রাডয়া আশহর
অনুবাদ – বিতস্তা ঘোষাল
(লেখক পরিচিতি: জন্ম ১৯৪৬ সালে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। পি এইচ ডির বিষয় ছিল আফ্রো-আমেরিকান সাহিত্য। প্রাক্তন অধ্যাপিকা, ঔপন্যাসিক, গল্পকার। ১৯৭০ এর শেষের দিকে লেখালিখির শুরু। পাঁচটি উপন্যাস, গল্পগুচ্ছ, এবং আমেরিকায় থাকাকালীন স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়। তাঁর উপন্যাস Granada-র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত।)
খোলা জানলা দিয়ে আমি দেখতে পেলাম তিনটে ছায়ামূর্তিকে। দেখে মনে হচ্ছিল এক পুরুষ ও এক নারী এমনভাবে লেপ্টে আসছে মনে হচ্ছিল একটাই শরীর। তারা খুব ধীরে সুস্থে হাঁটছিল, যেন আগামী বছরকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল নিজেদের দেহে। তাদের ডান-বামে কেউ ছিল না। পেছনে লেজের মতো একটা ছোট্ট মেয়েকে দেখা গেল অবশেষে।
ভদ্রলোক ও মহিলা আমি যে বাড়িতে কাজ করি সেই বাড়িতেই এলেন। তাদেরকে আমার বানানো চা আর কেক (কেক আমি সচরাচর বিশেষ দিনেই বানাই) পরিবেশন করে বারান্দায় এলাম কাচা জামা-কাপড়গুলো গুছিয়ে তোলার জন্য। প্রত্যাশা মতোই হার কাঁপানো ঠাণ্ডা হাওয়া বারান্দায়, আসলে এই আবাসনের সামনের রাস্তার ওপাশেই সমুদ্র সৈকত।
আমি দড়ি থেকে একটা একটা করে জামা কাপড় তুলে আলাদা আলাদা করে ভাঁজ করে সেগুলোকে একটা বড়ো বাস্কেটে গুছিয়ে রাখছিলাম। হঠাৎ-ই সিঁড়ি থেকে একটা আওয়াজ কানে ভেসে এল। প্রথমে ভাবলাম বুঝি বিড়াল, কিন্তু আওয়াজটা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় সিঁড়ির দিকে ঝুঁকে দেখতে গেলাম সেখানে কি হচ্ছে। আমাদের ঘর রাস্তার দিকের প্রথম তলায়। ডান দিকে পাঁচটা সিঁড়ি উঠে গিয়ে ঘরের দরজা। প্রথমে ভালো করে কিছু দেখতে না পেলেও যখন আরও কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, তাকে দেখতে পেলাম – সেই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা – সিঁড়িতে বসে একা।
-“তুমি এখানে কি করছ?”
-“অপেক্ষা করছি।”
-“কার জন্য?”
-“আমার মালিক আর মালকিনের জন্য।”
-“তোমার মালিক?”
-“হ্যাঁ। তারা তোমাদের ঘরে এসেছেন।”
-“কিন্তু তুমি কেন এখানে অপেক্ষা করছ? তোমার যদি কিছু বলার বা নেওয়ার থাকে দরজায় টোকা দিয়ে ভিতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নাও, তার পর চলে যাও।”
মেয়েটি নিজের জায়গায় সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ ছিল বারান্দার দিকে।
-“আমার তাদের থেকে কিছু নেওয়ার নেই। তারা আমাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে এবং বলেছে-‘নাড্যা, তুমি এখানেই অপেক্ষা করো, যতক্ষণ না আমরা ওদের সঙ্গে দেখা করে ফিরছি।’ বলেই সে বলল- “আমি কিছু জুঁই ফুল তুলতে পারি?”
-“তোমার শীত করছে না?” আমি জানতে চাইলাম।
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে বলল- “আমার খুব ভালো লাগে জুঁই ফুল তুলতে। কিন্তু আমি বেশি নেব না।”
-“বেশ, এদিক দিয়ে এসো। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।” আমি তাকে সিঁড়ি দিয়ে বাগানে আসার রাস্তাটা বলে দিলাম, যে পথটা ঘরের বাইরে দিয়ে রান্না ঘরে এসে মিশেছে।
-“কিন্তু আমার মালিক!”
-“আমি তাদের বলে দিচ্ছি তুমি আমার সঙ্গে রান্না ঘরে রয়েছ।”
আমি দরজা খুলে বাচ্চাটাকে ঘরে ঢোকাবার পর আলোয় তাকে ভালো করে দেখলাম। দূর থেকে যেমন মনে হচ্ছিল তার থেকেও ছোটো। রোগা, রুগ্ন চেহারা। খুব বেশি হলে ছয় বা সাত বছর বয়স। তার পরনে নীলের ওপর কমলা ফুলের ছোপ ছোপ একটা সাধারণ সুতির পাতলা জামা, মাথায় নীল দোপাট্টা জড়ানো, পাতে হাওয়াই চটি।
আমি তাকে সেখানে বসিয়ে বসার ঘরে গিয়ে আমার মালকিনকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘অতিথিদের সঙ্গে আসা বাচ্চা মেয়েটি আমার সঙ্গে রান্না ঘরে আছে।’
আমার মালকিন তা শুনে অতিথিদের দিকে ঘুরে তাকালেন, তাদের মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠল।
-“কাকু আপনি বলেননি তো আপনাদের কাজের মেয়েকে নিয়ে এসেছেন?” মালকিন তাদের উদ্দেশ্যে বললেন।
-“আমরা তাকে খেলার জন্য সিঁড়িতে রেখে এসেছি।”
-“ওকে রান্না ঘরেই রাখো, বাইরে প্রবল ঠাণ্ডা বাতাস বইছে।”
কারুকার্য করা কালো বড়ো লাল ফুল লাগানো পশমের চাদরে পা থেকে মাথা অবধি আবৃত করা ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন,
“ঠাণ্ডা যখন এতই, এই জানলাটা ভালো করে লাগিয়ে দাও, সানিয়া।”
-“হ্যাঁ, ম্যাডাম,” বলে আমি জানলাটা টেনে দিয়ে রান্না ঘরে ফিরে এলাম। আসার আগে মহিলাকে এক নজরে দেখলাম। বড়ো মুখ, সরু কাঁধ, বড়ো নিতম্ব, ওপরের অংশ তুলনায় কম ভারি, শরীরের ওপর অংশ আর নীচের অংশের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই।
রান্না ঘরে এসে আমি কেটলিতে করে চা বসালাম, তার পর ইলেক্ট্রিক বোর্ডে ইস্ত্রির প্লাগ লাগিয়ে ইস্ত্রি করার জন্য জামা রাখলাম আইরন প্লেটে।
-“আমি সাহায্য করব?” বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করল।
আমি তার কথা শুনে হেসে বললাম, “তুমি ইস্ত্রি করতে পারো বুঝি!”
সে গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, “আমার মালকিন বলেছে, আমি কোনো কাজই ঠিক মতো পারি না, কিন্তু রান্নার কাজটা আমাকে মন দিয়ে শিখে নিতে হবে। আমি চেষ্টা করছি শিখতে।”
আমি তাকে কাপে করে গরম চা আর আমার বানানো কেক থেকে একটা বড়ো টুকরো দিলাম খেতে।
আমার মালকিন ডাকছিলেন, ওকে দিয়ে যাও, ওর মালিকরা যাবার জন্য প্রস্তুত।
মেয়েটি উঠে পড়ল তাদের সঙ্গে যাবার জন্য। আমি বসার ঘরে গিয়ে এঁটো কাপ প্লেট আশট্রে নিয়ে এলাম পরিস্কার করার জন্য। সারা ঘর ধোঁয়ায় ভরতি। ঘরটা বদ্ধ লাগছে হাওয়া চলাচল হচ্ছে না বলে। আমি জানলাটা খুলে দিলাম, একটা শীতল বাতাস সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে এল। আর তখনি চাঁদনী আলোয় আমি ওদের রাস্তার দিকে মিশে যেতে দেখলাম।
অনুবাদক পরিচিতি- বিতস্তা ঘোষাল এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কথা সাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। আধুনিক ইতিহাসে এম এ, লাইব্রেরি সায়েন্সে বিলিস। কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। বাংলায় অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকার’ সম্পাদক ও প্রকাশনা সংস্থা ‘ভাষা সংসদ’-এর কর্ণধার। ‘বাংলা আকাদেমি সারস্বত সম্মান’ ‘বিবেকানন্দ যুব সম্মান’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক’ পুরস্কার, ‘কেতকী’ কবি সম্মান, ‘চলন্তিকা’ সম্মান, ‘বিজয়া সর্বজয়া’, ‘গৌতমী’, ‘জলধর সেন স্মৃতি সম্মান’, ‘মদন মোহন তর্কলঙ্কার সম্মান’, ‘আরাত্রিক সাহিত্য সম্মান’ সহ একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত। প্রকাশিত বই ৩৬টি। তাঁর কবিতা ও গল্প হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজি, স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে। ওড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত তাঁর গল্প সংকলন ‘রূপকথার রাজকন্যারা’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘হিরন্ময় পুরুষ’ বিপুল ভাবে পাঠক আদৃত হয়েছে।)
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন