prabandho-banglar-prachin

বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য-নিদর্শন
খন্দকার মাহমুদুল হাসান

শিকারি যুগে যেসব আদি-মানব বাংলাদেশে বাস করতো তাদের যে ঘরবাড়ির মতো কোনো স্থায়ী আবাসস্থল ছিল না তা বলা যায় সহজেই। শিকারি মানুষকে এক জায়গায় থিতু হলে চলে না৷ কৃষি আবিষ্কারের আগে কৃষি-গ্রাম গড়ে ওঠেনি। ডাল-পাতার ঝুপড়ি বানানোরও দরকার হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার বীরভনপুরে প্রায় ছয় হাজার বছর আগেকার ছোটো আকারের প্রস্তর হাতিয়ার পাওয়া গেছে। বীরভূম জেলার পাণ্ডুরাজার ঢিবিও প্রাচীন মানবের বসতি থাকার প্রমাণ বহন করে। বীরভনপুর প্রত্নস্থলে খুঁটি পোঁতার গর্তের সন্ধান মিলেছে। খুঁটিগুলো বাঁশ, কাঠ বা পাথরেরই হোক, সেই খুঁটির ওপরে চাল ছিল বলে ধারণা করা যায়। এতে যে দৃশ্যকল্প ফুটে ওঠে তাতে আমরা কিছু ঘর দেখতে পাই। সেগুলো খুঁটিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চালাঘর। কোনো দালানকোঠা সেগুলো ছিল না বটে, তবে মানুষের নির্মাণ- নিদর্শন যে ছিল তাতে সন্দেহ নেই। নিহাররঞ্জন রায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন-

‘দামোদর নদের তীরে বীরভানপুর গ্রাম। এই গ্রামে একটি স্থানে উৎখননের ফলে অসংখ্য স্ফটিক ও অন্যান্য গুঁড়ো পাথরের তৈরী ক্ষুদ্রাশ্মীয় কারুযন্ত্র পাওয়া গেছে, তিন ফুট মাটির নীচে। তারও নীচে নবাশ্মীয় পর্বের সমভূমিতে গোচর হয়েছে কয়েকটি গর্ত ; গর্তগুলি যে বাঁশের বা কাঠের বা পাথরের খুঁটির তা সহজেই অনুমেয়। ‘
( সূত্র : নিহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০১, পৃ.৬১)

পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের প্রাচীন ভূমিতে বাংলা অঞ্চলের পুরামানবের বসতি থাকার ব্যাপারে সন্দেহ রাখা চলে না। এই জেলাগুলোর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ারের সন্ধান মিলেছে। বাংলাদেশের কুমিল্লা, নরসিংদী, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটির মতো জেলা থেকেও পাওয়া গেছে প্রস্তর যুগের হাতিয়ার। যেহেতু সেকালের মানুষ রাত কাটানোর জন্য গর্ত, গুহা বা গাছের ডাল ব্যবহার করতো, তাই সেকালের মানুষের আবাসস্থল খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে দূর অতীতে বাংলাদেশের মানুষ হয়তো ডাল- পাতা- বাঁশ দিয়ে বানানো কুঁড়েতে বাস করতো। মাটির ঘরও যে বানানো হতো তাতেও সন্দেহ নেই। যেহেতু এদেশের বেশিরভাগ জায়গায় পাথর পাওয়া যায় না, তাই পাকা ইমারতের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ইটের প্রচলন পর্যন্ত। তবে প্রথম ইমারতটা কোথায় নির্মিত হয়েছিল তা বলা দুষ্কর।

বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানে ফ্রান্সের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথভাবে পরিচালিত ১৯৯২-১৯৯৩ সালের খননকাজের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে (২০০১ সালে প্রকাশিত) সম্ভাব্য মৌর্যপূর্ব, মৌর্য ও মৌর্য পরবর্তী প্রাচীন নির্মাণ কাঠামোর বিবরণ আছে। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পূর্ব দিককার দুর্গপ্রাচীর এলাকার ১ থেকে ৪ নম্বর স্তরে পাওয়া গেছে মেঝেসহ মাটির ঘর, ইট বিছানো মেঝে ও খুঁটির গর্ত। এই স্তর থেকে মানব বসতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রত্ন-নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই স্তরটির সময়কাল মৌর্যপূর্ব যুগ বলে মনে করা হয়। এর উপরের স্তরে অর্থাৎ খননকাজের পঞ্চম স্তরে মাটির দেয়াল, ভাঙা টালি, ইটের টুকরো ও মেঝের অস্তিত্ব শনাক্ত করা গেছে। তেজস্ক্রিয় কার্বন পরীক্ষায় এই স্তরের সময়কাল খ্রি. পূ. ৩৬৬ থেকে খ্রি.পূ. ১৬২ অব্দ ও খ্রি.পূ. ৩৭১ থেকে ১৭৩ অব্দ নির্ধারিত হয়েছে। অর্থাৎ এই স্তরের সময়কাল খ্রি.পূ. চতুর্থ শতক। এই বিবেচনায়ও এর নিম্নতর স্তরটি আরও প্রাচীনতর। ১৯৯৩ -১৯৯৯ সালের খননকাজের ৬, ৭ ও ৭(বি) নং স্তরের সময়কাল তেজস্ক্রিয় কার্বন পদ্ধতিতে নির্ণীত হয়েছে খ্রি.পূ. ৭১ থেকে খ্রি পূ. ১৭৩ অব্দ, খ্রি.পূ. ৩৬৭ থেকে খ্রি.পূ. ৮৫ ও খ্রি.পূ. ৩৭০ থেকে খ্রি.পূ. ৭২ অব্দ। অর্থাৎ সময়কাল খ্রি.পূ. চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শতক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রথম শতক পর্যন্ত। এই সময়ের নির্মাণকাজে মাটি, ইট, কাঠ ও টালির ব্যবহার দেখা যায় (সূত্র: খন্দকার মাহমুদুল হাসান, প্রথম বাংলাদেশ কোষ, প্রথম খণ্ড,দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, ২০০৬, পৃ.১৩৬, ১৩৭) ৷


ওপরে উপস্থাপিত তথ্যগুলো বিবেচনা করে এ কথায় আস্থা রাখা চলে যে, মৌর্যপূর্ব যুগের ইমারত-কাঠামোর সন্ধান বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। ইমারতে কাদামাটি, ইট / ইটের টুকরো এবং টালির ব্যবহার হয়েছিল। খুঁটির চিহ্ন দেখে বোঝা যায়, ছাদের ভারবহনকারী খুঁটির ব্যবহারের ধারাবাহিকতা চলছিল। বাংলার নির্মাণ ঐতিহ্যের প্রাচীনতার আদি ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে।

প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য-নিদর্শনের বিপুল সংখ্যকই ধর্ম সংশ্লিষ্ট। মন্দির, বৌদ্ধ বিহার, স্তূপ প্রভৃতি এর অন্যতম। বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মীয় প্রভাবের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের ইতিহাসও দীর্ঘকালের। প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যকর্মে তাই এই প্রধান প্রধান ধর্মমতগুলোর প্রভাব ছিল। বাংলার বেশ কিছু অংশ খ্রি.পূ. তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের আমলে মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। মৌর্যযুগ, এমনকি তার আগে থেকেই বাংলাদেশের কোনো না কোনো এলাকায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়ে থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভাব্য গুপ্তযুগের ( খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক ) আগেকার বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনা এদেশে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা মোটেই সহজ নয়।

বাংলাদেশে আবিষ্কৃত বেশিরভাগ প্রাচীন মন্দিরই বৌদ্ধ ধর্ম সংশ্লিষ্ট। অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের বৌদ্ধ বিহারগুলোতে মন্দির থাকতো। পালযুগীয় বড়ো বিহারে সাধারণত কেন্দ্রীয় মন্দির থাকতো। চৈত্য এবং স্তূপও ধর্ম সংশ্লিষ্ট স্থাপনা। এগুলো ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

নির্মাণকর্মে গাঁথুনির জন্যে কাদামাটি ব্যবহার করা হতো। আর বাইরের দেয়াল সজ্জার জন্যে ব্যবহৃত হতো টেরাকোটার অলংকৃত ফলক। ফলকে ধর্মীয় বিষয়ের বাইরের বহুকিছুর চিত্রই থাকতো। যেমন, পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের বাইরের দেয়ালের গায়ে সাঁটা প্রায় দুই হাজার ফলকের মধ্যে ধর্ম সংশ্লিষ্ট ফলক ছিল হাতে গোনা। সমকালীন জীবনধারার চিত্র সম্বলিত ফলকেরই ছড়াছড়ি। দরজার পাশে দাঁড়ানো শাড়ি পরা নারী, ভারবাহী গ্রামবাসী, যোদ্ধা, শূকরসহ বিভিন্ন প্রাণীর চিত্র প্রভৃতি এর মধ্যে রয়েছে। কুমিল্লার শালবন বিহারেও বহু রকমের চিত্র সম্বলিত ফলকের ব্যবহার হয়েছিল।

সেকালে ইমারত অনেক সময়ই ভূমি সমতল থেকে অনেক উঁচুতে নির্মিত হতো। এতে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্মটি বহুদূর থেকে দৃশ্যমান হতো। যেমন, পাহাড়পুরের কেন্দ্রীয় মন্দিরটি কালের প্রবাহে অনেকটা দেবে যাওয়ার পরও এর উচ্চতা ৭২ ফুট অর্থাৎ ২৯.৯২ মিটারের কম নয় (সূত্র: খন্দকার মাহমুদুল হাসান, বাংলাদেশের পুরাকীর্তি কোষ : প্রাচীন যুগ, পার্ল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০১৭ , পৃ.৭৭২)। বগুড়ার মহাস্থানের নিকটবর্তী গোকুল মেড়ও ভূমি থেকে উঁচুতে নির্মিত ইমারতের নিদর্শন। পাহাড়পুর ও গোকুল উভয় ক্ষেত্রেই শীর্ষ ইমারতটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই জাতীয় ইমারতগুলো ছিল এক ধরনের বহুতল বিশিষ্ট। এক্ষেত্রে ছোটো ছোটো পাকা কুঠুরি নির্মাণ করে সেগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করে এর উপরের তলে আরেক স্তরের কুঠুরি নির্মিত হতো। এভাবে স্তরে স্তরে কুঠুরি নির্মাণ করে শীর্ষ ইমারতটি (সাধারণত মন্দির) নির্মিত হওয়ার পর তা দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো হতো।
বিহার: বুদ্ধের জীবদ্দশায় বিহার নির্মিত হতে শুরু করেছিল। বিহারগুলো ছিল আবাসিক জ্ঞানকেন্দ্র। ভিক্ষু বা ছাত্ররা বিহারে বসবাস করতেন বলে বিহারগুলোতে ছাত্রাবাস কক্ষ থাকতে হতো। বিহারের একটি সাধারণ নকশা হলো, বর্গাকার বা প্রায় বর্গাকার একটি চত্বরকে ঘিরে প্রতি দিকেই একসারি করে কক্ষ থাকতো। আর কক্ষগুলোর সামন দিয়ে থাকতো টানা বারান্দা। কামরাগুলোর পেছনে থাকতো একটি সাধারণ দেয়াল। এই দেয়ালটি খুব চওড়া হতো (কুমিল্লার শালবন বিহারে তা ১৮ ফুট পুরু)। নিরাপত্তার বিবেচনায় প্রতিটি বিহারই যেন ছিল একেকটি দুর্গ। ভিক্ষুকক্ষের পেছনের দেয়াল তাই অনেকটা দুর্গপ্রাচীরের মতো পুরু। বড় বিহারগুলোর ভেতরের চত্বরের মাঝামাঝি জায়গায় একটা বড়ো মন্দির থাকতো। এটি ছিল কেন্দ্রীয় মন্দির। এর ভূমি পরিকল্পনা হতো ক্রুশাকৃতির।এর উদাহরণ হলো, পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দির।
ছোটো বিহারের বাইরে মন্দির থাকতো। যেমন, বগুড়ার ভাসু বিহারের মন্দির। ক্রুশাকৃতির ভূমি পরিকল্পনার বিষয়টি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। পাহাড়পুরের বিশ্বখ্যাত বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের ক্রুশাকার ভূমি পরিকল্পনা পরবর্তীকালে নির্মিত ইন্দোনেশিয়ার জাভাদ্বীপের বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনায় অনুকরণ করা হয়েছে। পাহাড়পুর ও শালবন বিহার ছাড়াও যশোর জেলার ভরত ভায়নার স্তূপের ভূমি পরিকল্পনাও ক্রুশাকার।

বিহারের ভেতরের চত্বরে কেন্দ্রীয় মন্দির ছাড়াও রান্নাঘর, গুদাম, কুয়ো, স্তূপ প্রভৃতি থাকতো। পাহাড়পুরে আমরা এটি দেখি।

যেসব বিহারে কেন্দ্রীয় মন্দির ছিল সেখানে বিহারের প্রবেশ পথ থাকতো উত্তর দিকে। যেমন, পাহাড়পুর ও শালবন বিহার। আবার যেসব বিহারে কেন্দ্রীয় মন্দির ছিল না সেখানে প্রবেশ পথ অন্য কোনো দিকে হতো। যেমন, বগুড়ার ভাসু বিহারের প্রবেশ পথ ছিল পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে। কুমিল্লার ইটাখোলা বিহারের প্রবেশ পথ ছিল পূর্ব দিকে ( সূত্র: হাবিবুর রহমান, ইটাখোলা বিহার ৭ম – ১৩ শ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন, ১৯৯২, পৃ. ৭-১২)।)

স্তূপ, মন্দির ও চৈত্য : স্তূপ এবং মন্দিরের মধ্যে ব্যবহারগত পার্থক্যের কারণে নির্মাণ রীতিতেও পার্থক্য ছিল। ছিল উপযোগিতার পাার্থক্য। স্তূপ এমন একটা ইমারত যাকে প্রদক্ষিণ করে পূজা করা হতো। যেমন, সাভারে রাজা হরিশ্চন্দ্রের বুরুজ একটি স্তূপ। পক্ষান্তরে মন্দিরের পূূজা করা হতো না। মন্দিরের ভেতরে ঢুকে সেখানে রক্ষিত মূর্তির পূজা করা হতো।

স্তূপ জৈন ধর্মে দেখা গেলেও বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গেই বেশি সম্পর্কযুক্ত বলে পরবর্তীকালে দেখা যায়। স্তূপের সাধারণ অর্থ ঢিবি এবং স্তূপ হলো স্থূলকায় ইমারত। বৌদ্ধ ধর্মে স্তূপ বুদ্ধের দেহ, বাণী ও আত্মার প্রতিনিধিত্ব করে। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তাঁর দেহভষ্ম আটটি ভাগে ভাগ করে আটটি জনপদের আটটি স্থানে সেই ভষ্মাবশেষের উপর আটটি স্তূপ নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। পরবর্তীতে সম্রাট অশোকের আমলে বুদ্ধের দেহভষ্ম সমৃদ্ধ স্তূপগুলো থেকে মূল দেহভষ্ম বের করে এনে তা বহুভাগে ভাগ করে সাম্রাজ্যের নানান জায়গায় পাঠানো হয় এবং প্রতিটি অংশের উপর একেকটি করে স্তূপ নির্মাণ করা হয়। ইউয়ান চোয়াঙের বর্ণনায় বাংলাদেশে অশোক নির্মিত স্তূপের কথা থাকলেও এখনও তেমন কোনো স্তূপের সন্ধান বাংলাদেশে মেলেনি।
তিন ধরণের স্তূপের মধ্যে রয়েছে।
১. যে স্তূপে বুদ্ধ বা তাঁর শিষ্যদের দেহাবশেষ থাকে তার নাম – শারিরীক স্তূপ।
২. যে স্তূপে বুদ্ধের ব্যবহৃত সামগ্রী সমাহিত হয় বা থাকে তা – পারিভৌগিক স্তূপ।
৩. যে স্তূপে বুদ্ধ জীবন বা বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ সংশ্লিষ্টতাকে নির্দেশ করে তা- নির্দেশিক বা উদ্দেশিক স্তূপ।

বাংলাদেশের কুটিলা মুড়ার স্তূপ তিনটি বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘকে নির্দেশ করে। তাই এটি নির্দেশিক বা উদ্দেশিক স্তূপ। এই স্তূপগুলো এখন দূর থেকে দেখতে অনেকটা ড্রামের মতো লাগে। ভক্তরা তীর্থস্থানে এসেও অপেক্ষাকৃত ছোটো আকারের অনেক স্তূপ নির্মাণ করতেন। এগুলো হলো নিবেদন স্তূপ। পাহাড়পুরের সত্যপীর ভিটায় এমন অনেক নিবেদন স্তূপ আছে ।

প্রথম প্রথম স্তূপে মূর্তি রাখার কোনো ব্যবস্হা না থাকলেও পরে স্তূপের গায়ে মূর্তি রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। মূর্তি প্রকোষ্ঠও তৈরি করা হতো। একে মূর্তি ও মন্দিরের মিশ্রণ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কুমিল্লার রূপবান মুড়ায় এমন ঘটেছে ( সূত্র : প্রাগুক্ত)। মন্দির বা কেন্দ্রীয় মন্দিরের যে কক্ষে মূর্তি থাকতো তার চারদিকে প্রদক্ষিণ পথ থাকতো। যেমন, পাহাড়পুরে কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রদক্ষিণ পথ।

কুমিল্লার শালবন বিহার ও আনন্দ বিহারে প্রকোষ্ঠযুক্ত কেন্দ্রীয় মন্দিরে ভিক্ষুনিবাস ছিল বলে ধারণা করা হয়। পাহাড়পুরে কেন্দ্রভাগের বদ্ধ কুঠুরিকে কেন্দ্র করে নির্মিত কেন্দ্রীয় মন্দিরে ভিক্ষুনিবাসের ব্যবস্থা ছিল না। তবে মন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ পথ ছিল।

মন্দিরের ভেতরে মূর্তি রাখার জায়গাটা মেঝে থেকে কিছুটা উঁচু করে নির্মিত হতো। এই উঁচু জায়গার নাম বেদী। মূর্তির সামনে পূজারীদের বসার জন্যে কোনো কোনো সময় আলাদা মঞ্চও থাকতো। কখনও কখনও বেদীতে কুলুঙি থাকতো। পদ্ম কিংবা দ্বিপদ্মও থাকতো। এভাবে অলংকৃত ও সাদামাটা দুই ধরনের বেদীই পাওয়া যায়।

কোনো ব্যক্তির স্মরণে বা তার চিতাভষ্মের উপরেও স্তূপ নির্মিত হতো। বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের দেহভষ্মের ওপরেই প্রথম দিককার স্তূপগুলো নির্মিত হয়েছিল। মানসসিদ্ধিমূলক ও ব্রতপূর্ণ স্তূপ বাংলাদেশে অনেক নির্মিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্তূপগুলো প্রধাণত ইটের তৈরি। কুমিল্লায় সেনানিবাসের ভেতরে কুটিলা মুড়া ঢিবিতে বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি মূলমন্ত্র – বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ -এর প্রতীকী উপস্থাপনা দেখতে পাই ইটে নির্মিত পাশাপাশি তিনটি স্তূপে। বাংলাদেশের বড়ো স্তূপের এটি একটি আদর্শ উদাহরণ। পাহাড়পুরের সত্যপীর ভিটা এবং শালবন বিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের নিকটবর্তী স্তূপগুলো ছোটো স্তূপের উদাহরণ। চট্টগ্রামের ঝিওরি, নরসিংদির আশরাফপুর ও কুমিল্লার ময়নামতিতে ব্রোঞ্জসহ ধাতুর তৈরি স্তূপ পাওয়া গেছে। নওগাঁ জেলার যোগীঘোপায় পাওয়া গেছে পাথরের স্তূপ। পাথর এবং ধাতুর তৈরি স্তূপগুলো বহনযোগ্য।

ধর্মীয় গুরুত্ব থাকায় এদেশে প্রাচীনকালে বিপুল সংখ্যক স্তূপ নির্মিত হয়েছে। একটি আদর্শ স্তূপের প্রধান অংশ চারটি। সেগুলো হলো – ১.মেধি, ২.অণ্ড, ৩. বেদী, ৪ ছত্র।

সবচেয়ে নীচের মঞ্চ বা বেদীর মতো উঁচু জায়গার নাম মেধি। মেধির চারপাশে প্রদক্ষিণের একটা পথ থাকতো। এটি অনুচ্চ প্রাচীর বা রেলিঙে ঘেরা থাকতো । এই প্রদক্ষিণ পথটা হলো মহাবেদী। রেলিঙে ঘেরা জায়গাটায় ঢোকার জন্যে চারপাশে চারটি প্রবেশ পথ থাকতো। মেধি ঘেঁষে ওপরের অর্ধবৃত্তাকার ও দর্শনযোগ্য অংশের নাম অণ্ড। অণ্ডর শীর্ষভাগে চারকোণাকার / বর্গাকার একটি অংশ থাকতো। সেটির নাম বেদী। বেদীর উপরে পরস্পর সংলগ্ন কতগুলো চাকতির মতো অংশ একটার উপর একটা মিলে একটা দণ্ড তৈরি করতো। এই চাকতিগুলোর নাম ছত্র এবং চাকতি দিয়ে তৈরি দণ্ডের নাম ছত্রাবলি। মৌর্য ও মৌর্যপূর্ব কালের স্তূপে বুদ্ধের দেহাবশেষ সংরক্ষিত থাকতো বলে ভক্তরা প্রদক্ষিণ পথ ধরে স্তূপ প্রদক্ষিণ করতো এবং স্তূপেরই পূজা করতো। স্তূপের ছত্রাবলি সরু হতে হতে কালক্রমে তা দণ্ডাকৃতি ধারণ করে এবং খ্রিষ্টীয় দশম শতকের আগেই তা অপেক্ষাকৃত সরু ও দণ্ডাকারের হয়ে যায় (সূত্র : খন্দকার মাহমুদুল হাসান, বাংলাদেশের পুরাকীর্তি কোষ: প্রাচীন যুগ, পার্ল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, ২০১৭, পৃ. ১১৭, ১১৮) ।

প্রাচীন কালে চৈত্য নির্মিত হতো। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্মে বিশ্বাসীরাই চৈত্য নির্মাণ করতেন। এটিও ছিল একটি ধর্মীয় স্থাপনা। স্তূপের মতোই চৈত্যেরও পূজা করা হতো। চৈত্যকে স্তূপের প্রাথমিক অবস্থা বলেও বিবেচনা করা হয়। বলা হয়, স্তূপের ভেতরে চৈত্য থাকে। চিতা থেকে চৈত্য কথাটা এসেছে। চিতা থেকে চৈত্য কথাটা এসেছে। দেহভষ্ম সংরক্ষণ করার স্থান, অন্য কথায় শবদেহ দাহ করার স্থান হলো চিতা। দেহভষ্ম এবং মৃতের ব্যবহৃত সামগ্রীর উপর ঢিবির মতো চৈত্য নির্মিত হতো।

জ্ঞান ও প্রকৃতির প্রতীকী প্রকাশ হিসেবে গণ্য করে প্রাচীন কালে পাহাড় বা পাথর কেটেও চৈত্য নির্মিত হতো। বাংলাদেশে ধাতব চৈত্যের সন্ধান মিলেছে।

এতক্ষণ আমরা প্রাচীন বাংলার সেসব স্থাপত্য – নিদর্শনের কথা আলোচনা করলাম তা আমাদের প্রত্ন-ঐতিহ্যকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে কুঁড়েঘর থেকে যাত্রা শুরু করে সোমপুর মহাবিহারের মতো বিশ্বখ্যাত স্থাপত্য-নিদর্শন উপহার দিয়েছিলেন, সুনির্দিষ্ট মাপজোক ও স্থাপত্য-নকশা প্রণয়নে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন, তা ভাবলে বিস্ময় জাগে মনে। বোঝা যায়, শিল্পকলার মতোই স্থাপত্যবিদ্যারও পঠন-পাঠন ভালোভাবেই প্রচলিত ছিল প্রাচীন বাংলায়।
প্রাচীন বাংলায় প্রকৌশল ও স্থাপত্যবিদ্যার অগ্রগতির প্রমাণ পাওয়া যায় স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের ধ্বংসাবশেষ দেখে। ধারণা করা যায়, অপ্রাতিষ্ঠানিক শুধু নয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও হয়তো লাভ করেছিলেন সেকালের মানুষ। বিহারসমূহে বিভিন্ন জাগতিক বিষয়ের শিক্ষাদানও যে চলতো সেটিও আমাদের জানা। কাজেই প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা দুটোই হয়তো লাভ করেছিলেন সেকালের স্থপতি, প্রকৌশলীরা। কারণ নিখুঁত ও নির্ভুল নকশা প্রণয়ন করে তার ভিত্তিতে তৈরি করা হতো ইমারত। নির্মাণকর্মীরাও নিশ্চয় দক্ষ ছিলেন। প্রাচীনকালের যেসব নির্মাণ নিদর্শন দেখা যায় তার মধ্যে ছিল –
১। দালানকোঠা
২। সড়ক
৩। স্তম্ভ
৪। দুর্গ
৫। সেতু প্রভৃতি

দালানকোঠার ধ্বংসাবশেষ লুপ্ত জনপদগুলোতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছিল ধর্মীয় স্থাপনা ও ধর্ম নিরপেক্ষ তথা ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন ইমারত। তবে সিংহভাগ প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনই ধর্ম সংশ্লিষ্ট। মন্দির, বিহার, স্তূপ, চৈত্য প্রভৃতি এর মধ্যে রয়েছে। তবে ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বিহীন ইমারতও যে নির্মাণ করা হয়নি তা নয়। নিশ্চয় রাজা ও সম্ভ্রান্তজনদের জন্যে প্রাসাদ নির্মিত হতো। কিন্তু তা যে ইট পাথরেরই তৈরি হতো তা বলা যায় না। মৌর্য আমলের রাজগীর – পাটলীপুত্রের মতো বাংলায়ও যে কাঠের প্রাচীর ও বাঁশ -কাঠের সাহায্যে তৈরি করা প্রাসাদ, হলঘর ছিল না তা বলা সহজ নয়। নির্মাণোপকরণের স্থায়ীত্বের অভাবে সিংহভাগ নির্মাণ নিদর্শনই হারিয়ে গেছে। বাঁশ- কাঠের মতো পচনশীল উপকরণের সাহায্যে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণযোগ্য স্থাপত্য নির্মিত হওয়া সম্ভব নয়। আর কাদার গাঁথুনি কিংবা কোনোরকমের মর্টার ব্যবহার ছাড়া গড়ে তোলা দালান দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে না। বাংলায় প্রাচীন স্থাপত্য-নিদর্শনের কাঠামোর পুনরুদ্ধারে এটিও একটি বাধা। এসব কথা বিবেচনায় এনে বলা যায়, বাংলায় মৌর্যপূর্ব ও মৌর্য যুগের যেসব ইমারতের চিহ্ন পাওয়া গেছে সেগুলোর নির্মাণ নকশার অনেক বিষয় নিয়েই মন্তব্য করা কঠিন।

নদীবহুল বাংলায় নৌপথের ব্যবহার যে ব্যাপক ছিল তাতে সন্দেহ নেই। নিশ্চয় প্রাচীন বাংলায় পোতাশ্রয় ছিল। সেখানে কোনো না কোনো রকমের নির্মাণ কাঠামোও ছিল। তবে সেগুলো যে সহজে উদ্ধারযোগ্য নয় তা বলাই বাহুল্য। নদী ও সাগরে বিলীন হওয়া বহু এলাকা থেকেই নির্মাণ কাঠামোর বিলুপ্তি ঘটেছে। বাংলাদেশে প্রাচীন যুগের বড়ো আকারের পোতাশ্রয়ের নিদর্শন না থাকলেও সুলতানি আমলের এ জাতীয় নিদর্শন পাওয়া গেছে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারের জাহাজঘাটা এর একটি নিদর্শন। তবে প্রাচীন বাংলার বড়ো বড়ো দিঘির পাকা ঘাটের কথা প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়। জলের গভীর থেকে ইট দিয়ে গেঁথে তোলা প্রাচীন যুগের এমন বিশাল ঘাট পাওয়া গেছে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার আচরাঙ্গা দিঘির পাকা ঘাটকে এর আদর্শ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার ছয়ঘাটি দিঘি, জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার নন্দীগ্রামের প্রাচীন দিঘিতেও এমন পাকা ঘাট ছিল। এসব পাকা ঘাটের ধ্বংসাবশেষ এখন পর্যন্ত আছে। স্থাপত্য- নিদর্শন হিসেবে এগুলো উপেক্ষণীয় নয়। সৌভাগ্যক্রমে এই স্থাপত্য-নিদর্শনগুলোর প্রতিটিই সরেজমিনে ভ্রমণকালে নিজে দেখার সুযোগ পেয়েছি।

প্রাচীনকালে নদীপথই যে একমাত্র পথ ছিল, তা নয়। সড়কপথেরও গুরুত্ব ছিল। বিশেষ করে সামরিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে সড়কপথ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রাচীন যুগের শেষ প্রান্তে বাংলায় বখতিয়ারের আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল সড়কপথেই। আর প্রাচীন বাংলার সড়কগুলোর মধ্যে পাকা সড়কও ছিল। সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার নিমগাছির সম্ভাব্য গুপ্ত আমলের লুপ্ত নগরীতে এবং নওগাঁ জেলার আমাইর থেকে পাহাড়পুরের দিকে চলে যাওয়া ইট-সুরকির পাকা সড়কের চিহ্ন আধুনিককাল পর্যন্ত টিকে থাকায় বোঝা যায়, যথেষ্ট মজবুত ছিল সেসব সড়ক।

বিজয় বা স্মারক চিহ্ন হিসেবে স্তম্ভ নির্মাণের প্রচলন সুদূর প্রাচীন কালেও ছিল। নীতি- আদর্শের প্রচারেও স্তম্ভ নির্মিত হতো। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোক নির্মিত স্তম্ভগুলোর কথাও বলা যায় এ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত পাথরের স্তম্ভগুলোর মধ্যে অন্তত দুটির কথা এখানে বলা যায়। দুটোই নওগাঁ জেলায় পাওয়া গেছে। এক. পত্নীতলা উপজেলার দীবর দিঘি স্তম্ভ, দুই. ধামইরহাট উপজেলার গরুড় বা বাদাল স্তম্ভ।

এর মধ্যে প্রথমটি গোটা বাংলার একটি ব্যতিক্রমী নিদর্শন।বাংলার বাইরের দূরবর্তী উৎস থেকে বিশাল গ্রানাইট পাথরখণ্ড এনে তা কেটে এই স্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল। শীর্ষভাগে নকশা খচিত এই বিস্ময়কর নির্মাণ- নিদর্শনটি (স্তম্ভটি) একটি বিশাল দিঘির (দীবর দিঘি) জলে পোঁতা অবস্থায় এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি বাংলার বিস্ময়। এটিকে অন্তত গুপ্তযুগের কীর্তি বলে মনে করা হয়। দ্বিতীয় স্তম্ভটি কালো পাথরে নির্মিত। এটির শীর্ষভাগে স্থাপিত ছিল একটি গরুড় মূর্তি। স্তম্ভের গায়ে পাথর খোদাই করে লেখা আছে ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলির বিবরণ। এটি পালযুগের কীর্তি।

সামরিক ও প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে দূর অতীত থেকে বাংলায় দুর্গ নির্মিত হত। দুর্গের প্রকারভেদও ছিল। তবে স্থানীয়ভাবে মাটির প্রাচীরে ঘেরা দুর্গ বাংলায় অনেক ছিল। দুর্গগুলো সুরক্ষিত থাকতো পরিখা দিয়ে। আসলে পরিখা ও প্রাচীরেই ঘেরা থাকতো এসব দুর্গ। দুর্গপ্রাচীর সবসময় মাটিতে ঘেরা থাকতো না, ইটের প্রাচীরও ছিল। রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার নীলাম্বর রাজার বাড়ি নামের প্রত্নস্থলের ইটের প্রাচীরে ঘেরা প্রাচীন দুর্গের বেশ খানিকটা অংশ উদ্ধার করা গেছে। দুর্গ অভ্যন্তরে পাকা ইমারতে ব্যবহৃত বিভিন্ন আকারের পাথর খণ্ড পাওয়া গেছে। বগুড়ার মহাস্থানে প্রাচীন দুর্গনগরী পুণ্ড্রনগরকে ঘিরে রাখা ইটের তৈরি পাকা প্রাচীর আবিষ্কৃত হয়েছে। এই দুর্গপ্রাচীরের গায়ে একাধিক মজবুত প্রবেশ পথও ছিল।

প্রাচীনকালে বাংলায় বাঁশ – কাঠের সেতু যে অনেক ছিল তা অনুমান করা যায়। তবে সীমিত আকারের হলেও পাকা সেতু যে মোটেই ছিল না তা বলা যায় না। এর অন্তত একটি উদাহরণ দেয়া যায়। সেটি হলো জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার পাথরঘাটায় তুলসীগঙ্গা নদীর উপরের সেতু। মূল সেতুটি বহু আগে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় তা এখন আর দৃশ্যমান অবস্থায় নেই। তবে নদীতীরের নির্দিষ্ট স্থানে ইটের কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ এবং পাড়ের সঙ্গে তার সংলগ্নতা দেখা যায়। এটিকে ইটের তৈরি খিলানের অংশবিশেষ বলে গণ্য করে ধারণা করা যায় যে, খিলানের সাহায্যে প্রাচীনকালে এখানে একটি সেতু তুলসীগঙ্গা নদীর উপরে নির্মিত হয়েছিল। নদীতে বিপুল সংখ্যক ছোটো- বড়ো পাথরখণ্ড পড়ে থাকায় এগুলোকে সেতুর নির্মাণোপকরণ বলে গণ্য করা হয়। সে বিবেচনায় প্রাচীন কালে এখানে পাথরে নির্মিত একটি সেতু ছিল।

এককথায় প্রকৌশল ও স্থাপত্যবিদ্যার ব্যাপক চর্চার বদৌলতে প্রাচীন বাংলায় বিপুলসংখ্যক নির্মাণকর্ম হয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে তা চলেছিল এবং দিনে দিনে বিকশিত হয়েছিল। এভাবেই মধ্যযুগের স্থাপত্য শিল্পের এক দৃঢ় পশ্চাৎভূমি নির্মিত হয়েছিল প্রাচীনকালেই।
পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *