ছন্দা বিশ্বাস
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রথিতযশা কবি ছিলেন অরুণ মিত্র। চল্লিশের দশকে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতা যখন রবীন্দ্রনাথের ভয়ঙ্কর আগ্রাসী থাবা থেকে নিজেদের মুক্ত করে বিপর্যস্ত, কিছুটা এলোমেলো ও ক্লেদাক্ত হয়ে পড়েছিল এমন সময়ে নতুন শৈলী নতুন কাব্য ভাষা তৈরী করে স্বতন্ত্র কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটালেন অরুণ মিত্র।
অধ্যাপনার পাশাপাশি সাহিত্য সাধনা, কবিতা রচনা এবং অনুবাদ কর্মে ব্রতী ছিলেন তিনি। মাত্র ষোলো বছর বয়েসে তাঁর সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ‘বেণু’ নামে একটা কিশোর পত্রিকায়। ‘প্রান্ত রেখা’ (১৯৪৩) থেকে যার কবি জীবনের যাত্রা শুরু এবং শেষ হয়েছিল ‘খুঁজতে খুঁজতে এতদূর’ (১৯৮৬) এসে। “প্রান্ত রেখা” কাব্যগ্রন্থে ‘লাল ইস্তেহার’, ‘কসাকের ডাক- ১৯৪২’, ‘একটি নিবেদন’ প্রভৃতি কবিতা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী কবি অরুণ মিত্রের কলম ঝলসে ওঠে,—
“প্রাচীর পত্রে পড়োনি লাল ইস্তেহার? লাল অক্ষর আগুনের হল্কায়
ঝলসাবে জানো?”
কিংবা,-
“প্রাচীরপত্রে অক্ষত অক্ষর
তাজা কথা কয়, শোনো;
কখন আকাশে ভ্রুকুটি হয় প্রখর
এখন প্রহর গোনো।
উপোসী হাতের হাতুড়িরা উদ্যত,
কড়া পড়া কাঁধে ভবিষ্যতের ভার;
দেবতার ক্রোধ কুৎসিত রীতিমতো;
মানুষেরা হুঁশিয়ার!”
জার্মানি-জাপান-ইতালির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাকী বিশ্ব উত্তাল তখন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, নিদারুণ অর্থনৈতিক মন্দা, কালোবাজারি, আগ্রাসন, বেকারত্ব, শোষণ- নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার জয়কে তিনি মানব মুক্তির একমাত্র দিশা জেনে লিখে ফেলেন ‘কসাকের ডাক- ১৯৪২’। বিশ্বাবাসীকে যেন জানাতে চান এই পথেই শ্রমজীবি – কৃষিজীবি মানুষের মুক্তির পথ মিলবে। তাই তো তিনি বলে উঠলেন,-
“জান দিয়ে গড়লাম রুশিয়া
সোভিয়েট রুশিয়া
জান দিয়ে রাখব এ দুনিয়া
রাখবই
ভাই হো…”
দীর্ঘ যাত্রাপথে রেখে গেছেন বহু অমূল্য কবিতা। লিখেছেন ‘উৎসের দিকে’(১৯৫০), ‘ঘনিষ্ঠ তাপ’( ১৯৬৩), ‘মঞ্চের বাইরে মাটিতে’ ( ১৯৭০), ‘শুধু রাতের শব্দ নয়’ (১৯৭৮), ‘প্রথম পলি শেষ পাথর’(১৯৮১) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। পরবর্তী কালে তাঁর কবিতাগুলি পনেরোটি খন্ডে প্রকাশিত হয়। ‘শুধু রাতের শব্দ নয়’ কাব্য গ্রন্থটির জন্যে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পান ১৯৭৯ সালে। ‘খুঁজতে খুঁজতে এতদূর’ গ্রন্থের জন্যে লাভ করেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ১৯৮৭ সালে।
যশোর জেলায় জন্ম কবি অরুণ মিত্রের। বাল্য আর শৈশব স্মৃতিতে সদা জাগরুক ছিল সেই সব স্মৃতি। বিরানব্বই বছর পর্যন্ত তিনি সক্রিয় ছিলেন লেখালিখিতে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘বয়স যাকে ছুঁতে পারেনি’।
নির্মেদ চেহারার চির তরুণ এই মানুষটি বিরানব্বই বছর বয়েসেও ছিলেন সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন।
এক সময় বামপন্থী ভাবধারায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তার কবিতা পড়তে পড়তে সেই সময়কে ছুঁতে চেষ্টা করি। অসাধারণ সব কবিতা লিখেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন তন্নিষ্ঠ পাঠক। পড়তে পড়তে এক সময়ে হাতে এল ভিক্টর হুগোর উপন্যাস। গোগ্রাসে গিলে ফেলেন বইটি। এরপরে পড়ে ফেলেন একের পর এক গ্রন্থ। শুধু ফরাসী সাহিত্যকে ভালবেসে শিখে নিলেন ফরাসী ভাষা। ফরাসী সরকারের আহবানে ফ্রান্স চলে যান ১৯৪৮ সালে। প্যারিসের সরবন কলেজ থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপরে চার বছর ফ্রান্সে কাটিয়ে ১৯৫২ সালে দেশে ফিরে এলাহবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে কাটিয়ে দিলেন দীর্ঘ কুড়িটা বছর। অনুবাদ কাজে হাত লাগান। ফরাসী সাহিত্য- কবিতা তাঁকে প্রথম থেকেই আকৃষ্ট করে। এরপরেই তিনি ফরাসী ভাষা চর্চা শুরু করে দিলেন। ফরাসী সাহিত্যের মহৎ লেখক লুই আরাগঁ, পল এল্যুয়ার, মায়াকভস্কির অনুবাদ আর কবিতা নিয়ে রীতিমতো চর্চা শুরু করে দিয়েছেন।
তাঁর একমাত্র উপন্যাস, ‘শিকড় দিয়ে যায় চেনা’।
তিনি চেয়েছিলেন মানুষের ভিতরে যে দুদর্শা, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে হিংসা, দূর্নীতি, লোভ, উন্মত্ততা, সেই সমস্ত বিষ থেকে সমাজকে মুক্ত করা। মানুষকে মুক্তির নিশ্বাস পেতে সাহায্য করা। পৃথিবীকে সুন্দর আর সহজ করে তোলা।
সারাটা জীবন তিনি এই আদর্শের মন্ত্র জপ করেছিলেন। কৈশোরে বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেও জন্মভূমির টান আমৃত্যু তার রক্তের ভিতরে প্লাবিত ছিল। সুযোগ পেলেই তিনি ফিরে যেতেন শৈশবের সেই মাটিতে। সেই খাল, বিল, জলা, জঙ্গল, সেই উন্মুক্ত প্রান্তর,আকাশ, মাঠ, সবুজ ফসলের খেত, ঝোপঝাড়, বাঁশবন, আম – জাম – কাঁঠালের দেশে। চলে যেতেন চিন্তায় সেই পুকুর ঘাট, বাঁশবন, তাল নারকেল আর সুপারি গাছের ছায়াঘন পরিবেশে। থেকে থেকে নস্টালজিক হয়ে পড়তেন। শৈশবে যাদের সঙ্গে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন তাদের ভিতরে বলিষ্ঠ চরিত্রের মানুষ যেমন ছিলেন, তেমনি খুব সাদামাটা মানুষও ছিলেন। এদের সবাই তাঁর চরিত্র গঠনে সাহায্য করেছিল। তাদের বাড়িটা ছিল সংস্কৃতিপ্রবণ বাড়ি। প্রবাসী পত্রিকা আসত, ছিল গ্রামোফোন রেকর্ড, আসত নানা পত্র-পত্রিকা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নানা গোয়েন্দা কাহিনি থাকত সেই সব বইয়ে।
ছোটদের সেসব বই নাড়াচাড়া করতে কোনোরকম বাধা ছিল না।
সেই সময়ে কেউ ছিল সাহিত্যে উৎসাহী, কেউ-বা আড়ালে গান্ধীবাদী, সাম্যবাদী ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত। এই সব মিলেই তাঁর জীবন একটু একটু করে গড়ে উঠছিল।
সাহিত্য তো জীবনের অংশ। আর কবিতা হল জীবনেরই অভিঘাত। তাই তার সাহিত্য সৃষ্টির পিছনে এদের সকলেরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। কলকাতায় এসে প্রথমে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হলেন। সেখান থেকে আই.এস.সি পাশ করে ভর্তি হলেন রিপন কলেজে। ডিস্টিংশন নিয়ে বি.এ পাশ করে, ইংরাজী সাহিত্যে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
চাকরি করতেন আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে। দশ বছর সেখানে কর্মরত ছিলেন। সেই সময়ে তিনি মার্ক্সবাদে আকৃষ্ট হন। এরপরে আনন্দবাজার পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন ‘অরণি’ পত্রিকায়। সেই সময়ে এই পত্রিকাটি চালাতেন সাংবাদিক শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার।
দীর্ঘ কর্মজীবন কাটিয়ে তিনি ফিরে আসেন কলকাতায়। ১৯৯০ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। ১৯৯২ সালে ফরাসী সরকার ফরাসী ভাষা সাহিত্যের উপরে গবেষণার জন্যে “লিজিয়ন অফ অনার” সম্মানে ভূষিত করেন। বাংলাতেও তিনি একাধিক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়, ‘আজ ও আগামিকাল’। ১৯৭০ সালে বের হয়, ‘সে এক ঝোড়ো বছর’। ১৯৭৫-এ ‘ভারতী থিয়েটার’, ও ‘গাছের কথা’ বের হয় পুস্তকাকারে। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় সাড়া জাগানো বই, —’মায়াকোভস্কি’। ১৯৮০-তে ‘সার্ত্র ও তাঁর শেষ সংলাপ’। ‘অন্যস্বর’, পল এলুয়ারের কবিতা প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৮৩ ও ১৯৮৫ সালে।
তাঁর কবিতা যেন বিদ্রোহ, অভিশাপ আর বিস্মরণের দহনে দগ্ধ। অরণ্য ধ্বংস করে নগরায়নের দিকে তিনি আঙ্গুল তুলেছেন।
‘বন কেটে বসতি’ কবিতায় যেন তারই ইঙ্গিত দেখতে পাই,—
“গাছের রাজ্যে পৌঁছে উত্তুরে ঝড় পেলাম,
পাতাগুলো ছিঁড়ে ছুটে উড়ছে
গুঁড়িগুলো মড়মড় ভাঙছে;
কী কান্ড, তখুনি সামনে গজিয়ে উঠল শহর”।
এই যে আমরা মাঝে মাঝে শুনতে পাই, বাঁধ ভাঙ্গার গল্প। পাহাড়ের গা দিয়ে গড়ে উঠছে হোটেল রেস্তোরাঁ, বাড়িঘর – বহুতল – শপিং প্লাজা। যে ভাবে বিপর্যস্ত হল কেদার, মানালি, যোশি মঠ, পাহাড়ে নামছে ধস। পাহাড়ি নদীতে বাঁধ দিয়ে গড়ে উঠেছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ভাঙছে নদী, পাল্টাচ্ছে গতিপথ। এই কল্লোলিনী তিলোত্তমা ছিল একদিন অরণ্যের কোলে শায়িত। ক্রমে তাকেও গ্রাস করল, গড়ে উঠল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। কোথায় সেই বিস্তৃত সুন্দরবন আর হারিয়ে গেল লবণ হ্রদ। কোনোমতে অস্তিত্ব নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে মৃত্যুর দিনের অপেক্ষায় আদি গঙ্গা। জলাভূমি বুজিয়ে গড়ে উঠেছে বহুতল। নদ-নদীগুলো হারিয়ে ফেলছে নাব্যতা। এই অশনি সংকেতের কথা কত কাল আগেই তিনি বলে গেছেন তাঁর কবিতায়,-
“মরা পাতায় ভর দিয়ে সেই যে উড়ছিল আশা
পচে নিশ্চয়ই তা সার হয়েছে
আর রসে টইটম্বুর করে উঠিয়ে দিয়েছে
বিশ পঁচিশ তলার ঝাড়,…
খুব সাদামাটা শব্দ চিরপরিচিত নিত্য ব্যবহার্য তদ্ভব শব্দে তিনি লিখে গেছেন। কখনো ভোরের শিউলির মতো, শিশিরের গন্ধমাখা বাতাসের মতো কোমল হৃদয়স্পর্শী আবার কখনও বজ্রের মতো শাণিত ধার। এমন লেখা তাঁর কলম থেকেই বের হতে পারে,-
“এক একটা শান্ত দিন নিয়ে বিভোর হই
তাকে মৃদু নদী করে ঘিরে রাখি
কুয়াশায় মুড়ে রাখি
ভোর ভোর আলো কিংবা গোধূলির গভীরে নিয়ে যাই”
অথবা,
“হিম শীতল রোদ আর ছায়া
কোন জলের শব্দ
নিস্তব্ধ মাঠ
মনের কপাট খুলে এইসব সংগ্রহ করি।”
( এক একটা শান্ত দিন)
কবি অরুণ মিত্র কখনো ভুলে যাননি তাঁর শৈশব।
তাই তো তাঁর লেখায় উঠে আসে ফেলে আসা বাংলাদেশের কথা, যশোরের দিনগুলোর কথা। তাঁর একমাত্র উপন্যাস “শিকড় দিয়ে যায় চেনা” উপন্যাসে আছে কলকাতা- যশোরের বাল্যস্মৃতি। কলকাতার নানা স্মৃতি কিছু কল্পনা মিশ্রিত এই উপন্যাসটিকে তাঁর আত্মজীবনী বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন ধুলোর মানুষ। আত্মসমীক্ষার জন্যে তিনি বারে বারে ফিরে গেছেন মাটির পৃথিবীর কাছে। তাই তো অবলীলায় বলতে পেরেছিলেন,-
“আমি এক ধুলোর মানুষ
পা জড়িয়ে ঘুরছি
লাথির ঝাপটায় ঝরে পড়ছি
তবু ধুলোর অহংকার রয়েছে আমার;”
( ধুলোর মানুষ, ‘যদিও আগুন ঝড় ধস ভাঙ্গা’, কাব্যগ্রন্থ)
তাঁর কবিতা কতটা আধুনিক তা বোঝা যায়, প্রায় একশ বছর হতে চলল আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক দেখে-
“শেষ সরাইখানায় পা রেখে শুনেছি হাহাহিহি
দুনিয়ার তামাশা বেশ জমেছে তাহলে।”
…
অথবা,
“আমি চলার রাস্তায় দেখেছি।
ন্যাংটো বাচ্চারা পোড়া কয়লা কুড়োচ্ছে
আর সোমত্ত মেয়ের আঁচলে আগুন জড়ানো
শুনেছি পাড়া-বেপাড়া থেকে হাওয়া শিসোচ্ছে শ্মশানে,
উল্লাসের রক্তে মাখামাখি গা মুখ হাত পা…।”
(শেষ সরাইখানায়)
তাঁর কবিতা একদিকে বারুদের স্ফূলিঙ্গে ঠাসা, অন্যদিকে স্নিগ্ধ শীতল পরশ মাখা।
তিনি যখন ‘শিল্প’ কবিতায় লেখেন-
“ধরো যদি আমার বাঁ’কব্জির শিরা চিরে ফেলে
ডান হাতের কলমে ঢেলে লিখতে থাকি।”
তেমনি লেখেন,-
‘সময়’ কবিতায়,-
“সময়কে নিয়ে অঙ্কে মজার খেলা দেখা গেল।
…
চোখ কান খুলেই রাখ,
বোধ হয় দৃশ্যের চূড়ান্তে আসা গেছে।
এবার সময়ের গলায় দাঁত বসেছে
লোভের দাঁত।
দ্যাখো এবারে কী হয়!”
এই কবিই আবার লেখেন,
“একটা ঘাস ফড়িং এর সঙ্গে আমার গলায় গলায় ভাব হয়েছে,
ভাব না করে পারতামই না।
ঝিরঝিরে বৃষ্টির পরে আমি ভিজে ঘাসে পা দিয়েছি
অমনি শুরু হয়ে গেল আমাদের আত্মীয়তা।”
কিন্তু এখানেই তিনি থামলেন না। থামতে পারলেন না। কারণ তিনি কথা দিয়ে এসেছেন যে-
“ভিজে ঘাসের উপরে আমাকে যেতেই হবে আবার।”
কিংবা ‘হরিণেরা’ কবিতায় দেখি কত অবলীলায় তিনি বলছেন, –
“একটা হরিণের চোখে চোখ রাখতেই কেমন অভিন্ন হৃদয় হয়ে গেলাম।
হরিণেরা দল বেঁধে এসেছে
আমার দিকে তাকিয়ে আছে
আর আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি”
কবি যখন আত্মমগ্নতার দিকে হেঁটে যান শুরু হয় আত্মসমীক্ষাও। অরুণ মিত্রের কবিতা একদিকে যেমন কঠোর, অন্যদিকে তেমনি কোমল অনুভূতির স্পর্শ এনে দেয়। যেমন এই কবিতাটিতে ধরা আছে কত স্নিগ্ধতা, ঘরে ফেরার দিশা-
“ দুর্বার কয়েকটা ছোপ
ধানের গুচ্ছের একটু ছটা
কয়েকটা দোয়েল টুনটুনি”
এ যেন জাদুকরের টুপির মতো। একের পর এক ভিন্ন রঙের পালক বের করে দর্শকের সামনে রাখছেন। আর আমরাও যেন নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। কবিতা পড়তে পড়তে মোহিত হয়েছি। কখনও তিনি দুর্বার নেতা, কখনো-বা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা।
আমাদের নিয়ে চলেছেন অন্য এক জগতের দিকে।
যেমন তিনি বুড়ো ঘুঘুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কঠিনতর বাস্তবতার উদাহরণ টানেন,-
“অপূর্ব শোভায় ঝলমল রঙ্গে রসে যে নন্দন কানন,
ওইখানে আপনাদের পুত্র-পৌত্র-প্রপৌত্রেরা খেলা করবে
অপ্সরাও সুরঙ্গনা সবাই তাদের নেচে নেচে টেনে নেবে…”
তখনি তাঁর রূঢ় কন্ঠস্বর শুনতে পাই,-
“ওইসব অভিজ্ঞতা আমাকে কি বোঝাবেন?
অযুত বছর এই পৃথিবীতে হাঁটিয়াছি আমি
নিশীথের অন্ধকারে, কতবার জাঁহাবাজ হাওয়া
আমাকে ফড়িঙ্গের মতো ঠ্যাং ধরে তুলে নিয়ে
চুবায়েছে ঈজিয়ান সাগরের বেলোয়াড়ি জলে,
কতবার ঘুরায়েছে চোখবাঁধা বলদের মতো
ভারতের সুপবিত্র প্রাগৈতিহাসিক
অমাবস্যার ভিতরে ঠুসে দিয়ে বলিয়াছ, হাঁটো।
আমাকে কী বোঝাবেন?”
(কাব্যগ্রন্থঃ ‘পাতলা গূঢ় সুসমাচার’)
উচ্ছন্নের কড়া সুরকেও পরিণত করেছেন উজ্জ্বীবনের কোমল গানে।
“কী বিঘ্ন, কী আনন্দ
এ সাক্ষাতে,
যতই কাঁপি অন্ধ কোনো
আশংকাতে
হৃদয় তবু অগাধ মিলে সামিল ,
অনড় হাওয়া যতই তুলুক পাঁচিল
প্রিয় নামের নিঃশ্বাসে তা বাতিল
ভাঙবে এ খিল তারই চরম আঘাতে।”
(শেষ ভোরের ডাক)
তাঁর দেখার দৃষ্টি ছিল সুদূর প্রসারী। তিনি ধ্বস্ত সময়ের ভিতরে তাঁর দৃষ্টিকে সংহত করে গভীরতার দিকে নিক্ষেপ করেন। তাঁর কন্ঠে শুনতে পাই,
“আমার কাছে বদলে যায়
কান্নার দ্যুতি চোখ, রাত্রি
যেখানে আরো রাত্রির দিকে দরজা খোলা,
টুপটাপ ফুল আর শিশিরের মাঝখান দিয়ে যে নিরুদ্দেশ
তার সামনে আমার অবস্থান”
(কাব্যগ্রন্থঃ ‘উৎসের দিকে’)
তিনি যেন কল্পনার অপূর্ব এক ভুবন নির্মাণ করেন। ‘উৎসের দিকে’ তাঁর দ্বিতীয় কাব্য সংকলন। এটি দীর্ঘ এগার বছর ধরে লেখা কবিতার সংকলন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সময়ে লেখা এই কবিতাগুলো শুধু বলিষ্ঠই নয়, পরিণত এবং আত্মমগ্নতার ছাপ ধরা পড়ে।
বাংলা কবিতা লেখার পাশাপাশি অরুণ মিত্র অনুবাদের কাজ করে চলেছেন। ফরাসী সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক-অধ্যাপক-অনুবাদকের হাত থেকে আমরা পেয়েছি দুর্মূল্য সব সৃষ্টি। লুই আরাগঁ, পল এল্যুয়ার, মায়াকোভস্কির গদ্য কবিতা ও তার অনুবাদ।
ভলতেয়ারের বিখ্যাত উপন্যাস “কাঁদিদ” এর অনুবাদ তিনি করেছিলেন। তাঁর পাঁচশ বছরের ফরাসি কবিতা”র অনুবাদ এক কথায় অসাধারণ। “ফরাসী সাহিত্য প্রসঙ্গে” তাঁর যে মৌলিক প্রবন্ধ আছে, সেটিও কৃতিত্বের দাবী রাখে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন