onubad-merudesher-meye

মেরুদেশের মেয়ে
মূল কাহিনি: মার্ক টোয়েন
অনুবাদ: যূথিকা আচার্য্য


আমি আর লাস্কা পাশাপাশি একটা বরফের স্তুপের ওপর বসেছিলাম। ও নিজের মুখে লেগে থাকা তেল-ময়লা জামার হাতায় ঘষে পরিস্কার করছিল। কিছুক্ষণ পর ও আমার দিকে তাকিয়ে খুব নরম গলায় বলল,“ঠিক আছে মিস্টার টোয়েন, কথা দিচ্ছি। যা জানতে চাও, সব বলবো। তুমি খুব ভালো মানুষ। অন্তত আমার সম্পর্কে জানতে তো চেয়েছো। সেটাই বা কজন জানতে চায়!”
মেরুদেশের রাত বড়ো চমৎকার। আসলে নামেই রাত। অন্ধকার আকাশে মেরুজ্যোতির অপূর্ব রামধনু আলো থইথই করে যখন তখন। বকের পালকের মতো সাদা ঝকঝকে তুষার উপত্যকায় সে আলোর ছটা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সেই জৌলুস নিজের চোখে না দেখলে বলে বোঝানো মুশকিল।
আমি কৌতূহলী চোখে লাস্কার দিকে তাকালাম। ও নড়েচড়ে বসল। ভারি মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে লাস্কা। নম্র-ভদ্র ব্যবহার, দেখতেও বেশ সুন্দর। আমেরিকার আম জনতা তাকে দেখলে হয়তো বলবে, মেয়েটা মুটকি। কিন্তু সাধারণ এস্কিমো মেয়েদের তুলনায় ও রীতিমতো সুন্দরী। ওদের গ্রামের সব ছেলেরাই ওকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে। অমন সুন্দর মেয়ে ওদের গাঁয়ে ওই একটিই। খোলামেলা পোশাক-আশাক বা মেকআপের বালাই নেই। ভারী ফারের তৈরি জামা, টুপি, জুতোর আড়ালে নারী-পুরুষ সবাইকে একইরকম বোধহয়। আমি শুধু মুখটুকুই দেখেছি ওর। তাতেও বুক ঠুকে বলতে পারি যে এমন সুন্দরী মেয়ে এ তল্লাটে আর একজনও নেই। সবচাইতে বড়ো ব্যাপার হল, সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে যে সহজাত অহংকারটুকু থাকে, ওর মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। ও যে সুন্দর এ খবরটা বোধহয় ওর নিজেরও জানা ছিল না, অথবা জানলেও হাবভাবে সে-কথা বুঝিয়ে দেওয়ার বদভ্যাস ওর ছিল না।
আমার দেখভালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল লাস্কার ওপর। উত্তর মেরুর দেশে আমি নবাগত। ও গত একসপ্তাহ ধরে ধৈর্য ধরে আমাকে ওদের রীতিনীতি-জীবনধারা সব বুঝিয়েছে। আমি ওর ব্যাপারে যত জানছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম। লাস্কা সাধারণ মেয়ে নয়। ওর বাবা এস্কিমোদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদের নেতা। তা ছাড়াও শুনেছি, তিনি অত্যন্ত ধনী। কাজেই অনায়াসে ওকে রাজকন্যা বলা চলে।
আমি ওর সঙ্গে মাছ ধরতে যেতাম। ওর ওই খুদে কায়াক নৌকোয় চড়ার দুঃসাহস কখনোই হয়নি আমার। ভয় পেতাম যদি নৌকাখানা উল্টে যায়। ওই বরফের মতো কনকনে জলে একবার পড়লে আর রক্ষে নেই! লাস্কা পাকা শিকারীর মতো ওর নৌকো থেকে বর্শা ছুঁড়ে মাছ ধরত, আর আমি বরফ-জমা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য হাঁ করে দেখতাম। ওর সঙ্গে শ্বেতভল্লুক শিকার করতেও গিয়েছিলাম একবার। কিন্তু সে অতি ভয়ানক অভিজ্ঞতা। শেষ অবধি দেখে উঠতে পারিনি। ভয়ে আমার বুক ধড়ফড় করছিল।

যাই হোক, আজকে আমার কপাল ভালো ছিল। শেষপর্যন্ত লাস্কা ওর নিজের জীবনের গল্প বলতে রাজি হয়েছে। ও বরফের স্তুপের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে ওর গল্প শুরু করল।
“এস্কিমোদের কথা তো জানই, মিস্টার টোয়েন। আমরা যাযাবর। বরফের সমুদ্রে এখান-ওখানে ঘুরে বেড়াই। কোনো স্থায়ী বাসস্থানের বালাই নেই। আমরাও তেমনি ছিলাম; কিন্তু বাবা কেন জানি না এই ঘোরাঘুরিতে বিরক্ত হচ্ছিলেন। বছর দুয়েক আগে তিনি এই বরফের প্রাসাদখানা তৈরি করালেন। প্রায় সাতফিট উঁচু, আর আকারে যেকোনো বাড়ির থেকে প্রায় চারগুণ বড়ো। তারপর থেকে এই প্রাসাদেই থাকি আমরা। আমার বাবার স্বপ্নমহল! অবশ্য বাবার দোষ নেই। অমন একখানা বিলাসবহুল প্রাসাদের মালিক হওয়া কি মুখের কথা! কী নেই ওখানে! মিস্টার টোয়েন, তুমি আমাদের বাড়ির ভেতরটা কখনো ভালো করে দেখেছ? মনে করো, মহলের শেষপ্রান্তে খাওয়ার ঘরের মধ্যিখানে রাখা বরফের তৈরি ওই মস্ত টেবিলখানা। সত্যিকথা বলো, অতবড়ো টেবিল তুমি আগে কখনো দেখেছ?”
আমি মেনে নিলাম,“তোমার কথাই ঠিক লাস্কা। আমেরিকার ধনকুবেরদের বাড়িতেও বরফের তৈরি অমন টেবিল আমি দেখিনি।”
দেখলাম ওর চোখদুটো আনন্দে ঝকঝক করে উঠল। ও হেসে বলল, “আমি জানতাম। অতবড়ো টেবিল আর কোত্থাও নেই। তারপর ধরো বরফের তৈরিওই ব্লকগুলোর কথা, যাদের ওপর আমরা ঘুমোই। তুমি যেগুলোকে বিছানা বল আর কি! সেগুলো কেমন সুন্দর মোটা ফার দিয়ে ঢাকা, দেখেছ! হলফ করে বলতে পারি, অমন নরম, উষ্ণ আর মোটা ফার তুমি অন্য কোনো বাড়িতে দেখনি। শ্বেতভল্লুক, রুপোলি শেয়াল, সিল, ভোঁদর— যেটাই বলো, তারই ফার পাবে তুমি আমাদের বাড়িতে। আচ্ছা, তোমাদের গ্রাম আমেরিকাতে তোমরাও কি অমনি নরম ফার ব্যবহার কর?”
লাস্কা বড়ো-বড়ো চোখ মেলে তাকালো আমার দিকে। মেয়েটা সরল মনেই প্রশ্ন করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রশ্নটা সাদাসিধে হলেও উত্তরখানা জটিল। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ধনসম্পদের মূল্যায়ন ও মাপকাঠি দুটোই বদলে যায়। এ-দেশে পশুর চামড়া, অর্থাৎ ফারের যোগান বেশি,তাই তার মূল্য নেই। অথচ আমেরিকা বা ইউরোপের যেকোনো শহরে ওই একই বস্তুর দাম আকাশছোঁয়া। লাস্কা ধনীর মেয়ে, তার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। এই অঞ্চলের গরিবস্য গরিব মানুষটির পরনের জ্যাকেট দেখেই আমার চোখ কপালে উঠে যায়। খাঁটি ফারের তৈরি জ্যাকেট—নিউইয়র্কে ও জিনিসের দাম হবে হেসেখেলে বারোশো থেকে পনেরশো ডলার। আমেরিকায় আমার চেনাজানা কোনো মানুষকে কখনো মহামূল্যবান ফারের জামা-জুতো পরে মাছ ধরতে দেখিনি। অথচ এখানে এগুলো প্রায় মূল্যহীন।
ভেবেচিন্তে ওকে খুশি করার জন্য বললাম,“ভারি লজ্জায় ফেললে দেখছি তুমি। কী আর বলব! বুঝতেই তো পারছ, আমার গ্রাম আমেরিকা নিতান্তই গরিব। বরফের টেবিল নেই, ফারের বেডকভারও নেই।”
লাস্কা বাচ্চা মেয়েদের মতো দু’গালে হাত দিয়ে বলল,“হ্যাট্! যাও, তুমি নির্ঘাত মিথ্যেকথা বলছ।”
“আরে! মিথ্যে কথা কেন বলব? সত্যি বলছি। আমাদের দেশে সবচাইতে ধনী লোকটির নাম মিস্টার ভ্যানডারবিল্ট। আমি হলফ করে বলতে পারি, মিস্টার ভ্যানডারবিল্টের বাড়িতেও অতবড়ো বরফের টেবিল নেই। টেবিল তো দূরের কথা, বরফের তৈরি একটা ভাঙা চেয়ার অবধি নেই তাঁর বাড়িতে।”
“ইশশ্! কেন গো? লোকটা বুঝি হাড়কিপটে?”
আমি ঢোঁক গিললাম। তারপর একটু ভেবে বললাম,“না, ঠিক তা নয়। আসলে ভ্যানডারবিল্ট শো-অফ করতে চান না। তাই ওভাবে থাকেন বোধহয়।”
লাস্কা এবার চিন্তিত স্বরে বলল,“আচ্ছা, ওই যে কী নাম বললে, ভ্যানডারবিল্ট, তা ওঁর বাড়িটাও কি আমাদের প্রাসাদের মতোই বড়ো?”
এবার আমি অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বললাম,“বাড়িটা ভালো। কিন্তু তোমার বাবার সাতফুট উঁচু বরফের প্রাসাদের সামনে সে কিছুই না।”
“তাতো বটেই। বরফের টেবিল, চেয়ার— কিছুই যখন নেই বলছ, সে আর ভালো দেখাবে কী করে? আচ্ছা, তোমাদের গ্রামে তোমরা যখন বরফ কেটে বিছানা বানাও, সেটা কি আমাদের মতোই এত বড়ো হয়?”
“হ্যাঁ। বড়ো-ছোটো সবরকমেরই হয়, তবে আমরা বরফ কেটে বিছানা বানাই না।”
“সে কী!” ও আকাশ থেকে পড়ল, “বরফ দিয়ে বিছানা বানাও না! কেন?”
বোঝানোর চেষ্টা করলাম‍ যে আমাদের দেশে বরফ অমনি-অমনি পাওয়া যায় না। মেশিনে তৈরি করতে হয়, অথবা টাকা দিয়ে বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। সে-কথা শুনে লাস্কা আঁতকে উঠল, “হে ভগবান! তোমাদের টাকা খরচা করে বরফ কিনতে হয়?”
আমি কাঁচুমাচু মুখে বললাম,“হ্যাঁ। যে দেশে যেমন নিয়ম।”
লাস্কা হেসেই খুন। সে হাসি আর কিছুতেই থামতে চায় না। পেট চেপে ধরে হাসে আর বলে,“হায় ভগবান! কী বোকা-বোকা কাণ্ড বল দেখি! গাঁটের কড়ি খসিয়ে কেউ বরফ কেনে? পড়ত আমার পাল্লায়। বুঝিয়ে দিতাম। টাকা তো দূরের কথা, একটা পচা মাছের কানকো অবধি দিতাম না! হা হা হা!”
আমিও হেসে ফেললাম,“হে তুষারদেশের রাজকুমারী, গরিব আমেরিকানের কষ্ট তুমি কী করে জানবে? গরমকালে নিউইয়র্কের অবস্থা যেমন হয় তাতে একবালতি বরফের দামে একখানা গোটা তিমি মাছ কিনে ফেলা যায়, তা জান!”
সে-কথা শুনে লাস্কা যেভাবে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো, তাতে স্পষ্ট বুঝলাম ভুল উপমা দিয়েছি। আমি ইচ্ছে করে এমন উদাহরণ দিয়েছিলাম যাতে ও সহজে বুঝতে পারে, কিন্তু ফল হল উল্টো। আমার কথা শুনে এখন ওর নিশ্চিত ধারণা হয়েছে যে নিউইয়র্কে বরফ জিনিসটা দামি হতে পারে, কিন্তু নীল তিমি অত্যন্ত সহজলভ্য। অলিগলিতে যখন-তখন তিমি মাছ পাওয়া যায়,হাত বাড়িয়ে ধরে নিলেই হল। বুঝতে পারছি সস্তায় পাওয়া নীল তিমির চিন্তায় ওর জিভে জল চলে এসেছে। আমি বেগতিক দেখে বললাম,“অবশ্য নিউইয়র্কের লোকজন তিমির মাংস খেতে ঠিক ততটা পছন্দ করে না।”
“সেকী! কেন? তিমি মাছ খেতে পছন্দ করে না, এমন মানুষ আছে নাকি!”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,“আসলে আমেরিকানগুলো মাথামোটা। ভালো জিনিসের মর্ম বোঝে না।”
দেখলাম এই উত্তরটা ওর খুব ভালো লেগেছে। বাচ্চাদের মতো পা দোলাতে-দোলাতে বলল,“তুমি হয়তো বললে বিশ্বাস করবে না মিস্টার টোয়েন, কিন্তু আমি এই ব্যাপারগুলো বুঝি। এই ধরনের বোকা লোকজন আমাদের এখানেও অনেক আছে। এই যেমন সাবান। সাবান বস্তুটাকে নিয়ে কী কম ঝামেলা হয়েছে এখানে! অথচ এখন দেখো…!”
আমি ওকে মাঝপথে থামিয়ে বললাম, “সাবান নিয়ে ঝামেলা হয়েছে মানে? আগে কী তোমরা সাবান ব্যবহার করতে না ?”
“না। বিদেশিদের কাছ থেকে পাওয়া সাবান নিয়ে ভারি সমস্যা হয়েছিল। প্রথম-প্রথম কেউ খেতেই চাইত না। অথচ এখন সবাই সাবান বলতে পাগল। কেন, তোমরা বুঝি সাবান জিনিসটা পছন্দ কর না?”
আমি বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। নিঃসন্দেহে সাবান বস্তুটি আমার অত্যন্ত প্রিয়, কিন্তু খাদ্যদ্রব্য হিসেবে নয়। কায়দা করে পাশ কাটালাম। সত্যি কথা বলতে গেলে লাস্কা কী বুঝতে কী বুঝে বসবে কে জানে! অতএব দেঁতো হাসি হেসে বললাম,“পছন্দ করি না মানে! আলবাৎ পছন্দ করি। সাবান ভালোবাসে না, এমন লোক আবার হয় নাকি?”
লাস্কা খুব খুশি হয়ে বলল,“আমিও সাবান খেতে খুব ভালোবাসি। তারপর মোমবাতি… আচ্ছা তোমার মোমবাতি খেতে ভালো লাগে?”
আমি আর কিছুতেই অবাক হচ্ছি না। দিব্যি মাতব্বরের মতো জবাব দিলাম,“সে আর বলতে। মোমবাতির মতো জিনিস আর আছে নাকি?”
ওর চোখদুটো আনন্দে চকচক করে উঠল। সোৎসাহে বলল, “একদিন পিকনিক করলে কেমন হয়? পৃথিবীর সবরকমের ভালো ভালো খাবার থাকবে সেখানে। সাবান-মোমবাতি-সার্ডিন মাছের ভাজা পাকস্থলী…!”
আমি যোগ করলাম,“তিমি মাছের তেল…”
“কাঁচা মাংস…”
“আইসক্রীম…”
“চিনির ডেলা, মৌমাছির চাক, তার্পিন তেল…”
“বাঁধাকপির আচার…”
“তারপর সবকিছু একসঙ্গে একটা কাঠের বালতিতে রেখে সব্বাই মিলে একসঙ্গে বসে খাওয়া!” ও বাচ্চাদের মতো ছটফট করে উঠল, “ইশ্ কী দারুণ হত… তাই না!”
মেরুকন্যার কল্পনায় আদর্শ চড়ুইভাতির মেনু ও বর্ণনা শুনে আমার অতিসাধারণ আমেরিকান মস্তিস্ক ও পেটটিতে যা শুরু হয়েছিল তা কহতব্য নয়। ওকে থামানোর জন্য বললাম,“থাক-থাক। আর বোলো না। এত ভালো-ভালো খাবারের নাম একসঙ্গে শুনলে আমার খিদে পেয়ে যাবে যে। আমি তো আর তোমার মতো বড়োলোক নই যে দিনরাত ভালোমন্দ জিনিস পাতে জুটবে।”
লাস্কা করুণ চোখে তাকালো,“ছি-ছি, তুমি অমন ভাবছ কেন? আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আচ্ছা ছাড় ওসব বাজে কথা! হ্যাঁ, তো যেমন বলছিলাম। যাযাবরের মতো ঘোরাঘুরি বন্ধ করে আমরা আমদের প্রাসাদে থাকতে শুরু করলাম। কোনো কিছুরই অভাব নেই। মুখ ফুটে বলার আগেই সবকিছু পেয়ে যাচ্ছি, অথচ আমার মনে এতটুকুও সুখ ছিল না। এত ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও আমি হাঁপিয়ে উঠতাম। একা-একা কী বেঁচে থাকা যায়? মনের কথা বলার মতো একটাও মানুষ নেই। একজন পুরুষ, যে শুধু আমাকে আমি বলেই ভালোবাসবে— এমন কেউ না থাকলে হয়? আমি তার সঙ্গে রাগ করব, খুনসুটি করব, সোহাগ দেখিয়ে গলা জড়িয়ে বলবো ‘ভালোবাসি।’ সেই পুরুষটিও আমাকে আপন বলে ভাববে। সত্যি বল তো মিস্টার টোয়েন, আমার চাহিদা কি খুব বেশি ছিল?”
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। সব প্রশ্নের তো উত্তর দেওয়া যায় না।
কিছুক্ষণ পর লাস্কা বলল,“আমার বিয়ের জন্য বাবাকে কখনো চিন্তা করতে হয়নি। বাড়িতে সবসময় পাত্রপক্ষের ভিড় লেগেই থাকত। তাদের মধ্যে যে কাউকেই আমার পছন্দ হয়নি, তাও নয়। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যে টের পেতাম, হবু বরের আসল লক্ষ্য আমার বাবার সম্পত্তি, আমি নই।”
“সম্পত্তি!”
“হ্যাঁ। আমার বাবা খুব বড়োলোক।”
আমি মনে মনে ভাবলাম, এদেশে সম্পত্তি বলতে আসলে কী বোঝায়? টাকাপয়সার ব্যবহার এরা জানে না। ওই সাতফুট উঁচু লিলিপুট রাজপ্রাসাদও নিশ্চয় সম্পত্তি নয়। ওরকম যে কেউ বানাতে পারে। এখানে জায়গা-জমির কোনো দাম নেই। বরফও পড়ে রয়েছে এন্তার। কাজেই ওই বাড়িখানা এমনকিছু মূল্যবান নয়। ওদের বাড়িতে দেখেছি খানকতক স্লেজগাড়ি, স্লেজটানার কয়েকটা কুকুর, প্রচুর ফার, আর কিছু হাড়ের বড়শি ও সূঁচ। এদের মধ্যে ঠিক কোন জিনিসটা এমন মহার্ঘ্য যাকে লাস্কা “সম্পত্তি” বলছে! এমন কী আছে ওর বাবার কাছে যে পাত্রপক্ষের দল সবসময় ওনাকে ঘিরে থাকে? ভেবে-ভেবে যখন কুলকিনারা কিছুই পেলাম না, তখন নিতান্ত বাধ্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম,“সম্পত্তি মানে?”
“চেষ্টা কর। দেখি তুমি বলতে পার কিনা, আমার বাবার কাছে কী আছে?”
“কী?” আমি রুদ্ধশ্বাসে প্রতিপ্রশ্ন করলাম।
লাস্কা খুব নাটকীয়ভাবে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,“মাছ ধরার বড়শি! হাড়ের নয়, খাঁটি লোহার— বাইশখানা!”
কথাগুলো বলে লাস্কা একটু দূরে সরে বসল, যাতে আমার প্রতিক্রিয়া ভালোভাবে দেখতে পায়। বুঝলাম, নিঃসন্দেহে ব্যাপারখানা ও খুব উপভোগ করছিল। আমিও প্রাণপণে চেষ্টা করলাম, যাতে ও হতাশ না হয়। চোখ উলটে, রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলাম। বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,“হে ঈশ্বর, বাইশখানা লোহার বড়শি! বাইশখানা! এমন ধনীও হয় মানুষ! হে ঈশ্বর!”
লাস্কা খুব তৃপ্তি সহকারে বলল,“একবর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। ভগবানের দিব্যি!”
আমি তাও চোখ সরু করে তাকিয়ে আছি দেখে শেষটায় বুঝি ওর অভিমান হল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “মিস্টার টোয়েন, তুমি কি আমাকে মিথ্যেবাদী বলতে চাও? মিছিমিছি এক বিদেশিকে বানানো গপ্পো শুনিয়ে আমার কী লাভ?”
আমি বললাম,“না লাস্কা। ভুল বুঝো না। তোমাকে মিথ্যেবাদী ভাবব কেন? কিন্তু বুঝতেই তো পারছ, একটিই মাত্র মানুষ বাইশখানা লোহার বড়শির মালিক! এই ব্যাপারটা অমনি এক কথায় বিশ্বাস করা সম্ভব? তুমিই বল।”
লাস্কা অপরাধীর মতো বলল,“তোমার কথাই ঠিক। ওভাবে হুট করে কথাটা বলা উচিত হয়নি।”
“তা নয়তো কী? তুমি যদি বলতে পাঁচ-ছ’খানা, অথবা দশ, তাও না হয় বুঝি। কিন্তু এক্কেবারে বাইশ বললে তো যে কোনো লোকেরই হার্টঅ্যাটাক হয়ে যাবে! আমার কী দোষ বল?”
ও প্রায় কাঁদোকাঁদো মুখে আবার ক্ষমা চাইল। আমি কোনোরকমে হাসি চেপে বললাম,“ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি বয়সে নিতান্তই ছোটো। এসব ভুলটুল একটুআধটু হতেই পারে। ও-সব কোনো ব্যাপার নয়।”
সেকথা শুনে লাস্কার মুখে আবার হাসি ফুটল। কিছুক্ষণ পর জানলাম যে ওই বাইশখানা বড়শি ছাড়াও ওর বাবার খাজানায় আরো একখানা মহামূল্যবান রত্ন রয়েছে। এবার আমি এমন ভাব দেখালাম যে এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে বরফের স্তূপ থেকে গড়িয়ে পড়ে যাব। লাস্কা আমাকে শক্ত করে ধরে বসে রইল। তারপর আমি একটু ধাতস্থ হওয়ার ভণিতা করার পর ও খুব ধীরে-ধীরে, রইয়ে সইয়ে জানাল, ব্যাপারটা যদি খুব বাড়াবাড়ি না হয় (অর্থাৎ আমি যদি চোখ উল্টে, দাঁত খিঁচিয়ে অক্কা না পাই) তবে ও আমাকে সেই রত্নখানা এক্ষুনি দেখাতে পারে। আমি বললাম,“ঠিক আছে। কথা দিচ্ছি, আমি নিজেকে সামলে নেব।”
আশ্বস্ত হয়ে ও ওর জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে মহার্ঘ্য বস্তুটি বের করে আনল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, সেটা একখানা তোবড়ানো পেতলের চাকতি। ওপরে নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনের স্ট্যাম্প। সাধারণত খুব বড়ো লাগেজ পরিবহনের সময় সরকার বাহাদুর এমন চাকতি দিয়ে মালপত্র সিল করে দেন।
আমি হাবার মতো মুখ করে বসে রইলাম, যেন মহামূল্যবান কোহিনূরটির জৌলুস দেখে কী বলব তা বুঝতেই পারছি না। লাস্কা আমার হাত থেকে চাকতিখানা নিয়ে অতিসাবধানে নিজের বুকের কাছে, জামার ভেতর সযত্নে লুকিয়ে রেখে বলল,“দেখলে?”
আমি হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ওঠার ভান করে বললাম,“তুমি কি পাগল লাস্কা? এত দামি একটা জিনিস কেউ এভাবে নিয়ে ঘোরে? সঙ্গে অন্তত একজন দেহরক্ষী তো রাখা উচিৎ ছিল তোমার!”
লাস্কা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,“শশশশ্ ! ধীরে বলো! এত জোরে চেঁচিও না। কেউ জানে না যে এটা আমার কাছে থাকে। সবাই ভাবে বড়শিগুলোর মতো এটাও বাবার খাজানাতেই রাখা আছে।”
আমি খুব নরম দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,“জানো লাস্কা, তোমাকে দেখে আমার কিন্তু খুব হিংসে হচ্ছে এখন। এমন রূপ, এত ধনসম্পদ, বাইশখানা বড়শি, এমন সুন্দর চাকতি, সাতফুট লম্বা এত্তবড়ো এক রাজপ্রাসাদ, এত দাসদাসী, প্রভাবশালী পিতা! সত্যি করে বলো তো লাস্কা, এমন কিছু জিনিস কি থাকা সম্ভব যা এরপরেও তোমার কামনার বস্তু? এমন কিছু কি আছে, যা তুমি পাওনি?”
ওর মুখখানা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। দৃষ্টিতে মেঘ জমল একটু-একটু করে। তারপর টুপির পাশ থেকে বেরিয়ে আসা একগোছা অবাধ্য চুল নিজের আঙুলে জড়িয়ে বলল,
“কোনোকিছুরই বাড়াবাড়ি ভালো নয়। জানো তো, প্রদীপের ঠিক নীচেই অন্ধকার এসে জমে। ধনসম্পত্তি ভালো, কিন্তু কখনো-কখনো মনে হয়, বোধহয় গরীব থাকলেই ভালো হত। ছোটোবেলায় আমরা যখন গরীব ছিলাম তখন আমাদের জীবন অনেক সাদাসিধে ছিল। আমাদের খুদে তাঁবুর দরজা মাঝেমধ্যে সারা রাত খোলা থাকত। কিন্তু কখনো ভয় পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। আর এখন দেখো, বাড়ির সামনে চব্বিশ ঘণ্টা দারোয়ান পাহারা দেয়। বাবা যখন গরিব ছিলেন তখন আমি আর মা ছিলাম তাঁর সবকিছু। বাবা তখন সবাই কে কত সম্মান দিয়ে কথা বলতেন, আর এখন…!”
“জানো মিস্টার টোয়েন, আমি আমার ছোটোবেলার সেই সাদামাটা জীবনটাই ফিরে চাইতাম। আমি, আমার সন্তান, আর আমার ভালোবাসার পুরুষ। শক্তপোক্ত শরীর, কিন্তু সরল মনের একটি মানুষ যে একান্তভাবে শুধুই আমার, আর আমিও শুধুই তার হয়েই বাঁচবো।
একদিন আমার সেই স্বপ্নপূরণ হল। শিকারে করতে বেরিয়ে অচেনা একটি মানুষকে সঙ্গে দেখা হল আমার। ওর নাম কালুলা। অনেক-অনেক দূরে উত্তর দিকে ওদের গ্রাম। এখানকার কিছুই ও চেনে না। আমার পরিচয়ও নয়। আমি তো দেখামাত্রই ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু লজ্জায় কিছু বলতে পারছিলাম না। কালুলা বাঁচাল আমায়। কয়েক দিনের মধ্যেই ও প্রেম নিবেদন করে বসল। তারপরের দিনগুলো স্বপ্নের মতো ছিল। আমরা একসঙ্গে মাছ ধরতাম। সিল শিকার করতাম। কখনো-কখনো নৌকো বেয়ে সমুদ্রে ঘুরতে যেতাম। ওর সঙ্গে যতক্ষণ থাকতাম, ঝড়ের বেগে সময় কেটে যেত। সবচাইতে মজার ব্যাপার কী ছিল জান? ও বা ওদের দলের লোকেরা তো আমাদের এই এলাকায় প্রথমবার এসেছিল। আমি কে, বা আমার বাবা কে— এ-ব্যাপারে ও কিচ্ছু জানত না।ও শুধু জানত যে এই অঞ্চলে একজন মস্ত ধনীলোক থাকেন। কিন্তু সেই ধনী মানুষটি যে আমারই পিতা, সে ব্যাপারে ওর বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। বাবাকে জানিয়েছিলাম সব। শেষপর্যন্ত আমি কাউকে ভালোবেসেছি জেনে বাবাও খুব খুশি হয়েছিলেন। সেই দিনগুলো এত সুখের, এত আনন্দের ছিল যে আমি বলে বোঝাতে পারব না।”
“তারপর একদিন ঠিক করলাম, আমার মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন— সবার সঙ্গে ওর দেখা করিয়ে দেব। বাবা খুশি হয়ে গ্রামের সবাই কে নেমন্তন্ন করলেন সেদিন। শুধু কালুলা কিছুই জানতো না। সন্ধ্যেবেলা ওকে বললাম, “আমার বাড়ি যাবে?”
ও খুব খুশি মনেই রাজি হল। বাড়িতে ঢোকার পথে আমাদের প্রাসাদখানা দেখে তো ওর প্রায় মাথা ঘুরে যায় আর কী। শুধু বড়ো বড়ো চোখে এদিক ওদিক তাকায় আর বলে,“ইশ্, এটা তোমাদের বাড়ি! বাপরে, তোমার বাবা তো দেখছি মস্ত বড়োলোক!”
প্রথম-প্রথম আমি তাতে একটু ভয় পেয়েছিলাম। জানই তো মিস্টার টোয়েন, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়। শেষপর্যন্ত কালুলাও যদি অন্য ছেলেদের মতো আমার বাবার সম্পত্তির দিকেই হাত বাড়ায়, তাহলে কী হবে? কিন্তু না, আমি মিথ্যেই ভয় পাচ্ছিলাম। দু’মিনিটের মধ্যেই দেখলাম ও ও-সব ভুলে গিয়ে শিশুর মতো সরল চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ওর দৃষ্টিতে এতটুকুও লোভ ছিল না।”
“আমার বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন— সবাই এক দেখাতেই ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল। কালুলা মানুষটাই ছিল অমনি। এককথায় সব্বাইকে আপন করে নিত। সেদিন রাত্রের নাচ-গান, হৈ-হুল্লোর সবকিছু থামলে বাবা সবাইকে এক জায়গায় ডাকলেন। আমি একপাশে চুপ করে বসেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, কী হতে চলেছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু জানতাম, বাবাকে বাধা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। সাদাসিধে, গরীব লোকের সামনে নিজের ধনদৌলত দেখানোই আমার বাবার শখ ছিল। এবারেই বা তার অন্যথা হবে কেন! গরীব মানুষেরা লুব্ধ চোখে তাকিয়ে দেখবে বাবার বড়শির সম্ভার! অবাক হয়ে ভাববে, একটাই মাত্র মানুষ বাইশখানা বড়শির মালিক হয় কী করে! তবেই না! দরিদ্রের দারিদ্র্যকে ঠিকমতো ব্যঙ্গ না করলে বড়লোকের দেখনদারি সম্পূর্ণ হবে কী করে?”
“সবাই একজায়গায় আসার পর, বাবা লুকোনো কুলুঙ্গি থেকে সবকটা বড়শি একসঙ্গে বের করে ফুলের মতো আমার মাথার ওপরে ছড়িয়ে দিলেন। বসার ঘরে আলোর অভাব ছিল না। বড়শিগুলো এখানে-সেখানে পড়ে তারার মতো ঝিকমিক করতে লাগল। আমি অসহায় চোখে কালুলার দিকে তাকালাম। বেচারা এতগুলো বড়শি একসঙ্গে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে। ওর মুখখানা ঈষৎ খোলা, যেন কী বলবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ পরে একটু সামলে নিয়ে ও প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,“ও! আপনিই তাহলে সেই ধনকুবের!” সে-কথা শুনে আমার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কালুলাও অপ্রস্তুত হয়ে বোকার মতো সেই হাসিতে যোগ দিল। এরপর বাবা বড়শিগুলো কে একসঙ্গে কুড়িয়ে একটা বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন। তখন যদি তাকে দেখতে তুমি মিস্টার টোয়েন, তোমার মনে হত উনি দামী বড়শি নয়, মেঝের ওপর থেকে আবর্জনা কুড়োচ্ছেন। আমি এসব নাটক দেখে অভ্যস্ত, কিন্তু কালুলা কী করে জানবে যে আমার বাবা কী বস্তু! ও অবাক হয়ে বলল,“ওমা, আপনি বড়শিগুলো গুনে রাখলেন না?”
বাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “যারা এক-দু’খানা বড়শির মালিক,তাদের মতো লোকেরাই নিত্যিদিন গোনাগুন্তি করে সময় নষ্ট করে। এতগুলো বড়শি থাকলে কী প্রত্যেকদিন গোনা সম্ভব হে ছোকরা?”
কালুলা সেকথা শুনে থতমত খেয়ে বলল,“তা তো বটেই, তা তো বটেই! আমারই ভুল। এতগুলো বড়শি একসঙ্গে দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কী বলতে কী বলছি তার ঠিক নেই। এর আগে সবচাইতে বেশি যে ধনী মানুষটিকে দেখেছিলাম, তার কাছে মাত্র তিনটে বড়শি ছিল।”
সে-কথা শুনে বাবা এত জোরে হেসে উঠলেন যে কালুলার বাকি কথাগুলো শোনাই গেল না।
সবার সামনে বাবা এমন ভাব দেখাতেন যে বড়শিগুলো তার হাতের ময়লা,তাই তিনি সেগুলো গোনার প্রয়োজন অবধি বোধ করেন না। অথচ আমি তো জানি সত্যিটা কী! দিনের মধ্যে কতবার যে লুকিয়ে-লুকিয়ে বাবা বড়শিগুলো গুনতেন তার ঠিক নেই।”

“সেদিন রাত্রে সবকিছু মিটে গেলে আমি চুপচাপ নিজের বিছানার ওপর শুয়েছিলাম। কালুলার কথা ভাবছিলাম। আমার সব স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে এই আনন্দে চোখে ঘুম আসছিল না কিছুতেই। এ-কথা সে-কথা ভাবতে-ভাবতে কখন দু’চোখের পাতা জুড়ে গেছে টেরও পাইনি। মাঝরাত্রে হঠাৎ বাবার হুঙ্কার শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। শুনলাম, বাবা খুব রাগী গলায় বলছেন,
“একটা বড়শি পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল ওটা? কে নিয়েছে?”
কেন জানি না বাবার কথা শোনামাত্র আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, যেন খুব অমঙ্গলকর কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আমার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে বাবা সেই মুহূর্তেই চেঁচিয়ে তার সাকরেদদের বললেন,“অ্যাই, কে আছিস! ওই নতুন ছেলেটাকে ধরে আনতো।”
এরপর বাইরে খুব চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। লোকজন সবাই কালুলার খোঁজে এলোপাথাড়ি ছোটাছুটি করছিল। আমি ওকে বাঁচাতে গেলাম। কিন্তু ওর কাছে পৌঁছোনোর আগেই দেখি, আমার বাবার লোকজন ওর হাত-পা বেঁধে ফেলেছে। আমি চিৎকার করে কান্নাকাটি করাতে আমার বাবা খুব বিরক্ত হয়ে তাকালেন আমার দিকে।
ওহ্, কালুলার মুখখানা দেখলে তখন বুঝি অতিবড়ো পাষাণও গলে যেত। চোরের মুখে কখনো অত যন্ত্রণা থাকে না। ও চুপচাপ, মুখ বুজে সবার গালিগালাজ সহ্য করছিল। বোধ করি আমার মতো কালুলাও ভাবছিল, পুরো ব্যাপারটাই একটা দুঃস্বপ্ন। এত কিছুর পরেও কিন্তু ওর মুখে এতটুকুও রাগ দেখিনি আমি। বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা, দুঃখ— সব ছিল ওর চোখে। কিন্তু রাগ বা ঘৃণার ছিঁটেফোঁটাও দেখিনি সেখানে। ওর প্রতি ভালোবাসা আমার আরো বেড়ে গেল। এরই মধ্যে শুনলাম বাবা বলছেন,“গাঁয়ের মোড়লদের ডাকা হোক। ওটাকে যদি আমি ফাঁসিতে না ঝোলাই তবে…!”
আমি রুখে দাঁড়ালাম,“মানে! কী বলতে চাও তুমি? তোমার কাছে প্রমাণ কোথায় যে চুরিটা ওই করেছে? আগে বড়শিটা খুঁজে তো দেখ!”
বাবা বিকৃত স্বরে বললেন,“ও আচ্ছা, আমার গুণনিধি মেয়ে এখন প্রমাণ দাবি করছেন! ঠিক আছে, আমাদের সামনে তুমিই খোঁজো তাহলে। হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে যাবে!”
আমি একটা মশাল হাতে নিয়ে বড়শিটা খুঁজতে শুরু করলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে বড়শিটা ওখানেই কোথাও পড়ে গেছে। কালুলা নির্দোষ। বাবা বিনাদোষে ওকে দোষী সব্যস্ত করেছেন। কিন্তু বিধি বাম, বড়শিটা কোত্থাও পাওয়া গেল না।
বাবা এবং তার লোকজন সবাই ব্যঙ্গ করে হাসতে শুরু করল। আমার যন্ত্রণা বুঝবে এমন একটা মানুষও সেখানে ছিল না। আমি মশালখানা রেখে, মাথা উঁচু করে কালুলার হাত ধরে বললাম,“আমি জানি তুমি নির্দোষ। কিন্তু তবুও আমার চোখে চোখ রেখে একবার বলো, তুমি এ-কাজ করনি!”
কালুলা বলল,“আমি মরে গেলেও অমন নোংরা কাজ কক্ষনো করব না। লক্ষ্মীটি, তুমি ভয় পেও না। নিশ্চয় কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
গাঁয়ের মোড়লরা আসার পর বাবা তার দিক থেকে অভিযোগ জানালেন, “প্রাসাদের দরজা বন্ধ ছিল, দরজার বাইরে দারোয়ানও দাঁড়িয়ে ছিল রীতিমতো। ও ছাড়া বাকি সবাই আমার চেনা, পরিবারের লোকজন। বাড়ির লোকজনের ওপর কেন সন্দেহ করব আমি?”
“বাড়িতে অচেনা মানুষের উপস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটলে সন্দেহ তো হবেই।” মোড়লরা সবাই একবাক্যে সায় দিলেন এ-কথায়। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বললেন,“অভিযুক্তের পক্ষ নিয়ে কারোর কিছু বলার আছে?”
আমি উঠে দাঁড়ালাম, “দু’দিন বাদে ও আমার স্বামী হতে চলেছে। আমার বাবার যা কিছু আছে তা তো ভবিষ্যতে এমনিতেই ওর হবে। চুরি করার প্রয়োজন কী ওর?”
কারোর মুখেই এই প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না। মোড়লরাও স্বীকার করলেন যে এ যুক্তি না মেনে উপায় নেই। তাঁরা বললেন,“এর বিরূদ্ধে কারো কিছু বলার আছে?”
আমার বাবা খুব অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন,“কাল রাত্রে, অন্ধকারে ছায়ার মতো কাউকে ওই ঘরের আশেপাশে দেখেছি আমি। তখন ভেবেছিলাম চোখের ভুল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ওটা ওই ছিল।”
কালুলা শুকনো গলায় বলল,“বিশ্বাস করুন, কোনো মন্দ উদ্দেশ্যে ও ঘরে যাইনি আমি।”
কথাটা শুনে আমরা সবাই কালুলার দিকে তাকালাম। এ কী বলছে ও! বাড়ির লোকের অনুপস্থিতিতে ও ওই ঘরটাতে গিয়েছিল!
কালুলা একটু ইতস্তত হয়ে বলল,“আমি জীবনেও ভাবিনি যে এতগুলো বড়শি একসঙ্গে দেখতে পাব। রাত্রিবেলায় বড়শিগুলোর কথা ভেবে আমার চোখে ঘুম আসছিল না। তাই সবার চোখের আড়ালে, লুকিয়ে আমি বড়শিগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। ওগুলোকে হাতে নিয়ে দেখেছি, চুমু খেয়েছি! তারপর সাধ মিটলে আবার জায়গা মতো রেখে দিয়েছি। হয়তো আমার হাত থেকে একখানা নীচে পড়ে গেছে। কিন্তু… কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি চুরি করিনি!”
আমি বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মানুষ এত বোকাও হয়! কালুলা এটা কী করল? মুর্খের মতো স্থান-কাল-পাত্র না দেখে এ কী বলে বসলো ও! আশেপাশের প্রতিটা মানুষের চোখ জিঘাংসায় ঝকঝক করছে। কালুলার স্বীকারোক্তি শোনার পর কে বিশ্বাস করবে যে ও চুরি করেনি? দমবন্ধ হয়ে আসছিল আমার। গাঁয়ের মোড়লদের মুখ থেকে বেরোনো প্রতিটি শব্দ ছুরির মতো আমার বুকে কেটে বসছিল। মোড়লরা ঘোষণা করলেন,“অভিযুক্ত কালুলার জন্য জলপরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে!”
আমার দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছিল। কী কুক্ষণেই যে জলপরীক্ষা শুরু হয়েছিল এ দেশে! আমাদের মধ্যে আগে এ-সবের চল ছিল না। আগে প্রকৃতির লক্ষণ দেখে পুরোহিতরা বিচার করতেন কে দোষী আর কে নির্দোষ। কপাল ভালো থাকলে কুকর্ম করেও স্রেফ দেবতার দয়ায় অনেককে বেঁচে যেতে দেখেছি তখন। কিন্তু জলপরীক্ষায় সেসব হওয়ার জো নেই। জলদেবতার নিদান স্পষ্ট। অপরাধীর পালানোর উপায় নেই। অভিযুক্ত যদি নিরপরাধ হয় তবে জলদেবতা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে নিজের বুকে টেনে নেন। নিরপরাধ মানুষ জলে ডুবে যায়, আর অভিযুক্ত অপরাধী হলে জলদেবতা ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ফিরিয়ে দেন। অপরাধী ব্যক্তি শূন্য কলসের মতো জলে ভাসবে অথবা সাঁতার কাটবে। এরপর অপরাধীকে ধরে এনে তার প্রাপ্য শাস্তি ঘোষণা করা হয়।
জলপরীক্ষার কথা শোনামাত্র আমি ভেঙে পড়লাম। কেউ মানুক আর না মানুক, আমি তো জানতাম যে কালুলা নির্দোষ। জলে পড়া মাত্র ও ডুবে যাবে। জলদেবতা নিজের বুকে টেনে নেবেন ওকে। আমার জীবন থেকে আমার প্রেমিক, আমার পুরুষ, আমার কালুলা চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে।
ওর শেষসময়ে আমি একমুহুর্তের জন্যও ওকে কাছছাড়া করিনি । আমার চোখের জলে ওর বুক ভিজে গিয়েছিল। ওর মুখেও কোনো কথা ছিল না। দুজনেই জানি এই শেষ দেখা। এরপরে আর কিচ্ছু নেই…সবকিছু শেষ!
সে যে কী যন্ত্রণা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমার বুক থেকে আমার প্রেমিককে ছিনিয়ে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিল জল্লাদের দল। আমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারলাম না। আমার চোখের সামনেই কালুলাকে সমুদ্রে সমর্পণ করা হল। আমি আর দেখতে চাইলাম না। দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে ভগবানকে বললাম, “হে ঈশ্বর, আমাকেও শেষ করে দাও!”
একটু পরেই লোকজনের বিকট চিৎকারে আমার ঘোর কাটল। আমি চোখ খুললাম।
কী জঘন্য সেই দৃশ্য! জলদেবতা গ্রহণ করেননি ওকে। কালুলা সাঁতার কেটে জলের ওপর ভেসে উঠল। সেই দৃশ্য দেখামাত্র আমি পাথর হয়ে গেলাম। কালুলা আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে! চুরিটা তবে ওই করেছিল! আমি আর সময় নষ্ট না করে বাড়ির পথ ধরলাম।
কালুলার শাস্তিদান পর্ব শেষ হওয়ার পর সবাই বাড়ি ফিরে এল। ওকে একটা বরফের টুকরোর ওপর চড়িয়ে দক্ষিণ মহাসাগরের দিকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘরে ফেরার পর বাবা বললেন,“তোমার গুণধর প্রেমিক যাওয়ার আগে তোমাকে বলতে বলেছে, “লাস্কাকে বলো আমি নিরপরাধ। আমার শেষমুহুর্ত অবধি আমি শুধু ওর কথাই ভাববো। ওকে বলো ও কবিতার মতো সুন্দর। আমি ওর ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেইটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।” তুমি কি…”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“চুপ করো বাবা। ও একটা চোর! ওর নাম আমি আর কখনো শুনতে চাই না।”
এরপর ন’মাস কেটে গেল। হতাশায় ভরা, বিরক্তিকর নয়খানা মাস। নতুন বছরের উৎসব শুরুর আনন্দে মেতে উঠল সবাই। মেয়েরা বছরের এই একটা দিন স্নান করে, চুল ধোয়, চুল বাঁধে। সেদিন স্নানের আগে আমি চুল আঁচড়ানো শুরু করামাত্রই চিরুনির গায়ে লেগে বেরিয়ে এল অভিশপ্ত সেই বড়শিখানা। আমার কালুলা, নিরপরাধ, নির্দোষ কালুলা যার জন্য নিজের প্রাণ খুইয়েছিল! ন’মাস আগে বাবা যখন আমার মাথার ওপর বড়শিগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেদিনই বড়শিখানা আমার চুলে আটকে গিয়েছিল।
আমি কাঁদতে-কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। বাবাও সবকিছু জানার পর শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। সেদিনের পর থেকে বাবাকে আর হাসতে দেখিনি কখনো। মাঝে মাঝেই ওঁকে বিড়বিড় করে বলতে শুনেছি,“আমি খুনি। ছেলেটাকে খুন করেছি আমি!”
কিন্তু এখন অনুতাপ করে আর কী লাভ, বল? সেদিনের পর থেকে আমি প্রত্যেকদিন চুল আঁচড়াই। কী যে খুঁজি তা আমি নিজেও জানি না।”
মেরুদেশের মেয়ের বলা করুণ প্রেমের গল্পটি এখানেই শেষ। হয়তো নিউইয়র্কের বাসিন্দা কোনো কোটিপতির জীবনেও এমন কিছু ঘটেছে। ঘটতেই পারে, তাই না? সেজন্যই নিউইয়র্কের কোটিপতি হওয়ার বদলে, মাত্র সেন্টদশেক খরচা করে মেরুদেশের রাজা হওয়াই আমার পছন্দ— বুঝলেন!


এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *