ্ট সেই অনুযায়ী তৈরি হবে। দ্যাটস ইট …”

“নো, নেভার। আমি এখানে স্ক্রিপ্ট পড়তে এসেছি, যে কোন কারুর যা খুশী লেকচার শোনার জন্য নয় …” শ্রমণা হঠাৎই বেশ তীব্রভাবে বলে ওঠে। অত্যন্ত অমার্জিত ওর কথা বলার ভঙ্গি। সম্ভাব্য ডিরেকটর সম্মন্ধে এমন কথা যে ভাবনার মধ্যেও থাকা উচিত নয় এটা বোধহয় একজন স্পটবয়ও জানে। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে যে শ্রমণা জানে না। রক্তিমা ভীষণ বিরক্ত হয়ে কিছু বলবে বলে ভাবছিল, অন্তঃত যে কথাটা ওর কিছুক্ষণ আগেই মনে হয়েছে সেটা তো এখুনি বলতে হবে। কিন্তু তার আগেই পলাশ বলে ওঠে, “আমি যে কেউ? একদিন এই যে কেউ লোকটাকেই হাতে পায়ে ধরতে এসেছিলে, ইউ সিডিউসড মী টু রিমুভ রক্তিমা ফ্রম অবিচল অ্যান্ড টু মেক ইউ স্বেতা …, মনে পড়ছে? তোমার জন্য, শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি ওকেও অকারণ আঘাত দিয়েছি …, দ্যাট ওয়জ মাই গ্রেটেষ্ট মিস্টেক…

এখন আমি যে কেউ হয়ে গেছি তাই না? বেইমান মেয়ে কোথাকার…, এই পলাশ দাস না থাকলে কে তোকে চিনত গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে? ”

প্রচন্ড চীৎকার করে ওঠে পলাশ। রাগে উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপতে থাকে ওর দামী পাঞ্জাবী জড়ানো জীর্ণ শরীরটা।

শ্রমণাও ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়। সেও সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে প্রত্যাঘাত করে যাচ্ছে। অবস্থা এতটাই আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাবে ভাবে নি রক্তিমা। কি ভীষণ অরূচিকর একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছে ঘরের মধ্যে। আর অরুণাভ কি অদ্ভুত শান্ত অবস্থায় বসে সব শুনে যাচ্ছে। আর কত অবাক হবে রক্তিমা অরুণাভকে দেখে?

সে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের বাকীদের দিকে তাকাতেও তার লজ্জা করছে। শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে তীব্র ভর্ৎসনাভরা গলায় বলে, “পলাশদা, শ্রমণা, চুপ কর তোমরা! কি শুরু করলে? ছি ছি…”

অনেকখানি চিৎকার চেঁচামেচির পর ঝপ করে ঘরের ভেতর নৈঃশব্দ নেমে আসে। রক্তিমা সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আগে অরুণাভর সামনে একবার দাঁড়ায়, “আমার সামান্য কিছু বলার ছিল …”

“বল না!” অরুনাভ জিজ্ঞেস করে হিংসা জাগানো প্রতিহিংসা নিয়ে। ও কিছু কি আঁচ করছে? অদ্ভুদ ঠান্ডা ওর গলা। রক্তিমা একঝলক তাকায় অরুণাভর দিকে।

“আমি এই ফিল্মে অভিনয় করতে চাইছি না। শ্বেতার রোল করতে আমার ইচ্ছে নেই। যেহেতু কোন এগ্রিমেন্ট ইত্যাদি হয়নি তাই মুখেই জানালাম। প্রয়োজন হলে লিখিত দিয়ে দেব। আমার জায়গায় অন্য কাউকে নেওয়া হোক …”

ঘরে যতজন বসে আছে তারা কেউ ভাবতেই পারেনি এরকম একটা কথা বলতে পারে রক্তিমা। পলাশ উত্তেজিত ছিলই। আরো বেশী অধৈর্য্য হয়ে হাত নেড়ে বলে ওঠে, “সে কি কথা! তুমি না করলে শ্বেতা কে করবে? অন্য কেউ তো পারবে না তোমার মত। না না, এটা হয় না …”

পলাশ অভিনয় করতে রাজি হয়নি। তাই হিরোর কাস্ট ভাবা হয়েছে সৌমেন সেন নামের বিখ্যাত এক অভিনেতাক। তাকেও ডেকেছে অরুণাভ। সে চুপ করে বসে থাকে। এরকম কাস্ট চেঞ্জ ফিল্ম লাইনে হয়েই থাক। অনেক দেখা আছে। উনি না করলে অন্য কেউ এসে যাবে। সৌমেনের এ নিয়ে কোন চিন্তা নেই। সে সাইনিং অ্যামাউন্ট-এর জন্য অপেক্ষা করছে। আজই ওটাও ফাইনাল হওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রোডাকশন অফিস থেকে।

পলাশকে একটাও উত্তর দেয় না রক্তিমা। শ্রমণা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসে রক্তিমা। তারপর অরুণাভ কে বলে, “আমার একটা প্রোপোজাল আছে। যদি অবশ্য প্রোডিউসার সেটা শুনতে চান তো বলি…”

“কি, কি প্রোপোজাল তোমার? আগেরদিন তো কথা হয়েই গিয়েছে যে তুমি শ্বেতা করবে। সেটাই উনিও বললেন। এখন হুট করে করব না বললে তো আমারও অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে …”

অরুণাভ একটা কথাও না বলে পলাশের কথাগুলো শোনে। তারপর তাকায় রক্তিমার দিকে, “কি প্রোপোজাল? শুনি…”

“বলছিলাম যে শ্বেতার রোলটা যদি শ্রমণাকে দেওয়া হয় …ওর কাজের স্ট্রিম যদিও চেঞ্জ হচ্ছে, আমার বিশ্বাস ও আপত্তি করবে না …, বরং অভিনয়ের প্রতি শ্রমণার একটা নিজস্ব ভালবাসা আছে, আকর্ষণ আছে এই শ্বেতা চরিত্রটির প্রতিও। পলাশদা ওকে দিয়েও অত্যন্ত সফলভাবে কাজটা করিয়ে নিতে পারবেন বলেই আমি মনে করি।”

শ্রমণা অনেকক্ষণ ধরেই বিশাল হাঁ করে তাকিয়ে ছিল রক্তিমার দিকে। এরকম যে হতে পারে ও ভাবেইনি। কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই কথা শুরু করে দেয় অরুণাভ। তার মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায়না সে বিস্মিত হয়েছে কিনা বা আদৌ এই প্রস্তাবনাতে তার কিরকম রিয়্যাকশন ইত্যাদি। খুব স্বাভাবিকভাবে ধীর গম্ভীর গলায় সে সকলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে, “বেশ, আমরা সবাই শুনলাম রক্তিমার কথা। কোন অভিনেতা অভিনেত্রীর নিজস্ব কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে। সে ব্যাপারে আমি প্রোডিউসার হিসেবে কোন মন্তব্য করব না। উনি যা যা বলেছেন তাতে আমার করে রাখা পরিকল্পনায় কিছুটা বদল আসবে। উনি দুটো মেসেজ দিলেন। এক, উনি শ্বেতা করবেন না। দুই, শ্রমণাকে শ্বেতার জন্য অফার দেওয়া যেতে পারে। আমি কাল বিকেল পাঁচটায় অফিসিয়ালি এই দুটো বক্তব্য সম্বন্ধে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব। এবং আপনারাও কিছু বলার থাকলে সেটা বলবে। তাই নিয়েও আলোচনা হবে। আমি চাই সকলে মিলে একটা টিম হিসেবে কাজ করতে। এখানে নিজেদের মধ্যে কো-অর্ডিনেশনে এতটুকু ফাঁক থাকুক আমি চাই না। তাহলে কাল আমরা পাঁচটায় মিট করছি এইখানেই?”

কথা শেষ করে উঠে পড়ে অরুণাভ। আর সৌমেন সেন, যে এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে আমার সাইনিং অ্যামাউন্টটা আজ আর হল না?”

অরুণাভ অল্প হেসে সৌমেনের পিঠে হাত রেখে বলে, “সাইনটাই তো আজ হল না। সাইন হলেই অ্যাডভান্স পেয়ে যাবেন ভাই। এই ফিল্মটা হিরোয়িন বেসড সেটা তো শুনেইছেন। এখন হিরোয়িন ঠিক হোক আগে, তারপর বাকী সব। আই হোপ উই ক্যান সর্ট আউট দ্য ম্যাটার বাই টুমরো।”

পলাশ গুম হয়ে বসেছিল। সে হঠাৎ অনেকটা উত্তেজিত হয়ে উঠেও আবার ঝিম ধরে নিয়েছে। ঘাড়ের কাছ থেকে মাথাটা বুকের ওপর ঝোলানো। কি ভাবছে তা মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে ওঠা শরীর দেখে বোঝা যায় না।

শ্রমণা প্রচন্ড অবাক হয়েছিল রক্তিমার কথায়। তারপর একটু একটু করে ওর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা উচ্চাশার পোকাগুলো বেড়িয়ে এসেছে। মনে জেগে উঠেছে অবিচলের নায়িকা হওয়ার জন্য একসময়ের আকুলতা। কি না করেছে এইটুকু পাওয়ার জন্য! এই লোকটার কাছে নিজেকে বিলিয়েও দিয়েছে। ভেঙ্গে দিয়েছে রক্তিমার সঙ্গে ওর সুসম্পর্ক। মিথ্যা কথার চাষ করেছে সুযোগ সময় মত। সব ছেড়ে রক্তিমা চলে গেল। কিন্তু শ্রমণার শেষ পর্যন্ত আর শ্বেতার রোলে নাম কেনা হল না। এই পলাশ লোকটাই তো পালটে গেল একেবারে। যে দুতিনবার শ্বেতা করেছে শ্রমণা, সবাই ওকে রক্তিমার সঙ্গে তুলনা করে শূন্যই দিয়েছে। একের পর এক নাটক ফ্লপ করতে করতে পলাশের সেই গ্ল্যামার একদিন ভ্যানিশ হয়ে গেল। তখন কোথায় শ্বেতা আর কোথায় শ্রমণা! ভাগ্য ভাল যে শ্রমণা নিজের ক্ষমতার জোরে একটা ভাল জায়গা করে নিতে পেরেছে। ওর অনেকগুলো স্ক্রিপ্ট চড়া দামে বিক্রি হল। ও অভিনয় না হোক, স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে নাম করে নিয়েছে। কিন্তু আজ এতদিন পরে আবার সেই একই চরিত্র সামনে এসে ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে নাকি! ভাগ্য যখন সুযোগটা হাতে তুলে দিল, আরেকবার পলাশের সঙ্গে সম্পর্কটা মেরামত করে নেওয়া দরকার হবে বোধহয়! পলাশ ছাড়া আর কেই বা পারবে এই ফিল্মের উপযুক্ত ডিরেকশন দিতে! যতই ঝগড়াঝাঁটি হোক, এটা স্বীকার করতে বাধ্য শ্রমণা।

নানারকম ভাবনায় নিজেকে মুহূর্তে পালটে ফেলে শ্রমণা। একটু আগেও যে কুৎসিত ঝগড়াটা হল দুজনের মধ্যে সেটা যেন হয়ইনি এইভাবে হেসে হেসে পলাশের পাশে গিয়ে বসে। দৃশ্যটা একবার তাকিয়ে দেখে রক্তিমা সবাইকে নমস্কার করে উঠে যায় সিঁড়ি দিয়ে।

“একবার দাঁড়াও প্লিজ …”

পেছন থেকে ডাক দিয়েছে শ্রমণা। রক্তিমাকে উঠে যেতে দেখে নিজেই উঠে এসেছে সোফা ছেড়ে। কিছু না বলে অপেক্ষা করে রক্তিমা ওর কথা শোনার জন্য।

“একটু ওদিকটায় আসবে?” কাচের দরজার বাইরে পেছনদিকের বড় ব্যালকনিটা দেখায় শ্রমণ। কিছু ব্যক্তিগত কথা বলতে চাইছে ও যা সকলের সামনে বলা যায় না। প্রথমেই রক্তিমার মনে হয় না করে দেয়। শ্রমণার সঙ্গে কোন ব্যক্তিগত কথা বলার বা শোনার সময় আর নেই ওর , ইচ্ছেও নেই। পরমুহূর্তেই অরুণাভ র শিক্ষা মনে করে মুখে টেনে আনে যান্ত্রিক হাসি , “বেশ তো, চল। আসলে আমি ভীষণ টায়ার্ড। শরীরটাও ভাল নেই। বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই পারছি না …, এসো …”

নিজের হাতেই দরজা খুলে ব্যলকনীতে পা রাখে রক্তিমা। সামনেই অনেকটা জায়গায় সবুজ ঘাস আর ফুলন্ত গাছে ভরা বাগান। অরুণাভ দিল্লিতে বসেই এই বাড়ির প্রতিটি গাছপালার দিকেও খেয়াল রাখে। ভারি সুন্দর হয়ে উঠেছে বাগানটা। গোলাপী রঙের বোগেনভিলিয়া সবুজের ওপর আলপনা কেটে রেখেছে। সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে ও। ভুলে যায় পাশেই দাঁড়ানো শ্রমণাকে।

শ্রমণাও মুগ্ধচোখেই দেখছিল রক্তিমাকে। তাকিয়েই ছিল চুপ করে। কিছুক্ষণ পর রক্তিমা পাশে তাকায়,

“বল, কি বলবে …”

“আমি …আমি সরি…ভীষণ সরি আমি …প্লিজ…তুমি আমাকে …” রক্তিমার হাতদুটো চেপে ধরেছে শ্রমণা। ওর পেন্ট করা গালে, পুরু আই লাইনার টানা চোখে সত্যিই বোধহয় অনুতাপ আর বিগত ভালবাসার ছোঁয়া লেগেছে। সত্যি? নাকি এটাও অভিনয়? নিজেকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও রক্তিমা থেমে যায়। নাহ, সত্যি মিথ্যে কিছুতেই আর কোন এফেক্ট হয়না আমার। আমি তো আর সেই আমি নেই। কোন পলাশকে বা কোন শ্রমণাকেই চিনিনা আমি। নতুন করে চিনতে চাইও না। শ্বেতাকেই যখন ভুলে গিয়েছি তখন এইসব ছায়া পরছায়ার জন্য কেন আর বাকি জীবনের একটাও অমূল্য মুহূর্ত নষ্ট করব? শ্রমণার হাত থেকে নিজের হাতদুটো ছাড়িয়ে নিয়ে সুন্দর করে হাসে রক্তিমা।

“সরি? কিসের সরি? কেন সরি? ওমা! শুধু শুধু সরি হতে যাবে কেন?” স্বভাবের বাইরে গিয়ে খিল খিল হাসিতে ভরিয়ে তোলে বারান্দার বাতাস। সেই অসময়ের হাসির তরঙ্গ বাগানের সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে ঢেউ হয়ে ছুঁয়ে দেয় বোগেনভিলিয়ার গোলাপি রঙ। বোগেনভিলিয়া চোখ পাকিয়ে শাসন করে ঘাসের গালচেকে, এই হাসি প্লাষ্টিকের। এতে এত আনন্দ পাওয়ার কিছু নেই। চুপ করে বোসো দেখি।

শ্রমণা একটু আহত হয়েছে বোধহয়। সে ধরা ধরা গলায় বলে, “তুমি হাসছ? আমি কিন্তু সত্যি সরি। তোমার সঙ্গে যা করেছি …”

থামিয়ে দেয় রক্তিমা, “কি করেছো? কিচ্ছু করনি তুমি। তোমার ক্ষমতাই কি করে হবে আমার সঙ্গে কিছু করার? তুমি আমার চেয়ে কত ছোট বলতো? ছোটরা সবসময় বড়দের স্নেহের পাত্রই হয়। আর কিছু থাকে না মাঝখানে। একদম এসব ভাববে না। এবার চল ভেতরে …।”

পা বাড়িয়েও যেতে পারেনা রক্তিমা। শ্রমণা এবার ধরে ফেলেছে তার শাড়ির আঁচল।

“কি হল আবার?”

“তুমি আমায় শ্বেতার রোলটা কেন দিয়ে দিলে? ওটা তো তোমারই জন্য লিখেছিল পলাশদা …, কতবার বলেছে আমায় … তুমি ছাড়া আর কেউ…”

রক্তিমা হাসে। শ্রমণার চোখে তাকায়।

“মনে কর না তোমায় ওই রোলটা গিফট করলাম আমি। একসময় তো সত্যিকার ভালবাসা ছিল আমাদের মধ্যে। ভালবাসা তো কখনো মরে না, শুধু তার চেহারা বদলে যায়।”

আর দাঁড়ায়না রক্তিমা। শ্রমণার ঢিলে হয়ে আসা মুঠির মধ্যে থেকে নিজের আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে ঢুকে যায় ভেতরে। পা রাখে মার্বেলের সিঁড়িতে।

এখন আগামী জীবন জুড়ে অবিচলের সঙ্গে তার একটাই ভূমিকা। সে শুধুমাত্র প্রোডিউসারের স্ত্রী।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *