সুমনা সাহা
ভারতীয় দর্শন মানবজীবনের পরম প্রাপ্তব্য বা পুরুষার্থ রূপে চারটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন— ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন অবস্থান ও রুচিভেদে মানুষ এই চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে জীবনের পরম লক্ষ্য রূপে স্থির করতে পারেন। আরও সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে বলতে হয়, একটি অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ধর্ম বা ন্যায় পথে থেকে বা সৎ ভাবে অর্থ উপার্জন দ্বারা সে ‘কাম’ বা কামনা চরিতার্থ করবে এবং প্রবৃত্তি মার্গ অবলম্বনে কামনা পূরণের মাধ্যমে ক্রমে নিবৃত্তি মার্গে পৌঁছবে এবং সকল কামনা ত্যাগ করে ‘মোক্ষ’ বা জীবনের পরম পুরুষার্থ লাভ করবে। কিন্তু বাস্তব জগতে ‘কাম’ যৌন সুখভোগ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই নরনারীর পরস্পরের প্রতি দেহজ আকর্ষণ স্বাভাবিক। প্রকৃতি তার সৃষ্টি রক্ষার তাগিদেই মানুষ তো বটেই, জীবজন্তু ও বৃক্ষাদির মধ্যেও এই যৌন মিলনের তাগিদ তৈরি করেছে, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে দেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে নানা অশিক্ষা, অন্ধ কুসংস্কার প্রভৃতি যৌনমিলন সুখ উপভোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং তৃপ্তির অভাবে অপূর্ণতাবোধ থেকে অনৈতিক সম্পর্কে ঠেলে দেয়, অজ্ঞান থেকে জন্ম নেয় নানা রোগ ও উপসর্গ। জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি সংকোচ হেতু যথার্থ আলোচনার অভাবে অবহেলিত থেকে যায় এবং ভবিষ্যতে এর কুপ্রভাব ব্যক্তি তথা সমাজের উপরেই ছাপ ফেলে। এই সমস্ত বিষয়ে গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করে প্রাচীন ভারতীয় এক আচার্য আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে লিখেছেন ‘কামসূত্র’ নামে একটি অভূতপূর্ব গ্রন্থ, যেখানে সুস্থভাবে কাম-উপভোগের পদ্ধতি বলা হয়েছে, দৈহিক কামচেতনার সঙ্গে মনোবিজ্ঞান নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে এবং উল্লেখ করা হয়েছে নানা বিধি ও নিষেধ। গ্রন্থের রচয়িতা মহর্ষি বাৎস্যায়ন, যদিও একই উপাধিধারী একাধিক ব্যক্তির অস্তিত্বও স্বীকার্য। গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়কে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে ভারতের ঋষিরা বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন—
(১) চারায়ণ লেখেন সাধারণ কাম বিচার’।
(২) সুবর্ণাভ লেখেন ‘যৌন কাম বিচার”।
(৩) ঘোটক মুখ লেখেন যুবতী নারীর বিচার’।
(৪) গোমার্দীয় লেখেন “স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের বিচার’।
(৫) গণিকা পুত্র লেখেন ‘পরস্ত্রী গমন বিচার’।
(৬) দত্তক লেখেন ‘পতিতাদের কাম বিচার’।
(৭) কুচুমার লেখেন ‘দেহ সৌন্দর্য ও যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধির উপায় বিচার’।
গ্রন্থগুলি প্রত্যেকটি উৎকৃষ্ট হলেও পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল বলে মানুষের মনকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাই ঋষি বাৎস্যায়ন এই সবগুলি গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় একত্রিত করে তাঁর “কামসূত্রম্’ গ্রন্থটি রচনা করলেন। এই গ্রন্থের বিভিন্ন বিভাগে কাম-সংক্রান্ত সবক’টি তত্ত্ব সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় স্পষ্ট আলোচনা করেছেন।
বাৎস্যায়নের মতে, কাম-উপভোগে সফল হতে হলে নারী বা পুরুষ উভয়ের কতকগুলি কলা শিক্ষা করা উচিত। মোট চৌষট্টি কলার কথা বলেছেন তিনি। একজন মানুষ হয়তো এই সবক’টি কলায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না, তবে কয়েকটি কলা সে অবশ্যই আয়ত্ত করতে পারে। আর কলা ছাড়া জীবন ও কাম কিছুই মধুময় হতে পারে না।
বাৎস্যায়নের পরিচয়—
প্রাচীন ভারতে জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা দিকে গুপ্তযুগ ছিল এক স্বর্ণ যুগ। কোথায় এবং কোন দেশে বাৎস্যায়ন জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তার ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত বিশেষ পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়, তিনি গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই মহাকবি কালিদাস, জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহির ইত্যাদি মনীষা সম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শূদ্রক রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ নামে সংস্কৃত নাটকও ঐ সময়ের। ‘কামসূত্র’ ও মহর্ষি গৌতমের ‘ন্যায়সূত্র’ গ্রন্থের টীকা ‘ন্যায়সূত্রভাষ্য’ রচয়িতা রূপে বাৎস্যায়নের নাম পাওয়া যায়। তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মল্লিনাগ বা মৃল্লান। বাৎস্যায়ন ছিল তার বংশনাম বা পদবি। নিজ গ্রন্থের শেষে তিনি যে আত্মপরিচয় দান করেছেন তা এইরকম—
“বাভ্রব্য ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থকারদের রচনা পড়িয়া তদনুসারে এবং তাঁহাদিগের দ্বারা প্রদত্ত অর্থবিধান পর্যালোচনা করিবার পর পবিত্র আদেশানুসারে জগতের কল্যাণার্থে বারাণসীর চতুষ্পাঠীর ছাত্র ও দেবসেবক বাৎস্যায়ন কর্তৃক এই সন্দর্ভটি রচিত হইয়াছে। ইহা আমাদিগের কামনাবাসনা চরিতার্থ করিবার পুস্তক নহে। যে ব্যক্তি এই বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক অবহিত, যিনি নিজ ধর্ম, অর্থ ও কাম রক্ষা করিয়া এবং লোকাচার মানিয়া চলেন, কেবল তিনিই তাঁর ইন্দ্রিয় জয়ে সক্ষম। সংক্ষেপে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি ধর্ম ও অর্থের অধিকারী হইলে কামেরও অধিকারী হইবেন। তজ্জন্য তাঁহাকে তাঁহার কামনা বাসনার ক্রীতদাসত্ব করিতে হইবে না। তিনি যাহাই করিবেন তাহাতেই সাফল্য পাইবেন।”
এই ‘বাৎস্যায়ন’ পদবী বা উপাধিধারী ব্যক্তি প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ের মানুষ। তাঁর রচনায় আছে, কুন্তলরাজ সাতকর্ণী সাতবাহন কামান্ধ হয়ে কর্তারি নামক অস্ত্রের সাহায্যে নিজ পত্নী মাল্যবতীকে হত্যা করেন। এই ঘটনা উল্লেখ করে বাৎস্যায়ন সর্বসাধারণকে সতর্ক করে দেখিয়ে দেন যে কামান্ধ হয়ে নারীকে আঘাত করার মতো প্রাচীন প্রথা বিপজ্জনক হতে পারে। এই কুন্তলরাজ খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন। অর্থাৎ, বাৎস্যায়নের সময়কাল প্রথম শতাব্দীর পরে। আবার বরাহমিহির রচিত ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থের অষ্টাদশ অধ্যায়টি কামকলা সংক্রান্ত। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু মূলত বাৎস্যায়নের গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে। বরাহমিহিরের সময়কাল খ্রিষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দী। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ বরাহমিহিরের পূর্বে রচিত, অতএব তাঁর সময়কাল প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
কেউ কেউ বলেন, তিনি কোনো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর পালিকা মাসি কাজ করতেন এক বেশ্যালয়ে, সেখানেই তাঁর শৈশব কেটেছিল এবং সেখান থেকেই তিনি কামকলা সংক্রান্ত প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেছিলেন।
বাৎস্যায়নের কামসূত্রের ইতিহাস—
বাৎস্যায়নেরও আগে কামশাস্ত্র রচনা করেছিলেন নন্দী। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে নন্দী হলেন শিবের বাহন, একটি বৃষ। বৃষ কিভাবে শাস্ত্র রচনা করতে পারে? হতে পারে শৈব সম্প্রদায়ের কোনও শাস্ত্রকার, যিনি নিজেকে শিবের অনুচর নন্দী মনে করেছেন, কিম্বা নন্দী তাঁর উপাধি বা ছদ্মনামও হতে পারে। পুরাণ বলছেন, ভগবান শঙ্কর ও মাতা পার্বতীর প্রেম-সংলাপ শুনে নন্দী শিবেরই আদেশ প্রাপ্ত হয়ে এক হাজার অধ্যায় যুক্ত সুবৃহৎ কামশাস্ত্র রচনা করেন। পরে মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র আচার্য শ্বেতকেতু এই গ্রন্থকে সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করেন। আরও পরে বাভ্রব্য নামে উত্তর ভারতের একজন ঋষি এই গ্রন্থটিকে সংক্ষিপ্ত করেন এবং ১৫০ টি পরিচ্ছেদে ভাগ করে বিশ্লেষণ করেছিলেন।
বাভ্রব্য-এর কামশাস্ত্র মোট সাতটি ভাগে বিভক্ত—
(১) সাধারণ কথা।
(২) নর-নারীর যৌনমিলন ও তৃপ্তি।
(৩) যুবতী নারীদের কাম জাগরণ।
(৪) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দৈহিক আনন্দ।
(৫) পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্বন্ধ ও পরস্ত্রীর সঙ্গে কাম।
(৬) বারাঙ্গনাদের কাম বৃত্তান্ত।
(৭) শারীরিক সৌন্দর্য ও কামশক্তি বৃদ্ধির উপায়।
এইভাবে তাঁর গ্রন্থে বাভ্রব্য কামশক্তিকে একটা সুনির্দিষ্ট পথে চালিত করেন ও তার সাতটি বিভাগ করে দেন। বাভ্রব্যের এই গ্রন্থ বিশ্বের পণ্ডিত সমাজে বিশেষ প্রশংসিত হয়। তবে এই দুজনের শাস্ত্রই পরবর্তী কালে হারিয়ে যায়। মহর্ষি বাৎস্যায়ন তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত রচনা ‘কামসূত্র’-তে কামশাস্ত্রের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ উপস্থাপন করেছেন।
কামসূত্রের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক—
(১) এই গ্রন্থে যৌন মিলনের ৬৪টি দৈহিক ভঙ্গিমার কথা এবং ভিন্ন ভিন্ন আট প্রকারে ভালোবাসা প্রকাশের কথা বলা হয়েছে।
(২) যদিও গ্রন্থের মাত্র ২০ শতাংশে দৈহিক ভঙ্গিমার উল্লেখ, বাকি ৮০ শতাংশে বলা হয়েছে কী করে একজন ভালো নাগরিক হওয়া যায় এবং পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পর্ক কী ভাবে ভালো রাখা যায়।
(৩) ১৮৮৩ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কামসূত্রের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়, ঐ বছরই ব্রিটেনে বইটির ২৫০ কপি বিক্রি হওয়ার পর তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯৬৩ সাল থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
(৪) ১৯৯৬ সালে কামসূত্রের ওপর তৈরি হওয়া ‘কামসূত্র — আ টেল অফ লাভ’ সিনেমাটি ভারতে মুক্তি পাওয়ার ব্যাপারে অনেক টালবাহানা চলতে থাকে, পরে, ১৪ টি কাটছাট-এর পর সিনেমাটি ভারতে মুক্তির ছাড়পত্র পায়।
(৫) বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ ৩৬ টি অধ্যায়ে গ্রথিত, সমগ্র গ্রন্থটি ৭টি পর্বে বিন্যস্ত। মোট ১২৫০ টি শ্লোক আছে।
(৬) এই বইতে এমন অনেক কথা বলা হয়েছে, যা প্রকাশ্যে আলোচনা করতে মানুষ লজ্জা বোধ করে, অথচ জানতে চায়। যেমন, এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, কামড়ানো ও খিমচানো যৌন আকর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম উপায়। এর জন্য আঙুলের নখ ও দাঁত পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
(৭) চুম্বনের প্রায় ৪০ টি বিভিন্ন উপায়ের হদিশ রয়েছে কামসূত্রে, যেগুলি আবার দশ ভাগে বিভক্ত।
(৮) মিলন সর্বার্থে সুন্দর হওয়ার জন্য ঘরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, ঘরে থুতু ফেলার আলাদা পাত্র রাখা, হাতির দাঁতের তারের বাজনা ঝুলিয়ে রাখার উল্লেখ আছে। এ ছাড়া, বলা হয়েছে বিছানা যাতে নরম থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয় এবং অবশ্যই ঘরে ফুলের পাত্র রাখা উচিত। অর্থাৎ দৈহিক স্বাস্থ্য ও মনের সৌন্দর্যবোধ—দুই দিকেই খেয়াল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বাৎস্যায়ন।
(৯) পিঠের ব্যথা, আর্থ্রাইটিস জাতীয় সমস্যাযুক্ত দম্পতিদের গ্রন্থে বর্ণিত দৈহিক ভঙ্গিমা এড়িয়ে চলার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
(১০) ‘কামসূএ’-এর একটি বড় অংশই হল মানব মনস্তত্ত্ব।
(১১) ‘কাম’ অর্থে মূলত যৌন-কামনা বোঝায়। কামনাশূন্য জীবন অসম্ভব, আর আধ্যাত্মিক কামনার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে ‘কামসূত্র’ আত্মোপলব্ধির কথাই বলে।
(১২) পরস্ত্রীদের সঙ্গে মিলনের জন্য এই বইতে রাখা হয়েছে আলাদা একটা অধ্যায়। কিন্তু সেটি উচিত কর্ম নয়, একথাও বলা হয়েছে।
গ্রন্থটি বিশেষ খ্যাতি লাভ করায় সতেরো শতকে ব্যাসজনার্দন বাৎস্যায়নের ‘কামশাস্ত্র’ অবলম্বনে রচনা করেন ‘কামপ্রবোধ’। ‘লিজ্জৎ-অল্-নিসা’ নামে এর একটি ফারসি অনুবাদও হয়। উনিশ শতকে রিচার্ড বার্টন বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এ ছাড়া উর্দু, ফরাসি এবং জার্মান ভাষায়ও গ্রন্থটির অনুবাদ হয়।
কামসূত্র সর্ব ভারতে এতই জনপ্রিয় ছিল যে,পরবর্তীকালে এর অনেক টীকা রচিত হয়। সেসবের মধ্যে যশোধরের জয়মঙ্গল এবং ক্ষেমেন্দ্রের বাৎস্যায়নসূত্রসার (১১শ শতক) উল্লেখযোগ্য। কামশাস্ত্রের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য মৌলিক গ্রন্থ হলো দামোদরগুপ্তের কুট্টনীমত (৮ম শতক), কুচুমারের কুচোপনিষদ্ (১০ম শতক), পদ্মশ্রীজ্ঞানের নাগরসর্বস্ব (১০ম/১১শ শতক), ক্ষেমেন্দ্র-র সময়মাতৃকা, কোক্কোকের রতিরহস্য (১২শ শতক), অনন্ত-র কামসমূহ (১৫শ শতক) ইত্যাদি।
বঙ্গদেশেও কামশাস্ত্র রচনা করেছেন সেই সময়ের কৃতি বাঙালি গ্রন্থকারগণ, তার মধ্যে জয়দেবের রতিমঞ্জরী, মীননাথের স্মরদীপিকা, হরিহরের শৃঙ্গারদীপিকা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ভারতীয় ইতিহাস অধ্যয়ন করে মহর্ষি বাৎস্যায়ন অনুভব করেছিলেন যৌনতা নিয়ে মৌন থাকার কারণে নরনারীর সম্পর্ক নষ্ট হওয়া এবং যেহেতু মানুষকে নিয়েই তার সমাজ, তাই তা থেকে সামাজিক অবক্ষয়ও অবধারিত। বিশ্বজুড়ে সমস্ত মানুষই যৌনজীবনের নানা জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে এই বইয়ের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন, তাই হাজার হাজার বছর পরে আজও এই বইয়ের আবেদন ম্লান হয়নি।
বিশ্ববিখ্যাত ‘কামসূত্র’ গ্রন্থের অন্দরমহল—
ধর্ম, অর্থ ও কাম দৈনন্দিন জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু মোক্ষ জন্ম ও পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তিলাভ। কামসূত্রম্ গ্রন্থে বাৎস্যায়ন লিখেছেন–“ধর্ম অর্থ অপেক্ষা শ্রেয়, অর্থ কাম অপেক্ষা শ্রেয়। কিন্তু অর্থই রাজার জীবনে প্রথম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ কেবল ইহা হতেই প্রজাগণ জীবনধারণ করিবেন। পুনরপি, কাম বেশ্যাদিগের উপার্জনপথ এবং তাঁহারা অন্য দুই অপেক্ষা ইহাকেই বাছিয়া লয়। ইহা সাধারণ নিয়মের ব্যতয়।” এই গ্রন্থের মূল উপজীব্য বিষয় যৌনতা সংক্রান্ত ব্যাবহারিক উপদেশ এবং গ্রন্থটি মূলত গদ্যে লিখিত হলেও এতে সন্নিবেশিত হয়েছে অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত বেশ কিছু পদ্যাংশ। ‘কাম’ অর্থে ইন্দ্রিয়সুখ বা যৌন আনন্দ আর ‘সূত্র’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ সুতো, যা গেঁথে রাখে।
৭ ভাগে বিভক্ত ৩৬টি অধ্যায়ের গ্রন্থের বিভাগগুলি হল—
(১) সাধারণম্ (ভূমিকা), (২) সাম্প্রযোগিকম্ (শাস্ত্রসংগ্রহ), (৩) কন্যাসম্প্রযুক্তকম্ (পত্নীলাভ), (৪) ভার্যাঽধিকারিকম্ (পত্নী সম্পর্কে), (৫) পারদারিকম্ (অন্যান্য পত্নী সংক্রান্ত), (৬) বৈশিকম্, (৭) ঔপনিষদিকম্—এই সপ্তম ও শেষ অধ্যায়ের বিভিন্ন পরিচ্ছেদে রয়েছে বশীকরণ, শারীরিক আকর্ষণের উন্নতিকরণ (বৃষ্যযোগাঃ), হ্রাসপ্রাপ্ত যৌনক্ষমতা পুনরায় বৃদ্ধি করার ও পুরনো আকর্ষণ ফের ফিরিয়ে আনবার উপায় (নষ্টরাগপ্রত্যানয়নম্, বৃদ্ধিযোগাঃ), ইত্যাদি নানা বাস্তবোচিত ও উপযোগী নির্দেশ ও আলোচনা। প্রত্যেকটি বিভাগই যৌন-সম্বন্ধ ও তৎসম্পর্কিয় অত্যাবশ্যক বিষয়গুলি মাথায় রেখেই সূত্রবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন- নায়কসহায়দূতীকর্মবিমর্শ (নায়কের সহায়তায় দৌত্যকর্ম সংক্রান্ত অধ্যায়), বর্ণসম্বিধানম্ সম্বন্ধনিশ্চয় চ (বিবাহের ধরন), কন্যাবিস্ৰম্ভণম্ (পত্নীকে শান্ত করণ), বালায়াম্ উপক্ৰমা ইঙ্গিতাকারসূচনম্ চ (পত্নীলাভ), একপুরুষাভিয়োগা (একক ব্যবস্থাপন), বিবাহ দ্বারা সম্মিলন, একচারিণীবৃত্তম্ প্রবাসাচার্য চ (এক পত্নী সংক্রান্ত), প্রধানা পত্নী ও অন্যান্য পত্নী সংক্রান্ত, সহায়গম্যাগম্যচিন্তা গমনকারণং গম্যোপাবর্তনম্ (প্রণয়ী নির্বাচন সংক্রান্ত উপদেশ), কান্তানুবৃত্তম্ (স্থায়ী প্রণয়িনীর অনুসন্ধান), অর্থাগমোপায়া বিরক্তলিঙ্গানি বিরক্তপ্রতিপত্তি নিষ্কাসনক্রম্ (অর্থোপার্জন), বিশীর্ণপ্রতিসন্ধানম্ (পুরাতন প্রণয়ীর সহিত পুনরায় বন্ধুত্বকরণ), লাভবিশেষা (লাভ সংক্রান্ত), অর্থানর্থবন্ধসংশয়বিচারা বেশ্যাবিশেষশ্চ (লাভ ও ক্ষতি), স্ত্রীপুরুষশীলবষ্ঠাপনম্ প্রকরণম্, স্ত্রীষু সিদ্ধাঃ পুরুষাঃ প্রকরণম্, অযত্নসাধ্যা যোষিতঃ (স্ত্রী ও পুরুষের আচরণ), পরিচয়কারণম্ অভিযোগাঃ (পরিচিত হওয়া), ভাবপরীক্ষা (ভাবপরীক্ষা করণ), দূতীকর্ম (দৌত্য), ঈশ্বরকামিতম্ (রাজসুখ), আন্তঃপুরিকাবৃত্তং দাররক্ষিকম্ (অন্দরমহল সংক্রান্ত)।
‘বৈশিকম্’ নামের বিস্তৃত অধিকরণের অন্তর্গত সহায়গম্যাগম্যগমনকারণচিন্তা প্রকরণম্, গম্যোপাবর্ত্তনম্, কান্তাঽনুবৃত্তম্, অর্থাগমোপায়াঃ, বিরক্তপ্রতিপত্তিঃ, নিষ্কাসনক্রমঃ, বিশীর্ণপ্রতি, লাভবিশেষাঃ প্রকরণম্, অর্থানর্থানুবন্ধসংশয়বিচারা বেশ্যাবিশেষাঃ প্রভৃতি পরিচ্ছেদগুলি থেকে প্রাচীনকালে ভারতীয় গণিকাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। সাধারণের মনে গণিকাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধাজনিত বিরূপ ধারণা আছে, বাৎস্যায়নের গ্রন্থে গণিকাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা সেই প্রাচীন ধারণা পরিবর্তিত করতে পারে।
বাৎস্যায়ন গণিকাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কামসূত্ৰমের চতুর্থ অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে বলেছেন–“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”। অর্থাৎ “গণিকাদের পুরুষ-ধরা বিদ্যা এবং অর্থ উপার্জন সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে”। ষষ্ঠ শ্লোকে বলা হয়েছে–“ন চানুপায়েনার্থান সাধয়েদায়তিসংরক্ষণার্থ”। অর্থাৎ, “পুরুষের কাছে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু খুব কৌশলে।”
এই পরামর্শই বুঝিয়ে দেয় গণিকাবৃত্তির বৈধতা ছিল, নিন্দনীয় ছিল না।
কেমন শয্যাসঙ্গী পছন্দ করা উচিৎ, গণিকাদের তার নির্দেশ দিয়েছেন বাৎস্যায়ন— (১) ধনী ও স্বাধীন পুরুষ। (২) যে প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করে। (৩) ধনী ও যৌন-বিকৃতি সম্পন্ন বৃদ্ধ। (৪) দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী ধনী (৫) যাদের হাতে অনায়াসে টাকা আসে, যেমন–সুদখোর মহাজন ইত্যাদি (৬) যে পুরুষ সুপুরুষ নয়, অথচ নিজেকে রমণীরঞ্জন মনে করে, (৭) আত্মশ্লাঘা সম্পন্ন ব্যক্তি, যার কাছ থেকে সহজেই টাকা আদায় করা যায়, (৮) ধনী, অথচ যৌন মিলনে অক্ষম (৯) পিতা-মাতার কাছে আদরণীয় নয় যে সন্তান, সে সহজেই বশ্য (১০) সঙ্গদোষে দুষ্ট হয়ে যাওয়া যুবক ইত্যাদি।
ক্ষেত্র বিশেষে কোন কোনও পুরুষের সঙ্গে গণিকাদের যৌনমিলনে নিষেধ করেছেন বাৎস্যায়ন, যেমন– যক্ষ্মারোগ ও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত পুরুষ, অন্যান্য যৌনরোগ যুক্ত পুরুষ, কঠোর ও কর্কশভাষী, কৃপণ ও গুরুজন দ্বারা ত্যজ্য পুরুষ, তস্কর ও বিশ্বাসঘাতক পুরুষ, যে পুরুষের মুখে দুর্গন্ধ, যে পুরুষ বশীকরণ জানে, প্রবঞ্চক বা প্রতারক পুরুষ ইত্যাদি।
এই সমস্ত দিক বিবেচনা করে একজন গণিকা “বর্তমানং নিষ্পীড়িতার্থমুৎস্যজন্তী বিশীর্ণেন সহ সন্ধ্যাৎ”–একজন পুরুষের অর্থ নিঃশেষ করে তারপর অপর অর্থবান পুরুষকে বশ করবে। (কামসূত্রম্ ৪/৩/১)। বাৎস্যায়নের মতে, একজন গণিকাকে বিভিন্ন রুচির পুরুষের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে বলেই তাকে কামশাস্ত্রের ৬৪ কলার অন্তত কয়েকটিতে পারদর্শিতা লাভ করতে হবে। শাস্ত্রোল্লিখিত এই ৬৪ কলা হল (১) কণ্ঠসংগীত (২) যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শিতা, (৩) নৃত্যকলা (৪) চিত্রাঙ্কন (৫) কেশ সজ্জা (৬) পুষ্পশয্যা নির্মাণ (৭) নানাবিধ বর্ণে গৃহ সজ্জায় নৈপুণ্য (৮) নিজের কেশ, নখ, দাঁত ও বস্ত্র রঞ্জনী দ্বারা সুসজ্জিত করে রাখা (৯) রঙ্গিন পাথর ও ধাতু দ্বারা ঘর ও শয্যা সুশোভিত করা (১০) বিভিন্ন উৎসবে শয্যায় বৈচিত্র্য পূর্ণ আস্তরণ দেওয়া (১১) সাঁতার ও জলকেলিতে পটুত্ব (১২) প্রেমিককে আকৃষ্ট করার মন্ত্র-তন্ত্র শেখা (১৩) ফুল দিয়ে মালা গাঁথা ও নিজেকে পুষ্প আভরণে সুশোভিত করতে জানা (১৪) ফুলের মালার মুকুট ও বেষ্টনী তৈরিতে দক্ষতা (১৫) ভিন্ন ভিন্ন উৎসব উপলক্ষে নিজেকে নানা রূপে পেশ করতে জানা (১৬) চিত্তহারী কর্ণালঙ্কার (১৭) সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি করা, তৈজসপত্রাদি তৈরি সম্পর্কে শিক্ষা করা (১৮) নতুন ভূষণ তৈরি বা পুরানো বিভিন্ন ধরনের অলংকার নতুন করে গড়া (১৯) অতিথি-পরিচর্যা (২০) পরিচ্ছদ রচনার সুচারুতা (২১) হস্তশিল্প পারদর্শিতা (২২) রন্ধনকলা (২৩) পানীয় দ্রব্য, বিবিধ মিষ্টান্ন, আচার, ইত্যাদি তৈরিতে কুশলতা (২৪) দেহের বস্ত্রাবরণ তৈরি করার জন্য সেলাই-এ দক্ষতা (২৫) বস্ত্রখণ্ড ও সুতো দিয়ে পাখি, পাতা, ফুল ইত্যাদি তৈরি করা। (২৬) বীণা ও ডমরুর শব্দ অনুকরণ (২৭) নানাবিধ হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণ (২৮) তাৎক্ষণিক কাব্যরচনা ও আবৃত্তি (২৯) কঠিন অর্থপূর্ণ দুরূহ শব্দের অর্থ নিরূপণ করা। (৩০) সুমধুর কণ্ঠে শাস্ত্রীয় শ্লোক আবৃত্তি (৩১) নাটক, অভিনয়, দর্শন ও নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের প্রকৃত সমালোচনা (৩২) কোনো কবিতার হারানো পঙক্তির পুনরুদ্ধার করা বা তা পুনরায় নতুন করে লেখা (৩৩) বেত বা তৃণ থেকে নানাবিধ নতুন নতুন আসবাবপত্র রচনা বা বোনা (৩৪) কাঠ কুঁদে ছবি বা দৃশ্য রচনা (৩৫) কাঠমিস্ত্রির কাজ, এবং বাড়িঘর নির্মাণ (৩৬) সোনা, রূপা ও দামি পাথর বসিয়ে নানা কাজ করা (৩৭) রসায়ন বা ধাতব শাস্ত্র অধ্যয়ন (৩৮) উজ্জ্বল পাথর ও দামি ধাতুর বস্তু রচনা (৩৯) উদ্যান শৈলী ও পুষ্পবিন্যাসের জ্ঞান (৪০) ভেড়া, মোরগ এবং পায়রাদের নিয়ে কৌতুকপূর্ণ খেলা করার উৎসাহ দান (৪১) শুক, ময়না প্রভৃতি পাখিকে কথা শেখানো ও তাদের দিয়ে মজাদার কাজ করানো (৪২) গাত্র মর্দন করতে শেখা, বেশভূষা রচনা করা, প্রয়োজনের শিল্প শিক্ষা করা (৪৩) সংবাদ প্রাপ্তির নমুনাস্বরূপ আঙ্গুলের দাগ বোঝা (৪৪) গুপ্ত সংকেত শেখা ও ব্যবহার (৪৫) বিভিন্ন দেশের লিখিত ভাষা ও কথাবার্তা বুঝতে পারার ক্ষমতা (৪৬) ঘোড়া, হাতি ও যানবাহন সুসজ্জিত করা। (৪৭) সংকেত চিহ্ন বা গুপ্ত বার্তা বোঝা (৪৮) নানা ধরনের যন্ত্রে জ্ঞানলাভ করা (৪৯) স্মৃতিশক্তি বা স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করার অভ্যাস (৫০) নানা বিষয়ের গ্রন্থ পাঠ (৫১) নানা পুস্তক রচনা (৫২) অভিধান ও বিশ্বকোশ সংগ্রহ (৫৩) ছন্দের নিয়ম এবং বক্তৃতা শিল্প শিক্ষা (৫৪) লুকানোর শিল্প, তুলো রচিত দ্রব্যকে পশমরূপে রূপদান, সাধারণ দ্রব্যকে চিত্তাকর্ষক করে তোলা, নানা বস্ত্র পরিধান করা (৫৫) দাবা খেলা ও পাশা খেলায় দক্ষতা, (৫৬) নানা পরিচ্ছদ পরিধান করে নিজেকে অন্যের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলা (৫৭) শিশুদের মতো পুতুল ও গোলাকার সব বস্তু নিয়ে খেলা করা (৫৮) নানা প্রকার শারীরিক ব্যায়াম ও কলাকৌশল শিক্ষা করা (৫৯) রাজনীতি শিক্ষা করা (৬০) সামরিক রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞান (৬১) মুখ দেখে মানুষের চরিত্র আন্দাজ করতে পারা (৬২) কৃত্রিম পুষ্প তৈরি (৬৩) কাদা বা নরম মাটি দিয়ে পুতুল, মূর্তি নির্মাণ (৬৪) গণিত বিষয়ে জ্ঞান লাভ।
বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ মূলত গণিকাদের আকর গ্রন্থ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, গ্রন্থে উল্লিখিত বিধি-নিষেধগুলি যে কোনও নরনারীর সুস্থ যৌন জীবন ও সম্পর্কের জন্য অমূল্য দিক নির্দেশ। আর ৬৪ কলার বেশ কয়েকটি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষণীয় ও কিছু বিশেষ কলা বিশেষ ক্ষেত্রে কাজের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী, যেমন- গুপ্তচর বিভাগ, সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক মন্ত্রণার ক্ষেত্রে।
বাৎস্যায়নের গ্রন্থে তৎকালীন সমাজের একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সেকালে আমাদের দেশ বিধর্মী দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। দেশে স্ত্রীদের যথেষ্ট স্বাধীনতাও ছিল। এমনকি বেশ্যারাও চাইলে বিবাহ করে আর পাঁচজন মেয়ের মতো সংসার করতে পারত। স্বামী তাকে কখনও পূর্ব পেশা নিয়ে খোঁটা দিতেন না। বিবাহের পরেও সে পুরনো ব্যবসা বজায় রাখতে পারত, শর্ত, স্বামীর সঙ্গে এক বছর কাটানো ও সন্তান লাভের পর। সমাজে
স্ত্রী-পুরুষ স্বাধীনভাবে মেলামেশা করত, এমন কি কৌশলে নানা শ্লোকের মাধ্যমে যৌনতার ইঙ্গিত দিয়ে ঠাট্টা তামাশা অশ্লীল বলে বিবেচিত হত না। বরং তা রুচিবোধের পরিচায়ক বলেই ধরা হত। পুরুষেরা পুঁথিপাঠ, গ্রন্থরচনা, ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষে দেশ-বিদেশে গমন করত। নারীরা স্বাধীনভাবে নানা শিল্পকলা ও সঙ্গীতকলায় পারদর্শিনী হয়ে সংসারের নানা সুখ-সম্পদ ভোগ করত। সে আমলের গণিকারা ছিলেন নৃত্যগীত নিপুনা ও বিলাস ব্যসন ও কৃষ্টিসম্পন্না। দেশের রাজকর্মচারী ও ধনী, অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা নৃত্যগীত ও বিলাস ব্যসনে অনেকটা সময় কাটাতেন। তাঁরা জীবনকে ভোগ করতেন ধর্ম, অর্থ, কামের প্রতীক রূপে। কাম-উপভোগের ক্ষেত্রে কোন সামাজিক বাধা ছিল না। তৎকালীন সামাজিক নিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে পরস্ত্রীগমন, পতিতাগমন প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে। নারী স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দের পুরুষ উপভোগ করতে পারত। পুরুষ অর্থ ও উচ্চপদের অধিকারী হলে ইচ্ছানুযায়ী নারী সম্ভোগ করতে পারত, কিন্তু বলপ্রয়োগ ছিল অশাস্ত্রীয়। গুণবতী বা রূপবতী নারী দরিদ্রা হলেও রাজ্যের প্রধান পুরুষকেও কামনা করতে পারতেন।
যদি কোন পুরুষ বংশদোষে হীনপদ বা অর্থাভাবে দীন হীন অবস্থা প্রাপ্ত হতেন, তিনিও শিল্প বা কলার প্রভাবে রাজ্যের রাজকন্যাকেও শয্যাসঙ্গিনী করতে পারতেন। বাৎস্যায়নের গ্রন্থ ছাড়া অন্যান্য সংস্কৃত পুঁথিতেও প্রাচীন ভারতীয় সমাজের এই উদার দৃষ্টান্ত পাই।
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরই প্রয়োজনে বদল হয় সামাজিক রীতিনীতি। প্রাচীন গ্রন্থ সর্বদাই অতীত ও বর্তমানের সেতু রূপে আমাদের পরিচালিত করে আরও উন্নততর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে। তাই আজও, সহস্র বছর পেরিয়ে এসেও মহর্ষি বাৎস্যায়ন ও তাঁর গ্রন্থ ‘কামসূত্র’-এর পর্যালোচনা আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
Ref. Books:
The Kamasutra: Original Sanskrit by Vatsyayana, an English translation by Larse Martin Fosse; Woodstock, NY, YogaVidya.com, 2012.
Impact of Puruṣārthas in modern life: An observation, Mithun Howladar, International Journal of Sanskrit Research Anantaa.
Vatsyayana, Encyclopaedia Bitanica.
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন