মূল রচনা – হেক্টর হিউগ মুনরো (Hector Hugh Munro), গল্পের নাম “Fur”
অনুবাদ – যূথিকা আচার্য্য
লেখক পরিচিতি – লেখক হেক্টর হিউগ মুনরো, জন্ম ১৮ই ডিসেম্বর, ১৮৭০, এবং মৃত্যু ১৪ই নভেম্বর, ১৯১৬ সালে। তৎকালীন ভিক্টোরিয়ান সমাজের কাল্পনিক গল্প এবং ব্যঙ্গাত্মক রসের স্রষ্টা হিসেবে ব্রিটিশ লেখক হেক্টর হিউগ মুনরো খুব অল্প বয়সেই বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায় যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর ছদ্ম নাম “সাকি”।
“কী রে, খুব টেনশনে আছিস বলে মনে হচ্ছে?:
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুজানা বলল, “না রে এলি, টেনশন ঠিক নয়। তবে ক’দিন ধরে একটা ব্যাপার নিয়ে…ছাড়। তুই শুনলে হাসবি।“
এলি ওরফে এলিনর হেসে বলল, “আচ্ছা বাবা, না হয় হাসবো। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে তোর প্রবলেমের সলিউশনও আমি ওই একই সঙ্গে দিয়ে দিলাম। তাহলে অ্যাটলিস্ট তোর মুখখানা এমন বাংলার পাঁচের মতো দেখাবে না।“
“যাহ্! তুই সবকিছুতেই খালি ইয়ার্কি মারিস।“
এলিনর এবার একটু সিরিয়াস মুখ করে সুজানার হাতখানা ধরে বলল, “ওকে ফাইন, আই প্রমিস। নো মোর ইয়ার্কি। প্লিজ বল এবার। কী হয়েছে? তুই জানিসই তো, আমি সাসপেন্স একদম পছন্দ করি না। প্লিইইইইজ সুজি!”
সুজানার বলার ইচ্ছে ছিল ষোলো আনার জায়গায় আঠেরো আনা। তবে কিনা একটু সাধাসাধি না করলে আগ বাড়িয়ে বলার মতো ব্যাপারখানা নয়, তাই ইচ্ছে করে খামোখা অ্যাক্টিং করছিল সে। তাড়াতাড়ি বান্ধবীর হাতদুটো শক্ত করে ধরে সুজানা বলল, “শোন না, তুই ব্যারন বাট্রাম নেয়েট-এর নাম শুনেছিস?”
এলিনর ভুরুদুটো কুঁচকে একটু ভেবে বলল, “ব্যারন বাট্রাম নেয়েট। আর্জেন্টিনার বনেদী ধনী লোক। ওদেশের নামকরা ব্যবসায়ীদের একজন। রিসেন্টলি ইংল্যান্ডেও এসেছিলেন শুনেছি। সেকী রে! তুই আবার ভদ্রলোকের প্রেমে পড়েছিস নাকি! দ্যাখ উনি বুড়ো মানুষ…ভালো কথা বলছি শোন…”
সুজানা তাড়াতাড়ি এলিনরের ঠোঁটে হাত চাপা দিয়ে বলল, “ইশ্, চ্যাঁচাচ্ছিস কেন? আগে শোন তো পুরো ব্যাপারটা। ব্যারন নেয়েটের প্রেমে কেন পড়তে যাবো? উনি সম্পর্কে আমার মায়ের ভাই হন। আমার মামা।“
এলিনর এবার চোখদুটো কপালে তুলে বলল, “সিরিয়াসলি!! ব্যারন বাট্রাম নেয়েট তোর নিজের মামা!! আর তুই এতদিন ব্যাপারটা বলার প্রয়োজন মনে করিসনি!!!”
সুজানা একটু ব্যাজার মুখে বলল, “নিজের নয়, মায়ের দূরসম্পর্কের ভাই।“
“কতখানি দূরের?”
“অনেকখানি। কিন্তু জানিসই তো যার ব্যাঙ্কে যত বেশি টাকা থাকে, তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও তত বেশি গভীর হয়। মা যদিও অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করে তার বিলিয়নিয়ার ভাইকে নিয়ে, আমি ইচ্ছে করেই একটু গা বাঁচিয়ে চলতাম এতদিন। তবে এবার এমন একটা পরিস্থিতি হয়েছে যে কী করবো বুঝতে পারছি না।“
এলিনর নাটকীয় ভাবে বলল, “বলিতে থাকো বালিকে, আমি শুনিতেছি।“
“তুই তো জানিস, সামনের মাসেই আমার জন্মদিন।“
“হ্যাঁ, তার পরের মাসে আমার। তো?”
“মা গতপরশু মামাকে বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন করেছিল। ডিনারের শেষে মা-র মুখে আমার বার্থ-ডে কথা উঠতেই মামা জানতে চাইলেন যে এবার বার্থ-ডেতে আমি কী গিফ্ট চাই?”
এলিনর একটু ভেবে বলল, “তা, এই মুহুর্তে তোর কাছে সবচাইতে ভালো গিফ্ট কী হতে পারে?”
“তুই বুঝতে পারছিস না। ব্যাপারটা অত সহজ নয়। মানুষের সাধ আর সাধ্য বেশিরভাগ সময়ই ম্যাচ করে না। যদি কখনো করে তাহলে সেটা সুবর্ণসুযোগ, আর আমি স্রেফ বোকামি করে এমন সুযোগ হারাতে চাই না।“
এলিনর চোখদুটো সরু করে বলল, “আমার কিন্তু মনে হচ্ছে সুজি, যে তুই ব্যাপারটাকে অনর্থক জটিল করে তুলছিস। তোর মামা, তুই জন্মদিনে কী গিফ্ট চাস জানতে চেয়েছেন। তোর যেটা ভালো লাগে বলে দে। ব্যস, হয়ে গেল।“
সুজানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“এলি তোকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি আমি। ছোটোবেলায় আমার দাদু আমাকে বলতেন যে মানুষ টাকা দিয়ে নয়, অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষ চেনে। আমি এতদিনে সেই কথাটার মানে বুঝলাম।“
“মানে?”
ঠিক আছে তোকে বুঝিয়ে বলছি। দ্যাখ, কেনসিংটনের একটা দোকানে একখানা অপূর্ব সুন্দর জাপানি পোর্সেলিনের পুতুল দেখেছিলাম। পুতুলখানা দেখতে যেমন সুন্দর, দামও তেমনি তার চড়া। পুরো ছত্রিশ শিলিং! শুধুমাত্র শখের জন্য অতগুলো টাকা খরচা করার কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না। তো মামা যখন বললেন আমি কী গিফ্ট চাই তখন আমি পুতুলটার কথা প্রায় বলেই ফেলেছিলাম। কিন্তু শেষ মুহুর্তে জিভ কামড়ে নিজেকে আটকেছি…”
এলিনর অবাক হয়ে বলল, “ওমা সেকী! কেন? আচ্ছা বুদ্ধু তো তুই! এমন সুযোগ কি কেউ হারায় নাকি?”
“এগজ্যাক্টলি! এমন সুযোগ হারানো উচিত নয় বলেই বলিনি।“
“বুঝলাম না তো। কী বলতে চাইছিস তুই?”
“থিঙ্ক এলি। ওই পুতুলখানা আমার কাছে ভীষণ দামী একখানা গিফ্ট, কারণ আমার অবস্থা খারাপ। কিন্তু আঙ্কেলের কাছে ওই টাকাটা তো নস্যি। তাছাড়া উনি যখন নিজে থেকেই উপহার দিতে চাইছেন তখন এমন কিছু নেওয়াই ভালো যেটা কেনার ক্ষমতা আমার আগামী জন্মেও হবে না। দেখ বাপু, আমি লোভী নই, কিন্তু তাই বলে যে মানুষ খোলামকুচির মতো ছত্রিশ হাজার পাউন্ড ছড়াতে পারে তার কাছে ছত্রিশ শিলিং-এর গিফ্টের কথা বলবো, এমন গন্ডমুর্খ হতেও আমি নারাজ। তাছাড়া আঙ্কেলও নিশ্চয় চাইবেন না যে আমি এমন বোকার মতো কাজ করি।“
এলিনর কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আমার কিন্তু মনে হয় না যে তোর দাদু এই অর্থে কথাগুলো বলেছেন। তাছাড়া উপহার, যে দেয় এবং যে নেয় তাদের দু’জনেরই মেন্টালিটির উপর নির্ভর করে। তোর কাছে যেটা আইডিয়াল গিফ্ট সেটা হয়তো তাঁর কাছে জাস্ট একটা বিরক্তিকর জিনিস। তাই বলছি, লাগামছাড়া না হয়ে, একটু ভেবেচিন্তে বলিস।“
“বলছিস?” সুজানা একটু ভেবে বললো, “কিন্তু আমি যে গিফ্টের কথাই বলি না কেন, আমি শ্যিওর যে দামটা ওঁর কাছে কোনো সমস্যা হবে না।“
“ব্যাপারটা শুধু দামের নয় সুজি। পৃথিবীতে বেশিরভাগ সাকসেসফুল মানুষের ছোটোবেলায় কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। পরবর্তীতে তাঁরা যত বড়লোকই হোন না কেন, ছোটোবেলার ওই না-পাওয়াগুলো ভূতের মতো সারাজীবন তাদের তাড়া করতে থাকে। তাই এদের কাছ থেকে ইচ্ছোমতো উপহার পাওয়ার সবচাইতে সহজ রাস্তা হল কথায় কথায় তোর নিজের খুব পুরোনো যন্ত্রণা বা অপ্রাপ্তির কথা শেয়ার করা। তাহলে সরাসরি চাওয়ার লজ্জাটাও থাকবে না, আবার খুব আলতো ভাবে নিজের ইচ্ছের কথাও জানিয়ে দেওয়া যায় সহজেই।“
সুজানাকে এবার বেশ চিন্তিত দেখালো। সে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আই আন্ডারস্ট্যান্ড এবং হয়তো তোর কথাই ঠিক। কিন্তু এভাবে ইঙ্গিতে কথা বলার তো সমস্যাও আছে অনেক। যেমন মনে কর, আমি আঙ্কেলকে বললাম যে এবার শীতে আমি দাভোস বেড়াতে যাব। সেখানে নিয়ে যাওয়ার মতো কিছু দিলে ভালো হয়। তাহলে তিনি হয়তো ভাববেন যে শীতকালে দাভোস ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসাবে ভীষণ ফেমাস এবং নাচের আসর সেখানে চলতেই থাকে। সেইজন্য দেখা গেল যে তিনি আমাকে একটা দামী লেদারের স্যুটকেস গিফ্ট করে বসলেন, অথবা সোনা-রুপোর জরি বসানো জাপানী পাখা।“
“স্কি-র জুতো-টুপি-দস্তানাও কিনে দিতে পারেন।“
“ঠিক বলেছিস। এদিকে ব্যাপারখানা হল এই যে, স্কি আমি করি না। অলরেডি দু-দু’খানা স্যুটকেস আছে আমার কাছে, আর আলমারির মধ্যে কম করে হলেও তিন-চারখানা জাপানি পাখা পড়ে আছে। কাজেই ওই তিনটের কোনোটাই আমি চাই না। আর যেটা আমি সত্যিই চাই সেটা মুখ ফুটে বলতে আমার বাঁধছে।“
এলি সুজানার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী?”
“ফার। জানিসই তো শীতের সময় দাভোসে রাশিয়া থেকে কতলোক ঘুরতে আসে। ওদের পরিবারের মেয়েদের গায়ে একেকখানা পশম দেখলে মাথা ঘুরে যায়। আর সেখানে যদি আমার কাছে কিছুই না থাকে তাহলে কেমন লাগে বল?“
“এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না সুজি। তুই নিজেই বলছিস তোর দূর সম্পর্কের মামা। তাঁর কাছ থেকে এতখানি দামী একটা জিনিস আশা করা কি ঠিক? হলেনই বা তিনি ধনী। তাতে তোর কী!“
“প্লিজ এলি! বুড়োদের মতো কথা বলিস না তো। সো হোয়াট্! মামার কাছে ওটা হার্ডলি এনিথিং। তাছাড়া মামা তো নিজেই বলেছেন আমি যা চাইব তিনি দেবেন। তাহলে আমিই বা বলবো না কেন! বাই দ্য ওয়ে, ফারের কথা শুনে মনে পড়লো। “গোলিয়াথ্ অ্যান্ড ম্যাস্টোডন”-এর নতুন কালেকশনটা দেখেছিস? দেখলে মনে হবে যেন স্বপ্ন দেখছিস। যদি কোনোভাবে আঙ্কেলকে একবার ওই দোকানটাতে নিয়ে যেতে পারি তাহলেই কেল্লাফতে।”
এলিনর হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গীতে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল, “তুই না আর শোধরাবি না।“ তারপর সে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ““গোলিয়াথ্ অ্যান্ড ম্যাস্টোডন”-এর শোরুমখানা তো উড ভিলের কাছেই। তোর আঙ্কেলও নিশ্চয় উড ভিলেতেই থাকেন। এই এলাকার সব ধনী লোকেদের বাড়ি তো ওইখানেই।“
সুজানা বলল, “হ্যাঁ, উড ভিলেতেই উনি আছেন আপাতত। কিন্তু কেন বলতো?”
“উনি নিশ্চয় বিকেলবেলা হাঁটতে বেড়োন?”
“হ্যাঁ, তা বেড়োন। ওয়েদার ভালো থাকলে তিনটে সাড়ে-তিনটে নাগাদ উনি হাঁটতে বেড়োন। ঘন্টাখানেক হাঁটার পর ক্লাবে যান।“
“গুড। এবার আমার প্ল্যানটা শোন। আগামী কাল ঠিক তিনটে নাগাদ আমরা “গোলিয়াথ্ অ্যান্ড ম্যাস্টোডন” কাছাকাছি ঘুরতে যাব, আর সেখানে “হঠাৎ” তোর মামার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যাবে । তারপরে তুই বলবি যে আঙ্কেল আমাদের সঙ্গে এস। কথায় কথায় তোর আঙ্কেলকে নিয়ে আমরা দোকানটাতে ঢুকবো। তুই না হয় বলবি যে তুই একটা খোপার নেট বা ওই ধরণের কিছু ছোটোখাটো জিনিস কিনতে চাস। সেকথা বলে তুই দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়বি। আমি তখন ব্যারন নেয়েটকে ইনিয়েবিনিয়ে বলব যে তোর জন্মদিনে তোকে যদি আমি একটা রুপোলী শেয়ালের পশম গিফ্ট করতে পারতাম তাহলে কী ভালোটাই না হত। ব্যস, হয়ে গেল।“
সুজানার মুখখানা আনন্দে ঝলমল করে উঠল। “ওহ্ এলি! তুই না একটা জিনিয়াস! সিরিয়াসলি! আমি ভেবে ভেবে সারা হচ্ছিলাম এতক্ষণ, আর তুই কত সহজেই পুরো সমস্যাটার সলিউশন বের করে ফেললি। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। তাহলে সেই কথাই থাকলো। কাল বিকেল দুটো পয়তাল্লিশে “গোলিয়াথ্ অ্যান্ড ম্যাস্টোডন”– এর উল্টোদিকে রাস্তায় দেখা হচ্ছে।
পরদিন বিকেলে পশমশিকারী দুই বান্ধবী তাদের প্ল্যানমাফিক দেখা করল বড় রাস্তার পাশে, পশমের দোকানের ঠিক উল্টোদিকে। দু’জনের কপাল সত্যিই ভালো ছিল, কারণ সেদিন বিকেলের আবহাওয়া ছিল চমৎকার। সকালের দিকে যেটুকু মেঘ ছিল তা কেটে গিয়ে সোনালী রঙের রোদে ঝলমল করছিল সবকিছু।
সুজানা তার হাতঘড়িতে সময় দেখল। এলিনর কোনো কারণবশত একটু চিন্তায় ছিল। সুজানা আড়চোখে তার দিকে দেখল ঠিকই, কিন্তু সেই ব্যাপারে কিছু না বলে তার স্কার্ফটাকে গলার চারপাশে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সে বলল, “আঙ্কেল নেয়েটের বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। আর মাত্র দশ মিনিট।“
এলিনর সেকথার উত্তর না দিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “সুজি, একটা হেল্প করবি আমায়?”
সুজানা আঙ্কেল নেয়েটের অপেক্ষায় ছটফট করছিল। সে বলল, “হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি বল, কী হয়েছে? আঙ্কেল যে কোনো সময় চলে আসতে পারে।“
“আজকে ডিনারের পর ন’টা নাগাদ কিছু একটা বাহানা করে একটু আমার বাড়িতে আসবি প্লিজ?”
যার উদ্দেশে কথাগুলো বলা, সে মোড়ের মাথা থেকে চোখ না সরিয়েই আলগোছে বলল, “কেন রে, কিছু সমস্যা হয়েছে?”
এলিনর মাথা নীচু করে লাজুক মুখে বলল, “আজ ন’টা পনেরোতে হ্যারি আসবে বলেছে। ও আগামী কাল আবার লন্ডনে ফিরে যাবে। এরপর আবার হয়তো ছ’মাস পর দেখা হবে আমাদের। এদিকে আটটা নাগাদ অ্যাডেলা আর তার পিসিমা তাস খেলতে আসবে। হ্যারির আসার খবর শেষ মুহুর্তে পেয়েছি তাই ওদের আর বারণ করতে পারিনি। তাই বলছি তুই যদি ন’টার দিকে এসে আমাদের সঙ্গে একটু তাস খেলতে বসিস, তাহলে অ্যাডেলাদের তোর দায়িত্বে রেখে হ্যারির সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ একলা কথা বলতে পারি। জাস্ট আধঘন্টার জন্য। রাত্রি দশটার মধ্যে হ্যারি আবার বেরিয়ে যাবে।“
সুজানা মিষ্টি হেসে বলল, “স্যরি এলি। সম্ভব হলে আমি নিশ্চয় করতাম, কিন্তু তোর বন্ধু অ্যাডেলার মতো বিরক্তিকর বোরিং মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। তার উপরে আবার তার পিসিমা! ওদের সঙ্গে আধঘন্টা তো দূরের কথা পাঁচ মিনিট বসলেই আমার ঘুম পেয়ে যাবে। তার ওপর রাত্রি দশটা অবধি জেগে থাকাটাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্লিজ এলি, এরকম উদ্ভট রিকোয়েস্ট করিস না।“
এলিনরের এখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সুজানা অমনি এককথায় তাকে “না” বলে দিল। সে প্রায় অবিশ্বাসের সুরে বলল, “তুই কি সত্যিই পারবি না সুজি, নাকি ইয়ার্কি মারছিস? হ্যারির সঙ্গে আমার আবার ছয় মাস পরে দেখা হবে। এই সময়টুকু আমার ভীষণ দরকার, প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর।“
সুজি এবারও হাসিমুখে বলল, “আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি। তুই অন্য কিছু বললে আমি নিশ্চয় ভেবে দেখতাম, কিন্তু প্লিজ, রাত্রি দশটা অবধি অ্যাডেলার সঙ্গে বকবক করলে আমি ঘুমের মধ্যেও দুঃস্বপ্ন দেখব। তুই বরং অন্য কাউকে বলে দেখ।”
এলিনর স্থির চোখে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, দেখছি।“
কাঁটায় কাঁটায় তিনটে না হলেও তিনটে দশ নাগাদ মোড়ের মাথায় দেখা গেল ব্যারন ব্রাট্রাম নেয়েট বেশ খোশ মেজাজে হাঁটতে বেড়িয়েছেন। পরনে হালকা অথচ মানানসই ঘিয়ে রঙের ইভনিং স্যুট। হাতে সুন্দর কারুকাজ করা রুপো বাঁধানো ছড়ি। তাকে দেখামাত্রই সুজানা ফিসফিসিয়ে বলল, “মামা এসে গেছে। চল এবার মোড়ের দিকে হাঁটা শুরু করি।“
এলিনর ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হুম্, চল যাওয়া যাক।“
বলাইবাহুল্য, ব্যারন নেয়েট তার পিছনে ঘটতে থাকা এতবড় ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি পথের মধ্যিখানে তার অল্পবয়স্ক বোনঝিটিকে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখে যারপরনাই খুশি হয়ে উঠলেন। নিয়মমাফিক বোনঝি এবং তার বান্ধবীকে টুপি খুলে শুভসন্ধ্যাও জানালেন তিনি। সুজানা ছোটো বাচ্চাদের মতো দু’গালে হাত দিয়ে বলল, “আঙ্কেল, তুমি এখানে? ক্লাবে যাচ্ছ বুঝি?”
ব্যারন নেয়েট হেসে বললেন, “হ্যাঁ, সেই আর কী। আমি বুড়ো মানুষ। ওই বুড়োদের ক্লাব ছাড়া কোথায় আর যাব বলো?”
সুজানা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, ক্লাবে যাচ্ছ যাও, কিন্তু তার আগে চল আমাদের সঙ্গে ঘোরো কিছুক্ষণ। আর হ্যাঁ, এই হল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এলিনর। এলি, ইনি হলেন আমার মামা, ব্যারন ব্রাট্রাম নেয়েট।“
এলিনর হেসে বাও করল ব্যারন নেয়েটকে। ব্যারন তাকে দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানানোর পর বললেন, “আচ্ছা বেশ, কিন্তু তোমরা দুই কন্যে চললে কোথায়?”
“ওই তো “গোলিয়াথ্ অ্যান্ড ম্যাস্টোডন”-এ যাচ্ছি আমরা। একটা খোপার নেট কিনব আমি।“
ব্যারন সেকথা শুনে হাসলেন।
“বেশ, বেশ। ভালোই হল। শুনেছি সেটি মস্ত বড় দোকান। যদিও এর আগে কখনো যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। চল আজ তোমাদের সঙ্গে আমিও দেখে আসি দোকানখানা।“
কথা মতোই কাজ হল। “গোলিয়াথ্ অ্যান্ড ম্যাস্টোডন”-এর পশম-ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে সুজানা এলিনর ও ব্যারনকে বলল, “প্লিজ, তোমরা এখানেই থেকো। আমি এই গেলাম আর এলাম। এলি, আঙ্কেলকে আমি তোর দায়িত্বে রেখে গেলাম। তুই বরং আঙ্কেল এই দোকানটা ঘুরিয়ে দেখা।“
সুজানা চলে যাওয়ার পর ব্যারন নেয়েট একখানা দামী পশমের স্টোল হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে এলিনরকে বললেন, “এই দোকানখানা কি সবসময়ই এইরকম ব্যস্ত থাকে?”
“হ্যাঁ, এমনিতেই খুব ভালো কোয়ালিটির জিনিসপত্র রাখে তাই দোকানটার সুনাম রয়েছে, তার উপরে আবার হেমন্তের সেল শুরু হয়েছে। তাই এত ভীড়। আসলে পরের মাসে আমার আর সুজির, দুজনেরই বার্থ-ডে, তাই আমরা দু’জন দু’জনের জন্য কী গিফ্ট কিনবো তাই দেখতে এসেছিলাম। “
“বাহ্! একটা ভালো ব্যাপার মনে করিয়ে দিলে তুমি এলিনর। সুজানার জন্মদিনে আমিও ওকে ওর পছন্দমতো কিছু একটা ভালো উপহার দিতে চাই। ওকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু ও লজ্জা পেয়ে কিছু বলেনি। তুমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড, তুমি নিশ্চয় জানো ওর পছন্দ বা অপছন্দ। তুমিই বল।“
এলিনর হাসিমুখে বলল, “আপনি চাইলে আপনার পছন্দমতো একটা জাপানী পাখা ওকে কিনে দিতে পারেন। এবার শীতে ও দাভোস যাচ্ছে কিনা; সেখানে নাচের আসরে মেয়েদের হাতে ওই জিনিসটি তো না থাকলেই নয়। তাই পাখা একদম পারফেক্ট গিফ্ট হবে ওর জন্য।“
ব্যারন একটু অবাক হয়ে বললেন, “তুমি নিশ্চিত ভাবে জানো যে ওকে পাখা দিলে ও খুশি হবে? এই বয়সের মেয়ে, পাখা ওর কাছে নিশ্চয় অলরেডি অনেক রয়েছে।“
“সুজানা ভীষণ লাকি। ওর কাছে সব আছে। আর তাছাড়া ও এত ভালো যে ইচ্ছে করে দুনিয়ার যেখানে যা কিছু সুন্দর জিনিস আছে, সব এনে ওর কাছে দিয়ে দিই। উল্টোদিকে ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন পোড়াকপাল। ওর ভাগ্য দেখে আমার না মাঝে মাঝে খুব হিংসে হয় জানেন।”
“সেকী! হিংসে কেন? তোমরা দুজন তো বেস্ট ফ্রেন্ডস্।“
“হিংসের কারণ বললে আপনি বোধহয় হাসবেন। আসলে প্রত্যেকবার আমাদের জন্মদিনের পর আমরা দুজনে একসঙ্গে আমাদের গিফ্টগুলো খুলে দেখতে বসি। প্রতিবারই সুজির উপহারগুলোর পাশে আমার পাওয়া সবকিছু খুব তুচ্ছ আর খেলো দেখায়। এদিকে আমার আত্মীয়স্বজন সবারই অবস্থা খুব খারাপ। তাই তাঁরা আমার জন্মদিনটা মনে করে সামান্য যা কিছু পাঠান সেটাই আমি হাসিমুখে মেনে নিই। সুজি পায় দামী সিল্কের স্কার্ফ, মুক্তোর মালা, রিস্ট-ওয়াচ্, আর সেখানে আমার কপালে জোটে সুতির রুমাল আর সস্তা ফাউন্টেন পেন। দু’বছর আগে আমার একজন দূরসম্পর্কের মামা প্রমিস করেছিলেন যে আমাকে একখানা রুপোলী শেয়াল মানে সিলভার ফক্স ফার কিনে দেবেন। আমি সেকথা শুনে যে কী খুশি হয়েছিলাম, আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। ওই ফারের সঙ্গে ম্যাচ করে পরার জন্য জামা আর জুতোও কিনে রেখেছিলাম আমি। দু’খানা পার্টিতে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম সেবার। আমার বন্ধু এবং বিশেষত শত্রুদের জানিয়ে রেখেছিলাম যে আমি যে ফারখানা পরে আসবো, সেটা দেখলে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।“
“তারপর?” ব্যারন নেয়েট জানতে চাইলেন।
“তারপর, তারপর আর কী!” এলিনর ম্লান হাসলো। “আগেই তো বলেছি যে আমার কপাল পোড়া। সেবার আমার জন্মদিনের ঠিক দশদিন আগেই মামীমা মারা গেলেন। মামা সেই শোক সামলাতে না পেরে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন, আর সেই সঙ্গে গেল আমার রুপোলী পশম গায়ে পরার শখ। এই দোকানটাতে এলেই যখন আমি এই পশমগুলো দেখি, আমার শুধু কান্না পায়। অথচ মনের কথা কাউকে বলে হাল্কা হব তেমন মানুষ কোথায়? যাকগে ওসব কথা। গরীবদের অত সাধ থাকতে নেই। চলুন আমি বরং আপনাকে পাখার ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যাই। সুজির জন্য আপনার পছন্দমতো সুন্দর একখানা পাখা কিনে আপনি ওদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। আমি সুজি এলে ওকে বলব যে ক্লাবে যেতে দেরী হচ্ছিল বলে আপনি বেরিয়ে গেছেন। সুজি বড় ভালো মেয়ে। ও নিশ্চয় বুঝবে।“
ব্যারন বললেন, “ তোমরা দুজনেই বড় ভালো এলিনর। আমি আসি। আবার দেখা হবে।“
এক মাস পর:
জন্মদিনের পরদিন সকালে সুজানা রেগেমেগে এলিনরকে ফোন করল।
“হ্যালো এলি। জানিস কী হয়েছে?”
এলিনর তখন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। এককাপ চা নিয়ে সবে ব্যালকনিতে বসেছিল বেচারি। সে হকচকিয়ে বলল, “কী হয়েছে রে সুজি? আর ইউ অলরাইট?”
“তুই বললে বিশ্বাস করবি না যে ওই বিচ্ছিরি বুড়ো ব্যারনটা আমাকে কী গিফ্ট দিয়েছে?”
“তুই কি তোর মামার কথা বলছিস? কেন? উনি কী দিয়েছেন?”
“একটা জাপানী পাখা!” ওপাশ থেকে সুজানা প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো। “এত করে বলার পরও কেউ কী করে এমন করতে পারে! পাখাটা যদিও খুব দামী। কিন্তু তাও…”
এলিনর বলল, “আশ্চর্য ব্যাপার। উনি কিন্তু আমাকে একখানা ভারী সুন্দর রুপোলী পশমের স্টোল পোস্ট করে পাঠিয়েছেন।“
সুজানার গলার আওয়াজ শুনে বোঝা গেল না যে বিরক্তি অথবা রাগ কোনটা তার বেশি হয়েছে? সে কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে থেকে ফোঁস করে উঠল, “তোকে! তোকে কেন গিফ্ট দিল বুড়োটা? ব্যাটা বজ্জাত বুড়োর ভীমরতি ধরেছে।“
এলিনর কোনোরকমে হাসি চেপে বলল, “তোর দাদুর কথাই সত্যি সুজি। মানুষ টাকা দিয়ে নয়, অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষ চেনে।“
খটাশ করে ফোনের লাইনটা এবার ওপাশ থেকে কেটে গেল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন