onubad-luk

Luk লুক
মূল রচনা: এদমুন্দো পাস সোলদান
অনুবাদ- জয়া চৌধুরী


লেখক পরিচিতি — এদমুন্দো পাস সোলদানঃ
জন্ম ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ার কোচাকাম্বা শহরে। লাতিন আমেরিকার সাহিত্য জগতে ম্যাজিক রিয়ালিজমের পরবর্তী একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার নাম MCondo মাকোন্দো, এই রীতিতে পুরনো রীতির সঙ্গে টেকনোলজিক্যাল দিকতি মেশাচ্ছেন। এই ধারা সাহিত্যে সোলদান এক বিশেষ নাম। খুয়ান রুলফো পুরস্কার, গুগেনহাইম স্কলারশিপ সহ বেশ কিছু পুরস্কারে সম্মানিত এই সাহিত্যিকের প্রকাশিত উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের সংখ্যা বেশ কিছু। এই গল্পটি তার বিখ্যাত বই “খুঁতওয়ালা প্রেম” ba Amores Perfectos থেকে নির্বাচিত।


নিচে নেমে যাচ্ছে জাহাজ। ছোট জানলাটা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ছুঁচলো পাথরগুলো। পাহাড়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে শহর। আর শুকিয়ে যাওয়া নদীখাত শহরের সীমানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেড়ে আসা ভয়ংকর বাতাসের সামনে ঢালের মত হয়েছিল শহর কোন্দ্রা। ঠিক যেন একটা শুকনো করার মেশিন। গরম বাতাসের দাপটে তাপ বাড়ছে। প্রচণ্ড তাপে মাথাও ধরিয়ে দিচ্ছে। এক রকমের প্রাণী ঘেউ ঘেউ করে ক্রমাগত তারস্বরে চিৎকার করছে, কানে এলে মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি। আমি আর লুক কতবার যে ভেবেছি এইসব পাথরের ফাঁকে ফাঁকে থাকা গুহাগুলো হিংস্র রাক্ষসে ভরা রয়েছে, তাদের চাইতে এ শহরে যে সব প্রাণী ঘুরে বেড়ায়, তারা ঢের বেশি হিংস্র। আমাদের কাছে ওরা গল্প করত- একদিন সবকটা মন্দির ভেঙে যাবে। সমস্ত বাড়ি ঘর ভাঙবে, মালিকরা সব নতুন হবে। আমরা ভুল করছিলাম। ধ্বংস আসলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকছিল। নিঃশব্দে আমাদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

বেস ক্যাম্পে কর্পোরেশনের অফিসারেরা সকলে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে উষ্ণ ভাবে জড়িয়ে ধরলেন তাঁরা। হাবভাব দেখে মনে হল আমার জন্য ওঁদের করুণা হচ্ছিল। আসলে সবাই জানতেন কি ঘটেছে, যদিও সাদাসিধা আমি বিষয়টাকে ব্যক্তিগতই রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দুনিয়া এতটাও বড় ছিল না যাতে আমরা কোনকিছু গোপন রাখতে পারি। তাছাড়া আমরা তো অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। সবসময় এই ভয়েই থাকতাম যা অন্যদের ছুঁয়েছে তা এই বুঝি আমাদের ছুঁয়ে ফেলল। অসময়ে ঘুম ভেঙে উঠে পড়তাম। তারপর প্রথমেই খুঁজতাম কোন আয়না। নিজের মুখ দেখার জন্যই আয়না খুঁজতাম। শরীরের মাংসপেশির যে কোনরকম বদল ঘটলেই তাড়াতাড়ি ছুটতাম ডাক্তারের খোঁজে। মনে ভেতর একটু উদ্বেগ হলেই ত্বকের উপর নানান রকম দাগ ফুটে উঠত। সেটা অনিদ্র থাকার কারণেও হতে পারে, কিংবা আজই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে… আজকেই হল শেষের সেই দিন… এমন কোন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে উঠলেও মনে উদ্বেগ হত। (সে এক এমন সময় ছিল যখন আমাদের প্রজাতির লোকেরা খারাপ কিছুকে বসে বসে প্রশ্রয় দিত। সর্বক্ষণ আমরা স্রেফ সন্ধ্যে নেমে আসার সাক্ষী থাকতাম।)

হয়ত অফিসারদের অনুরোধ করতাম যাতে ওঁরা আমার প্রতি জেগে ওঠা করুণার মনোভাবকে সংযত রাখেন। তবুও নিজেকে চুপ করিয়ে রাখলাম। জিপুতে উঠে বসলাম। জিপু এক বিশেষ ধরনের গাড়ি। হেলিকপ্টার ছেড়ে দিলাম। এই পৃথিবীতে এ ধরনের গাড়িই চলে। ‘কি’- র পাতায় বেরনো প্রতিবেদন থেকে সব খবর জানলাম। ক্ষমতাধারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা তাদের এগোনো জারী রেখেছে। মেগারার বাইরে একটা পরিত্যক্ত কারখানা দখল করে রয়েছে ওরা। চলে যাবার আগে কর্পোরেশনের একজন অফিসার অনুরোধ করলেন আমি যেন এক মুহূর্তের জন্যও সীমান্ত ছেড়ে না যাই। আমাকে ওঁর দরকার আছে। মনে করিয়ে দিলেন মাসের মধ্যে একমাত্র যেই দিন আমি লুকের সঙ্গে দেখা করতে যাই সেটা ছিল সেই দিন। আমি যেন ও কাজটা বাদ না দিই। এ প্রসঙ্গে আমি আরো একটু বাড়িয়ে বলতে চাইব। আসলে আমাকে না দেখলে লুকের মন খারাপ হয়ে যাবে। ওর মানসিক অবস্থার জন্যও এই রুটিন গুরুত্বপূর্ণ। কথা দিলাম লুকের কাছে তাড়াতাড়ি যাব। আবার সেদিন রাতেই ফিরে আসব। এক অফিসার অনুমতি দিল বটে তবে লোকটার কোন খারাপ মতলব ছিল। চোখের সামনে শূন্যে ঝুলতে থাকা স্ক্রিন থেকে অফিসার লোকটার মুখ মুছে গেল। এটা দেখে আপনার হয়ত আমাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হতে পারে তবে এটা ঠিক যে আমার নিজেরও সীমান্তের কাজটা তখন আর অপরিহার্য মনে হচ্ছিল না। অন্তত আমার নিজের লোকদের জন্য তো তা নয়ই। আর লুকের দিক থেকেও যদি তা ভাবি তাহলে সত্যিটা স্বীকার করতেই হবে যে এই লুকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া আমার কাছে যতখানি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, লুকের কাছে ততখানি ছিল না। কথাটা এভাবেও আমি বলতে চাইতাম না কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেতে গেলে এটার প্রয়োজন ছিল। সেক্ষেত্রে আমিও যাবার কারণ হিসাবে ‘দয়া’ বা ‘করুণা’ শব্দগুলো ব্যবহার করতাম। ভবিষ্যতে ওরাও যদি আমার সম্বন্ধে এই শব্দগুলো ব্যবহার করে তাহলে আমারও আর অভিযোগ করা উচিৎ না।

আকাশের সূর্যের তাপ মাটির উপর প্রায় ফেটে পড়ছিল। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। আমার শহর কোন্দ্রাকে যেমনটি ছেড়ে গিয়েছিলাম ঠিক সেখান থেকেই সে আমায় স্বাগত জানাল। দূরে দিগন্তে পাহাড়ের চুড়ায়, অসম্ভব তীব্র সবুজ গাছগাছালির ফাঁকে কলঙ্কহীন এক ঝকঝকে নীল আকাশ। আগে দিনের বেলার গরমে তেতে ওঠা মাটির প্রচন্ড তাপ লঘু করত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। কিন্তু শহরটা একটু সরে গিয়েছে যেন। আর শহরের স্থানান্তকরণ সেই পরিবেশকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে যদিও, তবু তা একেবারে ভুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অন্তত কিছুদিনের জন্য তো ভুলতেই পারছিলাম না পুরনো স্মৃতি।

মঠের দিকে যাবার রাস্তার দুপাশে দু জায়গায় আগুন জ্বলছিল। গাড়ি যে চালাচ্ছিল, পোশাকের আচ্ছাদনের বাইরে তার শুধু মুখটুকু বের হয়ে রয়েছিল। নোংরা মাতালদের মত গাড়ির চালকের মুখ ঢাকা ছিল। বলল ওটা নাকী জরুরী। ভাইরাস যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেইজন্য এই বন্দোবস্ত।। অথচ জঙ্গলে পরিবেশের সঙ্গে নিত্য মানিয়ে নেওয়ার মত যে সব মিউট্যান্ট প্রজাতির প্রাণীরা থাকে, প্রত্যেকবার তারা এত সাহসী হয়ে ওঠে যে খিদে পেলে খাবারের খোঁজে শহরেও হানা দেয়।

চালক বলল ওগুলো সবচাইতে খারাপ প্রজাতির প্রাণী। কোন্দ্রা থেকে ওগুলোকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়াও খুব একটা কার্যকরী হবে না। বরং ওগুলো সমূলে ধ্বংস করে ফেলা দরকার। যেটা আমরা করছি সেটা হল চারদিক ঘিরে রেখে শত্রু বেষ্টিত হয়ে আছি।

যেন কোন যুদ্ধের দৃশ্য।

শহরটা ভেতরে ভেতরে বরাবর এমনটাই ছিল। এখানে বাস করার অর্থ যুদ্ধে বসবাস করা।

ভাইরাসগুলো ততদিনে ছড়িয়ে গেছে আরো। জানি না ওইসব দাবানল কোন কাজে লাগবে।

কোন্দ্রার রেডিও অ্যাকটিভ খনিগুলো আবিষ্কৃত হবার আগে জায়গাটা যেমন ছিল, সেখানকার বাসিন্দাদের মনোভাব আবার সেরকম বানিয়ে দিয়েছিল। কর্পোরেশন যে ওগুলো দখল করে ফের সক্রিয় করে তুলবে সে ব্যাপারে তাদের কোন সচেতনতাই ছিল না। রিক্রুট অফিসারেরা বলেছিল সে অঞ্চলের লোকজনের যা হয়েছিল সেসব নাকী সংক্রামক নয়। ওখানে বাইরে থেকে লোকজন আনানোর জন্য আকর্ষণ করতে দ্বিগুণ মাইনে দেবে ঘোষণা করেছিল। আমার বাবা মাও এভাবেই এখানে এসে পড়েছিল। তারপর আসার কিছুদিনের মধ্যেই আমি জন্মালাম। যতদিন না কোন্দ্রায় একটা লোকের সঙ্গে মা জড়িয়ে পড়েছিল ততদিন পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। লুকের জন্ম হতে তখনো আরো কিছুদিন বাকী।

আমার পাশে যে বসেছিল সে ওখানকার মিলিটারি অভ্যুত্থান নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিল। ভদ্রলোকের জানাই নেই যে ক্ষমতাশালীদের গোপন কাগজপত্র দেখার অধিকার আমার ছিল। ওখানেই লেখা ছিল যে কোন্দ্রা সেরকমই এক শহর ছিল যেখানে লিকুইডেটর স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছিলেন। আমি অবাক হইনি। ইরিস গ্রহে উপনিবেশ গড়ার সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল যে জায়গা কোন্দ্রা তাদের মধ্যে সবচেয়ে অভিশপ্ত। ভাবলাম বিদ্রোহের ব্যপারটা দানা পাকাবার আগেই আমাদের আগাম যুক্তি তর্কের মধ্য দিয়ে সেটা আঁচ করা দরকার। বাবার পদভারের সুবাদে যে অফিসটা আমাদের দেয়া হয়েছিল, জেলের লাগোয়া, সেই বাড়ি থেকে – দুনিয়ার শেষপ্রান্তে থাকা বাড়িটা ভিক্টোরিয়ান শৈলীতে গড়া, সেখানে লুক আর আমি, আমরা দুই ছোট ছেলে – দেখতাম উঠোনে কয়েদীরা ঘোরাফেরা করছে। নিজেদের গায়ে পরানো বেড়ি আর তার দাগ দেখে নিজেরাই মোহিত হয়ে রয়েছে। কপালে আরো শাস্তি আসতে পারে সেসবের ভয় না পেয়ে উলটে আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করছে। ওরা আমাদের ঘেন্না করত। আমাদের মৃত্যুকামনা করত। এটা অবশ্য অবাক হবার মত কিছু নয়। বাবা যতই সাধারণ নাগরিক হোন না কেন আমরা আসলে মিলিটারি নিয়ন্ত্রণে থাকা মানুষদের মধ্যে থাকতাম। বাবার কাঁধে ছিল জেলের দায়িত্ব। তার ফলে বাবা ওদের কাছে শত্রু হয়ে গিয়েছিল, আর সেইসঙ্গে আমরাও যুক্ত হয়েছিলাম। লুক মাকে ভয়ে ভয়ে বলত – কয়েকজন লোক আমাকে খালি ভয় দেখায়। এক্ষুনি যেন আমার গলা টিপে দেবে এমন হাবভাব করে। মা তখন এমনিতে বাবার সঙ্গে যে ঘরে থাকত তার চেয়ে অনেকটা দূরে অন্য এক শোবার ঘরে একলা একলা ঘুমোত। লুকের কথা শুনে চোখ লাল করে মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাত এসব ততটা জরুরী কোন কারণ নয় যে মাকে স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। মাকে কখনও দেখতে পাওয়া যেত অলস ভাবে শুয়ে শুয়ে হাওয়া খাচ্ছে, কিংবা হয়ত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে অন্তর্বাস, নরম পা জোড়া কার্পেট প্রায় ছুঁচ্ছে কি ছুঁচ্ছে না। গাল আর চোখের পাতায় মেক আপ করছে এমন করে যেন এখুনি কোথাও বেরোবে। যদিও তখনো হয়ত ফ্ল্যাটবাড়ির একটা তলাও নিচে নামে নি। মেকআপ করার কারণটা ছিল স্রেফ বাবাকে রাগিয়ে তোলা। সে কারণেই হয়ত বা কোন্দ্রায় থাকার সময় প্রথম দিককার বছরগুলোয় বাবা পার্টিতে গিয়ে একেবারে মাতাল হয়ে ফিরত। আমি তখন একেবারে শিশু। তখনো লুকের জন্ম হয় নি। অন্যদের সঙ্গে মা নাচত, এমন সব খোলামেলা পোশাক পরত, পরনে এত গভীর কাটের ব্লাউজ থাকত বলে, বাবা বোতল নিয়ে বসত। মদ খেতে খেতে বলত- খানকী মাগী। পাশ দিয়ে মার জামাকাপড়ের কাট তখন খুব ছোট্ট হত। পায়ে জুতো থাকত উঁচু হীলের। ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক। কপাল মেক আপের জন্য বড্ড চকচক করত।

রেগে ফুঁসতে ফুঁসতে মা উত্তর দিত- অথচ যদি তুমি নিজেই চাইতে এমন পোশাক পরি- যদি বলতে- তোমার আমাকে নিয়ে উদ্বেগ নেই। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আমি নাচলে তুমি রাগ করতে না…

আমি এসব করি অথচ এসব তুমি চাও না, তার মানে তো এই নয় যে এসব আমি করব না।

মর্মান্তিক সেই ঘটনা ঘটে যাবার অনেকদিন পরেও ওঁরা যখন এসব বলাবলি করত, কল্পনা করতাম ওঁরা কোন্দ্রা জায়গাটাকে বোধহয় ঘেন্না করত। মা বাবা যখন পার্থে থাকত সেসব দিনের কথা ভেবে তখন নির্ঘাত খুব মন খারাপ করত ওঁদের। পার্থ একটা সত্যিকারের শহর বটে। এক বড়সড় সামাজিক বৃত্তের লোকজন ওঁদের দুহাতে স্বাগত জানিয়েছিল সেখানে। সে তুলনায় কোন্দ্রা তো প্রায় মরুভূমি। এক পতিত প্রান্তর ভুমি। যদিও তার প্রাকৃতিক দৃশ্য মন কেড়ে নেওয়া। কিন্তু ওঁরা আসলে বাবাকে ভাল মাইনে দিচ্ছিল। এর জন্যই বাবা পদত্যাগ করতে ইতস্তত করছিল। অথচ আগের জীবনটার কথা ভেবে বড্ড মনকষ্টে কাটছিল বাবার। বাবার মনোকষ্টের এটা অন্যতম কারণ। আসলে এটা ওঁদের দুজনেরই মনোকষ্টের কারণ। পার্থ শহরও তো ওঁদের আর ফের বলবে না যে – হ্যাঁ, আমরা কয়েকটা বছর বাঁচিয়ে রাখছি। তোমরা এই অপবিত্র নোংরা বাচাল গর্তটা ছেড়ে বেরিয়ে আসো। তারপর আমরা ওখানে বিশাল বড় বাড়ি কিনব। ছেলেমেয়েরা সত্যিকারের স্কুলে যেতে পারবে…। শেষমেশ বাবা মা দুজনে সিদ্ধান্ত নিল সবকিছু সত্ত্বেও এক হারিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য হয়ে থাকার চাইতে বরং বর্তমানে কোন্দ্রার রাজতন্ত্রের অংশীদার হওয়াই শ্রেয়।

জিপু গাড়িটা রাস্তা দিয়ে খুব দ্রুত আসছিল। পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম জনাকয়েক মুসলিম সাধু, ব্রহ্মচারীকে যাচ্ছেন ওঁদের কাছে পরম করুণাময়ের ডাক এসেছে। সে ডাক শুনে নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করে চলে এসেছেন ওঁরা। তারপর কোন্দ্রারই কোন একটা জায়গা বেছে থাকতে শুরু করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা ক্রমে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল। ওঁদের জন্য তারা খাবার রেখে যেতে লাগল। ওঁরাও এর বদলে ওদের জন্য প্রার্থনা করতেন। ওঁরা অবশ্য সর্বক্ষণ প্রার্থনা করতেন। ওঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কখনও কখনও লুককে সঙ্গে করে আমার কাছে চলে আসতেন। তাঁদের চোখে কোন পাতা ছিল না। ভাবতাম ওঁরা বুঝি অন্ধ।

জিপু খুব তাড়াতাড়ি রাস্তার উপর উঠে এসেছিল। পাশ দিয়ে দুটো সারিতে দুদিকে ভাগ হয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন জনা কয়েক ক্রেউক। ক্রেউক মানে ওইসব সন্ন্যাসীরা আর কী, যারা ঈশ্বরের ডাক পেয়েছেন এবং নিজেদের সমস্ত বিষয়আশয় ত্যাগ করে কোন্দ্রারই একটা পাশ বেছে নিয়েছেন বসবাস করবার জন্য। লোকজন ওঁদের কাছে এসে খাবার রেখে যেত। বদলে এঁরা তাদের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করতেন। সর্বক্ষণ এঁরা জপধ্যান করতেন। একবার কী এক উপলক্ষ্যে এঁদের মধ্যে একজন লুকের সঙ্গে আমার কাছে এসেছিলেন। ওঁর চোখের কোন পাতা ছিল না বলে আমাদের ধারণা হয়েছিল উনি অন্ধ। ঘাড়ে এক ধরনের কলার পরা ছিল যেটায় দুই মুখওয়ালা একটা কুশপুতুল আঁকা। পুতুলটার নাম খেরেরে। বাবাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম এটা কে, বাবা এমনটাই বলল। খেরেরে হলেন সেই দেবী যার কাছে প্রার্থনা করলেও তিনি কিছুই শুনতে পান না। এটা পুরোটা নির্ভর করে একটা বিষয়ের উপর। তুমি যখন ওঁর সামনে প্রার্থনা করছ, তখন সামনে দাঁড়িয়ে কোন আলো জ্বলতে থাকা বা নিকষ অন্ধকার কোন মুন্ডু সেসব শুনছে কী না, তার উপর নির্ভর করত সবকিছু। রেগে গেলে খেরেরে দেবী গোটা গোটা প্রাণীদের অভিশাপ দিয়ে দিতেন। তাদের শরীর কাছ থেকে একটা হাত বা অন্তত হাতের অর্ধেকটা কিংবা তাদের মাথার উপরের ছাদ ইত্যাদি যাই হোক না কেন- সেসব সরিয়ে দেন। সেকথা শুনে আমি তর্ক জুড়লাম- কিন্তু সবার তো এরকম একটা হাত রয়েছে তেমন কিছু দেখি না। না না সেরকম নয়- বাবা উত্তর দিল। – তবে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু হারায়। আমাদের কি নেই তাহলে বাবা? কিছু না- বাবা হাসতে শুরু করে- সেজন্যই তো আজ রাতে খেরেরেকে বিক্রি করে দেব। লুক আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। এরকম কোন ঠাকুর থাকতে পারে এমনটা বিশ্বাস করতেই আমাদের দুজনের কষ্ট হচ্ছিল। এটা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক কারণ দুজন খুব কম জিনিষই জানতাম। অথবা বলা যেতে পারে যে কিছুই জানতাম না। মাকে জিজ্ঞাসা করতাম বাবা ঠিক বলছে কী না। দেখতাম মা খুব রেগে যেত। আমাদের মাথায় এসব ঢোকানো বাবার যে এক্কেবারে ঠিক হচ্ছে না – সেকথা বলত। আর আমাদের বলত মা… আমি তোদের বাবার সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু তেমন কিছুও করত না।

সত্যি বলতে কি, মার কাছে এ কারণটা বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য যথেষ্ট বলেই মনে হত না। বাবা সন্দেহ করত মা নিশ্চয় কিছু করে। সে ব্যাপারটা সব্বাই জানত। তবে তারা বাবার এই স্বভাব সহ্য করে নিত। আর অবধারিত ভাবেই কেউ একমত হত না কে দোষী – এটা নিয়ে। কোন কোন লোক বলত বাবা নাকী কোন্দ্রার খনি শ্রমিক বা ওভারসীয়ার বাবু। বাবাকে নিয়ে গল্প ছড়িয়েছিল যে বাবা সামান্য একটা মেয়েকেই খুশি করতে পারে না। অথচ সে মহিলা নাকী জেলখানার অন্ধকূপে সেইসব ভদ্রসভ্য বন্দী পুরুষদের চরম শীর্ষসুখ দেবার অস্ত্র হিসাবে কাজ করত। রক্ষীরা তখন নাকী ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করত কখন তাদের পালা আসবে।

এই বন্দী লোকগুলো যাদের ওলোপোর্নো বলা হত, এই ওলোপোর্নোদের সম্বন্ধে গল্প শোনা যায় যে গভর্নর নিজে নাকী এদের কোন্দ্রাতে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তারা যে কোন উপায়ে গোপনে নকল পুঁথিপত্র চালান করত কিংবা গুপ্ত কাহিনীগুলো ‘কী’ পত্রিকা থেকে টুকে কোন্দ্রায় নিয়ে আসত বলে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সে গল্পগুলো আমায় কষ্ট দিত। তাদের যে আমি একদমই বিশ্বাস করতাম না শুধু তাই নয়, আসলে সেগুলোর কোন কোন অংশ আবার সত্যিও হত। অতএব সেটাকে তাদের দিক থেকে বিশ্বাসঘাতকতার কাজ হিসাবেই দেখা উচিৎ হত। বাবা এসব খানাখন্দওয়ালা গপ্পোকাহিনী শুনে মোটেও অবাক হত না। নিজের অফিসে বসে কোফত ফুঁকত আর তা নাহলে জেলখানার সংবাদে ভরা ‘কী’ পত্রিকায় চোখ বুলাতে বুলাতে ‘কুট’ চিবোতে থাকত। সাদা গোঁফজোড়া পাকাত কিংবা ‘কী’ কাগজের প্রথম পাতাটাকে সামনে আয়নার মত করে ধরে তাকিয়ে থাকত। যেন গতকাল কিংবা আজ বাবার মাথা থেকে যে চুলটা হারিয়ে গেছিল, সেটা কাগজের কোথায় পড়েছে তা খুঁজে দেখছে। যেন সেটা একটা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এতখানি আবেগ বর্জিত থাকা কিন্তু স্বাভাবিক ছিল না। (বোধহয় এ সব কিছুর দায় ওই হারানো চুলটার উপর দিয়ে বাবা বসে থাকত। নাকী বাবার সেই অল্প বয়সের রূপও বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে… এসব ভাবত!)

… একদিন তুমিও কারো জন্য এভাবেই বসে থাকবে। তখন আমাকে তুমি বুঝবে – আপন মনে বসে বসে নিজেকে দোষ দিতে দিতে এসব বলছিল বাবা। চোখদুটো কেমন যেন আনমনা। মনে হয় এতক্ষণ ধরে যে কোফত টানছিল, এ বুঝি তার প্রভাব। নাকী মদ খাচ্ছিল বলেও হতে পারে। ইদানীং বড্ড মদ খাচ্ছিল বাবা। আলমারির মধ্যে মদের বোতল লুকিয়ে রাখছিল। লেখার টেবিলে কিংবা কলঘরের পাশে খাটের নিচেও। দিশি ঝাঁঝালো মদ, যেটা কোন্দ্রার শ্রমিকদের খুব পছন্দের ছিল। কাচের মত চোখজোড়া। ইচ্ছে করত কান্নামাখা ওই দৃষ্টিটা ফালাফালা করে দিই। আমি সে চাহনি বুঝতে পারতাম না, সহ্য করতে পারতাম না, কাঁদতেও পারতাম না। সম্ভবত সেটাই চোখে কোন ভাষা জোগাত না। যাই হোক সেটা ছিল সবচেয়ে আক্রমণাত্মক একটা প্রতিক্রিয়া। সে দৃষ্টি দেখলে লোকে যেন পক্ষাঘাগ্রস্ত হয়ে পড়ত। মানুষ যা জানতে চায় না সেরকম কিছু সত্যি দেখলে তার চাহনি যেমন হয়ে পড়ে, এটাও ঠিক তেমনই এক ধরনের ফ্যালফ্যালে ক্যাটাটোনিক চাহনি। যা শুনছে সেটাকে অগ্রাহ্য করতে করতেও শিখে ফেলার দ্রুত ক্রিয়া। যা জানা হয়ে গিয়েছে তাকেই না জানার শিক্ষা। একটা শক্তি যেটা তাকে বোবা থাকার পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে, একরকম স্বল্পবাক অবস্থিতি- অন্তত নিজের কাছে তো সে এটাই চেয়েছিল। বহু বছর কেটে গেছে। সে ভুলে গিয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার কথাগুলি। অথবা অন্তত সেগুলোকে তার দূরের বিষয় বলে মনে হয় আজকাল। ব্যাপারটা এত সহজে হয়েছিল। কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ তার কাছে ছিল না। যেন কিছুই তাকে জানানো হয়নি এক ভান। খুব দ্রুত কৈশোরের শেষ পর্যায় চলে এল। লুকের মধ্যে একটা ব্যাপার ঘটতে শুরু হল। এতদিন ধরে সবাই যা নিয়ে সন্দেহ করত সেসব বিষয়ে লুক নিজে একদম নিঃসন্দেহ হয়ে উঠল।

অবশেষে একদিন বাবা আর কিছু করতে পারল না। নিজের মুখের মধ্যে একটা রিফ্লারপনের নল গুঁজে দিল। তার আগেও একবার ছুরির ধারালো ফলা বাগিয়ে ধরেছিল নিজের গলার কাছে। তারপর কী ভেবে সরিয়েও নিয়েছিল। কিন্তু এ দফায় রিফ্লারপন বন্দুকের ট্রিগার টিপে দিল। বাবার অন্যান্য বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছিল- বাবা নাকী লুকের এই পরিবর্তন আর দেখতে পারছিল না। আমারও খুব জোরদার বিশ্বাস ছিল যে মার দিক থেকে বিশ্বাসঘাতকতাই বাবাকে সবচেয়ে আঘাত করেছিল।

পথের শেষ প্রান্তে একটা টিলা ছিল। ওর ফাঁক দিয়ে মঠটা দেখা যেত। পাহাড়টা যে পাথর দিয়ে তৈরি, তা দিয়েই ওটার দেয়াল তৈরি। দেখে মনে হত যেন পাহাড় কেটেই সেটা বানানো। বাড়ির বাঁ পাশে লালরঙা ছাদের উপর আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে গর্বিত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকত এলাকার সবচাইতে উঁচু সেই চূড়া। মূল বাড়ির ডানদিকেও চারটে চূড়া ছিল। বাড়ির প্রত্যেক কোণে একটা করে চূড়া। আর ঠিক মাঝখানে একটা চূড়া ছিল যেটা দেখে মনে হত যেন শূন্যে ঝুলছে। ও জায়গাটি ছিল অনুতাপ করবার মন্দির।

বাইরের দেয়ালের ঠিক সামনে আমরা সবাই আটকে গেলাম। জিপু থেকে নামলাম। লাজুক চোখো একজন সাধু কাছে এগিয়ে এলেন। ওঁকে চিনি না। আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। কার্ড দেখালে আমাকে দরজা খুলে দিলেন। নিচের তলা পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন আমায়। রঙবেরঙের ফুলে ভরা বাগান দেখে আমি তো মুগ্ধ। ওই দুনিয়ায় তোমাসিনি আর মায়েলাগ্লিয়া ফুল দেখে ভীষণ আনন্দ হল। একটা মিষ্টি গন্ধের ঝাপটা নাকে এল। আরেক সাধুকে দেখতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম- ভাই কোথায়। প্রশ্ন শুনে সাধু এমন ভাব করলেন যেন কথা কানেই যায়নি। দীর্ঘক্ষণ এক নিস্তব্ধতা। তারপর উত্তর শোনার আশা যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, তখন বলে উঠলেন-

-সে খারাপ রয়েছে। আর সেকথা সে নিজেও জানে। বুঝি না, কেন যে বারবার একই প্রশ্ন করা হয়। মনে বিশ্বাস রাখা দরকার। বিশ্বাস থাকলে অসম্ভব কিছু ঘটেও যেতে পারে জীবনে। আবোলতাবোল কথা বলবেন না। আপনার মনে কোন বিশ্বাস নেই।

সেখান থেকে চলে গেলাম। খিলানের মত একটা ছাদওয়ালা ঘরের তলা দিয়ে দুজন যাচ্ছিলাম। সেখানে সন্তদের মূর্তি খোদাই করা। কুমারী মাতার মূর্তিও, সম্ভবত ধবধবে সাদা মূর্তি। ঘাড়, দুদিকে ছড়ানো দুহাত দেখে মনে হয় প্রায় অ্যালবিনোর মত সাদা মূর্তি খোদাই করা। মূর্তিগুলো কেমন ছন্নছাড়া। প্রত্যেকটার খোদাইয়ের মধ্যেও কোন মিল নেই, ওগুলো সমান মাপেও নয়। বিরক্তি লুকোতে পারলাম না। আমরা যেরকম সেরকম কিছুই দেখছি না। আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক সবকিছুকে বদলে দেয়া হয়েছে। এই পরিবর্তন কেমন যেন মানিয়ে নিচ্ছি। সবকিছু গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। কোন্দ্রাতে প্রতিদিন যা দেখতে পাওয়া যায় সেটা দেখে যাওয়াই ভাল। আচ্ছা, শিল্পের মধ্যেও কি প্রতিনিধিত্বর ব্যাপারটা থাকা উচিৎ?

উঠোনে নেমে গেলাম দুজন। প্রকৃতির রূপ চলে গেছে একদম। জায়গাটাকে ভয়ংকর অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে। যাদের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে তাদের সঙ্গেও দেখা হল। একজন সাধু তাদের উপর নজর রাখছেন। ওদের মধ্যে তিনজন একপাশে বসে ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি খেলছে। একজনের দেখি নাক নেই। আরেকজনের পা দুটো দেখে মনে হল কে যেন গোড়া থেকে কোপ দিয়ে কেটে নিয়েছে। তিননম্বর লোকটার মাথার খুলি ফাঁক করে খোলা। যে কেউ সেখানে উঁকি দিয়ে ঘিলু দেখতে পাবে। দুজনে মেঝেতে বসে রয়েছে। একজন গলা উঁচিয়ে দেখছিল। দর্শকের চোখে পড়বেই যে লোকটার অর্ধেক মুখ একটা বড় লোমওয়ালা আঁচিল দিয়ে ঢাকা। আরেকজনের চোয়াল দেখছি বামনদের মত সামনে অনেকখানি আগানো। খোলা ঠোঁট বেয়ে লালা ঝরছে। অনেকটা দূরে দশ বারোজন মিলে একটা অর্ধবৃত্ত বানিয়ে দাঁড়াল। এক সাধু তাদের ওভাবে দাঁড়াতে বলছিলেন। পিঠে দুটো যমজ বাচ্চা ঝুলছিল। হাত পা কাটা একটা বাচ্চা মেয়ে আর একজনের তো এতটা জোড়া পায়ের পাতা যে সামনে দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে বলে দৃশ্যমান। একজন মহিলার বুক ভরা টিউমার । এইরকম এক পর্যায়ে এসে আমার আর অবাক হবার কথা না। কিন্তু তবুও হচ্ছিলাম।

কোথায় আছে সে?

উঠোনের কোনের দিকে দেখালেন। একলা, কয়েকজনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন ওর কাছে গেলাম ফিসফিস করে বলে উঠলাম- লুক। ও ঘুরে দাঁড়াল, তাকাল আমার দিকে। গভীর শ্বাস নিল। ঠোঁটদুটো নাড়ল বটে তবে কোন শব্দ হল না। গাল দুটো একটু কাঁপল যার ফলে মুখটা কেমন ছেলেমানুষের মত লাগছিল। বাহুর মাংসপেশি দেখেই মনে হচ্ছিল পুষ্টির অভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে। দু হাত বাড়াল। কেমন জেলির মত থলথলে হাত। জিনিষটা ওকে দিলাম কিন্তু নিজের কাঁপুনিটা এড়াতে পারলাম না।

ওর মুখ দিয়ে কেমন গরগর করে আওয়াজ বের হচ্ছিল। আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল। পিছন থেকে সাধুটি গোটা ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলেন।

আর বেশিদিন না, লুক। তুই ভাল হয়ে যাবি। আমরা বাড়ি ফিরব।

যতবার দেখা করতে যেতাম ততবার এই কথা বলে বলে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কথাগুলো কোনরকম সান্ত্বনা হিসাবেও কাজ করত না। কারণ ততদিনে ও আর আমাকে বুঝতে পারত না।

গোটা সময়টা তোর কথাই ভাবি রে। এমনকি তোকে স্বপ্নও দেখি। দিনগুলো বড় কঠিন রে। শুধু তোর কথা ভাবলেই আমার ভাল লাগে।

মনে মনে পুরনো দিনের ভাইয়ের খুব ঝলমলে একটা ছবি দেখছিলাম। জেলখানার ঠিক লাগোয়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে জোলি গাছগুলোর পাশ দিয়ে আমরা দুজনে যেন দৌড়চ্ছি। বাবা একজন রক্ষীকে বলে দিয়েছিল, তারই কড়া তদারকিতে দৌড়চ্ছিলাম। সে সঙ্গ দিচ্ছিল। লুক আমার থেকে বেশি সাহসী। ওই চটচটে ফলটা পাড়বার জন্য লুক একটা জোলি গাছে উঠে পড়ল। লুক রক্ষীর মুখে ফলটা লেপে দিল। লাল চটচটে ফলে মাখামাখি হয়ে গেল মুখটা। আমায় ওর পিছন পিছন যেতে বলল। কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিচ থেকে ওকে দেখছিলাম। সূর্যের আলো পড়ে লুকের সোনালি চুলগুলো চিকমিক করছিল। বেপরোয়া চোখ চারদিকে ঘুরে দেখছিল কোনকিছু কৌতূহলের বস্তু চোখে পড়ে কী না। একটা লোমশ জুজে দেখে অমনি সেটা মুখে পুরবার জন্য তৈরি। ওদিকে এক অস্থির বক্সার পাখি আবার সেটার মাথা কেটে ফেলার জন্য ছটফট করছে। বক্সারটার বাসা কোথায় যেখানে তার ডিমগুলো রয়েছে? একটা ছুঁচলো পাহাড়ি লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিল ও খুঁজে খুঁজে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম ওর কান্ডকারখানা। নিজেকে ওর মতই স্বাধীন করতে ইচ্ছে করছিল। ও উঠে যাচ্ছিল। বেশ কষ্ট করেই উঠছিল।

এর মধ্যেই আবার এক লাফ দিয়ে উঠে জঙ্গলে ঢুকে গিয়ে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল- খেরেরে, খেরেরে, কোথায় তুমি? আমরা তোমাকে নিতেই এসেছি। ওর পিছন পিছন যেতে আমার ভয় করছিল। অপেক্ষা করতে গিয়ে আমার পা দুটো অসাড় হয়ে গিয়েছিল। রক্ষীটা যেন ওর পিছন পিছন যায় লুক ইশারায় তাই ইঙ্গিত করল। রক্ষীও জানত লুক হারিয়ে যেতে ভালই বাসে। কিন্তু সেও তো চায় না বাবার কাছে ধমক খেতে। তাই লুক নিজে যতই তা চাক না কেন, রক্ষী লুককে চোখের আড়াল করতে চাইছিল না। আমাদের অপেক্ষা করতে লুক বাধ্য করল। ভয়ে কাঁপছিলাম বটে, তবুও লুকের কথা শুনলাম। জানতাম ও ফিরে আসবে। হ্যাঁ ফিরেছিল, অক্ষত অবস্থায়, হাসতে হাসতে আর একই রকম বেপরোয়া ভঙ্গীতে লুক ফিরেছিল।

গরগর করা আওয়াজটা আরো বেড়ে গিয়েছিল। আমি কিছু আর করতে পারছিলাম না। সাধুকে বললাম – যথেষ্ট হয়েছে।

ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন চলে আসছি, আমার দিকে লুক ফিরেও তাকাল না। অসম্ভব এক একাকীত্ব আমায় ভেদ করে যাচ্ছিল। নিজেকে মনে হচ্ছিল মাকড়সার জালে আটকে পড়া একটা ক্ষমতাহীন পোকার মত। পোকাটা অপেক্ষা করছে কখন মাকড়সা এসে তাকে গিলে ফেলবে। প্রতিশোধ নিতে চাইছিলাম। কাউকে ঘুষি মারতে হবে। কপালের ফেরে আবার আমি যুদ্ধক্ষেত্রের সামনের সারিতে ফিরে এলাম। এই মওকায় ভেতরের রাগ উগড়ে দিতে পারলাম। ভাবছিলাম – এ কারণেই প্রত্যেকের জীবনে একবার মিলিটারি কেরিয়ার করা দরকার। কিন্তু একাকীত্ব দূর হল না।

মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে বেরোবার পথ খুঁজছিলাম। একটা বিকৃত অঙ্গের লোক আমার দিকে একদলা থুতু ছুঁড়ল। যা জিজ্জেস করলাম পাত্তাই দিল না আমায়।

বাঁকানো ছাদওয়ালা ঘরের সাধুটি বললেন কিছু দান করার কথা। ওঁদের দরকার। বললাম- সেদিনই দান পাঠিয়ে দেব। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম- ওঁর কাছে কিছু মিউট্যান্ট মুখ আছে কী না। মানে যারা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ভোল বদলে ফেলে মানিয়ে নেয়। প্রশ্ন শুনে উনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

আমার কাছে ওসব নেই। তখনো আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম… আপনি তো কখনই নয়, এমনকী ওইসব কুমারী দেবী মূর্তি বা দেবদূতেদের ছবিগুলোকে পর্যন্ত একেবারে কখনও আমাদের মত দেখতে নন। ওঁদের গায়ের ত্বক এত সাদা, একেবারে অ্যালবিনোর মত। হাত বা লম্বা ঘাড়ের রঙ।

এসব প্রায় কিছুই নয়। ওইভাবেই শুরু হয়েছিল ব্যাপারটা। অল্প অল্প করে। উনি বলতে থাকলেন- পরে যে মুখগুলো আসবে সেগুলো আরো ভাঙাচোরা হবে। সেগুলোর মাংসপেশি আরো বিকৃত হয়ে যাবে। এসব আসলে শিল্পীসুলভ পরিবেশন। … আরো বললেন- বাহিনীর কর্তা এনে সেখানে যেন আরো লোকজন ঢোকাই।- আমরা এখানে সবাইকে সমান ভাবেই নিই। … অথবা অন্যান্য মঠ রয়েছে। ভাইকে সেগুলোর কোন একটায় সরিয়েও নিয়ে যেতে পারি। … দেখবে ও কী করতে পারে।

বাগানে বেরিয়ে পড়লাম। মায়েলাগ্লাইয়াস ফুলগুলোর কাছে এগিয়ে গেলাম। গন্ধ এত প্রচন্ড মিষ্টি। অল্পতেই সাধ মিটে গেল। একটা ফুল ছিঁড়লাম। ওটাকে নিয়েই এগোতে যাচ্ছিলাম, তবে কিছুক্ষণ পরে ওটাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেললাম। হাতে খুব হালকা একটা কাঁপুনি অনুভব করলাম। ভয় না পাবার চেষ্টা করছিলাম। নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম ওটা নকল সতর্কবাণী। একবার কোন ক্রেউককে দেখিয়ে নিলে হত। কিছু যদি হয়ে থাকে। মনে মনে মিনতি করছিলাম খেরেরের কাছে। প্রার্থনা করছিলাম পরের বার লুকের সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন যেন ওর হাসিমুখ দেখি।

আকাশের দিকে চাইলাম। ঝকঝকে পরিষ্কার। বেরোবার সময় হয়ে গেছে।

Notes:
ইরিস- ভবিষ্যতের পৃথিবীর বাইরের একটি গ্রহের নাম। একটি স্থান যেখানে প্রচন্ড অসুস্থ বিকৃত এক পরিবেশ দেখা যায়। এই পৃথিবীতে সবসময় যুদ্ধ চলে। ইরিসে জবরদখলকারী এক ঔপনিবেশিক অঞ্চল রয়েছে। তার নাম পরিসীমা। এই পরিসীমার মধ্যে থাকে জেভিয়ার, ক্যাপ্টেন রেনল্ড ইত্যাদি কয়েকজন। সেখানে ইয়াস বলে একজন মহিলা নার্স থাকতে আসে। সে ‘খুন’ নামের এক ভেষজ গাছ খুঁজতে সেখানে আসে। সে ওষুধে নাকী স্নায়ুর কাজ পরিবর্তন করা যায়। সেখানে শুধু রাজধানীকে দখলমুক্ত করার যুদ্ধ চলে তাই নয়, যুদ্ধটা সরে যায় এক ফুলে ঘেরা উপত্যকায়। এইভাবে লেখা এগোতে এগোতে শেষমেশ মুক্তির জন্য আশাবাদী এক লড়াইতে পরিণত হয়। লুক নামের এই গল্পটি এদমুন্দো পাস সোলদানের অতি বিখ্যাত উপন্যাস- ইরিসের অন্তর্গত একটি অধ্যায়। এঁকে গল্প হিসাবেই তিনি ২০১২ সালে প্রথমবার প্রকাশ করেছিলেন।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *