prabandho-marxio-nondontatta

মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব নিয়ে দুটি কথা
শরীফ আতিক-উজ-জামান


মার্কসবাদে নন্দনতত্ত্বের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। কান্টের মতো মার্কস বিশ্বাস করতেন যে সৌন্দর্য হলো কোনো নিস্পৃহ দর্শকের শিল্পকর্ম দর্শনের পর মানসিক ক্ষমতাসমূহের সমন্বয় সাধনের ফলস্বরূপ প্রাপ্ত আনন্দময় অভিজ্ঞতা। পুঁজিবাদ সবকিছুকে একটা ক্ষণস্থায়ী মূল্য দেয় এবং সব দর্শক হয়ে ওঠে আগ্রহী ভোক্তা, সৌন্দর্য অনুরাগী নয়। বিশ শতকের মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ও হার্বাট মারকিউস মার্কসের অবস্থানের উপসংহার টেনেছেন এভাবে যে কোনো শিল্প পুঁজিবাদী সমাজে প্রতারণার শিকার হয়। তাদের মতে, শিল্পকলা মূল্যায়নের সঠিক মাপকাঠি হলো শ্রমিক বিচ্ছিন্নতা। শিল্পী ও শিল্পকর্ম যতটা বিচ্ছিন্ন ততটাই সঠিক তার রাজনৈতিক বক্তব্য। যে শিল্পকর্ম চোখে তৃপ্তি বা মনে প্রশান্তি দেয় না তবে উত্তেজিত করে, তা যথার্থ হিসেবে বিবেচিত। তাকে সুন্দর না হলেও চলে, কারণ তার মাঝে উপযোগিতা আছে আর তা ব্যক্তি বা সমাজের হয়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে উৎসাহ যোগায়। সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হলে সুন্দর শিল্পের অস্তিত্ব নির্মিত হয় না। যা কিছু কদর্য ও দানবীয় তা শিল্পে ঘৃণার্হ।

Capital-এর অসমাপ্ত তৃতীয় খণ্ডে কার্ল মার্কস বারংবার একটি ইতিহাস-উত্তর কল্পরাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিশীলতা বিচ্ছিন্ন শ্রমের জায়গা দখল করেছে। তাঁর মতে মানুষের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো নান্দনিক বোধ যা তাকে পশু থেকে আলাদা করেছে। বর্তমান পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের ঘৃণ্য অপরাধ হলো, তারা শুধুমাত্র দারিদ্র্য তৈরি করেছে তাই নয় বরং তারা সমাজকে নান্দনিক ভাবনা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। পুঁজিতন্ত্র সব ধরনের মূল্যবোধকে পাশ কাটিয়ে মানুষের দানবীয় ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষাকে উৎসাহ যোগায়। এর পাশাপাশি শিল্পের নামে উদ্ভট বিষয়াবলীর প্রশংসা করে। সামাজিক অন্যায়-অবিচারের সাথে সাথে সৌন্দর্য ধ্বংসের বিষয়টিও মার্কসকে ক্ষুব্ধ করেছে।

মার্কসের মতে, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে চিত্রশিল্প মানুষের মানসিক ক্ষমতাসমূহের মাঝে সমন্বয় তৈরির বদলে তাদের বেদনার অনুভূতি অবশ করে দেয়। প্রকৃত শিল্পী কোনো ভ্রান্ত সৌন্দর্য নির্মাণের পথে হাঁটেন না এবং মানুষের যন্ত্রণার সঠিক উপলব্ধি জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। মার্কস তার দার্শনিক তত্ত্ব রচনায় যে সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় তিনি ব্যয় করেছেন নন্দনতত্ত্বের অধ্যয়নে। জানা যায়, মার্কস একটা সময় নন্দনতত্ত্ব নিয়ে লিখতে চাইলেও পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু শ্রমবিভাজন ও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে যে তত্ত্ব তিনি প্রকাশ করেছেন তা থেকে নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কিত তার ধারণা সুস্পষ্ট প্রকাশ পায়।

সবাই মার্কসবাদকে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্বের কাঠামোতে ফেলে বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায় যে শ্রমের মধ্যেই তিনি নান্দনিক মূল্য লুকানো দেখতে পান। Capital-এর তৃতীয় খণ্ডে মার্কস আকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন যে সাম্যবাদী সমাজের শিল্প কারখানায় শ্রমিক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নান্দনিক কিছু সৃষ্টিতে। যেভাবে নিয়োজিত হচ্ছেন। বিচ্ছিন্ন অতীতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত শ্রম দিয়ে কাজের মাধ্যমে একটি আনন্দময় জগত নির্মাণ করেতেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক জগতের সদর্থক বৈশিষ্ট্য তুলে এনে তার কর্মকা-কে মহিমান্বিত করেছে। শ্রমের নান্দনিকতা প্রাগৈতিহাসিক সময়েও বলবৎ ছিল। প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষই একমাত্র সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম। মার্কসের মতে মানুষের শ্রমই নান্দনিক, এমনকি মৌমাছির স্বতঃপ্রবৃত্ত শ্রম অপেক্ষা তা উন্নত বৈশিষ্ট্যের। সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের যে নিস্পৃহ ভাব তা তার চরিত্রের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আরো কদর্যরূপ ধারণ করেছে এবং সবকিছুর মূল্য স্বার্থের অধীনতা লাভ করেছে। পুঁজিতন্ত্রের আগ্রাসনের সাথে সাথে সমাজ থেকে সৌন্দর্য বা নান্দনিক চেতনা হারিয়ে যেতে বসেছে। পুঁজিতন্ত্র এমনই এক পদ্ধতি যাকে সংস্কার করা বা বদলানো যায় না এবং মার্কস যুক্তি দেখাচ্ছেন যে পুঁজিতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন সমগ্র পৃথিবীকে মুঠোয় পুরে ফেলতে চাইছে। সমস্ত শ্রম আজ ভ্রষ্ট ও বিকৃত হয়ে গেছে এবং মানুষ পশুতে রূপান্তরিত হয়েছে। মার্কস বারংবার সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন যে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে সামাজিক উৎপাদন বাড়ানো হয়ে থাকে। অবদমন ও প্রতারণার মাধ্যমে উৎপাদনকারীরা তা করে থাকে। তারা শ্রমিককে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলেন একটি যন্ত্রাংশের মতো। তার কাজের আনন্দময় দিকটিকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়ে তাকে জঘণ্য পরিশ্রমের বিষয় করে তোলেন। পুঁজিতন্ত্রের নিস্পেষণে তার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

যদি মার্কসের বিশ্লেষণ গ্রাহ্য করা হয়, তাহলে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে বাস্তবতাকে অবহেলা করা হয়ে থাকে। একটি যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি প্রতারক ও প্রতারিতের মাঝে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থান নির্মাণ করে। মার্কসবাদে শিল্পীও অন্যদের মতোই একজন যোদ্ধা। শিল্পী একজন শ্রমিক কিংবা শ্রমিক একজন শিল্পী। তাদের শ্রম থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা এবং ব্যক্তিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতাকে সমান করে দেখা প্রয়োজন। মার্কসের মতে, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রম হলো কর্মীর বাহ্যিক ব্যাপার যা সে বাড়ির বাইরে থেকে সম্পাদন করে আর সেখানে তার মূলসত্তা অংশগ্রহণ করে না। তার শ্রমকে জোর করে আদায় করা হয়, অর্থাৎ শ্রমিক কাজ করেন তার নিজ শ্রম থেকে সন্তুষ্টি লাভ করেন বলে নয়, তার জীবনধারণের চাহিদা মেটানোর জন্য। আর এভাবেই সে তার সমস্ত শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। শ্রমিক তাই সমস্ত শ্রমকে এড়িয়ে চলতে চান, তাকে নিজের স্বত্বার বাইরে বিচ্ছিন্ন একটি বিষয় হিসেবে তাকে কল্পনা করেন। পুঁজিবাদে শ্রম শিল্পের মতো কোনো স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের প্রকাশ নয়, বরং তা অন্যের লাভালাভে ব্যয়িত বিষয় বলে শ্রমিক মনে করেন। এর মাঝ দিয়ে তার সত্তার অপচয় হচ্ছে বলে তার মনে হয়। পুঁজিবাদের মতো অমানবিক পদ্ধতিতে সব কাজকর্ম এবং সম্পর্কসমূহও কদর্য ও অশ্লীল।

পুঁজিপতি সৌন্দর্য উপভোগে অক্ষম। মার্কস মনে করতেন যে উনিশ শতকের পুরোটা সময়ই নান্দনিক চেতনাহীন এবং কখনো কখনো তা প্রতি-নান্দনিক। তবে কান্টের মতের সাথে তার ভাবনার কিছু সাদৃশ্য আছে। কান্ট মনে করতেন যে সৌন্দর্য উপভোগে বিষয়ী শিল্পকর্মের প্রতি একটি নিস্পৃহ ভাব নিয়ে অগ্রসর হয়। আবার তিনি এও মনে করতেন যে সঠিক বিবেচনা অসম্ভব। পুঁজিতান্ত্রিক মূল্যবোধ শিল্পের প্রতি সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকাতে শেখায়, আর তাই ঠিকমত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে না। একজন বিচ্ছিন্ন শিল্পী শুধুমাত্র মানসিক ক্ষমতাগুলোকে সমন্বয়ের ভণিতা করেন। পুঁজিতন্ত্র মানুষের নান্দনিক আকাক্সক্ষাসহ সব রকমের স্পৃহা কমিয়ে দেয়। মানুষ বেশি খাবে না, পড়াশোনা করবে না, শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড- উপভোগ করবে না, কোনো কিছু গভীরভাবে ভাববে না, কম ভালবাসবে তবে অধিক যৌনতায় আগ্রহী হয়ে উঠবে। ব্যাপক সম্পদ জড়ো করার মাধ্যমে ভোগের লিপ্সা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তুলবে, আর একইভাবে উপভোগের ক্ষমতা হারাবে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দৈহিক চাহিদা মিটলেও তা মার্কসের কাছে গুরুত্বহীন, কারণ তা মানুষের নান্দনিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ। উপযোগিতা পাশবিক আর নান্দনিকতা হলো মানবিক চাহিদা। মার্কস ইংরেজি সাহিত্য নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ মত প্রকাশ করেছেন। ইংরেজ মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভণিতা, অজ্ঞতা, কর্তৃত্বপরায়ণতা ইত্যাদি তুলে ধরার জন্য তিনি ডিকেন্স, থ্যাকারে ও ব্রন্টি বোনদের প্রশংসা করেছেন।

মার্কসের মতে, শিল্প সমাজবাস্তবতা তুলে ধরে একটি বিচ্ছিন্ন ও কদর্য সমাজে সমসাময়িক শিল্পের অবস্থান নির্ণয় করে। মার্কসের মত সমর্থন করে হার্বাট মারকিউস মন্তব্য করেছেন যে শিল্পীকে খাটিঁ, যথার্থ ও প্রাসঙ্গিক হতে হলে আধুনিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। পুঁজিবাদ জীবনকে বেশি মাত্রায় বিলাসী ও আনন্দদায়ক করে তোলে এবং শিল্পী মাঝে মাঝে ভেবে পান না কেন এসব প্রতিহত করতে হবে। বিচ্ছিন্নতা ও দুর্দশা চরমে পৌঁছালে তা প্রতিক্রিয়াশীল ও অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় যার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় বা অস্বীকার করতে হয়। এসব কারণেই মার্কস শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খানিকটা হতাশায় ভুগতেন। তিনি শিল্পের আনন্দদানের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে শিল্পীকে টানাপোড়েনের মধ্যে বসবাস করতে হয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়িয়ে তুলতে হয় এবং শেষমেষ বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে হয়। এই ধারণাকে মারকিউস ‘Great Refusal’ বলেছেন যার পরাবাস্তববাদী ও ভীতিকর গূঢ়ার্থ রয়েছে। তিনি মনে করতেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভালো শিল্পও বিষয়ীর ক্রোধ ধারণ করে। মার্কস ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলতেন যে কারিগরি দক্ষতার সাথে প্রামাণ্যতার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন মনে করতেন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে বড়। আচার-অনুষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে শিল্প নির্মাণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে শিল্পচর্চা করা। একজন শিল্পী রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতার সাথে সম্পর্ক নির্মাণ ব্যতীত খাঁটি শিল্প সৃষ্টি করতে পারেন না। মার্কসীয় আদর্শ ধারণকারী একজন শিল্পী সচেতনভাবে তার শিল্পকর্মে নিজের জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ তুলে ধরেন। আর কেবল তখনই তিনি যে পঙ্কিল জগতে বসবাস করেন তাকে অভিযুক্ত করতে পারেন। মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব বর্তমানকে কদর্য বিবেচনা করে।

মারকিউস ও প্রভাবশালী তাত্ত্বিকেরা পৃথিবীকে জঘন্য স্থান ও তার অধিবাসীদের দানবীয় হিসেবে দেখার বিষয়টি খারিজ করে দিয়েছেন। মার্কসের এই দার্শনিক শিক্ষণের ভিত্তি ছিল হেগেলীয় দর্শন। হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার মূল সুর হলো, জগতে মানুষের মূল উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। মানুষের ইতিহাস হলো তার নিরাকার চৈতন্য ও বস্তুর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, যার ভেতর দিয়ে সে স্রষ্টা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে। আর এভাবেই মানুষ ধীরে ধীরে তার নিজস্ব প্রকৃতি, চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আত্মসচেতনতা লাভ করে। হেগেলের সাথে মার্কসের তফাৎ খুব স্পষ্ট। হেগেল সৃষ্টিশীল আত্মপ্রকাশকে আধ্যাত্মিকতার সাথে যোগসূত্র হিসেবে দেখেন। আর মার্কস সৃষ্টিশীল নির্মাণকে মানবিক বৈশিষ্ট্য রূপে ভাবতে চান। হার্বাট মারকিউস মনে করেন যে বিচ্ছিন্নতা দ্বারা শিল্পীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তারা সেই বিচ্ছিন্নতা ভাঙার ক্ষমতাও রাখেন। হেগেলের সাথে মার্কস ও মারকিউসের আদর্শিক পার্থক্য রয়েছে। তারা দুজনই মনে করেন যে শিল্পী যে কোনো বিদ্রোহকে নিরন্তর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, আর হেগেল মনে করেন যে তা পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। মার্কসের নান্দনিক বীক্ষণের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, জগত দুর্নীতিগ্রস্ত আর সেই কারণে মানুষ নিজের স্বত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তারা মানবিক হয়ে উঠতে অক্ষম যার অর্থ সে নান্দনিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্য মূল্যায়ন করতে পারেনা। আর এই অসন্তুষ্টি সব শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান অন্ধকার সময়ের জন্য শিল্প একমাত্র প্রতিবাদী সচেতনতা নির্মাণের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের মাঝে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা ব্রেশটীয় প্রকাশবাদ অতিমাত্রায় উদ্ভটত্ব ও বিচ্ছিন্নতাকে উৎসাহ যোগায়, আর তা মানসিক ক্ষমতাসমূহকে একত্রিত করে আনন্দদায়ক কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। আর তাই সৌন্দর্য নির্মাণও সম্ভব হয় না। মার্কসবাদী শিল্পী পুঁজিবাদী শক্তি সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন এবং আরো বেশি মাত্রায় প্রতিবাদী শিল্প নির্মাণে সচেষ্ট হবেন। যেহেতু বিপ্লবীরা সহিংস কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে সমাজকে অস্বীকার করেন, শিল্পীও তেমনি তার শিল্পকর্মে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যান বা অভিযুক্ত করেন। সামগ্রিক প্রতিবাদী প্রত্যাখ্যানই মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব। জগতের যে কোনো সৌন্দয প্রত্যাখ্যান করাই মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্বকে দ্বান্দ্বিক অবস্থানে নিয়ে যায়। এই দ্বন্দ্ব জরুরি কারণ তা মার্কসবাদের অন্তর্নিহিত জটিল সমস্যা তুলে ধরে।

আবার দেখা যায় যে কার্ল মার্কস গ্রিক শিল্পকলা পছন্দ করতেন। কিন্তু গ্রিক শিল্পকলা আধুনিক মানুষের মনে যে নান্দনিক আনন্দ দান করে তা প্রকৃত নান্দনিক অভিজ্ঞতার আলোকে নির্মিত নয়। সেই আনন্দ শুধু স্মৃতিবিধূরতার কারণে লাভ করা সম্ভব হয়। কারণ ওই সমাজের শিল্পীরা সমাজব্যবস্থা থেকে আদৌ বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। একজন শিল্পী দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজব্যবস্থা থেকে আনন্দ লাভ করলে তার মধ্যে অনুশোচনা আসা উচিত। একটি সমাজ বিপ্লবের আগ পর্যন্ত বিনোদন ও নান্দনিক উপভোগের বিষয়টিও অপেক্ষমান রাখতে হয়। তার আগ পর্যন্ত বিনোদনধর্মী শিল্প নির্মাণ সঠিক নয় বলে মার্কসের মত।

মার্কসবাদে যে বিষয়টি খুবই বিতর্কিত তা হলো শিল্পীর স্বাধীনতা। পুঁজিবাদী সমাজে শিল্পী পুঁজির বশ্যতা নিয়ে কাজ করেন বলে মার্কস সমালোচনা করেন, কিন্তু সাম্যবাদেও আদর্শের অধীন থেকে শিল্প নির্মাণ করতে গিয়ে শিল্পী তার স্বাধীনতা হারান। শিল্পনির্মাণে শিল্পীর স্বাধীন চিন্তার একটি সুযোগ থাকা দরকার বলে শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, কিন্তু মার্কসীয় দর্শনে সে সুযোগ নেই যা এই আদর্শের সীমাবদ্ধতা। মার্কসের মতে, শিল্প কল্পনানির্ভর না হয়ে জ্ঞানভিত্তিক হবে। কিন্তু শিল্প পরিপূর্ণ বাস্তব বা জ্ঞানভিত্তিক হয় না। সেখানে কল্পনার ছোঁয়া থাকতে হয়। একেবারে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে গিয়ে মার্কসের শিল্পভাবনা তাত্ত্বিক জটিলতা নির্মাণ করেছে। তাই অস্বীকার করার উপায় নেই যে মার্কসের নন্দনতত্ত্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি আদর্শ যেখানে ভিন্নমত ও বিতর্কের যথেষ্ট স্থান রয়েছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *