Onubad – Ullas Ebong Anonder Mrityu

 

উল্লাস এবং আনন্দর মৃত্যু
(সঙ্গীতা পি মেনন মলহান)
(ভাষান্তরঃ অভীক মুখোপাধ্যায়)

সামনের মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছেন ? ভদ্রলোকের নাম উল্লাস রায়। বয়েস টেনেটুনে চুয়ান্ন হবে। দেখতে শুনতে একেবারে সাধারণ। একটা নেয়াপাতি ভুঁড়ি পেটের কাছে জামার বোতামগুলোকে আঁটসাঁট করে রাখে সারাদিন ধরে। চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু কলপ করেন না ভদ্রলোক। শরীর ভালো নয়। হাঁপের টান আছে। নিয়মিত মদ্যপানের অভ্যাসও আছে ওঁর।

‘উল্লাস’ মানে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু একমাত্র ভগবানই জানবেন যে কেন ভদ্রলোকের চোখেমুখে  কোনো সময়েই আনন্দের ছাপ থাকে না। 

প্রাথমিক পরিচয়ের পরে এবার আসা যাক উল্লাস রায়ের বর্তমান অবস্থায়। ভদ্রলোক গত তিনদিন ধরে মধ্যভারতের একটি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন। দেখলে মনে হবে ট্রেকিং করতে এসেছেন। সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার, পানীয় জল রয়েছে। ফোল্ডিং তাঁবু, সারভাইভাল কিট থাকায় বিগত তিনদিনে কোনো অসুবিধেয় পড়েননি উল্লাসবাবু।

কিন্তু কী করছেন জঙ্গলে ? ট্রেকিং ? অ্যাডভেঞ্চার ? উঁহু  ! ওসব নয়। জেনে চমকে উঠবেন না যেন। সুইসাইড ! আত্মহত্যা !

উল্লাসবাবুর সবসময়েই মনে হয়, বেঁচে থেকে কী হবে। জীবনে আহামরি কোনো কাজ উনি করে দেখাননি, এবং ভবিষ্যতেও তেমন কিছু করতে পারবেন না বলেই উনি মনে করেন। আবেগ বেশি। বুদ্ধি কম। হীনমন্যতায় ভোগেন। এটা পারলাম না, ওটা পারলাম না জাতীয় আক্ষেপে খালি বলেন, ‘এ জীবন লইয়া কী করিব ?’

যশ নেই, অর্থ নেই, প্রেম নেই। শুধু নেই, নেই, আর নেই। এসব থেকেই জন্ম নিয়েছে হতাশা। আর সেই হতাশাই আত্মহত্যার প্রবণতার জননী। সব ইন্টার রিলেটেড।

রাডারবিহীন জাহাজের মতো হাল হয়েছে উল্লাসের। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, বন্ধু তো দূর অস্ত একটা শত্রুও নেই। নিজেই নিজের শত্রু হয়ে উঠেছেন উল্লাসবাবু। একটা একচিলতে ঘরে একলা থাকেন। অগোছালো, নোংরা ঘরটার এমন হাল যে কুকুরকে ঠেঙালেও হাগবে না। আপাতত কোনো রুজি রোজগার নেই। দিন আনা দিন খাওয়া।

আত্মহত্যা করবেন কি করবেন না এই দ্বিধায় দিনের পর দিন ভুগেছেন উল্লাস। অবশেষে…হ্যাঁ, অবশেষে হার মেনেছেন। এ ব্যাপারে কারো সাহায্য চাননি উনি। জানতেন যে, শুধু জ্ঞান দেওয়ার লোক অনেক থাকবে, কিন্তু যেগুলো নেই, সেগুলো কেউ দেবে না।

বিশ বছর সময় দিয়েছেন ভাগ্যকে। পরিশ্রম করেছেন কঠোর ভাবে। যদি বিধাতা সহায় হন। হননি। নিটফল জিরো !

উল্লাসবাবু নাস্তিক। তবুও খারাপ সময়ে মন মানেনি। দেবতার দ্বারে মাথা নত করেছেন। কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। লোকে বলেছে, ইতিবাচক চিন্তাই ইতিবাচক জীবনের চাবিকাঠি। ইতিবাচক ভাবনার সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছেন নিজেকে, কিন্তু জীবনের ভেলা নড়েইনি। শেষে আজ ইতিই টানতে বসেছেন জীবনের। নিজের হাতেই।

সুইসাইড করবেন ভাবলেও ঝট করে তা করে ফেলেননি উল্লাস রায়। শহরের ভিড়ভাড়াক্কা থেকে বহু দূরে, শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চেয়েছেন বাবু উল্লাস। রীতিমতো গবেষণা করে সম্মানের সঙ্গে, সৃষ্টিশীল ভাবে দুচোখ বুজতে চেয়েছেন উনি। কী দারুণ না !

বিগত একমাস ধরে ইন্টারনেটে চেলে ফেলেছেন মধ্যভারতের অরণ্যের ইতিহাস-ভূগোল। পথ ঠিক করেছেন সন্তর্পণে। শুনলে হাসবেন কিনা জানি না, আসার আগে বনবিভাগের কর্তার থেকে বনে পথচলার পরামর্শ নিয়ে আসতেও ভোলেননি রায় বাহাদুর।

পরিকল্পনামাফিক শুরু করলেন বনাভিযান। সঠিক সময়ে, সঠিক পথে এগোতে লাগলেন। ধীরগতিতে। ওঁর পেছনে ক্রমশ হালকা হয়ে আসছিল জন অরণ্যের হইচই। ক্রমাগত মুখর হয়ে উঠছিল বন। অস্তিত্বে প্রকট হচ্ছিল গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি, পাখিদের কলতান। লোকালয় তো দূরের কথা, মানুষের দেখাই মিলছিল না। আর এক আধজনের সঙ্গে দেখা হলে বাধ্য হয়ে বলছিলেন, ‘গবেষণার কাজে এসেছি।’

মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। সময় আর দূরত্বের সব হিসেব তালগোল পাকিয়ে গেছে। একবার থমকে দাঁড়িয়ে হিপ ফ্লাস্ক বের করে টুক করে গলায় চালান করে দিলেন খানিকটা তরল। কিছু একটা ভাবলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে চিন্তাগ্রস্ত। তবে কি ফিরে যাবেন উল্লাস ? এভাবে কি ওঁর মরা হবে না ?

‘বলি, ও দাদা…’ কেউ একজন ডাকল। চমকে উঠলেন উল্লাস। এই বনের ভেতর এমন স্পষ্ট বাংলায় কে ডাকল ওঁকে ? হ্যালুসিনেট করছেন নাকি ? জল তো ঠিকঠাকই খেয়েছেন। ডিহাইড্রেশন হলে এমন মতিভ্রম হয় বলে।

‘দাদা…’। না, এবার আর ভুল নয়। এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ল দূর থেকে একটা রোগাপটকা চেহারার ছেলে ওঁর দিকে এগিয়ে আসছে। পরনে একটা হলুদ রঙের রাউন্ড নেক টি শার্ট, ব্লু  জিন্স। মুখ, চোখ বসা বসা। খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। ক্ষয়াটে চাঁদের মতো চেহারাটা দেখলে মায়াই হয়। পনিটেল আছে। বয়েস তেইশ চব্বিশ হতে পারে, আবার বেশিও হতে পারে। রোগাদের বেনিফিট অনেক। চুয়ান্নকেও চল্লিশ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

ছেলেটা বেশ হাসি হাসি মুখ করে ওঁর দিকে এগিয়ে আসছে। ভালো করে তাকালেন উল্লাস। টি শার্টে রোমান হরফে হিন্দিতে লেখা আছে, ‘আপনা টাইম আয়েগা’।

ভারিক্কি ভাব নিয়ে উল্লাস প্রশ্ন করলেন, ‘অ্যায়, তুমি কে ?’

ছেলেটা পাত্তাই দিল না। উল্টে বলল, ‘দাদা, আপনাকে দেখে কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার, আমি বলে বোঝাতে পারব না !’

‘যাশ্শালা!’ বলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন উল্লাস। ‘ছেলেটা কি একা ? আশেপাশে কেউ লুকিয়ে ফলো করছে না তো ?’

‘কতদিন ধরে অপেক্ষা করে বসে আছি, কেউ আসবে, কেউ আসবে। অবশেষে। আর আমার চিন্তা নেই,’ ছেলেটা বলল।

উল্লাস ভালো করে চেয়ে দেখলেন ছেলেটাকে। চামড়া সান বার্নড। দেহে খাওয়া দাওয়া না-জোটার ছাপ স্পষ্ট। মনে মনে ভাবলেন, ‘কথা শুনে তো মনে হচ্ছে না যে, জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছে। তবে কি পাগল ?’

উল্লাস জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে ভাই তুমি ? এখানে কি তুমি একা, নাকি অন্য কেউ আছে ? কোনো বিপদ পড়েছ নাকি ?’

হা হা করে হেসে উঠল ছেলেটা। গা জ্বলে গেল উল্লাসবাবুর। ভুরু কোঁচকালেন উনি –‘ইয়ার্কি করার জায়গা নাকি এটা !’

ছেলেটি সম্ভবত উল্লাস বাবুর ভুরু বাঁকানোটা লক্ষ্য করল। সে বলল, ‘না মশাই, আমি মোটেও পথ হারাইনি। একদম বুঝেসুঝেই এখানে এসেছি।’

‘শালা বলে কী !’ অবাক হলেন উল্লাস। একটা শহুরে ছেলে বনের মধ্যে একা একা কী করছে ?

তবে নিজের আশ্চর্য ভাবটাকে চেপে রেখে উল্লাস বাবু বললেন, ‘সে তোমার যা ইচ্ছে করো গে যাও। আমার কিস্যু যায় আসে না। আমি এখানে নিজের কাজে এসেছি। সময় নষ্ট কোরো না প্লিজ !’

‘স্যার, প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করুন ! চিরকাল ঋণী থাকব !’ মাথা চুলকে হাতদুটোকে জোড় করল ছেলেটা।

‘কী সাহায্য ? শুনি আগে…’

‘আমার নাম আনন্দ মোহন ঋষি। আমি একজন ছাত্র। এবং এখানে আত্মহত্যা করতে এসেছি।’

এক পলকে ফ্যাকাশে হয়ে গেল উল্লাস বাবুর মুখ। বোকার মতো মুখ থেকে একটা কথাই বেরিয়ে এল, ‘তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘স্যার…আপনার নামটা জানা হয়নি।’

‘নাম জেনেই বা কী হবে ?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমার কথাটা শুনুন স্যার। শহর থেকে এতদূরে ছুটে এসেছি শুধু একটু শান্তিতে মরার জন্য।’

‘তা মরো না। কে মানা করছে তোমায় ? জাহান্নামে যাও !’ কথা শেষ করেই এগোবার জন্য পা বাড়ালেন উল্লাসবাবু। কিন্তু আনন্দ ওঁর সামনে এসে দাঁড়াল। আবার হাতজোড় করে বলল, ‘একটু হেল্প করুন না ! একটা ভালো প্ল্যান আছে। একটিবার শুনুন প্লিজ !’

উল্লাস থমকে দাঁড়ালেন। একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল, ‘এই আপদটাকে এর মতো মরতে দিই, তারপর না হয় নিজের কাজটা সারব।’ ফ্লাস্ক বের করে এক ঢোক গলায় চালান করে দিয়ে বললেন, ‘তা বলো ভাই, কী করলে তুমি পটল তুলবে ? আমি যথাসাধ্য সাহায্য করব।’

আনন্দ অভিনেতা হতে চেয়েছিল। সাফল্য পায়নি। ক’টা খুচরো বিজ্ঞাপন, দু-একখানা বি গ্রেডের সিনেমা করে স্বপ্ন দেখেছিল উত্তম কুমার হওয়ার। ইয়ার্কির কালীপূজো নাকি ! হতে পারেনি।

নিজের কথা সংক্ষেপে সেরে আনন্দ উল্লাসকে বলল, ‘আসুন, আমার থাকার জায়গাটা দেখাই। ওখানেই মরতে চাই। সব রেডি। শুধু আপনার সাহায্য চাই।’

হ্যাঁ বা না কিছুই বলতে পারলেন না উল্লাস। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আনন্দকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চললেন জঙ্গলের ভেতরে। অনেকক্ষণ চলার পরে লতাপাতা দিয়ে বানানো একটা কুঁড়েঘর চোখে পড়ল উল্লাসবাবুর। ঘরের ভেতরে ঢুকে যে তাজ্জব হওয়ার পালা। দুটো বড় ছোট পাথরকে টেবিল চেয়ারের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে আনন্দ। পেন, খাতা রাখা আছে। আছে ক’টা বইও। টেবিলের মতো পাথরের একটা ধারে একটা স্টেনলেস স্টিলের কফি মাগ বসানো রয়েছে। ঘরের মধ্যে এক কোণে একটা স্টোভে আগুন জ্বলছে। উল্লাস মনে মনে ভাবলেন, ‘ভেতর থেকে বাইরে তাকালে কি হরিণ দেখা যায় ? ময়ূরের ডাক শোনা যায় ? আহা, কণ্বমুনির আশ্রম যেন ! অপূর্ব !’

অবাক হওয়ার পালা থামল না উল্লাস বাবুর। ‘একটা থ্রি-পিস ড্রাম সেট !’ মনে মনে চমকে উঠলেন উনি। তৎক্ষণাৎ একটা কথাই মাথায় এল ওঁর –‘এই বনেজঙ্গলে এসব টেনে আনল কী ভাবে ?’ কিন্তু একটি প্রশ্নও করলেন না আনন্দকে। ফাঁকতাল বুঝে সরে পড়তে চাইছিলেন উল্লাস রায়।

বসার পাথরটাকে দেখিয়ে আনন্দ বলল, ‘আরে স্যার, গরিবের কুটিরে পায়ের ধুলো দিলেন। বসুন না ! আর ইয়ে…মানে আপনার শুভনামটা এখনও জানা হল না যে !’

এবার খানিক বিরক্ত হয়ে উল্লাস বাবু বললেন, ‘নামে কী আসে যায় ? তোমাকে সাহায্য করলেই হল তো ? দেখো ভাই, আমার অনেক কাজ বাকি। ঝটাঝট নিজের প্ল্যানটা বলে ফেলো দেখিনি।’

নাটকের সংলাপ বলার মতো টেনে টেনে আনন্দ বলল, ‘তাহলে আমি আপনাকে সঙ্কটমোচন বলব। আমার সঙ্কটমোচনই তো আপনি !’

ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগল না উল্লাস বাবুর। উনি সন্দেহ করতে শুরু করলেন আনন্দকে। ‘আদৌ কি ছেলেটা সুইসাইড করতে চায় ?’

মিটিমিটি হাসছে আনন্দ। গা জ্বলে উঠল উল্লাস রায়ের –‘আরে ভাই, প্ল্যানটা কী বলো এবার… !’

‘এক মিনিট। একটু ভেঙে বোঝাই। আমি মরতে চাই। বেটার টু সে, সুইসাইড করতে চাই, কিন্তু দেখাতে চাই আমি নিহত হয়েছি। আত্মহত্যা করলে ঠিক সহানুভূতি পাওয়া যায় না। কিন্তু হত্যা হলে নিহত ব্যক্তি সহানুভূতি পায়। আর…আর একটা রহস্যের গন্ধ থাকবে পুরো ব্যাপারটায়। আত্মহত্যা করলে খুব বেশি হলে একদিন খবরের কাগজের ভেতরের কোনো পাতায় দু’লাইন বেরবে আমার নামে। কিন্তু ওই মরাটাকেই মার্ডার দেখাতে পারলে দিনের পর দিন আমিই হেডলাইন হব। যখনই এমন ভাবে কেউ মরবে, তখনই মিডিয়া আমার উদাহরণ দেবে, বহু বছর পরেও।’

আনন্দর কথা শুনে মাথা ঘুরে গেল উল্লাস বাবুর। ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওঁর মুখ।

‘চা খাবেন ?’

‘হুম ?’

‘বলছি, একটু চা খাবেন স্যার ? টায়ার্ড ভাবটা কেটে যাবে। ঝরঝরে লাগবে।’

উত্তরে হ্যাঁ-না কিছু না বলে উল্লাস বাবু বললেন, ‘প্লিজ, আমাকে স্যার স্যার কোরো না তো। উল্লাসদা বলো। আমার নাম উল্লাস রায়।’ ছেলেটাকে দেখে বড় মায়া হচ্ছিল ওঁর। ওঁর মতোই মরতে এসেছে এখানে। ওঁকে চেনে না, জানে না, তবুও কত বিশ্বাস করে সব বলল। ‘আহা রে !’

‘কিছু বললেন উল্লাসদা ?’

‘ন্না…না। আমি ভাবছিলাম, তোমার মৃত্যুটাকে খুনের মতো করে সাজাব কী ভাবে ?’

ঘন হয়ে বসল আনন্দ। উল্লাসের পায়ের কাছে। তারপর টেবিলের মতো পাথরটার একপাশ থেকে বের করে আনল একটা রিভলবার, একটা নাইলনের দড়ি, একটা ছুরি, আর এক শিশি বিষ।

ছুরিটা হাতে তুলে নিলেন উল্লাস বাবু। দেখার মতো জিনিস। হাতির দাঁতের হাতলটা সোনা দিয়ে বাঁধানো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন উনি। হাতলের পেছনদিকে একটা সোনার সূর্য বসানো রয়েছে।

‘ওটা মাকাল ফল টাইপের জিনিস উল্লাসদা। দেখতেই অত সুন্দর, আত্মহত্যার কাজে লাগল না। অন্তত আমি যেভাবে ভেবেছিলাম, তাতে তো নয় বটেই।’

‘ওর’ম মনে হয়। কখন যে কোন জিনিসটা কাজে লেগে যাবে কেউ আগে থেকে বলতে পারে না। কিছু না কিছু মাথা থেকে ঠিক বেরোবে। কিন্তু ভাই আনন্দ, মরার আগে একটু খেয়েদেয়ে নিলে হতো না ? আমার পেটে বাহান্নটা ছুঁচো মিলে ডন দিচ্ছে।’

‘জো হুকুম মেরে দাদা! এখুনি বানিয়ে ফেলছি ডাবল ডিমের অমলেট, আলুসেদ্ধ, আর ভাত। চলবে তো ?’

‘দৌড়বে !’

বনভোজন হল আক্ষরিক অর্থেই। কিন্তু উল্লাসের মাথায় ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন, ‘আত্মহত্যাকে হত্যা দেখাব কী করে ?’

খাওয়ার পর্ব শেষ হলে উল্লাস আনন্দকে নিয়ে বসলেন। মাথা চুলকে শুরু করলেন উনি, ‘ভাই আনন্দ, একটা কথা আমার বলা হয়নি। তোমার মতো আমিও এই জঙ্গলে মরতে এসেছি। অনেস্টলি বলি, আত্মহত্যা করতে এসেছি। র‍্যাদার টু সে, করতে এসেছিলাম। কিন্তু তোমার পরিকল্পনা এবং যুক্তি দেখে আমার মনেও সাধ জেগেছে নিজের আত্মহত্যাকে হত্যা বলে দেখানোর।’

‘আমার মনে হচ্ছে আনন্দে পাগল হয়ে যাব !’ বলে উঠল আনন্দ।

‘ধুত শালা, পাগল হবি কী রে ! মরা বাকি আমাদের।’

‘আমি ভাবতেই পারছি না যে, কেউ আমার মতোই নিরিবিলিতে আত্মহত্যা করার জন্য এই জঙ্গলে এসেছে, আমার পাশে বসে খেয়েছে, আর আমার সঙ্গে মরবে।’

‘ছাড়ো ওসব কথা। একটা জিনিস বলো তো – তুমি কেন মরতে চাইছ ?’

‘আমি মরতে চাইব নাই বা কেন ? ঘরে টাকা নেই। হাতে কাজ নেই। নো ইনকাম। বাবা দেনা করে রেখেছিল। নিজে চলে গেল রোগ ভোগ করে করে। মা পথ দুর্ঘটনায় চলে গেল গতমাসে। পৈতৃক ভিটেবাড়িটা যক্ষ্মা রোগীর মতো ধুঁকছে। তার গায়ে হাত পড়েনি আজ দীর্ঘ চল্লিশ বছর, যে কোনো সময়ে ভেঙে পড়বে। একটা প্রেম টিমটিম করে বাঁচার আশা জুগিয়ে চলছিল। ক’দিন আগে প্রেমিকাও মেরে চলে গেল আমার…।’

‘থাক ভাই আনন্দ। মরার আগে আবার মনখারাপ করে লাভ নেই।’

‘হ্যাঁ দাদা। একটু ঘুমিয়ে নিই তাহলে ?’

‘আবার ঘুমও হবে ? ভাই, ধন্যি তোমার মরার ইচ্ছা ! সবদিক বজায় রেখে মরছ…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই উল্লাস বাবুর কানে এল আনন্দর নাক ডাকার শব্দ। উনিও শুয়ে চোখ বুজলেন।

ঘুম ভাঙতে একরাশ অন্ধকার দেখলেন উল্লাসবাবু। একমুখ সারল্য নিয়ে আনন্দ অঘোরে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎই উল্লাস বাবু মনে মনে ভাবলেন, ‘আচ্ছা, ছেলেটা যদি না মরে ? আমি আর ও একসঙ্গে বাঁচার উদ্যোগ করলে কেমন হয় ? ঘুম থেকে তুলে বোঝাই তবে।’ হাতঘড়ির হিসেবে টানা তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন দুজনে। ঠেলে তুললেন আনন্দকে, ‘অ্যায় ভাই, ওঠো !’

ঘুম ভাঙতেই আনন্দ যেন ক্ষেপে উঠল –‘এতক্ষণ ডাকেননি কেন উল্লাসদা ? দেরি হয়ে গেল।’

‘দেরি আবার কীসের ? মরার ? আর মরতে হবে না তোমাকে। আমি ঠিক করে নিয়েছি। আমরা দুজনে জঙ্গল থেকে লোকালয়ে ফিরে গিয়ে নতুন করে বাঁচব। খেটে খাব দুই দাদা-ভাইতে।’

কুঁড়েঘরে ততক্ষণে আলো জ্বলে উঠেছে। মশালের মতো একটা দণ্ডের মাথায় জ্বলছে আগুন। সেই মশালটার মতোই জ্বলে উঠল আনন্দও। ‘বাহ্ ! আপনি কোথাকার কে এসে ঠিক করে ফেললেন আমি মরব কি মরব না ! নিজেও এই মরব বলছিল, আর এখুনি বলছে আর মরতে চাই না। শালার মাথায় ছিট আছে !’

কথা শেষ করেই উন্মাদের মতো হাতের সামনে থাকা সব জিনিস ছুঁড়তে আরম্ভ করল আনন্দ। কোনটা উল্লাসকে লক্ষ্য করে, আবার কোনটা উদ্দেশ্যহীন ভাবে কুঁড়েঘরের বাইরের অন্ধকারে। তারপর হাতে কিছু একটা তুলে ধরে আগুনে চোখ নিয়ে তাকাল উল্লাস বাবুর দিকে।

এতক্ষনে উল্লাসবাবু বুঝে গেলেন যে, ও আসলে কিছু ছুঁড়ছিল না বরং একটা জিনিস খুঁজছিল। রিভলবার। ঠিক কী ঘটতে চলেছে তা মুহূর্তে বুঝে গেলেন উল্লাস বাবু। টেবিলের মতো ব্যবহার করা পাথরটার আড়ালে ঝাঁপ দিলেন উনি। অন্ধকারে ডানদিকের রগের কাছটা ঘসা খেল কোথাও। আনন্দ ততক্ষণে মশালটাকে হাতে ধরে বেরিয়ে গেছে কুঁড়ের বাইরে। বন্দুকের নল তাক করা কুঁড়ের দরজার দিকেই। অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে কুঁড়ের বাইরের দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা করলেন উল্লাসবাবু। আর তখনই হাতে উঠে এল হাতির দাঁতের তৈরি হাতলওয়ালা ছুরিটা।

ছুরিখানাকে তুলে ধরে কুঁড়ের ভেতর থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে এসে আনন্দকে লক্ষ্য করে চিতাবাঘের মতো লাফ দিলেন উল্লাস রায়। আনন্দর হাতের রিভলবার গর্জে উঠল। জঙ্গলের অন্ধকার আর নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিল বুলেটের শব্দ ! গোঙানির শব্দ হল একজনের মুখ থেকে। আরেকজন করে উঠল আর্তনাদ ! দুটো শরীর নিজেদের ওজন নিয়ে লুটিয়ে পড়ল বনের মাটিতে।

কতক্ষণ ওভাবে পড়ে ছিলেন জানেন না উল্লাসবাবু। উঠে বসলেন। মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছিল। মশাল নিভে গেছে এরই মধ্যে। হ্যাং ওভারের মতো লাগছে। মনে করার চেষ্টা করলেন যে ঠিক কী ঘটেছিল। সব মনে পড়ল। সব ভুলে গলায় আবেগ নিয়েই ডেকে উঠলেন, ‘আনন্দ…ভাই, তুমি কোথায় ?’ সাড়া এল এক ডাকেই –‘আপনার পেছন দিকে আছি।’

অন্ধকারে আন্দাজ করে আনন্দকে তুলে ধরলেন উল্লাস। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছুরিটা লেগে যায়নি তো ?’

‘না। গলা ঘেঁষে বেড়িয়ে গিয়েছিল। একবার মনে হল গলাটাই নেমে যাবে। এ যাত্রা বেঁচে গেলাম !’

‘আমারও লাগেনি তোমার গুলি। মাথা লক্ষ্য করে কেউ গুলি চালায় ? লাগলে মরে যেতাম। সত্যি সত্যিই আমাদের মৃত্যুকে হত্যা বলে মনে হতো। চলো, এখানে আর এক মুহূর্তও নয় ! বাইরের জগত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’

‘চলুন দাদা।’

দুজনে উঠে দাঁড়াল। আকাশে আজ পূর্ণিমা। রূপোর ঢেউতে ধুয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চল। দীর্ঘ গাছেদের ছায়া পড়ছে দীর্ঘতর হয়ে। শুধু ওদের দুজনের কোনো ছায়া নেই। ওরা যে জায়গাটা ছেড়ে যাচ্ছে, সেখানে পড়ে রয়েছে দুটো শবদেহ। একজনের কপালে গুলির ক্ষতচিহ্ন, আরেকজনের গলার নলিটা ছিন্ন হয়ে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে। কালচে রক্ত জমাট বেঁধেছে ঝরা পাতার বুকে। সেখানেও রূপোলি আলোর ঢেউ।

মূল গল্পের নাম ‘দ্য পারফেক্ট সুইসাইড’। শুধু ভাষান্তর নয়, গল্পের খোলনলচে পালটে ফেলা হয়েছে আদ্যন্তভাবে। শিপ অব থেসাসে যেমন জাহাজখানাকে সারাতে সারাতে তার একটা কাঠও আর পুরোনো জাহাজের ছিল না, তেমনই বদলে গেছে এই গল্পটিও। তবুও চিন্তাধারায় মূল গল্পের লেখকের ছাপ রয়ে গেছে বলে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

 

6 thoughts on “Onubad – Ullas Ebong Anonder Mrityu

  1. অনুবাদ পড়ছি বলে মনে হলোনা। দারুণ লাগলো পড়তে।

  2. খুব ভালো লাগলো,বেশ প্রাঞ্জল ঝরঝরে,মূল লেখকের নিবাস কোথায় জানা হলো না!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *