রেয়া মার্টিন
অনুবাদ বৈশাখী ঠাকুর

(‘Wherever Mister Jenson Went’ গল্পটি ২০২০ সালে Commonwealth Short Story Prize বিভাগে কানাডা এবং ইউরোপ থেকে আঞ্চলিক বিজয়ী ছিল।)
রেয়া মার্টিন- এর জন্ম স্কটল্যান্ডে। তিনি বেশ কয়েকটি অনলাইন প্রকাশনায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং ২০১৮ সালের বিবিসি ইয়ং রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড-এর ফাইনালিস্ট ছিলেন। তিনি স্কটিশ NYAAG (ন্যাশানাল ইয়ুথ আর্টস অ্যাডভাইজরি গ্রুপ) এর সদস্য এবং স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা ও সৃজনশীল লেখার উপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যখন তিনি লেখালেখি করেন না, তখন তিনি তরুণদের উৎসাহিত করেন সৃজনশীল লেখার ব্যাপারে। বর্তমানে তিনি নিজের প্রথম উপন্যাসের কাজে ব্যস্ত।
মিস্টার জেনসন শহরের বাইরে থাকতেন। তিনি এমন এক জায়গায় থাকতেন যেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, গোলা-গুলি চলত আর যাবতীয় রহস্যজনক ব্যপারস্যাপার ঘটত। তার কালো মুখ আর কালো চোখের মাঝে গোলাপি ঠোঁট জোড়া বেশ অস্বাভাবিক লাগত। সে কুঁজো এবং রাগী এবং বিড়বিড় করে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলত। শহরের ডান দিকের বাসিন্দাদের ধারণা তার হাতের লাঠিটা মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি। বৃদ্ধাদের মনে হয় সেগুলো শিশুদের হাড় ছিল। জমাটি রবিবারের পোশাক পরে, কালো টুপির নীচে ভ্রু কুঁচকে তারা আলোচনা করত,
—— এখন থেকে খুব সাবধান হতে হবে বিশেষ করে যখন এরকম মানুষজন আশেপাশে।
জেনসন মহোদয়ের মত খুব বেশি মানুষ এলাকায় নেই। তাই হয়তো সাবধানতা বেশি করে অবলম্বন করা প্রয়োজন। মুখে না বললেও, সবাই জানে মিস্টার জেনসন বিশেষ কারণে অনেক দূরে গেছেন। সবাই জানত ব্যাপারটা এভাবেই গড়াবে।
সে তার বাড়ির সামনে একটা গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে চুরুট টানছিল। বাচ্চারা ধূলো উড়িয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে তার সমন্ধে আলোচনা করে। সে কিন্তু তাদের নীরবে পর্যবেক্ষণ করছে সরু চোখ দিয়ে, মুখের সামনে ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে। কেউ কেউ আবার বলে যে ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও তার জন্য চুপ করে থাকে। সন্ধের সময় পোকারা কখনও তার বাড়ির আশেপাশে গান গায় না। কেবল এসে মুখ উঁচু করে একবার দেখে তারপরেই হলুদ ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। মাছিরাও নিশ্চুপ, কেবল দরজায়, পর্দায় মাথা ঠুকে যাচ্ছে। মুখের আশেপাশে ঘুরে বেড়ালে সে হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। অবশ্য বেশির ভাগ সময় সে চটাস চটাস করে সেগুলোকে মেরে ফেলে। সেগুলো তার পায়ের ওপর দেহ রাখে আর তার বিশাল বপুর পোষা কুকুর সেই অবোধ প্রাণীগুলোর ওপর শুয়ে থাকে। বাচ্চারা দিনে সারাক্ষণ তাকে দেখে এবং রাতে তাকে নিয়ে গল্প বানায়।
মিস্টার জেনসন চুরুট ধূমপান করেন না। ধোঁয়ারা ওড়ে—- রক্ত এবং ধূলো আকাশে মিশে যায়।
মিস্টার জেনসনের কেউ নেই। নিজের স্ত্রী এবং সন্তানদের হত্যা করেছেন। একটি বন্দুক লুকিয়ে রাখেন স্ক্রীন দরজার পেছনে।
জীবনে কখনও প্রার্থনা করেননি মিস্টার জেনসন। ওর কখনও স্বর্গবাস হবে না।
মোটামুটি এই সব কথাই এলাকার বাচ্চারা বলে থাকে।
তারপর তারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে নৈশাহার করে। বাবাদের পুরনো সাইকেলগুলো চালানোর পরে যথাস্থানে রেখে তারপর যদি মিস্টার জেনসন সমন্ধে কোন কথা বলতে যায় তখন সপাটে চড় থাপ্পড় ছাড়া অন্য কিছু জোটে না। মায়েদের মুখগুলো দেখে মনে হয় তখন তারা বুঝি কোন টক ফলে কামড় বসিয়েছে।
খাবার টেবিলটা কোন জায়গা নয় এইসব কথা বলার।
মাংসের টুকরো কাটতে কাটতে তারা মাথা নাড়ে। মুখে রাগের অভিব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ে।
বসে বসে কারুর নামে নিন্দা করার জায়গা এটা নয়। বুঝতে পারছ কি তোমরা!
তারপর মায়েরা, সর্বদা রাগান্বিত বাবাদের দিকে তাকায়। আর বাবাদেরও সর্বদা মায়ের সাথে সহমত পোষণ করতেই হয়, নাহলে বিপদ আসন্ন! অন্যথা হলেই বাসনের ঝনঝনানি, মায়েরা রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করে চিৎকার করতে থাকে। তার সাথে বাড়ির সবাই শোরগোলে মেতে ওঠে। তার চিৎকার চেঁচামেচি হতেই থাকে যতক্ষণ না কেউ কাঁদতে শুরু করে। বেশীর ভাগ সময় সেটা মায়েরাই হয়ে থাকে। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,
তুমি কি কিছুই করবে না? তোমার আসলে কিছু যায় আসে না।
তারপর বাবারা ছুড়ি চামচে টেবিলে নামিয়ে প্লেট ঠেলে উঠে পরে। মহাসমারোহে গলা উঁচু করে বলে ওঠে।
ক্রিস, লুসি, তারা ছোট বাচ্চা! তারা কি করে জানবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল!
বাবারা ধূমপান করতে করতে ভুরু কুঁচকে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। মাঝে মাঝে তাঁদের দেখে মনে হয় তাঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন, কিন্তু তাঁরা জানে মায়েরা কখন ক্ষেপে যাবে। তারপর মায়েরা খেপে উঠলে বাবারা বেশ ভাল করেই হাত সুখ করে নেয় এবং মায়েদের বিরুদ্ধে তেমন নালিশ করে না কারণ তাঁদের ছোটবেলাতে তাঁরাও খাবার টেবিলে বসে নানান অপ্রিয় কথা বললে তাঁরাও বাবাদের হাতে ভালই মার খেয়েছে। ভাবলেই বাবার পিঠ দিয়েও ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায়। বিশেষ করে ওই ঘুমন্ত কুকুরটার কথা ভেবে; যেভাবে টপাটপ মাছিগুলোকে খেত; মুখটা একদিকে কাত করে গোলাপি জিভ ঠোঁটের ওপর ঝুলত শুকনো হাওয়ায়। সপাটে বেত পরার আওয়াজের মত করে খেত আর জনগণ বলত
এই কুকুর একদিন মানুষ খাবে।
জামাকাপড় ছেড়ে শুতে যাবার সময় মায়েরাও একই কথা বলত। বস্ত্রহীন অবস্থায় গোপনে তারা প্রার্থনা করত যেন প্রাণীটি মিস্টার জেসনকে হত্যা করে। কিন্তু তারা বাচ্চাদের জানতে দিতে চায় না কারণ বাচ্চারা আগে থেকেই অনেক বেশি জানে। বাচ্চাদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসে মন দেওয়া উচিত—পড়ার বই পড়বে, ধর্মগ্রন্থ পড়বে এবং নিজেদের প্রার্থনা সঠিক ভাবে জানবে। নগ্ন অবস্থায় বিছানায় মায়েরা এমনটাই ভাবে।
শহরের বাইরে থেকে খবর এল। রবিবারের পাতায় স্থান করে নিল সে খবর আর অভিজাত বাড়িতে পৌঁছল আরো তিন দিন পরে বেড়া ডিঙিয়ে, সবুজ ঘাস পার করে, পাইপ টপকে, একেবারে খাস বসার ঘরে। বাচ্চারা ব্যানারের মত করে সংবাদপত্র ধরে আছে। তারা ঝগড়া করে কে বাবাকে আগে খবরটা দেবে। তারা ঝগড়া করে বাবার কফির কাপের তলায় পরে থাকা কফির চুমুকটা কে নেবে; জিভ দিয়ে শেষ ফেনাটুকু চাটতে থাকে। এদিকে মা রান্না করে আর বাচ্চারা ঝুটঝামেলা করতেই থাকে যতক্ষণ বাবা চান ঘরে আছে ওপরের তলায়। চান ঘরে বসেই বাবা যাবতীয় দিনের পড়া সারে এবং বেরিয়ে মাকে যা যা বলা প্রয়োজন তা সম্বন্ধে অবগত করে। মা আসলে গল্পগুলো শোনার অপেক্ষায় থাকে কিন্তু সে ব্যাপারে মা আশ্চর্য রকমের নীরব। কারুর বাবাই সে ব্যাপারে মুখ খোলে না। আজকের রবিবারের পাতায় অনেক কিছু পড়ার আছে। পড়ার সম্ভার প্রচুর। প্রত্যেকের বাবারই মাথা ধরে যায়। তারা স্ত্রীদের শয্যাকক্ষে ডাকে এবং বাচ্চাদের কথা দেয় যে পরের দিন তাদের কফি পান করাবে যদি তারা এখন খেলতে চলে যায়।
বাচ্চারা খেলতে চলে যায়। তখন প্রায় নিঃশব্দে তারা সেই খবরটি পৌঁছে দেয়।
মিস্টার জেনসন লুইসা গেছেন।
সে এবং তার বৃহদাকার কুকুরটি।
বলা হচ্ছে যে সেখানে তিনি নিজেকে নিজে মেরে ফেলেছেন।
এক অপরাধবোধ কাজ করে স্ত্রীদের মধ্যে। তার করজোড়ে মাথা নীচু করে আর বাচ্চারা বুঝতে পারে আগামী দিনে বাজে কিছু ঘটতে চলেছে। তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ এমন সব কথা বলে যা তাদের মায়েরা ভীষণভাবে অপছন্দ করে। তারা শুনতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু ভালো করে বুঝতে পারে না। ফলে আরো গল্পের জন্ম নেয়। কেউ কেউ সেই সাইকেল রাখার জায়গায় চলে যায়। অন্ধকারে জং ধরা হাতলে হাতড়ায়, নাক জ্বালা জ্বালা করে তেলের গন্ধে। কোথাও কোন অভিজাত ঘরে মা কাঁদছে, বাবার মাথা ধরেছে রবিবারের খবরের কাগজ পড়ে, বাচ্চারা খেলতে গেছে। কেবল ধূলো বালির বাতাসের ঝাপটায় একটা হিসহিস শব্দ শোনা যায়।
বাচ্চারা টায়ার নিয়ে রাস্তার ওপর খেলতে থাকে। উঁচু নিচু রাস্তায় ধাক্কা খায়। পাখির মত ডাকে, কিচিরমিচির করে। সাইকেলের চেন নিয়ে আওয়াজ করে। একজন বলে সে মিস্টার জেনসনের বাড়ির পেছনে একটা লোককে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে। সে তিন দিন আগে একটা লোককে দেখেছিল বড় একটা বন্দুক নিয়ে এবং একটা কুকুরটাকে শুনেছিল রাত্রে খুব ডাকাডাকি করছিল। তারা বলে,
তুই বাজে বকছিস, তুই তো শহরে ছিলি তিন দিন আগে, মায়ের সাথে নতুন জামাকাপড় কিনতে গেছিলি।
সে জানে যে তারা সত্যি কথা বলছে তাই চুপ করে যায়। কিন্তু এরকম ধরনের কথাই বাচ্চারা বলতেই থাকে। তার বাড়ি পৌছনোর আগেই ফিসফিসানি শুরু হয়ে যায়। তাদের চলার গতি ক্রমে ধীর হয়, তারা কাঁটা গাছের আশেপাশে ওই বৃহদাকার কুকুরের ভূত খুঁজতে থাকে।
কিন্তু সে ঝোপঝাড়ের পেছনে লুকিয়ে আছে। এখনও মাছি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
তুমি দেখতে পাচ্ছ ওটা? ওই যে নড়ছে ওখানে। এখনও মাছির সন্ধানে আছে।
আওয়াজ করো না। সে হয়তো অতর্কিতে বেরিয়ে এসে তোমাকে মেরে দিতে পারে।
চোখ দিয়ে তাদের জল ফেটে বাড়িয়ে আসতে চাইছে। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি তারা কাঁদবে কিন্তু সাহসী বাচ্চারা কাঁদে না। জীবন বাজি রেখেও না।
আমাকে কেউ মারতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ। কেউ না। আমি কোন ভূতকে ভয় পাই না।
তারা গতি তুলে রাস্তা দিয়ে দৌড়তে শুরু করে। তারা হলুদ ঘাসের একটা উঠোনে দাঁড়ায়। ঠিক এই উঠোনটার পেছনে আছে যে বাড়িটা তার সব জানলা বন্ধ। প্রায় কিছুই নেই সেখানে , কেবল গাছের ডাল থেকে ঝুলছে দোলনার সীট। ওই সীট এবং এক শেরিফ যে ঝুঁকে একদম সামনে তাকিয়ে আছে। তারা যদি যথেষ্ট সতর্ক হয়, তাহলে তারা শেরিফের মুখ দেখতে পাবে। তারা মাটিতে নিজেদের মিশিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। শেরিফ তখন খুব বকবক করছেন। তাঁর মাথাটা দরজার থেকে একটু বাঁদিকে হেলে গেছে। তারা বুঝতে পারছে ভেতরে কেউ আছে। অনেক কথা দরজার আড়াল থেকে ভেসে আসছে এবং সেখানে অন্য একটি লোক আছে ধূমপান করছে। গন্ধে বাচ্চাদের দম বন্ধ হয়ে আসে।
লোকটা অনেকটা মাকড়সার মতন। বড় মাথা আর সরু সরু হাত। সিগারেট ধরা দুই আঙুলের ফাঁকে।
কুঁজোর সাথে লড়াই হত আর কি! একটা ভয়াবহ লড়াই! কিন্তু ভাবার বিষয়, কী এমনটা হল যা এটা করতে বাধ্য করল! ভগবানের দোহাই, কি সাংঘাতিক কাজ!
বাচ্চারা হাঁটু গেড়ে বসে একে অপরের ওপর ঠেলে লাফালাফি করছে। বাতাস ঘন হয়ে আসছে ঝগড়া এবং অপমানের ভাষায়। ছায়া – মানুষটির মুখের ঝুলন্ত সিগারেট থেকে ছাই ফেলছে সামনের দুটি দাঁতের ফাঁক দিয়ে। সে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করতে থাকে আর যাবতীয় সব কথাবার্তা শেরিফই করতে থাকেন।
পাণ্ডববর্জিত স্থান। বড় উঠোন। ছোট্ট ঘর। আর সেই বৃহদাকার কুকুর। আর কোন প্রাণী নেই। সত্যিই দুঃখজনক তাই না! তোমার এটা দুঃখজনক মনে হয় না, জেমস?
শেরিফকে অনেকটা মায়ের মত লাগে কারণ তিনি প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না। দরজার ফাঁক দিয়ে জেমস খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করছে। সে গোড়ালির নীচে সিগারেটটা পিষে দেয়। শেরিফের থেকে সে রোগা। বরফের মত ঠাণ্ডা মুখ। সোজা চোয়াল, ইস্পাতের মত তীক্ষ্ণ চোখ, কোণে আটকে থাকা ইঁদুরের মত দাঁত। সূর্যাস্তের সময় সেই দাঁত ঝলসে উঠত। বাচ্চারা এখনও শ্বাস ধরে আছে। তারা অপেক্ষা করছে কখন কুকুরটা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পরে কালো মেঘের মধ্যে মিশিয়ে দেবে। তারা হাড়ের ছড়ি নিয়ে মিস্টার জেনসনের জন্য অপেক্ষা করছে। যে কোন সময় সে এবার গাছ দোলনায় নিজের স্থান গ্রহণ করবে। সে এবার ধূমপান করবে এবং সোজা তাকাবে এবং শেরিফকে চিৎকার করতে করতে তাঁর মায়ের কাছে পাঠাবে। অদূরে এক কোণায় বাচ্চারা চুপ করে বসে থাকে। মাটিতে থাকার জন্য তাদের চামড়ায় দাগ হয়ে যায়। তারা কনুইয়ে ভর দিয়ে ফিসফিস করতে থাকে।
যে কোন মুহূর্তে এখন……একটু অপেক্ষা কর।
মিস্টার জেনসন লুকিয়ে আছে। অন্ধকারে অপেক্ষা করছে……
মিস্টার জেনসন এবং তার বৃহদাকার কুকুর।
নৈঃশব্দে, নীরবতায় আচ্ছাদিত চারিদিক। কিন্তু মিস্টার জেনসনের কোন পাত্তা নেই। কোন পায়ের ধ্বনি শোনা যায় না। কুকুরের কোন অলস মৃদু ডাকও কানে আসে না। শুধু একটি প্রাচীন চাবি ঘোরানোর শব্দ। এবং শেরিফ এখনও থুতনির চামড়া টেনে টেনে বের করে কথা বলেই যাচ্ছে। বলেই যাচ্ছে। সে অনেকগুলো সাইকেলের পাশ দিয়ে এখন যাচ্ছে ঠিক সাপের মত এঁকেবেঁকে। সিটের ওপর মরচে পড়েছে, প্যাডেলগুলোতেও; কিন্তু তাতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। ধূলোমাখা রাস্তা দিয়ে যখন লোকেরা নামছে বাচ্চারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। সূর্যাস্তের সময় তারা শরীর প্রসারিত করে টেনে টেনে নামছে। ইতিমধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকাদের তান শুরু হয়ে গেছে। তারা আজ খুব জোরে ডাকছে মিস্টার জেনসনের বাড়িতে। এতই জোরে যে বাচ্চাদের মাথা ধরে যাচ্ছে। একটা- দুটো মাছি তাঁদের শরীরে বসে, আর একটু পরপর নড়েচড়ে বসছে। দু একটা বাচ্চা হাঁসফাঁস করছে। অনেকক্ষণ ধরে ধরে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ছে। তারা সন্ধ্যা থেকে অন্ধকার পর্যন্ত মিস্টার জেনসনের জন্য অপেক্ষা করছে। আর রাত হচ্ছে তাদের অভিজাত বাড়িতে গল্পের সময়। টেবিলে ঝামেলার সময়। দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়ার সময়। কিন্তু আজ রাতে আর কারুর চোখে ঘুম নেই।
কেউ চিৎকার করে ওঠে, আমি বাড়ি যেতে চাই।
কিন্তু সাইকেলগুলো খুঁজে বের করবার জন্য আর কোন আলো নেই।
কেউ একজন তিরস্কার করে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলে উঠল, যা, দূর হ এখান থেকে, আমাকে পিষে দিচ্ছিস।
ঘাসের ভেতর দিয়ে একটা অদ্ভুর আওয়াজ ভেসে ওঠে। কেউ বলতে পারে না সেটা নিঃশ্বাস নাকি বাতাস। অবশেষে কেউ একজন নীরবতা ভাঙে।
লোকটা বলছে যে সে চলে গেছে। চলে গেলে তো সব ফাঁকা।
এইটা সেই একই ছেলে যে এখনও মায়ের সাথে শহরে যায়। একা যেতে ভরসা পায় না। এইটা যদি রাতের সময় না হত কেউ তার কথায় কান দিত না। আসলে অন্ধকার শিশুদেরকেও চিন্তান্বিত করে তোলে। তারা তার চারিদিকে একত্রিত হয় বড় বড় চোখ আর ফ্যাকাসে মুখে।
যদি ফাঁকা হয়, তাহলে আমরা ভেতরে যেতে পারি। ওর ভূতের সন্ধান করতে পারি। আসল ভূতের। আর দরজার পেছনে তাকাও………যেখানে সে বন্দুকটা রাখত…।
তারা দৌড়াতে শুরু করে। ছুটে তারা মাছির চেয়েও চুপিসারে ঘরের ভেতরে ঢোকে। আকাশের ওই আধখানা চাঁদকে সম্বল করে তারা সারা বাড়িটা ঘোরে। তাদের খুদে খুদে হাত ঘরের প্রতিটা কোণা হাতড়ে বেড়ায়। সূর্যোদয় হতে হতে তারা সকলে ঘুমিয়ে পড়ে এর ঘাড়ে ওর মাথা গুঁজে। সকালে ঘুম ভাঙলে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় যে মিস্টার জেনসন চিরকালের মত চলে গেছে। এবং তারা নিশ্চয়ই সঠিক কথাই বলেছিল কারণ সে আর ফিরে আসেনি।
কেউ তাকে নিয়ে আর কথা বলে না। না বাবারা, না মায়েরা, না বাচ্চারা। ব্যাপারটা হচ্ছে, সবসময়ই অন্য কেউ থাকে যার জন্য আবার গল্প বানানো যাবে। সবসময়ই অন্য কেউ একটা রয়েছে দূরদেশে কোন কারণের জন্য। মিস্টার জেনসন ব্যতীত, ঘটনা প্রায় একই থাকে। মায়েরা অন্য লোকেদের জন্য প্রার্থনা করে, বাবারা এখনও রবিবারের সংবাদপত্র খুঁটিয়ে পড়ে। এখনও রবিবারের কফির কাপের তলায় কফি পড়ে থাকে আর পুরুষেরা এখনও স্ত্রীদের কথা না শুনে ধূমপান করতেই থাকে। কিন্তু লোকেরা জানে যে জিনিসগুলো এভাবে পরিণতি নেবার কথা ছিল না। কারণ কেউ ঘুণাক্ষরেও কোন বন্দুক, কোন অশরীরি বা বৃহদাকার কুকুরের ছায়াটারও সন্ধান পায়নি। কেউ না—এমনকি স্থূলাকার শেরিফও কিছু খুঁজে পায়নি।
কেউ কেউ বলে যে সে মারা যাওয়ার ঠিক আগে তার বন্দুক লুকিয়ে রেখেছিল, এবং এটি এমন এক জায়গায় যেখানে কেউ কখনও দেখার কথা ভাবেনি। কেউ কেউ বলে যে সে কুকুরটাকে গাছের ওখানে ছেড়ে দিয়েছিল এবং গ্রীষ্মে ঝড়ের দাপটের সময় তার মাছি তাড়ানোর আওয়াজ বিলক্ষণ শোনা যায়। কারুর মতে তাকে তার নিজের উঠোনে কবর দেওয়া হয়েছে যেখানে সে তার স্ত্রী এবং নিজের সন্তানদের কবর দিয়েছিল। অন্যরা বলে সে একজন প্রাচীন মানুষ, দুঃখী এবং একাকী এবং শোকে আচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে সে তাদের নিজেদের দোষে চলে গেছে। মা, বাবা এবং বাচ্চারা শহরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকে।
ধীরে ধীরে বাচ্চাদের ব্যাপারটা বোধগম্য হতে শুরু করে। কেউ না জিজ্ঞেস করলে তারা নিজে থেকে কখনও বিষয়টি উত্থাপন করে না। আর কেউ জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দেয়,
মিস্টার জেনসন সবসময় শহরের বাইরেই থাকতেন।
বাবামায়েরা কফির কাপ রেখে দেয়। মহিলারা রান্না থামিয়ে বুকের কাছে হাত জড়ো করে। বাচ্চারা অনর্গল বলে চলে, সে সবসময় অনেক দূরে থাকত। দূরে থাকত বিশেষ কারণের জন্য।
তারা কাঁটাচামচ দিয়ে টুকটুক করে নৈশাহার করে। ঠোঁট চিপে গভীর চিন্তা করে। কেউ জানে না এটা টেবিলে বাজে কথা বলে গণ্য করা হবে কিনা। মায়েরা তাদের আর কিছু বলে না আর বাবাদেরও থাপ্পড় মারার কোন প্রয়োজন পড়ে না।
সর্বোপরি, সবাই জানে……
তারা থেমে যায়, নিজেরাই অনিশ্চিত। তারপর বাচ্চারা বলে সবচেয়ে নিরাপদ কথা যা তারা ভাবতে পারে, সে সেখানেই থাকত যেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। গোলাগুলি চলত আর যাবতীয় রহস্যময় ব্যাপাস্যাপার ঘটত।
রেয়া মার্টিন- এর জন্ম স্কটল্যান্ডে। তিনি বেশ কয়েকটি অনলাইন প্রকাশনায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং ২০১৮ সালের বিবিসি ইয়ং রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড-এর ফাইনালিস্ট ছিলেন। তিনি স্কটিশ NYAAG (ন্যাশানাল ইয়ুথ আর্টস অ্যাডভাইজরি গ্রুপ) এর সদস্য এবং স্ট্র্যাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা ও সৃজনশীল লেখার উপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যখন তিনি লেখালেখি করেন না, তখন তিনি তরুণদের উৎসাহিত করেন সৃজনশীল লেখার ব্যাপারে। বর্তমানে তিনি নিজের প্রথম উপন্যাসের কাজে ব্যস্ত।
মিস্টার জেনসন শহরের বাইরে থাকতেন। তিনি এমন এক জায়গায় থাকতেন যেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, গোলা-গুলি চলত আর যাবতীয় রহস্যজনক ব্যপারস্যাপার ঘটত। তার কালো মুখ আর কালো চোখের মাঝে গোলাপি ঠোঁট জোড়া বেশ অস্বাভাবিক লাগত। সে কুঁজো এবং রাগী এবং বিড়বিড় করে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলত। শহরের ডান দিকের বাসিন্দাদের ধারণা তার হাতের লাঠিটা মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি। বৃদ্ধাদের মনে হয় সেগুলো শিশুদের হাড় ছিল। জমাটি রবিবারের পোশাক পরে, কালো টুপির নীচে ভ্রু কুঁচকে তারা আলোচনা করত,
—— এখন থেকে খুব সাবধান হতে হবে বিশেষ করে যখন এরকম মানুষজন আশেপাশে।
জেনসন মহোদয়ের মত খুব বেশি মানুষ এলাকায় নেই। তাই হয়তো সাবধানতা বেশি করে অবলম্বন করা প্রয়োজন। মুখে না বললেও, সবাই জানে মিস্টার জেনসন বিশেষ কারণে অনেক দূরে গেছেন। সবাই জানত ব্যাপারটা এভাবেই গড়াবে।
সে তার বাড়ির সামনে একটা গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে চুরুট টানছিল। বাচ্চারা ধূলো উড়িয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে তার সমন্ধে আলোচনা করে। সে কিন্তু তাদের নীরবে পর্যবেক্ষণ করছে সরু চোখ দিয়ে, মুখের সামনে ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে। কেউ কেউ আবার বলে যে ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও তার জন্য চুপ করে থাকে। সন্ধের সময় পোকারা কখনও তার বাড়ির আশেপাশে গান গায় না। কেবল এসে মুখ উঁচু করে একবার দেখে তারপরেই হলুদ ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। মাছিরাও নিশ্চুপ, কেবল দরজায়, পর্দায় মাথা ঠুকে যাচ্ছে। মুখের আশেপাশে ঘুরে বেড়ালে সে হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। অবশ্য বেশির ভাগ সময় সে চটাস চটাস করে সেগুলোকে মেরে ফেলে। সেগুলো তার পায়ের ওপর দেহ রাখে আর তার বিশাল বপুর পোষা কুকুর সেই অবোধ প্রাণীগুলোর ওপর শুয়ে থাকে। বাচ্চারা দিনে সারাক্ষণ তাকে দেখে এবং রাতে তাকে নিয়ে গল্প বানায়।
মিস্টার জেনসন চুরুট ধূমপান করেন না। ধোঁয়ারা ওড়ে—- রক্ত এবং ধূলো আকাশে মিশে যায়।
মিস্টার জেনসনের কেউ নেই। নিজের স্ত্রী এবং সন্তানদের হত্যা করেছেন। একটি বন্দুক লুকিয়ে রাখেন স্ক্রীন দরজার পেছনে।
জীবনে কখনও প্রার্থনা করেননি মিস্টার জেনসন। ওর কখনও স্বর্গবাস হবে না।
মোটামুটি এই সব কথাই এলাকার বাচ্চারা বলে থাকে।
তারপর তারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে নৈশাহার করে। বাবাদের পুরনো সাইকেলগুলো চালানোর পরে যথাস্থানে রেখে তারপর যদি মিস্টার জেনসন সমন্ধে কোন কথা বলতে যায় তখন সপাটে চড় থাপ্পড় ছাড়া অন্য কিছু জোটে না। মায়েদের মুখগুলো দেখে মনে হয় তখন তারা বুঝি কোন টক ফলে কামড় বসিয়েছে।
খাবার টেবিলটা কোন জায়গা নয় এইসব কথা বলার।
মাংসের টুকরো কাটতে কাটতে তারা মাথা নাড়ে। মুখে রাগের অভিব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ে।
বসে বসে কারুর নামে নিন্দা করার জায়গা এটা নয়। বুঝতে পারছ কি তোমরা!
তারপর মায়েরা, সর্বদা রাগান্বিত বাবাদের দিকে তাকায়। আর বাবাদেরও সর্বদা মায়ের সাথে সহমত পোষণ করতেই হয়, নাহলে বিপদ আসন্ন! অন্যথা হলেই বাসনের ঝনঝনানি, মায়েরা রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করে চিৎকার করতে থাকে। তার সাথে বাড়ির সবাই শোরগোলে মেতে ওঠে। তার চিৎকার চেঁচামেচি হতেই থাকে যতক্ষণ না কেউ কাঁদতে শুরু করে। বেশীর ভাগ সময় সেটা মায়েরাই হয়ে থাকে। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,
তুমি কি কিছুই করবে না? তোমার আসলে কিছু যায় আসে না।
তারপর বাবারা ছুড়ি চামচে টেবিলে নামিয়ে প্লেট ঠেলে উঠে পরে। মহাসমারোহে গলা উঁচু করে বলে ওঠে।
ক্রিস, লুসি, তারা ছোট বাচ্চা! তারা কি করে জানবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল!
বাবারা ধূমপান করতে করতে ভুরু কুঁচকে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। মাঝে মাঝে তাঁদের দেখে মনে হয় তাঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন, কিন্তু তাঁরা জানে মায়েরা কখন ক্ষেপে যাবে। তারপর মায়েরা খেপে উঠলে বাবারা বেশ ভাল করেই হাত সুখ করে নেয় এবং মায়েদের বিরুদ্ধে তেমন নালিশ করে না কারণ তাঁদের ছোটবেলাতে তাঁরাও খাবার টেবিলে বসে নানান অপ্রিয় কথা বললে তাঁরাও বাবাদের হাতে ভালই মার খেয়েছে। ভাবলেই বাবার পিঠ দিয়েও ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায়। বিশেষ করে ওই ঘুমন্ত কুকুরটার কথা ভেবে; যেভাবে টপাটপ মাছিগুলোকে খেত; মুখটা একদিকে কাত করে গোলাপি জিভ ঠোঁটের ওপর ঝুলত শুকনো হাওয়ায়। সপাটে বেত পরার আওয়াজের মত করে খেত আর জনগণ বলত
এই কুকুর একদিন মানুষ খাবে।
জামাকাপড় ছেড়ে শুতে যাবার সময় মায়েরাও একই কথা বলত। বস্ত্রহীন অবস্থায় গোপনে তারা প্রার্থনা করত যেন প্রাণীটি মিস্টার জেসনকে হত্যা করে। কিন্তু তারা বাচ্চাদের জানতে দিতে চায় না কারণ বাচ্চারা আগে থেকেই অনেক বেশি জানে। বাচ্চাদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসে মন দেওয়া উচিত—পড়ার বই পড়বে, ধর্মগ্রন্থ পড়বে এবং নিজেদের প্রার্থনা সঠিক ভাবে জানবে। নগ্ন অবস্থায় বিছানায় মায়েরা এমনটাই ভাবে।
শহরের বাইরে থেকে খবর এল। রবিবারের পাতায় স্থান করে নিল সে খবর আর অভিজাত বাড়িতে পৌঁছল আরো তিন দিন পরে বেড়া ডিঙিয়ে, সবুজ ঘাস পার করে, পাইপ টপকে, একেবারে খাস বসার ঘরে। বাচ্চারা ব্যানারের মত করে সংবাদপত্র ধরে আছে। তারা ঝগড়া করে কে বাবাকে আগে খবরটা দেবে। তারা ঝগড়া করে বাবার কফির কাপের তলায় পরে থাকা কফির চুমুকটা কে নেবে; জিভ দিয়ে শেষ ফেনাটুকু চাটতে থাকে। এদিকে মা রান্না করে আর বাচ্চারা ঝুটঝামেলা করতেই থাকে যতক্ষণ বাবা চান ঘরে আছে ওপরের তলায়। চান ঘরে বসেই বাবা যাবতীয় দিনের পড়া সারে এবং বেরিয়ে মাকে যা যা বলা প্রয়োজন তা সম্বন্ধে অবগত করে। মা আসলে গল্পগুলো শোনার অপেক্ষায় থাকে কিন্তু সে ব্যাপারে মা আশ্চর্য রকমের নীরব। কারুর বাবাই সে ব্যাপারে মুখ খোলে না। আজকের রবিবারের পাতায় অনেক কিছু পড়ার আছে। পড়ার সম্ভার প্রচুর। প্রত্যেকের বাবারই মাথা ধরে যায়। তারা স্ত্রীদের শয্যাকক্ষে ডাকে এবং বাচ্চাদের কথা দেয় যে পরের দিন তাদের কফি পান করাবে যদি তারা এখন খেলতে চলে যায়।
বাচ্চারা খেলতে চলে যায়। তখন প্রায় নিঃশব্দে তারা সেই খবরটি পৌঁছে দেয়।
মিস্টার জেনসন লুইসা গেছেন।
সে এবং তার বৃহদাকার কুকুরটি।
বলা হচ্ছে যে সেখানে তিনি নিজেকে নিজে মেরে ফেলেছেন।
এক অপরাধবোধ কাজ করে স্ত্রীদের মধ্যে। তার করজোড়ে মাথা নীচু করে আর বাচ্চারা বুঝতে পারে আগামী দিনে বাজে কিছু ঘটতে চলেছে। তারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ এমন সব কথা বলে যা তাদের মায়েরা ভীষণভাবে অপছন্দ করে। তারা শুনতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু ভালো করে বুঝতে পারে না। ফলে আরো গল্পের জন্ম নেয়। কেউ কেউ সেই সাইকেল রাখার জায়গায় চলে যায়। অন্ধকারে জং ধরা হাতলে হাতড়ায়, নাক জ্বালা জ্বালা করে তেলের গন্ধে। কোথাও কোন অভিজাত ঘরে মা কাঁদছে, বাবার মাথা ধরেছে রবিবারের খবরের কাগজ পড়ে, বাচ্চারা খেলতে গেছে। কেবল ধূলো বালির বাতাসের ঝাপটায় একটা হিসহিস শব্দ শোনা যায়।
বাচ্চারা টায়ার নিয়ে রাস্তার ওপর খেলতে থাকে। উঁচু নিচু রাস্তায় ধাক্কা খায়। পাখির মত ডাকে, কিচিরমিচির করে। সাইকেলের চেন নিয়ে আওয়াজ করে। একজন বলে সে মিস্টার জেনসনের বাড়ির পেছনে একটা লোককে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে। সে তিন দিন আগে একটা লোককে দেখেছিল বড় একটা বন্দুক নিয়ে এবং একটা কুকুরটাকে শুনেছিল রাত্রে খুব ডাকাডাকি করছিল। তারা বলে,
তুই বাজে বকছিস, তুই তো শহরে ছিলি তিন দিন আগে, মায়ের সাথে নতুন জামাকাপড় কিনতে গেছিলি।
সে জানে যে তারা সত্যি কথা বলছে তাই চুপ করে যায়। কিন্তু এরকম ধরনের কথাই বাচ্চারা বলতেই থাকে। তার বাড়ি পৌছনোর আগেই ফিসফিসানি শুরু হয়ে যায়। তাদের চলার গতি ক্রমে ধীর হয়, তারা কাঁটা গাছের আশেপাশে ওই বৃহদাকার কুকুরের ভূত খুঁজতে থাকে।
কিন্তু সে ঝোপঝাড়ের পেছনে লুকিয়ে আছে। এখনও মাছি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
তুমি দেখতে পাচ্ছ ওটা? ওই যে নড়ছে ওখানে। এখনও মাছির সন্ধানে আছে।
আওয়াজ করো না। সে হয়তো অতর্কিতে বেরিয়ে এসে তোমাকে মেরে দিতে পারে।
চোখ দিয়ে তাদের জল ফেটে বাড়িয়ে আসতে চাইছে। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি তারা কাঁদবে কিন্তু সাহসী বাচ্চারা কাঁদে না। জীবন বাজি রেখেও না।
আমাকে কেউ মারতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ। কেউ না। আমি কোন ভূতকে ভয় পাই না।
তারা গতি তুলে রাস্তা দিয়ে দৌড়তে শুরু করে। তারা হলুদ ঘাসের একটা উঠোনে দাঁড়ায়। ঠিক এই উঠোনটার পেছনে আছে যে বাড়িটা তার সব জানলা বন্ধ। প্রায় কিছুই নেই সেখানে , কেবল গাছের ডাল থেকে ঝুলছে দোলনার সীট। ওই সীট এবং এক শেরিফ যে ঝুঁকে একদম সামনে তাকিয়ে আছে। তারা যদি যথেষ্ট সতর্ক হয়, তাহলে তারা শেরিফের মুখ দেখতে পাবে। তারা মাটিতে নিজেদের মিশিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে। শেরিফ তখন খুব বকবক করছেন। তাঁর মাথাটা দরজার থেকে একটু বাঁদিকে হেলে গেছে। তারা বুঝতে পারছে ভেতরে কেউ আছে। অনেক কথা দরজার আড়াল থেকে ভেসে আসছে এবং সেখানে অন্য একটি লোক আছে ধূমপান করছে। গন্ধে বাচ্চাদের দম বন্ধ হয়ে আসে।
লোকটা অনেকটা মাকড়সার মতন। বড় মাথা আর সরু সরু হাত। সিগারেট ধরা দুই আঙুলের ফাঁকে।
কুঁজোর সাথে লড়াই হত আর কি! একটা ভয়াবহ লড়াই! কিন্তু ভাবার বিষয়, কী এমনটা হল যা এটা করতে বাধ্য করল! ভগবানের দোহাই, কি সাংঘাতিক কাজ!
বাচ্চারা হাঁটু গেড়ে বসে একে অপরের ওপর ঠেলে লাফালাফি করছে। বাতাস ঘন হয়ে আসছে ঝগড়া এবং অপমানের ভাষায়। ছায়া – মানুষটির মুখের ঝুলন্ত সিগারেট থেকে ছাই ফেলছে সামনের দুটি দাঁতের ফাঁক দিয়ে। সে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করতে থাকে আর যাবতীয় সব কথাবার্তা শেরিফই করতে থাকেন।
পাণ্ডববর্জিত স্থান। বড় উঠোন। ছোট্ট ঘর। আর সেই বৃহদাকার কুকুর। আর কোন প্রাণী নেই। সত্যিই দুঃখজনক তাই না! তোমার এটা দুঃখজনক মনে হয় না, জেমস?
শেরিফকে অনেকটা মায়ের মত লাগে কারণ তিনি প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না। দরজার ফাঁক দিয়ে জেমস খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করছে। সে গোড়ালির নীচে সিগারেটটা পিষে দেয়। শেরিফের থেকে সে রোগা। বরফের মত ঠাণ্ডা মুখ। সোজা চোয়াল, ইস্পাতের মত তীক্ষ্ণ চোখ, কোণে আটকে থাকা ইঁদুরের মত দাঁত। সূর্যাস্তের সময় সেই দাঁত ঝলসে উঠত। বাচ্চারা এখনও শ্বাস ধরে আছে। তারা অপেক্ষা করছে কখন কুকুরটা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পরে কালো মেঘের মধ্যে মিশিয়ে দেবে। তারা হাড়ের ছড়ি নিয়ে মিস্টার জেনসনের জন্য অপেক্ষা করছে। যে কোন সময় সে এবার গাছ দোলনায় নিজের স্থান গ্রহণ করবে। সে এবার ধূমপান করবে এবং সোজা তাকাবে এবং শেরিফকে চিৎকার করতে করতে তাঁর মায়ের কাছে পাঠাবে। অদূরে এক কোণায় বাচ্চারা চুপ করে বসে থাকে। মাটিতে থাকার জন্য তাদের চামড়ায় দাগ হয়ে যায়। তারা কনুইয়ে ভর দিয়ে ফিসফিস করতে থাকে।
যে কোন মুহূর্তে এখন……একটু অপেক্ষা কর।
মিস্টার জেনসন লুকিয়ে আছে। অন্ধকারে অপেক্ষা করছে……
মিস্টার জেনসন এবং তার বৃহদাকার কুকুর।
নৈঃশব্দে, নীরবতায় আচ্ছাদিত চারিদিক। কিন্তু মিস্টার জেনসনের কোন পাত্তা নেই। কোন পায়ের ধ্বনি শোনা যায় না। কুকুরের কোন অলস মৃদু ডাকও কানে আসে না। শুধু একটি প্রাচীন চাবি ঘোরানোর শব্দ। এবং শেরিফ এখনও থুতনির চামড়া টেনে টেনে বের করে কথা বলেই যাচ্ছে। বলেই যাচ্ছে। সে অনেকগুলো সাইকেলের পাশ দিয়ে এখন যাচ্ছে ঠিক সাপের মত এঁকেবেঁকে। সিটের ওপর মরচে পড়েছে, প্যাডেলগুলোতেও; কিন্তু তাতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। ধূলোমাখা রাস্তা দিয়ে যখন লোকেরা নামছে বাচ্চারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। সূর্যাস্তের সময় তারা শরীর প্রসারিত করে টেনে টেনে নামছে। ইতিমধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকাদের তান শুরু হয়ে গেছে। তারা আজ খুব জোরে ডাকছে মিস্টার জেনসনের বাড়িতে। এতই জোরে যে বাচ্চাদের মাথা ধরে যাচ্ছে। একটা- দুটো মাছি তাঁদের শরীরে বসে, আর একটু পরপর নড়েচড়ে বসছে। দু একটা বাচ্চা হাঁসফাঁস করছে। অনেকক্ষণ ধরে ধরে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ছে। তারা সন্ধ্যা থেকে অন্ধকার পর্যন্ত মিস্টার জেনসনের জন্য অপেক্ষা করছে। আর রাত হচ্ছে তাদের অভিজাত বাড়িতে গল্পের সময়। টেবিলে ঝামেলার সময়। দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁপতে কাঁপতে উঠে পড়ার সময়। কিন্তু আজ রাতে আর কারুর চোখে ঘুম নেই।
কেউ চিৎকার করে ওঠে, আমি বাড়ি যেতে চাই।
কিন্তু সাইকেলগুলো খুঁজে বের করবার জন্য আর কোন আলো নেই।
কেউ একজন তিরস্কার করে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলে উঠল, যা, দূর হ এখান থেকে, আমাকে পিষে দিচ্ছিস।
ঘাসের ভেতর দিয়ে একটা অদ্ভুর আওয়াজ ভেসে ওঠে। কেউ বলতে পারে না সেটা নিঃশ্বাস নাকি বাতাস। অবশেষে কেউ একজন নীরবতা ভাঙে।
লোকটা বলছে যে সে চলে গেছে। চলে গেলে তো সব ফাঁকা।
এইটা সেই একই ছেলে যে এখনও মায়ের সাথে শহরে যায়। একা যেতে ভরসা পায় না। এইটা যদি রাতের সময় না হত কেউ তার কথায় কান দিত না। আসলে অন্ধকার শিশুদেরকেও চিন্তান্বিত করে তোলে। তারা তার চারিদিকে একত্রিত হয় বড় বড় চোখ আর ফ্যাকাসে মুখে।
যদি ফাঁকা হয়, তাহলে আমরা ভেতরে যেতে পারি। ওর ভূতের সন্ধান করতে পারি। আসল ভূতের। আর দরজার পেছনে তাকাও………যেখানে সে বন্দুকটা রাখত…।
তারা দৌড়াতে শুরু করে। ছুটে তারা মাছির চেয়েও চুপিসারে ঘরের ভেতরে ঢোকে। আকাশের ওই আধখানা চাঁদকে সম্বল করে তারা সারা বাড়িটা ঘোরে। তাদের খুদে খুদে হাত ঘরের প্রতিটা কোণা হাতড়ে বেড়ায়। সূর্যোদয় হতে হতে তারা সকলে ঘুমিয়ে পড়ে এর ঘাড়ে ওর মাথা গুঁজে। সকালে ঘুম ভাঙলে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় যে মিস্টার জেনসন চিরকালের মত চলে গেছে। এবং তারা নিশ্চয়ই সঠিক কথাই বলেছিল কারণ সে আর ফিরে আসেনি।
কেউ তাকে নিয়ে আর কথা বলে না। না বাবারা, না মায়েরা, না বাচ্চারা। ব্যাপারটা হচ্ছে, সবসময়ই অন্য কেউ থাকে যার জন্য আবার গল্প বানানো যাবে। সবসময়ই অন্য কেউ একটা রয়েছে দূরদেশে কোন কারণের জন্য। মিস্টার জেনসন ব্যতীত, ঘটনা প্রায় একই থাকে। মায়েরা অন্য লোকেদের জন্য প্রার্থনা করে, বাবারা এখনও রবিবারের সংবাদপত্র খুঁটিয়ে পড়ে। এখনও রবিবারের কফির কাপের তলায় কফি পড়ে থাকে আর পুরুষেরা এখনও স্ত্রীদের কথা না শুনে ধূমপান করতেই থাকে। কিন্তু লোকেরা জানে যে জিনিসগুলো এভাবে পরিণতি নেবার কথা ছিল না। কারণ কেউ ঘুণাক্ষরেও কোন বন্দুক, কোন অশরীরি বা বৃহদাকার কুকুরের ছায়াটারও সন্ধান পায়নি। কেউ না—এমনকি স্থূলাকার শেরিফও কিছু খুঁজে পায়নি।
কেউ কেউ বলে যে সে মারা যাওয়ার ঠিক আগে তার বন্দুক লুকিয়ে রেখেছিল, এবং এটি এমন এক জায়গায় যেখানে কেউ কখনও দেখার কথা ভাবেনি। কেউ কেউ বলে যে সে কুকুরটাকে গাছের ওখানে ছেড়ে দিয়েছিল এবং গ্রীষ্মে ঝড়ের দাপটের সময় তার মাছি তাড়ানোর আওয়াজ বিলক্ষণ শোনা যায়। কারুর মতে তাকে তার নিজের উঠোনে কবর দেওয়া হয়েছে যেখানে সে তার স্ত্রী এবং নিজের সন্তানদের কবর দিয়েছিল। অন্যরা বলে সে একজন প্রাচীন মানুষ, দুঃখী এবং একাকী এবং শোকে আচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে সে তাদের নিজেদের দোষে চলে গেছে। মা, বাবা এবং বাচ্চারা শহরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকে।
ধীরে ধীরে বাচ্চাদের ব্যাপারটা বোধগম্য হতে শুরু করে। কেউ না জিজ্ঞেস করলে তারা নিজে থেকে কখনও বিষয়টি উত্থাপন করে না। আর কেউ জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দেয়,
মিস্টার জেনসন সবসময় শহরের বাইরেই থাকতেন।
বাবামায়েরা কফির কাপ রেখে দেয়। মহিলারা রান্না থামিয়ে বুকের কাছে হাত জড়ো করে। বাচ্চারা অনর্গল বলে চলে, সে সবসময় অনেক দূরে থাকত। দূরে থাকত বিশেষ কারণের জন্য।
তারা কাঁটাচামচ দিয়ে টুকটুক করে নৈশাহার করে। ঠোঁট চিপে গভীর চিন্তা করে। কেউ জানে না এটা টেবিলে বাজে কথা বলে গণ্য করা হবে কিনা। মায়েরা তাদের আর কিছু বলে না আর বাবাদেরও থাপ্পড় মারার কোন প্রয়োজন পড়ে না।
সর্বোপরি, সবাই জানে……
তারা থেমে যায়, নিজেরাই অনিশ্চিত। তারপর বাচ্চারা বলে সবচেয়ে নিরাপদ কথা যা তারা ভাবতে পারে, সে সেখানেই থাকত যেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। গোলাগুলি চলত আর যাবতীয় রহস্যময় ব্যাপাস্যাপার ঘটত।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন