onubad-gorto

গর্ত
অ্যালিস মুনরো
অনুবাদ – বৈশাখী ঠাকুর


(লেখক পরিচিতি: অ্যালিস আন মুনরো (1931-2024) একজন কানাডিয়ান ছোটগল্পকার যিনি ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করেন। চারিত্রিক বৈশিষ্টের সাথে সাথে সাধারণ মানুষের গভীর ও জটিল মনোগত দিক প্রকাশ পেয়েছে তার গল্পে। মুনরোর লেখায় উপমার ব্যবহার ও বর্ণাত্মক ভঙ্গিমা উল্লেখযোগ্য।)

সেই সময় আমরা একটা নুড়ি-পাথরের গর্তের পাশে থাকতাম। খুব একটা বড় নয় যেটা কোন রাক্ষুসে মেশিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, বরং ছোট গর্ত যা থেকে কোন কৃষক হয়তো বেশ কিছু টাকা রোজগার করেছে অনেক বছর আগে। সত্যি কথা বলতে, গর্তটা তেমন গভীর ছিল না, কারুর মনে হতেই পারে এর অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল— কোন বাড়ির ভীত তৈরির লক্ষ্যে যেটা পরে বানচাল হয়ে যায়।

আমার মা এটার প্রতি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে। “আমরা ওই পাথরের গর্তের পাশে থাকি, স্টেশন রোডে” সে হেসে হেসে লোকেদের বলত কারণ তখন মা ভীষণ খুশী ছিল বিগত জীবনের সব কিছু ঝেড়ে ফেলে—- সেই রাস্তা—সেই বাড়ি—স্বামী—তার আগের জীবন!

আমার সেই জীবনের কথা প্রায় কিছুই মনে নেই। আমার কিছু জিনিস মনের স্মৃতিতে ধরা আছে কিন্তু সুতোগুলো নেই যা দিয়ে পুরো ছবিটা তৈরি করতে পারি। ওই বাড়ির মূলতঃ যে স্মৃতি আমার মাথায় আছে তা হল দেয়ালে লাগানো টেডি বীয়ারের ওয়াল পেপার। আমার যখন নতুন এই বাড়িটায় আসি, আমার দিদি, সারো পুরনো বাড়ীর অনেক কথা বলে আমার স্মৃতিকে উস্কে দিতে চাইত। আমরা যখন বিছানায় একসাথে শুতাম, তখন ও এইসব কথা বলত আর এই বাক্যালাপ শেষ হত আমার সব বিস্মৃতি দিয়ে যাতে ও অসন্তুষ্ট হত ভীষণভাবে।

গ্রীষ্মের সময় আমরা নতুন বাড়িতে ঢুকেছিলাম। আমাদের কুকুর, ব্লিজি আমাদের সঙ্গে ছিল। মা বলেছিল,
—– ব্লিজির জায়গাটা খুব পছন্দ। আর সত্যিই তাই। কোন কুকুরই বা টাউনের ঘর বাড়ির বদলে মফঃস্বলের খোলামেলা পরিবেশকে বেশি পছন্দ করবে না! রাস্তা দিয়ে যত গাড়ি যেত, প্রত্যেকটা গাড়ির দিকে তাকিয়ে উচ্চেস্বরে ভৌ ভৌ করত যেন রাস্তাটার মালিক ব্লিজি স্বয়ং। মাঝেমাঝেই আবার কোন কাঠবেড়ালি বা অন্য কোন ছোট প্রাণীকে মেরে নিয়ে আসত। সারোর সেটা ভাল লাগত না। তখন নীল তাকে বোঝাতো কুকুরদের প্রকৃতি সমন্ধে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার খাতিরে কিভাবে এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীকে মেরে খাদ্য সংগ্রহ করে।

“ও তো খাবার পায় আমাদের কাছ থেকে। “সারো তর্ক জুড়ত।

“হয়তো ঠিক মত পায় না। যদি কোনদিন আমরা ওকে হারিয়ে ফেলি, তখন ওর খাওয়ার ব্যবস্থা ওকে নিজেকেই করতে হবে।”

“আমি ওকে কখনো হারিয়ে যেতে দেব না। আমি সবসময় ওকে চোখে চোখে রাখব।”

নীল পেশাগতভাবে অভিনেতা ছিল। শহরে যে বাণ্যিজিক থিয়েটার হত, নিত্যনতুন চিন্তাভাবনার পসরা নিয়ে, তা নিয়ে কারুর কারুর উন্মাদনার শেষ ছিল না। আবার কেউ কেউ চিন্তিত থাকত নতুনত্বের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আমার মা এবং বাবা এই নাট্যচর্চাকে সমর্থন করত, মা সক্রিয়ভাবে কারণ তার হাতে সময় ছিল বেশি। আমার বাবা ইন্সিওরেন্স এজেন্ট ছিলেন এবং যাত্রা করতে হত প্রচুর। আমার মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল থিয়েটারের জন্য অর্থ সংগ্রহে এবং বিনা পয়সায় সঞ্চালনার কাজ করত অবলীলায়। মা ছিল আকর্ষণীয় এবং বয়সের তুলনায় ছোট দেখাত, ফলে অনেকেই অভিনেত্রী ভেবে ভুল করতেন। মা তখন অভিনেত্রীদের মত সাজপোশাকেও মনোযোগী হয়েছিল। গায়ে চাদর, লম্বা স্কার্ট, গলায় ঝুলছে লম্বা মালা। অবিন্যস্ত চুল খোলা রাখলেও, কোন মেকআপ করত না। তখন এই পরিবর্তনগুলো আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। আমার মা আমার চোখে আমার মা ছিল। কিন্তু সারোর চোখে পড়েছিল এই বদল। আর আমার বাবা! আমি যতটুকু আমার বাবার প্রকৃতি সমন্ধে জানি, তিনি নিশ্চয়ই গর্ব বোধ করতেন নিজের স্ত্রীকে নিয়ে যে কি ভালই না দেখাচ্ছে এই মুক্ত সাজ-সজ্জায় এবং কি ভাল ভাবে থিয়েটারের লোকজনের সঙ্গে মিশে গেছে। পরবর্তীকালে যখনই এই নিয়ে কথা উঠেছে বাবা বলত যে উনি সবরকম শিল্পকে স্বীকৃতি দেওয়া পছন্দ করেন।

তবে এর পরেই একটা পরিস্থিতি আসে যার পূর্বাভাস পাওয়া গেছিল কিন্তু আমার বাবা বুঝতে পারেননি। আমি জানি না অন্য কোন স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে এমনটা হয়েছিল কিনা! আমার মনে নেই তবে আমার বাবা নাকি একটা গোটা দিন শুধু কেঁদেছিলেন, মাকে চোখের আড়াল না করে সারা বাড়ি মায়ের পেছন পেছন ঘুরেছিলেন কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজি ছিলেন না। আর বাবাকে কোন সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে, মা বাবার পুরো মনোবলটাই ভেঙে দিল।

মা ঘোষণা করল, সন্তানটা নীলের!

মা কি নিশ্চিত ছিল?

অবশ্যই।

তারপর কি হল?

বাবা কান্নাকাটি বন্ধ করে দিলেন। বাবাকে কাজে ফিরে যেতে হত। মা আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নীলের সঙ্গে থাকতে এই পাথরের গর্তের পাশে চলে এল। পরে অবশ্য মা বলেছিল, মাও নাকি কান্নাকাটি করেছিল। কিন্তু মা এও বলেছিল যে নতুন জীবনে সে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। হয়তো জীবনে প্রথম বার মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল। মায়ের মনে হয়েছিল তাকে আবার একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে— নতুন করে জীবন শুরুর। সে তার রুপোর সেট, চায়না-বোন সেট মাড়িয়ে চলে এসেছে, তার ফুলের বাগান, বইয়ের তাকে সাজানো সারি সারি বই…। সে এখন বাঁচবে, আর পড়বে না। সে তার আলমারিতে দামী দামী সব কাপড় ঝুলিয়ে চলে এসেছে, জুতোর র‍্যাকে কতশত জুতো! লকারে তার হীরের আংটি, বিয়ের আংটি। ফিনফিনে সিল্কের সব রাতপোশাক। সে নগ্ন হয়ে কিছুদিন এই শহরতলীতে ঘুরে বেড়াবে ঠিক করেছিল, অন্ততঃ যতদিন আবহাওয়া গরম থাকবে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি কারণ সারো সেটা দেখেই লুকিয়ে পড়েছিল এবং নীলেরও আইডিয়াটা খুব একটা পছন্দ হয়নি।

কিন্তু এই সব নিয়ে নীলের কি ভাবনাচিন্তা ছিল? নীলের দর্শন ছিল, যা কিছু হবে তাকেই সে স্বাগত জানাবে। যা কিছু ঘটে সবটাই জীবনের উপহার। আমরা গ্রহণ করি এবং প্রদান করি।

যারা এরকম কথা বলে আমার তাদের প্রতি কিরকম সন্দেহ জাগে। যদিও সন্দেহ করার কোন অধিকার আমার নেই।

নীল প্রকৃত অর্থে অভিনেতা ছিল না। পরীক্ষানিরীক্ষা করতে সে অভিনয় জগতে প্রবেশ করেছিল। অভিনয় জীবন থেকে সে কি পেতে পারে – এটাই সে দেখতে চেয়েছিল। কলেজ ছাড়ার আগে, “ইডিপাস রেক্স”-এ সে একটা ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। সবার সঙ্গে মিলেমিশে এই কাজটা করতে তার ভাল লেগেছিল। তারপর একদিন টরন্টোর রাস্তায়, তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা, যে কিনা ছোট একটা শহরতলীর থিয়েটার কোম্পানিতে গ্রীষ্মকালীন একটা কাজের ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিল। হাতে ভাল কিছু করার ছিল না বলে, নীল তার সঙ্গী হল। শেষ পর্যন্ত বন্ধুটির বদলে, কাজটি পেল নীল। ব্যংকোর চরিত্রে তাকে অভিনয় করতে হবে।

থিয়েটার কোম্পানিটি কখনও ব্যাংকোর ভূতকে অদৃশ্য করত, কখনও দৃশ্যমান। এইবার তারা ভূতটিকে স্টেজে দেখাতে চায় এবং স্ক্রিপ্ট অনুসারে নীলের শারীরিক কাঠামো ছিল যথাযথ। শীতটা আমাদের শহরেই কাটানোর পরিকল্পনা, যখন মা তাকে চমকে দিয়েছিল নিজের পরিকল্পনার কথা শুনিয়ে। অবশ্য ততদিনে এই নুড়ি পাথরের খাদান নীলকে আকৃষ্ট করেছে।

সারোকে ইস্কুলও বদল করতে হয়নি। ইস্কুল বাস ওকে তুলে নিত আমাদের এই নতুন খাদান বাড়ির মোড়ের সরু গলি থেকে। ওকে শহরতলীর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে হয়েছিল আর শহরের বন্ধুদের অনেক কিছু ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে তবে এই নিয়ে কোন ঝামেলা হয়েছিল কিনা তা অবশ্য আমার জানা নেই।

ব্লিজি সবসময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত সারোর আসার অপেক্ষায়।

আমি কোন কিন্ডারগারটেন ইস্কুলে যাইনি কারণ আমার মায়ের কোন গাড়ি ছিল না। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে না মিশেও আমার বেশ চলে যেত। সারো বাড়ি থাকাই আমার জন্যে যথেষ্ট ছিল। আর মা অনেকসময়ই খেলাধুলোর মেজাজে থাকত। শীতের সময় যেমনি বরফ পড়ল, আমি আর মা একটা বরফ মানুষ বানালাম। মা বলল,
——এটার নাম কি নীল রাখব?
—— ঠিক আছে। তারপর তার মুখে চোখে আমরা হরেক জিনিস লাগাতে লাগলাম সেটাকে আরো মজাদার করে তোলবার জন্যে। তারপর আমরা ঠিক করলাম নীল ঘরে ফিরে এলেই আমরা চেঁচাব, “এই তো নীল! এই তো নীল!” এবং বরফমানুষের দিকে ইঙ্গিত করব। নীল গাড়ি নিয়ে ঢোকা মাত্রই আমি তাই করলাম এবং নীল গাড়ি থেকে বেড়িয়ে পাগলের মত চিৎকার করতে লাগল যে আর একটু হলে সে আমার ওপর দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে দিত।

এইটা সেই কয়েকটা বিরল মুহূর্তের মধ্যে একটা ছিল যেখানে নীল বাবার মত আচরণ করেছিল।

মায়ের নীলের সঙ্গে ভাল সময় কাটানোর সময় ছিল গভীর রাতে। যদি কখনও ঘুম ভেঙে বাথরুমে যাওয়ার হত, আমি মাকে ডাকতাম। সে খুশী মনে আসত কিন্তু কোন তাড়াহুড়ো করে নয়, এক টুকরো কাপড় বা স্কার্ফ জড়িয়ে—- সঙ্গে একটা গন্ধ যা আমাকে মোমবাতির আলো, সংগীতের মূর্ছনার কথা মনে করিয়ে দিত। আর ভালবাসার।

একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু সেই সময় আমি সেটার অত মানে খোঁজার চেষ্টা করিনি। ব্লিজি, আমাদের কুকুরটা খুব একটা বড় ছিল না, আবার এত ছোটও ছিল না যে সারোর কোটের নীচে ঢুকে যাবে। আমি জানি না সারো সেটা কিভাবে সম্ভব করে তুলেছিল। একবার নয়, দুবার। সারো তার কোটের নীচে ব্লিজিকে লুকিয়ে ইস্কুল বাসে উঠে গেছিল। কিন্তু তাকে নিয়ে সারো ইস্কুলে যায়নি, গেছিল শহরে আমাদের পুরনো বাড়িতে যেটা খুব একটা দূরে ছিল না আমাদের এই খাদান বাড়ি থেকে। নিঃসঙ্গ দ্বিপ্রহরের খাবার খেতে এসে বাবা তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন খোলা বারান্দায়। সবাই চমকে গেছিল ঠিক গল্প কাহিনির মত সে একা একা চিনে পুরনো বাড়িতে ফিরে গেছিল ভেবে। মনে আছে, সারো ভীষণ ঝামেলা করেছিল সারাদিন ব্লিজিকে না দেখতে পেয়ে। কিন্তু আরেকবার এই একই কাজ করে সারো সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেলল। বাসে বা ইস্কুলে ওকে কেউ সন্দেহ করেনি, কিন্তু মা করেছিল।

আমার মনে নেই যে বাবা ব্লিজিকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন কিনা! আমাদের এই শহরতলীর পরিবেশে বাবাকে যেন কল্পনাই করতে পারছি না। সেখানে এই খাদান বা এই খাদান বাড়ির ধারেকাছে তো নয়ই। হয়তো নীল আমাদের শহরের বাড়িতে গিয়ে নিয়ে এসে থাকবে। এই নিয়ে কিছু একটা অনুসন্ধান হয়েছিল যে সারো আদতে কুকুরটাকে নিয়ে কি করেছিল। খানিকটা আমার মনে আছে। সারো বলেছিল,
—– আমি একটু মজা করেছিলাম।
—– তুমি কি বাবার সঙ্গে গিয়ে থাকতে চাও?

আমার মনে আছে এটাই ওকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কিন্তু ও উত্তরে “না” বলেছিল।

আমি ওকে ব্যক্তিগতভাবে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আসলে ব্যাপারটায় আমি খুব একটা অবাক হইনি।

আমাদের চিঠিপত্তর সব জমা হত রাস্তার শেষে একটা ডাকবাক্সে। আমি আর মা প্রতিদিন হেঁটে ওখানে যেতাম যদি না ঝড়বৃষ্টি হত। এটা সাধারণতঃ দুপুরের ছোট্ট ঘুমের পর যেতাম। কোন কোন দিন এই সময়ই একমাত্র আমরা বাড়ি থেকে বেরোতাম এই উদ্দেশ্যে। সকালে আমি টিভিতে ছোটদের অনুষ্ঠান দেখতাম। মা তখন পড়ত। তারপর স্যুপ গরম করে দুপুরে খেতাম। আমি তারপর একটু ঘুমোতে যেতাম আর মা আরো একটু পড়ত। বাচ্চাটা এখন পেটে অনেকটা বড় হয়ে গেছে। বাইরে থেকে হাত দিলে নড়াচড়া টের পাওয়া যায়। বাচ্চাটার নাম ব্র্যান্ডি হবে—সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন!

কিছুদিন যাবৎ ম্যাজিকের মত বরফটা হ্রাস পেয়েছে। তবুও গাছগুলো ন্যাড়া ছিল পাতার অভাবে। মা প্রতিদিন সারোকে কোট পরিয়ে ইস্কুলে পাঠাত আর সারো রোজ কোট খুলে পেছনে টানতে টানতে ইস্কুল থেকে ফিরত।

আমার মা বলত তার যমজ বাচ্চা হবে কিন্তু ডাক্তাররা তা মানতে নারাজ।

ইতিমধ্যে সেই নুড়ি পাথরের গর্ত বর্ষার জলে, বরফের জলে কানায় কানায় পরিপূর্ণ, সেইজন্যে সারোকে ধার দিয়ে গিয়ে ইস্কুলের বাস ধরতে হত। স্বচ্ছ, নীল আকাশের নীচে একটা ছোট্ট পুকুরের আকার ধারণ করেছিল সেটা। সারো খুব একটা আশাবাদী না হয়েই জিজ্ঞেস করেছিল,
— আমরা কি খেলতে পারি ওখানে? মা উত্তর দিয়েছিল,
— পাগলামি করার কোন প্রয়োজন নেই। প্রায় বিশ ফুট গভীর হবে ওটা।
— অথবা দশও হতে পারে। নীল বলেছিল।
— একদম ধারে অত গভীর হবে না। সারো ফের বাঙময়।
— হ্যাঁ, ওটা গভীরই। এটা বীচে খেলতে যাবার মত ব্যাপার নয়। ওর থেকে দূরে সরে থাকাই ভাল। মায়ের সাবধানবাণী।
— আমরা কি কুকুরটাকেও ওর থেকে দূরে সরিয়ে রাখব? মা নীলকে জিজ্ঞেস করেছিল।
— কুকুররা সাঁতার কাটতে জানে।

একটা শনিবার, সারো টিভিতে “দ্যা ফ্রেন্ডলি জায়ান্ট” দেখল আর এমন মন্তব্য করল যে পুরো গল্পটা মাঠে মারা গেল। নীল ওর মত করে তখন ধূমপানে মত্ত। সারো মাঝেমাঝেই বিরক্ত করছিল নীলকে একটা সিগারেট দেওয়ার জন্য। অবশেষে নীল একটা দিয়েছিল কিন্তু মাকে জানাতে মানা করেছিল। কিন্তু আমি মাকে বলে দিয়েছিলাম।

টি ভি বন্ধ করে দেওয়ার পর সারো আর আমাকে বাইরে পাঠানো হল একটু খোলা আকাশের নীচে দৌড়াদৌড়ি করার জন্য। আমরা ব্লিজিকেও সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম। সারো আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কি করতে চাই। আমি উত্তর দিলাম যে আমি জানি না। ব্লিজির ইচ্ছে ছিল ওই পাথরের গর্তে গিয়ে সে উঁকিঝুঁকি মারবে। আমরাও তার পেছন পেছন গেলাম। হাওয়ার দোলায় অল্প অল্প ঢেউ খেলে যাচ্ছিল সেই জলাশয়ে। শীঘ্রই আমাদের খুব শীত করতে লাগল, তাই আমরা স্কার্ফগুলো ভাল করে বেঁধে নিলাম। আমি চারিপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম যখন হঠাৎ মনে হল আমাকে কেউ নির্দেশ দিচ্ছে মাকে আর নীলকে গিয়ে বলতে যে ব্লিজি জলে পড়ে গেছে আর সারো আশংকা করছে যে ব্লিজি ডুবে যাবে।

ব্লিজি জলে ডুবে যাবে। যেতে পারে? কিন্তু ব্লিজি তো জলে নেই। অথবা আছে! সারো তাকে বাঁচানোর জন্য জলে ঝাঁপ দিতেই পারে।

আমি কিছু একটা তর্ক করতে যাচ্ছিলাম যে নীল বলেছে কুকুররা সাঁতার জানে কিন্তু সারো আমাকে বলল তার নির্দেশ পালন করতে।

কেন ওর নির্দেশ পালন করতে হবে? আমি হয়তো আরো তর্ক জুড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মনশ্চক্ষে আমি দেখতে পাচ্ছি সারো ব্লিজিকে ওপরে তোলার চেষ্টা করছে কিন্তু ব্লিজি ওর কোটটা কামড়ে ধরে রেখেছে। জলে একটা দাপাদাপি ঝাঁপাঝাঁপি শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তার পরের ওই জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা মনে করতে পারি যখন একটা পর একটা ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। তারপরে মনে হয় আমি বাড়ির অভিমুখে রওনা হয়েছিলাম। নিশ্চয়ই তাই করেছিলাম।

যখনই স্বপ্নে এই ঘটনা আমার আসে, আমি দেখি আমি দৌড়াচ্ছি। আর স্বপ্নে আমি দেখি বাড়ির অভিমুখে নয়, আমি ওই গর্তের দিকে ছুটে চলেছি। আমি দেখতে পাই ব্লিজি শক্ত করে সারোর কোট ধরে আছে আর ডাঙার দিকে নিয়ে আসছে। আমি ওর হালকা বাদামী কোটটা দেখতে পাই, গলায় বাঁধা স্কার্ফ আর সারোর গর্বিত মুখ জলের ওপরে দেখা যাচ্ছে। আমি শুধু চেয়ে আছি তার দিকে, আমার মুখ উদ্ভাসিত।

যেটা আমি সত্যিই করেছিলাম তা হচ্ছে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম। তারপর খানিক বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসলাম। যেন বসে ছিলাম পরের ঘটনাটা ঘটার জন্য। আমি জানি না আমি কতক্ষণ বসেছিলাম। পাঁচ মিনিট। তার বেশী নাকি তার কম!

আমি একজন মনোবিদের কাছে গেছিলাম এই ব্যাপারে যে আমাকে আশ্বস্ত করেছিল যে আমি বাড়িতে অবশ্যই গেছিলাম এবং দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখতে পাই। বন্ধ কারণ আমার মা আর নীল তখন রতিক্রিয়ায় মগ্ন। অনাবশ্যক উপদ্রব তারা চায়নি বলে বন্ধ করে রেখেছিল। আমি দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিলে তারা বিরক্ত হত। কাউন্সেলর এই বলে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিল, আমিও তাই জেনে খুশী হলাম। কিন্তু সেটা সাময়িক। আসলে আমি জানি সেটা সত্যি না। তারা দরজা বন্ধ করত না। ওই অবস্থায় সারো একবার ঘরে ঢুকে গেছিল আর সারোর মুখের অবস্থা দেখে মা, নীল দুজনেই হেসেছিল।

হয়তো আমার মনে পড়ে গেছিল যে নীল বলেছিল যে কুকুররা সাঁতার জানে আর সারোর তাকে বাঁচানোর কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি কি ভেবেছিলাম যে সারো সাঁতার জানে। অনেক নয় বছরের মেয়েই সাঁতার জানে। গত গ্রীষ্মে সে কিছুটা শিখেছিল কিন্তু বাড়ি পরিবর্তনের ফলে আর শেখা হয়নি এবং আমি নিশ্চয়ই ভেবেছিলাম যে ও যা চায় তাই করতে পারে।

আমাকে কাউন্সেলর এটাও বলেছিলেন যে হয়তো সারোর হুকুম তালিম করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।

কতক্ষণ আমি বসেছিলাম আমার মনে নেই। আমি নিশ্চয়ই দরজায় টোকা মেরেছিলাম। নাকি মা নিজে থেকেই বিনা কারণে দরজাটা খুলে দিয়েছিল। আমি এরপর ভেতরে আর মা নীলের ওপর ভীষণ চেঁচাচ্ছে। নীল বোঝার চেষ্টা করছে। মায়ের গায়ে আলতো করে হাত দিল। কিন্তু মা ছুটে বেরিয়ে গেল। চটি পড়তে পড়তে নীল আমাকে কিছু একটা বলল। কি বলল মনে নেই।

মা নিজেকে জলে ছুঁড়ে দেয়নি। বা শকে লেবার পেনও শুরু হয়নি। শ্রাদ্ধের প্রায় দশ দিন বাদে আমার ভাই ব্র্যান্ডির জন্ম হয়েছিল। জন্মানোর আগের সময়টুকু মা কোথায় ছিল আমার জানা নেই। হয়তো হাসপাতালে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আছন্ন হয়ে পড়েছিল।

আমার সারোর শ্রাদ্ধের দিনটা ভীষণ ভালভাবে মনে আছে। মধুর ব্যবহারের এবং সংবেদনশীল এক অপরিচিত মহিলা—জোসি আমাকে নিয়ে সেদিন এক পরিক্রমায় বেড়িয়েছিলেন। আমি কিছু সময় দোলনায় দুলেছিলাম আর একটা পুতুল ঘরে গেছিলাম। এক রেস্তোরাঁয় খেয়েছিলাম আমার সব প্রিয় খাবার। জোসিকে পরে আমি খুব ভাল ভাবে জানতে পেরেছি। আমার বাবার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল কিউবায় এবং ডিভোর্সের পর সে আমার সৎ মা হয়ে যায়।

ধীরে ধীরে মা সুস্থ হয়ে উঠল। তাকে হতেই হত ব্র্যান্ডির জন্য। আমি আমার বাবার কাছেই ছিলাম যতদিন না মা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল। ব্র্যান্ডি যখন বসতে শিখে গেছে তখন আমি আবার মায়ের কাছে ফিরে আসি। আমি স্কুলে যাওয়ার সময় মায়ের একটা ঠিকঠাক চাকরি ছিল এবং সে আবার কাজের মধ্যে ডুবে যেতে লাগল।

নীল শ্রাদ্ধে বিশ্বাসী ছিল না তাই সারোরটাতে উপস্থিত ছিল না। সে ব্র্যান্ডির মুখও দেখেনি। নীল একটা চিঠি লিখে গেছিল যে সে বাবার ভূমিকা নিতে অক্ষম তাই শুরুতেই বিদায় নিচ্ছে। আমি মাকে সেই চিঠি কখনও দেখাইনি। আর আমার সবসময় মনে হয়েছে ব্র্যান্ডিকে মুলতঃ বাবার মতই দেখতে যদিও বাবা কোনোদিন এ নিয়ে মুখ খোলেনি। বাবা ব্র্যান্ডিকে আর আমাকে একই চোখে দেখতেন। সেটা বাবা যে কোন অবস্থাতেই দেখতেন।

আমার এখন একটা বান্ধবী আছে, রুথান, যে আমার থেকে বয়সে কিঞ্চিত ছোট হলেও আমার থেকে বেশি বুঝদার। আমি নীলের সঙ্গে কখনও আবার যোগাযোগ করতেই পারতাম না যদি না রুথান আমায় উৎসাহিত করত। আমার কোন উপায় ছিল না যোগাযোগের কিন্তু একদিন নীলই অ্যালুমনি গেজেটে আমার ছবি দেখে অভিনন্দনবার্তা পাঠাল।

আমি যেখানে পড়াই, সেখান থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরত্বে নীল থাকে। প্রথমে আমার উত্তর দেওয়ার কোন পরিকল্পনা ছিল না কিন্তু রুথান আমাকে উত্তর দিতে উৎসাহিত করল। অতঃপর, আমি একটা ইমেল পাঠালাম এবং ইউনিভার্সিটি ক্যাফেটারিয়ায় সাক্ষাতের ব্যবস্থা হল।

নীলকে যা দেখেছিলাম তার থেকে খাটো লাগল। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে। নিজে চা পান করছিল। আমার জন্য চা বলল। ও কি করে আজকাল? বলল যে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ছেলেমেয়েদের তৈরি করে, পড়ায়। রচনা লিখতে সাহায্য করে। অবশ্য পয়সার বিনিময়ে।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে কথা শুরু করব।
— আমি যেন পাথর হয়ে গেছিলাম। আমি তো কোন সাঁতারুও ছিলাম না। জলে ঝাঁপ দিলে আমিও ডুবে যেতাম। তুমি কি এটাই জানতে চাইছিলে?

আমি বললাম যে আমি ঠিক তার কথা ভাবছিলাম না। আমি ভাবছিলাম সারোর মনে তখন কি চিন্তাপ্রবাহ খেলা করছিল? কাউন্সেলর আমাকে বলেছিল—সেটা আমরা কোনদিনও জানতে পারব না। হয়তো সে নিজেও জানত না সে ঠিক কি চাইছে? মনোযোগ? আমার মনে হয় না কস্মিনকালে ও ডুবে যাবার কথা ভেবেছিল।

রুথান বলেছিল,
—— তোমার মাকে সিধে করতে চেয়েছিল। এমন সব পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হত যে মা শেষে বাধ্য হত তোমাদের বাবার কাছে ফিরতে।

নীল বলেছিল,
—– হয়তো ও ভেবেছিল ও যথেষ্ট ভাল সাঁতার জানে নিজেকে বাঁচানোর জন্য। হয়তো ও বুঝতে পারেনি শীতের পোশাক জলে ভিজে কতটা ভারী হতে পারে! অথবা ওকে সাহায্য করার মত পরিস্থিতিতে কেউ ছিল না।

আমার প্রতি নীলের বার্তা ছিল,
—–আর নিজের সময় নষ্ট কর না। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না যে যদি তাড়াতাড়ি আমাদের খবর দিতে তাহলে কি হত! মনের মধ্যে এই বোঝা নিয়ে ঘুরছ না আশা করি!

আমি মাথা নাড়লাম।
—–আসল কথাটা হচ্ছে আনন্দে থাকা। যাই হোক না কেন খুশি মনে বাঁচো। তুমি পারবে। যত দিন যাবে দেখবে চেষ্টা করলে কেমন সহজ হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতির সঙ্গে এই মনোভাবের কোন সম্পর্ক নেই। যাই আসুক না কেন, সেটাকে গ্রহণ করতে হবে। দেখবে দুঃখ কষ্ট ভুলে যাবে। অন্ততঃ খানিকটা হলেও লাঘব হবে। আর দেখবে পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কি সুন্দর তুমি জীবন যাপন করতে পারছ।

এখন বিদায়।

আমি বুঝতে পারছিলাম নীল কি বলতে চাইছে। এটাই আমার করা দরকার। কিন্তু মনের মধ্যে এখনও আমার ঘুরপাক খায় যে সারো জলের মধ্যে নিজেকে ছুঁড়ে দিচ্ছে এক জয়ের উচ্ছ্বাসে, আর আমি বসে আছি ওর ব্যাখাটা শুনব বলে।

কিন্তু তখনই জলের শব্দ ওঠে —- ছলাৎ! ছলাৎ!



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “onubad-gorto

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *