বাংলার ব্যঙ্গচিত্র

বাংলার ব্যঙ্গচিত্র
চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়
Whenever you have to say something with a punch, tell it with a cartoon.
মানুষের মধ্যে ন’ধরণের রস প্রবাহিত হয়। আনুষঙ্গিক রসগুলি এর মধ্যে পড়লেও আসল কথাটা হলো রসবোধ। মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর প্রধান পার্থক্যটাই হলো মানুষের রসবোধ আছে। প্রাণীর তা নেই। থাকলেও তার বহিঃপ্রকাশ নেই। আর তাই মানুষের এই রসবোধ থেকেই জন্ম নেয় একটা শিল্প – ব্যঙ্গশিল্প। শিল্প অর্থে শুধু আঁকা নয় – লেখাও। কারণ ব্যঙ্গসাহিত্য ও ব্যঙ্গচিত্র সবসময়েই একে অন্যের পরিপূরক। যেহেতু লেখার প্রচলন পৃথিবীতে এসেছে রেখার প্রচলনের অনেক পরে। তাই পৃথিবীতে এই শিল্পটির জন্ম রেখার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় কয়েক হাজার বছর আগে। কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র বলতে বোঝায় – উন্নতশৈলীর রেখাচিত্র দিয়ে একটি সমসাময়িক ঘটনার রসঘন প্রকাশ।

ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন কথাটি এসেছে ইতালির – কার্তোন(Kartone) থেকে। আগেকার দিনের শিল্পীরা বড় মাপের কোনও পেন্টিং-এ হাত দেবার আগে খুব বড় মাপের কাগজে সেই ছবিটার একটা খসড়া আঁকতেন। কাঠ-কয়লা, পেনসিল ও চক দিয়ে সেই খসড়া হতো। যে বড় কাগজে এই খসড়া ড্রইং করা হতো তার নাম কার্তোন। এর থেকেই কার্টুন কথাটির উদ্ভব। খ্রীষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগে প্যাপিরালে আঁকা ক্যারিকেচার ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। সেটিকেই প্রথম কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র হিসেবে ধরা হয়। ছবিটির বিষয়বস্তু হচ্ছে সিংহ এবং হরিণ (বাজি রেখে বোধহয়) দাবা জাতীয় কোন খেলায় ব্যস্ত।

ভারতবাসীগণও বহুযুগ থেকে এই নবরসের আস্বাদনে অভ্যস্থ ছিল। তারই প্রকাশ দেখা যায় প্রাচীন সংস্কৃত নাটকে। প্রাচীন ভাস্কর্যেও এই ব্যঙ্গ পরিলক্ষিত হয়। যদিও কালের গতিতে আজ অনেক কিছুই বিলুপ্ত, তবু যা পাওয়া যায় তাতেই আজও দর্শক হৃদয় অনুরণিত হয়। যেমন অজন্তা গুহাচিত্রের লোভাতুর ভিক্ষুক, অগ্রদানী ব্রাহ্মণটির চিত্রায়ণ। রসিকজনেরা শুধুমাত্র নিজেদের ন’ধরণের চরিত্র সৃষ্টিতে আবদ্ধ রাখেননই। দেবদেবীর মূর্তিতেও ত্রিভঙ্গ রূপ নিয়ে রসে মজা করেছেন। যেমন গণেশের নর রূপটি।

আধুনিক যে অর্থে কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র কথাটি ব্যবহার করা হয় তার চল অবশ্য খুব বেশিদিনের নয়। ১৮৪৩ সালে লণ্ডনের পাঞ্চ (PUNCH) পত্রিকায় ১০৮ নম্বর সংখ্যায় জন লীচের আঁকা একটি হাস্যরসাত্মক ছবিকে সর্বপ্রথম কার্টুন আখ্যা দেওয়া হয়। এর আগে অবশ্য কার্টুন ছিল ক্যারিকেচার পর্যায়ে। অবশ্য কলকাতা তখন উন্মোচিত কালিঘাটের পটচিত্রে। ১৮৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ব্যঙ্গচিত্রের আদিপুরুষ ও পথপ্রদর্শক গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলার রেনেসাঁস যুগের যে বিপ্লব জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অবদানে পুষ্ট ছিল, তাকে গগনেন্দ্রনাথ তুলির টানে এগিয়ে নিয়ে যান এক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
গগনেন্দ্রনাথের তিনটি ব্যঙ্গচিত্র সম্বলিত অ্যালবাম একদা প্রকাশিত হয়েছিল – ‘অদ্ভুত লোক’, ‘বিরূপ যন্ত্র’ ও ‘নবহুল্লোড়’। তবে একেবারে নিখাদ ব্যঙ্গচিত্র না হলেও ক্যারিকেচার জাতীয় ছবি আঁকার ব্যাপারে অনেকেই উৎসাহী ছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই মাধ্যমটিকে ভরিয়ে তুলেছিলেন তাঁর তুলির ভাষায়। রবীন্দ্রনাথের আঁকা বেশ কিছু ছবি ক্যারিকেচারধর্মী। বিশেষ করে মুসোলিনী ছবিটি। গগনেন্দ্রনাথের পর যাঁর আঁকা এবং লেখা বাংলা সাহিত্য ও ব্যঙ্গচিত্রকে ঋদ্ধ করেছে তিনি হলেন সুকুমার রায়। সুকুমার রায়ের আঁকা ছবি বাঙালি মননে অনেকটাই অধিকার করে আছে।
এরপর আসে যথাক্রমে চঞ্চলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বনবিহারী মুখোপাধ্যায়, বিনয় কুমার বসু, যতীন্দ্রকুমার সেন, চারু রায়, দীনেশরঞ্জন দাস, সতীশ চন্দ্র সিংহ, জ্যোতিষচন্দ্র সিংহ প্রমুখের নাম। চঞ্চলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম ব্যঙ্গসাহিত্য ও ব্যঙ্গচিত্রের যুগলবন্দী সৃষ্টি করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের কলির সঙ্গে তাঁর আঁকা রঙিন ব্যঙ্গচিত্রগুলো সে যুগে বাঙালি মোসাহেব ও কেরানীদের দুঃসহ জীবনধারাকে পরিস্ফুট করেছিল। ত্রৈলোক্যনাথের গল্পের সঙ্গেও একাত্ম ছিল চঞ্চলকুমারের ব্যঙ্গচিত্র। পেশায় নিখাদ বৈদ্য হলেও তুলি কালি নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন বনবিহারী মুখোপাধ্যায়। এনারই অনুজ বিখ্যাত শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। মানুষের সামাজিক আর নৈতিক ভুলচুক সম্পর্কে সচেতনতা আনতে বনবিহারীর ব্যঙ্গচিত্রগুলি চিত্রিত হয়েছিল। ব্যঙ্গচিত্র বিনয় কুমার বসু ছিলেন বিশ শতকের অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী। বিনয় নামে একাধিক ব্যঙ্গচিত্রের সিরিজ তিনি তৎকালীন বসুমতী, ভারতবর্ষ, সচিত্র শিশির প্রভৃতি পত্রিকায় এঁকেছিলেন।

যতীন্দ্রকুমার সেন ‘নারদ’ ছদ্মনামের আড়ালে নিয়মিত রাজশেখর বসুর (পরশুরাম) গল্পের সঙ্গে ছবি আঁকার সঙ্গত করে গেছেন। যদিও আলাদাভাবে তিনি ব্যঙ্গচিত্র খুব কম একেছেন তবু তাঁর ব্যঙ্গরসাত্মক ছবিগুলি ছিল অসাধারণ। সতীশ সিংহ – জ্যোতিষ সিংহ, দুই ভাইয়ের অয়েল পেন্টিং বেশি পছন্দের হলেও জ্যোতিষ সিংহ নিয়মিত বসুমতী, সচিত্র শিশির পত্রিকায় ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন। নিখাদশিল্পী ও ভাস্কর হওয়া সত্ত্বেও দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী বাবু কালচারের বিরুদ্ধে প্রচুর ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন। এর পরবর্তীতে বাংলা ব্যঙ্গচিত্রের জগতে এক নতুন প্লাবন আসে। পুরোধা হয়ে এগিয়ে আসেন প্রমথ সমাদ্দার, প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী, ও শৈল চক্রবর্তী। বাংলা ব্যঙ্গচিত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করায় এঁদের দান অসামান্য।

গগনেন্দ্রনাথ যদি বাংলা ব্যঙ্গচিত্রের জনক হন তাহলে পি.সি.এল নিঃসন্দেহেই আধুনিক ব্যঙ্গচিত্রের প্রবর্তক। প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী পি.সি.এল এবং কাফী খাঁ এই দুই নামেই ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন। ইতিহাসের অধ্যাপক ও বেহালাবাদক এই শিল্পীর হাতে রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রের এক নতুন রূপ উন্মোচিত হয়। তাঁর আমেরিকা সফরকালে সেখানেও তাঁর ব্যঙ্গচিত্র নিয়মিত ছাপা হতো। ১৯৩৪ সালে তিনি অমৃতবাজার পত্রিকায় যোগ দেন স্টাফ কার্টুনিস্ট হিসাবে। এদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যঙ্গচিত্রী যিনি আমৃত্যু এই শিল্পমাধ্যমটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণে তাঁর তুলনীয় ব্যঙ্গচিত্রী ছিল তখন নগণ্য। বাচ্চাদের জন্য তিনিই প্রথম কমিক স্ট্রিপ আঁকতে শুরু করেন। অমৃতবাজারে আঁকতেন ‘খুড়ো’ আর যুগান্তরে ‘শিয়াল পণ্ডিত’। এছাড়া পি.সি.এল বিদেশি স্টাইলে একটি অ্যালবামের প্রবর্তন করেন এ দেশে – ‘কাফিস্কোপ’। বুড়ো আঙ্গুল ও তর্জনীর চাপে দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টে গেলে একটা সম্পূর্ণ কমিক স্ট্রিপ ফুটে উঠতো। এছাড়া তাঁর এক অক্ষয় কীর্তি এখনও রয়ে গেছে বিড়লা তারামণ্ডলে। দক্ষ আর্কিটেকচারের মতো তিনি তৎকালীন কলকাতার স্কাইলাইনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন তারামণ্ডলের ভিতরের দেওয়ালে। গান্ধীজী ও নেতাজীকে নিয়ে তিনিই প্রথম দুটো বায়োগ্রাফিক্যাল স্কেচবুক প্রকাশ করেন ‘সত্যের সন্ধানে’ নাম দিয়ে। পি.সি.এল এর ব্যঙ্গচিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ তা কখনই ক্যাপশনের ভারে নুয়ে পড়েনি। ক্যাপশনলেস ব্যঙ্গচিত্র আঁকাতেই ছিল তাঁর মুনশিয়ানা।

রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অবক্ষয়তাকে তুলির নিপুণটানে নিয়মিত পুষ্ট করতেন প্রমথ সমাদ্দার। শুধু বড়দের জন্য নয়। শিশুদের জন্যেও নিয়মিত ব্যঙ্গচিত্রের চর্চা করে গেছেন শৈল চক্রবর্তী। যদিও কাফী খাঁ এখানে প্রথম স্ট্রিপ কার্টুন আঁকতে শুরু করেন, কিন্তু তা জনপ্রিয়তা লাভ করে শৈলবাবুর হাত দিয়েই। তাঁর সৃষ্ট ‘ডাকু’ সিরিজের কার্টুন অনবদ্য। যুদ্ধ দপ্তরের বিজ্ঞাপনেও তাঁর আঁকা কার্টুন ব্যবহৃত হয়েছে। তবে শৈলবাবুর প্রিয় বিষয় ছিল পেন্টিং। নেচার স্টাডি বা চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকতে তিনি ছিলেন অগ্রণী। ওয়াশ দিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকায় তাঁর সমকক্ষ ভারতবর্ষে কেউ নেই। কলকাতা দূরদর্শনের জন্য তিনিই প্রথম পাপেট নক্‌ মানোট বানান বাচ্চাদের জন্য। অ্যানিমেশন নিয়েও তিনি প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। শিবরাম চক্রবর্তীর যাবতীয় গল্পের ছবি এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র টেনিদার চরিত্র চিত্রায়ণ ইনিই করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা বাংলা গল্পের ভেতরে ইলাসস্ট্রেশন শৈলবাবুই শুরু করেন শারদীয় আনন্দবাজারে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘ল্যাবরেটারী’র মাধ্যমে।

ঠিক এর পরবর্তীকালে আসেন রেবতীভূষণ ঘোষ, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, চণ্ডী লাহিড়ী প্রমুখ। তুলির ব্যবহারে অসামান্য দক্ষতার অধিকারী ছিলেন শিল্পী রেবতীভূষণ ঘোষ। বিশেষ করে পোর্ট্রেট ক্যারিকেচার ও জীবজন্তুর ছবি আঁকায় তাঁর শৈল্পিক গুণ আন্তর্জাতিক মানের। সামাজিক ব্যঙ্গচিত্রেও তাঁর সমান দক্ষতা ছিল। মূলত নিখাদ শিল্পী হলেও দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ও বেশ কিছু ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন। বিশেষত রাজনৈতিক প্রয়োজনে। স্বাধীন ভারতের নির্বাচনী প্রচারে ব্যঙ্গচিত্রকে দলীয় প্রচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে প্রাচীর চিত্রের ব্যঙ্গচিত্র নাম দিয়ে বাংলায় প্রথম শুরু করেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। এরপরই নাম করতে হয় চণ্ডী লাহিড়ীর। চণ্ডী নামের আড়ালে এই বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ম মেধার মানুষটি প্রতিনিয়ত বাংলা ব্যঙ্গচিত্রকে ভরিয়ে দিয়েছিলেন সোনার ফসলে। শুধু রেখায় নয়। রম্যরচনাতেও তিনি সমান সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এছাড়া পূর্ণ দৈর্ঘ্যের অ্যানিমেশন ফিল্ম চণ্ডী লাহিড়ীই প্রথম তৈরি করেন এখানে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র সব্যসাচীর মতন এঁকে গেছেন তিনি।

এরই মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেন আরও বহু ব্যঙ্গচিত্রী। বাংলা ব্যঙ্গশিল্প ভরে ওঠে সোনার ফসলে। রবীন, কুমার অজিত, কমল সরকার, অহিভূষণ মালিক, চক্রধর শর্মা, ওমিও, ভাদুভাই, কাজী, সুফি, সুকুমার, রামকৃষ্ণ, নারায়ণ দেবনাথ, অমল চক্রবর্তী প্রমুখেরা নিয়মিত আঁকতেন তৎকালীন পত্রপত্রিকায়। এর মধ্যে ব্যতিক্রমী শুধু নারায়ণ দেবনাথ, যিনি সুদীর্ঘকাল ধরে শুধুই কমিক স্ট্রিপ এঁকে চলেছেন। তাঁর সৃষ্ট হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে আজ বাঙালির গর্ব। এছাড়া অনেক প্রখ্যাত লেখকও অনেক সময়েই ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন বেশ কিছু। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুল, শিশু সাহিত্যিক অনিল নিয়োগী (স্বপনবুড়ো), হিমানীশ গোস্বামী অনেক ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে শতাব্দীর দ্বার পেরিয়ে এসে বাংলার ব্যঙ্গচিত্র বর্তমানে এক করুণ অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাংলা ব্যঙ্গশিল্পের যে স্বর্ণযুগ সূচিত হয়েছিল গগনেন্দ্রনাথের হাতে, আজ তার সূর্য প্রায় অস্তমিত। এখনও শুধুমাত্র ব্যঙ্গচিত্রকে পেশা করে নিয়মিত ছবি এঁকে চলেছেন মাত্র এক আশিঊর্দ্ধ মানুষ অমল চক্রবর্তী। অমল চক্রবর্তীকে যদি বাংলার শেষ সফলতম ব্যঙ্গচিত্রী ধরা হয় তারপরেও কেটে গেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। বাংলার ব্যঙ্গশিল্পে আর কোন ব্যঙ্গশিল্পী এই পেশাকে জীবিকা হিসাবে নিয়ে আর কাজ করছেন না। অবশ্য সুখের কথা এই প্রজন্মের অনেকেই আবার ব্যঙ্গচিত্র আঁকছেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে। অমল চক্রবর্তীর পর যদি এই শিল্পের প্রতি কারও একনিষ্ঠতার কথা বলা চলে তো তিনি নিঃসন্দেহে দেবাশীষ দেব। যদিও নিখাদ ব্যঙ্গচিত্রের থেকে জীবিকার প্রয়োজনে তাঁকে অনেক বেশি হাস্যরসাত্মক ইলাস্ট্রেশন করতে হয়। তবুও তাঁর আঁকা ব্যঙ্গচিত্রগুলি অসাধারণ। এই প্রজন্মের তিনিই শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গচিত্রী। আরও অনেকে সক্রিয়ভাবে ব্যঙ্গচিত্র আঁকছেন – তমাল ভট্টাচার্য, উদয় দেব, অভিজিৎ, ঋতুপর্ণ, সৌকর্য, অভী, রৌদ্র, সেন্টু, জুরান, অর্ক, চিরঞ্জীত প্রমুখেরা। দু’একজন চেষ্টাও করছেন ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে ভাবনাচিন্তার। কিন্তু তারাও স্থায়ী হতে পারছেন না, মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, সারা ভারতবর্ষে কোনও আর্ট স্কুলে বা কলেজে ব্যঙ্গচিত্র শিল্প শেখার কোনও আলাদা সিলেবাস নেই। কোথাও শেখানো হয় না। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে ব্যঙ্গচিত্রকে জনপ্রিয় বা উৎসাহিত করার জন্য যে ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা বা কাগজের নেবার কথা ছিল তা তারা কেউই পালন করেননি। অর্থনৈতিকভাবে এখানে ব্যঙ্গচিত্রীদের সামান্যতম ভবিষ্যৎও নেই। তৃতীয় কারণটিই মুখ্য। সেটি হলো ব্যঙ্গসাহিত্য ও ব্যঙ্গপত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে শিবরাম চক্রবর্তীর পর আজ বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গধর্মী রচনার মান অনেকখানি পড়ে গিয়েছে। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, নবনীতা দেবসেনদের পরবর্তী আর কোনও ব্যঙ্গলেখক উঠে আসেননি। একথা অনস্বীকার্য যে ব্যঙ্গসাহিত্য ও ব্যঙ্গচিত্র একে অন্যের পরিপূরক। ব্যঙ্গসাহিত্যে যেমন আকাল এসেছে, তেমনই একে একে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাংলার সবকটি ব্যঙ্গপত্রও। ১৮৭৪ সালে শুধুমাত্র ব্যঙ্গচিত্র ও ব্যঙ্গসাহিত্যের জন্য প্রকাশিত হয়েছিল বসন্তক, হরবোলা ভাঁড় পত্রিকা। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সব আজ বন্ধ। বসন্তক থেকে শুরু করে সচিত্র ভারত, সচিত্র শিশির (১৯২৩), বিদূষক (১৯১৩), বেপরোয়া (১৯২১), শনিবারের চিঠি (১৯২০), রবিবারের লাঠি (১৯২৯), অচলপত্র (১৯৪৯), যষ্টিমধু, সরস কার্টুন সবই আজ কালের গভীরে। এছাড়াও ছিল মজলিস, টেক্কা, রসরাজ, বঙ্গীয় ভাঁড়, বিদ্রুপ, অবতার প্রভৃতি কাগজ।

বাংলাদেশে আঁকা ব্যঙ্গচিত্র দেশের পথিকৃৎ হিসেবে এই শতকের কয়েকটা দশক ভরিয়ে তুলেছিল সোনার ফসলে। শুধু ব্যঙ্গচিত্র নয়, ব্যঙ্গসাহিত্যে ও ব্যঙ্গপত্রিকারও সে সময়টা ছিল রেনেসাঁসের যুগ। কিন্তু স্ফুলিঙ্গের মতোই তার জ্বলে ওঠা ও নিভে যাওয়া। আজ শুধু স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো। অথচ এই স্বল্প সময়েই বাংলার ব্যঙ্গচিত্র পৌঁছেছিল এক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। আজ সবাইকে বেশি করে ভাবতে হবে ব্যঙ্গচিত্রের বিষয়ে। সুখের কথা এতদিন বাদে কার্টুনের স্বাধিকার নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘কার্টুনদল’ নামে একটি সংস্থা। সেখানে বাংলার এই হারিয়ে যাওয়া গৌরব নিয়ে নিয়মিত আলোচনা, প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবু সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে আরও উৎসাহ নিয়ে, নয়তো একদা প্রাচুর্যে ভরপুর এই শিল্প স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *