poem-bikrampurer-mati

বিক্রমপুরের মাটিতে মাথাটা ঠেকিয়ে আসিস
সন্তোষ ঢালী

বাংলাদেশের কথা শুনেই ভেজা কণ্ঠে ঠাকুরদা বলে ওঠেন-
বিক্রমপুরের মাটিতে মাথাটা একটু ঠেকিয়ে আসিস;
ঠাকুরদার বয়স যখন কুড়ি, বরিশালের মেয়ে ঠাকুরমার ন’ বছর; বিয়ে হলো,
তারপর দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে সাতচল্লিশে দেশছাড়া
সেই থেকে শেকড়হীন শেকড়ে জীবন রেখে একটু মমতারসের আক্ষেপ
যাপিত জীবনের সবটুকু জুড়ে করুণ দীর্ঘশ্বাস।
দিন মাস বছর বহুবার চোখের জলে নদীর জলে একাকার, ঘর ভর্তি নতুন জীবন
বৃক্ষের মতো শাখা-প্রশাখা গজায় সংসারেও-
বাংলাদেশের নাম শুনলেই ঠাকুরমা প্রায়শ আঁৎকে ওঠেন
মৃদু হাওয়ায় কম্পমান কচি বাঁশপাতার মতো,
দ্বিজাতিতত্ত্বের রক্তমাখা খড়গ নেমে এসেছিল আসমান থেকে দৈবাৎ,
বাবা আর ভাইকে কুপিয়ে খুন করেছিল ধর্মান্ধ পিশাচ নৃশংস রাতে
এখনও সেই রক্ত ফিনকি দিয়ে ছোটে বুড়িগঙ্গা থেকে গঙ্গা চোখের তারায়-
জলবিহীন বৃক্ষের যন্ত্রণায় ঠাকুরদা গত হয়েছেন কয়েক বছর, ঠাকুরমাও
আমার আর বিক্রমপুর যাওয়া হয় নি মানুষের জটিল বিধি-নিষেধে,
বাংলাদেশে যাবার কথা মনে হলেই মনে পড়ে-
সরোদের ঝালার মতো কী এক আবেগমাখা ভেজা কণ্ঠে ঠাকুরদা বলেছিলেন-
বিক্রমপুরের মাটিতে মাথাটা একটু ঠেকিয়ে আসিস;
সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসার সময় পাশের বাড়ির রুস্তম শেখকে
বিনে পয়সায় দিয়ে এসেছিলেন তার জায়গা-জমি সব,
প্রাণের বন্ধু রুস্তম চোখের জল ছাড়া আর কোনো ভরসা দিতে পারে নি ঠাকুরদাকে;
চামড়ায় বাঁধানো একটা শ্রীমদ্ভগবত গীতা ছিল ঠাকুরদার
চোখের জল মুছতে মুছতে রুস্তমের হাতে সেটা দিয়ে বলেছিলেন-
রুস্তম, এটাও তোর কাছে রেখে দে, আমি আর কোথায় নিয়ে যাব?
সযত্নে রেখেছে সে তার প্রাণের বন্ধুর আবদার,
তার ঘরেই লাল কাপড়ে বাঁধা ছিল পবিত্র কোরান শরিফ
রুস্তম সেই একই কাপড়ে যত্নে জড়িয়ে রাখলো কোরান আর শ্রীমদ্ভগবত গীতা;
কেমন করে দু’টো ধর্ম, দু’টো দর্শন এক হয়ে গেল, একই সাথে থাকে দিনরাত
বছরের পর বছর সাতচল্লিশ বায়ান্ন একাত্তর;
তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় না, বিবাদ হয় না, রক্তপাত হয় না
অথচ ওদের নিয়েই মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি!
লাল কাপড় বিবর্ণ হয়, ধুলো জমে গায়ে; দুই গ্রন্থে কোনো বিবাদ হয় না
যেমন বিবাদ হয় না পুরুলিয়া আর বিক্রমপুরের মাটিতে;
ঠাকুরদা বলেছিলেন- বিক্রমপুরের মাটিতে মাথাটা একটু ঠেকিয়ে আসিস,
বিক্রমপুরের মাটির গন্ধও কি সেই আগের মতোই আছে,
যেখানে মিশে আছে ঠাকুরদার শৈশব কৈশোরের ঘাম?

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *