যে ছেলেটা ফুল ভালোবাসত

যে ছেলেটা ফুল ভালোবাসত
মূল কাহিনিঃ স্টিফেন কিং রচিত ‘দ্য ম্যান হু লাভড ফ্লাওয়ার্স’ (১৯৭৭)
অনুবাদ – সৌভিক চক্রবর্তী
১৯৬৩ সাল। মে মাসের বিকেল। পকেটে হাত গুঁজে নিউ ইয়র্কের থার্ড অ্যাভিনিউ দিয়ে দ্রুতপায়ে হেঁটে যাচ্ছিল এক যুবক। নরম হাওয়া বইছিল চারদিকে, আকাশের নীল একটু করে গোধূলিবেলার গোলাপির দিকে এগোচ্ছিল। যারা শহরকে ভালোবাসেন, এমন একটা সন্ধে তাঁদের সেই ভালোবাসার তীব্রতা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। মুদির দোকানদার, ড্রাই ক্লিনিংয়ের দোকানের মালিক থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টের দরজায় দাঁড়ানো কর্মী— সবার মুখেই হাসি লেগে ছিল যেন।
ঠেলাগাড়িতে করে ব্যাগভর্তি আনাজ নিয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধা ছেলেটাকে দেখতে পেয়ে হাঁক পাড়লেন, “এই যে, শুনছ।” অল্প হেসে তাঁর দিকে হাত নাড়ল ছেলেটাও।
বৃদ্ধা মনে মনে ভাবলেন – ও নির্ঘাত প্রেমে পড়েছে।

ছেলেটাকে দেখে সেটা স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছিল। পরনে ধূসর একটা স্যুট, গলার টাইটা অল্প নামানো, কলারের বোতাম খোলা। মাথায় কালো চুল, চোখের রঙ নীল। চেহারায় তেমন কোনও বৈশিষ্ট্য না থাকলেও বসন্তের এই নরম সন্ধেবেলা, এই রাস্তায়, ১৯৬৩ সালের এই মে মাসে, অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। এক মুহূর্তের জন্য মিষ্টি নস্টালজিয়ার রেশ এসে ঘিরে ধরল বৃদ্ধাকে। বসন্তে সব ছেলেকেই সুন্দর দেখায়… বিশেষ করে তারা যখন তাদের স্বপ্নের নায়িকাদের সঙ্গে বেরোয়, ডিনারে অথবা নাচের আসরে। বসন্তই একমাত্র সময় যখন অতীতের স্মৃতিচারণ তিক্ততার বদলে সুখ এনে দেয়, আর তাই ভদ্রমহিলা খুশি মনে হেঁটে চললেন, খুশি কারণ তিনি ছেলেটাকে ডেকে কথা বলেছেন, এবং ও প্রত্যুত্তরে হাত নেড়ে তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছে।
সিক্সটি থার্ড স্ট্রিট ধরে হেঁটে চলল ছেলেটা, পা ফেলার ছন্দে যৌবনের উচ্ছ্বলতা এবং ঠোঁটে আলতো হাসি নিয়ে। কিছুটা এগিয়ে রঙচটা ঠেলাগাড়িতে ফুল নিয়ে রাস্তার পাশে বসে থাকা একজন বুড়ো লোককে দেখতে পেল ও। গাড়িতে হলুদ ফুলই বেশি ছিল— জংকুইল এবং ক্রোকাস। তাছাড়া ছিল কিছু কার্নেশান, আর হটহাউজের কিছু টি রোজ, হলুদ, সাদা আর লাল। বুড়ো দোকানদার পাউরুটি চিবোতে চিবোতে তার ঠেলাগাড়ির এককোণে রাখা ট্রানজিস্টার রেডিওতে খবর শুনছিল।

একের পর এক খারাপ সংবাদের ফিরিস্তি দিয়ে যাচ্ছিল সেই রেডিও – হাতুড়ি দিয়ে একের পর এক খুন করা খুনি এখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি, জন এফ কেনেডি জানিয়েছেন এশিয়া অঞ্চলের এক ছোট দেশ ভিয়েতনাম-এর (যিনি খবর পড়ছিলেন তিনি শব্দটাকে ‘ভাইতনাম’ উচ্চারণ করলেন) পরিস্থিতির ওপর তাঁর সরকার নজর রাখছে, ইস্ট রিভার থেকে এক অজ্ঞাতপরিচয় মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, হেরোইন ব্যবসার অভিযোগে অভিযুক্ত মাফিয়াকে আদালতের গ্র্যান্ড জুরি অপরাধী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে, রাশিয়া আবার পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ঘটনাগুলো অবাস্তব, অথবা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। আলতো একটা হাওয়া বইছিল চারদিকে। ভুঁড়িওয়ালা দুজন লোক পাশের বেকারির বাইরে দাঁড়িয়ে হাসিঠাট্টা করছিল। গ্রীষ্মের দোরগোড়া পেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছিল বসন্ত, এবং নিউ ইয়র্কের মতো শহরে গ্রীষ্ম এবং স্বপ্ন সমার্থক।

ঠেলাগাড়ি ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল ছেলেটা। ফিকে হয়ে এল দুঃসংবাদের ধ্বনি। তারপরই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। ইতস্তত করে পেছনে ফিরল, যেন হঠাৎ কোনও চিন্তা মাথায় এসেছে। কোটের ভেতরের পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা ছুঁয়ে দেখল। কয়েক মুহূর্তের জন্য ওর মুখের ভাব বদলে গেল, নিঃসঙ্গতার অভিব্যক্তি ছাপ ফেলল সেখানে। পরক্ষণেই পকেট থেকে হাত বের করে নিল। ওর মুখে ফিরে এল আগের মতোই উজ্জ্বল প্রত্যাশা। ঠোঁটে হাসি নিয়ে ঠেলাগাড়ির কাছে ফিরে গেল ছেলেটা। নর্মা-র জন্য ও ফুল নিয়ে যাবে। তাতে সে খুশি হবে। উপহার পেয়ে তার দুচোখে যে আনন্দ, যে উৎসাহ ফুটে ওঠে তা দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। ছোট ছোট উপহার, কারণ ওর সামর্থ্য ওইটুকুই। কখনও একবাক্স লজেন্স, কখনও একটা ব্রেসলেট। একবার তো ব্যাগভর্তি ভ্যালেন্সিয়া-র কমলালেবু দিয়েছিল ও, কারণ ও জানত নর্মা কমলালেবু পছন্দ করে।
“এসো, তরুণ বন্ধু,” ধূসর স্যুট পরা ছেলেটাকে ফিরে আসতে দেখে বলে উঠল দোকানদার, তাড়াতাড়ি একবার ঠেলাগাড়িতে রাখা ফুলগুলোর ওপর নজর বুলিয়ে নিল। লোকটার বয়স আটষট্টির কাছাকাছি, গায়ে ছাই ছাই রঙের একটা ছেঁড়া সোয়েটার, মে মাসের গরমেও মাথায় টুপি। মুখে অজস্র বলিরেখার কাটাকুটি, চোখ কোটরাগত, দু’ আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। কিন্তু বসন্তের দিনগুলোতে যৌবন উদযাপনের স্মৃতি সে ভোলেনি। বসন্তের ভালোবাসা… এত ভালোবাসা যে হাত ছাপিয়ে ছলকে যায়। এমনিতে দোকানদারের মুখ ব্যাজার থাকে, কিন্তু এখন সেখানে হাসি ফুটল, ঠিক যেমন আনাজ কিনে নিয়ে যাওয়া বৃদ্ধা মহিলার মুখে ফুটেছিল। ছেলেটাকে একনজরে দেখেই প্রেমিক বলে মনে হচ্ছিল। সোয়েটার থেকে পাউরুটির গুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে বুড়ো ফুলওয়ালা ভাবল – ভালোবাসা যদি কোনও রোগ হত তাহলে ছেলেটা এতক্ষণে আইসিইউ-তে ভরতি থাকত।
“ফুল কত করে?” ফুলওয়ালার কাছে জানতে চাইল ছেলেটা।
“ওই তোড়াগুলো এক ডলার করে। আর এই টিরোজ-গুলো হটহাউজের মাল, তাই দাম বেশি পড়বে। একেকটা সত্তর সেন্ট। সাড়ে তিন ডলারে আধ ডজন।”
“বড্ড বেশি দাম।”
“ভালো জিনিস কখনও সস্তা হয় না, তোমার মা সেটা বলেননি তোমাকে?”
মুচকি হাসল ছেলেটা। “বলেছিল হয়তো, আমিই ভুলে গেছি।”
“আমি নিশ্চিত তিনি বলেছিলেন। যাই হোক, আমি তোমাকে ছ’টা গোলাপের একটা তোড়া বানিয়ে দিতে পারি, দুটো লাল, দুটো সাদা, দুটো হলুদ। ওপরে জিপসোফিলিয়া ছড়িয়ে চারদিকে ফার্ন-এর ঘেরা দিয়ে দেব, খুব সুন্দর লাগবে। সাড়ে তিন ডলার। ওরা গোলাপ খুব পছন্দ করে। অথবা এক ডলার দিয়ে ওই তোড়াও নিতে পারো।”
“ওরা পছন্দ করে মানে?” যুবকের মুখে তখনও হাসি লেগে ছিল।
“দেখো, বন্ধু,” নিভে যাওয়া সিগারেটের টুকরোটা পাশের নালায় ছুঁড়ে দিল দোকানদার, “এই মে মাসে কেউ নিজের জন্য ফুল কিনতে আসে না, সবাই অন্যের জন্যই কেনে। এটাকে জাতীয় আইন বলতে পারো।”
নর্মা-র খুশি খুশি মুখটা মনে পড়ে গেল ছেলেটার। ঠোঁটের আলতো হাসি, চোখের অল্প বিস্ময়— সব। “এটা আপনি ঠিকই বলেছেন,” সায় দিল ও।
“তা তুমি কোনটা বাছলে?”
“আপনি হলে কোনটা নিতেন?”
“এই বিষয়ে আমি তোমাকে কিছু উপদেশ দিতেই পারি। জ্ঞান শুনতে তো আর পয়সা লাগে না।”
হেসে ফেলল ছেলেটা। “এই একটা জিনিসই বোধহয় এখনও ফ্রি-তে পাওয়া যায়।”
“যা বলেছ,” বলে উঠল ফুলওয়ালা। “শোনো, বন্ধু, যদি ফুলগুলো তোমার মায়ের জন্য হয়, আমি বলব এক ডলারের তোড়াটা নিতে। ক’টা জংকুইল, ক’টা ক্রোকাস, ক’টা লিলি অফ দ্য ভ্যালি। তাতে তিনি অন্তত বলতে পারবেন না, ‘আহা কী সুন্দর ফুলগুলো আমার খুব পছন্দ হয়েছে কিন্তু খোকা এত দাম দিয়ে ফুল আনার দরকার কী ছিল তোকে কতবার না বলেছি টাকা নয়ছয় করবি না’ ইত্যাদি।”
দোকানদারের রসিকতায় হাসিতে ফেটে পড়ল ছেলেটা।
ফুলওয়ালা বলেই চলল, “কিন্তু ফুলগুলো যদি তোমার প্রেমিকার জন্য হয়, তাহলে ব্যাপারটা আলাদা। আর তুমিও সেটা জানো। সেক্ষেত্রে আমি বলব, টিরোজ-এর তোড়া নিতে। কারণ প্রেমিকা হিসেবনিকেশের ধার ধারবে না, সোজা তোমার গলা জড়িয়ে ধরবে।”
“আমি তাহলে গোলাপই নেব”, বলল ছেলেটা। এবার দোকানদারের হেসে ওঠার পালা। বেকারির সামনে দাঁড়ানো লোকদুটোও মুচকি হেসে ছেলেটার দিকে তাকাল।
“এই যে খোকা”, ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠল, “সস্তায় বিয়ের আংটি কিনবে নাকি? আমারটা বিক্রি করব ভাবছি… আমার আর এটা কোনও কাজে লাগবে না।”
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল ছেলেটার মুখটা।
ছ’টা টি রোজ তুলে নিল ফুলওয়ালা, ডাঁটিগুলো অল্প ছেঁটে, সামান্য জল ছিটিয়ে কাগজ দিয়ে মুড়ে দিল।

‘আজ রাতের আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকবে,’ বলে উঠল রেডিও। ‘তাপমাত্র পঁয়ষট্টি থেকে আটষট্টি ডিগ্রি ফারেনহাইট, সঙ্গে মৃদুমন্দ হাওয়া। রোম্যান্টিক মানুষদের পক্ষে আদর্শ, ছাদে বসে আকাশের তারা দেখার জন্যও একেবারে উপযুক্ত। নিউ ইয়র্ক-এর বাসিন্দাদের বলছি, এই রাত প্রাণভরে উপভোগ করুন।’
কাগজের মোড়কটাকে স্কচ টেপ দিয়ে আটকে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিল দোকানদার, সঙ্গে উপদেশও দিল, “প্রেমিকাকে বলবে ফুলদানির জলে অল্প চিনি ফেলে দিতে, তাতে ফুলগুলো অনেকদিন ভালো থাকবে।”
“বেশ, ওকে বলব,” পাঁচ ডলারের একটা নোট বাড়িয়ে দিল ছেলেটা। “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”
“আমি তো শুধু নিজের কাজ করছি, বন্ধু”, দেড় ডলার ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল দোকানকার। তারপরই তার মুখের হাসি চওড়া হল। “আমার তরফ থেকেও ওকে একটা চুমু দিও কিন্তু।”

রেডিও থেকে ‘ফোর সিজনস’-এর গান ভেসে এল। খুচরো পয়সা পকেটে ভরে ফের রাস্তায় পা রাখল ছেলেটা। ওর একাগ্র, অপেক্ষমান চোখদুটো আশেপাশের সমস্ত কিছু গ্রহণ করছিল… আংশিকভাবে নয়, সামগ্রিকভাবে। থার্ড অ্যাভিনিউ জুড়ে জীবন-স্রোতের অবিরাম ওঠাপড়ার পাশাপাশি ছোটখাটো আরও কয়েকটা দৃশ্য ওর নজরে এল। এক মা তার ছোট বাচ্চাকে প্যারাম্বুলেটরে চাপিয়ে রাস্তায় হাঁটছে, বাচ্চাটার সারা মুখে আইসক্রিম লেগে। অল্পবয়সি একটা মেয়ে লাফান-দড়ি নিয়ে খেলতে খেলতে ছড়া বলছে। একটা লন্ড্রির বাইরে দুজন গর্ভবতী মহিলা দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। এক দল লোক হার্ডওয়ারের একটা দোকানের জানলার বাইরে ভিড় জমিয়ে বেসবল ম্যাচ দেখছে। দোকানের ভেতর বড়, দামি একটা কালার টিভিতে খেলা চলছে, খেলোয়াড়দের মুখগুলো সবুজ সবুজ দেখাচ্ছে, মাঠের রঙ গোলাপি। নিউ ইয়র্ক ফিলাডেলফিয়ার থেকে ৬-১ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে।
ফুলের তোড়া হাতে হেঁটে চলল ছেলেটা, জানতেও পারল না যে লন্ড্রির বাইরে দাঁড়ানো মহিলা দুজন নিজেদের মধ্যেকার কথাবার্তা থামিয়ে আগ্রহভরে ওকে দেখছে; ফুল পাওয়ার বয়স তারা অনেক আগেই ফেলে এসেছে। ও জানতেও পারল না ও রাস্তা পারাপার করার সময় একজন অল্পবয়সি ট্রাফিক সার্জেন্ট হুইসিল বাজিয়ে থার্ড অ্যাভিনিউ এবং সিক্সটি নাইন্থ স্ট্রিট-এর সমস্ত গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে; ছেলেটার মুখের স্বপ্নালু ভাব চিনতে সার্জেন্টের অসুবিধে হয়নি কারণ সে নিজেও প্রেমিক, এবং দাড়ি কামাবার আয়নায় এই একই মুখের ভাব অনেকবার দেখেছে। ও জানতেও পারল না ওর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুজন কিশোরী মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকাল, তারপর খিলখিলিয়ে হেসে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ল।

সেভেন্টি থার্ড স্ট্রিট পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরল ও। খয়েরি খোয়া বাঁধানো এই রাস্তাটা একটু বেশিই অন্ধকার। রাস্তার দুপাশে সারি দিয়ে কতগুলো রেস্টুরেন্ট, তাদের নামগুলো সবই ইটালিয়ান। তিন ব্লক আগে ফাঁকামতো একটা জায়গায় পড়ন্ত আলোয় স্টিকবল খেলা চলছিল, মাঝে মধ্যেই সেখান থেকে খেলোয়াড়দের গলার স্বর ভেসে আসছিল। অতদূর অবশ্য গেল না ও, আধা ব্লক পেরিয়ে সরু একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়ল।
আকাশের বুকে তারাদের ঝিকিমিকি দেখা যাচ্ছিল। গলিটা অন্ধকার, ছায়ার আড়ালে আবর্জনা ফেলার ড্রামের অস্পষ্ট আকৃতি। ছেলেটা একা— না, ঠিক একা নয়। লালচে আবছায়া ভেদ করে একটা জান্তব চিৎকার শুনতে পেল ছেলেটা। ওর ভুরু কুঁচকে গেল। কামতাড়িত হুলো বেড়ালের কর্কশ ডাকের মধ্যে সৌন্দর্যের লেশমাত্র ছিল না।


চলার গতি কমিয়ে দিল ছেলেটা, হাতঘড়ির দিকে তাকাল। পৌনে আটটা বাজছিল। এতক্ষণে তো নর্মার এসে পড়ার কথা—ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে দেখতে পেল ও, দূর থেকে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। পরনে গাঢ় নীল স্ল্যাক্স আর ব্লাউজ। ওর বুকের কাছটা মুচড়ে উঠল যেন। নর্মার প্রথম ঝলক সর্বদাই ওর মনে বিস্ময় জাগিয়ে তোলে, মিষ্টি একটা অবাক করা ভাব বয়ে আনে— সর্বদাই বড্ড অল্প বয়সি মনে হয় তাকে!
ওর ঠোঁটের হাসি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি পা চালাল ও।
‘নর্মা!’ ডাকল ছেলেটা।
মুখ তুলে হাসল মেয়েটা, কিন্তু আরেকটু কাছাকাছি আসামাত্র সেই হাসি মিলিয়ে গেল।
ওর নিজের হাসিটাও কেঁপে গেল, এক মুহূর্তের জন্য অস্বস্তি বোধ হল। মেয়েটার মুখটা কেমন যেন ঝাপসা লাগছিল। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছিল… ও কি তাহলে চিনতে ভুল করল? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব। না, মেয়েটা নর্মা-ই।
‘আমি তোমার জন্য ফুল এনেছি,’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কাগজে মোড়া ফুলের তোড়াটা মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিল ও।
ক্ষণিকের জন্য ফুলগুলোর দিকে তাকাল মেয়েটা, হাসল একটু, তারপর তোড়াটা ফিরিয়ে দিল।
‘ধন্যবাদ, কিন্তু আপনার মনে হয় কিছু একটা ভুল হয়েছে। আমার নাম-’
‘নর্মা,’ ফিসফিসিয়ে বলল ও, কোটের পকেট থেকে এতক্ষণ লুকিয়ে রাখা ছোট হাতলের হাতুড়িটা বের করে আনল। ‘এগুলো তোমার জন্য এনেছি, নর্মা… সবসময় তোমার জন্য… সবকিছু তোমার জন্য।’
কয়েক পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা। তার মুখটা আবার ঝাপসা হয়ে এল। চিৎকার করার জন্য ঠোঁটদুটো ফাঁক হল যেন… মেয়েটা নর্মা নয়। নর্মা মারা গেছে দশ বছর আগে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ মেয়েটা এবার চিৎকার করবে। চিৎকার থামাতে হাতুড়ি চালাল ও। চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল। আবার হাতুড়ি চালাল ও, আর ওর হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নিচে পড়ে গেল। ফেটে গেল কাগজের মোড়ক, ছড়িয়ে গেল ফুলগুলো। লাল, সাদা, হলুদ গোলাপফুল পড়ে রইল তোবড়ানো ডাস্টবিনের পাশে। অন্ধকার থেকে ভেসে এল মিলনরত হুলোবেড়ালের তীক্ষ্ণ শীৎকার। প্রেমের আর্তনাদ।
হাতুড়ি চালাল ছেলেটা। মেয়েটা চিৎকার করল না। কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে করতে পারে, কারণ সে নর্মা নয়, তারা কেউ নর্মা ছিল না। হাতুড়ি চালাল ও, হাতুড়ি চালাল, হাতুড়ি চালাল। মেয়েটা নর্মা নয়, তাই হাতুড়ির চালাল ও, যেভাবে এর আগেও পাঁচবার চালিয়েছিল।
কিছুক্ষণ পর হাতুড়িটা কোটের ভেতরের পকেটে ঢুকিয়ে নিল ছেলেটা, দূরে সরে এল খোয়া বাঁধানো পথে লুটিয়ে থাকা ছায়ামূর্তি, পাশে ছড়িয়ে থাকা ফুল, উলটোনো ডাস্টবিনগুলোর থেকে। সরু গলিটা থেকে বেরিয়ে এল ও। ততক্ষণে চারদিকে আরও ঘন অন্ধকার নেমেছে। স্টিকবল খেলা শেষ, খেলোয়াড়রা সবাই নিজের নিজের বাড়ি ফিরে গেছে। ওর পোশাকে যদি রক্তের দাগ লেগেও থাকে, এই অন্ধকারে, এই শেষ বসন্তের আঁধারে কারওর নজরে পড়বে না।
মেয়েটার নাম নর্মা ছিল না। কিন্তু ওর নিজের নাম ও জানে। ওর নাম…
ভালোবাসা!
ওর নাম ভালোবাসা, এবং নর্মা-র খোঁজে অন্ধকার রাস্তায় হেঁটে বেড়ায় ও। নর্মা ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে। একদিন না একদিন ও তাকে খুঁজে পাবেই। খুব শিগগিরই…। ছেলেটার মুখে হাসি ফিরে এল, হাঁটার গতি বাড়ল। সেভেন্টি থার্ড স্ট্রিট ধরে ফিরে যেতে লাগল ও। তাদের বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসে এক মধ্যবয়সি দম্পতি ওকে দেখতে পেল। ভাসা ভাসা দৃষ্টি আর ঠোঁটে আলতো হাসি ঝোলানো ছেলেটা চোখের আড়াল হলে ভদ্রমহিলা তার স্বামীকে জিগ্যেস করল, “তুমি আমার দিকে আর এমনভাবে তাকাও না কেন বলতে পারো?”
“কী বললে?”
“কিছু না”, চুপ করে গেল ভদ্রমহিলা, খয়েরি স্যুট পরা ছেলেটাকে আসন্ন রাতের আবছায়ায় মিলিয়ে যেতে দেখে আপনমনে ভাবল, পৃথিবীতে যদি বসন্তের চেয়েও সুন্দর কিছু থাকে, তা হল যৌবনের ভালোবাসা।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *