novel-vanga-kacher-ayna

ভাঙ্গা কাঁচের আয়না
রাজশ্রী বসু অধিকারী


রূপম ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার দেখে নিচ্ছিল। ভাল করে দেখে নিয়ে এবারে ও নিশ্চিত হয়। এই মেয়েটা আর কেউ নয়, এ মিঠি। এ সেই মিঠি যাকে রূপম সেই ভয়ঙ্কর ঝড়ের রাত্রে বাইকে লিফট দিয়ে পৌঁছে দিয়েছিল ব্যারাকপুর চিড়িয়ামোড় থেকে বিরাটী পর্যন্ত। শ্যামলালের পিসতুতো বোন মিঠি। কী যেন ভাল নাম ছিল মেয়েটার! মনে নেই রূপমের। বলেছিল বোধহয়। শুধু সেই দিনই তো নয়, আরো অনেকগুলো দিন দেখা হয়েছিল ওর সাথে। কোথাও একটা অস্পষ্ট কথা তৈরি হচ্ছিল যে আরো অনেক অনেকবার দেখা হবে। কিন্তু সেই অস্পষ্ট কথাগুলো ঝাপসা হয়ে থেকে থেকে একদম মিলিয়েই গেল পেনসিলের হালকা দাগের মত। আর দেখা হলনা পাঁচ ছয় সাত বছর। এরমধ্যে কত পাল্টে গেল পৃথিবী। কত তারা খসে গেল মহাকাশে। কত পাল্টে গেল রূপম নিজেও। আর ঐ মেয়েটা? ঐ মিঠি? সেও তো বদলে গেল কত! তাই বলে এতটাই? এতটাই সেই পরিবর্তন যে এভাবে এই অখ্যাত রিসর্টে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গিনী হয়ে ওকে আসতে হবে? তার গলা ধরে প্রায় ঝুলে পড়ে এলোমেলো পা ফেলে ফেলে ঢুকে যেতে হবে সামনের কটেজে? রূপমের মুখের ভেতরটা তেতো লাগে। ড্রয়ার থেকে ভাজা মৌরীর কৌটোটা নিয়ে ঢাকনি খুলে হাতে ঢালতে যায়। অন্যমনস্ক ছিল কিছুটা। কৌটো হাতে তুলতে প্রায় সবটা মৌরীই পড়ে গেল। ভীষন বিরক্ত লাগে ওর। কার্পেটময় পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে মৌরী। খাওয়া তো হলোই না, এবার সুইপার ডেকে পরিষ্কার না করানো পর্যন্ত শান্তি নেই। এক্ষুনি ম্যাডাম বিপাশা এসে যাবেন। চতুর্দিকে তার একশটা চোখ। ঢুকেই হাজার প্রশ্ন করবেন, কে ফেলেছে কিভাবে ফেলেছে যে ফেলেছে তার মন কোথায় ছিল? সব প্রশ্নের তীর এসে রূপমকেই বিঁধবে। কারণ এই দুপুরবেলায় ও ছাড়া আর প্রায় কেউই নেই রিসেশনে। একজন সুন্দরী মহিলার যে কি করে এমন কঠিনপ্রাণ হতে পারে, এটাও ওর কাছে আশ্চর্যের! এমনিতে দিনের পর দিন ওনার দেখা পাওয়া যায়না। সমস্ত দায়িত্ব আরেকজনের ওপর। কিন্তু যেদিন আসেন চারদিকে একেবারে ঝড় তুলে দিয়ে চলে যান।

সুইপারকে, সুইপার বলে চেনার উপায় নেই। ফেড জিন্সের প্যান্ট, মাথায় সর্বক্ষণ রঙ্গীন টুপি আর রংচংয়ে টি শার্টে সে একজন পর্দাফেরত উঠতি ছোকরা বলেই মনে হয়। নামেও তরুণ, হাবভাবেও তাই, বয়স যাই হোক না কেন। তরুণের একটাই বড় গুণ যে কখনোই ওর মুখে বিরক্তি দেখা যায়না। সবসময় কোন না কোন ডালখোলামার্কা গান ভাঁজছে। রূপমরা যে কেউ অনুরোধ করলেই আবার বেশ গলা ছেড়েও গান গেয়ে দেয় সময় সময়। শুধু ম্যাডামকে দেখলেই আর গান কেন, কোনরকম আওয়াজই বের হয়না ওর। অবশ্য ম্যাডাম আসার আগেই ওর যা কাজ। দু’বেলা পুরো রিসর্ট ঝাড়ু পোঁছা করে চকচকে তকতকে করেই রাখে। এখন মাঝদুপুরে কোথায় ওকে পাওয়া যাবে, আরো একবার ঝাড়ু করার জন্য! রূপম এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল তরুণের খোঁজে। মৌরী পড়ে যাওয়ায় আপাততঃ ওর মাথা থেকে মিঠির চিন্তাটা গেছে।

বেশীক্ষণ খোঁজ করতে হয়না। পুরনো এক বাংলা ছবির গান গাইতে গাইতে ঝাড়ু হাতে তরুণ নিজেই এসে হাজির। কার্পেটের ওপর দিয়ে বিনাবাক্যব্যয়ে সে চালিয়ে দিয়েছে তার হাতের মেশিন। ঝাড়ুটাকে সে মেশিন নামেই ডাকে। কেউ কিছু বললেই বলে, দাঁড়াও আগে মেশিনটা নিয়ে আসি। এখন সে একেবারে তৈরি হয়েই এসেছে। রূপম অবাক হয় একটু, “কী রে! তুই নিজেই এসে গেলি? আমি ডাকতেই যাচ্ছিলাম …”

“নিজে কি করে আসব? আমি তো ঘরে শুয়ে প্যাডে ফিল্ম দেখছিলাম। ওই তো উনি গিয়ে ডাকলেন আমায় … বলল তুমি নাকি কী বিপদে পড়েছো …পা সরাও …”

“বিপদ আবার কি? নে নে এখানটা ভাল করে ক্লিন কর …একটাও মৌরী যেন পড়ে না থাকে …” তরুণের কথার উত্তর দিতে দিতে সামনের দিকে তাকায় রূপম। ওর চোখের সামনে দিয়ে হলুদ, গোলাপী ছাপা শিফন শাড়ির একটুখানি আঁচল ভেসে চলে যায় বাঁদিকের প্যাসেজ বেয়ে। ওদিকটায় আছে পরপর গেষ্টরুম। একতলা, দোতলা নানারকম ঘর। তাছাড়াও আছে আরো একটা অফিস রুম। সেখানেই মোটামুটি পাওয়া যাবে ওই গোলাপী, হলুদ শাড়ির মালকিন রাগিনী সহায়কে। ও এই রিসর্টের হেডক্লার্ক, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, অ্যাডভাইসার ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। ম্যাডাম তো কালেভদ্রে আসেন এখানে। বলতে গেলে রাগিনীই এই রিসর্টের একনম্বর মাথা। ওই অফিসটাতেই ওর বসার জন্য আছে একটা ছোট্ট এয়ারকন্ডিশনড চেম্বারও। কিন্তু সেখান থেকেও ও কি করে যে সারাক্ষণ পুরো রিসর্টে, বিশেষতঃ রূপমের ওপরেও নজরদারি করে কে জানে? বোঝা গেল আজকেও তরুণকে তড়িঘড়ি খবর পাঠিয়ে রাগিনীই এনেছে। নিজেও দেখে গেল একবার কিন্তু একটা সেকেন্ডও দাঁড়াল না যাতে রূপম অন্তঃত একবার সৌজন্যের হাসি হাসতে পারে ওর দিকে। অদ্ভুত মেয়ে একটা।

অবশ্য এই রিসর্টের কোন জিনিসটা বা কোন মানুষটা অদ্ভুত নয়? খোদ মালকিনই কী কম অদ্ভুত! কোটি কোটি টাকার মালিক, বর বাচ্চা ছেড়ে এই গ্রামে এসে রিসর্ট খুলে বসেছে। তাও আবার যখন তখন আসে যায়, সমস্ত দায়িত্ব ঐ রাগিনীর ওপর। কেনই যে মানুষ সংসার করে, আবার কেনই বা সেই সংসার ছেড়ে চলে আসে, তা রূপমের মাথায় ঢোকেনা। যত দিন যাচ্ছে একটা অংশের কাছে সম্পর্ক ভাঙ্গা গড়ার খেলাটা খুব প্রিয় একটা অকুপেশান দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সম্পর্ক আর কাঁচের গ্লাসের মধ্যে তাদের কাছে ফারাক নেই কিছু। এই মানুষদের রূপম ভয় পায়, সাঙ্ঘাতিক ভয়। কিন্তু আলাদা করে চিনে নেওয়া ওর কর্ম নয়। চিনতে গেলেই প্রবল ভাবে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই সবার থেকে আলাদা হয়ে একা থাকতেই ভালবাসে ও। প্রত্যন্ত গ্রামের ভেতর সবুজের চাদর মুড়ি দেওয়া এই জাগরন গ্রামীন রিসর্টের চেয়ে আর কোন ভাল জায়গা পাওয়া যাবে একা থাকার জন্য! মাঝে মধ্যে গোলাপী আঁচলের ছায়া সামনে এসে পড়লেও তাই চোখ বুজে থাকে রূপম। কোনদিকে তাকাতেই ও বারণ করে রেখেছে নিজের মনকে। যতই সেই ছায়া মাঝে মাঝে ওকে আনমনা করে তুলতে লড়াই চালাক মনে। রূপম ছায়াকে ওয়াক ওভার দিয়ে সরে যায় নিজের নিভৃত কোণে। এজীবনে আর ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে অঙ্গে ব্যাথা করতে রাজী নয় রূপম মজুমদার। সে এখানে ম্যানেজারি করতে এসেছে। সেইটুকুই করে যাবে চুপ চাপ। তরুণের গুনগুন গান শুনতে শুনতে আর ঝাঁট দিয়ে জড়ো করা মৌরীর স্তূপের দিকে দেখতে দেখতে ভেবে চলে রূপম। বোঝেনা এই এত এত মাইল ভাবনা আসলে সেই ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে মাথা ব্যাথারই অপর এক রূপ।




কানা ফকির গান গাইছিল। কত জনম গেল পার / সকল মোহ ছাড়ি আলাম / তবু পাইলাম না রে মোহন / তোমায় পাইলাম না। প্রতিবার পাইলাম না বলার সঙ্গে সঙ্গে ফকিরের থুঁতনিটা প্রবল আবেগে কেঁপে কেঁপে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল আর আকাশের দিকে হাত তুলে অনেকটা সুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছিল সে। যেন এখুনি কোথাও থেকে নেমে আসবে সেই মোহন নামের না পাওয়া কেউ একজন। তখন আর পাইলামনা বলে এতটা সুর খরচ করতে হবে না গায়ক কে। রূপম মন দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ফকিরের মুখের প্রতিটা মুভমেন্ট। আজ মঙ্গলবার। রূপমের ছুটির দিন। নামেই ছুটি, হয়তো এক্ষুনি কোন আর্জেন্ট ডাক আসবে আর ওকে ছুটে যেতে হবে। সেরকমই বলা আছে ম্যানেজমেন্টের তরফ থেকে। তবু, অন্যদিন যেমন ডেস্ক থেকে নড়াই যায়না, এই মঙ্গলবারগুলো ওর ডিউটিতে কিছুটা ঢিল দেওয়ার অনুমতি আছে। মনে করলে বাড়িও যেতে পারে। কিন্তু প্রায় চার মাসের ওপর বাড়িমুখো হয়নি রূপম। কে আর আছে বাড়িতে? মা চলে যাওয়ার পর বাড়ির ওপর আর কোন টান অনুভব করেনা ও। তাছাড়া ও গেলেই যেন সামনের ফ্ল্যাটে একটা অকারণ দেখনদারীর উৎসব শুরু হয়, যেটা ভাবলেই গা গুলিয়ে ওঠে। বাড়ি যেতে পা ওঠেনা রূপমের।

তাই এই ছুটির দিনগুলো নিজের ইচ্ছেমত বেরিয়ে পড়ে, যেদিকে চোখ যায় মন যায়। রিসর্টে বলা আছে দরকার হলেই ওকে ফোন করতে। ও না থাকলে রাগিনী সামলে নেয় সবটা। রূপম তবু নিজের ইচ্ছেমত অবকাশের সময়টুকু খরচ করে এদিক ওদিক। রাগিনীর সেই বালাইও নেই। সে সারাক্ষণ ওই রিসর্ট নিয়েই পড়ে আছে। ভাবলে বেশ অবাক লাগে রূপমের। কিন্তু রূপম বেশি ভাবতেই চায়না আজকাল। কোনকিছু নিয়ে বা কাউকে নিয়েই ওর ভাবনার অভ্যাসটা একজন একদম কালি লেপে ঢেকে দিয়েছে। ভাবতে আর ভাল লাগেনা রূপমের। তার চেয়ে অনেক ভাল এই বটগাছতলায় বসে কানা ফকিরের গান শোনা। গত সপ্তাহেও তাই করেছে। ফকির রোজ আসেনা। শুধুমাত্র প্রতি মঙ্গলবারেই ওকে দেখতে পাওয়া যায় পারূলিয়ার হাটে বা গাছতলায়।

ফকিরেরও কি রূপমের মতই মঙ্গলবার অফ ডে? কথাটা মনে হতে নিজের মনেই হেসে মাথা নাড়ে ও। ধুর, ফকিরের এটা অফ ডে হতে যাবে কেন? এটা ওর ওয়ার্কিং ডে। এই গান গাওয়াটাই তো ওর কর্মসংস্থান। গ্রামের মানুষ এটা সেটা, পাঁচ দশ টাকা দিয়েই যায়। আর রূপম তো আগের দিন পঞ্চাশটাকা দিয়েছে। আজকেও দেবে ভেবে রেখেছে। এতটা বেশী দেওয়ার একটাই কারণ। আজকের দিনে ডেইলি ওয়েজ দশটাকা কিছুতেই হতে পারেনা। পঞ্চাশ টাকাটাও কম, কিন্তু ওর এটুকুই ক্ষমতা।

“এট্টু চা খাওয়াও দেখি ভাইটি …গলাটা বড্ড শুকায়ে গেছে।” গান শেষ করে গাছের বাঁধানো গুঁড়িতে বসতে বসতে বলে ফটিক। গামছা দিয়ে মোছে মুখে, কপালে জমে থাকা ঘাম। ফটিকের মধ্যে কোথাও ভিখিরী ভাব নেই। তার ভাবখানা এমন যেন সে সবাইকে গান শুনিয়ে আনন্দ দিচ্ছে। তার বদলে পারিশ্রমিক নিচ্ছে। এই যে চা চাইল তার মধ্যেও একটা যেন অধিকারবোধ আছে কোথাও। লোকটার এটাই বিশেষত্ব। রূপমকে এটাই টানে। বিনাবাক্যব্যয়ে সে পাশের ঝুপড়ি দোকান থেকে দুই ছোট কাঁচের গ্লাসে চা নিয়ে এসে বসে ফটিকের পাশে। আয়েশ করে চায়ে চুমুক দেয় ফটিক।

“বাবু তোমার মনটা ভাল। চ্যায়রাপত্তর বেশ ভাল। লেখাপড়া করা শহুরে মানুষ এই গ্রামে কেন পড়ে আছ বল দেখি …”

“পড়ে নেই ফটিকদা। চাকরি পেলাম না অনেক চেষ্টা করেও। এখানে কাজটা পেয়ে একটা হিল্লে হল …এই আর কী!”

এক চোখের পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ফটিক দেখে নেয় রূপমের মুখ। তারপর একগাল হেসে মাথা নাড়ায়,

“উঁহু, এটা তো বাইরের কথা। চাইলে তুমি শহর বাজারে কিছু পেতে না এটা মানতে পারলাম না গো …”

এবার রূপমও হাসে, “তুমি কি এবারে গান গাওয়া ছেড়ে দিয়ে গোয়েন্দাগিরি ধরবে ভাবছো? তোমার একখানা চোখ গেল কী করে সেই গল্পটা বলো বরং …”

“বলিনি তোমায় এটা হল গিয়ে উন্ডস অফ লাভ …যাকে প্রাণের চেয়ে ভালবাসলাম সে কুড়ুল ছুঁড়ে প্রাণটাই শেষ করে দিতে চেয়েছিল। প্রাণ রয়ে গেল, চোখটা থাকলনা।” হাসতে হাসতে বলে ফটিক। যেন বেশ মজাদার কোন ঘটনা।

পথে পথে গান গেয়ে বেড়ানো লোকটির মুখে ইংরেজী শুনে রূপম অবাক হয়না। আগেও শুনেছে। ওর ধারণা, এই ফটিক বেশ পড়াশোনা জানা লোক। ওর অবাক লাগে ফটিকের হাসিমুখ দেখে। উত্তেজিত ভাবে বলে “তুমি থানা পুলিশ করলে না? তুমি তো মরেও যেতে পারতে …”

“মরিনি তো! জীবনে এত আনন্দ চারদিকে ছড়ানো, খামোখা অসময়ে মরতে যাব কেন?”

রূপমের মাথার ভেতরে চক্কর দেয় ফটিকের কথাগুলো। এই যে আনন্দময় একটা প্রাণ, এটাই এই লোকটার ইউ এস পি। প্রথম দেখা থেকে এইজন্যই এই লোকটা ওকে বেঁধে ফেলেছে।

“কেস হয়েছিল জানো! আমি কমপ্লেইন না করলে কি হবে, সুয়ো মটো কেস করল পুলিশ তরলার নামে। পাড়া ঘরের মানুষজন আমায় ভালবাসত, তারাই পুলিশকে দিয়ে করাল।”

“তারপর? সাজা হল তরলার?”

“নাহ …”

“সে কি?”

“হবে কি করে? আমি তো সাক্ষীর ডকে দাঁড়িয়ে তাকে চিনতেই পারলামনা। কে আমায় মেরেছে তাও মনে পড়ল না আমার।”

“তুমি মিথ্যে সাক্ষী দিলে? ছি ছি …”

“না গো, মিথ্যে সাক্ষী দিইনি আমি। সামনে দাঁড়ানো তরলার দিকে তাকিয়ে শুধু মনে পড়ছিল এই মানুষকে কত ভালবেসেছি, কত গান গেয়ে শুনিয়েছি একসময়। ও যে আমায় কুড়ুল ছুঁড়ে মারল সেকথা তো কই একবারও মনে পড়ল না। মনে মনে বিচারককে বললাম হুজুর, মাফ করে দিন তরলাকে। ভালো থাক, সে তার আশনাইএর মানুষের সঙ্গে। একটাই তো জীবন। তার হক আছে ভালোবাসার, ভালো থাকার।”

রূপম বুঝে উঠতে পারেনা এই মানুষটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে। ফটিক বোকা মূর্খ, নাকি আদ্যন্ত একটা ভালো মানুষ, সকালবেলার আকাশের মত নির্মল ওর মন, যেখানে মেঘের আঁকিবুকি দেখা দিলেও তা দাঁড়াতে পারেনা, দমকা হাওয়ায় ভেসে চলে যায়!

রূপম কেন আজো চিনুকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারল না? ভুলতেও বা পারলনা কেন? কেন চিনুর নামটুকু মনে এলেও একরাশ ঘৃণা এসে ওকে অস্থির করে তোলে! কেন নিজের শহর ছেড়ে এতদূর গ্রামে এসে ওকে মন লুকোতে হয়?

আগের চা অনেকক্ষণ শেষ। আবার দু গ্লাস আনবে কিনা ভাবছে এমন সময় পকেটে কাঁপুনি। ফোন বের করে একমিনিট থমকায় ও। রাগিনী ফোন করেছে? নিজে? কখনো করেনা তো! দরকার পড়লে অন্য কাউকে বলে যে ওকে ডেকে নেয়। বেশ অবাক হয়ে ফোনটা রিসিভ করে ও। আর সঙ্গে সঙ্গেই কানে আছড়ে পড়ে কয়েকটা শব্দ।

“এত দেরি একটা ফোন ধরতে? কতদূরে আছ? এখুনি রিসর্টে ফেরো।”

“আসছি আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে।” কোন প্রশ্ন না করে মোবাইল পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ায় রূপম। রাগিনী ডেকেছে মানে খুব কিছু একটা দরকার আছে নিশ্চই। কিন্তু ওর আওয়াজটা কেমন অন্যরকম শোনালো যেন! রূপমের চিন্তা হয় সামান্য। অল্পে অধীর হওয়ার মেয়ে সে নয় বলেই তো মনে হয়েছে।

“চলি গো ফটিকদা। আবার সামনের সপ্তাহে দেখা হবে।”

“তার আগেও হতে পারে। তোমাদের দিদিমনি আমাকেও ডেকেছেন গো …”

এ খবরটা নতুন রূপমের কাছে। বেশ অবাক লাগে ওর। এখানে কতকিছু ঘটছে, সারাদিন কাজ করেও তার অনেককিছুই অজানা ওর। “কোন দিদিমনি? বড় নাকি ছোট?”

“ছোট দিদিমনিই ডেকেছেন গো, অবিশ্যি বড়দিদিমনির নাম করে।”

ওহ, রাগিনী একবার বলেওনি রূপমকে। রাগ এসে যায় মনে। আবার মূহূর্তেই সেই রাগ উদাসীনতার জলে ঠান্ডাও হয়ে যায়। রাগিনী কিই বা বলে ওকে! কথাই বা ক’টা বলে ওর সঙ্গে! ফোনটাও নিজে না করে অন্যকে দিয়ে করায়। আজ নেহাত কিছু দরকার পড়েছে নিশ্চয়ই কিম্বা কাউকে পায়নি আশেপাশে। নাহ, কারুর ওপরেই আর রাগ অভিমান কিছুই নেই ওর। শুধু দিনগত জীবনক্ষয় করে যাওয়া মুখ বুজে।

বাইকে পা ঠেকিয়ে ঘাড় হেলায় রূপম, “আসি তাহলে। এলে দেখা করে নিও।”

ফটিক হাসিমুখে ঘাড় হেলিয়ে হাত তুলে গান ধরে, “দিনে রাতে শুনি ধ্বনি …তার চোখেতে মেঘ …তাকে ডাকি আমি পাগলপারা …খুঁজে না পাই শেষ …” ছুটন্ত মোটরবাইকের আওয়াজ ভেদ করে রূপমের কানে লেগে থাকে ফটিকের গানের রেশ।

বাইক এসে দাঁড়ায় রিসর্টের গেটের সামনে। বাঁশের খাঁচা জুড়ে মাধবীলতার ফুলে ভরা ঝাড় দুলছে শরীরে ঢেউ তুলে তুলে। ওল্টানো ইউ অক্ষরের মত প্রবেশপথটি ভারী সুন্দর। গেটের মাঝখান থেকে নুড়ি বেছানো রাস্তা একে বেঁকে চলে গিয়েছে ভেতরদিকে। ফুলের মাঝখান থেকে একটা পাটাতনের মত টাঙ্গানো রয়েছে গেটের মাথায়। সেখানে বড় বড় রঙ্গীন কাঠকুটো দিয়ে লেখা জাগরন রিসর্ট। দিনে তো বটেই, রাতের আলোয় যা অতি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। প্রথমদিন এই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রূপমের মনে হয়েছিল এই অদ্ভুত নামটা কেন? তারপর কয়েকদিন থাকতে থাকতে নিজেই নামের ব্যাখ্যা খুঁজে নিয়েছে। সেটা ঠিক বা ভুল যাই হোক, এখন মনে হয় এই জাগরন নামটাই সার্থক এখানে। অন্তঃত ওর ক্ষেত্রে তো তাই। সত্যিই রাতগুলো জেগে থাকার মত সুন্দর এখানে। কিন্তু সেকথা আলাদা। এখন সেই গেটের সামনে একখানা পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রূপম সত্যি অবাক হয়। ভেতরে ঢুকে বাইক স্ট্যান্ড করে অফিসের দিকে দৌড়ে যায় ও। তিনজন কনষ্টেবল দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। আশে পাশে রিসর্টের কর্মচারী দু’একজন ও দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে জটলা পাকিয়ে। কোনদিকে না তাকিয়ে রূপম ছুটে যায় রাগিনীর চেম্বারে। রাগিনী সেখানে নেই। পেছন ফিরেই দেখে তরুণ।

“রূপমদা, ওদিকে চল। রাগিনীদিদি তোমাকে ডাকছে।”

“ওদিকে কোথায়? পুলিশ কেন এসেছে রিসর্টে? কী হয়েছে?”

“ওই তো জলছবি কটেজে সবাই আছে। চল ওখানে …” তরুণ আগে আগে হাঁটে। ওর গলায় কোন গান নেই এখন।

খড়ে ছাওয়া, মাটির দেওয়াল, উঁচু মাটির দাওয়া, চালের ওপর ঝাঁপিয়ে লাউ লতার সবুজ সাম্রাজ্য, দাওয়ার চারপাশ দিয়ে গোলাপী সাদা সন্ধ্যামালতীর ছোট ছোট জঙ্গল। দেওয়ালগুলোতে সাদা, হলুদ, সবুজ নানা রঙ অপটু হাতের আলপনা। সব মিলিয়ে প্রত্যন্ত কোন গ্রাম থেকে একটুকরো শিল্পসম্মত কুঁড়েঘর যেন তুলে আনা হয়েছে। শুধু একটাই নয়, পুরো রিসর্ট জুড়ে আম কাঁঠাল পেয়ারার জড়ামড়ি জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে এই মেকশিফট ভিলেজ। এখানে ওখানে ছড়িয়ে র‍য়েছে ঘাট বাঁধানো ডোবা পুকুর। কটেজের ভেতরে আছে শহুরে সমস্ত বিলাসব্যসন। এসি, ফ্যান, লাইট, টিভি, ওয়াইফাই, আধুনিক স্নানাগার কোনকিছুর অভাব নেই। মোট দশখানা কটেজ এখানে, যা বছরের বেশিরভাগ সময়েই নাকি ভরা থাকে। এই প্রবল গ্রীষ্মেও শহরের তাপদগ্ধ প্রাণ বিলাসী মানুষের দল এখানে এসে গ্রামজীবনের স্বাদ নিয়ে ঠান্ডা হয়ে ফিরে যায়। বেশি ভীড় থাকে ছুটির দিনগুলোতে। আজ মঙ্গলবার। দু’ একটা কটেজ ফাঁকা আছে। মোটামুটি সাতখানা কটেজের কিছু মানুষ এবং রিসর্টের লোকজনেরা ভীড় করে আছে জলছবি কটেজের সামনে।

রূপম লম্বা পা ফেলে এসে দাঁড়ায় ভীড়ের পেছনে। উঁকি মারে ভেতরে। ঘরের ভেতরটা বাইরের চড়া রোদে কিছুটা আলোআঁধারি দেখাচ্ছে। খাটের ওপর উঠে তিনজন পুলিশের লোক ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ঝুলে থাকা একটি মহিলার শরীর ধরাধরি করে নামাচ্ছে। রূপমের মুখ দিয়ে কিছুটা আঁতকে ওঠার শব্দের সঙ্গে ছিটকে আসে আরো দু’টো শব্দ, “এ কী! মিঠি!”

সঙ্গে সঙ্গেই কেউ যেন এক হ্যাঁচকা টানে ওকে ভীড় থেকে অনেকটা দূরে আমগাছের তলায় নিয়ে আসে। রাগিনী এভাবে ওকে ধাক্কা দিতে পারে, এটাও একটা বড় আশ্চর্য রূপমের কাছে। কিছু বোঝার বা বলার আগেই বুকের একদম কাছে থেকে সাপের মত হিস হিস শব্দ ওঠে,

“এগুলো কি বলছো? কে মিঠি? তুমি চেন ওকে?”

“ওই তো …ঐ তো মিঠি …চিনতাম তো …কিন্তু কী করে হল এসব …ও কি আর বেঁচে নেই?”

“চুপ করো! আস্তে কথা বলো স্টুপিড …” আবারও রাগিনী ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলে হিস হিস করে,

“চেন তো বলনি কেন? আমায় বলতে পারনি? কেন বলনি আমাকে?”

“কি বলতাম? কাউকে চেনাটা বলার মত ঘটনা? তাছাড়া কালই দেখলাম যে ও এসেছে এখানে …” বিড় বিড় করে জবাব দেয় রূপম। মা ছাড়া আর কোন মৃতশরীর এত কাছে থেকে দেখেনি ও। তাছাড়া মিঠি কি সত্যিই মরে গেছে? এই রিসর্টে এসে কেনইবা মরতে গেল ও? এটা কি সত্যি সত্যি সেই মিঠি যার সঙ্গে বেশ অনেক মাইল রাস্তা হেঁটেছিল রূপম! নাকি এটা মিঠির মত দেখতে অন্য কেউ! মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম একটা অনুভব। মনে হচ্ছে শরীরটা হাল্কা হয়ে ও পড়ে যাবে গাছের তলায়।

“শোন, আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমার সঙ্গে ওর শুধুই চেনা নয়, কোন একটা সম্পর্কই ছিল। সব তুমি আমার কাছে গোপন করে গিয়েছো …” রাগিনী রীতিমত ভাঙ্গা গলায় বলে, যেন এখুনি কেঁদে ফেলবে ও। আর এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে মিঠি মরে গিয়েছে এমন একটা অবাক করা দৃশ্য থাকা সত্ত্বেও রূপম আবার অবাক হয় নতুন করে। রাগিনীর কাছে ও গোপন করে গিয়েছে? মিঠির সঙ্গে সম্পর্কের কথা? এসব কি বলছে রাগিনী? এই যে কয়েকমাস রূপম এই চাকরিটা নিয়েছে, এতদিনের মধ্যে ক’টা কথা হয়েছে ওর সাথে রাগিনীর? ও তো সবসময় রূপমের সঙ্গে কথা বলাটাই এড়িয়ে চলে। ওর সব খেয়াল রাখে কিন্তু কথা বলেনা। সেভাবে দেখতে গেলে রূপমের সবটাই তো রাগিনীর কাছে গোপন। এখন সেই নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছে! স্ট্রেঞ্জ!

“এখানে আসার পর থেকে তোমার সঙ্গে কথা হয়েছিল ওর?” রাগিনী নিজের ভাঙ্গা গলা সামলে নিয়ে আবার নিজের ফর্মে চলে এসেছে।

“না তো! ও তো জানেই না আমি এখানে আছি। কাল আমি ডেস্কে বসেই একঝলক দেখেছিলাম।”

“বেশ। ও যে তোমার চেনা তা কাউকে বলার দরকার নেই। একটাও বেফাঁস কথা বলবেনা। এখানেই থাকো সবার সঙ্গে।” কথা ক’টা বলে সামনে এগিয়ে যায় রাগিনী। ম্যাডাম বিপাশা চল্লিশ কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে এসেছেন হাঁফাতে হাঁফাতে। রিসর্টের ইতিহাসে এরকম ঘটনা এই প্রথম। ওনার দুশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। এসেই রাগিনীকে খুঁজছেন। রূপমেরও ডাক পড়ল বলে। পুলিশের কনষ্টেবল তিনজন বডি নামিয়ে খাটের ওপরেই রেখেছে। একজন বড়কর্তা সম্ভবতঃ আই, সি হবেন এসে ঢুকে গেলেন ঘরের ভেতর। রূপম পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে দরজার কাছে।

ওর মনে একটাই প্রশ্ন। মিঠি যে লোকটার সঙ্গে এসেছিল সে কোথায় গেল? কাল ওরা কটেজের দিকে চলে যাওয়ার পরে আর রূপম দেখেনি। দেখার কথা মনেও ছিলনা। হয়তো মিঠির কথা মনে হত। দেখার পর থেকে হচ্ছিলও। কিন্তু হাত থেকে মৌরীর কৌটো খুলে মেঝেতে ছড়িয়ে যাওয়ার পর আর মনে ছিলনা। সন্ধেবেলাও অন্যদিনের মত কাজকর্ম সেরে নিজেদের আড্ডা গল্প সেরে শুয়ে পড়েছিল সে। কাল অন্যান্যদিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়েছিল। সকালে দেরী করে উঠেছে ছুটির আমেজে। কেউ ওকে ডাকেওনি। ব্রেকফাষ্টের পর তো বেরিয়েই গিয়েছে। এপথ ওপথ ঘুরে হাটে গিয়ে হাটুরেদের সঙ্গে খানিকটা গল্পগাছা করে শেষে গিয়ে বটতলায় বসেছে ফটিকদার গান শুনতে। মিঠির কথা সত্যিই এরমধ্যে একবারও ওর মনে পড়েনি। শুধু ওর মৃত শরীর প্রথম দেখায় চমকে উঠেছে। কিন্তু রাগিনীই বা মিঠিকে ও চেনে শুনে এভাবে রিয়্যাক্ট করল কেন? রূপমকেই তো রাগিনী ভাল করে চেনেনা এখনো। কোনদিন কোন ঘনিষ্ঠ কথাবার্তাও হয়নি ওদের মধ্যে। তাহলে রূপমের জীবনে কে ছিল বা না ছিল তা নিয়ে রাগিনীরই বা মাথাব্যথা থাকবে কেন? চারদিকে কিসব ঘটছে! সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে ওর মাথায়। রূপম সামনে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে মিঠিকে। ও কি সত্যিই মারা গেছে? গলায় ওড়না দিয়ে ঝুলে পড়েছিল মিঠি। কেন? কি কারণে এই আত্মহত্যা? যে কোন একটা লোকের সঙ্গে রিসর্টে এসে রাত কাটানোর মত অবস্থায় পড়েও যখন ও আত্মহত্যা করেনি তাহলে একরাত্রের মধ্যে কী এমন ঘটল যে ওকে এভাবে মৃত্যুকে ডেকে আনতে হল?

এই প্রশ্নটা মাথায় আসতেই রূপমের মাথায় আরো বড় একটা প্রশ্ন জেগে ওঠে। কে বলতে পারে যে মিঠি আত্মহত্যাই করেছে? ওকে কেউ মার্ডার করে এভাবে ঝুলিয়ে রেখে যায়নি তো? যার সঙ্গে এসেছিল সেই লোকটাই বা কোথায় গেল? একই সঙ্গে একই কথা পুলিশের বড় কর্তাটির মাথাতেও এসেছে বোধহয়। তিনি বিপাশা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“দেখুন, বডি তো আমরা পোষ্টমর্টেমে পাঠাবই। এটা সুইসাইড না কি মার্ডার তা এখন বলা যাচ্ছেনা পি এম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত। তবে আমি একটু আপনাদের রেজিষ্টারগুলো দেখব। কার সঙ্গে ইনি এসেছিলেন ইত্যাদি…”

“হ্যাঁ, এই তো রূপম রয়েছে এখানে। আমাদের ম্যানেজার। ও আপনাদের হেল্প করবে …”

ম্যাডামের ইঙ্গিতে রূপম বড় সাহেবকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল রিসেপশনের দিকে। কয়েক পা যাওয়ার পর দেখে রাগিনী পেছন থেকে পা চালিয়ে ওদের ধরে নিল। বুঝল কিছু বেফাঁস যাতে না বলে ফেলে সেজন্য ও রূপমকে চোখে চোখে রাখতে চাইছে। কিন্তু কেন? রূপম মিঠিকে চেনে এটা যদি কেউ জেনেও যায় তাহলে কি হবে! রূপমের যদি কোন ক্ষতিও হয় তাতে ওর কী! রূপমের মাথায় প্রশ্ন পোকা কুটুস কুটুস কামড় দিয়েই যেতে থাকে। শরীরটা কেমন হাল্কা হাল্কা লাগছে। এখন ভর দুপুর। সকালের রূটি তরকারি কখন হজম হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারে ক্ষিদে পেয়েছে। সে একদম ক্ষিদে সহ্য করতে পারেনা। হয়তো খেতে বেশি দেরী হলে মাথা ঘুরে পড়েই যাবে। রাগিনী বলেছে স্বাভাবিক থাকতে। মাথায় জেগে ওঠা যাবতীয় অস্বাভাবিক ভাব জোর করে অগ্রাহ্য করে গেষ্ট এন্ট্রি রেজিষ্টারখানা খুলে আই সি সাহেবের দিকে এগিয়ে দেয় রূপম।

আজ মঙ্গলবার। গতকাল অর্থাৎ সোমবার লাঞ্চটাইমের কিছু পর, বেলা দুটো নাগাদ এন্ট্রি নিয়েছিল ওরা। ঘর বুক করা হয়েছে মোহনবাবু আগরওয়াল অ্যান্ড মোনালিসা মজুমদারের নামে। ফর ওয়ান ডে অনলি। অ্যাড্রেস …কলকাতা ওয়ান থার্টি সিক্স, নারায়নপুর। এজ …ফর্টিএইট অ্যান্ড থার্টি থ্রী। রিলেশন …ফ্রেন্ড।

ফর্মটা খুঁটিয়ে দেখে পুলিশ অফিসার ভ্রূকুটি করেন।

“ফর্টিএইট অ্যান্ড থার্টিথ্রী …ফ্রেন্ড? স্ট্রেঞ্জ!”

রূপমের মাথার মধ্যে উত্তর ভেসে যায়, বন্ধুত্বের কি কোন বয়স হয়? রূপমের বুকের ভেতর প্রশ্ন পোকা নড়ে চড়ে, মিঠি এই এত বড় বয়সের বেঢপ চেহারার লোকটার সঙ্গে কিসের আশায় বন্ধুত্ব করেছিলে? মরার জন্য?

রাগিনী ওকে বেফাঁস কথা বলতে না বলেছে। ও চুপ করে থাকে। ওর দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে রাগিনী এগিয়ে আসে সঠিক কথা নিয়ে,

“আসলে স্যর আমাদের এটা কাপল ফ্রেন্ডলি রিসর্ট। রিসেন্ট রায়টার পর তো আর …”

“হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে ঠিক আছে …তা এনারা কখন এলেন, কি কি খেলেন, কতক্ষণ রুমের বাইরে ছিলেন, রাত্রে কখন রুমে ঢুকলেন, সকালে চা খেলেন কিনা, লোকটিকে রাত্রে বা সকালে কখন শেষ দেখা গেল, কে তাকে দেখেছে …এই সমস্ত ডিটেইলস আমার চাই।”

“ইয়েস স্যর। আপনি যা যা বললেন তার একটা ডিটেইলড রিপোর্ট তৈরি করে আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

রাগিনী রূপমের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ চোখে তাকাতেই পুতুলের মত ঘাড় নেড়ে সায় দেয় ও,

“ইয়েস স্যার, আমি এখুনি সবটা দেখে রিপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছি।”

বেরিয়ে যাচ্ছিলেন পুলিশ অফিসার। ম্যাডাম বিপাশা এসে দাঁড়ান।

“স্যর, আপনি তো জানেন কতটা স্বচ্ছভাবে ব্যবসা করি আমরা। এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল, একটু দেখবেন স্যর। আমি …আমি …রিয়্যালী আয়্যাম সো শকড …”

একটু অপ্রস্তুত দেখায় পুলিশ অফিসারকে। এই মহিলার হাত বহু বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তা এখানে জয়েন করেই শুনেছেন তিনি। একটু চুপ করে থেকে বলেন, “দেখুন আগে তো পোষ্টমর্টেমটা হোক। এখুনি কিছুই বলা যাবেনা। তবে আনন্যাচারাল ডেথ তো, যা প্রসিডিওর আছে সবটাই করতে হবে। ইউ ডি কেস স্টার্ট, তারপর সুরতহাল ইত্যাদি।”

“সে কী! এখানে এখন ডেড বডি পড়ে থাকবে? অন্য গেষ্টরা আপত্তি করতে পারেন। তাছাড়া রিসর্টের বদনামও তো বটে …” আঁতকে ওঠেন ম্যাডাম বিপাসা। রূপমের মনে হয় মিঠির কি এমন কষ্ট ছিল যে, খামোখা এমন মিঠি থেকে বডি হয়ে যেতে হল ওকে! আগে তো ওকে দেখে কোনদিন মনে হয়নি এভাবে কষ্ট চেপে রাখতে পারে ও! যতদূর মনে পড়ছে শ্যামলাল ওর এই বোনটা সম্মন্ধে একটা কথাই বলত, বড় হাস্যমুখী মেয়ে। কিন্তু সেসব কতদিন আগের কথা! শ্যামলালকেও বা শেষ কবে দেখেছে রূপম!

রূপম বোধহয় থেকে থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। হয়তো এইজন্যই রাগিনীর কাছে আবার বকুনি খেতে হবে ওকে। ম্যাডাম আর আই সির কথার এইটুকু পরিসরেই অর্ডার দিয়ে রাগিনী সুন্দর কফিটেবল সাজিয়ে ফেলেছে রিসেপশনের ছোট্ট সিটিং এরিয়ায়। কফি, কাজুবাদাম, রিসর্টে বানানো কাঁচাগোল্লা, নোনতা বিস্কুট, কি নেই!

“স্যার, একটু গলা ভিজিয়ে নিন স্যার। প্লীজ …”

এই অফিসারটি নিজের কাজে বেশ মনোযোগী। কিন্তু অনেক পরিশ্রমের পর গরম কফির

আহ্বান ত্যাগ করা কঠিন। অভদ্রতাও বটে। কাপ হাতে নিয়ে তিনি বলেন, “নিয়ম যা কিছু তা তো করতেই হবে। তবে, এইটুকু করতে পারি, বডি আমি নিয়ে যাচ্ছি হাসপাতালে। ওখানেই সুরতহাল করিয়ে নেব।”

“ব্যস ব্যস … এনাফ …। আপাততঃ এটাই যথেষ্ট।” ম্যাডাম বিপাশা বলেন।

কফি পান শেষে বেরিয়ে যায় আই সি র গাড়ী। তার একটু পেছন পেছন মিঠিকে নিয়ে কনষ্টেবল তিনজন। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ীটাও চলে যায় বাকীদের নিয়ে।

রূপম রিপোর্ট তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু শেষ পয়েন্টে এসে ওর হাত থেমে যায়। কে শেষ দেখেছিল ওদের? সে তো মাত্র একবারই দেখেছে। এই বার জনে জনে জিজ্ঞেস করতে হবে। কেউ কি স্বীকার করবে? সকালে চা দিতে গিয়ে আরতিদি ডেকে ডেকে সাড়া পায়নি এটাই তো সবাই বলছে। অনেক বেলা পর্যন্ত আর কেউ ওদিকটায় যায়ওনি। এখানে যারা আসে অনেকেই কোনরকম ডিষ্টার্বেন্স পছন্দ করেনা। স্বামী স্ত্রী বা ফ্যামিলী হলে আলাদা কথা। এমনি যারা কাপল আসে তারা তো নিজেদের মধ্যে নিরিবিলি কাটাতেই আসে। তাদের কাছে খাওয়া দাওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওদেরও কেউ ডাকেনি আর। কিন্তু ব্রেকফাষ্টের সময় বহুক্ষণ পার হয়ে গেল তবুও ঘর খুললো না দেখেই ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। তারপর তো পুলিশে খবর দেওয়া হয় এবং পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে মিঠিকে ঝুলন্ত আবিষ্কার করে। তাহলে রাত্রের দিকে কে ওদের শেষ দেখেছে? লোকটি কখন বের হল রিসর্ট থেকে? সকালে নাকি রাত্রে? দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তার মানে লোকটি বেরিয়ে যাওয়ার পর মিঠি দরজা বন্ধ করেছে নিশ্চয়ই! তাহলে মার্ডারের থিওরী খাটেনা। কিন্তু এমন কি হতে পারেনা যে ওই লোকটি মিঠিকে মেরে দরজার বদলে জানলা দিয়ে বা পেছনে বাথরুমের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল? পুলিশ কি ওই দরজা জানলাগুলো দেখেছে ভাল করে?

রূপম হাফ রিপোর্ট তৈরী করে ভাবনার জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। ওর চারদিকে শুধু বড় বড় প্রশ্নের জটা জাল। ক্রমঃশ যা ওর চোখে চুলে জড়িয়ে যাচ্ছে, সামনের রাস্তা আটকে দিচ্ছে। কতক্ষণ এভাবে বসেছিল রূপম জানেনা। এখন আর ওর সেই হাল্কা ভাবটাও নেই শরীরের মধ্যে। কানে এসে ঢোকে ফিসফিস ডাক। তরুণ ওর ডেস্কের সামনে এসে ডাকছে ওকে।

“কি রে? কী হয়েছে?”

“রূপমদা, উনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিল …”

“উনি? কে উনি?”

“ওই যে গো, জলছবিতে যে মারা গেল আজ …” তরুণ প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে “কি? কি সব বলছিস?” প্রচণ্ড চমকায় রূপম। ওর ধারণা ছিল মিঠি ওকে দেখেইনি। তরুণ কি বলছে এসব?”

“হ্যাঁ গো। কাল ধরো এই রাত এগারোটা হবে। ওই মোটা লোকটা মদ খেয়ে বেহেড হয়ে ঘরেই বমি করে ফেলেছিল। ওই মেয়েটা তখন রিসেপশনে ফোন করে কাউকে পাঠাতে বলল। তুমি তখন রুমে চলে গিয়েছো। রাগিনীদিদি ফোন ধরে আমাকে যেতে বলেছিল।”

“এত সব কান্ড! আমাকে বলিসনি তো !”

“তোমাকে পাব কোথায়? সকালে উঠেই তো তুমি বেরিয়ে গেলে। তারপর এইসব কান্ড। তারপর শোননা …”

রূপমের প্রশ্নের অপেক্ষা না করে বলে যায় তরুণ, “আমি তো গেলাম। লোকটা ধ্যাপ হয়ে বসেছিল সোফায়। মেঝে পোস্কার করে আমি তো বেরিয়ে আসছি। ওই উনি আমার পেছন পেছন বারান্দায় এসে হাতে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে দিল।”

“আঃ, কিসের টুকরো? তুই নিলি কেন?”

“বাঃ নেবনা কি গো? সেই সঙ্গে দুশোটা টাকাও তো দিল। বলল কাগজটা তোমায় দিতে। আর বলল যে তুমি যেন একবার দেখা কর। উনি বারান্দায় বসে থাকবে।”

তরুণের কথা শুনে রূপমের পা দুটো কেঁপে ওঠে থরথর করে। মাথার ভেতরে কেমন একটা অস্থিরতা। তরুণের দুই কাঁধে হাত দিয়ে বলে, “তুই আমাকে কাল বলিসনি কেন কথাটা?”

“আরে তুমি তো ঘরে চলে গিয়েছো ততক্ষণে। আমি ডাকতেই যাচ্ছিলাম। তো রাগিনীদিদি এসে গেল মাঝখানে। আমাকে জিজ্ঞেস করল ওদিকে কেন যাচ্ছি …”

“তারপর?”

“তারপর আমি বললাম …”

“কি বললি?”

“বললাম যে উনি তোমায় ডেকেছেন। কাগজটাও দেখালাম …”

“উঃ …, কি লেখা ছিল সেই কাগজে?”

“আমি কিকরে জানব? আমি তো পড়িনি। রাগিনীদিদি পড়ল। তারপর আমায় বলল, আমি বলে দেব, তুই যা।”

তরুণকে ছেড়ে দিয়ে রূপম ধপ করে বসে পড়ে ওর চেয়ারে। মিঠি দেখা করতে চেয়েছিল ওর সঙ্গে? মিঠি দেখেছিল ওকে এখানে? কিন্তু কেন দেখা করতে চেয়েছিল? কী লিখেছিল কাগজে? রাগিনীই বা বলেনি কেন ওকে? সকালেও তো বলতে পারত! ওর সঙ্গে কথা হলে হয়তো মিঠি এভাবে চলে যেত না! রূপমের এতক্ষণের না খাওয়া স্টমাক এবার শোধ নিতে চায় সময় বুঝে। টক জলে ভরে ওঠে মুখ। উঠে পাশের বেসিনে গিয়ে নিজেকে অনেকটা খালি করে। ঘাড়ে মাথায় জল দেয় থাবড়া থাবড়া। ভীষন অসুস্থ লাগতে থাকে ওর। পেছন ফিরে ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে দেখে রাগিনী থালায় করে গরম রুটি আর মাংসের ঝোল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র চোখে রাগিনীর দিকে তাকায় রূপম। ভীষণ একটা অননুভূত রাগে কষ্টে মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে ওর। থালাটা সীটিং এরিয়ায় টেবিলে রেখে রাগিনী এগিয়ে আসে ওর সামনে। হাতটা ধরে ওকে চেয়ারের সামনে নিয়ে আসে।

“রাগ দুঃখ যা কিছু সব পরে করলেও চলবে। আগে এক্ষুনি কিছু খাওয়া দরকার।”

রাগিনীকে আসতে দেখেই তরুণ কেটে পড়েছে। রূপমের অসহ্য লাগছে সবকিছু। কেন রাগ কার ওপরে রাগ নিজেই জানেনা ও। শুধু মনে হচ্ছে যদি দেখা হত কাল মিঠির সঙ্গে তাহলে হয়তো আজ মিঠি বডি হয়ে যেতোনা। হয়তো বেঁচে থাকত ও। মাঝখানের ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া বছরগুলো সব মুছে গিয়ে শুধু সেই হাত ধরে ধরে হেঁটে বেড়ানো সময়টা ঝলকে ঝলকে বুকের মধ্যে তাজা রক্তের স্রোত বওয়াতে শুরু করে। তীব্র দৃষ্টিতে রাগিনীর দিকে তাকিয়ে দু’পা পিছিয়ে এসে খাবারের থালাটা নিয়ে মেঝের ওপর ছুঁড়ে মারে রূপম। মেঝেময় মাংসের ঝোল আর রুটি ছড়িয়ে পড়ে থাকে।

রিসেপশনে কেউ ছিলনা সেই মূহূর্তে ও আর রাগিনী ছাড়া। এতক্ষণ বিপাশা ম্যাডামও ছিলেন না। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জলছবি কটেজ স্যানিটাইজ করাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক এই সময়টাতেই পা রাখেন রিসেপশনের দরজায়। আঁতকে ওঠেন সঙ্গে সঙ্গেই, “এ কী! হোয়াট ইজ দিস? এখানে খাবার কে আনল? সেটা মাটিতে পড়লই বা কী করে? রূপম?”

“আমার হাত থেকে পড়ে গিয়েছে ম্যাডাম। আমি খেতে খেতে উঠে এসেছিলাম একটা কাগজ নেওয়ার জন্য। আমি এখুনি সাফ করিয়ে দিচ্ছি।” রূপম কিছু বলার আগেই রাগিনী কথাগুলো বলে এগিয়ে যায় তরুণকে ডাকতে ডাকতে। রূপম প্রথম ঝোঁকে ভাবে যে বলে দেবে সত্যি কথাটা। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে। রগিনীকেও মিথ্যেবাদী প্রমাণ করাটা ওর প্রতি অন্যায় হবে। রূপমের চাকরিটা না থাকলে খুব কিছু যায় আসেনা। কিন্তু রাগিনীর ফ্যামিলীতে এই চাকরিটা খুব দরকার, এটা ওর জানা আছে তরুণের কল্যাণে। দপদপ করতে থাকা মাথা নিয়ে এসে নিজের ঘরে তক্তার ওপর শুয়ে পড়ে রূপম।




তেলরং নামের কটেজটা একদম কোণার দিকে। ওটার পরেই একটা মাঝারী মাপের পুকুর। তেলরং এর সেজন্য ডিমান্ড আলাদা। পুকুরপাড়ে অজস্র গাছপালা থাকার জন্য প্রকৃতি প্রেমিক লোকজনের ভীড় লেগেই থাকে। আজ সকালে একটা হানিমুনিং কাপল এসে উঠেছে। মেয়েটির একমাথা সিঁদুর দেখেই বোঝা যাবে বিয়ের বয়স খুব বেশী হলে দশ দিন। ছেলেটা, মেয়েটা এখনো কয়েনের দু’পিঠের মত লেপটে আছে এ ওর সঙ্গে। দুপুরবেলা এই সমস্ত কান্ড কারখানা দেখে ছেলেটা বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। দুদিনের বুকিং ক্যান্সেল করে ফিরে যেতে চাইছে। রূপম সেই যে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে এখনো বের হয়নি। ম্যাডাম ফিরে যাওয়ার আগে বারকয়েক ওর খোঁজ করছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে বেশ টেনশনে আছেন তিনি। রাগিনী সামলে রেখেছে ওনাকে। সে এই মহিলাকে ছোটবেলা থেকে চেনে। জানে যে ইচ্ছে হলেই দুম করে তিনি এই ব্যবসা বন্ধ করে চলে যেতে পারেন, ঠিক যেমন কয়েকঘন্টার নোটিসে পনেরো বছরের সংসার, স্বামী সব ছেড়ে চলে এসে এই রিসর্ট খুলেছেন। রাগিনীর মা ম্যাডামের বাড়ীর কুক ছিল। মায়ের সঙ্গে ওবাড়ীতে শিশুকাল থেকে আসা যাওয়া রাগিনীর। নিজের চেষ্টায় সে গ্রাজুয়েশন, পোষ্ট গ্রাজুয়েশন করেছে। কিন্তু ইতিহাসের এম এ এই বাজারে সহজে চাকরি পায়না। রিসর্টের চাকরিটা হয়েছে প্রায় বিপাশারই দয়ায় বলতে গেলে। বিছানায় পড়ে থাকা মায়ের দেখাশোনা এই দিয়েই চলে যায়। রাগিনী সাধ্যমত চেষ্টা করে সেই ঋণ চোকাতে। নিজের কাজ বলে একে একে সবটুকু দায়িত্বই নিজের মাথায় টেনে নিয়েছে। এখন ম্যাডাম যাওয়ার সময় খুব বেশী চিন্তা করছিল দেখে সে নিজেই বলে রেখেছে যে রূপম একটু রেষ্ট করে কাজে এলেই আগে রিপোর্টটা তৈরি করিয়ে থানায় পাঠিয়ে দেবে।

“দেখো যদি পি এম টা নর্মাল ডেথ দেখানো যায়। দরকার হলে ডক্টরকে কন্টাক্ট কর।” ম্যাডাম পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিল। রাগিনী জানে এটা খুবই শক্ত কাজ। সব মানুষের টাকার লোভ থাকেনা। একটা আত্মহত্যা বা মার্ডারকে নর্মাল ডেথ বলে চালাতে পারলে রিসর্ট বদনাম হওয়া থেকে বেঁচে যাবে ঠিকই কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার লোক খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল। ডাক্তারকে কে রাজী করাবে? মনে যাই ভাবুক মুখে ম্যাডামকে নিশ্চিন্ত করেই পাঠিয়েছে নানারকম বলে। রূপম এলেই একবার কথা বলতে পাঠাবে ভরসা দিয়েছে। কিন্তু রূপমের এখনো দেখা নেই। মনের মধ্যে তীব্র অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকে রাগিনী।

এরমধ্যে আবার এসে জুটেছে তেলরং কটেজের কাপলটি। ওদের এক কথা। বুকিং অ্যামাউন্টের অর্ধেক ফেরত দেওয়া হোক, ওরা চলে যাবে। এই অবস্থায় এদের যেতে দেওয়া মানে রিসর্টকে আরো বেশি বেশি বদনামের সামনে ঠেলে দেওয়া। রাগিনী মিষ্টি হেসে বলে, “দেখুন যা ঘটেছে তাতে তো রিসর্টের কোন হাত নেই। আপনাদের আমি একটাই অনুরোধ করব যে, যা ঘটেছে সেটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আপনারা নিজের নিজের মত এনজয় করলেই আমরা খুশি। ফিরে যাওয়া তো রইলই। আমি শুধু বলব একটা রাত্রি এখানে থেকে যান। কথা দিচ্ছি আপনাদের আনন্দের জন্য আমরা প্রয়োজনে অনেক দূর অবধি যাব।” রাগিনীর কথায় ছেলেটার বিশেষ হেলদোল হয়না। শুধু বউটি যেন অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছে এইভাবে বরকে খোঁচাতে থাকে আজকেই এখান থেকে চলে যাওয়ার কথাটা তুলে নেওয়ার জন্য ।

“চল আজকের রাতটা থেকেই যাই। ওনারা তো বলছেন বিশেষ কিছু অ্যারেঞ্জমেন্ট করবেন …”

“না না আমাদের কটেজ থেকে কয়েক পা গেলেই ওই জলছবি না কি যেন কটেজটা। ওখানে এই কান্ড ঘটে গেল। সারাক্ষণ মন পড়ে থাকছে ওদিকে। এভাবে বেড়ানো হয়না।” ছেলেটা সেই এক গোমড়া মুখে মাথা নেড়ে যেতে থাকে দুদিকে। আশ্চর্য! একটা মিসহ্যাপ হয়ে গিয়েছে ঠিক কথা। তাই বলে এদের দু’জনের মন সেইদিকেই পড়ে থাকবে, নিজেদের আর কোন এনগেজমেন্ট থাকবে না! রাগিনী বিরক্ত হয় মনে মনে। মানুষ বিয়ে কেন করে সেটাই বোঝেনা ও। বিয়ে মানেই তো চব্বিশ ঘন্টা একজন আরেকজনের সঙ্গে বেঁধে থাকা। সেটার জন্য তো কিছুটা অন্তঃত পারস্পরিক আকর্ষণ থাকা দরকার। তা না থাকলে বিয়ে করার তো দরকার নেই কোন। আর নিজেদের মধ্যে আকর্ষণ থাকলে সারাক্ষণ বাইরের দিকে মন পড়েই বা থাকবে কেন! সেক্সের জন্য তো বিয়ের প্রয়োজন নেই আজ আর। পয়সা ফেললেই এরকম হাজারটা কাপল ফ্রেন্ডলি আস্তানা পাওয়া যাবে। ও যদি কখনো বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আগে দেখে নেবে হবু বরটির সঙ্গে ওর একান্তে সময় কাটাতে কতটা ভাল লাগছে।

নিজের বিয়ের কথা মনে আসতেই রাগিনীর চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যায় একখানা উদাসী মুখ, বড় বড় দুটো ভাসা চোখ, যে চোখ যেন সবসময়েই অনেকদূরের কোন আকাশের দিকে তাকিয়ে সারাক্ষণ খুঁজে চলেছে এক অজানা বাতিঘর। এলোমেলো চুলে ভরা মাথা নিয়ে সেই মানুষটা সবকিছুর প্রতি এক অসীম নৈরাশ্যে ডুবে থেকে প্রতিদিনের কাজটুকু করে যায় শুধু, যেন বাঁচলেও হয় না বাঁচলেও হয়। সেই মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কী তোমার এত খোঁজ? কোথায় পৌঁছাতে চাও তুমি? আমায় সঙ্গে নেবে? আমি তোমায় আঁচলভরে কাঁঠালিচাঁপা এনে দেব। বলতে ইচ্ছে হয় আরো অনেক কথা, যে কথাগুলো হয়তো জীবনে কোনদিন মুখে উচ্চারণ করতে পারবেনা রাগিনী, তার আগেই ও চলে যাবে এই দায় দায়িত্বে ভরা জীবনটা ছেড়ে।

মেয়েটা সমানে তার বরকে বুঝিয়েই চলেছে। বর এতক্ষণে নিমরাজি হয়েছে। নিজের চিন্তা ছেড়ে রাগিনী সামনে মন দেয়। দেখতে পাচ্ছে গেটের ভেতর আরো একটা গাড়ী ঢুকে পড়ল। হৈ হৈ করে পাঁচ সাত জন নেমেও পড়েছে। এখুনি এদিকেই আসবে। এরা একটা বড় গ্রূপ। তিনখানা রুম বুক করা আছে। এরকম সময়ে রূপম গিয়ে ঘরে পড়ে রইল। খাবার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, অতটা মেজাজ দেখান এসবের পরেও রাগিনী বলেই এসে ওর ডেস্ক সামলাচ্ছে। অথচ এইসব লোকজন সামলানো ওর কাজ। রাগিনী কেন যে রূপমের ডিউটিটা করতে এসেছে ভেবে নিজের ওপরেই রেগে যায়। সামনে তাকিয়ে থেকে ডেস্কের ভেতরে ও রূপমের ঘরের ইন্টারকমে রিং করে কয়েকবার। ধরছেই না। উফফ! আচ্ছা ছেলে যাহোক।

“বলুননা সন্ধেবেলায় কী প্রোগ্রাম থাকবে?” সামনের বৌটি না জেনে ছাড়বেই না। কিছু একটা না বললে একে থামানো যাবেনা। রাগিনী চট করে মাথা খাটিয়ে বলে, “লোকগীতির আসর আছে স্থানীয় শিল্পীর। আপনাদের খুব ভাল লাগবে।”

এবার ছেলেটির মধ্যে ম্যাজিকাল পরিবর্তন ঘটে। এতক্ষণের বিরক্তি মূহূর্তে ভ্যানিশ। ডেস্কের সামনে এগিয়ে এসে হাসিমুখে জানতে চায়, “লোকগীতি? আরিব্বাশ! দারুণ ব্যাপার তো! আই লাভ লোকগীতি। ওকে! আমরা থেকে যাচ্ছি। দুটো কফি পাঠান প্লীজ …”

মাত্র একটা শব্দ মানুষটাকে আমূল পালটে দিল। বউ এর কোমড় জড়িয়ে হেলেদুলে চলে যাচ্ছে সে। সেদিকে তাকিয়ে রাগিনী নেক্সট চিন্তায় ঢুকে পড়ে। বুকিং তো থাকল। কিন্তু এখন শিল্পী পাওয়া যাবে কোথায়! ওদিকে গাড়ী থেকে নেমে বড় গ্রূপটা হৈ হৈ করে এসে পড়ল বলে। জোরে জোরে ঘন্টা বাজিয়ে দিনুদাকে ডাকে ও। বুড়ো দিনুদা এখনো দৌড়ে অনেক পুঁচকেকে হার মানাবে। কোথায় ছিল সে কে জানে, ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ায়, “কী বলছো? কী করব?”

“কিছু না, শুধু এক্ষুনি রূপমকে ডেকে আন। নিজের ঘরে আছে, ঘুমোলে টেনে তুলে আনবে।”

দিনুদা এখানে প্রথম থেকে রয়েছে। রিসর্টের গোড়াপত্তন বলতে গেলে তার হাত ধরে। ম্যাডামের বাবার খাস কাজের লোক ছিল দীনুদা। এখন ম্যাডামের লোক। হেডমালী কাম পিওন। এই হল দীনুদার পোষ্ট। আরেকটা অলিখিত পোষ্ট আছে যেটা রাগিনী অনুভব করে। দীনুদা সকলের সেলফ অ্যাপয়েন্টেড গার্জেন। সে কাল ছিলনা, আজও এল খানিক আগে। মেয়ের বাড়ী গিয়েছিল পাশের গ্রামে। যখন ফিরল তখন সকাল দুপুরের ঝামেলা সব প্রায় নিভে গেছে। শুধু মন খারাপের নিভু নিভু আঁচটা ছড়িয়ে আছে সবখানে। দীনুদা এদিক ওদিক থেকে হয়তো শুনেছে। একটাও কথা বলেনি কাউকে। এসেই মাটি রঙ ঢোলা বারমুডা পরে হাসনুহানার গোড়া খুঁড়তে লেগে পড়েছিল। তারপরেও ঘাস কুটো আগাছা পরিস্কার এটা ওটা কাজ তার লেগেই থাকে। এই যে ঘন্টা শুনে ছুটে এল এটাও দীনুদা খুব সিরিয়াসলি করে। পিওন হিসেবে সে বেশি ভালো নাকি মালী হিসেবে, এই প্রশ্নটা মাঝে মাঝে রাগিনীর মনে জাগে। রূপমের ঘরের দিকে ছুটন্ত দীনুদাকে পেছন থেকে দেখতে দেখতে আরো একবার জাগল।

ছেলে মেয়েগুলো হৈ হৈ করে ঢুকে পড়েছে রিসেপশনে। রূপম আসতে কতক্ষণ নেবে কে জানে। রাগিনী রেজিষ্টার বের করে এগিয়ে দেয় একজনের দিকে।

“শুনেছি এখানে কটেজগুলোর নাম ভারী সুন্দর। আমাদের গুলোর নাম কী?” একজন মহিলা জিজ্ঞেস করে রাগিনীর দিকে তাকিয়ে।

রাগিনী হাসে, “নবপত্রিকা, সবুজকনিকা আর সুবাতাস। আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে।”

“উফফ …কী দুর্দান্ত! এই আশীষ, আমি কিন্তু সবুজকনিকা নেব আগেই বলে দিচ্ছি।” মহিলা হাততালি দিয়ে ওঠে।

“আমি নবপত্রিকা …” কোণের দিকে দাঁড়ানো লম্বা চুল ছেলেটি বলে। তার পিঠে স্প্যানিশ গীটার। গায়ে অজস্র তাপ্পিমারা আধুনিক বাউলাকৃতি কুর্তা আর ছেঁড়া জিন্স।

“কিন্তু নামের মতই কটেজগুলোর ভেতরটাও সুন্দর তো?” দলের অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষটি বলেন। রূপম ঢুকছিল। পেছনে দীনুদা।

রাগিনী হাসে, একগোছা চাবি এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই তো রূপম, তুমি এসে গিয়েছো? ওনাদের কটেজগুলো একবার দেখিয়ে দিয়ে আমার অফিসে এস।” যেন ঠিক এই জন্যই রূপমকে ডাকছিল ও। এমনই সহজ ভঙ্গীতে কথাগুলো বলে রূপমের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে নিজের অফিসের দিকে চলে যায় রাগিনী।




রূপম দেখেশুনে রিপোর্ট তৈরি করে পাঠিয়ে দিয়েছে থানায়। শেষ কখন কে দেখেছিল মিঠিকে এই পয়েন্টে এসে থেমে গিয়েছিল ও। যদি তরুণ ওকে কাগজটা দিত ঘরে এসে তাহলে এই শেষ নামটা ওর নিজেরই হত। কিন্তু তা হয়নি। আর রাগিনী? এই মেয়েটাও রূপমকে একটা বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কেন রাগিনী ওকে একবারও বলল না যে মিঠি দেখা করতে চেয়েছে? যত রাতই হোক রাগিনী তো একটা ফোন করেও জানাতে পারত! কাজের ব্যাপারে তো কতসময় মাঝরাত্রেও ডেকে তুলে ফোন করে। একবার এক গেষ্ট এর জন্য ইলিশ মাছের অর্ডার ছিল। ওকে রাত সাড়ে বারোটায় ফোন করে সেটা মনে করিয়ে দিয়েছিল যেন পরদিন ভোরে অবশ্যই যেখান থেকেই হোক ইলিশ আনানো হয়। আরো কত সময় কত কাজে রাগিনী ফোন করেছে ওকে। শুধু এই কথাটাই বলল না। মিঠির সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল তরুণের। সেটাই বলেছে রিপোর্টে। আর ওই লোকটা! সে কখন চলে গেল রিসর্ট ছেড়ে! কেউ জানেনা। ওর গাড়ীটাও তো নেই। তাহলে অতবড় একটা গাড়ী চালিয়ে একটা লোক রিসর্ট থেকে চলে গেল কেউ দেখল না! এটা হয় নাকি! রূপমের মনে হয় দারোয়ান নিশ্চই দেখেছে। নিশ্চই লোকটা দারোয়ানকে টাকা দিয়েছে কিছু, মুখ বন্ধ রাখতে বলেছে। তারপর এতসব কান্ড দেখে দারোয়ান আর ভয়ে মুখ খুলছেনা। সবটা ভাবলেই রূপমের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। অজস্র প্রশ্নের একটারও উত্তর নেই। সামনে যেন একটা কঠিন প্রশ্নপত্র যেটা নিয়ে পরীক্ষার হলে বসে কলম কামড়াচ্ছে রূপম। দাঁড়িয়ে ফেল করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

“রূপমদা …” তরুণ কখন এসে ঢুকেছে। কানের কাছে ফিসফিসানি শুনে মাথা তোলে রূপম। অন্যসময় হলে গান শুনেই টের পাওয়া যায় তরুণ আসছে। কাল থেকে বেচারীর গান বন্ধ হয়ে গেছে।

“কী রে! কেউ নেই তো এখানে, ফিস ফিস করছিস কেন?”

“রূপমদা, ওই পুকুরধারে একবার চল মাইরি …”

“কেন? পুকুরধারে আমার কাজ নাকি? আমি কেন যাব?”

“আঃ চলই না একবার। ওই যে তিনটে কটেজ বুক করেছে …ওরা এলো না একটু আগে? ওই যে গো সবুজকনিকা …”

“হ্যাঁ বুঝেছি। কী হয়েছে ওদের?”

“একটা মেয়ে মাইরী পুকুরে নেমেছে সাঁতার কাটতে। কী ফিগার মাইরি! একা দেখে সুখ হয় বল? উফফফ…আমি একটু দেখেই চলে এলাম তোমাকে ডাকতে …।”

রূপম গম্ভীর হয়, সত্যি কত তাড়াতাড়ি আজকাল মানুষ সব ভুলে যায়! এই লোকটা কাল ভয়ে হাঁ করছিলনা। আর আজ মেয়ে দেখবে বলে সঙ্গী ডাকতে এসেছে।

“আরে কি হল? আবার কি ভাবতে শুরু করলে! চলো…”

“তরুণ, তোর বয়স কত? আমার থেকে কত বড় তুই জানিস?”

তরুণ মাথা চুলকায়, “কত আর বড় হব! এই বছর দশেক …তাতে কি?”

“তোর লজ্জা লাগেনা একটা কচি ছেলের মাথা খেতে? যা পালা …”

“তোমার মাথাটাই আছে কিনা আমার সন্দ হয় মাঝে মাঝে। এই ঝোপে জঙ্গলে এসে পড়ে আছ কলকাতা ছেড়ে …। ঠিক তো? যাবেনা তো?”

“না যাব না। মেয়ে দেখতে আমার ভাল লাগেনা। তার থেকে গাছ অনেক সুন্দর।”

“হ্যাঁ দীনুদাও তাই মনে করে। তাই গাছের পেছনে লেগে থেকে নিজেকে বিপদে ফেলে দেয় মাঝে মাঝেই।” বলতে বলতে রাগিনী এসে ঢোকে ঝড়ের বেগে। চমকে ওঠে রূপম আর তরুণ।

“দীনুদার কি হল আবার? এই তো ছিল একটু আগে” রূপম বলে …

“আরে যত ঝামেলা তো একসঙ্গেই হবে, সেটাই নিয়ম। দীনুদাকে আটকে রেখেছে বিডিও অফিসে। রূপম যাও শিগগীর। ওদের বুঝিয়ে বলে ছাড়িয়ে আন দীনুদাকে। আমি তো বেরোতে পারছিনা রিসর্ট থেকে, এতগুলো গেষ্ট।” রাগিনী বলে যায় হুড় হুড় করে। একটাও কথা না বাড়িয়ে রূপম বাইকের দিকে এগোচ্ছিল। ও অবাক হয়নি। দীনুদাকে মাসের মধ্যে তিন থেকে চারবার ছাড়িয়ে আনতে হয় এখান সেখান থেকে। মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নিজের ইচ্ছেমত কাজ করে বসে দীনুদা যার ফলে সেই লোকগুলো রেগে যায় ওর ওপর। রিসর্টে খবর আসে যথারীতি। রূপম বা রাগিনী গিয়ে সেখান থেকে ছাড়িয়েও আনে। রূপম বাইকের কাছে এসে গেছে, এবার বসবে, পেছন থেকে ডাকে রাগিনী,

“আর হ্যাঁ শোন, তোমার কাছে ফটিকচাঁদের নম্বরটা আছে না?”

“আছে।”

“তাকে একবার আসতে বলো সন্ধাবেলায়। আমি ডেকেছি বললেই বুঝবে গতকাল ভেবেছিলাম ওকে ডাকব, সেটা তো হলনা। লোকগীতির লোভে ঐ কাপলটা লাঞ্চ অব্ধি থেকে চেক আউট করবে জানিয়েছে।”

কাদের কথা বলছে জানে রূপম। জলছবির পাশের কটেজের কাপল। কাল শেষ পর্যন্ত আর কাউকে না পেয়ে ওই ছেলেটাই রাত্রিবেলায় ফায়ারপ্লেসের সামনে স্পীকার আর ঢোলক নিয়ে নিজেই আসর বসিয়েছিল। তরুণ তো এইসব আসরের ফ্রী গায়ক।

রূপম বাইক ছোটায় বিডিও অফিসের দিকে। কাল থেকে একবারের জন্যও ওর মাথাটা ফাঁকা গেলনা। এখন এই যে বিডিও অফিস যাচ্ছে, মাথায় ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে আরো একঝুড়ি প্রশ্ন। আজ আবার কী করল দীনুদা? ক’দিন আগে পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ীর পেছনের মোজেইক বারান্দায়, সামনের এক পানাপুকুরের পানা তুলে ঢেলে ঢেলে সবুজ করে দিয়েছিল। প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। তারপর বাড়ীর কাজের মেয়ে দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করে দীনুদাকে কাঠগড়ায় খাড়া করল। ওপর থেকে চটি ফটফট করে নেমে এলেন প্রধান মশাই। এত জায়গা থাকতে এই বাড়ীর বারান্দা কেন নোংরা করতে এল, এই প্রশ্নের উত্তরে দীনুদার সাফ জবাব ছিল, নোংরা নয়, সে বারান্দাটা পরিস্কারই করেছে। কেমন সুন্দর সবুজ দেখাচ্ছে সবটা! সেবার রাগিনী এসেছিল প্রধানের বাড়ীতে দীনুদাকে ছাড়াতে। কিভাবে কি বলে শেষ পর্যন্ত ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল দীনুদাকে রূপম জানেনা। শুনে থাকলেও এখন আর মনে নেই। তবে এটা অনুমান করতে পারে যে প্রধানের মন গলাতে রাগিনীকে অনেক পাঁপড় বেলতে হয়েছে। আজ আবার সে কি ঘটাল কে জানে।

বিডিও অফিসের হাতায় বাইক থামাতেই চার পাঁচজন স্টাফ একসঙ্গে হৈ হৈ করে ওঠে। একজন বলে ,“এই তো জাগরনের দাদা এসে গেছে, এই পোকাশ যা সাহেবকে খবর দে …”

“আরে দাদা ভেতরে চলুন, সাহেব আপনার জন্যই বসে আছেন …” সম্ভবতঃ পোকাশ নামের লোকটিই উত্তর দেয়।

রূপম এদিক ওদিক তাকায়। নাহ, কোথাও তো দেখা যাচ্ছেনা দীনুদাকে। ও এগোতে থাকে বিডিওর চেম্বারের দিকে। পেছনে একটা ছোটখাট দল। এরা সবাই এই অফিসেরই স্টাফ এবং নানা কাজে আসা লোকজন। মোটামুটি মুখ চেনা আছে কয়েকজনের। একজনের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় ও, “কি হয়েছেটা কি? আজ আবার কি ঘটাল দীনুদা …”

“আরে দাদা আমাদের কিচ্ছু বলা বারণ আছে। সাহেব বলেই রেখেছেন আপনাদের কেউ এলেই যেন সোজা ওনার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই তো …, যান সোজা ভেতরে চলে যান …” লোকটি হেসে হেসে মজা দেখা মুখ করে উত্তর দিয়ে চেম্বারের মুখ অবধি পৌঁছে দেয় ওকে।

নতুন বিডিও এসেছেন। জানত না রূপম। আগেরজনকে চেনা ছিল কিছুটা। ইনি একেবারেই নতুন। তোলা হাঁড়ির মত মুখ মানুষটির। বয়স ওরই মত হবে কিন্তু এইসব সরকারী চেয়ারে বসলে বোধহয় অকারণ হাঁড়ি টাইপ করেই রাখতে হয় মুখ। কে জানে, হবেও বা। এত এত গম্ভীর মানুষের সামনে রূপম কেমন নার্ভাস হয়ে যায়, অথবা হঠাত হঠাত ওর ফ্যাক ফ্যাক করে হাসি পেয়ে যায়। এখন কে জানে কেন দ্বিতীয়টা হচ্ছে। নিজেকে জোর করে গম্ভীর রেখে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,

“আসব স্যর?”

“অবশ্যই আসবেন। আসতে তো আপনাকে হবেই …আসুন, বসুন”

“মানে! স্যর আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা …” রূপম চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে।

“আপনি তো এই এলেন। এতক্ষণ ধরে আমিই কি কিছু বুঝতে পেরেছি? এই নরেন, কৈবর্ত … নিয়ে এস লোকটিকে।”

নিশ্চই দীনুদাকে আনার আদেশ হল। রূপম অপেক্ষা করে দীনুদার নতুন নাটক দেখার জন্য।

কিছু পরে ওর অনুমান সত্যি প্রমান করে নরেন এবং কৈবর্ত নামের লোকদুটি দুই হাত ধরে ধরে দীনুদাকে নিয়ে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। রূপম তাকিয়ে দেখে নেয় দীনুদাকে এরা কোন মারধোর করেছে কিনা। নাহ সেরকম কোন চিহ্ন নেই শরীরে। সে দিব্যি তার চিরকালীন মাটিরং ঢোলা বারমুডা আর ডবল সাইজ আধাময়লা গেঞ্জি পরে হাতে খুরপি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে দুশ্চিন্তা বা অপরাধ করে ধরা পড়ার কোন ছাপ নেই। শুধু রূপমকে দেখে একগাল হেসে জানান দেয় যে মাথাটা তার নতুন করে কিছু বিগড়োয়নি।

“ইনিই তো দীনু ঘোষাল? আপনাদের জাগরন রিসর্টের মালী কাম পিওন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যর। কিন্তু কি করেছেন ইনি? আমাদের জরুরী তলব দেওয়া হল আপনার অফিস থেকে …, কি ব্যাপারটা ঠিক…আমি তো…”

“ওনাকেই জিজ্ঞেস করুন। দেখুন উনি কী বলেন।”

“কি গো? দীনুদা কী করেছো? কী বলছেন সাহেব?

“কই কিছুই তো করিনি? কী বলছে এরা সবাই? আমার কি এত সময় আছে? চল রেসটে ফিরে চল। মাধবীলতার জল খাওয়ার টাইম হয়েছে।” ভীষন সিরিয়াস মুখে বলে দীনুদা। এতক্ষণ অফিসে আটকা থাকায় বেশ বিরক্ত।

“স্যর, উনি তো কিছুই বলছেন না। আপনিই বলুন নাহয় …”

“এই তো, এটাই ওনার স্ট্র্যাটেজি। কোন কিছু প্রশ্ন করলেই এমন ভাব করছেন যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না বুঝতে পারছেন না। অথচ নিজের যা মনে হচ্ছে তাই বলছেন, বলে যাচ্ছেন।” বিডিওসাহেব বেশ রয়ে বসে বলে যান। রূপমের মনে হয় এই ব্যাপারটা ছাড়া ওনার এতবড় ব্লকে আজকের মত আর কোন কাজই নেই। বারান্দায় ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা অতগুলো মানুষের হয়তো কত নানারকম দরকার আছে। তারা বুঝতেই পারছেনা আজ আর তাদের কাজটা আদৌ হবে কিনা। কী অদ্ভুত এই সিস্টেম। যদি দীনুদা কোন অন্যায় করেই থাকে তো সোজাসুজি বলা হোক সেটা। নাহলে তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন ভেবে ছেড়ে দেওয়া হোক। নাহলে রিসর্ট ম্যানেজমেন্টকেই কিছু সাবধানবানী দিয়ে আজকের মত ছেড়ে দেওয়া হোক দীনুদাকে। তা না সবাই মিলে যেন নাটক দেখে যাচ্ছে সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে। ভীষন বিরক্ত লাগে রূপমের। ও জানেনা রাগিনী হলে কিভাবে এই সিচুয়েশনটা ম্যানেজ করত। ওর তো ইচ্ছে করছে উঠে দাঁড়িয়ে দীনুদার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বাইকে স্টার্ট দিতে।

হয়তো রূপমের মুখের ভাবে মনের বিরক্তিটা কিছুটা ধরা পড়েছিল। এবার বিডিও সাহেব কিছুটা নড়ে চড়ে বসেন। কেন কে জানে নিজের মুখে ঘটনাটা খুলে বলতে ওনার বড্ড আপত্তি। এবার নিজের স্টাফের দিকে তাকিয়ে বলেন, “কৈবর্ত, বল তো কি করেছে এই লোকটা …, কেন এত রেগে গেলাম আমি …বল ওনাকে সবটা …”

কৈবর্ত বলল। চিবিয়ে চিবিয়ে অনেকটা সময় নিয়ে অ্যাঁ ও করে করে বলল দীনুদার অপরাধ।

এখন হল ভালবাসাবাসির যুগ। গ্রাম শহর পাড়া জেলা নদ নদী নর্দমা খাল বিল সবকিছুকেই শুধু ভালবাসাই যথেষ্ট নয়, সেই ভালবাসার সোচ্চার প্রদর্শন এখন লেটেষ্ট যাচ্ছে সবজায়গায়। তা, এই নতুন বিডিওসাহেব জয়েন করে একটা চমৎকার আইডিয়া এনেছিলেন। এমন ভাবে সেই ভালবাসার প্রদর্শনটি তিনি করবেন তার ব্লকে যা আর কোথাও কেউ এখনো দেখেনি। সামনেই গ্রামে মেলা রয়েছে, তাতে মহা মহা মন্ত্রী সান্ত্রী থেকে জেলাশাসক মহকুমাশাসক সকলেই আসবেন উদ্বোধনের দিন। তাই বেশ কয়েক লক্ষ টাকার বরাতে গ্রামের সবচেয়ে বড় পুকুরের ওপর বিশালাকৃতি লাল টুকটুকে প্লাষ্টিকের ভালবাসা ভাসানো হয়েছিল। সবেমাত্র দুদিন আগেই কাজটা শেষ হয়েছে। ভোররাত্রে এসে ওই লক্ষ টাকার ডেকোরেশান কুড়ুলের ঘা দিয়ে দিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে দীনু ঘোষাল। যখন তাকে সবাই মিলে ধরে নিয়ে এল, তার মুখে একটাই কথা। বেশ করেছি। জলে প্লাষ্টিক টাঙ্গালে আবার করব। তাকে কেউ কিছুতেই বোঝাতে পারলনা যে এই এত টাকার ক্ষতি করাটা অপরাধ। এখন এই ক্ষতিপূরন কে দেবে? বিডিও সাহেবের যে আশাভঙ্গ হল, সবার সামনে যে ওনার মুখ নষ্ট হবে তার মূল্য কে দেবে? কৈবর্ত সাত কাহন থেকে সতেরো কাহন বলে চলে দীনুদা কতবড় অপরাধ করেছে।

“আপনি একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন তো কি বলে …” বিডিও সাহেব গম্ভীর চালে বলেন। রূপমের কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার নেই। ও মনে মনেই জানে যে দীনুদা একদম ঠিক কাজ করেছে। জলের মধ্যেখানে প্লাষ্টিকের অতবড় জিনিসটা মাছের চাষে অসুবিধাজনক। বড় মাছও এটাকে এড়িয়ে চলবে। পরিবেশ রক্ষায় প্লাষ্টিক বর্জনীয় এটা ঐ ডিগ্রীহীন মানুষটা জানে অথচ এত বড় বড় সব অফিসারের জ্ঞানে তা নেই। এই লোকের ওপর কিনা ব্লকের উন্নয়নের ভার। রূপম চুপ করে থাকে কিচ্ছু না বলে।

“কি হল ভাই আপনি কিছু বলছেন না কেন? জিজ্ঞেস করে দেখুন কি বলে …” বিডিও আবার চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন।

“দীনুদা কী করেছো তুমি? জলে টাঙ্গানো ভালবাসার বোর্ড ভেঙ্গেছো কেন? জাননা ওটা সাহেবরা সবাই দেখবেন? এত টাকার জিনিস নষ্ট করলে?” আলগা স্বরে বলে যাচ্ছিল রূপম। কারণ ও বুঝেছে যে এই নাটকটা শেষ না হলে এখান থেকে দীনুদাকে নিয়ে রিসর্টে ফেরা যাবেনা চট করে। কিন্তু দীনু বিকট চিৎকার করে ওকে ধমকে দেয়, “চুপ কর মূর্খের দল। জলের মধ্যে প্লাষ্টিক? অ্যাঁ? মাছগুনো সব বাঁচবে?”ঘরের সবাই বেশ চমকেছে। বিডিও এই ধমকটা আশাই করেনি। এবার বেজার মুখে রূপমের দিকে তাকিয়ে বলে, “নিয়ে যান ওনাকে। হাফ পাগল মানুষকে আর কি শাস্তি দেব। তবে এরপর থেকে চোখে চোখে রাখবেন, রিসর্ট থেকে বের হতে দেবেন না।”

দীনুদার হাত ধরে নিয়ে এসে বাইকে বসায় রূপম। অতি কষ্টে আবারো সেই ফ্যাক ফ্যাক করে বেরিয়ে আসতে চাওয়া হাসিটা চেপে রেখেছে। স্টার্ট দেওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিসফিস করে বলে, “দীনুদা তুমি একদম ঠিক কাজ করেছ। ওই লাল বোর্ডটা আমারও দুচক্ষের বিষ। যেখানে সেখানে অত ভালবাসা আমারও সহ্য হয়না। প্লাষ্টিকের ভালবাসায় শুধু মাছেদের নয় মানুষেরও ক্ষতি। ”




রাগিনী হেঁটে আসছিল তেলরং কটেজের পাশ দিয়ে। পুকুরের ধার দিয়ে পর পর সব কটেজগুলো। জলছবি কটেজটার সামনে এসে ওর পা টা নিজেই থেমে যায়। হাতের চাবির গোছাটার দিকে একবার তাকায়। তারপর কী মনে হতে জলছবির দরজা খুলে ঢুকে পড়ে ভেতরে। পুলিশ এটাকে সিল করেই দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বিপাশা ম্যাডামের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত আর করেনি। ম্যাডামের বক্তব্য ছিল রিসর্টের মাঝখানে একটা কটেজ সিল করা থাকলে অন্যান্য গেষ্টদের মধ্যে তার খারাপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। রাগিনীর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। ঐ মেয়েটাকে এন্ট্রির সময় প্রথমটায় দেখেনি ও। বোধহয় রূপমও দেখেনি। মেয়েটা গাড়ীতেই ছিল। লোকটা নেমে রেজিষ্টারে সই করেছিল। রূপম যদি প্রথমেই দেখত তবে নিশ্চই কথা বলার চেষ্টা করত। ওর সঙ্গে পরিচয় ছিল মেয়েটার! কতটা পরিচয়! মেয়েটা রাত্রেই দেখা করতে চেয়েছিল রূপমের সঙ্গে। যদি রূপম জানতে পারত তবে কি যেত ও? মেয়েটা তো ডেকেছিল রূপমকে।

একথা সত্যি যে রাগিনী একদম চায়নি যে রূপম দেখা করুক ওর সাথে। সেই জন্যই জানতেই দেয়নি ওকে। কিন্তু কেন? কেনই বা চায়নি রাগিনী? কী সম্পর্ক ওর রূপমের সাথে? রূপম কার সঙ্গে দেখা করল বা করল না, সম্পর্ক রাখল বা রাখল না তাতে কতটুকু যায় আসে রাগিনীর? এমন তো নয় যে রূপম ওর ব্যক্তিগত সম্পত্তি! ব্যক্তিগত কোন বাঁধনই তো নেই ওদের মধ্যে। তাহলে কেন রাগিনী মেয়েটার সঙ্গে রূপমের দেখা হওয়াটা আটকাল? হয়তো ওদের দেখা হলে, কথা হলে মেয়েটা সুইসাইড করত না। তাহলে কি ওর সুইসাইডের জন্য পরোক্ষভাবে রাগিনীও কিছুটা দায়ী?

আর ভাবতে পারেনা ও। খাটের ওপরে ঝুলে থাকা মেয়েটার শরীর যেন চোখের ওপর ভেসে ভেসে উঠছে। এমনিতে রাগিনী খুব শক্তধাতের মেয়ে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন এই ঘরটা চারদিক থেকে ওকে চেপে ধরবে। ভীষণ দুর্বল লাগতে থাকে। কেন যে এই ঘরে এসেছিল সেটাও আর মনে পড়েনা। নিছক রুমটা দেখতে নাকি অন্য কোন কাজ ছিল! পায়ে পায়ে এসে বাথরুমের ধারে রাখা ছোট্ট আলমারীটা টান মেরে খোলে। তাকের ওপর রাখা লাল ওড়নাটা চোখে পড়ে যায়। এ কী! এটা পুলিশের চোখে পড়েনি! ওরা তো সব জিনিসপত্র সীজ করে লিষ্ট বানিয়ে নিয়ে গেছে। সেই লিষ্টে তো রাগিনী সইও করেছে। তাহলে এই ওড়নাটা! এটা রয়ে গেল কিভাবে? নিজেরই অজান্তে ওড়নাটা হাতে নিয়ে বিছানার ওপর মেলে ধরে রাগিনী।

এক কোণের দিকে সাদা মার্কিং পেন্সিল দিয়ে বড় বড় করে লেখা, “আমি চলে যেতে চাইনি। তোমার কাছে থাকতেই চেয়েছিলাম। পাঁকে নেমে গেছি। আর কি পারব তোমার কাছে ফিরতে? ক্ষমা করে দিও।”

থরথর করে কেঁপে ওঠে রাগিনীর পা দু’খানা। ওর মন বলে এই কথাগুলো রূপমের জন্যই লিখেছিল ওই মেয়েটা। কিন্তু যখন লিখেছে তখনও কি জানত যে এটাই ওর শেষ লেখা! মাথার ভেতর কেমন একটা অপরাধবোধ, একটা নাম না জানা কষ্ট ডানা মেলে উড়ে যায়। হয়তো পড়েই যেত রাগিনী। অনেক দূর থেকে ভেসে আসে কিছু কথা, কয়েকজনের গলার আওয়াজ। কি যে বলছে ওরা! কাকে বলছে!

“আরে কী ব্যাপার! তুমি এইখানে? সুজন, তরুণ, এই যে রাগিনী দিদি …, আয় আয় ধর শিগগীর”

রূপমের গলার আওয়াজ ভেসে ভেসে চলে যায় কানের পাশ দিয়ে। রূপমরা সবাই মিলে রাগিনীকেই খুঁজতে বেরিয়েছিল। দু’খানা গেষ্ট পার্টি এসে রিসেপশনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রুমের চাবির গোছাটা ড্রয়ারে নেই। রূপম গেষ্টদের কোল্ড ড্রীঙ্ক সার্ভ করতে বলে রাগিনীকে খুঁজতে বেরিয়েছিল। এখানে এভাবে পাবে ভাবেনি। মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল মেয়েটা। রূপম ধরে নিয়ে খাটে শোয়াতে যেতেই রাগিনী আচ্ছন্ন অবস্থাতেও চেঁচিয়ে ওঠে, “না আ আ, ওখানে না…”

তরুণের দিকে চোখের ইশারা করে রূপম। বাইরে নিয়ে যায় ওরা রাগিনীকে। খাটের ওপর পড়ে থাকা ওড়নাটা কারো নজরে পরলেও তার কোণায় লেখাটা কেউ দেখেছে বলে মনে হয়না। রাগিনীর হাত থেকে চাবিটা নিয়ে সুজন লক করে দেয় ঘরটা। রাগিনী সামলে নিয়েছে কিছুটা। তবু রূপম ওকে পুরোটা ছেড়ে না দিয়ে হাতটা ধরে থাকে। পায়ে পায়ে সবাই এগোয় রিসেপশনের দিকে।

“কি ব্যাপার? এই ঘরে এসেছিলে কেন তুমি? এটার তো কোন বুকিং নেই আজ। আজ কেন এই সপ্তাহেই নেই …”

“জানি। আমি একবার দেখে নিলাম রুমটা ঠিকঠাক আছে কিনা …” মৃদু স্বরে বলে রাগিনী।

“এভাবে একা এখানে আসা তোমার উচিত হয়নি। আমাকে বলতে পারতে …”

এতদিনে কখনো রূপম এই অভিভাবকের স্বরে কথা বলেনি রাগিনীর সাথে। এই সুরে রাগিনীই সবার সঙ্গে কথা বলে থাকে। আজ রূপমের অজান্তে ওর গলার আওয়াজ পালটে গেছে। রাগিনী মনে মনে ভাবে, ভাগ্যিস এসেছিলাম একা। নইলে এই রূপমকে পাওয়া যেত না।

নিজের অফিসের কাছে এসে থেমে যায় ও। একটু চুপ করে থেকে বলে, “আজ লাঞ্চটা একসঙ্গে করবে? আমার চেম্বারে দিতে বলি?”

“ক’টা বাজল? গেষ্টদের একবার দেখে নিয়ে আসছি। তুমি ভেতরে যাও। খেতে দিতে বল।”

খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবে চলে যায় রূপম। পেছন থেকে ওকে দেখতে দেখতে একটা কথাই মনে হয় রাগিনীর। ও কি আমায় নিয়ে কিছুই ভাবেনা কখনো? তাহলে আমায় পড়ে যেতে দেখে ওভাবে গিয়ে ধরল কেন? এটা কি শুধুই একজন মানুষের জন্য আরেকজনের কনসার্ন? একটুও বেশী কিছু নয়? এই যে হাত ধরে ধরে নিয়ে এল …। এটা কি শুধুই সহানুভূতি? আমার হাত ছুঁয়ে ওর একটুও কিচ্ছু মনে হল না?

রাগিনী নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। নিজেকে ধমক দিয়ে ফিরিয়ে আনতে চায় নিত্যদিনের রাগী রাগী

ডিসিপ্লিনড চেহারায়। কিন্তু কি যে হয়েছে আজ ওর! অবশ্য ঠিক আজ নয়, ঐ সেদিন রাত থেকেই নিজেকে আর চিনতে পারছেনা। যে মূহূর্তে তরুণের মুখে শুনল যে ওই মেয়েটা রূপমকে ডেকেছে, কী যে হয়ে গেল মাথার ভেতরে! অথচ তার কত আগে থেকেই তো রূপম এসেছে এখানে। ভালও লাগে ওকে। কিন্তু এভাবে নিজের করে ভাবতে ইচ্ছে হয়েছে কি আগে কখনো! ওর প্রতি কোন অধিকারবোধও অনুভব করেছে কি? তাহলে এখন এসব কি হচ্ছে? কেনইবা সেদিন ওভাবে মেয়েটার চিরকুটটা ওকে না দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল? একা একা কেন আকাশ কুসুম ভাবছে? এসব কি ওকে মানায়? কত দায়িত্ব রয়েছে ওর সংসারে। নাহ, এভাবে নিজেকে ভাঙ্গলে তো ওর চলবেনা। নিজের এতদিনকার জায়গাটা ফিরে পেতে প্রাণপন লড়াই চালায় রাগিনী। যে কিছুই বোঝেনা, যার হয়তো ওর প্রতি কোন ফিলিংসই নেই তাকে নিয়ে আকাশ কুসুম কল্পনা করা আর নিজেকে নিজে অপমান করা একই সমান। দু’হাতে মাথা গুঁজে টেবিলে আধা শোওয়া হয়ে ভেবেই যায় ভেবেই যায় রাগিনী। এটা এমন একটা ভঙ্গী যেভাবে কিনা ওকে কোনদিন কেউ দেখেনি।

সেই আশ্চর্য়েরই প্রকাশ রূপমের গলাতেও। সে তড়িঘড়ি গেষ্টদের রুমে পাঠিয়ে লাঞ্চ করতে এসেছে। এসে এক মিনিট দাঁড়িয়ে আছে রাগিনীর চেম্বারের দরজায়, একই দৃশ্য। দেখে মনেই হচ্ছেনা ইনি জেগে আছেন আদৌ।

“কি ব্যাপার! আবার শরীর খারাপ হল নাকি তোমার? খাবার দিতে বলেছো?”

রূপমের গলার আওয়াজে নড়ে বসে রাগিনী। মুখে অপ্রস্তুত হাসি, “ও কিছুনা, ঠিক আছি। তুমি বস। হাত মুখ ধুয়েছো তো? দাঁড়াও একটু …”

ইন্টারকমটা তুলে নিয়ে ক্যান্টিনে কানেক্ট করে, “সরমা লাঞ্চটা পাঠাও। দুটোই দেবে, আমার আর রূপমদার। মাছ আছেতো? আমাকে ছোটোমাছের চচ্চড়ি দিও। আর সব্জী। রূপমদাকে কাতলা দিও পেটি দেখে। দই দেবে।”

রূপম শুনছিল রাগিনীর কথাগুলো। এবার অল্প হাসে। ওর হাসি দেখে আবার নিজের ওপর রাগ এসে যায় রাগিনীর। কি দরকার ছিল তার রূপমের মেনু বলে দেওয়ার! যারটা সে নিজেই বলবে এটাই তো নিয়ম। নাহ, এই বদভ্যাসগুলো ছাড়তেই হবে ওকে। কি ভাবছে রূপম! ছি ছি। এই তো হেসেই যাচ্ছে ওর দিকে তাকিয়ে।

“হাসির কি হল?”

“না, আমি ভাবছিলাম আজ আমি দই খাব, তুমি বুঝে গেলে কি করে? এটা ঠিক আমার মায়ের মত হল …”

“মায়ের কাছে কতদিন যাওনি? ছুটি পাওনা আছে তো তোমার। গিয়ে ঘুরে এলেই পার …”

আবার হাসে রূপম, “এত তাড়াতাড়ি চলে যাব বলছো? ওপরে যেতে হবে তো তাহলে …”

“ওহ উনি তো নেই! ইসস আমি সরি…”

“সরির কি আছে …তোমার তো জানার কথাও নয়।”

“না আমি জানি…”

“জান? কিকরে? আমার সাথে তো কোনদিন কথা হয়নি!”

অপ্রস্তুত মুখে রাগিনী বলে,”ওই তো ওরা সব বলছিল একদিন।” ওরা যে কারা সেই জেরাটা আর করার সময় পায়না রূপম।

খাবার এসে গেছে। ডাইনিং এ গিয়ে খাওয়াই নিয়ম। কিন্তু এটুকু বিলাসিতা রাগিনী ছাড়তে পারেনা। নিজের চেম্বারে বসে আরাম করে খাওয়াটা একটা ব্যাপার। ভাত এসে গেছে। রূপমকে এগিয়ে দিয়ে নিজের প্লেটটা টেনে নেয়। ভাতের ওপর ডাল ঢালতে গিয়ে গম্ভীর চোখ তুলে তাকায় রূপমের দিকে, “এতদিন এক জায়গায় চাকরি করছি আমরা, নিজেদের আরেকটু ভাল করে চেনা প্রয়োজন ছিল। তাই না?”

একমুখ ভাত নিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে রূপম বলে, “মানে?”

“মানেটা খুব সাধারন। এই ধর তোমার বাড়ীতে কে কে আছেন, তোমার অতীত জীবন, তোমার সঙ্গে এই মেয়েটির সম্পর্ক …”

থেমে যায় রূপম, “কার কথা বলছ? মিঠি?”

“নাম তো আমার জানার কথা নয়…” মৃদুগলায় বলে রাগিনী। রূপমের মুখচোখ পালটে গেছে। দেখে রাগিনী কিছুটা থমকে যায় প্রসঙ্গটা তোলার জন্য। কিন্তু ছুঁড়ে দেওয়া তীর ফেরত আসেনা।

তাই ঠান্ডা হয়ে ও অপেক্ষা করে। এই প্রসঙ্গটা তোলারই ছিল। এটা শুধুমাত্র একটা হঠাত এসে পড়া মেয়ের প্রসঙ্গমাত্র নয়। নিজের কাজে, নিজের চাকরিতে ক্ষতি হচ্ছে এমন যে কোন ব্যাপারকেই রাগিনী বেশীক্ষণ বা বেশীদিন বাড়তে দিতে চায়না। কারন বিপাশা ম্যাডামের ওপর ওর দায়িত্ব রয়েছে। বিপাশার এই রিসর্টের ওপর ওর দায়িত্ব রয়েছে। নিজেকে নিয়ে আগোছালো থেকে সেই দায়িত্বে ফাঁকি দিতে চায়না বিপাশা।

“আমি সব বলব আমার সম্বন্ধে, তার আগে তুমি বল কেন সেদিন রাত্রে আমাকে বলনি তুমি যে মিঠি আমায় ডেকেছে? বল কেন বলনি! চুপ করে থাকবেনা … বল…” রূপম খাওয়া থামিয়ে তীব্রভাবে বলে যেতে থাকে রাগিনীর দিকে তাকিয়ে। ওর মত শান্ত ভদ্র ছেলে এভাবে কথা বলতে পারে ভাবা যায়না। এখানে কেউ ওর এই মূর্তিটা দেখেনি। রাগিনী এই নতুন চেহারাটা অবাক হয়ে দেখতে থাকে। সেদিন খাবার ছুঁড়ে দেওয়া, তারপর এই আজ। কি হয়ে যাচ্ছে রূপমের!

“কি হল? আমার কথা তোমার কানে যায়নি? আমার কথা জানতে চাও? ওই মিঠিকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম আমি। তার আগেই ও চলে গিয়েছিল আমায় ছেড়ে বুঝেছো? শুধু মিঠি কেন, আরো একজন চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে আমায় ভেঙ্গে দিয়ে সুখের ঘর তৈরি করেছে আমারই কাজিন দাদার সঙ্গে। বাড়ী যেতে চাইনা আমি। কারণ বাড়ি গেলেই ওই ওদের দেখতে হবে। ঘেন্না করে আমার ওদের হাসিমুখ দেখতে। শুনবে? আরো শুনবে? কিন্তু কেন শুনতে চাও এসব? কি দায় তোমার এসব শোনার? কেন মিঠির চিরকুটটা আমাকে দাওনি সেদিন? বল?”

কথা বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে রূপম। চেম্বারের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল সুজন। ভেবেছে খাওয়া হয়ে গিয়েছে, প্লেট বাটি নিয়ে যাবে। রূপমকে উত্তেজিত ভাবে কথা বলতে শুনে চলে গেল হাঁ করা মুখে। সেদিকে দেখে নিয়ে রাগিনী রূপমের হাত ধরে টানে, “বসে পড়ো। খাওয়াটা শেষ করো। অত জোরে কথা বলছো, সবাই শুনল হয়তো…

“শুনুক। কে কি ভাবল তার আর তোয়াক্কা করিনা আমি। আমার কাছে আমার জীবনটাই শেষকথা।” “ঠিক আছে। তুমি আগে খাওয়াটা শেষ করো। তারপর কথা হবে।” রাগিনী আর একটাও কথা না বলে নিজের থালায় মন দেয়। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে রূপমও খেতে শুরু করে। মাথাটা কেন এত গরম হয়ে গেল ভেবে এখন খারাপ লাগছে ওর। ছি ছি, এরকম তো করেনা কখনো ও। আসলে রাগিনীর ওপরে চাপা রাগটা ভেতরে ভেতরে সেদিন থেকেই তাতিয়ে যাচ্ছিল ওকে। মিঠির ওপরে যা কিছু ফিলিংস তা বহু আগেই চলে গেছে। শুধু যদি এভাবে মিঠি চলে না যেত! আর যাওয়ার আগেরদিন এভাবে ওকে দেখা করতে বলা, এটাই আরো বড় চিন্তার মুখে ফেলে দিয়েছে রূপমকে। ও যদি না জানতে পারত যে মিঠি দেখা করতে চেয়েছিল ওর সাথে তাহলে কিছুই মনে হত না হয়তো। সেদিক দিয়ে ভাবলে বলতে হয় একা রাগিনী নয়, এমনকি তরুণও শত্রুতা করেছে ওর সঙ্গে। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে। এরা দুজনেই দায়ী রূপমের মনের শান্তি নষ্ট করার জন্য। তাহলে একা রাগিনীর ওপরে রাগ করল কেন ও? কই তখন তরুণের সঙ্গে কথা হল, ওকে চেঁচাল না তো! ছি ছি। নিজের ওপরেই এবার ভয়ানক রাগ হতে থাকে রূপমের। একটাও কথা না বলে কোনমতে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ায়।

“আমি সরি। কিছু মনে রেখোনা। মাথাগরম করে কতগুলো বাজে কথা বলে ফেললাম।”

চলে যাচ্ছিল রাগিনীর চেম্বার ছেড়ে। আবার ঘুরে দাঁড়ায়, “আমি সত্যি কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাব। এই জায়গাটা একটু বদল হওয়া দরকার আমার। নাহলে এমন মাথাগরম হতেই থাকবে যখন তখন। ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়ে দিচ্ছি। ম্যাডামকে দিয়ে একটু অ্যাপ্রুভ করে দিও।”

রাগিনী কী বলে তা শোনার জন্য আর দাঁড়ায় না ও। বেরিয়ে পড়ে হাঁটতে থাকে পুকুরের দিকে। ওইখানে সিঁড়ির ওপরে বসে একটু জলে ভেসে থাকা মাছেদের নড়াচড়া দেখবে। কতদিন এই মাছের সাঁতার কাটা দেখে দেখে মন ভাল করেছে এখানে আসার পর।

এই দুপুরবেলা রিসর্টে শুকনো পাতা পড়ার আওয়াজটুকুও শোনা যাবে মনে হচ্ছে। আজ যেন বড্ড বেশী নিস্তব্ধ সব। সুজন, তরুণ, দীনুদা সব গেলই বা কোথায়? ওয়েটার ছেলেগুলোও তো এঘর ওঘর ট্রে জলের জাগ হাতে নিয়ে ছোটাছুটি করে। রূপম নিজে রিসেপশন থেকে নড়েনা তাই বাইরের এই দুপুরবেলার রূপটা ওর সেভাবে চোখে আসেনা। রোজই কি এমন শান্ত থাকে চারদিক? পুকুর ঘাটের সিঁড়িগুলো সুন্দর লাল ইঁট দিয়ে বাঁধানো। ধাপে ধাপে অনেকটা নেমে এসে জল থেকে কিছুটা দূরে বসে রূপম। অন্যান্যদিন ও রেজিষ্টারগুলো বের করে সমস্ত হিসেব আপ টু ডেট করে রাখে, খাতা পত্র সব গোছানো, ভাউচার, বিল সব টপ টু বটম মেলানো, একেবারে ঝকঝকে কাজ ওর। ইলেক্ট্রিক থেকে শুরু করে, মাছ হোক বা মাংস, মুদিখানা বা কাষ্টমারদের সাইনড কপির বিল, সমস্ত ফাইল সুন্দর করে গুছিয়ে রাখাটা রূপমের নেশার মত। কিন্তু অন্যান্য দিনের মত আজ আর কোন কাজে মন লাগে না ওর। গিয়ে ডেস্কে বসবে ভাবতেই ভাল লাগছে না। কী যে হয়ে গেল এতটা চিৎকার করে ফেলল রাগিনীর সঙ্গে যা কোনদিন ভাবতেই পারেনি। আর চিৎকার করল কী নিয়ে? না মিঠির কারনে। কে মিঠি? সে আজো এতদিন পরেও এতটাই গুরুত্বপূর্ণ রূপমের কাছে? কেন? কেন তা হবে? একটা সময় ছিল যখন মিঠিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল রূপম। কিন্তু কয়েকদিনের মেলামেশাটাকে মিঠি তো গুরুত্বই দেয়নি। কিছুমাত্র আভাস না দিয়ে একদিন চলে গিয়েছিল রূপমের কাছ থেকে। সম্পূর্ন যোগাযোগ ছিন্ন করে দেওয়ার আগে রূপমকে কোন কিছু বলার সম্মানটুকুও দেখায়নি। তখন বেকার রূপম। মিঠিকে বেঁধে রাখার ক্ষমতা ছিলনা ওর। কিন্তু উদ্যম তো ছিল। স্বপ্ন ছিল। মিঠিকে পাশে নিয়ে জীবনের পথে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিল রূপম। কিন্তু কাল আসব বলে মিঠি আর কোনদিন এলোই না। ফোনের সিম পালটে ফেলল। ওর দাদাকেও বোধহয় বারণ করেই দিয়েছিল। তাই বন্ধুর কাছে বারবার খোঁজ করেও তার বোনের কোন খবর পায়নি ও। তারপর সেই পাগল হতে বসা রূপমকে সুস্থ মানুষ করে তুলেছিল চিনু। চিনুর হাত ধরে আবার জীবনের উপর ভরসা ফিরে পেয়েছিল রূপম। আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। মিঠির ফেলে যাওয়া ছিন্নভিন্ন আশা ভরসা স্বপ্নগুলো আবার নতুন করে গেঁথে তোলার আয়োজন করতে শুরু করেছিল।

কিন্তু চরম ধাক্কা লাগল, যখন দেখতে পেল চিনু হেসে হেসে ওরই খুড়তুতো দাদা মানসের গলায় মালা দিয়ে ওর সঙ্গে এক বাড়ীতে থাকতে এল। বিয়ের দুদিন আগেও রূপম টের পায়নি মানুদার সঙ্গে চিনুর বিয়ে হতে যাচ্ছে। বিয়ের মাত্র দশদিন আগেও ওর সঙ্গে ডায়মন্ডহারবারের সেই ছোট্ট হোটেলটায় একটা গোটা দুপুর কাটিয়েছিল চিনু। রূপম সেই প্রথম চিনেছিল নারী শরীর। সেই চেনার খেসারত দিতে এখনো ঘেন্নায় ও কাকার পোর্শনের দিকে তাকাতে পারেনা। ওর মনে বারবার জিজ্ঞাসা এসেছে ওই দিন কি চিনু সব জেনেশুনেই গিয়েছিল ওর সঙ্গে? রূপম কোন চাকরি করেনা। সমস্ত খরচ চিনুই দিয়েছিল। খুব খুশী ছিল ও। ফেরার পথে বাসে ওর কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, ইউ আর এ গুড পারফর্মার। ছিঃ। একবুক ঘেন্না রূপমকে এখনো রাত্রে জাগিয়ে রাখে।

একথাও ও ভাবতে চেয়েছিল যে এটা ওদের সম্বন্ধ করে বিয়ে। চিনুর হয়তো কিছু করার ছিলনা, হয়তো ওর বাড়ী থেকে বিয়ে ঠিক করেছে, হয়তো ও জানতই না যে মানস, রূপমের দাদা। এইটুকুমাত্র সান্ত্বনা পেলেও রূপম বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু বৌভাতের দিন হেসে হেসে মানুদা যখন বলছিল গত তিনবছরের রিলেশন ওদের, কত প্ল্যান প্রোগ্রাম করে তারপর এই বিয়ে, তখন কেউ রূপমের কানে গলানো মোম ঢেলে দিচ্ছিল। তিনবছর ধরে প্রেম? তাহলে গত দেড়বছর আগে চিনু দুর্গাপুজোর ভাসানের দিন কেন রূপমকে বাড়ীর ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। কেন বলেছিল ওর শাড়ীর কুঁচি ঠিক করে দিতে? কেন রূপমের হাতে গুঁজে দিয়েছিল পারফিউমের শিশি? ওটা মেখে পরদিন শান্তি ক্লাবের পাশের গলিতে কেন ওকে দাঁড়াতে বলেছিল? কেন সেখানে রিকশা করে এসে ওকে তুলে নিয়ে বিভুদার রেস্তোরাতে বসেছিল? তারপর আবার, আবার, আবার …। কেন কেন কেন? একই সঙ্গে দাদা এবং ভাই দুজনকে নিয়ে একটা জান্তব আনন্দ ভোগ করে গেছে চিনু? কেন? এই কেনর উত্তর কোনদিনই পাওয়া হবেনা রূপমের। কারণ ওর আর রুচি নেই চিনুর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর। এক একবার ভেবেছিল যে মানুদাকে সব বলে দেবে। কিন্তু ওর হাসিমুখটা দেখে মায়া হয়েছে। ও যদি কিচ্ছু না জেনে খুশী থাকতে পারে, তাহলে রূপম কেন ওর আনন্দটা নষ্ট করতে যাবে? না, এতটা নিচে নামতে পারেনি ও। যদি রূপম, মানুদার বিয়েতে বরযাত্রী যেত তাহলে আগেই জানতে পারত। কিন্তু কাকার ফ্যামিলির সঙ্গে ওদের খুব একটা লেনাদেনা কখনোই ছিলনা। মা, কাকীমার সম্পর্ক ভাল ছিলনা। ওরাও নিজেদের দূরে দূরেই রেখেছে বরাবর। একই ঘেরাটোপে মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাট। যেটুকু যোগাযোগ না থাকলে নয় তাই ছিল মাত্র। নিমন্ত্রণ করে গেছে, বৌভাতের দিনে যাবে এটাই ভেবে রেখেছিল। বাড়ীর ভেতরে বড়দের মধ্যে যাই সম্পর্ক হোক, বাইরে ওর সঙ্গে মানুদার তো ভালই কথাবার্তা ছিল। এক ক্লাবে খেলা, এক মাঠে খেলা দেখতে যাওয়া, এক কলেজে পড়া। সাধারণ বন্ধুত্ব না হয়ে যায় কি করে। যদি ওই বৌভাতের দিনটাতেও না যেত! অনেকবার ভেবেছে রূপম। তাহলে তো চিনুর ওই হাসি হাসি মুখটা ওকে দেখতে হতনা। সবচেয়ে ও অবাক হয়েছিল চিনু একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে সকলের সামনে নিজের বান্ধবীদের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিল, এই যে আমার একমাত্র দেওর বলে। রূপম যে ভেঙ্গেচুরে শেষ হয়ে যাচ্ছে, রূপমের মুখটা যে কালো হয়ে গেল এসব যেন ওর চোখেই পড়েনি। সেদিন মায়ের কিনে দেওয়া কানের দুলটা চিনুর হাতে দিয়ে কিভাবে রূপম ফিরে এসেছিল নিজের ঘরে সেটা শুধু ওই জানে। ওই নির্লজ্জ মেয়েটা তারপরেও এসেছে ওর ঘরে, ওকে ডেকেছে নিজেদের ফ্ল্যাটে।

কেউ জানেনা। শুধু রূপম জানে মানুদার বিয়ের পর ক’টা দিন কি পাগলের মত ও একটা চাকরি খুঁজেছে যাতে ও বাড়ী ছেড়ে বাইরে চলে যতে পারে। পেয়েও গেল এই রিসর্টের কাজটা। একটা মূহূর্তও ভাবেনি ও। চলে এসেছে বাড়ী ছেড়ে। এখানেই ওর সরকারী চাকরির চেষ্টা বা প্রিপারেশান সব শেষ। আর কিচ্ছু ভাবতে পারেনি। এখানে এসে নিজেকে চেনা পৃথিবীর বাইরে লুকিয়ে ফেলে এক নতুন জীবনে ঢুকে গিয়েছে। এর মধ্যে মাও চলে গেল। কোনমতে একবার গিয়ে ক্রিয়াকর্ম সেরে ঘরে তালা ঝুলিয়ে চলে এসেছে। মাঝে মাঝে ভাবে ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে দেবে। কিন্তু তার জন্য যেটুকু ব্যবস্থা করা দরকার,সেটা করার মত উদ্যমও আর অবশিষ্ট নেই ওর। চিনুর মুখটা মনে পড়লেই বাড়ি যাওয়ার সবটুকু ইচ্ছা উদ্গত একটা না হওয়া বমিভাবে ঢাকা পড়ে যায়।

এখানে এসে রাগিনীর সঙ্গে পরিচয়। কাজের সম্পর্কের বাইরে একটা মিনিটও ভাবেনি ও। ভাবনা আসেইনি মনে। এত যে রঙ বেরং এর সুন্দরীর আনাগোনা এই রিসর্টে, রূপমের কোনদিন ইচ্ছে হয়নি কারুর দিকে চোখ তুলে তাকানোর বা একটাও কথা বলার। বোধহয় ওর মনের দরজাটা মেয়েদের জন্য বন্ধই হয়ে গেছে। তার জন্য কোন আক্ষেপ নেই ওর। প্রথম তিন চার মাস নিজের কাজের জায়গাটা ছেড়ে আর নিজের দায়িত্বে থাকা রেজিষ্টার ক’খানা ছেড়ে আর কোনদিকে মন যায়নি ওর। রাগিনী এখানে ওর ইমিডিয়েট বস। নানা কাজে রাগিনীর সঙ্গে কথা বলতেই হয়। কথা বলতে হয় ম্যাডাম এলেও। প্রথমদিকে তো চোখ তুলে কারোর দিকে তাকাতই না রূপম। তারপর ধীরে ধীরে অনেকটা সহজ হয়েই এসেছে। না হয়ে উপায়ইবা কি ছিল। কাজের সম্পর্কটাও তো ফেলনা নয়। বরং এটাই এখন আসল। রাগিনীর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ওর নজরে এসেছে কী যেন একটা স্পেশাল নজর আছে রাগিনীর ওর ওপর। ওর প্রতিটি স্বাচ্ছন্দ্য সুবিধার দিকে কড়া নজর। খাওয়ার সময় যেন কোনদিন পার না হয়ে যায়, বিশ্রাম নেওয়ার সময়ে যেন কাজে ডুবে না থাকে রূপম, মাঝে মাঝে যেন ছুটি নেয় ও, রাত্রিবেলায় যেন ওর জন্য ভাত না হয়ে রুটি হয়, ওর খাওয়ার পাতে যেন ভাল জিনিসটুকু থাকে ইত্যাদি সবকিছু। এমনকি ওর ঘরে মশকুইটো রিপিল্যান্ট ফুরিয়ে গেলে তার খবরটাও রাগিনীর কাছে থাকে। সন্ধ্যাবেলায় ওর ঘরে তালা খুলে ধূপ জ্বালানোর ব্যবস্থাও রাগিনী করে যায় নিশ্চুপ ভাবে। রূপম প্রথমদিকে খেয়াল না করলেও ক্রমাগত নানা সুবিধা পেতে পেতে এখন জেনেই গেছে কার কোমলহাতের ছোঁয়ায় ওর সমস্ত প্রয়োজন সুন্দরভাবে মিটে যায় মুখ ফুটে বলার অনেক আগেই। কিন্তু এই পাওয়াগুলোর কোন প্রতিদান দেওয়ার কথা ও এখনো ভাবতেই পারেনা। ভাবনা আসার অনেক আগেই ও নিজের মনের ভাবনা চিন্তার সমস্ত জানলা দরজা বন্ধ করে রেখেছে। মনের বিস্তৃত জমিতে শুধুই ঘৃণা। সেখানে ভালবাসা তো দূর, একটা ছোট কৃতজ্ঞতার চারাগাছও আর বপন করতে ভয় পায় রূপম। তাই এমন ভাব করে থাকে ও যেন কিছু বুঝতেই পারেনি।

কতক্ষন পুকুরপারে বসেছিল রূপম জানেনা। চমক ভাঙ্গে দীনুদার কথায়।

ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে দীনুদা। হাতে একটা বোগেনভিলিয়ার ডাল।

“এই যে, রূপমদাদা, বল দেখি এই ডালটা কোথায় পোঁতা যাবে? এমন জায়গা বল যেখানে দিলে ফুলে ফুলে ভরে যাবে। এর কালারটা একদম আলাদা, গোলাপী আর কমলায় মেশানো। এই ফুল এখানে আর একটাও নেই।”

রূপম জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিল যে কোথা থেকে এই গাছ এনেছে দীনুদা। কিন্তু একটাও শব্দ বলে ওঠার আগেই ওর আঙ্গুল দিক নির্দেশ করে রাগিনীর ঘরের দিকে। এইটুকুই যথেষ্ট দীনুদার পক্ষে। সে আর কিছু না বলে হেলেদুলে চলে যায় রাগিনীর ঘরের দিকে।

অনেকটা দূর ঐ ঘরটা পুকুরপার থেকে। পুরোটা দেখা যায়না। শুধুমাত্র বারান্দার একটা অংশ। সেখানে একপাশ থেকে উঠে গেছে একটা সাদা ফুলে ভরা টগর গাছ। আর একটা পাশ পুরোই ফাঁকা, যা এখানে কোন কটেজেই থাকেনা। সমস্ত কটেজের বারান্দাগুলোর দুইধার নানা রঙ এর ফুলগাছে সাজানো। কোথাও বা ফুল ছাড়া শুধু চকচকে সবুজ পাতাবাহারের ঝোপ। রাগিনীও কোনদিন দীনুদাকে বলেনি ওই ফাঁকা জায়গাটায় কোন গাছ লাগাতে। ও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো রিসর্ট সাজিয়ে তোলে। শুধু কেনই যে নিজের ঘরের দিকে কোন নজর দেয়নি কে জানে। এখন দীনুদা বোগেনভিলিয়ার ডাল নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে রাগিনীর বারান্দায়। ভেজানো দরজায় নক করে ডাকে, “দিদি …ও দিদি গো … দেখো এসে তোমার জন্য কী এনেছি …”

“বারান্দায় রেখে চলে যাও দীনুদা। আমি পরে উঠে দেখব …” ভেতর থেকে রাগিনীর গলা ভেসে আসে। রূপম এতদিন দূর থেকে শুনতে পায়না কিছু শুধু বুঝতে পারে দীনুদা কিছু বলছে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।

“এ জিনিস রেখে চলে যাওয়ার জিনিস নয় গো। এ জিনিস মাটিতে যত্ন করে পোঁতার জিনিস,

জল ঢেলে ঢেলে যত্ন করার জিনিস। এ হল গে ভালবাসার গাছ। কাঁটা আছে, আবার ফুলও আছে। কাঁটা ভয় পেলে তো চলবে না, রোজ একে ভালবাসতে হবে। তবেই তো ফুল ফুটবে। গাছে গাছে যত ফুল ফোটে মানুষের চারপাশেও ততই ভালবাসার সুগন্ধ বের হয়। দেখছোনা চারপাশটা কেমন পচে উঠছে রোজ! এখন আরো বেশি বেশি করে ভালবাসার গাছ পুঁততে হবে।” নিজের মনে অজস্র কথা বলে যায় দীনুদা। হাতে কাজ করে যায়। রাগিনীর বারান্দার যেপাশটা ফাঁকা ছিল সেখানে গাছের ডালটা দিব্যি পোঁতা হয়ে যায়। এতদূর থেকে রূপম শুধু দেখতে পায় দীনুদার নড়াচড়া। একসময় যখন দীনুদা উঠে চলে যাচ্ছে রূপম পুকুরের ধার থেকে চিৎকার করে,

“ও দীনুদা আ আ … কবে ফুটবে গো বোগেনভিলিয়া?”

“ফুটবে গো ফুটবে। আগে তো ভালবেসে জল ঢাল তবে তো ফুল ফুটবে …”

নড়ে চড়ে বাঁ হাতে খুড়পি নাচাতে নাচাতে চলে যায় দীনুদা। মুখে অবিশ্রান্ত বক বক বক বক। দীনুদা এইরকমই। হয় প্রচুর কথা বলছে নইলে থম মেরে বসে আছে।

রূপমও ঘাটের সিঁড়ি থেকে উঠে পড়ে। পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা নুড়িতে লাথি কষিয়ে অদৃশ্য দীনুদার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, “হ্যাহ শালা ভালবাসার জল …! তুমি ঢাল শালা দেখা থাকে তো …আমি তো জীবনে দেখলাম না কাকে বলে ভালবাসার জল।”

নুড়িটা কোথায় গিয়ে ঠেকল সেটা চোখে পড়েনা। নিজের ঘরে গিয়ে সটান শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। দুপুরে অন্যান্য দিন যে একটু গড়িয়ে নেয় আজ সেটা হয়নি। মাথাটা এত গরম হয়ে গেল যে খোপড়িতে বাতাস লাগানোর জন্য বসে রইল পুকুরপাড়ে। ফাঁকা মনে বসবে তার তো উপায় নেই। দুনিয়ার হাবিজাবি ছেঁড়া পৃষ্ঠা তক্তপোষের তলা থেকে মাথার ঘিলুতে উঠে এসে আরো রাগ ধরে যেতে লাগল। তাও দীনুদাটাকে দেখে ওর সঙ্গে কথা বলে একটু মনটা ভাল হচ্ছিল। তা ও এমন সব ডায়লগ দিয়ে গেল যে আবার বিরক্ত লাগছে। এই বিরক্তিটা এমন যে সহজে যাওয়ার নয়। মাথার মধ্যে ঝিকিঝিকি করে রেলগাড়ী চলতেই থাকবে। টানা একটা সলিড ঘুম দিতে পারলে ঠিক হত। কিন্তু অনেকক্ষণ অফিসে ঢোকেনি, একবার দেখে যাওয়া দরকার।

নিজের চেয়ারে বসে বুকিংগুলো চেক করছিল রূপম। দেখে নিচ্ছিল আজ সকালের মেইলগুলো। দেখতে দেখতে একটা মেইল এ চোখ আটকে যায় ওর। মিসেস সুচরিতা ঘোষ একটা কটেজ চেয়ে মেল করেছেন। তাতে রিগ্রেট মেল করেছে রাগিনী, সরি নো কটেজ ইজ অ্যাভেইলেবল ফর দিস উইক। পুকুরের হাওয়া লাগিয়ে মাথাটা ঠান্ডা করেছিল রূপম। আবার কেমন ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। চিনুর ভাল নাম সুচরিতা। এখন ও মিসেস সুচরিতা ঘোষ। এরা এখানেও আসার জন্য ধাওয়া করেছে! উঃ কোথাও গিয়েই কি একটু শান্তি পাবেনা রূপম! কিন্তু রাগিনী রিগ্রেট মেলটাই বা দিল কেন? চার চারখানা কটেজ ফাঁকা আছে এখনো। রাগিনীর খোঁজে উঠে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই রাগিনী নিজেই এসে ঢোকে রিসেপশনে। পাশের আলমারীটা খুলে কিছু একটা রেজিষ্টার বের করছে। রূপম ওর পাশে গিয়ে বুকিং রেজিষ্টার খুলে বলে, “এই মেলটা তুমি করেছো তো?”

“তুমি আর আমি ছাড়া আর তো কেউ এখানে মেল করেনা। তুমি না করে থাকলে আমিই করেছি”

রাগিনী খুব হাল্কাভাবে বলে। চোখ নিজের হাতের রেজিষ্টারে।

“তুমি জায়গা থাকতেও রিফিউজ করে দিলে? কেন? তুমি একে চেন?” রূপম উত্তেজিত স্বরে বলে। রাগিনী উত্তর না দিয়ে আলমারীতে ঢুকিয়ে রাখছিল নিজের হাতের রেজিষ্টারটা। সম্ভবতঃ ওর কাজ হয়ে গেছে।

“কি হল উত্তর দিচ্ছ না কেন? কেনওওও? বল চেন একে?” রূপম রাগিনীর এক কাঁধ ধরে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। রাগিনী ওর কাঁধ থেকে রূপমের হাতটা শান্তভাবে ধরে সরিয়ে দেয়। একবার দেখে নেয় আশেপাশে আর কেউ আছে কিনা। কেউ নেই দেখে এবার রূপমের আধহাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেটে কেটে বলে, “এখানে কাকে রুম দেব আর কাকে দেব না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাওয়ারটা আমার। আমি ম্যাডাম ছাড়া আর কাউকে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। ভবিষ্যতে আর কোনদিনও এভাবে কথা বলবেনা আমার সঙ্গে।”

রাগিনীর চোখে চোখ রেখে স্থির দাঁড়িয়ে ওর কথাগুলো শুনছিল রূপম। এবার ও থামলে বলে

“আমার প্রশ্নের উত্তরটা এখনো পাইনি।”

রাগিনী চুপ করে গিয়েছে। কিছু যেন ভাবছে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। ওখানে ইঁটের ওপর দিয়ে ফলস দেওয়াল করে সাজানো হয়েছে কিছু শুকনো শ্যাওলায় ভরা বেড়ার সেপারেটর। দেখে মনে হবে একটা সুসজ্জিত কুঁড়েঘর। কিন্তু ভেতরে একটা দস্তুরমতো বিল্ডীং এর অংশ। সেইখান দিয়ে আস্তে আস্তে জ্বলে উঠছে একটা দুটো চাঁদের আলো রঙ বাল্ব। যেন কোনদিনও আগে এরকমটা দেখেনি এভাবেই তাকিয়েছিল রাগিনী। হঠাত যেন ঐ আলো জ্বলে ওঠাটাই ওর কাছে সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে, আর সব ফাঁকি। এমনইভাবে তাকিয়ে থাকে রাগিনী। যেন রূপমের প্রশ্ন ওর কানে যায়নি।

রূপম বুঝতে পারেনা রাগিনী ইচ্ছে করে ওকে পাত্তা দিচ্ছেনা, নাকি সত্যিই ও বিশেষ কিছু ভাবছে অন্যদিকে তাকিয়ে। শুধু নিজের মাথার মধ্যে, সারা শরীরে বয়ে চলা অসহ্য তাপবাহী শিরা ধমণীগুলোর মধ্যে চামড়ার কোষে কোষে শিরশির জাগানো এক অজানা অনুভূতির মধ্যে টের পায় এই মূহূর্তে সামনে দাঁড়ানো ওই মেয়েটাকে পিষে ফেলতে পারলে যেন এতদিন মনে চেপে রাখা সমস্ত মেয়ে জাতটার ওপর ওর অসম্ভব এক বিদ্বেষ আর রাগ এক অন্যায়ের আগুনে পুরিয়ে ছাই করে ফেলা যাবে। অগ্রপশ্চাৎ কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা থাকেনা রূপমের। রাগিনীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে নিজের ঘরে।

“কি করছো? এভাবে হাত ধরে থেকোনা। ছাড় আমাকে। সবাই দেখবে …” রাগিনী ওকে শান্ত করার চেষ্টায় বলে। সে নিজেও অবাক হয়েছে প্রচন্ড। রূপমকে প্রথম থেকেই সবাই এখানে শান্ত ভদ্র ছেলে হিসেবে দেখেছে। সেই ছেলে যে এরকম উগ্র মারমুখী হয়ে উঠতে পারে তা রাগিনীর কল্পনার বাইরে।

“চুপ! একটাও কথা নয়। আমার ঘরে এসো …” হাত ছেড়ে দিয়ে হন হন করে রূপম নিজের রুমের দরজা খুলে ফেলতে চায় ঝন ঝন শব্দে তালায় বাড়ী মেরে। পেছন থেকে রাগিনী ওর দিকে চাবি এগিয়ে দেয়।

“উফফফ… আমার ঘরের চাবিটাও তোমার সঙ্গে সঙ্গে রাখা থাকে? কেন? কেন? ডিসগাষ্টিং …” চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলে রূপম। রাগিনী প্রথম ধাক্কার অবাক ভাবটা সুন্দরভাবে হজম করে নিয়েছে। এখন শান্তগলায় বলে, “এখানকার সব ঘরেরই ডুপ্লিকেট চাবি আমার কাছেই থাকে সবসময়। মাথা ঠান্ডা হলেই এটা তোমার মনে পড়বে। এখন লস্যি খাও …”

“লস্যি?” অবাক চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রূপম দেখে দীনুদা ট্রের ওপর দুগ্লাস লস্যি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাগিনী একটা নিজে নেয় আরেকটা রূপমের হাতে তুলে দেয়।

“এটা? কখন তুমি…”

“ওই তো যখন তুমি আমায় টেনে নিয়ে আসছিলে। পেছনেই দীনুদা আসছিল। ওকে ইশারায় বলে দিলাম নিয়ে আসতে …। আমি বুঝেছিলাম তোমার লস্যি খাওয়া দরকার।” একটুও না হেসে গম্ভীর ভাবে কথাগুলো বলে যেতে যেতে নিজের গ্লাসে চুমুক দেয় রাগিনী।

কি যে আছে এই মেয়েটার মধ্যে! রূপম আর যুদ্ধ করতে পারেনা নিজের রাগ অসহিষনুতার সঙ্গে। দু’পা ছড়িয়ে গ্লাস হাতে নিয়ে বসে পড়ে ঘরে রাখা একমাত্র চেয়ারে। ওর সামনের সিঙ্গল খাটের ধারে খুব স্বাভাবিকভাবে বসে থাকে রাগিনী। লস্যি খেতে খেতে এমনভাবে তাকায় চারদিকে যেন এই প্রথম ও এই ঘরে এল। অথচ প্রতিদিন রূপমের অজ্ঞাতে নিজে দাঁড়িয়ে এই ঘর পরিস্কার করিয়ে যায় ও। কোথায় কি প্রয়োজন সে সবদিকে তীক্ষ্ণ নজর থাকে তার। রূপম আন্দাজ করলেও কোনদিন এই নিয়ে একটা শুকনো ধন্যবাদও দেয়নি কখনো। আজকেও ঘরের কোনে নতুন টাঙ্গানো ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো স্ট্যান্ড ল্যাম্পটার দিকে দেখলেও কিছু বলল না। সমস্ত কটেজে এরকম ডেকর করা হয়েছে জানে রূপম। কিন্তু সেটা গেষ্টদের জন্য বরাদ্দ। ওর মত স্টাফের জন্য সাধারণ থেকে সাধারণ ব্যবস্থা। সেখানে ওর রুমটা এখন যে কোন হায়ার ক্লাস কটেজরুমের চেয়েও সুন্দর ভাবে সাজানো। এই সবকিছু রাগিনীর জন্য হয়েছে। একমাত্র এই মহিলা কিচ্ছু জানিনা, শুনিনা ভাব করে দিনে দিনে রূপমের সমস্ত সাধারণ অভ্যাসগুলো পালটে দিচ্ছে। ওর খাওয়া শোওয়া এমন কী কখন কোনটা পরবে সেদিকেও ধীরে ধীরে প্রোব করে যাচ্ছে। হ্যা, প্রোব ছাড়া আর কোন শব্দ রূপমের মাথায় আসেনা। খুব ধীরে যেন ওর জীবনের সঙ্গে নিজেকে, নিজের ইচ্ছা পছন্দ ভাললাগা সবকিছুকে মিশিয়ে দিচ্ছে এই মহিলা।

কিন্তু কেন? কী সম্পর্ক ওর রূপমের সঙ্গে? একদৃষ্টিতে হাতের লস্যিভরা কাঁচের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, কাঁচের গায়ে বিন্দ বিন্দু জমে ওঠা জলের দাগের গায়ে দেখতে দেখতে রূপমের মাথায় আবার সেই একই প্রশ্ন কাঁটা হয়ে খোঁচা দিতে থাকে। এই ঘরের দিকে যখন ও রাগিনীকে নিয়ে আসছিল নিতান্ত অসভ্য একটি বর্বর মানুষের মত, তখন ওর ইচ্ছে হচ্ছিল সমস্ত শক্তি দিয়ে এই মেয়েকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ও নিজের প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করে নেয়। কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে রাগিনীর আশ্চর্য শান্ত ব্যবহার ওকেও যেন পালটে দিল। এখন আর সেই ইচ্ছেটা জাগছে না ভেতরে। বরং ও নিজেও যেন অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে। শুধু সামনে বসে থেকেই কিভাবে একজন মানুষের মনের ভেতরের আগ্নেয়গিরিতে জল ছেটানো যায় তাও কী অসম্ভব ভাল জানে এই মহিলা! কই আর তো সেই বিচ্ছিরি রাগটা হচ্ছেনা রূপমের! এখন ও কেমন শান্তভাবে বসে বসে লস্যির গ্লাসে চুমুক দিতে পারছে।

নিজের অবস্থা এবং অবস্থা পরিবর্তন চিন্তা করে এবার হাসি পেয়ে যায় রূপমের। এমনকি একটু বোধহয় হেসেও ফেলে থাকবে ও। রাগিনীর দিকে বিশেষ তাকায়নি এতক্ষনের মধ্যে। নিজের চিন্তাতেই ডুবে ছিল। রাগ থাকুক আর নাই থাকুক কৌতূহল তো আছেই। ওকে জানতে হবে রাগিনীর বিষয়ে। কেন এই স্পেশ্যাল কেয়ারগুলো পাচ্ছে রূপম, কেন মিসেস সুচরিতা ঘোষকে কটেজ থাকা সত্ত্বেও রিগ্রেট লেটার দেওয়া হল, কেন ডাকার আগে আগেই তরুণ চলে আসে মেঝে পরিস্কার করতে, কেন কেন কেন …। এই ছ’মাসের ইতিহাসে অজস্র কেনর আবর্তন রূপমের মনের চারপাশে।

“হাসছো যে? আর কোন কাজ নেই তোমার আজ? আমাকেও যে ডেকে নিয়ে এলে ঘরে? তাহলে এবার চল পুরো রিসর্টটা একবার ঘুরে আসি। গাছগুলো দেখে আসি একটু। বেলিফুলের ঝাড়টা …পুকুরের ধারে …”

কথা শেষ না করে উঠে দাঁড়ায় রাগিনী। বাথরুমটা খুলে উঁকি মেরে বলে, “উফফ এদের একটা কথা হাজারবার বলতে হবে। …দীনুদা আ আ দীনুদা আ…”

দীনুদা কোথায় যে ছিল কে জানে। এক মিনিটের মধ্যে এসে দাঁড়ায়।

“বাথরূম ফ্রেশনারটা পাল্টাতে বলেছিলাম মনে নেই? জেসমিন নিয়ে এস…”

চলে যায় দীনুদা। এখানে রাগিনীর কথাই শেষ কথা। কেউ তার কোন কথায় কাজে কোন প্রশ্ন তুলবেনা শুধু তামিল করবে এটাই ম্যাডামের অর্ডার। কেউ তার বাইরে নয় শুধু রূপম কেন যে মানতে পারছে না! সে উঠে আসে চেয়ার ছেড়ে।

“রাগিনী, তুমি কে?”

ধীর গম্ভীর ঠান্ডা গলার স্বর রূপমের, “তুমি এটাও কী করে জানলে যে জেসমিন আমার প্রিয় গন্ধ!”

রাগিনী ব্যস্ত ছিল নতুন লাগানো পর্দার কুঁচিটা চেক করতে। একটুও আশ্চর্য না হয়ে, একবারও রূপমের দিকে না তাকিয়ে সে বলে, “কারণ আমিও জেসমিনের গন্ধ ভালবাসি, সিম্পল।”

“আর সুচরিতা? তাকে তুমি আসতে দিলেনা …”

এবার হাতের কাজ ফেলে রূপমের একদম সামনে এসে দাঁড়ায় রাগিনী। স্পষ্ট চোখে তাকায় রূপমের দিকে, “কারণ আমি চাইনি সে আবার তোমার সামনে এসে দাঁড়াক, তার অশুভ দৃষ্টি দিয়ে তোমার অতি কষ্টে তৈরি এই শান্তির জায়গাটুকুতে অশান্তি ছড়িয়ে দিক। অনেকটা জীবন তোমার কেড়ে নিয়েছে সে, এখন এই রূপমের ওপর তার আর কোন অধিকার নেই। পৃথিবীতে রিসর্টের অভাব নেই কোন। সে তার স্বামীর সঙ্গে যে কোন জায়গায় যেতে পারে, শুধুমাত্র জাগরন ছাড়া।”

রূপম স্থির হয়ে যেতে থাকে রাগিনীর কথাগুলো শুনতে শুনতে। রাগিনী ক্রমশঃ ওর এত কাছে চলে এসেছে, এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে ওর কোমড় এবং গলা, এমন কোমলে কঠিনে মেশা ছোঁয়ায় ওকে জাগিয়ে তুলেছে যে সমস্ত অস্থিরতা শুধু এক জমাট বরফ পাহাড়ের গলনাঙ্কের কাছাকাছি অধৈর্য্ তীতিক্ষায় রূপমকে নবজন্মদান করতে চেয়ে আস্ফালন করে। রূপম বোঝেনা এই নবজন্মের হাতছানি ওকে বাঁচিয়ে তুলবে নাকি আবার এক অমোঘ মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাবে। রূপম সমস্ত শক্তি দিয়ে রাগিনীকে ঠেলে সরাতে যায় কিন্তু সেই শক্তিটাও বোধহয় ওর মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। কোনমতে শুধু হাঁফ ধরানো গলায় বলতে পারে, “কী করছো তুমি! আয়না ভেঙ্গে গেলে তাতে মুখ দেখা যায়না …”

“অনেক জিজ্ঞাসা তোমার তাই তো? সব প্রশ্নের একটাই উত্তর। তোমার চোখ থাকলে সেই উত্তরটা অনেক আগেই খুঁজে পেতে। এভাবে অন্ধকারে হাতরে মরতে হতনা …”

“মানে? এবার আমায় তোমার হেঁয়ালী শুনতে হবে, তাই তো?” একটু আগের বিহবল অবস্থা কাটিয়ে রূপম বলে। রাগিনী অনেকটা সরে গেছে এখন। ওর চোখেমুখে ফুটে উঠেছে রিসর্টের প্রধান প্রশাসকের গাম্ভীর্য। এবারে সে গিয়ে বসেছে রূপমের ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটায়। চোখ তুলে বলে, “হ্যাঁ বল কী তোমার প্রশ্ন।”

“তুমি সুচরিতা…”

হাত তুলে রূপমকে থামিয়ে দেয় রাগিনী, “তোমাকে একটু ডিটেলে শুনতে হবে। হ্যাঁ আমি সুচরিতা ঘোষ অর্থাৎ চিনুকে চিনি, আই মীন চিনেছি। আমি তোমার বাড়ী গিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে কথাও বলেছি।

“হোয়াট? তুমি আমার বাড়ী গিয়েছিলে? কবে? কেন?”

রাগিনী ছেলেমানুষকে প্রবোধ দেওয়ার মত করে হাসে, “বা রে, যার সঙ্গে নিজের বাকী জীবনটা জড়াতে যাচ্ছি তার সবটা জেনে বুঝে দেখে নিতে হবেনা?”

রূপম বুঝে উঠতে পারেনা কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে। স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে শুধু বলে, “তুমি জান কি বলে যাচ্ছ?”

“অবশ্যই জানি। আমি না জেনে বুঝে কিছু বলিনা, করিও না। প্রথমে তোমার ডায়েরী থেকে জানতে পেরেছিলাম চিনুর কথা, মিঠির কথা। তারপর…”

“এই, ওয়েট ওয়েট…, তুমি আমার ডায়েরী পড়েছো? কবে? কেন?”

রাগিনী আঁচল মুঠো করে ধরে চিন্তিত হয়ে দেওয়ালের দিকে তাকায়, “নাহ, এবার এই ঘরে একটা এ সি লাগাতেই হবে। তবে সেটার জন্য ম্যাডামের পারমিশন লাগবে …, হ্যাঁ কি বলছিলে? কবে পড়েছি সেটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়। মিঠির চ্যাপ্টারটা ওর মৃত্যুর পরে জানলাম। ওটা ছোট খাতাটায় ছিল। চিনুর ব্যাপারটা অনেক আগে থেকেই জানি। কেন পড়েছি? প্রাণের দায়ে। দায় বোঝ? জানতাম বুঝবে না …যাকগে, আর কিছু বলার আছে তোমার? আরো কোন খাতা আছে কি?”

উঠে দাঁড়ায় রাগিনী, “আর শোন, আমি ঠিক লুকিয়ে ডায়েরী পড়া ধরনের মেয়ে নই, এটা ভাল করে জেনে নাও। পড়েছি কারণ তোমার চোখে লেগে থাকা যন্ত্রণাটা আমায় প্রথম দিন থেকে হন্ট করেছিল। তারপর যেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখেও ঐ একই ছায়া দেখতে পেলাম সেদিনই ঠিক করেছিলাম দু’জন মানুষের একই সাথে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে একসাথে আনন্দে বাঁচা ভাল। কিন্তু তোমার মাথায় ভগবান এটুকু সেন্সও দেননি যে একজন ভদ্রমহিলাকে এত কষ্ট দিতে নেই, তাকে স্বীকার করে কাছে ডেকে নিতে হয়।”

রূপম সারা শরীরে একটা অদ্ভুত কাঁপুনি টের পায়। আবার একটা ঝোড়ো হাওয়া যেন প্রবল দাপটে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, শুকনো পাতার মত ওকে উড়িয়ে নিতে চাইছে নতুন কোন গ্রহে যেখানে হয়তো বা আরো কঠিন কোন দমবন্ধ মৃত্যু ওর জন্য অপেক্ষা করছে। রাগিনীর কথাগুলো ওকে

সমস্ত বোধশক্তির উর্ধ্বে কোন অলীক জগতে নিয়ে যায়। মুখ দিয়ে শুধু কেটে যাওয়া রেকর্ডের মত একটাই কথা বেরিয়ে আসতে থাকে, “ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা যায়না … না তুমি জাননা … কোথাও ভুল হচ্ছে তোমার, অনেক বড় ভুল …”

রাগিনী আবার রূপমের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একদম কাছে। যতটা কাছে এলে শোনা যায় হৃদয়ের শব্দ। রূপমের ঠোঁটের কাছে গরম নিঃশ্বাস, একটা নরম ছোঁয়া মূহূর্তে জমে থাকা বরফে আগুন ধরাতে চেয়ে অকম্প শিখার মত নিজেকে এগিয়ে আনে, এ আলো এমন যা শত ঝড়েও নেভেনা।

“কে বলল ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা যায়না? আমি দেখছি তো! তুমি বোঝনি গত প্রায় ছ’মাস ধরে রোজ দেখি নিজেকে! সারাজীবন দেখব। আমি তোমার মিঠি নই চিনু নই। আমি পালাতে শিখিনি ভাঙ্গতেও শিখিনি।”

কখন যে পাথরের মত নিষ্প্রান এলিয়ে থাকা রূপমের হাতদুটো রাগিনীকে জড়িয়ে ধরেছে ও নিজেও জানেনা। মনে হয় ফোঁটায় ফোঁটায় শিশির ঝরে পড়ছে ওর জমাটবাধা কঠিন শরীরে মনে।

বেশ কিছুক্ষণ সময় বয়ে গিয়েছে। রূপমের বুকের ওপর বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছে রাগিনী। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমের ঘোরে বোধহয় স্বপ্ন দেখছে কোন সুন্দর দিনের যেখানে নেই অকারণ আঘাত আর পলায়নপরতা। আর রূপমের জিভে সদ্য লেগে থাকা এলাচের গন্ধটা ওর মাথায় জন্ম দিচ্ছে নতুন এক বিশ্বাসের কুঁড়ি। দরজায় মৃদু করাঘাতে ভেঙ্গে যায় সেই স্বপ্ন।

কিছুটা বিস্রস্ত হয়ে থাকা শাড়ীর আঁচল সামলে রাগিনী ডাকে,

“এসো দীনুদা …”

দীনুদা ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠে রাগিনী বলে, “এ কি? কি কান্ড করেছো?”

দীনু নামের সংসারবহির্ভূত নিজের ঘোরে থাকা মানুষটি একখানা জুঁই ফুলের গাছভর্তি বড় টব ঘাড়ে করে ঘরে ঢোকে। একগাল হেসে বলে,

“তুমি তো বললে জ্যাসমিন আনতে!”

“দীনুদাআআ আমি জেসমিন বাথরূম ফ্রেশনার আনতে বলেছি …”

দীনুদা হাসে, “তাতে কি? আমি লাইফ ফেশনার আনলাম। আমি তো জানি তোমরা দুজনেই জ্যাসমিন ভালবাস। এখানা এই বারান্দায় থাক। এই গন্ধ শুধু তোমাদের দুইজনকার। রোজ দুজনায় মিলে ভালবাসার জল ঢালবে, তবে তো ফুল ফুটবে।”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *