onubad-jadugrastha-biral

যাদুগ্রস্ত বিড়াল
হাঙ্গেরির উপকথা – Author: Baroness Orczy
অনুবাদ – মলয় সরকার


ব্যারনেস অরত্জি বা Baroness Emma Orczy র পুরো নাম Emmuska Magdalena Rosalia Maria Josepha Barbara Orczy। জন্ম ২৩-শে সেপ্টেম্বর ১৮৬৫, মৃত্যু ১২-ই নভেম্বর ১৯৪৭। জন্মসূত্রে তিনি হাঙ্গেরিয়ান হলেও তিনি ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হিসাবেই খ্যাত। তিনি The Scarlet Pimpernel নামে একটি উপন্যাস সিরিজের জন্য বেশি খ্যাতি লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি The Old Man in the Corner, The Emperor’s Candlesticks, Nest of the Sparrowhawk ইত্যাদি নানা উপন্যাসের রচয়িতা। তাঁর রহস্য রোমাঞ্চ ধরনের গল্প বেশ জনপ্রিয়।

অনেক কাল আগে, পারস্যের সীমানায় একটি রাজ্য ছিল, যার রাজা ছিলেন সুলতান আবু হাফিজ। সেই রাজ্য ছিল ফলে-ফুলে ভরা, ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ আর প্রজারাও ছিল খুব সুখী।

রাজ্যে সবাই ছিল সুখী, শুধু দুঃখী ছিলেন সুলতান নিজে। তিনি নিজে হাঁটতেন নিজের সুন্দর প্রাসাদের বারান্দায় আর তাকাতেন নিজের সুন্দর বাগানের দিকে। কিন্তু তাতেও তাঁর হাসি আসত না। এমন কি তাঁর ফোয়ারার জলের তলায় থাকা সুন্দর সোনালী মাছেদের মিষ্টি হাসিও তাঁকে আনন্দ দিতে পারত না। সুলতানের হাসি সেদিন থেকেই চলে গেছে, যেদিন সুন্দরী সুলতানা আরিজেদকে মৃত আনা হল প্রাসাদে।

একদিন সুলতানা আরিজেদ যখন তাঁর সহচরীদের সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, তখন হঠাৎ প্রাসাদের দরজার সামনে এক বিশাল ভয়ংকর রাক্ষসকে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাঁর আর জ্ঞান ফিরে আসে নি। তাঁর চাকর-বাকর বা সহচরী কর্মচারীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, তাঁর জ্ঞান ফেরাতে। কিন্তু কিছুই লাভ হয় নি। শেষে তাঁর দেহটি প্রাসাদে সুলতানের কাছে আনতে হল।

দুঃখে সুলতান তাঁর জামাকাপড় বিলিয়ে দিলেন, তাঁর দাড়ি ছিঁড়তে লাগলেন। তিনি রাজসভা শোকে বন্ধ করে দিলেন, মাসের পর মাস কেউ তাঁর মুখও দেখতে পেত না। বেশ কিছুদিন পর, রাজ্যের প্রয়োজনে, তাঁকে বাধ্য হয়ে বাইরে আসতেই হল। তিনি আগের মতই প্রজাদের কথা শুনে, তাদের প্রতি ধৈর্য্য ধরে, ন্যায় বিচার করতে লাগলেন। প্রজারা খুশী হল, কিন্তু তিনি আর আনন্দ করতে পারেন না। এমন কি তাঁর নিজের ছেলেও দেখেনি বাবাকে হাসতে।

ক্রমশঃ দুঃখ তাঁর বুকে এতই চেপে বসেছিল যে, সবাই ভয় পাচ্ছিল, এই দুঃখের চাপেই হয়ত তিনি মারা যাবেন একদিন। কাজেই সমস্ত মন্ত্রীরা মিলে যুক্তি করে স্থির করল যে, সুলতানকে এর থেকে বের করে আনতেই হবে। তার জন্য প্রধানমন্ত্রী বেন আহমেদ সুলতানের কাছে তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব তুলবেন।

সেই মত, বেন আহমেদ একদিন সুলতানকে আরও বেশি দুঃখিত দেখে, একেবারে সম্রাটের পায়ে পড়লেন। বললেন, মহামান্য সুলতান, একজন সামান্য কর্মচারী হয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি তার ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন। আপনার এই দুঃখ, সমস্ত প্রজাদের দুঃখিত করে তুলেছে এবং তা সমস্ত দেশের উপরেও প্রভাব ফেলছে। গোটা রাজ্য থেকে হাসি বিদায় নিয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য সব থমকে রয়েছে। এর থেকে দেশকে বের করে আনা আপনার পবিত্র কর্তব্য। সেজন্য আমি সমস্ত দেশের হয়ে সুলতানের কাছে আর্জি জানাচ্ছি, আপনি না হয় দ্বিতীয়বার এমন একটি সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করুন, যে আপনাকে সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে আনন্দ দিতে পারবে।

স্বাভাবিক ভাবেই সুলতান প্রথমে এসব কথা, শুনতেই চাইলেন না। শেষে সমস্ত কথা শুনে, ভেবে চিন্তে রাজী হলেন, কিন্তু এক শর্তে যে, মেয়েটিকে আগের সুলতানার মতই সুন্দরী এবং প্রাণবন্ত হতে হবে।

তখন প্রধানমন্ত্রী আশেপাশের সমস্ত রাজ্যে দূত পাঠালেন যে,আগের সুলতানার মত, সুলতান আবু হাফিজের দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন কোনো মেয়ে কোথাও আছে কি না, খুঁজে বের করতে।

দূর দেশে গিয়ে একজন দূতের নজরে পড়ল এরকম একটি মেয়ে। যে, তার সৌন্দর্য, সম্পদ, বুদ্ধি ইত্যাদিতে আগের সুলতানার সমকক্ষ। সে এক রাজপুত্রের রাণী, যে যুদ্ধে মারা গিয়েছে। এই মেয়েটি সুলতান আবু হাফেজের সুলতানা হওয়ার এবং তার সন্তানের জননী হওয়ার মত সমস্ত গুণের অধিকারিনী। এর মধ্যে, মেয়ের পক্ষ থেকে একটিই শর্ত ছিল যে, রাণীর নিজের একটি ছেলে আছে, যাকে রাণী ছাড়বেন না, সঙ্গেই রাখতে হবে।

দূত সুলতানকে রাণীর সৌন্দর্য, সুমধুর গলা, তার দারুণ বুদ্ধি ইত্যাদির কথাও বলে পাঠাল। সুলতান সব শুনে, শেষে রাণীর সঙ্গে কথা বলতে রাজী হলেন এবং বিয়েতে সম্মত হলেন।

তিনি তিনহাজার দূত পাঠালেন, যারা দামী দামী উপহার নিয়ে গেল। এ ছাড়া তিনশ’ সাহসী সুন্দর ভদ্র কর্মচারী গেল। যারা রাণী, তাঁর ছেলে এবং তাঁর জিনিসপত্র যা আছে সব নিয়ে আসতে।

বার প্রাসাদে এক রাজকীয় বিয়ের ব্যবস্থা হল। প্রাসাদ সাজানো হল দারুণ সুন্দর ভাবে, এবং একটি বিশাল ভোজের ব্যবস্থাও করা হল।

সুলতান তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে পাঠালেন শহরের প্রধান দরজায় সবাইকে আপ্যায়ন করতে আর নিজে দাঁড়ালেন প্রাসাদের দরজায় রাণীকে গ্রহণ করতে। সুলতান আবু হাফিজ রাণীকে দেখে খুবই মোহিত হয়ে গেলেন, দেখলেন যে, রাজদূত যে খবর দিয়েছিলেন, তা একবর্ণও বাড়িয়ে বলা নয়, বরং আসলে তার চেয়েও বেশি।

সুলতান তাঁকে হাত ধরে ভোজসভায় নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁর সিংহাসনের পাশেই রাণীকে বসালেন। তাঁর কথাবার্তা সুলতানকে, রূপের চেয়েও বেশি মুগ্ধ করল। কথার মধ্যে, বিশেষ করে, বলার শৈলী, সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান সুলতানকে মোহিত করল।

তিনদিন ধরে প্রচণ্ড রাজকীয় হৈ চৈ আনন্দ উৎসবের মধ্যে কাটল। রাণীর সামনে নানা বৈভব বস্তুসম্ভার প্রদর্শিত হল। তারপর সবাই নিজের নিজের জায়গায় ফিরে যেতে রাজ্য আবার নিজের গতিতে ফিরে এল।

অল্পদিনেই বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী রাণী সমস্ত রাজ্যে একজন ভাল রাণী হিসাবে সকলের মন জয় করে ফেললেন। ধীরে ধীরে রাজ্যের সমস্ত প্রজা ও সুলতানের উপরেও প্রভাব পড়তে লাগল।

নতুন সুলতানা খুব গর্বিত সব কিছু পেয়ে। যদিও তিনি প্রজাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করছিলেন, কিন্তু তবুও তাদের মন যেন ধীরে ধীরে তাঁর দিক থেকে ঘুরে যাচ্ছিল।

ক্রমে মানুষ বুঝতে পারছিল, তিনি যেন তাঁর প্রভাব খাটিয়ে সিংহাসনের ব্যাপারে, নিজের ছেলের পক্ষে মানুষের মন ঘোরাতে চাইছেন। অথচ সমস্ত প্রজারা জানে এবং চায় সুলতানের নিজের ছেলেই যাতে সিংহাসনের অধিকারী হয়, কারণ সে-ও নিশ্চয় বাবার মতই দয়ালু ও বিচক্ষণ হবে। তার প্রতি তাদের একটা আলাদা ভালবাসা ছিল মানুষের। যুবরাজের প্রতি এই ব্যবহার নতুন সুলতানা ও তাঁর পুত্রের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াল। তাঁরা সুলতানের অজান্তে, তার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু এটা বেশ অসম্ভব ছিল, কারণ যুবরাজ প্রায় সব সময়েই হয় সুলতানের কাছে, আর নয়ত বিশ্বস্ত কর্মচারীদের সঙ্গেই থাকে।

ধীরে ধীরে সুলতানের বয়স বাড়তে লাগল এবং ক্রমশঃ রাজ্য চালাতে অসুবিধা বোধ হতে লাগল। তাই একদিন সুলতানা ও যুবরাজকে ডেকে বললেন, তিনি স্থির করেছেন, এবার যুবরাজ আল হাফিজের একটি সুন্দরী বুদ্ধিমতী রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তার হাতে রাজ্য তুলে দেবেন।

এই ব্যবস্থা মোটেই সুলতানা এবং তাঁর ছেলে বেন হারুণের মনঃপূত হল না। কারণ এতে তাঁদের সমস্যার তো সুরাহা হবেই না উপরন্তু তা বাড়বে। তারা মাতাপুত্রে আলোচনা করতে লাগলেন, কি করা যায়।

এদিকে আল হাফিজ রাজসভার একটি মেয়েকে খুব ভালবাসে। সুলতানও তাতে সম্মত হয়ে আগামী তিন দিনের মধ্যে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে বললেন।

Courtesy: Wikipedia

এই বিবাহ হয়ে গেলে, সুলতান, ছেলের হাতে রাজ্য, সিংহাসন তুলে দিয়ে নিজে রাণী ও তাঁর পুত্রকে নিয়ে অবসর জীবন যাপন করবেন স্থির করলেন।

নতুন সুলতানা আর তার ছেলে তখন স্থির করলেন যে, একটা কিছু তো করতেই হবে। সেই রাতে যখন সবাই ঘুমিয়েছিল, তখন তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন। রাণীর সঙ্গে আসা আব্রাদুজ নামে এক জাদুকরের কাছে এসে হাজির হলেন।

যাদুকর তখন অদ্ভুত এক পেয়ালায় জাদুর কিছু পানীয় তৈরি করছিল। তাঁরা দেখলেন, তার মাথায় রয়েছে লম্বা এক টুপি আর তার দাড়ি এতই লম্বা যে তা মাটিতে লুটোচ্ছে।

সুলতানা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই, তাঁকে না দেখেই যাদুকর আব্রাদুজ বলে উঠল, আমি জানি তুমি কি চাইছ বা কি জন্য এসেছ। তুমি যুবরাজ আল হাফিজকে মেরে ফেলতে চাইছ। কিন্তু এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর, আমার যাদু অনেক কিছু পারলেও, এটা পারবে না।

সুলতানা রেগে চোখে আগুন ছুটিয়ে বললেন, কিন্তু আমাকে সাহায্য করতেই হবে। যদি যাদু না পারে আমার ছুরি তো পারবেই, আর যদি তুমি সাহায্য না কর তো—

আমি ভয় পাই না–বলল, যাদুকর।

-তবে আমি তোমাকে সাহায্য করব, কারণ তোমরা আমাকে আগে অনেক সাহায্য করেছ। আর তাছাড়া এই যুবরাজ, জাদুকরদের খুব ঘৃণা করে। কাজেই সুলতান হলে সে নিশ্চয়ই সমস্ত যাদুকরদের রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেবে।

কাজেই, একটা কাজ করতে পার। যদিও আমার ওকে মারার কোন ক্ষমতা নেই, আমি তোমাকে একটা যাদু ওষুধ দিতে পারি, যার এক ফোঁটা যদি ওর মাথায় ফেলতে পার, সে একটি কালো বেড়ালে পরিণত হবে। তারপর তাকে সহজেই মারতে পারবে।

কিন্তু মনে রেখো, প্রত্যেক পূর্ণিমার রাত্রে আমার যাদুর ক্ষমতা কমে যাবে এবং সে আগামী ছয় ঘন্টার জন্য মানুষ হয়ে যাবে এবং সমস্ত ক্ষমতা ফিরে পাবে। কাজেই খুব বুদ্ধি করে কাজ করতে হবে, যাতে কেউ টেরও না পায়।

এই কথা বলে, সে তার যাদুলাঠিটা একটা মাথার খুলির চার ধারে গোল করে ঘোরাল। তার মধ্যে একটা কালো তরল ঢালল। সুলতানা ও তার ছেলে আশ্চর্য হয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন। তারপর যাদুকর বিড় বিড় করে কি সব মন্ত্র বলে, তার মধ্যে কিছু ব্যাঙের ঠ্যাং, সাপের চামড়া, হাঙ্গরের দাঁত, ইউনিকর্ণের শিং এই সব ঢালল।

সব যখন হয়ে গেল, সে সেটি সুলতানাকে দিয়ে দিল আর তিনি সেই যাদু-তরলটি লুকিয়ে প্রাসাদে নিয়ে চললেন।

পরদিন সকালে প্রাসাদের সকলে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করতে লাগল, যে, যুবরাজ আল হাফিজকে হঠাৎ পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন, পৃথিবীই তাকে গিলে নিয়েছে। তাঁর দুই নিগ্রো রক্ষীরা জানাল, কেউ প্রাসাদের ভিতর আসেই নি। তবে, যুবরাজ একবার বেরিয়েছিলেন। তারপর কি হয়ে গেছে বলা যাচ্ছে না, কিন্তু কোথাও যে তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না এটাই আসল কথা।

সারা রাজ্য জুড়ে খোঁজা শুরু হল।কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। যেন ভোজবাজির মত একটা মানুষ উধাও হয়ে গেল। তার সুন্দরী নতুন বাগদত্তা এবং সুলতান নিজে ভীষণ দুঃখে পাগলের মত হয়ে গেলেন। কিছুতেই তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়া গেল না। গোটা প্রাসাদ আবার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ল। এতটা শোকাচ্ছন্ন বোধ হয় আগের সুলতানা মারা যেতেও কেউ হয় নি।

এত দুঃখের মধ্যে প্রাসাদে একমাত্র আনন্দের খোরাক ছিল একটি সুন্দর কালো বেড়াল। একে যুবরাজ উধাও হয়ে যাওয়ার পর থেকেই দেখা যেতে থাকল। সে গোটা প্রাসাদে ঘুরে বেড়াত এবং ঘন্টার পর ঘণ্টা সুলতানের হাঁটুতে বসে থাকত। তাঁর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। তার লোমে হাত বুলোলে, চোখের দিকে তাকালে সুলতানের কেমন যেন হারানো ছেলের কথা মনে হত। কিন্তু সুলতানা স্বস্তি পাচ্ছিলেন না এই ভেবে যে, পূর্ণিমা এগিয়ে আসছে। তখনই তো যুবরাজ নিজের চেহারা ফিরে পাবে। তাহলে কি করা যায়! সে তো সব সময়েই সুলতানের কাছেই থাকে। সুলতানের হাঁটুর উপরেই সব সময় বসে থাকে, রাত্রেও তাঁর বিছানার নীচেই ঘুমায়।

একদিন রাত্রে, সব কিছুই যখন অনুকূল এবং সুলতানও কয়েকদিন শোকে অনিদ্রায় থাকার জন্য গভীর ঘুমোচ্ছেন, সুলতানা চুপিচুপি সুলতানের ঘরে এসে একটা বড় মোটা কাপড় সেই ঘুমন্ত বিড়ালটার উপর ছুঁড়ে দিলেন।তারপর তাকে ভাল করে জড়িয়ে জাপটে এনে গায়ের জোরে পাশের দীঘির জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।

সুলতানা একটা ঝুপ করে জলে পড়ার শব্দ শুনতে পেলেন, কিন্তু পিছু ফিরে আর না তাকিয়ে সোজা চুপিচুপি নিজের ঘরে চলে এলেন। পরদিন সকালে তিনি খুব খুশী মনে এবং নিশ্চিন্ত হয়ে বিছানা ছাড়লেন যে, যাক, তাঁর পথের কাঁটা চিরকালের জন্য দূর হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ চোখে পড়ল, দূরে বিড়ালটি তার ভিজা লোম শুকাচ্ছে এবং তাঁর দিকে রেগে তাকিয়ে রয়েছে। তিনি কোন কৌতুহল এ ব্যাপারে না দেখিয়ে ভাবতে শুরু করলেন, এটা কি করে হল!

আসলে, তঁখন যুবরাজ আল হাফিজের বাগদত্তা অন্যান্য সহচরীদের নিয়ে সেই দীঘিতে স্নান করতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখেন, বিড়ালটি ঝুপ করে কোথা থেকে যেন জলে পড়ল। বিড়ালটি কিন্তু মোটেই জলের মধ্যে স্বস্তিতে নেই। যদিও তার আঘাত লাগেনি। কিন্তু তার মাথাটা ডুবে যাচ্ছে দেখে, তাকে তুলে এনে সবাই প্রাসাদে রাখল। তার লোম শুকাতেও বেশ কিছুটা সময় লাগল।

এই ঘটনা শুনে সুলতানা যেন তাঁর রাগ আর চেপে রাখতে পারছিলেন না। তিনি তা চেপে রাখতে না পেরে প্রকাশও করে ফেলছিলেন। অনেক সময় সুলতানের সামনেই তা প্রকাশ হয়ে পড়ছিল। কিন্তু তিনি আর তাঁর ছেলে একের পর এক মতলব আঁটছিলেন কি করে বিড়ালটির ক্ষতি করা যায়। বিড়ালটা এমনই ধূর্ত যে, সবই বানচাল হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে পূর্ণিমাও এগিয়ে আসছে।

একদিন বিড়ালটি বেরিয়ে এল। কারণ, মনে হল যেন তাজা মাছের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে দেখল, সত্যিই মাটিতে একটি মাছ পড়ে রয়েছে। সে ধীরে ধীরে গুঁড়ি মেরে মাছের দিকে এগোল। কিন্তু সে যেই কাছে এগোল, মাছটি একটু পিছিয়ে গেল। আবার যেই তার দিকে এগোল, সেটি আবার পিছিয়ে গেল।

এটা কি হচ্ছে! মাছটা তো বেশ লোভনীয় কিন্তু এটার পিছনে যাওয়াটা কি, ঠিক হবে! সে একবার ভাবল, কিন্তু পরক্ষণেই, কি ভেবে লাফ মারল মাছটির উপর।

কিন্তু হায়, এ কি হল! একটা ভারী কাপড় তার মাথার উপর এসে পড়ল। সে চোখে অন্ধকার দেখল। তখন সে বুঝতে পারল, একটা ভারী পাথরও যেন তার গলায় বাঁধা হল। তাকে ধরে যে দীঘির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেটাও সে বুঝতে পারল। কিন্তু বড়ই অসহায়! এখানে তার সমস্ত চেষ্টা, আঁচড়, কামড় সব বৃথা। সে তখন সম্পূর্ণ ভাবে তার শত্রুদের হাতে বন্দী, যাদের সে দেখতেই পাচ্ছে না। সে শুনতে পেল, তার বিমাতা, সেই সুলতানার কণ্ঠস্বর। উনি বলছেন, শীঘ্র কর, দীঘি আর দূরে নেই। আমি দেখতে পাচ্ছি পূর্বদিক থেকে চাঁদের আলো আসছে। কাজ সারতে হবে পূর্ণিমার আগেই।

কাজেই, বিড়ালটির সমস্ত আশাই জলে গেল, যখন তার মাথার থেকে কাপড়টা সরিয়ে নেওয়া হল, সে দেখতে পেল সামনেই সেই সুলতানার ক্রুর হাসি মুখ। সে দেখল, বেন হারুণ তাকে জলে ফেলে দিতে যাচ্ছে। আহা, অসহায় বিড়ালটি তখন দেখল, তার মৃত্যু আসন্ন, আর কোন উপায়ই নেই।

ঠিক এই সময়েই, পূর্ণিমার চাঁদ পূর্ব দিকে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে বিড়াল যুবরাজ হয়ে গেল। আর পরমুহূর্তেই দেখা গেল বেন হারুণ মল্লযুদ্ধ করছে তার সৎভাইয়ের সঙ্গে। আর তাদের মা, সুলতানা ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছেন। আল হাফিজ নিজের শরীরে অসুরের শক্তি অনুভব করল আর খুব শীঘ্রই বেন হারুণকে পরাস্ত করে বন্দী করে ফেলল।

সুলতান যখন এই ঘটনাটি শুনলেন, রেগে আগুন হয়ে আদেশ দিলেন, রাণীকে এবং তার পুত্রকে যেন রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা ফিরতে চেষ্টা করলে যেন তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর সেই যাদুকরকে পরদিন সকালেই ফাঁসির কাঠে ঝুলানো হল।

এরপর?

এরপর আর কি হবে! সুলতান তাঁর হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুব খুশী হলেন। তিনি খুব ধুমধাম করে প্রাসাদে ছেলের বিয়ে দিলেন। আর বাকী দিনগুলো খুব আনন্দেই কাটাতে লাগলেন।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *