onubad-nagor

নাগর
মূল রচনা – পার্ল এস বাক্ (Pearl S. Buck) গল্পের নাম “The Old Demon”
অনুবাদ – যূথিকা আচার্য্য


লেখক পরিচিতি – লেখিকা পার্ল এস বাক্, জন্ম ২৬শে জুন, ১৮৯২, এবং মৃত্যু ৬ই মার্চ, ১৯৭৩ সালে। মিশনারি দম্পতি-দুহিতা পার্লের জন্ম আমেরিকার মাটিতে কিন্তু তিনি বড় হয়েছিলেন চীনে। বলা হয় যে পার্ল তাঁর মাতৃভাষা ইংরেজি শেখার আগেই ম্যান্দারিন রপ্ত করে ফেলেন এবং অতি অল্প বয়সেই তাঁর চীনে বন্ধুবান্ধবদের থেকে ভালো ম্যান্দারিন বলতে ও লিখতে শুরু করেন। আমেরিকার এই মেয়েটির সঙ্গে চীন দেশটির সম্পর্ক ছিল এতটাই গভীর। প্রায় সত্তরটি বইয়ের রচয়িতা পার্ল তার লেখা “The Good Earth” উপন্যাসটির জন্য ১৯৩৫ সালে পুলিৎজার এবং ১৯৩৮ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিতা হন।


“যুদ্ধ যুদ্ধ বলছে বটে লোকে। কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি যে এই রাক্ষুসে নদীর মতো বদ জিনিস পৃথিবীতে খুব কমই আছে।” সদ্য বোনা বাঁশের টুকরিটা নাতি শাও-ঝুর হাতে দিয়ে কথাটা বলল বুড়ি ওয়াং।

যার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা সেই ছোকরা, অর্থাৎ বুড়ির ছোট নাতি শাও-ঝু কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “আহ বুড়ি, ছাড় না এসব কথা এখন। কোথায় না কোথায় কী শুনেছিস, সেসব কথায় কান দিচ্ছিস কেন?”

বুড়ি সে কোথায় কান না দিয়ে গজগজিয়ে বলল “যুদ্ধ না ছাই! যত্তসব আলসে ছেলেপুলে আর তাদের বাজে গল্প। মানুষের কাজ নেই তাই…”

গ্রীষ্মের দিনগুলো বেশ বড়। তাই গাঁ-ঘরের মানুষ সারাদিনের কাজকর্ম শেষ করে খুদকুঁড়ো আর কচু-কুমড়ো যা জোটে দুটো সেদ্ধ করে খায়। তারপর ভরা পেটে সন্ধের মুখে ভিড় জমায় নদীর বাঁধের উপর। হোয়াংহো নদীর ওপার থেকে ভেসে আসা ভেজা বাতাস তাদের রোদে পোড়া চামড়ায় আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়। বুড়ি ওয়াং এই গাঁয়ের সবচাইতে পুরোনো বাসিন্দা। কাজেই সব ব্যাপারে তার মতামতের গুরুত্ব দেয় লোক। তবে আজকে যুদ্ধ নিয়ে কথা শুরু হতেই বুড়ির মাথা বিগড়েছে। এদিকে আসল কথা হল এই যে বুড়ি পড়েছে ফাঁপরে। গ্রামের অন্যান্য লোকেদের মতো যুদ্ধ সম্পর্কে তারও ধারণা ভাসা ভাসা। মানে যুদ্ধ যে একটা মোটের উপর খারাপ ব্যাপার, এ ব্যাপারে বুড়ি নিশ্চিত। চীন জাপানের যুদ্ধে হারামজাদা জাপানিগুলো চীনের নিরীহ লোকজনকে খামোখা কচুকাটা করছে। একথা সে শুনেছে। তবুও তার চেনাজানা সবকটা মানুষ বহাল তবিয়তে আছে বলে সে ধরেই নিয়েছিল যে যুদ্ধটুদ্ধ সব বাজে কথা। শুধু বোকা, অলস লোকজন, যাদের কোনো কাজ কারবার নেই তারাই ওসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে। কাজেই যুদ্ধ-এরোপ্লেন আর জাপানিদের নিয়ে গাঁয়ের লোকের মাতামাতি দেখে বুড়ি ভারী বিরক্ত হয়েছিল।

বুড়ির ছোট নাতি শাও-ঝু-র কথা তো আগেই বলেছি। সে বেচারা গাঁয়ের পাঠশালায় কয়েক কেলাস অবধি পড়াশোনা করেছে। সেই সুবাদে বুঝতে শিখেছে যে বুড়ির বলা সব কথা মোটেই ঠিক না। কিন্তু পিতামহীর সামনে দাঁড়িয়ে সেকথা বলবে তেমন বেয়াদবিও সম্ভব নয়। কাজেই যুদ্ধ সম্পর্কে তার পিতামহীর মতামত শুনে সে কথা কাটানোর জন্য বলল, “ওসব কথা ছাড়, আসল কথাটা বল এবার। তুই কখনো কোনো জাপানিকে দেখেছিস?”

শাও-ঝুর কথা শুনে বাঁধের উপর বসে থাকা গ্রামের অন্যান্য লোকজনও নড়েচড়ে বসলো। বুড়ি ওয়াং-এর সব কথা গাঁয়ের লোক একবাক্যে মানে। দেখ ভাই, সোজা কথা, যার বয়স যত বেশি, তার দেখা, শোনা আর শেখার অভিজ্ঞতাও ততটাই বেশি হবে। বুড়ি গ্রামের সবচাইতে পুরোনো মানুষ। কাজেই সে জানে শোনে অনেক বেশি। আর সবচাইতে বড় ব্যাপার হল এই যে আপদে বিপদে বুড়ি তাদের মায়ের মতো আগলে রাখে। কাজেই বুড়ি ওয়াঙের সব কথা তারা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে। শাও-ঝু জাপানিদের প্রসঙ্গ তুলতেই তাই সবাই প্রায় একসঙ্গে তাকালো বুড়ির দিকে। ওয়াং বুড়ি তার ছেঁড়া চটের গদি মোড়ানো বাঁশের মোড়াতে একবার নড়েচড়ে বসে বলল, “জাপানি কিনা জানি না, তবে একবার দেখেছিলাম একটা বিদেশীকে। লোকটা মাথায় ছিল আমার বাড়ির চালের থেকেও উঁচু। চুলগুলোর রং ছিল বালির মতো। চোখদুটো মাছের চোখের মতো ধূসর। মোদ্দা কথা হল জাপানি বলো বা অন্য কোনো বিদেশী, ওরা হল পাক্কা শয়তান। ওদের একবার দেখলেই চিনবি।”

সেকথা শুনে শাও-ঝু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু তুমি যে বলো হলদে নদীটাই সবচেয়ে বড় শয়তান। তাহলে জাপানিরা কি নদীর থেকেও বেশি…” নাতির কথা শেষ হওয়ার আগেই বুড়ি তার নাতির পিঠে একটা থাবড়া মেরে বলল, “চুপ কর হতভাগা! নদীর পাশে দাঁড়িয়ে নদীঠাকুরের নিন্দা করিস! তোর কী প্রাণের ভয় নেই রে হতচ্ছাড়া ?” বুড়ির থেকে একটু দূরে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে থেকে একজন চেঁচিয়ে বলল, “কিন্তু বুড়িমা, জাপানিদের আমরা দেখব কি করে, ওরা তো শুনেছি আকাশে এরোপ্লেন চড়ে ঘুরে বেড়ায় আর ঠাঁই ঠাঁই করে শুধু মানুষ মারে?”

বুড়ি প্রায় বলতেই যাচ্ছিল যে, এই হচ্ছে তোদের আরেক দোষ বুঝলি। যেখানে যা শুনিস, বোকার মতো বিশ্বাস করে বসিস। এরোপ্লেন বলে কী সত্যিই কিছু আছে নাকি? লোহার পাখি। সে নাকি পেটের ভেতর মানুষ নিয়ে আকাশে ওড়ে! তাই কখনো হয়! এইসব আজগুবি গপ্পো শুনে তোরা বিশ্বাস করিস কেমন করে বল দিকি? এরোপ্লেন ব্যাপারটা আমি নিজের চোখে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করবো না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজের জিভ কামড়ে চুপ করে বসে রইলো সে। ইদানিং বুড়ি ওয়াং ঠাওর করে দেখেছে যে তার জানাশোনার বাইরেও এমন অনেক কিছু ঘটছে যার কথা সে ভাবতেই পারে না। এই যেমন ধর দেশের রাণীমা যে স্বর্গযাত্রা করেছেন সে কথাটা বুড়ি বহুবার শুনেও বিশ্বাস করেনি। অমন সোনার পিতিমের মতো মহারাণী, সাত মহলা প্রাসাদ ভরা যার দাসদাসী। সোনা-হীরে-জহরতে মুড়ে থাকেন সবসময়। তিনি অমনি এককথায় মরে গেছেন সে কথা বিশ্বাস করতে বুড়ির সময় লেগেছে প্রায় কয়েক বছর। তারপর এই যে মনে কর আজকাল গণতন্ত্র নামের কী একটা রগড়ের জিনিস নিয়ে লোকজন কেমন বাঁদরনাচ নাচছে। অথচ কেউই ঠিক জানে না যে গণতন্ত্র ব্যাপারটা কী, আর ওয়াং গ্রামের সঙ্গেই বা তার সম্পর্কই বা কী? বুড়ি তার চারপাশে দেখেছে যে চাঁদ, সুয্যি,হলদে নদী, ধানের ক্ষেত, গোয়ালের গরু, কোলের বাচ্চা সবই যেমন ছিল তেমনি আছে। তাহলে গণতন্ত্র নামের জিনিসটা আছে কী নেই তাতে কার কী এল গেল। কিন্তু এসব কথা বলে লাভ নেই। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলো বুঝবে না কিছুই, তার উপর আবার উল্টে হাসবে সবাই দাঁত বের করে। বুড়ি তাই ওসব ব্যাপারে কোনো কথা না বলে নীচু গলায় বললো, জাপানী টাপানি জানি না বাপু, আমি খালি জানি যে আমাদের এই বুড়ো নদী ঠিক থাকলেই আমরা ঠিক থাকবো। তারপর সে পাশে বসে থাকা নাতিকে বলল, “চুপ করে বসে না থেকে তুই একটা গান শোনা তো দেখি?”

শাও-ঝু দু-একবার কেশে গলা পরিস্কার করে, কাঁপা কাঁপা সুরে গাইতে শুরু করলো কৃষকদের বাড়ি ফেরার গান। বুড়ি সেই গান শুনতে শুনতে চোখ বুজে ভাবছিল তার নিজের যৌবনকালের কথা। সেই সতেরো বছর বয়সে বিয়ে করে বরের হাত ধরে এসেছিল সে এই গাঁয়ে। গ্রামের লোকজন প্রথমবার যখন দেখেছিল তাকে, নারী-পুরুষ সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছিল যে চাষির পো ওয়াং কপাল করেছে বটে। নইলে চাষার ঘরে এমন সুন্দরী বৌ জুটলো কি করে। বুড়ির মরদ ওয়াং অবশ্য ঠোঁট উল্টে বলেছিল, “পায়ের পাতা দুটো বড্ড বড়। পদ্মচরণ নয়। কিন্তু ওসব ছিল কথার কথা। নেহাত বলতে হয় তাই বলা। নইলে সেই লোকটার মনেও রস কিছু কম ছিল না। মানুষটা বড় অল্প বয়সে চলে গেছিল। বুড়ির তখন জোয়ান বয়স। তার বড় বাচ্চাটা তখন কোলে। পেটেরটা পাঁচ মাসের। বাচ্চাটার হাত ধরে সে কোনোরকমে হাঁচড়েপাচড়ে উঠতে পেরেছিল বাড়ির চালে। ঘরের লোকটা পারেনি। হড়কা বানে ভেসে গেছিল খড়কুটোর মতো। তাদের বাড়ির চালে বসে শূন্য চোখে দেখেছিল বুড়ি সে দৃশ্য। মানুষটা অপঘাতে মরে নরকবাস করছে। এই যন্তন্নায় বুড়ি রাতের পর রাত কেঁদে কাটিয়েছে। তারপর যখন তার ছেলে বড় হল। তখন বুড়ির হাতে একটু টাকাপয়সা জমলে প্রত্যেক বছর মন্দিরে নগদ পয়সা জমা দিয়ে একটু একটু করে নরক থেকে মানুষটাকে বের করেছে সে। শেষের দিকে অবশ্য বুড়ি বিরক্ত হয়ে গেছিল। পুরো সংসারের দায়িত্ব, সবার খাওয়া-পরা, জমির চাষাবাদ সবকিছু সামলানোর পর নরকবাসের মেয়াদ কমানোর জন্য পয়সা কম পড়তো বারবার।

মন্দিরের পুরুত দেখা হলেই হেসে বলতো, “এইতো হয়ে এল। তোর সোয়ামীর শুধু ডান হাতটুকুই আটকে আছে নরকে। আর মাত্র দশটা রুপোর টাকা পেলেই নরকবাস থেকে মুক্তি।”

বুড়ি বলতো, “বাকি শরীরটা বেরিয়েছে তো?”

“হ্যাঁ, তা বেরিয়েছে।”

সেকথা শুনে বুড়ি জবাব দিত, “তাহলেই হবে। শরীর যখন বেরিয়েছে তখন হাতটা ও নিজেই টেনে বের করে নেবে।”

সেদিন রাত্রিবেলা নাতবৌ এসে মশারি টাঙিয়ে, বিছানা তৈরি করে দেওয়ার পর বুড়ি তার বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ভাবলো, জাপানীগুলো কী এতই খারাপ! ওরাও তো মানুষ। ওদেরও ঘরে বৌ-বাচ্চা-মা-বাবা আছে। এই লোকগুলোর হাতে এক পেয়ালা চা দিয়ে, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে যদি বলা যায় যে বাছারা এমন কেন করছিস, থাক না বাবা নিজের বাড়িতে। চাষবাস কর। বাচ্চাদের হাত ধরে, কাঁধে চড়িয়ে মেলায় ঘোরাতে নিয়ে যা। বৌকে আদরসোহাগ কর। খামোখা এইসব ঝগড়া-বিবাদ করছিস কেন! স্বপ্নেও বোধহয় বুড়ি জাপানিদের চা খাওয়াচ্ছিল। কেননা রাত্রি একটা নাগাদ তার নাতবৌ এসে যখন চেঁচিয়ে বলল, “ঠাকুমা ওঠো, পালাও! ওরা এসে গেছে। গাঁয়ের উপর বোমা পড়লো বলে…ওঠো, ওঠো তাড়াতাড়ি। তখন বুড়ি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বারবার বলছিল “চায়ের কেটলিটা কোথায়, ওদের আরেকটু চা দে, ও নাতবৌ একটু এগিয়ে দে মা আমার…”

শাও-ঝুর বৌ সেসব কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, “চায়ের কেটলি খোঁজার সময় এখন নেই ঠাকমা, উঠে দৌড়াও। সবাই জঙ্গলে চলে গেছে… এস তাড়াতাড়ি…”

বুড়ির হাতপা কাঁপছিল উত্তেজনায়। সে কোনোরকমে মশারি থেকে মাথাটুকু বের করে বলল, “ও নাতবৌ, কাদের কথা বলছিস রে? কারা এসেছে? কোথায়?”

নাতবৌ তাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে, বিছানা থেকে হিচড়ে টেনে বের করে রুদ্ধশ্বাসে বললো, “জাপানিরা …আকাশে এরোপ্লেন নিয়ে চক্কর কাটছে গোল গোল…তাড়াতাড়ি চলো…সময় নেই…”

বুড়ি আর তার নাতবৌ তাদের কুঁড়ের বাইরে বেরিয়ে দেখলো চারপাশের চেহারাছবি সব বদলে গেছে। থেকে থেকে জঙ্গলের দিক থেকে মানুষের চিৎকারের আওয়াজ আসছে। আকাশে ক্ষয়াটে, ভাঙা চাঁদের আলোয় এরোপ্লেনগুলো দেখাচ্ছিল আকাশে উড়তে থাকা বুনো হাঁসের মতো। বুড়ি তার চোখদুটো সরু করে সেদিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো আহ্লাদি মুখে বলল, “ওমা! ও নাতবৌ! দেখছিস। এই হল তবে এরোপ্লেন! এ যে দেখি সত্যিই পাখির মতো ডানা মেলে উড়ছে রে…”

নাতবৌ সেদিকে না তাকিয়ে বুড়ির হাত ধরে টানতে টানতে বলল, “এরোপ্লেন পরে দেখো। এখন পালাতে হবে…তাড়াতাড়ি এস…”

বুড়ি নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেই কোন ছোট্ট বয়সে দৌড়োতাম দিদিভাই। পা বাঁধার পর আর দৌড়োইনি। তার উপর এই বুড়ো বয়স। ও আমার দ্বারা হবে না বাপু। তুই যা। পালা।”

বৌটিও জেদি মেয়ে। সে বেঁকে বসলো। বুড়ি না গেলে সেও যাবে না। বুড়ি সেকথা শুনে তাড়াতাড়ি ঘরের দাওয়ার নীচে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে এসে বলল, “শাও-ঝু কোথায়?”

বৌ বলল, “জঙ্গলে। অন্যদের সঙ্গে পালিয়েছে।”

বুড়ি বিড়বিড়িয়ে বলল, “যেমন দাদু, তার তেমন নাতি। পোয়াতি বৌকে ফেলে পালিয়েছে!”

বুড়ির নাতবৌটিও সাতমাসের ভরা পেট নিয়ে বুড়ির পাশে বসার চেষ্টা করছিল। বুড়ি তাকে সাবধানে ঠেলে উঠিয়ে দিয়ে বলল, “না, দিদিভাই। বসিস না। জঙ্গলে যা। লুকিয়ে থাক। কাল সকালে এসব ঝামেলা মিটলে তবেই বেরোবি আড়াল থেকে…”

“কিন্তু ঠাকমা তুমি!”

বুড়ি এবার করুণ গলায় বলল, “দেখছিসি তো সব কান্ডকারখানা এখানে। যা অবস্থা পুরুষগুলো একটাও বাঁচবে কিনা সন্দেহ। শাও-ঝুকে বাঁচাতে পারবো কিনা জানি না। তবে তুই বাঁচলে অন্তত ওর বাচ্চাটা বেঁচে থাকবে। তাই নিজের জন্য না হোক, বাচ্চাটার কথা ভেবেই পালা। আমার জন্য ভাবিস না। অনেক বয়স হয়েছে। আজ আছি তো কাল নেই…যা যা দেরি করিস না। পালা।”

বুড়ির কথা শেষ না হতেই রুপোর তৈরি ডিমের মতো আকাশ থেকে কী সব পড়তে শুরু করলো। প্রথম ডিমটা পড়লো গাঁয়ের দক্ষিণ সীমানায়। আশেপাশের গাছপালা সব কিছু পুড়ে গিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। তারপর এক এক করে আরো ডিম পড়তে লাগলো আশেপাশে।

মেয়েটি সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, “হে ভগবান, কাল অবধি সব টিকলে হয়!” তারপর বুড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সে বলল, “ঠাকমা…”

বুড়ি এবার কড়া গলায় বলল, “নাতবৌ যা বলছি কর! বড় আস্পদ্দা হয়েছে তোর! আমার মুখের উপর কথা বলিস! যা পালা…”

মেয়েটা বাধ্য হয়ে ভারী শরীর নিয়ে, টলোমলো পায়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দৌড়োতে শুরু করলো জঙ্গলের দিকে। গ্রামের অন্যান্য লোকজন যেখানে লুকিয়ে আছে।

নাতবৌ-এর দৌড়োতে থাকা অবয়বটির দিকে তাকিয়ে বুড়ি এক নিঃশ্বাসে মন্ত্রের মতো জপ করছিল, “ঠাকুর দেখো, মেয়েটার যেন কোনো বিপদ না হয়… নিরাপদে যেন ঠিক জায়গায় পৌঁছতে পারে।”

শাও-ঝুর বৌ চলে যাওয়ার পর বুড়ি একটু স্বস্তির শ্বাস ফেললো। সত্যি কথা বলতে কি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কৌতুক বোধ করছিল সে। ছোট বাচ্চারা যেমন আসন্ন বিপদের সামনেও দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে সব দেখে, এও ঠিক তেমনি। যুদ্ধ নিয়ে এতকথা এতদিন লোকের মুখে শুনেছে বুড়ি। আজকে সেই যুদ্ধ হচ্ছে ঠিক তার চোখের সামনে। তার চেনা বাঁধের পাশে। নিজের বাড়ির উঠোনে বসে রুপোর ডিম পাড়া এরোপ্লেন সে দেখতে পাবে এমন তামাশার কথা বুড়ি জন্মেও ভাবেনি। বয়স হয়েছে, বুড়ো হয়েছে; আজ বাদে কাল মরণ তো হবেই। মরার আগে বরং এমন একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে মরতে পারলে তার মরণ সার্থক। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে সবার ঘরবাড়ি ভেঙেছে। চাষের ফসল গেছে। কিন্তু সেতো প্রত্যেক দু-তিনবছর পরপরই হয়। হলদে নদীর রাক্ষুসে বন্যায় বাড়িঘর জলাজমি সব ভেসে যায় তাদের। গ্রামের সবাই গরীব দুঃখী কিষাণ। বাঁশ, খড় আর কাদা মাটি দিয়ে তৈরি বাড়ি তাদের। বাড়ি না বলে ঝুপড়ি বলাই ভালো। খাবারদাবার আর দু’চারটে ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়জামা ছাড়া ঘরে আর নেই তেমন কিছু। কাজেই ঘরবাড়ি ভেঙে গেলেও আবার গড়ে নেওয়া যায় চটপট। ও অমন কিছু মস্ত বড় ব্যাপার নয়। মরতে যখন হবেই তখন এমন একটা খাসা জিনিস দেখে মরাই ভালো। বুড়ি ওয়াং বোধহয় নিজেকেই শুনিয়ে জোরে জোরে বলল কথাগুলো। তারপর গায়ের চাদরটাকে ভালো করে টেনে সারা গায়ে জড়িয়ে, বাঁধের পাশে একটা মাটির ঢিপিতে হেলান দিয়ে বেশ আয়েস করে বসলো। এখান থেকে সবকিছু আরো ভালো করে দেখতে পাওয়া যাবে।

সারারাত বুনো হাঁসের মতো আকাশে ওড়াউড়ি করলো এরোপ্লেনগুলো। রুপোর ডিম ফেললো এখানে সেখানে। ভোরের ঠিক একটু আগে বুড়ি অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে পশ্চিম আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অন্যরকম দেখতে কতগুলো এরোপ্লেন এসে আক্রমণ করলো আগেরগুলোকে।

বুড়ি অবাক চোখে দেখল সেসব। ভোরের ঠিক আগমুহূর্ত অবধি নতুন আর পুরোনো এরোপ্লেনগুলোর মধ্যে এমনি মারামারি আর কামড়াকামড়ি চলল, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই এরোপ্লেনগুলো যে যেখান থেকে এসেছিল সেদিকে ফিরে যেতে শুরু করলো। বুড়ি বুঝলো যুদ্ধ শেষ। সে এমনি আবার খুটখুট করে পায়ে পায়ে রওনা দিল গাঁয়ের দিকে। বাড়িঘর কিছুই তেমন ছিল না। এখানে ওখানে কয়েকটা ভাঙা মাটির দেয়াল, পোড়া বাড়ির চাল, ভাঙাচোরা মাটির বাসন এইটুকুই ছিল পড়ে। কিন্তু বুড়ি সেসবের দিকে দেখেও দেখল না। সে তখন যুদ্ধ দেখেছে এই আনন্দেই মশগুল। ওহ্, এই তাহলে যুদ্ধ। এই নিয়েই এত হুরুমঝুড়ুম! এ তো গাঁয়ে ডাকাত পড়ার মতোই। খালি এই পাখির মতো জিনিসগুলোই নতুন যা দেখলাম। একটাকে যদি কাছ থেকে দেখতে পেতাম তবে মন্দ হত না. ইচ্ছেপূরণ ঠাকরুন বোধহয় কাছাকাছিই ছিলেন। তিনি বুড়ির কথা শুনেই বোধহয় বললেন “তথাস্তু”। কারণ গাঁয়ের ঢোকার মুখেই বুড়ি দেখল যে তার বাড়ির পশ্চিমের জমিটাতে, যেখানে শাও-ঝু কদিন আগেই সয়াবিনের নতুন চারা বুনেছিল, ঠিক সেখানে গোঁ গোঁ করে গোত্তা খেতে খেতে একটা জাপানি এরোপ্লেন এসে পড়লো।

কান ফাটানো আওয়াজ শুনে বুড়ি প্রথমে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল। সয়াবিনের নতুন লকলকে চারাগুলোর কথা ভেবে বুকটা মুচড়ে উঠল একবার। কিন্তু পরক্ষনেই মনস্থির করে সে লাঠির উপরে ভর দিয়ে পা বাড়ালো জমির দিকে। চোখের সামনে এমন একটা আজব জিনিস পাঠিয়েছেন ঠাকুর। একবার ঠাওর করে দেখবো না! ভাবলো বুড়ি।

গাঁয়ের কুকুরগুলোও বলিহারি। সারা রাত সেগুলো ভয়ে ল্যাজ গুটিয়ে পড়েছিল এদিক সেদিক ঝোপেঝাড়ে। ভোরবেলা বুড়িকে আসতে দেখে সেগুলো বুকে সাহস পেয়ে বুড়ির পিছু নিল। বুড়ি একবার ভাবলো ওগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। পরের মুহূর্তেই তার বড় মায়া হল। আহা, অবোলা জীব। সারারাত ভয়ে কেঁদেছে। থাক থাক, সঙ্গে আসছে, আসুক।

তবে সয়াবিন ক্ষেতের কাছাকাছি যেতেই সারমেয়বাহিনীর চীৎকারে কানপাতা দায় হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে হাতের লাঠিটা উঁচিয়ে বুড়ি মারের ভঙ্গি করতেই অবশ্য তারা আবার চুপ করল, তবে সন্দেহের বশে চাপা গলায় গরররর শব্দ করে নিজেদের আপত্তি করাটা বন্ধ করলো না কিছুতেই। রেগে এবার বুড়ি সবচাইতে কাছে যে কুকুরটা ছিল তার পাঁজরে মারলো একটা খোঁচা। “আহ্, চুপ করতে বললুম যে তোদের! কানে যায় না কথা! পিটিয়ে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব দেখবি?”

কুকুররা কী বুঝলো কে জানে, তবে বুড়ির বিক্রম দেখেই বোধহয় তারা বুঝতে পারলো যে ভয় পাওয়ার কিছু দরকার নেই। তেমন কিছু দরকার হলে বুড়ি একাই দেখে নেবে। অতএব তারা নিশ্চিন্তে ল্যাজ দুলিয়ে বুড়ির কাছাকাছি গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।

ওয়াং বুড়ি ততক্ষণে ঝোপঝাড় ঠেঙিয়ে জমির মাঝখানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা এরোপ্লেনটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এরোপ্লেনটাকে দেখে বুড়ি সেটার গায়ে সাবধানে হাত বুলালো, তারপর সাবধানে দু-এক জায়গার ধুলো-কালি সরিয়ে ওটার গায়ে আঙুলের টোকা মেরে ফোকলা মুখে, আহ্লাদী গলায় বললো, “দেখেই বুঝেচি। খাঁটি রূপো। ঠাকুর আমাদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন অবশেষে। এ জিনিস বিক্রি করলে গাঁয়ের সবাই বড়োলোক হয়ে যাবে।”

তারপর এরোপ্লেনটার আশেপাশে ঘুরে বুড়ি এটা সেটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। এরোপ্লেন নামের এই মস্ত বড় রূপোর পাখিটা যে মরে গেছে সে ব্যাপারে বুড়ির সন্দেহ ছিল না। কিন্তু এতবড়ো শরীরটা নিয়ে পাখিটা ওড়ে কী করে সেটা না জানা অবধি সে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। দু-একবার পাখিটার লেজ আর ডানায় হাত বুলিয়ে দেখলো যে কোনো সারা নেই। তারপর পাখিটার ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে কিনা শোনার জন্য সেটার পাঁজরের কাছে গিয়ে সাবধানে কান পাতলো। কিন্তু সয়াবিন ক্ষেতের উপর বইতে থাকা হাওয়ার শোঁশোঁ আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ কানে এলো না তার। ঠিক তখুনি এরোপ্লেনটার মুখের কাছে একটা গর্ত দেখে বুড়ি ঠুকঠকিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। গর্তটার ভেতরে প্রথমে মনে হল কয়েকখানা মোটা কাপড় দলে মুচড়ে রাখা আছে. তারপর আরেকটু ভালো করে দেখার পর বুড়ি বুঝলো কাপড় নয়, মানুষ!

বুড়ি তাড়াতাড়ি ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লোকটার হাত চেপে ধরলো। বেঁচে আছে। চোট পেয়েছে বড় রকমের, কিন্তু নাড়ি ধুকধুক করছে এখনো। বুড়ির সাড়া পেয়ে ছেলেটা মাথা ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে। বুড়ি দেখলো কালো চুল, কালো চোখ, সুন্দরপানা গোলমুখ। অল্পবয়স্ক বাচ্চা ছেলে একটা। চোখমুখে বুদ্ধির দীপ্তি। ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে ভালো ঘরের ছেলে। তার নাতি শাও-ঝুর বয়সী। অনেকটা তার মতোই কিন্তু কোথায় যেন একটু আলাদা। তখুনি নাতি-নাতবৌ আর তার বংশের অনাগত প্রদীপটির কথা মনে পড়তে বুড়ির চোখদুটো ভিজে উঠলো হঠাৎ। ছেলেটাকে সে আলতো স্বরে বলল, “বাছা ঠিক আছো তুমি?”

ছেলেটা সেকথা শুনে অতিকষ্টে ইশারায় দেখালো তার বুকের ডানদিকে। বুড়ি সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠে বলল, “এত রক্ত! জামাকাপড় সব ভিজে গেছে দেখছি।” বুড়ি এবার কোনোরকমে তার শরীরখানা এরোপ্লেনের ওই গর্তটার মধ্যে ঢুকিয়ে বললো, “বাছা আমার হাতখানা ধরো। তোমাকে বের করতে হবে আগে এখান থেকে, তারপর গাঁদাপাতার রস দিয়ে তোমার রক্তটা বন্ধ করবো…এস এস হাত ধরো…” ছেলেটা সেকথার উত্তরে বিড়বিড়িয়ে বলল কিছু। বুড়ি তার কথাগুলো শুনলো কিন্তু বুঝলো না কিছুই। “তোমার বাড়ি নিশ্চয় দক্ষিণে? তাই না? আমার নাতি আমাকে বলেছে যে দক্ষিণের মানুষদের মুখের বুলি, চালচলন সবকিছুই আলাদা। তোমার বাড়ি নিশ্চয় সেখানে।”

কথা বলতে বলতেই বুড়ি ছেলেটার কনুই আর কোমর ধরে হিচড়ে টেনে বের করলো। গরমের সময়। তাই ভোরবেলা হলেও পরিশ্রমের চোটে বুড়ির দরদরিয়ে ঘাম ছুটতে শুরু করলো। ছেলেটার ওজন কম, হালকা চেহারা। তাই রক্ষে। নইলে বুড়ির একার পক্ষে তাকে বের করা অসম্ভব হয়ে যেত।

“খোকা, তুমি কী আমার বাড়ি অবধি হেঁটে যেতে পারবে? জোয়ান বয়স হলে তোমাকে পিঠে করেই নিয়ে যেতে পারতুম জানো। কিন্তু এই বুড়ো হাড়ে অত পরিশ্রম আর সহ্য হবে না…” ছেলেটার ভর নিজের কাঁধে নিয়ে ক্ষেতের বাইরে বেরোলো বুড়ি। কিন্তু তখুনি তার মনে পড়লো, নিয়ে তো যাচ্ছে, কিন্তু বাড়ি নামক বস্তুটির অস্তিত্ব কি আর আছে? কালরাতে ওই রূপোর ডিম পড়ার পর বাড়ির জায়গায় তো পড়ে আছে শুধু মুঠো মুঠো ছাই। বুড়ি অসহায় চোখে একবার দেখলো জঙ্গলের দিকে। গাঁয়ের লোকেরা এখনো কেউ বেরোয়নি। সেরকম কাউকে দেখলে তার সাহায্য নেওয়া যেত। কিন্তু উপায় নেই। কোনোরকমে ছেলেটাকে নিয়ে গাঁয়ের সীমানায় পৌঁছে, হাঁটা রাস্তার পাশে তাকে বসিয়ে দিল সে।

এরোপ্লেনের ছেলেটিকে বুড়ি যেখানে এনে বসিয়েছিল, সেখান থেকে ঠিক দু-কদম গেলেই বুড়ির বাড়ি। মানে বাড়ির জায়গা। ছেলেটাকে বসিয়ে বুড়ি একবার ঘুরে এল সেখানে। বাড়িঘর গেছে যাক। কিন্তু বাঁধ একদম ঠিকঠাক আছে। স্লুইশ গেটগুলো সচক্ষে গিয়ে ভালো করে দেখে এলো। না ঠিক আছে সব। ফাটল ধরেনি কোথাও। হুড়কোগুলো ঢিলে হয়ে যায়নি কোথাও। বুড়ি নিশ্চিন্ত হল। বাড়ির আর কী? সবাই মিলে হেঁইয়ো বলে লাগলে তিন চার দিনে গাঁয়ের সবার বাড়ি আবার তৈরি হয়ে যাবে। সত্যিকারের চিন্তার ব্যাপার হত যদি বাঁধটার কোনো ক্ষতি হতো। তা যখন হয়নি তখন আর কোনো ভয় নেই। একটু হালকা মনে বুড়ি আবার এসে দাঁড়ালো আহত ছেলেটির কাছে।

ছেলেটি ততক্ষণে বোধহয় একটু ধাতস্থ হয়েছে। বুড়ি কাছে গিয়ে দেখলো যে সে নিজের জ্যাকেটটাকে খুলে রেখেছে পাশে। জ্যাকেটের মধ্যে থেকে বেরোলো একটা সাদা কাপড়ের পট্টি আর একটা ছোট ওষুধের শিশি। বুড়ি খুব কৌতূহলী চোখে দেখছিল ছেলেটার কান্ডকারখানা। ছেলেটা হাঁপাচ্ছে, কিন্তু কাঁপা কাঁপা হাতে কাজ করছে ঠিক। বুড়িকে ফিরে আসতে দেখে ছেলেটা ইশারায় নিজের ক্ষতস্থান আর ওষুধটা দেখিয়ে কিছু একটা চাইলো। এটা সেটা জিজ্ঞেস করে বুড়ি বুঝলো যে জল, ছেলেটা জল চাইছে। “দাঁড়াও বাছা, দাঁড়াও। নদী পাশেই আছে. জল এখুনি এনে দিচ্ছি…” বলতে বলতে পাশের একটা বাড়ির উঠোন থেকে একটা ভাঙা বালতি নিয়ে বুড়ি নদীর জল নিয়ে এল। তারপর ছেলেটার ক্ষতস্থান ধুয়ে মুছে যত্ন করে ওষুধ মাখিয়ে পট্টি বেঁধে দিল। তারপর তার মনে হল এবার তো একটু কিছু খাওয়া দরকার। তার নিজের খিদে পেয়েছে, কিন্তু তার থেকেও বেশি খাবারের দরকার ওই বাচ্চা ছেলেটার। আহা রক্ত পড়ে পড়ে মুখখানা একদম ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ওর। জলের বালতিটা যত্ন করে পাশে সরিয়ে রাখলো বুড়ি। কে জানে কখন কাজে লাগে আবার। তারপর নিজের পরনের কাপড়ে ভেজা হাত মুছে ইশারায় ছেলেটাকে বলল, একটু দাঁড়াও। আমি কিছু খাবার জোগাড় করে আনি। ছেলেটা শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুড়ি আরো একবার বলল খাবার কথা‌। ছেলেটা তাতেও কোনো সাড়া দিল না। ওর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি নিঃশ্বাস নিতেও ওর কষ্ট হচ্ছে।

বুড়ি কী করবে বুঝতে না পেরে ছেলেটার মাথায় হাত রেখে বলল, “আসছি দাদুভাই। আমি খাবার নিয়ে আসছি। দেখিস পেটে একটু খাবার পড়লেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবি তুই।” বলে বুড়ি আবার দেখল আশেপাশে কেউ আছে কিনা। যদি কারোর দায়িত্বে অসুস্থ ছেলেটাকে রেখে যাওয়া যায়। কিন্তু কাউকে কোথাও না দেখে বুড়ি অনিচ্ছাসত্বেও বেরোলো খাবারের খোঁজে। চলতে চলতে বুড়ির মনে হল খাবারের খোঁজে এখন মুদিখানার দোকানে যাওয়া বৃথা। শুধু চাল-সবজি পেলেও তো লাভ নেই। এখন রান্না করবে কে! তার চাইতে বরং গ্রামের বেকারীটাতে গিয়ে খোঁজ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সেখানে অন্তত তৈরি রুটি পাওয়া যাবে। সেইমতো বেকারীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো বুড়ি। গাঁয়ের অন্যান্য বাড়িগুলোর মতোই বেকারিটাও ভেঙেচুরে গেছে। তবে দোকানের সদর দরজাটা ভাঙেনি। বুড়ির মনে পড়লো যে রুটির উনুনটা আছে দরজার ঠিক পেছনেই। কাজেই ওটা নিশ্চয় এখনো আস্ত আছে। দরজার ভাঙা পাল্লাটা সাবধানে খুলে বুড়ি ভেতরে গিয়ে দেখলো যে, ঠিকই ভেবেছে। দরজাটা সামনেই ছিল বলে উনুনটার কোনো ক্ষতি হয়নি। রুটিওয়ালা ওটার মুখে একটা বড় লোহার কড়াই চাপা দিয়ে রেখেছে দেখে বুড়ি নিশ্চিত হল যে ভেতরে ঠিক রুটি আছে। কড়াইটাকে সাবধানে তুলে ভেতরে হাত ঢুকাতেই বুড়ির মুখে হাসি ফুটলো। যেমন ভেবেছে ঠিক তাই। নরম, তাজা রুটি দিয়ে ভরা কড়ার ভেতরটা। রুটিওয়ালা বোধহয় কাল রাত্রিতেই বসিয়েছিল। রুটিগুলো এখনো গরম আছে। মনে মনে রুটিওয়ালাকে আশীর্বাদ করে কড়ার ভেতর থেকে চারটে রুটি বের করলো সে। একটা রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে বুড়ি আবার বেকারী ছেড়ে বেরুলো রাস্তায়। রুটিওয়ালা এই ভাপানো রুটিটা বড্ড ভালো বানায়। এর সঙ্গে শুধু যদি কয়েক কোয়া রসুন আর এক কাপ চা পাওয়া যেত তাহলেই রীতিমতো ভোজ বলে মনে হত। কিন্তু সবসময় কী আর সবকিছু জোটে। এই যে নরম রুটি তাদের কপালে জুটেছে এই না কত! বুড়ি রুটি চিবোতে চিবোতে পায়ের গতি বাড়ালো আরো। আসার সময় ছেলেটার অবস্থা ভালো ছিল না। রুটিটা পেলে একটু গায়ে জোর পাবে নিশ্চয়। মিনিট দশেকের হাঁটা পথ পেরিয়ে বুড়ি যখন বাঁধের পাশে পৌঁছলো তখন দেখলো আরো জনাচারেক লোক ওখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। কোত্থেকে এসেছে কে জানে! ছেলেগুলোর পরনে সৈনিকের পোশাক। ওদের বাড়িও নিশ্চয় কাছাকাছি কোনো গ্রামেই হবে। সামনে আধশোয়া হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটাকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যেই কথা বলছিল ওরা। বুড়ি একটু বিরক্ত হল ওদের দেখে। এসব যুদ্ধ-কাজিয়া করা মানুষজন সে মোটেই পছন্দ করে না। যারা টাকার জন্য খুন করে, তারা আবার মানুষ হল নাকি! কিন্তু সে কিছু বলার আগেই তাকে দেখতে পেয়ে সৈনিকদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে বলল, “ও দিদিমা, এই হারামজাদা জাপানিটাকে কোথা থেকে পেলে?”

বুড়ি অবাক হয়ে বলল, “জাপানি কেন বলছো বাছা। ও ছেলে তো তোমাদের মতোই দেখতে। কালো চুল, কালো চোখ। বালাই ষাট! ও কেন জাপানি হতে যাবে?”

সৈন্যগুলোর মধ্যে দুজন এবার খিকখিক করে বিশ্রীভাবে হেসে বলল “দিদিমা আগে কোনোদিন তুমি জাপানি শুয়োর দেখোনি, তাই না ?”

বুড়ি ওয়াং যারপরনাই বিরক্ত হল সে কথা শুনে। সে আগে কোনো জাপানি দেখেছে কি দেখেনি সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু তাই বলে একটা বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলার সামান্য সম্মানটুকুও দেখাবে না এরা! বুড়ি ভুরুদুটো কুঁচকে বললো, “জাপানি কি জাপানি না, তা কী করে জানবো বাপু! ওদিকের জমিতে একটা এরোপ্লেন এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তার মধ্যে বসেছিল। ব্যথা পেয়েছে। রক্ত পড়ছিল দেখে আমি সাবধানে এখানে এনে বসিয়েছি। কিন্তু বাছারা তোমরা এখানে কেন? এই গাঁয়ের লোক তো কারোর সাতেপাঁচে থাকে না। তাহলে তোমরা কেন এখানে এসে ভিড় করছো? যাও বাপু, যাও এখান থেকে। এমনিতেই অশান্তির শেষ নেই। তার উপরে তোমরা এসে আর ঝামেলা বাড়িও না”।

সৈন্যদের মধ্যে যে সবার আগে কথা বলেছিলো সে আবার বলল, “ঝামেলা আমরা আর কোথায় করলাম দিদিমা। তুমি যাকে খাতির করে রুটি খাওয়াবে ভাবছো, ঝামেলা তো করছে তারা। তোমার গাঁয়ের এই অবস্থায় ওরাই করেছে কাল রাতে।”

সেকথা শুনে বুড়ি আমতা আমতা করে বলল, “তা অবশ্য ঠিক। আমি কাল রাতে নিজেই দেখেছি। কিন্তু ওরা কেন এমন করছে বল তো?”

“কেন আবার, ওই শুয়োরগুলো তোমাদের গাঁয়ের মাটি দখল করতে চায়…”

বুড়ি আঁতকে উঠল।

“এই গাঁয়ের মাটি! মানে আমাদের জমি! তা আমরা কেন দেব?”

“তুমি বরং সেটা এই হারামজাদাটাকেই শুধাও।”

বুড়ি কী বলবে বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে সৈন্যগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন সময় চতুর্থজন একটু সাবধানী গলায় বলল, “পুবদিকটায় একটু খেয়াল রেখো দিদিমা।”

বুড়ি একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলল “কেন, ওদিকে কি আছে?”

প্রথমজন একটু নীচু গলায় বলল, “জাপানিরা ওদিক থেকেই আসছে। কাল রাতে ওরা পাও-অ্যান গ্রামে ঢুকেছিল… তোমাদের এই ওয়াং গাঁয়ের পুবদিকে প্রায় চৌদ্দো মাইল গেলে দক্ষিণে…”

বুড়ি সেই ছোকরাকে থামিয়ে বলল, “থামো বাছা থামো! ওই গাঁয়ের হদিশ আর তোমাকে বলতে হবে না। আমি পাও-অ্যান গাঁয়েরই মেয়ে। সে গ্রামের মুদির দোকানদার পাও আমার নিজের ভাই। তার খবর যদি কিছু বলতে পারো তো বলো”।

সৈনিক চারজন একটু অপ্রস্তুত ভাবে বলল, “ও গাঁয়ে আর কেউ বেঁচে নেই। জাপানিরা রাতে এসেছিলো। গাঁয়ের লোকজন বাড়ি থেকে বেরোনোরও সময় পায়নি। কচুকাটা করে মেরেছে সবাই কে… আমরা ওখান থেকেই পালিয়ে আসছি…আমরা চেষ্টা করেছিলাম ওদের আটকানোর কিন্তু ওরা সংখ্যায় এতো বেশি ছিল…কী আর করবো…”

বুড়ি ওয়াঙের গা-হাত-পা কাঁপছিল। রাগে না ভয়ে কে জানে। তার একমাত্র ভাই…তার ছোট ভাই…কোলে পিঠে করে বড় করেছে সে…নিজের হাতে ভাতের গরাস তুলে খাইয়ে দিত সে ভাইকে…সেই ভাই আর তার পরিবার! হে ঈশ্বর! তার বাবার বংশে বাতি দেওয়ার আর কেউ রইলো না!”

সৈন্য চারজন তার অবস্থা বুঝতে পেরে এতক্ষণ করুণ মুখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখে আঁতকে উঠলো। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে শুরু করলো যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে হবে এই গ্রাম থেকে। জাপানিরা এদিকেই আসছে, সেই খবরটা সময়মতো হেড অফিসে না জানালে আরো মানুষ বেঘোরে মরবে। বুড়ি চমক ভেঙে তাকালো তাদের দিকে।

“বলি ও বাছারা, এই নে। এই তিনটে রুটি সঙ্গে রাখ। পথে খিদে পেলে খাস। শুধু একটা কথা বলে যা। জাপানিরা আসলে বুঝবো কী করে বল দেকিনি?”

প্রথমজন যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে গাঁয়ের পুবদিকের সীমানা দেখিয়ে বলল, “বেটে বামনগুলো পিল পিল করে ওদিক থেকেই আসবে দিদিমা… গাঁয়ের অন্যদেরও বলে দিও সাবধান থাকতে। পারলে যেন লুকিয়েই থাকে। ওরা দেখতে পেলে কেউ বাঁচবে না. আমরা চলি…”

দ্বিতীয়জন যেতে যেতেও হঠাৎ ফিরে এল হাতে একটা খোলা ছুরি নিয়ে। এসে বুড়িকে বলল, “বুড়িমা, একটু সরো তো দেখি। যাওয়ার আগে এই শুয়োরটার গলাটা ফাঁক করে দিয়ে যাই…শালারা কালরাতে অনেক অনেক মানুষ মেরেছে…সরো একটু…”

বুড়ি কিন্তু এত কষ্টেও শক্ত হাতে বাধা দিল ছেলেটাকে। ছোকরা অবাক হয়ে বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “বুড়িমা ওরা তোমার ভাইকে মেরেছে!”

“সে তাদের নিজেদের কর্ম বাছা। তাই বলে আমি তো তাদের মতো হতে পারি না। এই ছেলেটা মরেছে না বেঁচে আছে কে জানে। যদি মরে যায় তাহলে অপঘাতে মরার পর নরকে যাবে। আমি তাকে কাটাছেড়া শরীর নিয়ে সে তল্লাটে পাঠাই কী করে বল? সে পাপ আমি ঘাড়ে নিতে পারবো না। আমি বুদ্ধের পুজো করি রোজ।”

অন্য তিনজন দ্বিতীয়জনকে ডাক দিতে সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে তার সঙ্গীদের দিকে দৌড়োতে শুরু করলো। যেতে যেতে শুধু বলে গেল “পালাও।”

সৈনিক চারজন চলে যাওয়ার পর বুড়ি নিজের আধখাওয়া রুটিটার থেকে একটু ছিঁড়ে আধশোওয়া ছেলেটার মুখের কাছে ধরে বলল, “রুটি, রুটি এনেছি। চোখ খোলো। ওঠো.”

ছেলেটার তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। বুড়ি মমতামাখা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না এই ছেলেটা জাপানি দলের। ছেলেটার বয়স নিতান্তই কম। হাত-পাগুলো এখনো নরম লোমে ঢাকা। মুখখানা শিশুর মতো। কোনো কাঠিন্য নেই। দেখেই বোঝা যায় খুব ভালো ঘরের ছেলে। বুড়ি অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই রাগ করতে পারলো না ছেলেটার উপর। কিছুক্ষন পর তার যখন সত্যিই মনে হল যে ছেলেটা আর বেঁচে নেই তখন সে তাকে মাটির বুকে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে তার পাশে বসে রুটিটা খেয়ে নিল তাড়াতাড়ি।

খাওয়া শেষ হলে বুড়ি বাঁধের সিঁড়ি বেয়ে উঠলো বাঁধের উপর। প্রথমেই সে গেল নদীর কাছে। এক রাত্রিতেই অনেকটা জল বেড়েছে। নদীর জলে হাত ডুবিয়ে দেখলো জল বেশ ঠান্ডা। তার মানে কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। সেই জল জমেই নদীর এত বাড়বাড়ন্ত। আঁজলা ভোরে নদীর জল তুলে সেই ঠান্ডা জলে মুখ-হাত ভালো করে ধুয়ে বুড়ি দেখলো পশ্চিম দিকে। যেদিকে ওই চার সৈনিক পালিয়েছে। তারা এখনো বেশি দূর যায়নি। তাদের দেখতে বুড়িকে বেশি বেগ পেতে হল না। তারপর দেখলো বুড়ি জঙ্গলের দিকে। মানুষজনের নড়াচড়া না দেখে সে বুঝলো যে গায়ের লোক রাতারাতি হয়তো জঙ্গল ছেড়ে পাশের গাঁয়ে পালিয়েছে। তা দেখে বেশ খুশি হল সে। যাক বাবা, শাও-ঝু আর তার বৌটি অন্তত নিরাপদে আছে। থাক বাবা, সুখে থাক, বেঁচে থাক ওরা দুজন।

বুড়ি ঠিক করলো যে তারও ওদিকে রওনা দেওয়া উচিৎ। পাশের গাঁয়ে তার নাতি আর নাতবৌ নিশ্চয় বুড়ির জন্যই অপেক্ষা করছে। নাতবৌটির পোয়াতি পেটের কথা ভেবে বুড়ি এতো কষ্টেও হেসে ফেলল। ক’দিন পর বুড়ির নাতির ঘরে পুতি আসবে, এ কী কম আনন্দের কথা! ছোট্ট পুতিটির সঙ্গে কী কী খেলবে, কেমন মজা করবে সেসব ভাবতে ভাবতে বুড়ি নীচে নামার জন্য ধীরে ধীরে বাঁধের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু নেমে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ সে দেখল যে পুবদিকটা কেমন যেন ধূসর দেখাচ্ছে। যেন ধুলোর ঝড় উঠেছে সেদিকে। এখন তো ধুলোঝড় ওঠার সময় নয়। বুড়ি সেদিকে তাকিয়ে ভাবলো। তারপর তাড়াতাড়ি উঠলো আবার বাঁধের মাথায়। ধুলোঝড় নয়। মানুষ আসছে। শয়ে শয়ে। দল বেঁধে। কালো মাথার দেশলাই কাঠির মতো দেখাচ্ছিল তাদের দূর থেকে। সকালবেলার সূর্য্যের আলো লেগে তাদের হাতের অস্ত্র চক চক করছে। সৈন্যগুলো তাহলে ঠিকই বলেছিল যে জাপানিরা এদিকেই আসছে। বুড়ি সেদিকে তাকালো আরেকবার, তারপর পশ্চিমে তাকালো খুব মমতা মাখা চোখে। আহা রে, তার ছোট্ট পুতিটা কী মিষ্টিই না হবে।

তারপর বুড়ি নদীর দিকে তাকিয়ে ভাবলো, নদীঠাকুর, আজ চলো একটু মস্করা করি তোমাতে আমাতে। সারাটা জীবন আমাকে জ্বালিয়েছো তুমি। আমার ঘর ভেঙেছো কতবার। হিংসুটে নাগরের মতো আমার ঘরের লোকটাকেও খেয়েছো। আজ আমি সুযোগ পেয়েছি তোমাকে দিয়ে আমার কাজ করানোর। আমিই বা সে সুযোগ ছাড়ি কেন বলো? তুমি তো এমনিতেও একুল ওকুল দুকূল ভাসাবে একটু পরে। আজ না হয় আমার কথামতোই সেকাজ করলে। পুণ্যি হবে গো ঠাকুর। জাপানিগুলোকে মারতে পারলে কতগুলো গাঁয়ের মানুষের প্রাণ বাঁচবে বল দেখি। আমার শাও-ঝু, আমার নাত-বৌ, তাদের বাচ্চাটা… আরো কতজন। তবে তোমার সঙ্গে দিনদুপুরে এমন পীড়িত করে মরলে নরকবাস করবো আমি জানি। কিন্তু এই যে আমি এতগুলো লোকের প্রাণ বাঁচাবো। তথাগত বুদ্ধ কি সেদিকটা দেখবেন না? কে জানে এমনও তো হতে পারে যে তিনি আমার সঙ্গে আমার মরদটাকেও স্বর্গে ঠাঁই দিয়ে দিলেন। ওর তো শুধু হাতটুকুই আটকা পরে আছে নরকে। সেটুকু তো ক্ষমা করাই যায়। তার আগে আজ শুধু তোমাতে আমাতে সময় কাটাই চলো।

বুড়ি এবার লাজুক চোখে তাকালো নদীর দিকে। পায়ের আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলো জলের ধারা। নদী প্রেমিকের মতো এসে চুমু খেল তার পায়ের পাতায়। তারপর বুড়ি একে একে নিজের বুকের বোতামের মতো খুলতে লাগলো স্লুইশ গেটের একেকখানা হুড়কো। নদীর জল তার পায়ের দিক থেকে উপরে ওঠে আর সে আনন্দে নববধূর মতো শিহরিত হতে থাকে। প্রথম দুটো গেট খুলতেই যা একটু কষ্ট হয়েছিল তার। তিন নম্বর গেটটা খুলতেই নির্লজ্জ প্রেমিকের মতো নদী এসে সর্ব অঙ্গ দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। তারপর তাকে বুকে ধরে দামাল পুরুষের মতো নদী ছুটলো পুবদিকে। একসঙ্গে, এক হয়ে…

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *