novel-tin-tirikee-dosh

তিন তিরিক্কে দশ
নন্দিনী নাগ


সেদিন মাঝরাতে টয়লেট পেয়েছিল বলে ঘুমটা ভেঙে গেছিল আমার। নাহলে আমি তো ব্যাপারটা কোনোদিন জানতেই পারতাম না! এমনিতে রাতে সচরাচর ঘুম ভাঙে না আমার, একেবারে সকালেই উঠি, তাই এতদিন কিছু চোখে পড়েনি। উর্মি আমার দিকে পেছন ফিরে শুয়েছিল, আমার যে ঘুম ভেঙে গেছে ও বুঝতে পারেনি। ওর ফোনের আলো জ্বলতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এখনও ঘুমাওনি?”

আমার গলা শুনে চমকে উঠে পাশ ফিরল উর্মি, “হ্যাঁ এই তো ঘুমাবো।”

আমি ঘড়িতে দেখলাম রাত দেড়টা। উর্মি বরাবরই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, এত রাত অবধি ওকে ফোন নিয়ে জেগে থাকতে দেখে তাই একটু অদ্ভুত লাগল।

বাথরুম সেরে ফিরে এসে দেখলাম, ও ফোন রেখে দিয়েছে, আমিও আর কিছু জানতে চাইনি।

পরদিন উর্মি নিজে থেকেই কথা তুলেছিল।

“আমার একটা নতুন বন্ধু হয়েছে, তার সাথেই চ্যাট করছিলাম কাল রাতে। বেচারাকে অনেকরাত অবধি জেগে অফিসের কাজ করতে হয়, তাই আমি একটু সঙ্গ দিচ্ছিলাম।”

আমি আর উর্মি কখনো কিছু লুকাই না কারো কাছে, জানিস তুই। তাই স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলাম,

“কে সে? কোথায় পেলে তাকে?”

“ফেসবুকের বন্ধু। পুনেতে থাকে। তবে ভয় পেও না, সেম জেন্ডার।”

নতুন বন্ধু ওর হতেই পারে আর তার সাথে চ্যাট করাটাও দোষের কিছু নয়। সেদিন ওর নিজে থেকে জেন্ডারের প্রসঙ্গ তুলে করা ঠাট্টাটা গায়ে মাখিনি আমি, কিন্তু এখন সেইটা নতুন করে ভাবাচ্ছে আমাকে। ওর মনে অন্য কিছু ছিল বলেই কি আগেভাগে সাফাই গেয়ে রাখল! কিচ্ছু বুঝতে পারছি না রে! খুব অশান্তিতে আছি।

একটানা কথাগুলো বলে দু’হাতের মধ্যে নিজের মুখটা গুঁজে দিল সুপর্ণ। বিভাসও চুপ করে রইল, কারণ এই ব্যাপারে কোনোরকম মন্তব্য করা কিংবা পরামর্শ দেবার আগে, আরো অনেক কিছু ওকে জানতে হবে সুপর্ণর কাছ থেকে।

গতরাতে সুপর্ণ ফোন করেছিল বিভাসকে, বলেছিল, “খুব জরুরি দরকার আছে। কাল তোকে আসতেই হবে, যেভাবেই হোক।”

ছোটোবেলার বন্ধুর আবদার ফেলতে পারেনি বিভাস। অফিসের পর অন্য সব কাজ মুলতুবি রেখে চলে এসেছে সেই পাবে, যেটা ওদের বন্ধুদের আড্ডা দেবার জায়গা। সুপর্ণর সমস্যার গুরূত্ব বুঝতে পেরে ওর কথাগুলো মন দিয়ে শুনেছে বিভাস। এবারে জিজ্ঞেস করল, “তুই কি সিওর?”

“সেটাই তো জ্বালা। সিওর হলে তো ল্যাটা চুকে যেত! এসপার ওসপার কিছু একটা করে ফেলা যেত! কিন্তু এমন কিছুই পাচ্ছি না যা থেকে সিওর হতে পারি। তবুও সন্দেহ যাচ্ছে না আমার মন থেকে। সন্দেহ যে কি সাংঘাতিক জিনিস আগে কখনো বুঝিনি। আমাকে একেবারে শেষ করে দিচ্ছে। মাঝেমাঝে উর্মিকে সন্দেহ করার জন্য মনে অনুতাপ হচ্ছে, নিজেকে এত ছোটো মনে হচ্ছে যে ,ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। অথচ বেরোতেও পারছি না এই জায়গা থেকে।”

“তুই খোলাখুলি সেটা ওকে বলছিস না কেন?”

“বলিনি ভাবছিস! আমার কথা শুনে ও তাচ্ছিল্য করে ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বলেছে, নিজেই দেখে নাও! আমি রাত জেগে কার সাথে কথা বলি আর কী কী কথা বলি! আমি লজ্জায় তখন উর্মির সামনে দেখতে পারিনি, তবে পরে দেখেছি। কিন্তু কিছুই পাইনি।”

“তাহলে?”

“সেজন্যই তো তোকে ডেকেছি। কিছু একটা কর ভাই! আমাকে বাঁচা! নাহলে সন্দেহ আর বিবেকের দংশন এদুটো দুই ধার থেকে চেপে ধরে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে!”

“তুই তো ফোনে কিছুই পাসনি বললি! তাহলে এখনো কেন সন্দেহ করছিস?”

“উর্মির নতুন বন্ধুর প্রোফাইলে সত্যিই একটা মেয়ের ছবি, অল্পবয়সী একটা মেয়ে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমার চোখে ধুলো দেবার জন্যই সেই ব্যক্তি ওই ছবি রেখেছে। কেন মনে হবে না বল! শুধু রাতে নয়, সারাদিন ধরেও ওদের দুজনের মধ্যে যা চ্যাট চলে, অত কথা উর্মি এতবছরে আমার সাথেও কোনোদিন বলেনি। ওদের মেসেজগুলো আমি বেশ কয়েকদিন লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি, জানি অন্যায় করেছি, কিন্তু এছাড়া আমার উপায় ছিল না ভাই! কথাবার্তা দেখে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, ওরা কেউ কাউকে ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। অন্য কথা তো ছেড়েই দে, খেলো কি না ,স্নান করল কি না, কটায় ঘুমোতে গেল, সব দুজনে শেয়ার করে। আমার মনে হয়, কিছু কিছু মেসেজ নিশ্চয়ই ও ডিলিট করে দেয়, যেগুলো থেকে প্রমাণ পাওয়া যেতে পারত।”

“তাহলে পুরো চ্যাটই ডিলিট করে দেয় না কেন?”

“তুই একটা গাধা! পুরো চ্যাট ডিলিট করলে আমার আরও বেশি সন্দেহ হবে না! ও নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছে, আমি লুকিয়ে ওর ফোন ঘাঁটি।”

আলোচনার প্রথমদিকে বিভাস ভাবছিল, বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুপর্ণর মাথা থেকে সন্দেহের ভুত নামাবে। ভালো কথায় না হলে, গালাগাল দিয়ে ওর ঘাড় থেকে ভুত ছাড়াবে। উর্মিকে সেই কলেজ লাইফ থেকে চেনে বিভাস, বড় ভালো মেয়ে। বিয়ের এতবছর বাদে, যখন ছেলেটাও বড় হয়ে গেছে, তখন কি না ও পরকীয়া করতে যাবে! কি বুঝতে কী বুঝেছে ছেলেটা! কিন্তু এখন সুপর্ণর কাছে সমস্ত কথা শোনার পর বিভাস নিজেও দ্বিধায় পড়ে গেল! নিজেই সঠিক বুঝতে পারছে না বিষয়টা, তো সুপর্ণকে কি বোঝাবে? গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বসে থেকে অবশেষে বলল, “দেখছি, কি করা যায়! আমি একবার উর্মির সাথে কথা বলব ভাবছি।”




উর্মি নিজেও বুঝতে পারে না কি ম্যাজিক চলছে তাকে ঘিরে।

সকালে ঘুম ভেঙে চোখ খোলার আগেই পালকের মুখটা ভেসে ওঠে বন্ধ চোখের পাতায়, রাতে চোখ বোজার আগেও ওই মুখটাই দেখতে সাধ হয়। দুপুরে খেতে বসার আগে মনে হয়, হয়তো ওর খাওয়া হয়নি, কাজের চাপে বেচারা খেতেই সময় পায়নি। অমনি মেসেজ করতে ছোটে। মাঝেমাঝে পালক ধমক লাগায়, “তুমি এত কেন চিন্তা করো বলতো? আমি কি কচি বাচ্চা?”

উর্মি হাসে। পালকের ওই ধমকের মধ্যে যে বিরক্তি নেই সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না ওর। তাই ভারিক্কি চালে জবাব দেয়, “সে তুই বুঝবি না।”

পালক যতই নিজেকে কচি বাচ্চা নয় বলে দাবি করুক না কেন, উর্মি বেশ বুঝে গেছে ওর মধ্যে একটা শিশু এখনো গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। পালককে একান্তে পেলে সেই শিশু ঘুম ভেঙে বেরিয়ে আসে, আর দস্যিপনা করে বেড়ায়। ওর সমবয়সী আর দশজন ছেলেমেয়েদের মতো নয় পালক, তাই তো ওকে এত ভালো লাগে উর্মির, এতো ভালোবাসে।

ভালোবাসার কথা শুনে প্রথম প্রথম খুব হাসত পালক, বলতো, “আমার মতো একটা তারকাটা উড়নচণ্ডীর মধ্যে তুমি কী দেখলে বলতো? ”

“তোর পিওরিটি দেখলাম। তুই এতো ইনোসেন্ট, এতো জেনুইন যে ভালো না বেসে পারলাম না।”

“বিরাট ভুল করছ কিন্তু! পরে পস্তাবে তুমি, সাবধান করে দিলাম।”

পালক মুখে না বললেও উর্মি বেশ বুঝে গেছে, অনুভবে সেও পিছিয়ে নেই। সারাদিনের যাবতীয় কথা উর্মিকে না বলে শান্তি পায় না পালক। দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান প্রায় এক প্রজন্মের, কাজেই দৃষ্টিভঙ্গীও আলাদা হবারই কথা। অথচ দুজনে এমনভাবে আদান-প্রদান করে সমস্ত অনুভূতি, যে মনে হয় ওরা সেই নার্সারি ক্লাস থেকে পাশাপাশি বসে বেড়ে উঠেছে।

“তোকে আমার এত চেনা লাগে পালক, তোর সব কিছু এত পরিচিত লাগে, যে মনে হয় তোকে সেই ছোট্টবেলা থেকে চিনি”

“ভাগ্যিস বলনি গত জন্ম থেকে চেনো!” এরপর একটা হাসিমুখের ইমোজি পাঠিয়েছিল পালক।

“ইয়ার্কি মারিস না! আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বললাম।”

এবারে একটা আদুরে মুখের ছবি এল ওদিক থেকে, সাথে সাথে জবাবও এল, “জানি তো। তুমি আমাকে আমার চাইতেও ভালো চেনো। তোমার সঙ্গে কথা বললে মনে হয় যেন আমি নিজের সাথেই কথা বলছি।”

“থাক! আর মাখন লাগাতে হবে না!”

“না গো, সত্যি বলছি! আর সেইজন্যই আমার ভয় লাগে।”

“ভয় আবার কিসের?”

“তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। জানো, সেই ছোটোবেলা থেকেই যা কিছু আমার প্রিয় ছিল, ভালোবাসার ছিল, সব হারিয়েছি, কিছুই ধরে রাখতে পারিনি।”

এরকম একটা বিষণ্ণতা মাখা কথা লেখার পর পালককে অনেক কিছুই লেখার ছিল উর্মির। লেখার ইচ্ছে ছিল, আমাকে নিয়ে অহেতুক ভয় পাস না, আমি তোকে কোনোদিনই ছেড়ে যাব না যতদিন না ওপরওয়ালা ডাক পাঠায়। কিন্তু একটা শব্দও লিখতে পারল না উর্মি, ভাত পোড়া গন্ধ নাকে লাগাতে ফোন ফেলে দুদ্দাড়িয়ে ওকে ছুটতে হল রান্নাঘরে। ওভেনে ভাত বসিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে পালকের কাছে আসামাত্র ভাতের সাথে ওর যে কোনো সম্পর্ক আছে, সেটা একেবারে ভুলে মেরে দিয়েছিল উর্মি। এখন এই পোড়া ভাত ওপরের দিক থেকে আলতো করে তুলে নিয়ে সুপর্ণকে খেতে দিতে হবে। নতুন করে আবার রান্না করার মতো সময়ও নেই, সুপর্ণ স্নানে গেছে, এখুনি খেতে বসবে। খেতে বসে যদি ভাতে পোড়া গন্ধ পায়, তবে আবার সেই ফোনের প্রসঙ্গই তুলবে সুপর্ণ, জানে উর্মি। ফোনের প্রসঙ্গ মানে আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পালকের প্রসঙ্গ, যেটা নিয়ে সুপর্ণর সাথে আলোচনা করতে উর্মির ভালো লাগে না, তাই এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করে। সুপর্ণ বাড়িতে থাকলে তাই পালকের সাথে ফোনে কথাও বলে না উর্মি, কে জানে আবার কি শুনে কি ভেবে বসে!

মাঝে মাঝে অবশ্য মনটা বিদ্রোহ করে উর্মির, কোনো অন্যায় তো করছে না ও, তাহলে কেন এমন লুকোছাপা করবে! এই বয়সে এসে, যখন কি না বাণপ্রস্থ যাওয়ার সময় এগিয়ে এসেছে, তখন কার সাথে কথা বলবে, কার সাথে মিশবে, সেসব কি অন্য কারো পছন্দ অনুযায়ী করবে!

তবে এই বিদ্রোহী মনোভাব স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ, সংসারে শান্তি বজায় রাখার কথা ভেবে আবার নিজের গুহাতেই ঢুকে যায়।

সুপর্ণর পিছুপিছু রনিও বেরিয়ে যায় প্রতিদিন। কলেজের পর আড্ডা-টাড্ডা মেরে ছেলেটা সন্ধের আগে কোনোদিনই বাড়ি ফেরে না, আর ওর বাবা তো ফেরে আরো পরে। একা থাকার এই দীর্ঘ সময়টা আগে যেন ফুরাতেই চাইত না উর্মির, ঘুমিয়ে, বই পড়ে, গান শুনে, কিছুতেই ঘড়ির কাঁটাটাকে সাতটার দিকে ঠেলা যেত না। আর এখন পালক থাকাতে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায়! মাঝেমধ্যে তো এমনও হয়, রনি ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে, অথচ জলখাবার বানানো হয়নি। হাসতে হাসতে সেই কথা পালককে বলতে ওদিক উত্তর এসেছে, “ইসস! আমি যদি তোমার কাছাকাছি থাকতাম, তবে অফিস থেকে ফিরে এসে রনির মতো ভালো ভালো খাবার পেতাম! যাও তুমি ছেলের জন্য খাবার বানাও, এখন ফোন রাখো।”

যদিও কথাটা পালক হাসতে হাসতেই বলেছিল, তবু উর্মির মন থেকে খচখচানিটা যায় না। হা-ক্লান্ত হয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে বেচারাকে যে এক কাপ চা খেতে হলেও নিজেকেই তৈরি করে খেতে হয়, সেটা তো জানে উর্মি। ভালো কিছু রান্না করলেই তাই চারবেলা দোকানের কেনা খাবার খেয়ে দিন কাটানো পালকের জন্য দীর্ঘশ্বাস বার হয়ে আসে উর্মির।

“তুই যখন আসবি তোকেও অনেক কিছু রান্না করে খাওয়াব।”

কথাটা শুনে খুব হেসেছিল পালক, “তুমিও কিছু পারো! শোনো, চাপ নিও না তো একদম, আমি খেতে মোটেও ভালোবাসি না।”

উর্মি তর্ক করেনি, চুপ করে শুনছিল পালকের হাসি। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নেমে আসা জলের স্রোতের মতো সেই হাসি ভাঙতে ভাঙতে ছড়িয়ে পড়ছিল উর্মির ভেতরে, ভীষণ ভালো লাগছিল ওর। উর্মির দিক থেকে কোনো জবাব না পেয়ে পালক খোঁচালো, “কি গো? রাগ করলে নাকি?”

প্রশ্নটা কানে ঢোকেনি উর্মির। কিংবা এটাও হতে পারে, পালকের ওপরে রাগ হবার আদৌ কোনো কারণ ছিল কি না সেটা ওই মুহূর্তে মনে পড়েনি ওর। কারণ পালকের হাসি ওর মধ্যে যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছিল তার রেশ তখনো কাটেনি। অনেকটা স্বগতোক্তি করার মতো করেই বলল উর্মি, “তোর হাসিটা বড্ড সুন্দর।”

“দুসস! তোমার চোখ আর কান দুটোই গেছে!” আবার খিলখিল করে হেসে ফেলল পালক।




“এতরাতে কার সাথে চ্যাট করছিস রে!”

ঋজুর মেসেজটা ঢুকল পালককে অনলাইন দেখে। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে যে কয়েকজনের সঙ্গে পালকের এখনো যোগাযোগ আছে ঋজু তার ভেতরে একজন। তার জন্য অবশ্য পুরো ক্রেডিট ঋজুরই প্রাপ্য, নিয়মিত ফোন করা কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে খোঁচানোর কাজটা ও নিষ্ঠা সহকারেই করে থাকে, যেমন আজও করল।

“জেনে তোর কি হবে!”

“বলই না! নতুন পার্টনার জুটিয়েছিস?”

“তুই এর বাইরে আর যেতে পারিস না, না? ডোন্ট ডিস্টার্ব, এখন তোর সাথে বকতে পারছি না।”

“শুধু একবার বল কার সাথে এখন চিপকে আছিস, আমি কেটে পড়ছি।”

“উর্মিদি। যা তো এবারে।”

“আর ইউ ক্রেজি! রাত জেগে কি না উর্মিদি! আমি বিশ্বাস করলাম না।”

“ইউ জেলাস! যা ভাগ!”

ঋজু সেই রাতের মত বিদায় নিল বটে, তবে পরদিনই ফোন করল পালককে। কোনোরকম ধানাইপানাই না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “তুই কাল মিথ্যে বললি কেন আমাকে! এত বয়স হল, এখন এইসব লুকোচুরির কোনো অর্থ আছে?”

“মানে? আমি তোকে আবার কি মিথ্যে বললাম!” পালক সত্যিই বুঝতে পারছিল না ঋজুর রাগের কারণ।

“তুমি শালা প্রেম করছ, আবার সেটা লুকিয়ে ন্যাকামি করছ!

“আমি প্রেম করছি এই গোপন খবরটা আমাকে জানানোর আগে তোকে কে দিল?” পালক হাসতে হাসতে বলল।

ওর হাসিতে আরো পিত্তি চটে গেল ঋজুর, একটা খিস্তি দিতে গিয়েও গিলে নিয়ে বলল, “তাহলে রোজ অত রাত পর্যন্ত চ্যাট করিস কার সাথে? বলতে না চাইলে বলবি না! স্কুলের বাচ্চাদের মতো ঢপ দিলি কেন!”

পালক এবারে বুঝতে পারল ঋজুর রাগের কারণ, তাতে ওর আরও হাসি পেতে লাগল। ব্যাটা নিজে না ঘুমিয়ে পালকের ফোনে নজরদারী চালিয়েছে বাচ্চাদের মতো, আবার উল্টে ওকেই বলছে স্কুল স্টুডেন্ট! নাহ্ ছেলেটার এইসব স্বভাব আর বদলালো না। কোনোমতে হাসি চেপে পালক বলল, ” ওরে পেগাসাস! স্পাইং করার স্বভাবটা এবার বদলা, নইলে কিন্তু তোর কপালে অনেক কষ্ট আছে। শোন আমি তোকে মোটেও ঢপ দিইনি। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে তোর সন্দেহ মেটাবো। এখন ফোন রাখছি, নইলে বস আমাকেও মিটিয়ে দেবে।”

সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ফিরে পালক ফোন করল ঋজুকে। তবে পালকের বকবকানিই সার হল, ঋজু কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইল না ওর কথা।

“তুই বলছিস বলে মেনে নিতে হচ্ছে, তবে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, তুই প্রতিদিন এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে চ্যাট করিস রাত জেগে।”

“বিলিভ মি ইয়ার! আচ্ছা, তোকে মিথ্যে বলে আমার লাভ কি বল!”

“সেটাই তো ভাবছি। দেন, আই মাস্ট সে, ইউ আর ক্রেজি। তোর ইমিডিয়েট একটা প্রেম করা উচিত।”

ঋজুর উদ্বেগ দেখে সশব্দে হেসে ফেলল পালক। টেলিফোনের অপর প্রান্তে সেই হাসির আওয়াজ পৌঁছে গিয়ে ঋজুর রাগের আগুনে খানিকটা যেন ঘি ঢালল।

“দাঁত ক্যালাস না গাধার মতো। আমার তো মনে এখন অন্য আর একটা চিন্তা উঁকি দিচ্ছে।”

“কী?” সিরিয়াস গলাতে জিজ্ঞেস করল পালক।

“মে বি ইউ আর আ লেসবি”

সারাটা রাত ঘুমাতে পারল না পালক। ঋজুর কথাটা সূঁচের মতো বিঁধে গেছিল ওর মনে, রাতে আলো বন্ধ করার পর সেই সূঁচই ছুরি হয়ে ফালাফালা করে দিতে লাগল ওকে।

এমনিতে কারো কথায় বড় একটা বিচলিত হয় না পালক, কিন্তু আজ ঋজুর বলা কথাটা ওকে যেন নগ্ন করে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। মনের অতল থেকে একের পর এক প্রশ্ন উঠে এসে জেরায় জেরায় ওকে জেরবার করে তুলতে লাগল, সেই প্রশ্নগুলো ওর মনটাকে যাচাই করে জেনে নিতে চাইছিল ঋজুর বক্তব্যের মধ্যে সত্যিই কোনো সত্যতা লুকিয়ে আছে কিনা, যার সন্ধান এতদিন ও নিজেই পায়নি।



উর্মির প্রতি ওর ভালোবাসা প্রশ্নাতীত। কারণ উর্মিদিই তো ওকে শিখিয়েছে ভালোবাসতে, নিজেকে এবং জীবনকে। উর্মিদি না বললে পালক কোনোদিন জানতে পারত নাকি, যে ও এত সুন্দর! বরং ছোটবেলা থেকে উল্টোটাই জেনে এসেছে। গায়ের রঙ আর নাক, দুটোই চাপা, মুখের ছাঁদে কমনীয়তা কম, এই মেয়েটাকে বানানোর সময় ভগবান কিপ্টে হয়ে গেছিলেন, তাই দিদির মতো সুন্দর তো দূরের কথা, দিদির নখের যোগ্য করেও পাঠাননি ছোটো বোনটাকে, এমনটাই শুনে শুনে, তা বিশ্বাস করে বেড়ে উঠেছে পালক। এমনকি একবছর প্রেমপর্ব চলাকালীন সুস্মিতও কখনো বলেনি যে হাসলে পালককে ভারী সুন্দর দেখায়। বলেনি ওর ঠৌঁটের জ্যামিতিতে যে সারল্যের আঁকিবুকি তা ওর ভেতরের শিশুর মত নিষ্পাপ মানুষটাকেই প্রকাশ করে প্রতিটি হাসিতে। উর্মিদিই তো প্রথমবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পালকের চোখের দৃষ্টি আর চোয়ালের দৃঢ়তায় এমন একটা কর্তৃত্ব মেশানো সৌন্দর্য আছে যা ওকে আভিজাত্য দিয়েছে, দিয়েছে বিশিষ্টতা। সকলের সমীহ আদায় করে নেবার মত একটা ব্যক্তিত্ব আছে পালকের যার জন্য ওকে ওর রূপসী দিদির থেকেও বেশি আকর্ষণীয় লাগে, এটা তো উর্মিদিই বুঝিয়ে দিয়েছে। আর সেইজন্যই তো আয়নায় দেখা মেয়েটাকে প্রতিদিন আরো বেশি করে ভালোবাসতে শুরু করেছে পালক।

উর্মিদি আছে বলেই একলা থাকলেও একাকীত্ব গায়ে লাগেনা, সুস্মিতের জন্য মনখারাপের দিনগুলোকেও পালকের এখন হাস্যকর মনে হয়। কাল কি হবে জানা নেই, তবে ওর আজকের দিনগুলোকে খুশি আর ভালোলাগা দিয়ে পুরোপুরি ভরে রেখেছে উর্মি নামের যে মানুষটি, তাকে ভালো না বাসাটাই তো অস্বাভাবিক।

উর্মিদির প্রতি যে টান, তার প্রকৃতি নিয়ে কখনো কাঁটাছেড়া করেনি পালক, আজ ঋজু এমন একটা তকমা গায়ে সেঁটে না দিলে ভালোবাসা নিয়ে এত বিশ্লেষণও করত না হয়ত ও। কিন্তু এখন যখন বিশ্লেষণ করা শুরুই করে ফেলেছে, তখন সেটা সৎ ভাবেই করতে হবে। এইটুকু ভাবামাত্র বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠল পালকের, দোদুল্যমানতায় দুলতে দুলতে দ্বিখণ্ডিত হতে থাকল ওর মন।

বালিশে মাথা ছোঁয়ানো মাত্র যে মেয়েটা তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে, তার চোখে আজ ঘুমের লেশমাত্র নেই। সহজ সরল মেয়েটা ভাবছে আর ভাবছে উর্মিদির জন্য ওর যে ভালোবাসা, যে টান, সে কি প্রেমের তুল্য? ফিরিয়ে আনছে সুস্মিতের সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি, বুঝতে চেষ্টা করছে সুস্মিতের সঙ্গে দেখা করার জন্য, কথা বলার জন্য তখন ওর মনের মধ্যে যে অস্থিরতা হত তার সঙ্গে এখনকার অনুভূতির পার্থক্য কোথায়? দূরে থাকে বলে উর্মিদির সাথে সশরীরে দেখা করতে পারে না বটে, কিন্তু ভিডিও কল করে রোজই। প্রতিদিন ফোনে কথা তো হয়ই, তা সত্বেও সারাদিন ধরেই মেসেজ চালাচালি হতেই থাকে। এটা কি প্রেমে পড়ার লক্ষণ? দিশাহারা লাগতে থাকে পালকের।

বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়ালো পালক। নিজের শতচ্ছিন্ন মনটাকে একটু জুড়ানোর জন্য বাইরের ঠান্ডা হাওয়া চোখে মুখে লাগতে দিল। অবশ্য তাতে শরীরটা ঠান্ডা হলেও মন অশান্তই থেকে গেল। এইসময়ে ওর আরও বেশি করে উর্মিদিকে মনে পড়ছিল, মনে হচ্ছিল সে নিশ্চয়ই এই বিরোধের মীমাংসা করে ওকে মুক্তি দিতে পারত এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু এই গভীররাতে উর্মিদিকে ফোন করা উচিত নয়, তাছাড়া এমন একটা কথা পালক কিভাবেই বা বলবে তাকে! অন্য সব কথা মন খুলে বললেও নিজের এই মানসিক যন্ত্রণার কথা কখনোই উর্মিদিকে বলতে পারবে না পালক, তাতে মানুষটাকে ছোটো করা হবে, তার ভালোবাসাকে অসম্মান করা হবে।

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্ধকারকে ফিকে হয়ে আসতে দেখল পালক, রাতচরা পাখিদের ডাকাডাকি স্তিমিত হয়ে আসতে শুনল। ধীরপায়ে ঘরে যখন ফিরে এল পালক তখন ওর অসহায়তা কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, আর ওর ইচ্ছে করছে উর্মিদির কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে। ইচ্ছে করছে উর্মিদি মুছে নিক ওর যত কষ্ট, উর্মিদির হাতের স্পর্শে ঘুম নামুক ওর দুচোখ জুড়ে।




দুপুরের খাওয়া শেষ করে রান্নাঘর গোছাচ্ছিল উর্মি, এই সময়ে কলিংবেল বেজে ওঠায় বেশ বিরক্তই হল ও। যত ডেলিভারি পার্সন, সেলসম্যান আছে, এই ভরদুপুর ছাড়া তারা আর আসার আর সময় পায় না। নিজের মনে গজগজ করতে করতে দরজা খুলতে গেল উর্মি। সকাল থেকে নানা কারণে মনটা ওর তেতো হয়ে আছে, ভেবেছিল এখন চুপচাপ শুয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেবে, তা নয় এখন আবার ফালতু গুচ্ছের বকবক করতে হবে। তবে ম্যাজিক আইতে চোখ রেখে বিভাসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উর্মির খারাপ লাগাটা কেটে গেল, ভীষণ অবাকও হল ও।

একে তো এতদিন বাদে এসেছে বিভাস, তাও আবার এই অসময়ে। দরজা খুলে নিজের মনোভাব গোপন করতে পারল না উর্মি।

“তুমি? এতদিন পরে পথ ভুল করে এলে নাকি?”

“কাছাকাছি এক জায়গায় এসেছিলাম কাজে, মনে হল দেখা করে যাই, তাই চলে এলাম। তা বর বাড়িতে নেই বলে কি ঢুকতেও দিবি না?”

কলেজ জীবন থেকে বিভাসের সঙ্গে উর্মির পরিচয়, সুপর্ণর সাথে সম্পর্কেরও আগে থেকে। সুতরাং সুপর্ণর বাড়িতে থাকা বা না থাকাতে বিভাসের যে এই বাড়িতে ঢোকা আটকাবে না সেটা ওরা দুজনেই জানে। হাসতে হাসতে পথ ছেড়ে দাঁড়াল উর্মি।

নানারকম গল্প করতে করতে বিভাস ভাবছিল কিভাবে আসল কথাটা পাড়বে। সেইজন্যই নির্ভেজাল আড্ডায় মনঃসংযোগ করতে পারছিল না। ওর উশখুশ ভাবটা চোখ এড়ায়নি উর্মির, তাই ও সরাসরি জিজ্ঞেস করল,

“তুমি কি কিছু বলবে বিভাসদা? বিশেষ কোনো কথা?”

ধরা পড়ে গিয়ে আরো অপ্রস্তুত বিভাস, কোনোরকমে হোঁচট খেয়ে সুপর্ণর সন্দেহের কথাটা বলল উর্মিকে।

উর্মি গম্ভীর হয়ে গেল।

“তুই রাগ করিস না প্লিজ! সুপর্ণর কথাটা ভাব একবার! ও তোকে ভালোবাসে, বেচারা খুবই মানসিক যন্ত্রণায় আছে!”

“তাই তোমাকে দূত হিসাবে পাঠিয়েছে? সেই কলেজ লাইফের মত?”

রাগে লাল হয়ে গেছিল উর্মির মুখ। বিভাসও বাক্যহারা। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বিভাস বলল,

“দ্যাখ-”

“তুমিই আগে দেখো-”

বিভাসকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল উর্মি। বোকার মত বসে রইল বিভাস।

কয়েকমিনিটের মধ্যে উর্মি ফিরে এল, হাতে নিজের স্মার্ট ফোনটা নিয়ে।

“দেখো! এই হচ্ছে আমার বন্ধু পালক, যাকে নিয়ে তোমার বন্ধুর অশান্তির শেষ নেই।”

একটি অল্পবয়সী মেয়ের ছবি দেখালো উর্মি।

“আমার চ্যাটিং এর সময়গুলো দেখো। তাহলেই বুঝতে পারবে, এর সাথেই আমি দিনরাত কথা বলি, কারণ আমার ভালো লাগে। তুমি আমার কললিস্টও দেখতে পারো। দেখবে প্রতিদিনই ওকে আমি কিংবা ও আমাকে কল করেছে, আর সবগুলোই অনেক সময় ধরে। কারণটাও শুনে নাও, আমি পালকের সাথে কথা বলতে ভালোবাসি, আর ও-ও তাই।”

তখনও রাগী দেখাচ্ছিল উর্মির মুখ, নাকের পাটা ফুলে উঠছিল প্রতিটা কথার সঙ্গে। বোঝাই যাচ্ছিল সাংঘাতিক আহত হয়েছে ও। বিভাস ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করল।

“অত রাগছিস কেন! জানিস না রাগলে শরীর খারাপ করে!”

“এসব ন্যাকামির কথা ছাড়ো বিভাসদা! যার দূত হয়ে এসেছ, তাকে গিয়ে বোলো, কোনো শাস্ত্রে লেখা নেই বন্ধুত্ব কেবল সমবয়সীদের মধ্যে হবে! যার সাথে মনের মিল হবে, যার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগবে, তার সাথেই বন্ধুত্ব হবে।”

অসভ্যতা জেনেও বিভাস দ্রুত চোখ বোলাচ্ছিল উর্মির সঙ্গে পালকের চ্যাটগুলোতে, কারণ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতুহল বড় বেশি। এবারে উর্মিকে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

“মেয়েটা কিন্তু তোকে বড্ড ভালোবাসে।”

“তাতে দোষের কি কিছু হয়েছে? আমিও ভীষণ ভালোবাসি পালককে।”

আজ সকাল থেকেই উর্মির মনে অশান্তি লেপটে আছে। যে মেয়ে গুডমর্নিং মেসেজ না দিয়ে কোনোদিন বিছানা ছাড়ে না, বেলা দশটা বেজে যাবার পরও তার কোনো মেসেজ নেই। শুধু তাই নয়, উর্মির পাঠানো মেসেজগুলোও পৌঁছায়নি ওর কাছে। সকাল আটটা থেকে দশটার মধ্যে বহুবার কল করেছে উর্মি, প্রত্যেকবারই একই উত্তর পেয়েছে, “সুইচড অফ”।

এমন নয় যে আজ ছুটির দিন, ফোন বন্ধ করে সারা সপ্তাহের ঘুমের ঘাটতি পুষিয়ে নিচ্ছে পালক! যদি তাও হত, তবে উর্মিকে আগে থেকে জানিয়ে রাখত ও। মনের মধ্যে খচখচানিটা নিয়েই সকাল থেকে সংসারের সব কাজ সামলেছে উর্মি, রোজকার রুটিনের কাজ, তবু ভুলভ্রান্তি হয়ে গেছে অনেক।

বেলা বারোটা বেজে যাবার পরেও পালকের দুটো ফোন থেকে যান্ত্রিকস্বর একই কথা শোনালো যখন, উর্মির কান্না পেতে লাগল। কিছু একটা যে হয়েছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা যে কী জানার কোনোই উপায় নেই। শুধু ফোন নাম্বার ছাড়া ওর কাছে পৌঁছানোর কোনো উপায়ই জানা নেই উর্মির। পুনেতে যেখানে থাকে পালক, তার ঠিকানা জানা আছে, কিন্তু সেখানে যাবে কী করে? কী কৈফিয়ত দেবে সুপর্ণ কিংবা রনিকে! অসহায় লাগতে থাকে উর্মির, চোখের জল কোনো সমাধান নয় জেনেও তাতেই ভাসতে থাকে, আর কিছুক্ষণ পর পর ডায়াল করতে থাকে পালকের নাম্বারে।

বেলা দুটো নাগাদ প্রথমবার রিং হল। ফোনটা ধরতে যে সময়টুকু নিচ্ছিল ওপ্রান্ত, সেই সময়টাতে উর্মির বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছিল। ওর মনে হচ্ছিল, নিজের বুকের ধুকপুকুনির শব্দ ছাপিয়ে ওদিককার কোনো কথাই যেন কান অবধি এসে পৌঁছাবে না।

“বলো” জড়ানো গলায় বলল পালক।

“বলবি তো তুই! কী হয়েছে তোর!” এতক্ষণের জমিয়ে রাখা উদ্বেগ কান্না হয়ে বার হয়ে এল উর্মির।

“তুমি কাঁদছ?”

“না তো কি নাচব! কী হয়েছে আগে বল, নয়ত স্ট্রোক হয়ে যাবে আমার। এত টেনশনে ফেলে দিয়েছিলিস!”

“সরি! আমি ঘুমোচ্ছিলাম। শরীরটা ভালো লাগছিল না।”

“মিথ্যে কথা বলবি না পালক, আমি সব বুঝতে পারি। কি হয়েছে বল আমাকে?”

“সত্যি গো। কাল রাতে ঘুমোতে পারিনি একদম, সকালে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এই জাস্ট উঠলাম।”

“কিন্তু ফোন বন্ধ করে রেখেছিলি কেন?”

“চার্জ ছিল না। বুঝতে পারিনি যে বন্ধ হয়ে গেছে!”

“ঠিক আছে, সত্যি কথাটা বলতে না চাইলে বলিস না। কিন্তু আর মিথ্যে বলে পাপের বোঝা বাড়াস না পালক। বেলা দুটো অবধি না খেয়ে আছিস, এখন ফোন রাখ, স্নান খাওয়া করে নে।”

পালককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল উর্মি। পালক ভীষণ আবেগপ্রবণ, হয়তো কারো সাথে কোনোরকম ঝামেলা করে মনখারাপ করে বসে আছে, তাই এসব কান্ড করেছে। তবে মেয়েটা যে ঠিক আছে, কোনোরকম দুর্ঘটনা ঘটেনি, এটা জেনেই স্বস্তি পেয়েছে ও।

আজ সকাল থেকে এক কাপ চা আর একটা বিস্কুট ছাড়া কিছুই খাওয়া হয়নি উর্মির, পালকের চিন্তায় এতটাই ডুবে ছিল ও। এখন দুশ্চিন্তা মাথা থেকে নামতে খিদে পেয়ে গেল খুব।

একলা বাড়িতে খেতে বসা উর্মিকে গিলে খেতে লাগল অভিমান। পালকের যদি অন্য কারো সাথে ঝামেলা হয়, কিংবা মেজাজ খারাপ থাকে তবে তার জন্য সে কেন উর্মিকে কষ্ট দেবে! ওর তো বোঝা উচিত, ফোনে ওকে না পেলে উর্মি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়বে! তার মানে এসব নিয়ে পালক মোটেই ভাবিত নয়, শুধু শুধু উর্মিই বোকার মত ভেবে মরে।

অভিমান বড় বড় ফোঁটায় গড়াতে লাগল ওর গাল বেয়ে। ছেলে হোক বা মেয়ে, বন্ধু হোক বা প্রেমিক, ভালোবাসার মর্যাদা কেউই দেয় না। শুধু বোকাগুলোই ভালোবাসে আর কষ্ট পায়। উর্মি ঠিক করল, এবার থেকে পালকের ক্ষেত্রে আর একটু সংযত হবে, নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে, যাতে এমন অযাচিত কষ্ট আর পেতে না হয়।




ফোনটা রেখে দেবার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল পালক। মিথ্যেটা ধরে ফেলে উর্মিদি যে দুঃখ পেয়েছে সেটা ও বুঝতে পারছে, কিন্তু আর কী-বা করার ছিল ওর শরীর খারাপের অজুহাত দেওয়া ছাড়া! ও কি বলতে পারত, একটা সন্দেহের ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে আমার মনে, সে ঠুকরে খাচ্ছে আমার মগজ, এই অবস্থার মধ্যে তোমাকে টেনে আনতে চাই না আমি। যতক্ষণ না লড়াইতে একজনের জিত না হয়, ততক্ষণ তোমার কাছ থেকে দূরেই থাকতে হবে আমাকে, এটা ভেবেই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলাম নিজেকে। সেই মগজখেকো ঘুণপোকা, যে কী না কাল রাত থেকে একটু একটু করে খেতে শুরু করেছে আমাকে, তাকে না মেরে ফেলা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না ভেবেছিলাম, কিন্তু পারলাম কই! সেই তো লড়াইয়ের শেষ না দেখেই ফোনের সুইচ অন করে ফেললাম, খুলে দিলাম যোগাযোগের সেতু। তোমার সাথে কথা বললেই আমি দূর্বল হয়ে যাব, সে তো আমার জানাই ছিল। ঘুণপোকা আমার মগজের পুরোপুরি দখল নিয়ে নিলে আমি একেবারেই ছেড়ে চলে যাব তোমাকে এমন যে পরিকল্পনা করেছিলাম, তোমার সাথে একবার কথা বলে ফেললে সেই সংকল্প যে আমি আর রাখতে পারব না, এটা জানতাম বলেই সকাল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করেছি। তবু সফল হতে পারলাম কই!

এসব কিছুই বলা সম্ভব নয় উর্মিদিকে। আদ্যন্ত সহজ সরল এই মানুষটি যে অসম্ভব ভালোবাসে পালককে, সেটা তো জানে ও। ওঁর ভালোবাসায় অন্য কোনো রঙ মিশিয়ে তাকে নষ্ট করার কোনো অধিকারই নেই পালকের। তাই পালক কিছুতেই সত্যিটা জানাতে পারবে না, গতরাতে ঋজুর বলা কথা শোনার পর থেকে কেমন ভাবে পুড়েছে পালক, কেমন ভাবে পোড়া ঘায়ের ক্ষতে বিষিয়ে উঠেছে ওর শরীর, দেখাতে পারবে না তাও।

বিছানা ছেড়ে উঠল পালক। স্নান করে মাথাটা ঠান্ডা করা দরকার আর পেটেও কিছু দিতে হবে, নাহলে শরীর আর চলছে না, মাথাও কাজ করছে না আর।

অতদূরে থেকেও উর্মিদি ঠিক বুঝতে পেরে গেছে পালকের এখন এটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যে মানুষটা দূরে থেকেও সবসময় জুড়ে থাকে, তাকে এমনভাবে কষ্ট দেওয়াটা মোটেও ঠিক হয়নি, পালকের অনুতাপ হল। ও ঠিক করল স্নান খাওয়া সেরে উর্মিদিকে ফোন করবে, আর তখন একটা বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যেকে বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বলে, ক্ষমা চেয়ে নেবে।

বেলা প্রায় তিনটে, ফ্রীজে একটা আধখাওয়া পাউরুটির প্যাকেট ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। লাঞ্চটা পালক প্রতিদিন অফিসেই সারে, আর রাতের খাবার বাইরে থেকে আনিয়ে নেয়, তাই ওর ফ্রীজে ব্রেকফাস্টের উপযোগী খাবার ছাড়া আর কিছুই থাকে না। দুধের একটা প্যাকেট ছিল, কিন্তু সেটা জ্বাল দেবার মত ধৈর্য ছিল না। মাথায় জল পড়ার পর থেকে পেটের মধ্যে যেন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে। কোনোমতে চারপিস পাঁউরুটি সেঁকে নিয়ে একটু জ্যাম লাগিয়ে খেতে বসল পালক।

শুকনো পাঁউরুটি চিবাতে বসে চোখে জলের ধারা নামল ওর, নিজেকে পরিত্যক্ত বলে মনে হতে লাগল।

সুস্মিতের সঙ্গে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেল যখন তখনও এতটা কষ্ট হয়নি, যেমনটা এখন হচ্ছে। তবে কি ঋজুই ঠিক? আসলে কি পালক সমকামী? আর সেইজন্যই ওর প্রেমটা টিঁকল না?

নিজেকেই বুঝতে পারছিল না পালক, নিজের মনের চাহিদা, ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছিল না বলেই ওর ছটফটানিটা বাড়ছিল, বাড়ছিল অসহায়তাও।

“কেবল আজকের দিনটাই তুমি পাবে সেটল করার জন্য। ভেবেচিন্তে যা সিদ্ধান্ত নেবার আজকের মধ্যেই নিতে হবে, রোজ রোজ অফিস কামাই করে বসে থাকলে চাকরিটা যাবে!” নিজেই নিজেকে শাসাল পালক।

“সমকামী হওয়াটা দোষের কিছু নয়, বহু বিখ্যাত মানুষই তাই! সুতরাং তুমি যদি তাই হও তবে লজ্জার কিছু নেই! শুধু সত্যিটা তোমাকে বুঝে নিতে হবে, আর তার জন্য তোমার আজকের দিনটাই বরাদ্দ। আর উর্মিদিকে এর মধ্যে জড়াবে কি না সেই ব্যাপারেও তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আজই, খুব বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই।”

নিজের সাথেই অবিরাম কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছিল পালক, যদিও নিঃশব্দে। একা ঘরে, যখন কারো কাছে কিছু আড়াল করার প্রয়োজন নেই তখন নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুঁজে বার করতে চাইছিল এই ধাঁধার তল। কিন্তু বেচারা মগজ আর কতই বা চাপ নিতে পারে, তার ওপরে আবার রয়েছে রাত জাগার ক্লান্তি, কিছুক্ষণের মধ্যেই পালকের দুচোখ জুড়ে নেমে এল ঘুমের আদর, ওর আর হিসাব মেলানো শেষ হল না।

উর্মিদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিভাস ফোন করেছিল সুপর্ণকে। রাস্তায় চলতে চলতে নয়, একটা ফাঁকা পার্কের বেঞ্চে বসে।

“তুই একটা পারফেক্ট ক্যালানে!”

ফোন ধরে বিভাসের এই মধুর বচনটাই শুনতে হয়েছিল সুপর্ণকে।

“ছেলে বিয়ে দিয়ে বৌমা ঘরে আনার সময় হয়ে গেল, তবু এখনো বৌকে সন্দেহ করিস! আমারই ইচ্ছে করছে তোর ওই ঢ্যালার মত চোখদুটো আঙুল ঢুকিয়ে গেলে দিই।” গালাগালি করার ফাঁকে ফাঁকে বিভাস ওর আজকের অভিযানের কাহিনী সবটাই প্রায় খুলে বলল সুপর্ণকে, উর্মি যে সাংঘাতিক রেগে গিয়েছিল সেই কথাটাও গোপন করল না।

“উর্মির জায়গায় আমি থাকলে আজকের পর তোর সাথে ফাটাফাটি হয়ে যেত, আর সেটাই হওয়া উচিত। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে বউকে ঠান্ডা কর, পুরো লাভার মত ফুটছে দেখে এলাম।”

বিভাসের কথা শুনে সুপর্ণ ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেল। ওর মনে হচ্ছিল, এর মধ্যে বিভাসকে না জড়ালেই ভালো হত। কিন্তু একবার যখন হাত থেকে বেরিয়ে গেছে দান, আর কিছু তো করার নেই!

বাড়িতে ফিরে কী প্রচন্ড ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে সেটা মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছিল বলে, সুপর্ণ অন্যদিনের চেয়ে আজ আরও দেরিতে ফিরল। অশান্তি, ঝগড়াঝাঁটি এসব বরাবরই বড্ড অপছন্দ সুপর্ণর, এখন তো আবার ছেলে বড় হয়ে গেছে, ওর সামনে এসব কথাবার্তা হওয়াটা অত্যন্ত লজ্জার। কিন্তু আজকে বিভাস যাওয়াতে ব্যাপারটা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে উর্মি আজ শালীনতা বজায় রাখতে পারবে কি না, সেই ভরসা পাচ্ছিল না সুপর্ণ। তাই পরিস্থিতিটাকে এড়িয়ে যাবার জন্য বন্ধুর পরামর্শ না মেনে দেরি করে বাড়িতে ফিরল ও।

এইসময়ে রনি বাড়িতেই থাকে। সুপর্ণ আশা করেছিল সে-ই আজ আসবে দরজা খুলতে। ছেলের বদলে উর্মিকে দেখে একটু নার্ভাস হয়ে গেল ও। কিন্তু, যেন কিছুই হয়নি এমন একটা মুখ করে দরজা খুলে দিয়ে চলে গেল উর্মি। যদিও ছেলের অসাক্ষাতে সুপর্ণকে কথা শোনানোর প্রচুর সুযোগ ছিল ওর হাতে, অথচ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল না উর্মি, এটা দেখে অবাক হয়ে গেল সুপর্ণ।

প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পর একটু একটু করে সাহস ফিরে পাচ্ছিল সুপর্ণ। রাতে বেডরুমে ঢোকার পর যে সাইক্লোন আছড়ে পড়তে চলেছে,এ নিয়ে ওর মনে কোনো সন্দেহই ছিল না তাই তার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিল।

কিন্তু রাতে সুপর্ণকে একান্তে পেয়েও উর্মি এ প্রসঙ্গে কোনো কথাই তুলল না, এমনকি বিভাসের আসার কথাটাও বলল না। এতবছরের সম্পর্কে উর্মিকে এমনভাবে ঝগড়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে কখনো দেখেনি সুপর্ণ, তাই খুব অবাক হল। তবে অদ্ভুত লাগলেও, ও নিজে থেকে আর খোঁচাতে গেল না, চুপচাপ শুয়ে পড়ল। উর্মিও শুয়ে পড়ল, তবে প্রতিদিনের ভঙ্গিতে নয়, সুপর্ণর দিকে পেছন ফিরে।

এই ভঙ্গিটা চেনা সুপর্ণর। বিয়ের পর প্রথম প্রথম রাগ বা অভিমান হলে, এমনভাবেই মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকত উর্মি, যতক্ষণ না সুপর্ণ জোর করে টেনে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিত। দীর্ঘদিনের সাংসারিক ঘষামাজায় অনুভূতি ,আবেগ সব ভোঁতা হয়ে গেছে বলে, এসব ব্যাপার এখন দুজনের জন্যই ইতিহাস।

অনেকবছর বাদে আজ উর্মিকে ওরকম ভাবে শুতে দেখে সুপর্ণর ইচ্ছে করল, আগের মতই পাশ ফিরিয়ে নিজের কাছে ওকে টেনে নেয়। কিন্তু ভেতর থেকে কী একটা যেন বাধা এসে টেনে ধরে রাখল সুপর্ণর হাত, হতে পারে সেটা ওর মনে জমে থাকা অপরাধবোধ, সুপর্ণর আর ইচ্ছেপূরণ করা হল না। দুজনে দু’দিকে ফিরে ঘুমোতে থাকল আর ওদের মাঝখানের দূরত্ব বাড়তেই থাকল এরপর থেকে প্রতি রাতে।




“ভালোবাসা কাকে বলে জানিস? একে অন্যের ভালোতে বসবাস করা। তাহলে কাউকে ভালোবাসাটা অনুচিত কেন হবে? যতক্ষণ তুই নিজের বা অন্য কারো ক্ষতি না করছিস, ততক্ষণ ভালোবাসা অন্যায় নয়। শুধু তোকে জানতে হবে তোর সীমা, জানতে হবে কোথায় তোকে থামতে হবে।”

পালকদের ক্লাস টীচার বৈশাখীদি কথাগুলো বলেছিলেন রিনিকে, তখন ওরা ক্লাস টেনে। ওদের বয়সটা এমনই ছিল যে, যুগে যুগে ছেলেমেয়েরা এই বয়সে দুমদাম প্রেমে পড়ে যায় আগুপিছু না ভেবেই। আর অভিভাবকদের সম্মতি থাকে না যেহেতু, তাই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে হয়। তাই এই নিয়ে অনেকেই দুর্ভাবনা আর অপরাধবোধে ভোগে। পালকদের ক্লাসের রিনিরও হয়েছিল এমন অবস্থা, উভয়সংকটে পড়ে বেচারা পড়াশোনাতে মন দিতেও পারছিল না। বৈশাখীদি মেয়েদের খুব ভালো বুঝতেন, ওনার অভিজ্ঞ চোখ এড়াতে পারেনি রিনি। রিনিকে একটু টোকা দিতেই ও কেঁদে ফেলেছিল, বলে দিয়েছিল গত কয়েকমাস ধরে ওর মনের মধ্যে চলতে থাকা অশান্তির কথা।

বৈশাখীদি তখন ওকে বুঝিয়েছিলেন, দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে অনেকটাই সাহায্য করেছিলেন। যদিও রিনি উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু কথাগুলো তিনি আসলে সব মেয়েদেরই বলতে চেয়েছিলেন, পরে সেটা বুঝেছে পালক। কারণ বলা তো যায় না, কবে কে কী সংকটে পড়ে যায়, আর কথাগুলো তার কাজে লেগে যায়! এই যেমন এখন, স্কুল ছেড়ে আসার এতগুলো বছর পরে, জীবনের এক ঘোরতর সংকটের মুহুর্তে, পালকের মনে পড়ে গেল কথাগুলো, মানসিকভাবে খানিকটা জোর পেল ও।

রাতে, আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ার পর ছোটবেলায় শোনা কথাগুলো বার বার মনে মনে বলল পালক। হঠাৎ করেই ওর মনের দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেল।সত্যিই তো, উর্মিদিকে ভালোবাসা নিয়ে মনের মধ্যে এত গ্লানি পুষে রাখার কোনোই কারণ থাকা উচিত নয়। পরস্পরের ভালো ছাড়া ওরা কেউই তো আর কিছু চায় না, আর পালক, উর্মিদিকে ভালোবাসলে দুনিয়ায় কারো কোনো ক্ষতিও হচ্ছে না। অতএব অত জটিল করে ভাবার দরকারটাই বা কি! সেই কোনকালে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন সত্যকে সহজে নিতে, সেই উপদেশ যদি দরকারের সময় মনেই না পড়ে, তবে আর কি লাভ! নিজেকেই নিজে বকে দিল পালক, তারপর একা একাই হাসল।

আসলে পালক সোজাসাপটা প্রকৃতির মেয়ে। কোনো বিষয়কে নিয়ে জটিল চিন্তাভাবনা করতে পারে না, সহজ সমাধানটাই আগে চোখে পড়ে ওর। তাছাড়া খুব বেশি সময় ধরে একই বিষয় নিয়ে ভাবাটা বড্ড বোরিং লাগে ওর কাছে, তেমন পরিস্থিতি হলে ঘুম পেয়ে যায়। জীবনে এই প্রথম একটা বিষয় নিয়ে এত বেশি ভাবল পালক, গোটা একটা রাত নির্ঘুম কেটে গেল। এখন, একটা আলোর দিশা চোখে এসে পড়ায় খুব খুশি হল ও, শান্তিতে ঘুমোতে পারবে আজ রাতটা। চোখ বোজার আগে শেষবারের মতো বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিল পালক, উর্মিদিকে মেসেজ করল, “কাল বলব তোমায় সব। এখন ঘুমোও, আলাবিউ, গুডনাইট”। শেষে দুটো হাসি মুখের ইমোজি পাঠিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল পালক।

নিজের পরিবারের মধ্যে বসবাস করেও একলা হয়ে গেছে, আজকাল এমনটাই বোধ করে উর্মি, কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সকলের থেকে। রনি বড় হয়ে গেছে, ওর একটা নিজের দুনিয়া তৈরি হয়ে গেছে, এখন আর ‘মা-মা’ করে আঁচল ধরে ঘুরবে না, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এতটাই কি দূরত্ব তৈরি হবে যে খাবার সময় কেবল ‘হুঁ,হ্যাঁ’ করে মায়ের প্রশ্নের উত্তরগুলো দেওয়া ছাড়া সারাদিনে দশটা মিনিটও মায়ের সঙ্গে বসে কথা বলতে পারে না! নিজের সম্পর্কে, বন্ধুদের সম্পর্কে, কলেজজীবন সম্পর্কে খানিকটা আগডুম-বাগডুম বকতে পারে না! উর্মির দিদির ছেলেমেয়েরা কিন্তু রনির মতো নয়, তারা বড় হয়ে গেলেও মা- বাবার সঙ্গে বন্ধন আলগা করেনি, বরং সম্পর্কটা বন্ধুর মত করে নিয়েছে। ওদের বাড়িতে সারাদিন ছেলেমেয়েদের বন্ধুবান্ধবদের আসাযাওয়া চলতেই থাকে, ছেলেমেয়েদের বন্ধুরা উর্মির দিদিরও বন্ধু হয়ে গেছে। রনিটা কোথা থেকে যে এমন একাচোরা হল, বোঝে না উর্মি। অথচ এই ছেলেকে বড় করে তোলার জন্য নিজের শখ, ভালোবাসার জিনিসগুলো একে একে সব ছেড়ে দিয়েছে ও। গানবাজনার প্রতি ভালোবাসা ছিল, নিজে শেখার পাশাপাশি সপ্তাহে একদিন একটা গানের স্কুলও চালাতো উর্মি। রনির জন্মের পর প্রথমে ক্লাসটা বন্ধ করে দিতে হল, ছেলে একটু বড় হতে নিজের শেখাটাও বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ির কাজ, ছেলের পড়াশোনা, টিউশন, ক্রিকেট, সাঁতার সব সামলে নিজের রেওয়াজে বসার মত সময়ই বার করে উঠতে পারছিল না তখন। রনির বেড়ে ওঠার সেইসব দিনগুলোতে ওকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হত উর্মিকে যে আলাদা করে নিজের কথা ভাবারই সময় পায়নি। ‘রনির মা’ এই পরিচয়টুকুই যথেষ্ট ছিল ওর জন্য।

ছেলে উড়তে শেখার পর হারমোনিয়ামটা বার করে ধুলো টুলো ঝেড়ে আবার শুরু করার কথা উর্মি ভেবেছিল কয়েকবার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। প্রতিবারই আলস্য এসে ঘাড়ে চেপে বসেছে, কানে কানে বলেছে, ধুস কি আর হবে! গান গাওয়ার আর শেখানোর জন্য এত লোকজন চারপাশে গিজগিজ করছে যে তুমি আরও একজন না গাইলে কিছু বদল ঘটবে না দুনিয়ায়। অতএব, ধুলোয় ভরা হারমোনিয়ামের পাশে তার ছেঁড়া তানপুরাটাও দীর্ঘদিন ধরে ঘুমিয়ে আছে, গায়ে বেশ করে জামাকাপড় পরে। সুপর্ণ কয়েকবার বলেছিল, ‘এগুলোকে এভাবে ফেলে রেখে নষ্ট করছ কেন? হয় নিজে আবার শুরু কর নয়ত কাউকে দিয়ে দাও!’

‘রনির বউয়ের জন্য রেখে দিয়েছি।’ ঠাট্টা করেছিল উর্মি।

‘ওই আনন্দে থাকো তুমি।’ সুপর্ণ কথা বাড়ায়নি আর।

পালককে এসব কথা গল্প করে বলেছিল উর্মি। মেয়েটা শুনে খুব জোরাজোরি করাতে একটু নড়েচড়ে বসেছে উর্মি, আবার ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করেছে।

‘ভাবাভাবির কি আছে এত? তোমার গলা দিয়ে তুমি গাইবে নিজের ঘরে বসে, এতে এত দিনক্ষণ দেখার কি আছে? যেদিন খুশি শুরু করে দাও না। একাই তো থাকো সারাদিন!” ধমক দিয়েছিল পালক।

“রেওয়াজ করিনা কত বছর! এখন হারমোনিয়াম নিয়ে বসলে পাড়ার কুকুরগুলো বাড়ির সামনে বসে অবরোধ করবে।”

“বাজে বোকো না! অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছ অলরেডি, আর কোরো না। কাল থেকেই বসবে।”

“আরে কাল বললেই বসা যায়! হারমোনিয়ামটা কী কন্ডিশনে আছে দেখতে হবে না!”

“তো দেখো না! আজ সারাদিন কী করবে! শুধু বাহানাবাজি!”

পালকের ধমক খেয়ে হারমোনিয়াম বার করেছিল উর্মি। অনেকদিন না বাজানোতে আওয়াজটা বসে গেছে শুধু, তাছাড়া ঠিকই আছে। রিডগুলোতে আঙুল ছুঁইয়ে অনেকবছর পরে নিজের কৈশোরে ফিরে গেছিল উর্মি।

সেই ভোরবেলা মায়ের ঘুম থেকে তুলে রেওয়াজ করতে বসানো আর অনিচ্ছাসত্বেও ওদের দুইবোনের গলা সাধা, সন্ধেবেলা আবার মায়ের জোরাজোরিতে রেওয়াজে বসা-সব মনে পড়ে যাচ্ছিল ছবির মতো।

মায়ের ইচ্ছেতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেও প্রথম প্রথম গান গাইতে ভালো লাগত না উর্মির, দুটো বছর লেগে গেছিল গানকে ভালোবাসতে। সেই সময়ে মায়ের পুরনো হারমোনিয়াম নিয়েই গাইত ওরা দুই বোন, কয়েকবছর পর বাবা এই স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়ামটা কিনে দিয়েছিলেন। দিদির বিয়ের পর থেকে সেইটাতে উর্মিরই একচ্ছত্র অধিকার এসে গেছিল, নিজের বিয়ের পর হারমোনিয়ামটা সঙ্গে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল ও।

প্রিয় এই সঙ্গীকে কী করে এতদিন ভুলে ছিল, কী করে যে এর সাদা কালো আঙুলগুলোতে আঙুল না বুলিয়ে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিতে পেরেছে, সেটা ভেবে আজ অবাক হয়ে যাচ্ছিল উর্মি। সত্যিই তো, আজ পালক না ধমক দিলে, আরও কত দেরি হয়ে যেত নিজের জায়গাটাতে আবার ফিরে আসতে কে জানে! হয়তো আসা হতই না, এমনটাও হতে পারত! উর্মি মনে মনে ক্ষমা চায় প্রিয় হারমোনিয়ামটার কাছে, তাকে একলাটি এমন অবহেলায় অযত্নে এতদিন ফেলে রাখার জন্য। পালকের কাছে কৃতজ্ঞ হয় ওকে পুনর্জীবনের পথে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। আনমনে আঙুল বোলায় রিড গুলোর ওপর, আস্তে আস্তে ওদের মৃতপ্রায় শরীরে প্রাণের স্পন্দন দেখা দেয়, বেজে ওঠে উর্মির প্রিয় একটি গানের সুর।

‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে’ এরপর বাণী লাগে সুরে, হয়ে ওঠে গান। অনেক অনেক বছর বাদে একলা ঘরে উর্মি প্রাণ ভরে গেয়ে ওঠে।




আজ ভোর ভোর উঠে পড়েছেন মৈত্রী। যদিও কাজ বলতে সেরকম কিছু নেই, অতিথিদের জন্য রান্না করা বা ঘরদোর গোছানো সব লোকজনই করবে, নিজেকে শুধু একটু দেখে নিতে হবে ব্যস, তবু রাতটা শান্তিতে ঘুমাতে পারেননি তিনি। আজকের পর্বের সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটলে তবে শান্তি।

তবে, রান্নাবান্না বা অতিথি আপ্যায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই মৈত্রীর, চিন্তা কেবল পেটের শত্রু ছোটো মেয়েটাকে নিয়ে। লোকজনের সামনে যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে তাহলেই মুশকিল।

বড়মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন চারবছর আগে, নাতির মুখেভাতও হয়ে গেছে দু’মাস হল। এখন ছোটোটাকে পাত্রস্থ করতে পারলে দায়মুক্ত হতে পারেন মৈত্রী। কিন্তু সে আর পারছেন কোথায়? কিছুতেই তাকে রাজি করানো যাচ্ছে না। একে তো এখনকার দিনের মেয়ে, তার ওপরে আবার চাকরি করে, তাকে নাগালে পাওয়াই দুষ্কর। তাছাড়া ছোট থেকেই এই মেয়েটা বেয়াড়া প্রকৃতির, নিজের ইচ্ছেতেই চলে। আগাগোড়া জ্বালিয়েছে মাকে, এখনও জ্বালাচ্ছে। নিজে যদি কাউকে পছন্দ করত, জাত-বেজাত দেখতেন না মৈত্রী, তার সাথেই ঝুলিয়ে দিতেন। সেটাও জোটাতে পারেনি এতবছর ধরে! বাধ্য হয়ে মৈত্রীকেই উঠে পড়ে লাগতে হয়েছে, কারণ আইবুড়ো মেয়ে ঘরে থাকলে মায়েরই তো যত জ্বালা, বাপের আর কি?

এই সম্বন্ধটা এনেছে মৈত্রীর বড়মেয়ে, ওর শ্বশুরবাড়ির দিকের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। যতই দূর সম্পর্ক হোক না কেন, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির দিকের লোক তো, তাই তাদের যাতে কোনোরকম অমর্যাদা না হয়, তা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন মৈত্রী।

গতকালই বাড়িতে এসেছে ছোটমেয়ে পুলু, তাও মিথ্যে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনা হয়েছে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে বললে ও মেয়ে কিছুতেই আসত না, তাই দাদুর শরীর খারাপের অজুহাত দেওয়া হয়েছিল। কাল বাড়িতে পা দিয়ে সত্যিটা জেনে প্রচুর চেঁচামেচি করেছে পুলু, আজ আবার লোকজনের সামনে কী কান্ড করবে কে জানে? ওইজন্যই দুশ্চিন্তায় আছেন মৈত্রী, রাতে ভালো করে ঘুমাতে পর্যন্ত পারেননি।

“দেখতে আসছে মানেই বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই! তোর যদি পছন্দ না হয়, করবি না।”

রাতে অনেক বুঝিয়েছেন মৈত্রী।

“সেটা তো পরের কথা। তুমি তো জানো এভাবে মেয়ে দেখাটা আমি পছন্দ করি না। আমি কি আলুপটল নাকি যে লোকে নেড়েচেড়ে দেখে পছন্দ করে অর্ডার দেবে!”

“তা কেন! বুলির শ্বশুরবাড়ির দিকের লোকজন ওরা, সেই হিসাবেই আসছে। বাড়িতে লোকজন এলে যেমন যাস তাদের সামনে, তেমনই যাবি।”

“তাই যদি হত তাহলে আমাকে মিথ্যে কথা বলে ডেকে পাঠালে কেন? আমি এখনই নেটে টিকিট দেখছি, যদি পেয়ে যাই তাহলে আমি কাল সকালেই ফিরে যাব!”

মেয়ের রাগের সামনে মাথা নোয়ানোর মানুষ মৈত্রী নন। তিনিও এবার গলা চড়ালেন।

“তোর এইসব বায়নাক্কা অনেকদিন ধরে দেখছি বুঝলি! আগে বিয়েটা কর, মা হয়ে দেখ, তখন বুঝবি মায়েদের কত জ্বালা!”

পালক আর কথা বাড়াল না। মায়ের ব্লাড প্রেশার হাই, এটাকে বরাবর ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন তিনি। বেশি চেঁচামেচি করলে প্রেশার বেড়ে যাবে, শরীর খারাপ করবে, তখন বাবা আর দিদি ওকে দোষারোপ করবে। তার চাইতে বুদ্ধি খাটিয়ে এমন কিছু করতে হবে যাতে সাপও মরে আবার লাঠিটাও আস্ত থাকে। রাতে শুয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে ঠিক করল ও। আপাতত ছাদের ঘরে গিয়ে উর্মিদিকে ফোন করতে হবে, মায়ের এসব চক্রান্তের কথা ওকে না বলা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না পালক।

বাড়িঘর দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে, তার জানলা-দরজা খুলে তাতে রোদ বাতাস ঢুকতে না দিলে তাতে অচিরেই নোনা ধরে, ধীরে ধীরে পুরো বাড়িটাই চলে যায় তার দখলে। তারপর একদিন দেওয়াল থেকে ঝুরঝুর করে খসে পড়তে থাকে পলেস্তারা, শ্রী উড়ে গিয়ে পড়ে থাকে কেবল বাড়ির কংকালটাই।

যেকোনো সম্পর্ক ঠিক এমনটাই, সেও যত্ন চায়, চায় মনোযোগ। আলো বাতাস নিয়মিত না পড়লে সম্পর্কের ওপরও জমে পুরু ধুলো, সেই ধুলো উড়িয়ে সম্পর্কটাকে খুঁজে পাওয়া তখন অসম্ভব হয়ে যায়।

যে কোনো পুরনো দাম্পত্যের মতই সুপর্ণ আর উর্মির সম্পর্কের ওপরে অনেকদিন ধরেই একটু একটু করে ধুলো জমছিল। তখন খেয়াল করলে হয়ত মুছে ফেলা যেত সেসব ময়লা, কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। এখন ওদের সম্পর্কের মধ্যে ‘অভ্যাস’ এর ভাগটাই বেশি, একসাথে থাকার অভ্যাস, এক বিছানায় শোওয়ার অভ্যাস।

উর্মির জীবনে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধার পর থেকে দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে আরও কিছুটা। বিশেষ করে বিভাসের মধ্যস্থতার চেষ্টায় হিতে বিপরীত হয়েছে, মনে মনে সুপর্ণর কাছ থেকে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছে উর্মি। বাইরে সাংসারিক জীবনটা একইরকম আছে, কিন্তু ভেতরে ধরেছে ফাটল।

একঘরে এক বিছানায় রাত কাটাতে হলে ফাটলটাকে মেরামত করে নিতেই হয়। নিজে থেকে এগিয়ে এসে সেটা করতে পারেনি সুপর্ণ, একটা লজ্জা কিংবা দ্বিধা ওকে পেছনে টেনেছে বার বার। যদি উর্মি নিজে থেকে এব্যাপারে কথা তুলত, তাহলে হয়ত সুপর্ণ ক্ষমা চেয়ে নিতে পারত। কিন্তু অভিমান সরিয়ে উর্মিও এগিয়ে আসেনি। ফলে বিষয়টা রয়ে গেছে অমীমাংসিত। রাতের খাওয়াটা রনির উপস্থিতিতে হত বলে একটা আড়াল পেয়ে যেত দুজনেই, কিন্তু শোবার ঘরে ঢোকার পর শীতলতাটা ভীষণই অস্বস্তিকর। অস্বাচ্ছন্দ্যের থাবা থেকে মুক্তি পাওয়ার রাস্তাটা প্রথম খুঁজে বার করল সুপর্ণই, খাওয়ার পর বসার ঘরে ল্যাপটপ খুলে বসল সে।

“শোবে না এখন?”

রুটিন বদলে গেছে দেখে উর্মি জিজ্ঞেস করল।

“তুমি আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ো, আমি কাজটা শেষ করে যাচ্ছি।”

স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়ে উত্তর দিল সুপর্ণ। আসলে কাজ ওর কিছুই ছিল না, ও কেবল উর্মির ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছিল।




বর্ধমান থেকে বোলপুরের দূরত্ব বেশি নয়, তবু এটুকু পথ আগে কখনো একা একা পাড়ি দেয়নি উর্মি। আসলে যেদিন থেকে জীবনে সুপর্ণ এসেছে, একা কোথাও যাওয়ার অভ্যাসটাই চলে গেছে। বিয়ের আগে বা পরে, ওকে ছাড়া কোনো জায়গায় যাওয়ার কথা ভাবেনি উর্মি। দুদিন আগে পালক যখন ফোন করে জানালো ওর বাড়িতে আসার কথা তখন থেকেই মেয়েটার সাথে দেখা করার জন্য মনটা ছটফট করছে। কাল রাতে সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিল শেষ পর্যন্ত, যদিও বাড়িতে কাউকে কিছু বলেনি এই ব্যাপারে। সুপর্ণ আর রনি বেরিয়ে যাবার পর উর্মিও বেরিয়ে এসেছে, বাড়ির চাবি দিয়ে এসেছে পাশের বাড়িতে। এই ব্যবস্থা বেশ পুরনো, যদি কেউ আগে ফিরে এসে তালাবন্ধ দেখে তবে চাবি নিয়ে নেবে ওই বাড়ি থেকে। অতএব ফিরতে দেরি হলেও চিন্তার কিছু নেই।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল উর্মি, ‘পিচকুরির ঢাল’ নামের একটা স্টেশনকে পেরিয়ে যেতে দেখে নড়েচড়ে বসল। পালক বলে দিয়েছিল, এই স্টেশনটা পেরলেই উর্মিকে নামার প্রস্তুতি নিতে, কারণ এই ট্রেন রামপুরহাট অবধি যাবে, বোলপুর শেষ স্টেশন নয়।

“কী গো কতদূর?”

পালকের ফোন এল ‘পিচকুরির ঢাল’ পেরনোর পরই। মেয়েটা ট্রেনে ওঠার পর বার বারই ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে, আর এজন্যই উর্মির মনে হচ্ছে না যে ও একদম একা সফর করছে, মনে হচ্ছে পালক সঙ্গেই আছে।

ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল উর্মি। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে গতি কমে আসতে ওর চোখদুটো খুঁজছিল পালককে। এই প্রথম পালকের সঙ্গে দেখা হবে সেজন্য একটা উত্তেজনা তো ছিলই, তাছাড়া অনেকবছর পর একা নতুন জায়গায় আসার জন্যেও বুকের মধ্যে ধুকপুকুনিটা একটু জোরেই হচ্ছিল। সেই ছাপ ওর মুখে হয়ত বা ফুটে উঠে থাকবে নয়ত দেখা হওয়া মাত্র পালক কেন বলবে, ‘টেনশন করছ কেন? আমি অনেক আগে স্টেশনে চলে এসেছি।’

একমুখ হাসি উপহার দিল উর্মি, পালককে দেখে ওর দারুণ স্বস্তি হল।

‘কোথায় যাব আমরা?’

‘আমার বাড়িতে অন্তত নয়! আপাতত কোপাইয়ের ধারে হলে চলবে?’

‘খুউব’

বাধ্য বালিকার মত ঘাড় হেলালো উর্মি, ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল পালক।

পার্কিংএ স্কুটি রাখা ছিল পালকের, উর্মিকে নিয়ে সে ছোটালো তার পক্ষীরাজ।

‘মায়ের রাগ কমেছে?’ উর্মি জিজ্ঞেস করল।

পাত্রপক্ষকে বোল্ড আউট করেছে পালক সেটা জানে উর্মি। কাজেই ওর মায়ের রাগের সঙ্গত কারণ আছে।

‘উনি ওনার রাগ নিয়ে থাকুন, হু কেয়ারস!’

‘এরকম ভাবে বলতে নেই। মায়ের তো একটা চিন্তা থাকবেই।’

‘আমি তো খারাপ কিছু বলিনি! ওরা আমাকে চাকরি ছেড়ে কলকাতায় সেটল করার কথা বলেছিল, তাই আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম ছেলেকে চাকরি ছেড়ে পুণেতে সেটল করার কথা ভাবতে। আমি যদি কলকাতায় নতুন জব খুঁজে নিতে পারি, সেও পুণেতে খুঁজে নিতে পারে। আমি হেল্প করব, এটাও বলেছিলাম। তবুও ওরা যদি রেগে যায়, কি করব বল!’

‘তুই পারিসও বটে!’

দুজনেই হাসতে লাগল। হাসি থামলে সিরিয়াস গলায় পালক বলল, ‘মা খুব রেগে গেছে, দিদির শ্বশুরবাড়ির দিকের লোকজনকে অপমান করেছি ব’লে। আমার সাথে কোনো কথাই বলছে না। দিদিও পরদিন সকালে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। বাড়িতে থাকাই মুশকিল হয়ে গেছে আমার, এমন বিচ্ছিরি পরিবেশ। পরশু ফিরে যাব আমি, আজ ভাগ্যিস তুমি এলে, দিনটা খুব ভাল কাটবে।’

উর্মির একটা হাত পালকের কাঁধে ছিল। সেই হাতে আলগা চাপড় দিল ওর কাঁধে, বোঝাতে চাইল, ‘আমি আছি’। পালক স্কুটির হ্যান্ডেল থেকে ডান হাতটা উঠিয়ে নিয়ে উর্মির হাতের ওপর রাখল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, হাত থেকে হাতে ছড়িয়ে গেল ভরসা আর ভালোবাসার ভাষা।

‘মাকে বলে দিয়েছি এমন ভাবে সিনক্রিয়েট আর না করতে। আমি বিয়ের জন্য এখনো মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড নই, সময় হলে নিজের পার্টনার নিজেই চুজ করে নেব। এটা শোনার পর মা আরও বেশি ক্ষেপে গেছে।’

উর্মি চুপ করে থাকল। ভাবতে চেষ্টা করল, সে নিজে পালকের মায়ের জায়গায় থাকলে কি করত।

‘চুপ করে গেলে কেন?’

‘ভাবছিলাম, তোর মা তো ভুল কিছু করেননি। বিয়ে তো করতে হবেই, আজ হোক বা কাল।’

‘কেন? করতে হবেই কেন?’

‘বারে! অন্য দরকারের কথা যদি ছেড়েও দিই, একটা সঙ্গী তো দরকার! একা একা বাঁচতে পারে নাকি মানুষ!’

‘একটা সত্যি কথা বলবে? তুমি আর তোমার বর তো আগে ভালো বন্ধু ছিলে, এখনো কি তেমনই আছ?’

উর্মি উত্তর দিতে পারল না। বন্ধুত্বের উদোম খোলামেলা সম্পর্কটা তো তাদের মধ্যে সত্যিই আর নেই! সংসারের জাঁতাকল কবেই তাকে পিষে একমুঠো ধুলো করে উড়িয়ে দিয়েছে। এখন পড়ে আছে শুধু সেই বন্ধুত্বের খোলসটুকু।

‘মনখারাপ কোরো না উর্মিদি। এটা শুধু তোমার একার গল্প নয়। আরে, পুরুষ আর মহিলা হল চিরকালের শ্রেণিশত্রু, এরা কখনো ভালো বন্ধু হতে পারে নাকি!’

‘শ্রেণিশত্রু’ বিশেষণটা শুনে হাসি আর থামতেই চায় না উর্মির। কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। মিছিলে স্লোগানে কত যে ‘শ্রেণিশত্রু’কে ‘নিপাত’ করেছে ওরা সেইসময়ে। পুরুষ আর নারী আজন্মের শ্রেণিশত্রু, এই কথাটা ছাত্র নেতারা শুনলে যে কি করত!

কোপাইয়ের পাড়ে পৌঁছে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল উর্মির, কতদিন যে এভাবে নিরিবিলিতে একা একা বসে থাকা হয়নি। জগৎসংসার একমুহূর্তে পেছনে পড়ে থাকল, পড়ে থাকল জীবনের যত গ্লানি, এ যাবৎকালে জমে উঠা যত তার ভার। এই প্রকৃতি, পরিচিত পৃথিবীর গন্ডি থেকে মুক্তি, উর্মিকে বিশ্বের অপার আনন্দের সাথে যুক্ত করে নিল, মনটা আনন্দ আর শান্তিতে ভরে উঠল। গলায় ভেসে এল গান, গুনগুন করে এককলি গেয়ে উঠলো উর্মি, ‘তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে’।

‘গলা খুলে গাও না! রবিঠাকুর খুশি হবেন।’

অনেকদিন কারো সামনে গায় না উর্মি, কিন্তু আজ বিনা দ্বিধায় গেয়ে ফেলল পুরো গানটাই, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে।’

স্থানমাহাত্ম্যের কারণে কি না জানা নেই, কিন্তু আজকের মত দরদ দিয়ে, গভীর উপলব্ধি দিয়ে এই গানটা আগে কখনো গায়নি উর্মি।

গান শেষ হয়ে যাবার পর দুজনের কারো মুখে কোনো কথা যোগায়নি অনেকক্ষণ, কেবল শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাওয়ার শব্দটুকু বুঝিয়ে দিচ্ছিল পৃথিবী এখনো নিঃশব্দ হয়ে যায়নি।

একসময় নিস্তব্ধতা ভাঙল পালকই, ‘অপার্থিব! গানই তোমার জায়গা উর্মিদি, তুমি ফিরে যাও তোমার আশ্রয়ে।’

মুচকি হাসল উর্মি।

‘যদি শান্তিনিকেতনেই থেকে যেতে পারতাম!’

‘তুমি যেখানে বসে গাইবে, সেই জায়গাটাই শান্তিনিকেতন হয়ে যাবে!’

‘বড্ড বাজে বকিস! পরিবেশের একটা প্রভাব আছে না! এমন একটা জায়গায় থাকতেন বলেই রবিঠাকুর এত ভালো লিখতে পেরেছেন, বুঝলি!’

অফিস থেকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিল সুপর্ণ। ভেবেছিল উর্মিকে নিয়ে বিকেলে বেরবে। অনেকদিন দুজনে কোথাও যাওয়া হয় না, একান্তে সময় কাটানোও হয় না। সেই অস্বস্তিকর ব্যাপারটার পর খোলামেলা কথাবার্তাও হয়নি দুজনের। আজ বাইরে মুভি দেখে একেবারে ডিনার করে ফেরার প্ল্যান ছিল সুপর্ণর, রনির খাবারটা প্যাকিং করে নিয়ে আসবে ভেবেছিল।

অফিসে বসে হঠাৎ করে করা প্ল্যান, তাই উর্মিকে কিছু জানানো হয়নি। ফোনও করেনি সারপ্রাইজ দেবে বলে, কিন্তু বাড়িতে ফিরে তালা ঝোলানো দেখে ও নিজেই বোকা হয়ে গেল। চাবি আনতে গিয়ে শুনল, উর্মি সকালের দিকে বেরিয়েছে তবে কোথায় গেছে বলে যায়নি। একটু উদ্বিগ্নই হল সুপর্ণ, হয়ত উর্মিদের পরিবারের কারো কিছু হয়েছে, এখনো ঠান্ডা লড়াই চলছে বলে হয়তো ও সুপর্ণকে কিছু জানায়নি। তাড়াতাড়ি উর্মিকে ফোন করল সুপর্ণ।

‘তুমি কোথায়?’

‘একটু বাইরে আছি।’

‘কখন ফিরবে?’

‘ঘন্টাদুয়েক লাগবে। কেন?’

‘না, এমনিই।’

সুপর্ণ আর কিছু বলেনি, রেখে দিয়েছিল ফোন। উর্মিও আর কিছু জানতে চায়নি, তবে ওর মন বলছিল সুপর্ণ হয়ত আজ বাড়িতে ফিরে এসেছে তাড়াতাড়ি। এসে ওকে দেখতে পায়নি বলে ফোন করেছে। ওর এই ধারণা বদ্ধমূল হল যখন রাস্তা থেকে দেখল ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে।

বসার ঘরে টিভি দেখছিল সুপর্ণ। স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় গেছিলে?’

সহজভাবেই প্রশ্নটা করেছিল ও, কৈফিয়ৎ চাওয়ার জন্য নয়।

‘শান্তিনিকেতন।’

এবার অবাক হয়ে উর্মির দিকে তাকাল সুপর্ণ। সেই দৃষ্টিতে অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল, হঠাৎ শান্তিনিকেতনে কেন? আমাকে জানাওনি কেন? কাদের সাথে গেছিলে?

উর্মি ফেরার পথে ট্রেনে বসে ভেবে রেখেছিল এই ব্যাপারে কোনো প্রশ্নের সামনে পড়তে হলে সব সত্যি কথাই বলবে।

‘পালকের সাথে দেখা করতে গেছিলাম। মেয়েটা বাড়িতে এসেছে কয়েকদিনের জন্য, আবার পরশুই ফিরে যাবে। তাই-‘

সুপর্ণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ‘আবারও সেই পালক!’ ওর মুখে হতাশা আর রাগ যুগপৎ ফুটে উঠেছিল।

‘এই মেয়েটা কি আমাদের দুজনের সম্পর্কটার মাঝখানে ঢুকেই থাকবে এঁটুলির মত? সম্পর্কটাকে পুরো গিলে না খেয়ে ও কি সরবে না!

ভাবনাটা অবশ্য মুখে প্রকাশ করেনি ও, কিন্তু মনের মধ্যে উষ্মা থেকে যাওয়ায় সহজও হতে পারেনি। অথচ আজই ও ভেবেছিল উর্মির সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে লেগে যাওয়া গিঁটগুলোকে খুলে তাকে আগের মত সহজ সরল করে ফেলবে।




উর্মির যখন ঘুম ভাঙল তখনও সূর্য ওঠেনি। মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা থাকলে ঘুম এমনিতেই ভেঙে যায়, বেড়াতে যাবার সময় প্রতিবার দেখেছে আগে। আজকের উত্তেজনা অবশ্য অন্যরকমের। যে দিনটাতে অনেক প্রাপ্তি থাকে, পূর্ণতার আশা থাকে, সেই দিনটার জন্য জেগে উঠতে কার না ভালো লাগে!

রাতপোশাক ছেড়ে কোণের ছোট ঘরটাতে চলে গেল উর্মি, ওখানেই বন্দীদশায় ওর প্রাণভোমরা রাখা ছিল এতদিন । দরজা ভেজিয়ে দিয়ে উর্মি হাতে তুলে নিল তানপুরা, সুর বাঁধলো তাতে। আস্তে আস্তে ডুবে গেল রাগ টোড়িতে।

আজকের সকালটা সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাবে শুরু হল সুপর্ণর, এমন সকাল শেষ কবে দেখেছে স্মৃতি হাতড়েও মনে করতে পারেনি ও। ‘চা হয়ে গেছে, শিগগির ওঠ’ বলে যে মেয়েটি ধাক্কা দিয়ে জাগালো ওকে, তাকে নিজের বউ বলে চিনতে পারছিল না সুপর্ণ।

অন্যদিন এই সময়ে টেবিলের ওপর চা রেখে ডেকে যায় যে, তার পরনে থাকে রান্নাঘরের তেলহলুদ মাখা ম্যাক্সি, মাথার এলোমেলো চুল উঁচু করে খোপা বাঁধা, মুখে লেপটে থাকে ঘাম আর অপ্রসন্নতা। কোনোরকমে ‘চা থাকল তোমার’ বলার পর একমিনিটও দাঁড়ায় না সেই কলের পুতুলরূপী নারী। আর আজ যে ঘুম ভাঙালো তার পিঠময় ছড়ানো ভেজা চুল, সদ্য স্নান সারা তরতাজা এই রূপে কতদিন যে উর্মিকে দেখেনি সুপর্ণ! সাদা খোলের শাড়িতে কি পবিত্র আর দীপ্ত যে দেখাচ্ছে ওকে!

‘হাঁ করে দেখছ কি! উঠে এসো, বারান্দায় চা ভিজতে দিয়ে এসেছি।’

উর্মির পেছন পেছন সম্মোহিতের মত বারান্দায় গেল সুপর্ণ, যদিও ব্যাপারস্যাপার কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না।

টি পট থেকে পাতলা ফিনফিনে দুটো কাপে চা ঢালছিল উর্মি, আর সুপর্ণ বাক্যরহিত হয়ে মনে করার চেষ্টা করছিল আজকে বিশেষ কোনো দিন কি না। ওদের বিবাহবার্ষিকী কিংবা উর্মির জন্মদিন যদি হয়ে থাকে আজ আর সেটা যদি সুপর্ণ ভুলে গিয়ে থাকে তবে তো কেলেঙ্কারী। উর্মি বোধহয় সুপর্ণর মনের কথা পড়তে পারল, চায়ের কাপটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘অমন ভেবলে যাওয়ার কিছু হয়নি। আজ আমাদের কারো জন্মদিন কিংবা বিবাহবার্ষিকী নেই, এমনকি লটারিও পাইনি আমি। আসলে আজ আমার ভীষণ ভালো লাগছে, মনটা আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে আছে।’

সুপর্ণর অবাক দুটো চোখ স্থির হয়ে ছিল উর্মির মুখের ওপর।

কাল তো কিছুই বলা হয়নি উর্মিকে, বলা হয়নি পুরনো মন কষাকষি মিটিয়ে ফেলার তাগিদে কাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিল সুপর্ণ আর উর্মিকে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল। তাহলে ওর মধ্যে এই ভাবান্তর কেন? সুপর্ণকে অবশ্য কিছুই অনুমান করতে হল না কষ্ট করে, উর্মি নিজেই উত্তর যোগালো।

‘এতদিন মনের মধ্যে একটা দমচাপা ভাব ছিল, ডিপ্রেশড লাগত সবসময়, সেটা আর নেই জানো! এখন আমার সবকিছুই ভালো লাগছে, সবাইকে ভালো লাগছে। তাই আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছি, কত কাজ সারা হয়ে গেছে এতক্ষণে!’

উর্মি কথা বলে যাচ্ছিল সুপর্ণর উত্তরের অপেক্ষা না করে। অকাজের কথা মানুষকে হালকা করে। কতদিন যে ওরা দুজন সংসারের চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তায় সময় নষ্ট করেনি! আস্তে আস্তে সহজ হল সুপর্ণ, হাসিঠাট্টায় ডুবে গেল সে ও।

ঘুম ভাঙার পর রনি অবাক। সকালের এই ব্যস্ত সময়ে মা-বাবাকে এমনভাবে বসে গল্প করতে শেষ কবে দেখেছে ও মনেই করতে পারল না। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ বাবার ছুটি নাকি?’

‘না রে! এই তো এবার উঠব। তুইও আয় না, এখানে বস।’

ছেলেকে ডেকে পাশে বসালো সুপর্ণ। বাবা-মায়ের মধ্যে কোনো কারণে একটা অদৃশ্য দেওয়াল যে তৈরি হয়েছিল, সেটা চোখ এড়ায়নি রনির। আজ সেটাকে সরে যেতে দেখে রনিরও ভালো লাগল।

পুণেতে যে ফিরে এল এবারে, সে অন্য পালক। এই পালক অনেক শান্ত, অনেক স্থিতধী। ভালোবাসা কাউকে এতটা প্রভাবিত করতে পারে, বদলে দিতে পারে, এটা আগে কখনো বোঝেনি ও। অফিসের কাজে দিনের বারো ঘন্টা চলে গেলেও ক্লান্ত লাগে না, অপরিচিত শহরে একলাটি থাকতে হলেও নিজেকে আর একা লাগে না। এমন একজন মানুষের সংস্পর্শে এসেছে ও, যে দূরে থেকেও জুড়ে থাকে। মিথ্যে বলে বাড়িতে ডেকে পাঠানোর জন্য মাকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করে পালকের। বাড়িতে গেছিল বলেই তো মানুষটার সাথে দেখা হল, অতটা সময় একসাথে কাটাতে পারল! সেদিন উর্মি যে গানটা গেয়েছিল ফোনে রেকর্ড করে নিয়ে এসেছে পালক, প্রতিদিনই একবার করে বাজিয়ে শোনে আর প্রতিবারই মনটা অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে যায়।

মায়ের রাগারাগি, দিদির অপমানজনক কথাবার্তা ওর মনের মধ্যে যে ক্ষত তৈরি করেছিল তার জ্বালাও আর নেই, সব জুড়িয়ে মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে গেছে। উর্মি যেন জাদু জানে!

রাত্রে আয়নার সামনে দাঁড়ালো একাকী পালক।

‘ভালোবাসো ওকে?’

‘সন্দেহ নেই।’

‘একজন নারী যেভাবে পুরুষকে ভালোবাসে, সেভাবে?’

‘জানি না। জানতে চাইও না। নারী পুরুষকে ভালোবাসলে কি তাদের শিং বা ল্যাজ গজায়? না তো! আমারও গজায়নি। মনের মধ্যেকার এই আনন্দময় অনুভূতি যদি প্রেম হয়, তবে আমার এই ভালোবাসাকে প্রেম বলতে অসুবিধা কোথায়!’

‘কিন্তু ও তো বিবাহিত, স্বামী, সন্তান আছে? তাহলে?’

‘আমি তো কেবল ওকে ভালোবেসেই খুশি। মাঝে মাঝে একটু দেখা, সাথে থাকা, ব্যস এটুকুই। আর কিছুই চাই না।’

‘তুমি সিওর এটুকুতেই বাকি জীবন সন্তুষ্ট থাকতে পারবে?’

‘দূরের কথা আমি কোনোদিনই ভাবি না, এখনও ভাবছি না। আমি কেবল বর্তমান নিয়েই খুশি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখনকার ভালো থাকাটাকে নষ্ট করতে চাই না।’

‘বেশ! কিন্তু ও পক্ষ কি তোমার মত করে ভাবে?’

‘জানি না। জানতে চাই না। ও আমাকে ভালোবাসে, ভীষণই ভালোবাসে, তাতেই খুশি আমি।’

‘কিন্তু সব সম্পর্কই পূর্ণতা চায়। সেসব ভেবে দেখেছ?’

‘না ভাবিনি। ভাবতে চাইও না। আমি বরাবরই আমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েছি, এখনো তাই। কাউকে কোনো কথা দিইনি আর তাই রাখার দায়ও নেই। আর পূর্ণতা তো মনের ব্যাপার, সব রাস্তা রোমের দিকেই যাবে তার কি কোনো মানে আছে?’

‘চমৎকার! কুর্ণিশ তোমাকে!!’

আয়নার মেয়েটি ব্যঙ্গ করল কিনা বোঝা গেল না, তবে পালক গায়ে মাখল না। জ্ঞানদাত্রী নিজের প্রতিবিম্বটাকে লম্বা করে ভেংচি কেটে বিছানায় চলে গেল।


১০


গাছতলার বেদিতে বসে জটলা করছিল গোটাকয়েক ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে কয়েকজন মুখচেনা আর আর গুটিকয়েকের সাথে পরিচয় আছে। মাস্টার্সে বাইরে থেকে অনেকেই নতুন ভর্তি হয়েছে রনির মতো, সবাইকে চেনা সম্ভব নয়। রনি ভেবেছিল অফ পিরিয়ডটাতে ওদের সাথে আড্ডা দেবে, কিন্তু ওদের কাছে পৌঁছনো মাত্র ওরা কথা থামিয়ে দিল। অনেকে আবার এমনভাবে রনির দিকে তাকাচ্ছিল যে ওর অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। ও তাই সোজা ক্যান্টিনের দিকে হাঁটা লাগালো।

রনিকে চলে যেতে দেখে জটলা থেকে উঠে বেরিয়ে এল কুহু, ওর পাশে পাশে চুপচাপ এগোতে লাগল। কুহুর সাথে রনির বন্ধুত্ব অনেকদিনের, সম্পর্কের অভিমুখ অন্য দিকে ঘুরে গেছে তাও বছরখানেক হল।

‘তোরা কী নিয়ে কথা বলছিলি যে আমি যাওয়াতে অসুবিধা হল?’

‘তোরা বলিস না, বল ওরা। আমি কিছুই বলিনি, শুনছিলাম শুধু।’

‘বিষয়টা কী বলবি?’

‘তোকে নিয়েই’ বলে আড় চোখে রনির মুখটা দেখে নিল কুহু, কথাটা এখন বলা উচিত কি না বুঝে নিতে চাইল। তারপর ভাবল প্রয়োজনীয় কথা চেপে রেখে লাভ নেই, তাড়াতাড়ি বলে ফেলাই বরং ভালো।

‘বলছি। তবে তুই কোনো ঝামেলা করবি না ওদের সাথে, প্রমিস কর-‘

‘বড্ড ভাও খাচ্ছিস, বলতে হলে বল নাহলে ভাগ! প্রমিস টমিস করতে পারব না!’

‘ওরা বলছিল, অ্যান্টির নাকি একটা অ্যাফেয়ার আছে-‘

কোনোমতে এটুকু বলে চুপ করে গেল কুহু, রনি কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে এটা শুনে সেটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে ছিল ও।

‘মানে! আমার মায়ের অ্যাফেয়ার!!’

‘সোনালী ব’লে যে মেয়েটা বোলপুর থেকে এসেছে, ও বলছিল। ওদের এলাকার একটি মেয়ের সাথে আন্টির নাকি সম্পর্ক অনেকদিন ধরে, পাড়ার সবাই জানে। মেয়েটার বাড়িতে নাকি এজন্য খুব অশান্তি, তাই সেই মেয়ে বাড়িতে থাকে না!’

কত সহজে কথাটা বলে ফেলল কুহু। রনির মাথায় কিন্তু আগুন জ্বলে গেল। একে তো নিজের মাকে নিয়ে পাবলিক প্লেসে আলোচনা, তার ওপরে এমন বিশ্রী একটা বিষয় নিয়ে।

‘তুই যা বলছিস ভেবে বলছিস?’ রনির বিস্ফোরণ হল। ওর চিৎকারে কুহু একটু চমকে গেলেও সামলে নিল পরক্ষণেই।

‘আমার ওপর বেকার চ্যাঁচাচ্ছিস! দম থাকে তো যে বলেছে তাকে গিয়ে বল! নিজের মাকে চ্যালেঞ্জ কর!’ আর দাঁড়ালো না কুহু, অন্যদিকে হাঁটা লাগালো। ওর যাওয়ার রাস্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রনি। যদিও কিছুই দেখছিল না তখন ও, অন্য কিছু ভাবতেও পারছিল না, ওর মাথার দখল ততক্ষণে নিয়ে নিয়েছে একটু আগে কুহুর বলা কথাগুলো।

আজ অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছে রনি। ক্লাস করতে বা বন্ধুদের সাথে কথা বলতে কোনোটাই ভালো লাগছিল না। বাইরে যে যতই বিপ্লবী সেজে এলজিবিটিদের সমর্থনে গলা ফাটাক কিংবা মিছিলে হাঁটুক না কেন, ওই কেচ্ছা যখন নিজের ঘরে ঢোকে, তখন সকলেরই অস্বস্তি লাগে।

কুহু রাগ করে চলে যাবার পর একা একা ক্যান্টিনে বসেছিল রনি, সিগারেটের পর সিগারেট পুড়িয়ে সেই ধোঁয়া সহযোগে কুহুর দিয়ে যাওয়া ভাবনাগুলোকে গিলে ফেলার বৃথা চেষ্টা চালিয়েছে অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু পারেনি।

বাইরের দরজা খোলাই ছিল। অসময়ে ফিরে দরজার বাইরে চটি জুতোর স্তুপটা না দেখলে রনি জানতেই পারত না যে এত ছেলেমেয়ে ওর মায়ের কাছে গান শিখতে আসে। আপাতত বেশ কিছুক্ষণ মায়ের মুখোমুখি হতে হবে না, এটা ভেবে একটু স্বস্তি হল রনির, নিঃশব্দে বাড়িতে ঢুকে সোজা ওপরে নিজের ঘরে চলে গেল ও। মায়ের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার আগে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে হবে।

কয়েকবছর আগে মা আর বাবার মধ্যে চাপা একটা টেনশন চলছিল একটা মেয়েকে নিয়ে, রনি তখন যথেষ্টই বড়, ব্যাপারটা না বুঝতে পারার কোনো কারণ নেই। তখন মনে মনে মাকেই সাপোর্ট করেছিল রনি, বাবার আচরণটাই বরং অস্বাভাবিক লেগেছিল। কিছুদিন পরে অবশ্য ব্যাপারটা মিটেও গেছিল, বাবা-মায়ের সম্পর্ক ওর চোখে আগের মতই হয়ে গেছিল। কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে, এইজন্যই কি বাবা দূরে বদলি নিয়ে নিল?

নিজের বালিশে মুখ গুঁজে রনি শুনতে পাচ্ছিল নিচের তলা থেকে ভেসে আসা মায়ের গান, খুব যত্ন নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শেখান উর্মি। বাবা বদলি হয়ে যাবার পর মায়ের দিনগুলো অনেকটাই ফাঁকা, সেই ফাঁক মা পুরোটাই গান দিয়ে ভরেছেন, দেখেছে রনি। অন্যদিন হলে রনি মন দিয়ে শুনত মায়ের গান, কিন্তু আজ পরিস্থিতি অন্যরকম। আজ মায়ের কথা মনে পড়লে এতটাই বিকর্ষণ বোধ হচ্ছে যে ওই মহিলার প্রতি যে, এতদিনের ভালোবাসা, শ্রদ্ধার কণামাত্র আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও মনের কোনো কোণ থেকে উদ্ধার করতে পারছে না।

‘কিরে শরীর খারাপ?’

মাথায় হাতের স্পর্শে ধড়ফড় করে জেগে উঠল রনি, বুঝতেই পারেনি কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

‘এই অসময়ে ঘুমোচ্ছিস, আবার আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিস, শরীর ঠিক আছে তো?’

‘তুমি আমার খেয়াল করেছ দেখে ভালো লাগল। শরীর ঠিকই আছে।’ পাশ ফিরে শুল রনি।

উর্মি ছেলের মাথার পাশে বসল।

‘এরকম ভাবে কেন কথা বলছ বাবাই? কী হয়েছে?’

‘কি আর হবে! আর হলেই বা কি! আমাদের ভালো-খারাপে তোমার কি কিছু যায় আসে?’ এতক্ষণ ধরে মনের ভেতরে শান দিয়ে রাখা কথাগুলোর এই সময়েই বেরিয়ে আসা উচিৎ ছিল, কিন্তু বেঈমানী করে তারা আটকে থাকল গলার ভেতরে, আর একগাদা অভিমানে ভেজা জ্যাবজেবে কথাকে ঠেলে পাঠালো জিভের আগায়।

‘তুমি তো জানো বাবাই, আমি স্পষ্ট কথা পছন্দ করি। তুমি কী বলতে চাইছ সোজাসুজি বল। আর তোমার এই ‘আমাদের’ এর মধ্যে আর কে কে আছে, সেটাও খুলে বল!’ উর্মি ছেলের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন।

‘আমার আর বাবার কিসে খারাপ লাগতে পারে, তা নিয়ে তুমি কখনো মাথা ঘামিয়েছ? তুমি শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত!’

‘তুমি কি আমার গান নিয়ে কিছু বলতে চাইছ? আর এর মধ্যে বাবাকে কেন টানছ?’

এটাই সুযোগ, মরিয়া হয়ে রনি বলে ফেলল, ‘ওই মেয়েটার সাথে তোমার কী সম্পর্ক? আমি চাই না তুমি ওর সাথে কোনোরকম রিলেশন রাখো।’

‘তুমি কি পালকের কথা বলতে চাইছ?’

মায়ের বদলে যাওয়া গম্ভীর গলার স্বর শুনে মাথা নিচু করে থাকল রনি। আগে কোনোদিন এমনভাবে মায়ের সঙ্গে কথা বলেনি ও, তাই মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না ও।

‘একটা মানুষের সাথে আর একটা মানুষের যে সম্পর্ক থাকে, পালকের সাথে আমারও সেই সম্পর্ক। আরো একটা কথা জেনে রাখো, তোমাদের পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে অনেক বছর বেঁচেছি, এখন আমি বাঁচব নিজের জন্য, নিজের ভালোলাগাকে গুরুত্ব দিয়ে।’

উর্মি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর রনি গায়ে একটা জামা গলিয়ে বেরিয়ে গেল, রোজই সন্ধ্যাবেলায় যেমন যায়। পার্থক্য কেবল আজ বেরনোর সময় মাকে জানিয়ে বেরল না। অন্যান্যদিন ও সাড়ে আটটা-নটায় ফিরে আসে, কিন্তু আজ ফিরল রাত সাড়ে দশটা পার করে। রাতের খাওয়াটা ওরা একসাথেই খায়, তাই উর্মি অপেক্ষা করছিল।

‘এত দেরি করলি কেন? হাত-মুখ ধুয়ে সোজা খাবার টেবিলে চলে আয়’

সন্ধেবেলার বাদানুবাদ ভুলে উর্মি আগের জায়গায় ফিরে আসার চেষ্টা করছিলেন।

‘আমি খেয়ে এসেছি’ কথাটা মায়ের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল রনি। উর্মিরও আর খেতে ইচ্ছে করছিল না, খাবারগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।

খুব ভোরে উঠে রেওয়াজ করে উর্মি, কিন্তু আজ উঠতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেল। আসলে রাতে ঘুমোতে পারেনি ঠিক মত, প্রায় সারারাত জেগে থাকার পর ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

রনির সাথে হওয়া ঝামেলাটাতে মনের সুর-তাল কেটে গেছিল ওর। এপাশ ওপাশ করছিল আর ভাবছিল, ছেলেটাকে কে এমন কী কথা বলল যে ও এতটা বিগড়ে গেল! দুজন পরিণত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কার সাথে বন্ধুত্ব করবে, সেই বন্ধু কতটা গভীর হবে, সেসব ঠিক করে দেবার ওরা কে? তবে সন্ধ্যাবেলাতে রনির কথায় এমন প্রতিক্রিয়া না দেখালেই হত, ও কার কাছে ঠিক কি শুনেছে সেটা জেনে নিয়ে ওকে বোঝানো উচিত ছিল, বড্ড ভুল হয়ে গেছে!

রোদ এসে চোখে ঝাপটা দেওয়ায় ঘুম ভাঙল উর্মির, বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা রনির ঘরে গেল। সকালবেলা খোলা মনে ছেলের সঙ্গে কথা বলে ওর ভুল ভাঙিয়ে দেবে, এটাই ইচ্ছে ছিল। চলে যাওয়া রাতের সঙ্গে চিন্তা ভাবনার মালিন্যও ধুয়ে যাওয়া উচিত, নাহলে নতুন দিনে বাঁচবে কি করে মানুষ!

দোতলায় রনির ঘরে গিয়ে উর্মি দেখল ঘর ফাঁকা। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এত সকালে কোথায় গেল ও? তাও আবার না বলে?

‘বাবাই তুই কোথায়?’ ফোনে রনিকে ধরতে পারল উর্মি।

‘আমার এক বন্ধুর বাড়িতে।’

‘এত সকালে? তাও না বলে?’

‘প্রজেক্ট রেডি করতে হবে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে ডাকিনি। আমি কাজ করছি, এখন রাখো।’

‘আসবি কখন?’

‘একেবারে ক্লাস করে।’ ফোন কেটে দিল রনি।

আসল কথাটা হল নিজের মনের মধ্যেই প্রবল দোলাচলে ভুগছে রনি, যা করেছে সেটা ঠিক না ভুল বুঝতে পারছে না। আর এই অবস্থায় মায়ের মুখোমুখি হতেও পারছে না। তাই সাতসকালে এসে অম্লানকে তুলে দিয়েছে ঘুম থেকে, নিজেকে জোর করে বসিয়েছে কম্পিউটারের সামনে।


১১


এতবছর বাদে রনির কাছ থেকে ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ পেয়ে বেশ অবাকই হল পালক। উর্মিদির ছেলে রনির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে অনেক আগে, ওদের বাড়িতে যেবার প্রথম গিয়েছিল। ছেলেটাকে তেমন মিশুকে মনে হয়নি, উর্মিদি ডেকে নিয়ে এসে আসায় দু-একটা কথা বলে নিজের ঘরে চলে গেছিল।

‘রনিটা এরকমই। কারো সাথে হুট করে মিশতে পারে না। তুই আরো কয়েকবার এলে দেখবি আস্তে আস্তে সহজ হয়ে যাবে।’ ছেলের ঠান্ডা ব্যবহারের অস্বস্তি ঢাকতে বলেছিল উর্মিদি।

তারপরেও বেশ কয়েকবার ও বাড়িতে গেছে পালক, থেকেও গেছে, কিন্তু রনি ‘হাই’ ‘হ্যালো’ পেরিয়ে আর এগোতে পারেনি। এমন প্রকৃতি যার, সেই ছেলের কাছ থেকে বন্ধুত্বের ডাক এলে অবাক লাগারই কথা।

সাড়া দিয়েছিল পালক, উর্মিদিকে জানিয়েওছিল সেই কথা। উর্মিও অবাক হয়ে জবাবে লিখেছিল, ‘তাই! অদ্ভুত তো!’

উর্মির অদ্ভুত লাগারই কথা। আগেরদিন যে ছেলে পালককে নিয়ে ঝামেলা করল মায়ের সঙ্গে, পরদিন সে নিজেই বন্ধুত্বে আগ্রহী হল, ব্যাপারটা ঠিক মেলানো যায় না। রনির এই ঝামেলা করার বিষয়টা উর্মি পুরো চেপে গেছে পালকের কাছ থেকে। মেয়েটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে কি লাভ? এমনিতেই বেচারাকে কত ঝামেলা সহ্য করতে হয়, সেগুলোর তো ভাগ নিতে পারে না উর্মি, তাই পালকের বোঝা আর বাড়াতে চায়নি উর্মি।

বেলা বাড়তে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছিল পালক, রনির কথাটা মাথায় ছিল না আর। সারাদিন কাজের চাপে অপ্রয়োজনীয় কোনো মেসেজ খুলে দেখার সময় হয় না ওর, রাতে বাড়ি ফিরে একবারে সবগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেয়। আজ মেসেঞ্জার খুলে প্রথমেই চোখে পড়ল রনির মেসেজটা। পুরো মেসেজটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল পালক।

আজ দুপুরে গানের রেকর্ডিং আছে উর্মির, কলকাতায় যেতে হবে। এখন মাঝেমাঝেই টেলিভিশনে গাওয়ার ডাক আসে ওর। ইউটিউবেও চ্যানেল খুলে দিয়েছে পালক, অনুগামীর সংখ্যা সেখানেও কিছু কম নয়। আবার গানে ফিরে আসা, এই জনপ্রিয়তা সবটাই সম্ভব হয়েছে পালকের জন্য, অথচ ও মেয়ে কিছুতেই সেই কথা মেনে নেবে না। বললেই বলবে, ‘দুসস! তোমার যোগ্যতায় তুমি এখানে পৌঁছেছ, আমি কি করেছি?’

‘যোগ্যতা তো আগেও ছিল। কই খুঁড়ে বার করেনি তো কেউ!’

‘তুমিই তো বল, সবকিছু প্রিডিটারমাইন্ড। এতদিন সেই সময় আসেনি, তাই হয়নি।’

তর্কে কখনো পারা যায় না পালকের সঙ্গে, তাই বরাবর উর্মি হাল ছেড়ে দেয়। তবে মনে মনে ও জানে, পালকের মত আর কেউ ওকে ভালোবাসতে পারেনি, একদম নিঃস্বার্থ এই ভালোবাসা। আসলে একটা মেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু একজন মেয়েই হতে পারে। মেয়েদের চিন্তাভাবনার ধরণ পুরুষের থেকে একেবারেই আলাদা, তাই মেয়েরাই সেটা সবচেয়ে ভালো বোঝে।

সকালে সুপর্ণ ফোন করেছিল, বলেছিল ‘একা না গিয়ে রনিকে নিয়ে যাও না! একদিন কলেজে না গেলে কি এমন ক্ষতি হবে ওর!’

রনি যে আজ অনেক সকালে বেরিয়ে গেছে সেটা আর বলেনি উর্মি, ফালতু কথা বাড়াতে চায়নি।

‘অসুবিধা হবে না। আমার হ্যান্ডসরাও তো সঙ্গে যাবেন।’

সুপর্ণর ফোনের পর অনেকক্ষণ মনে মনে অপেক্ষা করেছিল উর্মি, পালকের জন্য। রেকর্ডিং এ যাবার আগে পালক ফোন করবে না, এ হতেই পারে না। শেষ পর্যন্ত উর্মিই ফোন করল, ওদিকে শুধু রিং হয়ে গেল।

সময় হয়ে গেছিল বলে মনের মধ্যে খচখচানি নিয়েই উর্মিকে বেরতে হল।

পালককে ফোনে না পাওয়ায় উর্মি ভেবেছিল ও হয়ত স্টুডিওতে চলে আসবে সারপ্রাইজ দিতে। এরকম সারপ্রাইজ দিতে পালক খুব ভালোবাসে আর এখন তো ও ট্রান্সফার পেয়ে কলকাতায় চলে এসেছে মাস ছয়েক হল, অতএব এরকম কিছু একটা করবে সেটা আশা করাই যায়।

কিন্তু আশাহত হতে হল উর্মিকে, টেলিভিশন চ্যানেলের অফিসে ঢোকার আগে পর্যন্ত পালককে দেখতে পেল না, ওর কোনো ফোন বা মেসেজও পেল না। হতে পারে কোনো দরকারি কাজে আটকে গেছে, এটা ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিল উর্মি।

‘আমি যাচ্ছি।’

রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাবার পর ফোন খুলে পালকের মেসেজটা পেল উর্মি, কিন্তু মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। রেকর্ডিংয়ের সময়টা তো ওর জানাই ছিল, তাহলে কি শেষ হয়ে যাবার পর এসে দেখা করতে চাইছে? কিন্তু কখন আর কোথায় আসবে? উর্মি কি এখানেই অপেক্ষা করবে? বাধ্য হয়ে আবার ফোন করল উর্মি।

এবার ফোন তুলল পালক।

‘তুই কোথায়? আমি কি এখানে অপেক্ষা করব?’

‘আমার জন্য আর অপেক্ষা কোরো না। তুমি বাড়ি চলে যাও।’

পালকের স্বর অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে বলে হল উর্মির।

ট্যাক্সি নিয়ে পালকের ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছতে উর্মির আরও চল্লিশ মিনিট লাগল। নিজের গাড়িতে এলে আরও একটু কম সময় লাগত হয়ত, কিন্তু মিউজিশিয়ানদের তো কলকাতা থেকে বর্ধমানে ফিরতে হবে, তাই গাড়িটা ওদের ছেড়ে দিল।

এই চল্লিশ মিনিট দম বন্ধ করে বসেছিল উর্মি, মনটা কু গাইছিল।

কলকাতায় এসে একটা পুরনো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে পালক, বাড়িটা উর্মির চেনা। পালক এখানে শিফট করার পর বার দুয়েক এসেছে উর্মি। গলির মুখে ট্যাক্সি ছেড়ে দুদ্দাড়িয়ে তিনতলায় পৌঁছে বেল বাজাল উর্মি, একবার,দুবার, তিনবার, কোনো সাড়া পেল না। এবার পাগলের মত বেল বাজাতে থাকল ও, সঙ্গে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকল।

পালকের কোনো সাড়া না পাওয়া না গেলেও উর্মির ডাকাডাকিতে উল্টোদিকের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বার হয়ে এল। সকলের ধাক্কাধাক্কিতে পুরনো দরজার ছিটকিনি গেল ভেঙে, ভেতরে ঢুকে উর্মি দেখল ঘুমিয়ে আছে পালক।

সৌভাগ্যক্রমে পায়েলের নামটা সেইসময়ে মনে পড়েছিল উর্মির, তাই ঝামেলার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল। পায়েল উর্মির ছাত্রী, সপ্তাহে একদিন কলকাতায় গানের ক্লাস নিতে আসে উর্মি, সেখানেই শেখে ও। পায়েলের বাবা ডাক্তার, নিজের নার্সিংহোম আছে। মেয়ের টিচারের বিপদের কথা জেনে তিনি এককথায় পালককে সেখানে ভর্তি করে নিলেন, থানা পুলিশের ঝামেলা পোহাতে হল না। অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল পালক, উর্মি ঠিকসময়ে গিয়ে না পড়লে হয়ত ওই ঘুম আর ভাঙত না।

পরদিন দুপুরে পালককে ছাড়ল নার্সিংহোম থেকে। ওর বাড়িতে ইচ্ছে করেই খবর দেয়নি উর্মি, কারণ পালক যে সেটা পছন্দ করবে না ভালোমত জানে ও। এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে বাড়ীর লোকজনেরও ভূমিকা থাকতে পারে, যেহেতু পরিবারের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা খুব একটা ভালো নয়, এটাই মনে হয়েছিল উর্মির। অতএব যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, সেটা সামলানোর ভার যে এখন তার নিজেরই, সেটা বুঝতে পেরে উর্মি, রনি আর সুপর্ণকে জানিয়ে দিয়েছিল, বিশেষ দরকারে দুদিন ওকে কলকাতায় থেকে যেতে হচ্ছে। নার্সিংহোম থেকে পালককে নিয়ে ওর ফ্ল্যাটে ফিরে আসার পর দুজনেই খুব ঘুমোল, একজন অসুস্থতা আর একজন রাতজাগার কারণে।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর, যখন পালককে একটু সুস্থ বলে মনে হচ্ছিল তখন প্রথমবার উর্মি ওকে প্রশ্ন করল, ‘কেন করেছিলি?’

পালক জানত যেকোনো সময়ে প্রশ্নটা আসবে। তবু নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারেনি ও। একে তো এটা এমন একটা কাজ যা মনের নেগেটিভ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়, যেটা উর্মির বরাবরের না-পসন্দ, তার ওপরে এর জন্য উর্মিকে এত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে এটা ভেবে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল পালক যাতে উর্মি ওর মুখ না দেখতে পায়। উর্মি ওর মাথায় হাত রাখল,নিচু স্বরে বলল, ‘একবার আমার কথাটা ভাবলি না!’

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল পালক। উর্মি ওর মুখটা নিজের কোলে তুলে নিল, বলল, ‘এমন কী ঘটনা ঘটল যে তুই আমাকেও বলতে পারলি না!’ এই ভালোবাসার স্পর্শটুকু পেয়ে প্রতিরোধ ভেঙে গেল পালকের।

‘আমার জন্য তোমার সব কিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তোমার পরিবার, সুনাম সব। তাই ভাবলাম আমার সরে যাওয়াই উচিত।’

‘বাহ্! আমার এত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা, অথচ আমি জানতেই পারলাম না, আর তুই সব জেনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি! চমৎকার!’

পালক নিরুত্তর। উর্মি রাগত স্বরে বলল, ‘কিভাবে এমন একটা সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে আমাকে জানানো যায় কি?’

জানি ‘তুমি রেগে আছ। তাহলে এটা পড়ে বল, আমার জায়গায় তুমি থাকলে কি করতে?’ পালক ওর ফোন থেকে একটা মেসেজ বার করে এগিয়ে দিল উর্মির দিকে।

প্রেরকের ছবি যেহেতু লেখার ওপরেই আছে তাই তাকে চিনতে অসুবিধা হল না উর্মির। পুরোটা পড়ে উর্মি কিছুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে ফেলল। এসব কী লিখেছে ছেলেটা? পালককে সম্বোধন করেছে ‘ইউ লেসবিয়ান’ বলে! এরকম চিন্তাভাবনা আর ভাষা ও কোথায় পেল? এরকম শিক্ষা দিয়ে কি ওকে বড় করেছে উর্মি! ছেলের কাজের জন্য পালকের দিকে মুখ তুলে তাকাতে লজ্জা লাগছিল উর্মির।

ঘুমোনোর আগে উর্মি, পালকের মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল। আসলে ও মেয়েটাকে কয়েকটা কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরদিনই ফিরে যেতে হবে ওকে তাই পালককে ভালো করে বোঝানোর জন্য আজ রাতটাই শুধু সময় আছে ওর কাছে।

‘তুই আমাকে অনেক দিয়েছিস পালক, ভালোবাসা, নামযশ, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছিস। স্বপ্নের পেছনে দৌড়নোর সাহস যুগিয়েছিস, আমাকে আমার ভেতরের খোলসটা থেকে টেনে বার করে এনে উড়তে শিখিয়েছিস। আমি তোকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দিইনি। আজ তোকে একটা পরামর্শ দেব, যেটা আমার উপলব্ধি। আমার বয়স আর অভিজ্ঞতা আমাকে পরিণত করেছে, এই পরামর্শ মেনে নিলে ভালোই হবে তোর, শান্তি পাবি।’

পালক এবারে উর্মির হাত চেপে ধরে ওর দিকে পাশ ফিরল।

‘তোমার কোন পরামর্শটা শুনি না? এটা একটা ভুল হয়ে গেছে। সরি তো বলেছি বাবা!’ আদুরে গলায় বলল পালক।

‘জীবনের বিরুদ্ধে অযথা লড়াই না করে, জীবনের সঙ্গে ভাসতে চেষ্টা কর, জীবন তোকে ঠকাবে না। এটার জন্য যে ঘটনাটা যেমনভাবে আসছে, তাকে সেভাবেই গ্রহণ কর, মেনে নে, তারপর ভুলে গিয়ে নিজের পথে চল।’

‘আমার ব্যাপার হলে তো মেনেই নিই, কে কি বলছে কানে তুলি নাকি! কিন্তু তোমার অসম্মানটা যে মানতে পারছিলাম না।’

‘রনি ভুল বুঝে আবেগের বশে একটা কথা বলল, আর সেটাই সত্যি হয়ে গেল! আমরা নিজেরা যখন জানি যে, আমাদের সম্পর্কটাতে অন্যায় কিছু নেই, তখন কে কি বলল সেটা কেন গায়ে মাখতে যাব! বড় বড় পাথর জলের তলায় থাকে অথচ জল কি তার ভেতরে ঢুকতে পারে? নিজের মনটাকে ওইরকম তৈরি করতে হবে পালক, কাদায় ডুবে থাকলেও কাদা যাতে আমাদের ভেতরে ঢুকে মনটাকে নষ্ট করে দিতে না পারে। ভালোবাসার অনেক রঙ থাকে রে পাগলি, সবাই সেগুলো দেখতে পায় না। বেশিরভাগ মানুষ সাদা আর কালো এইদুটো রঙই চেনে, কিন্তু এই রঙদুটোর মিশেলে যে আরও কত রঙ তৈরি করা যায় তা তারা জানে না। তাই তারা সব সম্পর্কের মধ্যেই কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজে, স্বার্থ খোঁজে, যৌনতার গন্ধ খোঁজে। স্বার্থের হিসাব নিকাশ বাদে, যৌনতাকে না জড়িয়েও যে মানুষে-মানুষে ভালোবাসাবাসি হতে পারে, তা কি সবাই বুঝতে পারে পাগলি? তাতে বিস্তর দম লাগে রে! তাই বলছি, এই সব মানুষকে প্রাধান্য দিলে কি নিজের জীবনটা নিজের মত করে বাঁচা যায়?’

‘কিন্তু এইসব মানুষগুলো যদি আত্মীয় হয়? তখন কি তাদের তুমি ইগনোর করতে পারবে?’

‘আত্মীয় যে হবে, সবার আগে তার তো আত্মার সঙ্গে যোগ থাকতে হবে। তাহলে সে কি আমার আত্মাকে আঘাত করতে পারবে? যে মানুষ আমার আত্মাকে কাঁদায় তাকে আমি আত্মীয় বলে মানি না, সে যদি আমার নিজের সন্তান হয়, তবুও না।’

‘তোমার মত করে ভাবার ক্ষমতা আমার নেই উর্মিদি, সাহসও নেই। তাই যখন দেখলাম, তোমার ছেলে আমার দিকে আঙুল তুলে বলছে আমার জন্যই তোমার পরিবারটা নষ্ট হয়ে গেছে, বর, ছেলে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ তুমি, তখন আমার তো খারাপ লাগবেই। নিজেকেই অপরাধী ব’লে মনে হবে।’

‘রনি ভালো করে তলিয়ে না ভেবে এসব বলেছে, কিন্তু তুই তো জানিস সত্যিটা কি। ছেলে বড় হয়ে গেছে, তার এখন নিজের জগৎ তৈরি হয়ে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। ও কি এখন আমার বন্ধু হতে পারে? ছেলের বাবাও নিজের কাজকে কেন্দ্র করে চরকিপাক খায়, সেখানেই বা আমার জায়গা কোথায় বল? আমি কাউকে দূরে সরাইনি, ওরা স্বাভাবিক নিয়মেই যে যার পছন্দের গন্তব্যের দিকে চলে গেছে। আমি কেবল ‘ওরা আছে’ এই বিশ্বাসটাকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটাচ্ছিলাম তুই আসার আগে পর্যন্ত। তাছাড়া আর একটা কথা কি জানিস? স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের সম্পর্কের বাইরেও প্রতিটা মানুষের একজন বন্ধু থাকা দরকার, যার কাছে অকপট হওয়া যায়, যার সাথে কথা বললে একবুক অক্সিজেন পাওয়া যায়। সেই মানুষটার উপস্থিতি হল ঘরের বাইরে একচিলতে বারান্দার মত। আমার জন্য সেই বারান্দা তুই, যেখানে এসে দাঁড়ালে আমি প্রতিদিন নতুন করে বাঁচি। আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে যে, সে কেন নিজেকে অপরাধী ভাববে?’

পালকের চোখ জলে ভরে উঠল। উর্মির গলা জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এত ভালোবাসো তুমি আমাকে?’

‘তুই যা বুঝেছিস তার চাইতে আরও একটু বেশি।’ হেসে ফেলল উর্মি, গত দুদিনের মধ্যে এই প্রথম।

খুশি, আনন্দ কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে খুব তাড়াতাড়ি সংক্রমিত হয়, পালকও হাসতে থাকল।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “novel-tin-tirikee-dosh

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *