onubad-kutsit-mohila

বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত মহিলা
মূল রচনা: ওলগা তোকারচুক
অনুবাদ: বৈশাখী ঠাকুর


লেখক পরিচিতিঃ
পোলীয় লেখিকা, ওলগা তোকারচুকের জন্ম ২৯শে জানুয়ারি ১৯৬২ সালে। তিনি লেখিকা, সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবি। তাঁকে তার প্রজন্মের অন্যতম সমাদৃত ও ব্যবসাসফল লেখক বলে গণ্য করা হয়। ২০১৮ সালে তিনি তাঁর বিগুনি (ফ্লাইটস নামে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত) উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন। পোল্যান্ডের থেকে তিনিই প্রথম যিনি এই পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।


তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। সার্কাসের আয়োজক হিসেবে বেশ নাম থাকায়, তিনি বিশেষভাবে ভিয়েনাতে আলাদা করে যাত্রা করেছিলেন তাকে দেখার জন্য। ব্যাপারটা আদৌ পূর্বপরিকল্পিত ছিল না। আগে থেকে ওঁর কখনই মনে হয়নি যে তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবেন। কিন্তু একবার চোখে দেখার পরে, যখন প্রথম ধাক্কাটা সামলে ওঠেন, তারপর থেকে উনি চোখ ফেরাতে পারেন নি ওই চেহারা থেকে। তার একটা বড় মাথা ছিল আব এবং মাংস পিন্ডে ভর্তি। তার ক্ষুদে, কুতকুতে চোখ জোড়া নিচু ভ্রূযুগলের তলায় অবস্থান করত। দূর থেকে দেখলে দুটো ছোট ফুটো মনে হত। তার নাকটা দেখে মনে হচ্ছিল সেটা ভাঙা বিভিন্ন জায়গায় আর ডগাটায় ছিল হালকা নীলচে আভা আর কয়েকটা বিক্ষিপ্ত লোম। তার বৃহৎ মুখটা ছিল ফোলা আর খোলা ঝুলছে সর্বদা। ছুঁচলো দাঁতের নীচে সবসময় ভিজে ভেতরটা দেখা যেত। এটা যেন যথেষ্ট নয়, তুলির শেষ টানের মত তার মুখের চারিপাশে লম্বা, রেশমি চুল ঝাকড়া হয়ে গজিয়েছিল।

প্রথমবার সে ভ্রাম্যমাণ সার্কাসের যে পিচবোর্ডে আঁকা সুন্দর সুন্দর সিনারির ছবি থাকে, তার পেছন থেকে সে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল। বিস্ময় এবং বিরক্তির সংমিশ্রিত চিৎকার জনতার মাথা থেকে তার পায়ের ওপর এসে আছড়ে পড়ে। হয়তো সে হাসছিল, কিন্তু সেটা দুঃখজনক কাঁপুনি ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছিল না। সে স্থির হয়ে দাড়িয়েছিল, সম্পূর্ণ অবগত যে জোড়ায় জোড়ায় চোখ তার দিকে চেয়ে আছে, পর্যবেক্ষণ করছে নিখুঁতভাবে প্রতিটি খুঁটিনাটি যাতে দর্শকমন্ডলী তাঁদের বন্ধুদের, প্রতিবেশীদের গিয়ে তার মুখাবয়বের সঠিক ব্যাখা দিতে পারে, অথবা তাঁদের সন্তানদের, যাতে তারা আবার মনে করে এবং আয়নার সামনে নিজের মুখের সাথে তুলনা করতে পেরে—অতঃপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে ধৈর্য সহকারে দাঁড়িয়ে ছিল, উচ্চমনোভাবাপন্ন হয়ে তাকিয়ে ছিল তাঁদের মাথা ছাপিয়ে পেছনের বাড়িঘরগুলোর দিকে।

দীর্ঘ নীরবতার পর, বিস্ময়ে ফুলে ফেঁপে, একজন অবশেষে চিৎকার করে বলল,

— আমাদের নিজের সমন্ধে কিছু বল।

সে ভিড়ের মধ্যে উঁকি মারার চেষ্টা করল, যেদিক থেকে আওয়াজটা এসেছিল। সে খুঁজছিল সেই মানুষটাকে যে এই কথাগুলো বলেছিল কিন্তু ঠিক তখনই বলিষ্ঠ চেহারার এক মহিলা রিংমাস্টার ওই কার্ডবোর্ডগুলোর পেছন থেকে ছুটে বেড়িয়ে এসে ওই কুৎসিত মহিলার হয়ে উত্তর দিল,

— ও কথা বলে না।

— “তাহলে আপনি ওঁর গল্পটা বলুন।“ সেই স্বর অনুরোধ করল। অতএব সেই বলিষ্ঠ চেহারার মহিলা গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করলেন।

অনুষ্ঠানের পর তিনি এক কাপ চা পান করলেন তার সাথে, সার্কাস পার্টিদের যেমন স্টোভে চা হয় তাতে— ওই কুৎসিত মহিলাকে বেশ চালাক চতুর বলেই মনে হল ওঁর। সে অবশ্যই কথা বলতে পারত আর বুঝেশুনেই বলত। তিনি খুব নিবিড়ভাবে ওই মহিলাকে পর্যবেক্ষণ করলেন নিজস্ব ভাবনা এবং প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার সাথে লড়াই করতে করতে। সে কিন্তু ওঁর ভেতরটা পড়তে পারছিল।

— আপনি নিশ্চয় ভেবেছিলেন আমার কথাবার্তাও আমার চেহারার মত উদ্ভট আর বিরক্তিকর হবে, তাই না!

তিনি উত্তর দিলেন না।

সে রুশ কায়দায় নিজের চা পান করল। সামোভার থেকে হ্যান্ডেলবিহীন কাপে চা ঢালল, প্রতি চুমুকের সাথে খুটে খুটে চিনি খাচ্ছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি জানতে পারলেন যে সে অনেক ভাষায় কথা বলতে পারে কিন্তু কোনটাতেই তেমন দক্ষতা নেই। থেকে থেকেই সে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় চলে যাচ্ছিল। এটাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই— ছোটবেলা থেকে সে সার্কাসে বড় হয়েছে, একটি আন্তর্জাতিক ট্রুপে অদ্ভুত সব মানুষের সাথে ঘুরেছে, কোন জায়গায় দ্বিতীয়বার পদার্পণ করেনি।

— আমি জানি আপনি কি ভাবছেন— নিজের স্ফীত, পশুর মত চোখ নিয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে সে আবার বলল। খানিক নীরবতার পর সে যোগ করল,

— যার কোন মা নেই, তার কোন মাতৃস্বরও থাকে না। আমি অনেক ভাষা ব্যবহার করি কিন্তু কোনটাই আমার নিজস্ব নয়।

ওঁর আর সাহস হয়নি উত্তর দেবার। আচমকা ওঁর মনে হয়েছিল সে ওঁর স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে কিন্তু কেন তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। সে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য করছিল। নির্দিষ্ট এবং সুসঙ্গতভাবে কথা বলছিল— যা তিনি একটুও আশা করেননি।

অতঃপর তিনি বিদায় জানালেন তাকে, এবং ওঁকে চমকে দিয়ে সে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল— ভীষণ নারীসুলভ একটি আচরণ। মেয়েলি একটি ইঙ্গিত আর বস্তুতঃ কি নিখুঁত, সুন্দর হাতটা ছিল তার। তিনি মাথা নত করেছিলেন হাতের দিকে কিন্তু ঠোঁট স্পর্শ করেননি।

হোটেলে যখন মাথার নীচে হাত রেখে শুয়েছিলেন, তখন তার কথাই ভাবছিলেন। নিজেকে তার জায়গায় বসিয়ে ভাবছিলেন তার অন্তরের অন্তস্থলে কি চলে— কেমন লাগে সে যা তাই হতে! কেমন লাগে পৃথিবীকে দেখতে ওই শূকরের মত ক্ষুদে কুতকুতে চোখের মধ্যে দিয়ে, নিঃশ্বাস নিতে কেমন লাগে ওই রকম বিকৃত নাকের মাধ্যমে— সে কি সাধারণ মানুষের মত একই রকম গন্ধ পায়! আর কেমন লাগবে এ হেন দেহকে রোজ স্পর্শ করতে স্নানের সময়, চুলকনোর সময় বা ছোট ছোট নিত্যক্রিয়াদি যা আমরা রোজ করে থাকি!

একবারের জন্যেও তিনি দুঃখ পাননি তার এই অবস্থানের জন্যে। তিনি যদি করুণার চোখে দেখতেন তাহলে তাকে প্রেম নিবেদন করতেন না।

কিছু মানুষ এই গল্প বলে বেড়াত যে তাঁদের অত্যন্ত অসুখী একটা প্রেমের সম্পর্ক চলত — এই ভেবে যে তিনি ওর হৃদয়ে সোজাসুজি তাকিয়েছিলেন এবং উনি ওর কুৎসিত মুখকে উপেক্ষা করে ওর ভেতরের মিষ্টি স্বভাবের পরীর প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু না, সেরকম কিছু আদপে নয়। সাক্ষাতের প্রথম রাতের পর থেকেই, নিজেকে রোধ করতে পারছিলেন না এই ভাবনা থেকে যে এরকম এক প্রাণীর সাথে ভালবাসাবাসি করতে কেমন লাগবে, তাকে চুম্বন করতে অথবা তাকে নিরাভরণ করার প্রক্রিয়া—।

পরের কয়েক সপ্তাহ তিনি ওই সার্কাস দলের মধ্যে ঘুরঘুর করতে লাগলেন। তিনি চলে যেতেন, আবার ফিরে ফিরে আসতেন। তিনি ম্যানেজারের ভরসার পাত্র হয়ে উঠলেন, এবং এই সার্কাস দলের জন্য ব্রুনোতে একটা কন্ট্র্যক্ট সই করিয়েছিলেন। সেখানেও এই সার্কাস পার্টিকে অনুসরণ করেছিলেন এবং সার্কাসের সদস্যরা তাঁকে নিজের লোক বলেই মনে করতে শুরু করল। সার্কাসের হয়ে তিনি টিকিট বিক্রি করতেন এবং পরবর্তীকালে স্থূলকায় মহিলা রিংমাস্টারের কাজটাও নিয়ে নিয়েছিলেন এবং সেই কাজে উনি বেশ দক্ষ ছিলেন। সার্কাসের পর্দা উত্তোলনের আগে পর্যন্ত দর্শকদের বেশ জমিয়ে রাখতেন।

“চোখ বন্ধ করুন,” উনি চিৎকার করতেন, “বিশেষ করে মহিলা এবং বাচ্চারা কারণ এই প্রাণীর কদর্যতা সংবেদনশীল চোখের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। যিনি প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনাকে নিজের চোখে দেখবেন তিনি শান্তিতে আর কখনও ঘুমোতে পারবেন না। কিছু মানুষ তো বিধাতার ওপর আস্থাই হারিয়ে ফেলেছেন—”

এই সময় তিনি ঘাড় ঝুলিয়ে থাকতেন বাক্যটি অসম্পূর্ণ রেখে। আসলে এর পর কি বলবেন তিনি জানতেন না। উনি ভাবতেন বিধাতার প্রসঙ্গ আনলেই ব্যাপারটা জোর পাবে। আলোকিত হবে। কিছু মানুষ বিধাতার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে পর্দার পেছনে রমণীটিকে দেখলেই, কিন্তু তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত। বিধাতা যদি কোন কিছু তাকে প্রদান করে থাকেন তাহলে সেটা— বিশ্বের কুৎসিততম মহিলা। কিছু বোকার দল সুন্দরী মহিলাদের জন্য লড়াই করে একে অপরকে মেরে ফেলেছে। আবার কিছু গাধা আছে যারা নাকি নিজের সমস্ত সম্পত্তি খুইয়ে বসে আছে কোন মহিলার খেয়ালের বশবর্তী হয়ে। কিন্তু উনি ব্যতিক্রমী। কুৎসিততম মহিলাটি নিজের ভালবাসা দেখাত দুঃখী কোন পোষা জানোয়ারের মত। সে অন্যান্য মহিলাদের থেকে একদম আলাদা ছিল এবং তাঁকে আর্থিক আনুকূল্য এনে দিত তাকে ঘিরে দর কষাকষিতে সুযোগ করে দিয়ে। যদি তিনি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে তিনি আলাদা ভাবে চিহ্নিত হবেন। ওঁর কাছে বিশেষ কিছু আছে যা অন্য কোন পুরুষের কাছে নেই।

তিনি ওকে ফুল কিনে দিতে শুরু করলেন— তেমন দামী বোকে নয়, সস্তার কিছু ফুল ফয়েল বা টিস্যু পেপার দিয়ে ডাঁটি গুচ্ছ মোড়া, অথবা সুতির কোন গলার স্কার্ফ, চকচকে ফিতে বা এক বাক্স লজেন্স। তারপর তিনি সম্মোহিতের মত দেখতেন যখন সে ফিতেটা তার কপালে বাঁধত। তাতে শোভা বর্ধনের বদলে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠত। তারপর যখন সে লজেন্সগুলো চুষত অতিরিক্ত বড়, স্ফীত জিভ দিয়ে, তিনি হাঁ করে চেয়ে থাকতেন আর দেখতেন কিভাবে তার বাদামী লালা তার ফাঁকা ফাঁকা দাঁতগুলো দিয়ে গলে তার লোমশ গালে এবং থুতনিতে এসে পড়ত।

তার অজান্তে তিনি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। তিনি সকালে চুপিসারে উঠে তাঁবুর আড়ালে লুকিয়ে পড়তেন তাঁকে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখবেন বলে তা সে যে কোন ফুটো বা কাঠের বেড়ার ফাঁক দিয়েই হোক না কেন! সে রোদ পোহাত এবং রোদে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সে তার অগোছালো, নোংরা চুল আঁচড়াত, যেন সে কোন ঘোরে রয়েছে, সরু সরু বিনুনি করত, আবার সেগুলো খুলে ফেলত তৎক্ষণাৎ। অথবা সে একটা ঢিলেঢালা শার্ট পরে, উন্মুক্ত বাহুতে একটা গামলা নিয়ে কাচতে বসত। তার বাহুজোড়া এবং বুকের ওপরের চামড়া ত্বক ফিকে এক লোমের আবরণ দিয়ে যেন ঢাকা ছিল। খুব সুন্দর লাগত দেখতে। নরম, ঠিক কোন পশুর মত!

এই গোয়েন্দাগিরির তাঁর প্রয়োজন ছিল, কারণ যত দিন যেতে লাগল তাঁর বিতৃষ্ণা হ্রাস পেতে লাগল, গলে যেতে লাগল রোদে যেমন ছোট কোন গর্তের জল বাষ্প হয়ে উড়ে যায় কোন তপ্ত দুপুরে। ধীরে ধীরে ওই বেদনাদায়ক অসামঞ্জস্য তাঁর চোখে সয়ে আসছিল, তার বিসদৃশ শারীরিক অনুপাত, তার সমস্ত ত্রুটি, বাড়াবাড়ি— সবটা। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হত তাকে বেশ সাধারণ দেখতে!

যখনই তিনি অস্বস্তি অনুভব করতেন, তিনি সার্কাস পার্টিকে বলতেন যে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছেন, যে ওঁর একটি মিটিং আছে অমুক এবং অমুকের সাথে— তিনি এক আগুন্তুকের নাম নিতেন বা কোন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করতেন। তিনি চুক্তি করছেন। তিনি আলোচনা করতে চলেছেন। জুতো পালিশ করে, সেরা জামাটা কাচতেন এবং নিজের রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। বেশী দূর তিনি কোনদিনই যেতেন না। নিকটবর্তী শহরে থামতেন, কারুর পয়সার ব্যাগ চুরি করে গলা পর্যন্ত মদে ডুবে থাকতেন। কিন্তু তখনও উনি তার থেকে মুক্তি পেতেন না। তিনি তার সমন্ধে গল্প করতে শুরু করতেন। তিনি তাকে ছাড়া বিল্কুল চলতে পারতেন না– এইসব চম্পট অভিযানেও।

আর সবচেয়ে যেটা অদ্ভুত ব্যাপার হল—সে তাঁর সবচেয়ে দামী সম্পত্তি হয়ে উঠেছে। যখন তিনি চাইতেন, তার কদর্যতাকে মনে করে মদের গ্লাসে উল্লাস তুলতেন। তার থেকেও বড় কথা তিনি সুন্দরী অল্পবয়সী যুবতীদের মোহিত করতেন তার মুখমন্ডলের বিবরণ দিয়ে, যে সব যুবতীরা ওঁকে বলত তার কথা বলেই যেতে রাতের অন্ধকারে যখন তারা নগ্ন ওঁর নীচে শুয়ে।

যখন তিনি ফিরতেন তখন সবসময় তাঁর কাছে একটা নতুন গল্প থাকত জনতার জন্য তার কদর্যতাকে ঘিরে। কোন অস্তিত্বেরই তেমন মূল্য নেই যদি তার পেছনে কোন বিশেষ কাহিনী না থাকে। প্রথমে তিনি তাকে সেটা পাখি পড়ার মত মুখস্থ করিয়ে নিতেন কিন্তু অচিরেই দেখলেন বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত মহিলা গল্প বলাতে একদম পটু নয়। একঘেয়ে ভাবে গল্পটা বলে যেত এবং তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ত, তাই তিনি তার হয়ে গল্প বলাটা শুরু করলেন। তিনি একদিকে দাঁড়াতেন, তার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলতেন,

— এই হতভাগ্য প্রাণীটার মা, যে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে, যার উপস্থিতি আপনাদের নিষ্পাপ চোখের পক্ষে অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে, একদা ব্ল্যাক ফরেস্টের ধারে একটি গ্রামে থাকত। আর সেখানে এক গরমের তপ্ত দুপুরে সে ফল কুড়োচ্ছিল জঙ্গলে, তখন এক জংলী শূকর তাঁকে শিকার করেছিল, আক্রমণ করেছিল উন্মক্ত লালসায়।

ঠিক এই মুহূর্তে তিনি অবশ্যম্ভাবী শুনতে পেতেন চাপা, আতঙ্কিত কান্না, আর কিছু মহিলা যারা ছেড়ে চলে যাবার উদ্যোগ নিয়েছিল, তারা তাঁদের দ্বিধান্বিত স্বামীদের শার্টের হাতা ধরে টানাটানি করত।

এ কাহিনির আরো সংস্করণ ছিল তাঁর কাছেঃ

— এ মহিলার আগমন অভিশপ্ত এক জায়গা থেকে। শয়তানের উত্তরসূরি এই মহিলা, নিষ্ঠুর একটি জাতি যারা কোন দয়ামায়া দেখায়নি একটি অসুস্থ ভিখারিকে, যে জন্যে আমাদের প্রভু শাস্তি দিয়েছিলেন এই সমগ্র গ্রামটিকে বংশানুক্রমে এই সাংঘাতিক কদর্যতা প্রদান করে।

এরকম আর দু চাররকমের কাহিনি প্রস্তুত থাকত। তাই জন্যে কোন অপরাধবোধ ওঁর মধ্যে ছিল না। যেন যে কোন একটা সত্যি হতেই পারত।

— আমি জানি না আমার বাবা-মা কারা, বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত মহিলা ওঁকে বলেছিল, আমি বরাবরই এরকম। আমাকে শিশু অবস্থায় সার্কাসে পাওয়া যায়। তাঁর আগের গল্প কেউ জানে না।

তাঁদের একসাথে কাটানো প্রথম মরশুম যখন শেষের দিকে, সার্কাস দল অলস ভঙ্গীতে ধীরে ধীরে চলেছিল ভিয়েনাতে শীতঘুমের জন্য, তখন তিনি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। লজ্জায় রাঙা হয়ে সে কেঁপে উঠেছিল। তারপর শান্ত হয়ে বলেছিল,

— ঠিক আছে। তারপর আলতো করে তার মাথাটা তাঁর বাহুতে রেখেছিল। তিনি তাঁর গায়ের গন্ধ পাচ্ছিলেন— নরম সাবানের মতন গন্ধ। এই মুহূর্তটা সহ্য করে নিয়েছিলেন, বরঞ্চ সরে এসে তাকে দুজনের ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা বলতে লাগলেন, প্রতিটা জায়গার নাম উল্লেখ করে যেখানে দুজনে একসাথে বেড়াতে যাবেন। ঘরময় পায়চারি করছিলেন যখন তিনি, সে তার নজর তাঁর ওপর নিবদ্ধ রেখেছিল, কিন্তু নীরব আর বিমর্ষ ছিল। তারপর তাঁর হাতটা ধরে ঠিক উল্টো কথা বলল সে, কোথাও একটা নিশ্চিতভাবে স্থিতু হতে চায় সে, কোথাও যেতে চায়না, কারুর সাথে দেখা করতেও চায়না। আর সে রান্না করবে, আর তাদের বাচ্চা থাকবে আর একটা বাগান থাকবে অবশ্যই।

— তুমি এটাকে কোনদিনও মেনে নিতে পারবে না। তোমার বড় হয়ে ওঠা একটা সার্কাস পরিবারে। তোমার দিকে লোকে তাকিয়ে থাকবে—এটা তোমার চাহিদার মধ্যে পড়ে। তুমি মরে যাবে লোকেদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করতে পারলে।

সে কোন উত্তর দেয়নি।

ছোট্ট একটা গির্জায় তাদের বিয়ে হয় ক্রিসমাসের সময়। যে পাদ্রি বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পাদন করেছিলেন তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন। মন্ত্রোচ্চারণের সময় পাদ্রির গলা কাঁপছিল। অতিথিদের মধ্যে সার্কাসের লোকজনই ছিল কারণ তিনি তাকে বলেছিলেন যে তার মত তিনিও একা এই পৃথিবীতে। তাঁরও পরিবার পরিজন কেউ নেই।

যখন সবাই যে যার সীটে ঢুলছিল, সবার বোতল ফাঁকা হয়ে গেছিল এবং ঘুমোতে যাবার তোড়জোড় করছে, তিনি সবাইকে থাকতে বললেন আর আরো মদ চেয়ে পাঠালেন। ওঁর নেশা হচ্ছিল না কিন্তু উনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলেন মাতাল হবার। কিছু একটা ওঁর মধ্যে ভীষণ সজাগ ছিল, উত্তেজিত ছিল। পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে ঘাড় এলিয়ে থাকতে পারছিলেন না, তিনি সটান সোজা হয়ে বসেছিলেন, গাল দুটো লাল হয়ে যাচ্ছিল। চোখ দুটো যেন জ্বলছিল।

— চল এবার যাই, আমার প্রিয়, সে তাঁর কানে ফিসফিস করে বলল। কিন্তু তিনি টেবিলের ধার আঁকড়ে বসে রইলেন, যেন কেউ কোন অদৃশ্য পিন দিয়ে গেঁথে রেখে দিয়েছে। অতি পর্যবেক্ষক অতিথিরা হয়তো ভেবেছিলেন যে তিনি ঘনিষ্ঠ হওয়ার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছেন, ওই চেহারার নগ্ন রূপ— ফুলশয্যার রাতে বাধ্যতামূলক যে শারীরিক উন্মোচন, ঘনিষ্ঠতা—। তবে কি সেটাই আসল কারণ ছিল?

— আমার মুখ স্পর্শ কর, অন্ধকারে সে তাঁকে অনুরোধ করল কিন্তু তিনি তা করলেন না। নিজের হাতের ওপর ভর করে তিনি নিজেকে উচ্চ আসনে নিয়ে গেলেন যাতে ওই ক্ষীণ আলোয় তাকে সিলুয়েট ছাড়া আর কিছু মনে না হয়। তারপর তিনি চোখ বন্ধ করলেন, সে দেখতে পেল না— তারপর তাকে গ্রহণ করলেন, অন্য আর যে কোন মহিলার মত, মাথার মধ্যে কিছু না রেখে যেমনটা তিনি সাধারণতঃ করে থাকেন।

পরের মরশুমটা তারা নিজেদের মত শুরু করলেন। তিনি তার কিছু ছবি তোলালেন এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিলেন। টেলিগ্রাফ থেকে বুকিং এল। তারা অজস্র জায়গা ঘুরে বেড়ালেন এবং সমস্তটাই প্রথম শ্রেণীতে। সে সবসময় একটা টুপি পরত আর একটা মোটা, ধূসর রঙের ঘোমটার মত আবরণ যার আড়াল থেকে রোম, ভেনিস ইত্যাদি দেখেছে সে। তিনি তাকে অনেক লেসের ঢাকা দেওয়া পোশাক এনে দিয়েছিলেন যাতে যখন তারা ইউরোপের বিভিন্ন শহরের ভিড় রাস্তায় হেঁটে চলে বেড়ায় তখন তাদের স্বাভাবিক দম্পতির মতই লাগে। কিন্তু সেই সুখের সময়েও, তাঁকে থেকে থেকেই পালিয়ে যেতে হত। ঠিক যেমন মানুষটা উনি ছিলেন— চিরন্তন পলাতক। হঠাৎ করে কোন আতঙ্ক ওঁকে গ্রাস করত, অসহ্য এক উদ্বেগে আক্রান্ত হতেন। দর দর করে ঘামতে শুরু করতেন, দম বন্ধ হয়ে আসত। অতএব তখন বেশ কিছু ক্যাশ নিয়ে, টুপিটা মাথায় দিয়ে, তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে নিজেকে নির্ভুলভাবে কোন বন্দরের জলে খুঁজে পেতেন। এইখানে তিনি আরাম করতেন। খেতেন, পান করতেন, ঘোরাঘুরি করতেন মনের আনন্দে যতক্ষন না কোন গণিকা তাঁর সব পয়সা কেড়ে নিয়ে সর্বস্বান্ত করেছে।

প্রথম বার কুৎসিততম মহিলা তাঁকে তাঁর আচরণের তিরস্কার করেছিল, তিনি তার পেটে এক ঘুষি মেরেছিলেন, কারণ এখনও তার মুখ স্পর্শ করতে উনি ভয় পেতেন।

তিনি আর উন্মক্ত শূকর বা ভগবানের অভিশাপের গল্প বলতেন না নিজেদের রুটিনের কাজ করার সময়। তিনি ভিয়েনার চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অধ্যাপকের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন। ইদানীং ওঁর নিজের স্ত্রীকে বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে ব্যাখা করতে বেশি ভাল লাগে,

“প্রিয় মহাশয় এবং মহাশয়াগণ, এখানে আমাদের মধ্যে উপস্থিত রয়েছে প্রকৃতির এক আশ্চর্য খেয়াল— একটি মিউট্যান্ট— বিবর্তনের ভুল, হারিয়ে যাওয়া প্রকৃত সূত্র। এই নমুনা বড় বিরল নমুনা। এমন একটা নমুনা জন্মাবার সম্ভাবনা ততটা, এখানে আমার এই বক্তব্যের মাঝে উল্কাপাতের সম্ভাবনা যতটা”।

অবশ্য তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সাথে মাঝে মাঝেই দেখা করতে যেতেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে তারা দুজনে একসাথে ছবিও তুলেছিলেন— সে বসেছিল এবং তিনি তার পেছনে দাঁড়িয়ে, হাতটা তার কাঁধে দিয়ে।

একবার যখন ভদ্রমহিলার শারীরিক মাপ নেওয়া হচ্ছিল, অধ্যাপক মশাই একটা কথা জানতে চেয়েছিলেন তার স্বামীর কাছ থেকে,

— আমি ভাবছি এই মিউটেশন বংশগত কিনা? আপনার কি সন্তান নেবার ব্যাপারে পরিকল্পনা আছে কোন? আপনারা কি চেষ্টা করেছেন? আপনার স্ত্রী কি—? আপনি কি সত্যিই আসলে—মানে—?

এর খুব বেশি দিন পরে নয়, হয়তো এই কথাবার্তার সাথে কোন যোগাযোগ নেই, সে ওঁকে জানাল যে সে মা হতে চলেছে। সেই থেকে তিনি যেন এক দ্বিখণ্ডিত পুরুষ। তিনি চেয়েছিলেন তার যেন নিজের মতই এক সন্তান হয়— তাহলে তারা আরো অনেক বেশি চুক্তি করতে পারবে, আমন্ত্রন পাবে। সেরকম দিন এলে, তার যেন সারা জীবনের জন্য রসদ মজুত থাকে, যদি তার স্ত্রী চলার পথে ইহলোক ত্যাগও করে। বলা যায় না তিনি বিখ্যাতও হয়ে যেতে পারেন! কিন্তু তখনই মনে হল— যদি বাচ্চাটা একটা রাক্ষস হয়, এবং তিনি যদি পারতেন তাহলে ওই অভিশপ্ত জীবন যাপন করার চেয়ে তার পেট চিরে ওই সন্তানকে বের করে রক্ষা করতেন ওই বিষাক্ত ত্রুটিপূর্ণ রক্তের কবল থেকে। তারপর রাতে দুঃস্বপ্ন আসতে লাগল যে তিনিই আসলে তার ছেলে হয়ে তার পেটে বন্দী হয়ে আছেন এবং ওই মহিলার অপত্য স্নেহ তাঁকে গ্রহণ করতে হবে এবং তার পেটের ভেতর থাকতে থাকতে ক্রমশঃ তাঁর মুখ ওই মহিলার মত হয়ে যাচ্ছে! অথবা উনি স্বপ্ন দেখতেন যে তিনি জঙ্গলের সেই বন্য শূকর যে একটি নিষ্পাপ মেয়েকে আক্রমণ করেছিল। ঘামতে ঘামতে উঠে বসতেন আর কায়মনোবাক্যে তাঁর গর্ভপাতের কামনা করতেন।

তার পেট জনতাকে সাহস জুগিয়েছে, সহজে দর্শক ক্ষমা করতে পেরেছে তার দানবীয় কদর্যতাকে। তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল যার উত্তর সে খুব লাজুক ভাবে দিত এক শান্ত, অবিশ্বাস্য উপায়ে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবরা শর্ত ফেলতে শুরু করেছে যে কিরকম সন্তান তার হবে। কন্যা সন্তান নাকি পুত্র সন্তান কোল আলো করে আসবে? সে সবকিছুই ভীরু মেষশাবকের মত গ্রহণ করত।

সন্ধের দিকে সে বাচ্চাদের জন্য জামা সেলাই করত।

“তুমি জান”, সে বলত, অদূরে কোন বিন্দুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে হঠাৎ থেমে, “মানুষ এত দুর্বল এবং একা, আমার তাদের জন্য খুব দুঃখ হয় যখন আমার সামনে বসে আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখি। তাদের অন্তরগুলো যেন সব ফাঁকা, যেন তাদের একটা ভাল করে সামনে বসে দেখার কিছু চাই নিজেদের ভরিয়ে রাখার জন্য। এক এক সময় আমার মনে হত ওরা আমাকে হিংসে করে। আমার তবু একটা অবস্থান রয়েছে। ব্যতিক্রমী কোন কিছুর এত অভাব তাদের মধ্যে, অতএব তারা বিশেষ কিছু হয়ে উঠতে পারছে না। “

তিনি চমকে উঠেছিলেন কথাগুলো শুনে।

সেই রাতে সে জন্ম দিল নীরবে, কোন ঝামেলা না করে ঠিক পশুদের মত। ধাইমা শুধু নাড়ি কাটতে এসেছিল। তিনি ধাইমাকে বেশ অনেকগুলো নোট ধরিয়েছিলেন যাতে সে অতি দ্রুত কোন গল্প ছড়াতে না শুরু করে। তাঁর হৃৎকম্প হচ্ছিল অত্যন্ত দ্রুত তালে, সব কটা আলো উনি একসাথে জ্বালিয়ে দিলেন, যাতে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। বাচ্চাটি কদাকার ছিল, মায়ের থেকেও বেশি! বমির বাসনা রোখার জন্য সাথে সাথে চোখ বুজে ফেলেছিলেন। অনেক পরে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে সদ্যজাত শিশুটি কন্যাসন্তান যেমনটা ওর মা চেয়েছিল।

তো তারপর যেটা হয়েছিল— তিনি শহরের অন্ধকার জায়গায় গেলেন— সেটা ভিয়েনা হতে পারে বা সেটা বার্লিনও হতে পারে। হালকা তুষারপাত হচ্ছিল। রাস্তার নুড়িপাথরের ওপর করুণভাবে তিনি জূতো পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। অন্তরে নিজেকে বিভক্ত অনুভব করলেন— খুশি কিন্তু একই সাথে বেপরোয়া।

তিনি পান করলেন কিন্তু সংযত থাকলেন। দিবাস্বপ্ন দেখে হলেন আতঙ্কিত। যখন তিনি ফিরলেন বেশ অনেকদিন বাদে, তখন ভ্রমণের সাথে সাথে প্রচারের সব পরিকল্পনা প্রস্তুত। তিনি অধ্যাপককে চিঠি লিখে একজন ফটোগ্রাফারের ব্যবস্থা করলেন, যার কাঁপা কাঁপা হাতে ম্যাগনেসিয়াম ঝলসে ঝলসে উঠে উভয় প্রাণীর দানবীয় কদর্যতা রেকর্ড হচ্ছিল।

যেমনি শীতের অবসান হল, যেমনি ফরসিথিয়া ফুল ফুটে উঠল, যেমনি বড় বড় শহরের পাথর শুকিয়ে গেল, তাঁর মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল পিটারসবারগ, বুখারেস্ট, প্রাগ, ওয়ারস, আরো দূরে আরো দূরে— সেই নিউইয়র্ক, বুয়নেস অ্যারিজ— মাথার ওপর এই দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ আর ভাসমান মেঘের ভেলা দেখে যেমন সবাই মুগ্ধ হয় তেমনি সারা পৃথিবী তাঁর স্ত্রী কন্যার কদর্যতায় মুগ্ধ হবে এবং তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে।

জীবনের এরকম একটা মুহূর্তে তিনি তাকে চুম্বন করেছিলেন প্রথমবারের মত। ঠোঁটে নয়, না না, কপালে। সে তাঁর দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, একদম মানুষের মত। তারপর সেই আমোঘ প্রশ্নটা ফিরে এসেছিল— কে তুমি? কে তুমি? তুমি কে? নিজের মনে বারবার প্রশ্নটা করতে লাগলেন। হুঁশ ছিল না ঠিক কবে থেকে উনি প্রশ্নটা করতে শুরু করেছেন অন্যদেরকেও? এমনকী নিজেকেও আয়নায় দেখে শেভিং করার সময়! ব্যাপারটা এমন যেন তিনি জীবনের নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন করেছেন— প্রত্যেকেই ছদ্মবেশে, মানুষের মুখ আসলে তার মুখোশ, সারা জীবনটা আসলে একটা নাটক। এক একসময় পানাহার করে তিনি কল্পনা করতেন— কারণ ভদ্র থাকার সময় তিনি কখনই এসব করতে নিজেকে অনুমতি দিতেন না— যে তিনি মুখোশগুলো খুলে ফেলছেন আর সামান্য আঠা লাগানো সেই সব মুখোশ খুলে খুলে পরে আসল রূপ বেরিয়ে আসছে— হায়! সত্যি নাকি! ব্যাপারটা এমন আলোড়িত করেছিল ওঁকে যে উনি বাড়িতে স্ত্রী কন্যার সাথে থাকতেই রাজি ছিলেন না। ওনার ভয় করত কখনও যদি ওই ভাবনার বশবর্তী হয়ে উনি সত্যি সত্যি আঁচরে খামচে তার মুখের কদর্যতাকে তুলে দিতে চান। তাই তিনি পান করতে বেরিয়ে পড়তেন, পরের ভ্রমণের খসড়া তৈরি করতেন, পোস্টার ডিজাইন করতেন এবং টেলিগ্রাম লিখতেন।

কিন্তু বসন্তের প্রাককালে, সাংঘাতিক স্প্যানিশ ফ্লু-এর আগমন ঘটল, এবং মা-সন্তান দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। দুজনে প্রবল জ্বরে পাশাপাশি শুয়ে থাকত এবং ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলত। থেকে থেকেই কোন আতঙ্কের বশে সে বাচ্চাটাকে নিজের কাছে টেনে আনত আর ঘোরে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করত। বুঝতে পারত না যে বাচ্চাটা মরে যাচ্ছে। তার মধ্যে আর কোন অবশিষ্ট শক্তি নেই দুধ টানার। আর সত্যিই যখন শিশুটি মারা গেল, তিনি তাকে বিছানার একটা ধারে রাখলেন আর একটা সিগারেট ধরালেন।

সেই রাতে এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত মহিলার একটু জ্ঞান ফিরেছিল এবং অসহায় ভাবে সে কাঁদতে শুরু করেছিল। তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। ওই নিকষ কালো অন্ধকার, একে অন্ধকারের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, তার মধ্যে ওই কান্নার স্বর! তিনি কানে চাপা দিলেন। শেষে নিজের টুপিটা করায়ত্ত করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। তবে খুব বেশি দূর গেলেন না। নিজের ঘরের বাইরে জানলার পাশ দিয়ে পায়চারি করলেন সারা রাত এবং এইভাবে তাকেও মৃত্যুবরণ করতে সাহায্য করলেন। উনি যা আশা করেছিলেন, তার থেকে অনেক আগেই মৃত্যুটা ঘটে গেছিল।

নিজেকে ওই ঘরে বন্দী করে দুটি মৃতদেহর দিকে তাকালেন। আচমকা ওগুলোকে ভীষণ ভারী, বোঝার মত মনে হল। তিনি অবাক হয়ে গেলেন যে গদিটা কতটা ঝুলে পড়েছে ওই দুটি প্রাণীর অবস্থানের ফলে। তিনি কাউকে বললেন না। পান করতে করতে একমাত্র অধ্যাপককে ফোন করলেন।

অধ্যাপক যখন এলেন ময়নাতদন্তের উদ্দেশে তিনি করুন আর্তি নিয়ে বললেন,

— ওদেরকে বাঁচান।

— আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এরা দুজনেই তো আর বেঁচে নেই।

এরপর অধ্যাপক একটি কাগজ ধরালেন ওঁর হাতে। বিপত্নীক ব্যাক্তিটি ডান হাত দিয়ে ওই কাগজে সই করলেন এবং বাঁ হাত দিয়ে টাকাটা নিলেন।

কিন্তু সেই একই দিনে বন্দরে অদৃশ্য হবার আগে, তিনি অধ্যাপক মহাশয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাবার জন্য দেহ দুটো গাড়িতে তুলতে সাহায্য করেছিলেন।

তা প্রায় কুড়ি বছর ধরে তারা দুজন ওই বিল্ডিঙের নিচে স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় থাকত। পরে যখন সুদিন এল তখন তারা মূল সংগ্রহের সাথে অবস্থান করার সুযোগ পেল— জোড়া মাথার বাচ্চা, বিভিন্ন প্রজাতির যমজ বাচ্চা কোন না কোন ভাবে জুড়ে গেছে— তাদের সাথে। এখনও গেলে তাদের দেখা যাবে প্যাথোলজিস- অ্যান্যাটোমিচেস, বুন্ডেসমিউজিয়াম—এর ষ্টোররুমে কাচ চোখওয়ালা মা ও মেয়ে, নিথর হয়েও এখন সম্পূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ ভঙ্গিতে— কোন নতুন, অসফল প্রজাতির অবশিষ্টাংশের মত।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *