তৃষ্ণা বসাক
নৌকোর গলুইয়ে একটা জায়গা আছে, যেখানে ভুলক্রমে মেয়েরা পা দিয়ে ফেললে অতি অসন্তুষ্ট হন মাঝিমাল্লারা। পবিত্র এই স্থানটি মেয়েদের স্পর্শে অপবিত্র হয়ে গেল যেন, এমন ভাব ফুটে ওঠে তাঁদের মুখে চোখে।
কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ট্রেনে গোড়া থেকেই এরকম কোন জায়গা নেই। বরঞ্চ মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য মেয়ে কামরা ছিল বরাবর। আজো লোকাল ট্রেনে নিত্যযাত্রিণীদের জন্যে আছে মেয়ে কামরা, লেডিস কম্পার্টমেন্ট বা মহিলা ডিব্বা, এমনকি একটা গোটা ট্রেনই আছে মেয়েদের জন্যে, মাতৃভূমি লোকাল, এসবই মেয়েদের একটা আলাদা নিবিড় স্পেস তৈরি করেছে।
যদিও রেলের চাকরিতে মেয়েদের তেমন জায়গা ছিল না অনেকদিন পর্যন্ত। রেলে কাজ করা পুরুষদের বলা হত রেলওয়ে মেন। তারা পরিবার নিয়ে রেলের কোয়ার্টারে থাকত, ছেলেরা বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রেলেই ঢুকত, মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হত রেলে চাকরি করা পরিবারেই। রেলের ছিল অত্যন্ত সুবিন্যস্ত একটি পরিকাঠামো, যেখানে কৌলীন্য ও সামাজিক মর্যাদা নির্ভর করত কে কোন পজিশনে চাকরি করে তার ওপর।
ইতিহাস বলে ১৮৫৪ সালের ১৫ অগস্ট, প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ২৪ মাইলের রেললাইন ব্যবহৃত হয়। এর পর প্রথমে হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া, পরে ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত নিয়মিত ট্রেন চালু হয়। প্রথমে পণ্য পরিবহণের জন্য চালু হলেও অচিরেই আরও বহু রেললাইন বসে এবং মানুষের যাতায়াতের অঙ্গ হয়ে ওঠে রেলগাড়ি। ‘সম্বাদ প্রভাকর’ কাগজে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘শারদ্বর্ণন’ কবিতায় লিখলেন— ‘টাকা ছেড়ে থাবড়ায়/ পার হয়ে হাবড়ায়/ চালিয়েছে রেলওয়ে পথে। হুগলির যাত্রী যত/ যাত্রা করি জ্ঞান হত/ কলে চলে স্থলে জলে সুখ। বাড়ী নহে বড়ো দূর/ অবিলম্বে পায় পুর/ হয় দূর সমুদয় দুখ’। ১৮৮৪ সালে দুর্গাচরণ রায়ের লেখা ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ বইয়ে দেবতা বরুণ, ব্রহ্মাকে ভারতে রেলপত্তনের ইতিহাস বর্ণনা করে বলেছেন— ‘যে দিন প্রথমে চলে অনেকে সাহস করিয়া উঠে নাই। তৎপরদিন আরোহীর সংখ্যা দেখে কে?’। দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকামিনী দাসী, রূপচাঁদ পক্ষী থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু লেখকের লেখায় এই নতুন আশ্চর্য যানের উল্লেখ ছিল।
রবীন্দ্রনাথের ‘অপরিচিতা’ একটি আশ্চর্য গল্প, যেখানে রাতের ট্রেন যাত্রায় আলো পড়ে এক যুবকের মনে, মা ও মামার হাতের পুতুল হয়ে যে পরমাকে তার পাওয়া হয়নি, বিবাহ বাসরে, মেয়ের গায়ের সোনা খুলিয়ে মামা ওজন করে দেখতে চেয়েছিলেন তারা ঠকেছেন কিনা, আর তার প্রতিবাদে মেয়ের বাবা বর আর বরযাত্রীকে খাইয়ে বিদেয় করেন, মেয়ের বিয়ে না দিয়ে। সেই ঘটনার চার বছর পর হঠাৎ দেখা হয়ে যায় ট্রেনে তার সঙ্গে, চার দেওয়ালের চৌহদ্দির মধ্যে নয়, দূরপাল্লার ট্রেনে, ট্রেনের গতি, রাতের অন্ধকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুবকটির মনের তোলপাড় কী আশ্চর্য নিপুণতায় গেঁথেছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘মাকে লইয়া তীর্থে চলিতেছিলাম। আমার উপরেই ভার ছিল। কারণ, মামা এবারেও হাবড়ার পুল পার হন নাই। রেলগাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। ঝাঁকানি খাইতে খাইতে মাথার মধ্যে নানাপ্রকার এলোমেলো স্বপ্নের ঝুমঝুমি বাজিতেছিল। হঠাৎ একটা কোন স্টেশনে জাগিয়া উঠিলাম। আলোতে অন্ধকারে মেশা সেও এক স্বপ্ন। কেবল আকাশের তারাগুলি চিরপরিচিত- আর সবই অজানা অস্পষ্ট। স্টেশনের দীপ কয়টা খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া আলো ধরিয়া এই পৃথিবীটা যে কত অচেনা এবং যাহা চারিদিকে তাহা যে কতই বহুদূরে, তাহাই দেখাইয়া দিতেছে…
এমন সময়ে সেই অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত রাত্রে কে বলিয়া উঠিল ‘শিগগির চলে আয়, এই গাড়িতে জায়গা আছে’
বাঙালি মেয়ের মুখে বাংলা কথা কী যে মধুর তা এমন করে আচমকা অসময়ে অজায়গায় শুনলে বোঝা যায়।
‘গাড়ি লোহার মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল। আমি মনের মধ্যে গান শুনিতে শুনিতে চলিলাম। তাহার একটিমাত্র ধুয়া ‘গাড়িতে জায়গা আছে’
এরপর কি উৎকন্ঠা, প্রতি স্টেশনেই একবার করে মুখ বাড়িয়ে দেখা পাছে সে নেমে যায়।
এই ট্রেনযাত্রায় মেয়েটিই হয়ে উঠল মা আর ছেলের পথ প্রদর্শক। এমনকি রক্ষাকর্ত্রীও। সাহেবরা অন্যায় ভাবে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে চাইলে সে প্রতিবাদে ফেটে পড়ল, বলল ‘না আমরা এ গাড়ি ছাড়িব না’। এ গল্প একদিকে যেমন নারীর স্বতন্ত্র সত্তার প্রতিষ্ঠার, তেমনি স্বাদেশিকতার চেতনারও। আর এর প্টভূমি ট্রেন। এই ট্রেনেই মেয়েটি পুরুষমানুষের উপস্থিতির তোয়াক্কা না করে খাবারওলার কাছ থেকে চানা মুঠ কিনে ছোটদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছিল, এই জড়তা ভাঙার পরিবেশটিও রচনা করে দিয়েছিল সেই প্রথম যুগের রেলযাত্রা। মনে রাখতে হবে এ সেই সময়ের কথা যখন ট্রেনে চড়তে হলে অনেক মেয়েই কার্যত না খেয়ে থাকতেন ছোঁয়াছুঁয়ি হবার ভয়ে। দু তিনদিনের ট্রেন যাত্রায় তাঁরা প্রায় আধমরা হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতেন। শরতকুমারী চৌধুরানীর শুভ বিবাহ গল্পে এমন নজির আছে।
কানপুরে গাড়ি এসে থামতে উদ্ঘাটিত হল এ আসলে সেই মেয়েটি, যাকে পেতে গিয়েও পাওয়া হয়নি। তবু আশা ছাড়ে না সেই যুবক, তার কানে বাজে ‘জায়গা আছে’। শুধু তো ট্রেনের কামরায় নয়, মেয়েটির মনের কামরাতেও বুঝি। এই অনির্বচনীয় আশ্বাসে শেষ হয় গল্পটি।
রবীন্দ্রনাথেরই একটি কবিতা ‘হঠাৎ দেখা’-য় আবার প্রাক্তন প্রেমিক যুগলের দেখা বিষাদ ঘনিয়ে তলে। মনে পড়ে যায় ‘জতুগৃহ’ কিংবা ‘ইজাজত’ সিনেমার অবিস্মরণীয় ওয়েটিং রুমের দৃশ্য দুটি।
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু —
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় —
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়;
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
“কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, “বলব।”
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
“আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।”
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
“রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।”
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, “থাক্, এখন যাও ও দিকে।”
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।
তবে সব ট্রেনযাত্রা এমন হয় কি? শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’-র ট্রেন সফর ঘনিয়ে আনে দুর্যোগ, মহিমের কাছ থেকে সুরেশ ছিনিয়ে নিয়ে যায় অচলাকে এই ট্রেন থেকেই।
মনে পড়ছে বিভূতিভূষণের ‘ডাকগাড়ি’ গল্পটা, যেখানে জীবনের সব দিক থেকে বঞ্চিত রাধা ভেবেছিল মাঝে মাঝে স্টেশনে এসে বসে থাকলে ক্লিন্ন মলিন জীবনটা অন্যরকম হয়ে যায়।
বিখ্যাত সিনেমা ‘ফুলেশ্বরী’ তো আগাগোড়া ট্রেন ঘিরেই। ট্রেন এলে ‘ফেলাগ’ দেখানো বৃন্দাবন মোটেই পাত্তা পায় না তিনপুরুষের রেলের কারবারী ফুলির কাছে। সেখানে গানের কথাতেও এসেছে ট্রেন। সেই যে একটু ধেনো খেয়ে এসে যখন অনুপকুমার লিলি চক্রবর্তীকে ঘিরে ঘিরে গাইছেন ‘হ্যাদে গো পদ্মরানি, তুমি ভারি সুন্দরী, তোমার মনের বয়লারে, মন যে আমার কয়লারে, আহা মরি মরি’। ট্রেন নিয়ে আর কী কী গান আছে ভেবে ভেবে দুতিনটে মনে পড়ল-
ইফ ইউ মিস দ্য ট্রেন আই মর্ন, ইউ উইল নো দ্যাট আই হ্যাভ গন, ইউ ক্যান হেয়ার দ্য হুইসেল ব্লো এ হান্ড্রেড মাইলস…হান্ড্রেড মাইলস…!
‘তুফান মেল যায়। তুফান মেল’ কানন দেবীর গাওয়া গান ‘শেষ উত্তর’ ছবিতে। এই সিনেমাতেই সম্ভবত কানন দেবীর স্নানের একটি দৃশ্য ছিল। পোশাক খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন কানন দেবী। দর্শক উদ্গ্রীব। এমন সময় সেই স্নানদৃশ্য ঢেকে দিয়ে তুফান মেল চলে গেল। বাইরে বেরিয়ে নাকি হতাশ জনতা বলাবলি করত ‘একটা দিনও কি ট্রেন লেট করতে পারে না?’
‘ট্রেন নিয়ে আফসোসের পাল্লাটা বেশ ভারি। এ কারণে প্রবাদ হয়ে দাঁড়ায়- নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে? অথবা ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং/আইতে যাইতে কতদিন? কখন ট্রেন ছাড়বে আর কখন পৌঁছাবে, কেমন গতিতে চলবে সেই টেনশন থেকেই গল্প তৈরি হয়। যেমন-স্টেশন মাস্টারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক মহিলা। এই মহিলার তিনকূলে কেউ নেই, শুধু একটা গাভী আছে। রেলস্টেশনে এই গাভী রাজার মতো ঘুরে বেড়ায়। এই গাভীর দুধ প্রতিদিন এক বা একাধিক লোক দুইয়ে নিয়ে যায়। স্টেশন মাস্টারকে জড়িয়ে মামলা করার কারণ এই যে ট্রেন যতক্ষণ স্টেশনে থেমে থাকে আর যাত্রা শুরু করার পর যে গতিতে চলে, তাতে এক বা দুইবার গরুর দুধ দুইয়ে নিয়ে যাওয়া যায়!’
হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ছিল এক পাগলের কথা। সে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতো-‘বাবারা লাইনে থাকিস!’ ট্রেনের মতো জীবনের লাইনে থাকাটাও জরুরি। মারফতি ভাণ্ডারি গানের কথাও তাই এমন-বাবা ভাণ্ডারি/তেল ছাড়া চলে না রেলগাড়ি! বাবা ভাণ্ডারি/লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি! লাইনে না থাকলে নাকি কখনও সাফল্য আসে না।
ইতিহাস বলে ট্রেন আসার পর বাঙ্গালিনীর যৌনজীবন আর আগের মতো রইল না। আগে যারা যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে কলকাতার চাকুরিস্থল থেকে কয়েকমাস অন্তর বাড়ি আসতেন, তাঁরা এখন সপ্তায় সপ্তায় বাড়ি আসতে লাগলেন, কেউ কেউ আবার কলকাতার বাসা বা মেস ছেড়ে বাড়ি হেকেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে লাগলেন। তাতে যেসব স্ত্রীরা চাতকিনীর মতো তাকিয়ে থাকতেন স্বামী ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে, তাঁদের সন্তপ্ত হৃদয়ে প্রলেপ এনে দিল রেল। তাঁরা বহুমুখে রেলের প্রশংসা করতে লাগলেন।
ছড়া বাঁধলেন
‘রেল রেল রেল
তোমার পায়ে দিই তেল’
আগে ছিল জল আনতে যাওয়া। এখন হল ট্রেন দেখতে, কলের গাড়ি দেখতে।
‘-এখন তোদের অদৃষ্টক্রমে ইংরেজ বাহাদুররা কল বানিয়েছেন, সেই কলকেতেই সকল কল চলছে,
-হ্যাঁ গো এই, সকল কল চলছে কি গা, আরও কি কল আছে?
সে কি লো, তাও কি আর বুঝতে পারিসনি? নিত্তি নিত্তি তোদের কত্তা বাড়িতে আসছে, এর চেয়ে কি আর সুখ আছে? … আগে কত্তা ন মাসে ছ মাসে আসত, তা আবার পথ চলতেই ছেলের বয়স যেত, তখন বারো বৎসর একটা ছেলে হওয়াই ভার হত, এখন কলিকালে বৎসর ফিরতে দেয়নি, একটু করে সন্তান বাড়ে, তোমাদের তো এখন বৎসর ফাঁক যায় না।
তবে আই সাহেবরা আমাদের পক্ষে
বানায়ে কলের গাড়ি করেছেন রক্ষে
দিবারাত্র লয়ে পতি থাকি গো সর্বরী
প্রণাম প্রণাম করি বড় উপকারী
এমন উপকার এই কেবা কার করে
নিজ পতি নিত্য নিত্য এনে দ্যায় ঘরে ‘
‘বানিয়েছে রেল, রেলের গাড়ি, ধন্য রেলের কারিকর
এখন বিশ্বকর্মার পূজা ছেড়ে ওই সাহেবকে পূজা কর
কতসব বুরী ঝিউরী, কি ছুঁড়ি, কি যুবা বুড়ি
দেখতে যাই তাড়াতাড়ি, ওই যে দিদি কলের গাড়ি
লোহার চাকা লোহার গাড়ি, লোহার উপর রেখে ভর
আয় গো দিদি বেলা গেল, মাথা বাঁধি গিয়ে চলো
ইস্টিশনে গাড়ি এল, বঁধূ আসবার কথা ছিল
আহ্লাদে চাপিয়া পড়, ধর গা দিদি ধর গা ধর’
এই যে ইতিহাস, এ কিন্তু রেল কলোনি কেমনভাবে জাতপাতের বাধা ভাঙছিল, তারও ইতিহাস। আমরা শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে দেখেছি, না খেতে পেলেও গফুর মেয়েকে নিয়ে ফুলবেড়ের চটকলে যেতে রাজি হয়নি, কারণ সেখানে মেয়েদের আব্রু থাকে না। এই যন্ত্রসভ্যতার আর একটা দিক আছে, সেখানে ছোঁয়াছুয়ির ভড়ং রাখা যায় না, উঁচু জাত নিচু জাত সবাই সমান, পেটের দায়ে বর্ণহিন্দু আর দলিত হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়।
‘সে সময় কেবলমাত্র উঁচু জাতের লোকজনরাই সোনার গয়না পরতে পারত। কিন্তু রেল কলোনিতে যারা থাকত, তারা অনেকেই সোনার গয়না পরত। কোনরকম বিধিনিষেধ সেখানে ছিল না। আসলে ব্রিটিশ শাসনকালে রেল কলোনি আর ক্যান্টনমেন্ট গুলো অনেকটা মুক্তাঞ্চলই ছিল দলিত মানুষদের কাছে। সামাজিক বিধিনিষেধের ফতোয়া সেখানে খুব একটা খাটত না। উঁচু জাতের লোকজনদের মতো তারাও এখানে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেত। উঁচু জাতের লোকজনদের মতো দলিতরাও রোজগার করছিল এবং উন্নততর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হচ্ছিল। জাতপাতের ব্যাপারটা ব্যক্তিগতভাবে মানলেও কর্মক্ষেত্রে সেগুলো মানার কোন উপায় ছিল না। এখানে উঁচু জাত আর নীচু জাতের প্রত্যেককেই একই কুয়ো থেকে জল তুলতে হত। গ্রামের মতো এখানে কুয়ো ব্যবহার করা নিয়ে অচ্ছুতদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর কেউ থাকত না। তবে উঁচু জাতের মহিলারা অচ্ছুতদের ছোঁয়া এড়িয়ে চলত। একই সময়ে তারা জল নিতে আসত না এই ভয়ে যে ছোট জাতের লোকদের বালতির ছোঁয়া লেগে তাদের জাত চলে যাবে। অচ্ছুত মহিলারাও ক্রমশ তাদের জীবনযাত্রা পাল্টাচ্ছিল। তারা প্রতিদিন স্নান করত, নিজেদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখত’
শুধু যে জাতপাতের দেওয়াল ভাঙছিল তাই নয়, ট্রেন খুলে দিয়েছিল মেয়েদের রোজকারের পথ। আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’-র জয়গুণ ময়মনসিংহ থেকে চাল এনে অন্য জায়গায় বেচত। যদিও বেআইনি কাজ চাল পাচার। পুলিশের ভয় ছিল। কিন্তু এইভাবে এ বঙ্গে এবং ও বঙ্গে অনেক মেয়েই সংসার টানত, আর সে কাজ সম্ভব হত এই ট্রেনের জন্যেই। ‘জয়গুণ ফতুল্লা স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ট্রেন আসার এখন অনেক দেরি। সে এদিক ওদিক খুঁজে সাথী জোগাড় করে নেয়। নয়টার ট্রেন আসে দশটার পরে। এখানে এক মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না গাড়ি। ভিড়ের মাঝে সঙ্গিনীদের সাহায্যে গাড়িতে উঠে পড়ে জয়গুণ। মেঝেতে থলে বিছিয়ে বসে পড়ে’
এভাবে যেসব মেয়েরা চাল পাচার করত রেলগাড়ি চেপে, তাদের মানবিক মুখ বড় মমতায় এঁকেছেন বিভূতিভূষণ তাঁর ‘গল্প নয়’ গল্পে। একবার হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে উঠে লেখক দেখেন এক বৃদ্ধ মুসলমান হাড় জিরজিরে এক শিশুকে নিয়ে চলেছে। সারা ট্রেনের কারো মাথাব্যথা নেই শিশুটিকে নিয়ে, অথচ বাগনান থেকে ওঠা দুটি নারী, যারা চাল আনতে চলেছে, তাদের কি উদবেগ এই মরণাপন্ন শিশুটিকে নিয়ে। তাদের প্রশ্নের শেষ নেই-
মা কতদিন মারা গিয়েছে বললে?
বয়স কত হল?
কি খেতে দিচ্ছ?
-ঠান্ডা মোটেই লাগিও নি, বিষ্টি হচ্ছে, জানলাটা বন্ধ করে দাও। আহা এমনিতেই ওর কাশি হয়েছে।
একবার খোকা হাঁচল, তরুণী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল জীব!
‘এই গাড়ির মধ্যে এত পুরুষমানুষ ছিল, কেউ ফিরেও চেয়ে দেখেনি ছেলেটার দিকে। সনাতনী মাতৃরূপা নারী দুটি এসে এই মাতৃহীন মৃত্যুপথযাত্রী শিশুকে মাতৃস্নেহের বহু পুরাতন অথচ চির নূতনবাণী শুনিয়ে দিলেঃ সেদিন সে ট্রেনের মধ্যে গুটি কয়েক ক্ষণের জন্য বিংশ শতাব্দী ছিল না- সমাজদ্রোহী, কালোবাজার পুষ্ট লোভী বিংশ শতাব্দী। ছিল সেই অমর মাতৃলোক, বিশ্বের সমগ্র জীবজগত যার করুণাধারায় বিধৌত।
পাঁশকুড়া স্টেশনে বধূটি ও তার সঙ্গিনী ট্রেন থেকে নেমে গেল।’
তবে শুধু স্বনির্ভরতাই নয়, শুধু যৌনতাই নয় কিংবা শুধু মমতাই নয়, ট্রেনের কামরায় লেগে আছে মেয়েদের রক্ত আর অশ্রুও। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ভারত থেকে পাকিস্তানগামী আর পাকিস্তান থেকে ভারতগামী ট্রেনে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ও গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্রেনে চড়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর একাধিক আক্রমণ ও ট্রেনের বগি উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে। কিসান চন্দের ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ আর খুশবন্ত সিং-র ‘ আ ট্রেন টু পাকিস্তান’ ধরে রেখেছে মেয়েদের ওপর নারকীয় অত্যাচারের কাহিনী।
তথ্যসূত্র-
বটতলা সমগ্র, সম্পাদক অদ্রীশ বিশ্বাস
আমার বাবা বালাইয়া, শৌভিক দে সরকার,
আহসান কবির, বাংলাট্রিবিউন
খেরোর খাতা, লীলা মজুমদার
গল্পগুচ্ছ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিভূতিভূষণ গল্পসমগ্র
ও অন্যান্য
কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ট্রেনে গোড়া থেকেই এরকম কোন জায়গা নেই। বরঞ্চ মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য মেয়ে কামরা ছিল বরাবর। আজো লোকাল ট্রেনে নিত্যযাত্রিণীদের জন্যে আছে মেয়ে কামরা, লেডিস কম্পার্টমেন্ট বা মহিলা ডিব্বা, এমনকি একটা গোটা ট্রেনই আছে মেয়েদের জন্যে, মাতৃভূমি লোকাল, এসবই মেয়েদের একটা আলাদা নিবিড় স্পেস তৈরি করেছে।
যদিও রেলের চাকরিতে মেয়েদের তেমন জায়গা ছিল না অনেকদিন পর্যন্ত। রেলে কাজ করা পুরুষদের বলা হত রেলওয়ে মেন। তারা পরিবার নিয়ে রেলের কোয়ার্টারে থাকত, ছেলেরা বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রেলেই ঢুকত, মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হত রেলে চাকরি করা পরিবারেই। রেলের ছিল অত্যন্ত সুবিন্যস্ত একটি পরিকাঠামো, যেখানে কৌলীন্য ও সামাজিক মর্যাদা নির্ভর করত কে কোন পজিশনে চাকরি করে তার ওপর।
ইতিহাস বলে ১৮৫৪ সালের ১৫ অগস্ট, প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ২৪ মাইলের রেললাইন ব্যবহৃত হয়। এর পর প্রথমে হাওড়া থেকে পাণ্ডুয়া, পরে ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাওড়া থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত নিয়মিত ট্রেন চালু হয়। প্রথমে পণ্য পরিবহণের জন্য চালু হলেও অচিরেই আরও বহু রেললাইন বসে এবং মানুষের যাতায়াতের অঙ্গ হয়ে ওঠে রেলগাড়ি। ‘সম্বাদ প্রভাকর’ কাগজে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘শারদ্বর্ণন’ কবিতায় লিখলেন— ‘টাকা ছেড়ে থাবড়ায়/ পার হয়ে হাবড়ায়/ চালিয়েছে রেলওয়ে পথে। হুগলির যাত্রী যত/ যাত্রা করি জ্ঞান হত/ কলে চলে স্থলে জলে সুখ। বাড়ী নহে বড়ো দূর/ অবিলম্বে পায় পুর/ হয় দূর সমুদয় দুখ’। ১৮৮৪ সালে দুর্গাচরণ রায়ের লেখা ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ বইয়ে দেবতা বরুণ, ব্রহ্মাকে ভারতে রেলপত্তনের ইতিহাস বর্ণনা করে বলেছেন— ‘যে দিন প্রথমে চলে অনেকে সাহস করিয়া উঠে নাই। তৎপরদিন আরোহীর সংখ্যা দেখে কে?’। দীনবন্ধু মিত্র, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকামিনী দাসী, রূপচাঁদ পক্ষী থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু লেখকের লেখায় এই নতুন আশ্চর্য যানের উল্লেখ ছিল।
রবীন্দ্রনাথের ‘অপরিচিতা’ একটি আশ্চর্য গল্প, যেখানে রাতের ট্রেন যাত্রায় আলো পড়ে এক যুবকের মনে, মা ও মামার হাতের পুতুল হয়ে যে পরমাকে তার পাওয়া হয়নি, বিবাহ বাসরে, মেয়ের গায়ের সোনা খুলিয়ে মামা ওজন করে দেখতে চেয়েছিলেন তারা ঠকেছেন কিনা, আর তার প্রতিবাদে মেয়ের বাবা বর আর বরযাত্রীকে খাইয়ে বিদেয় করেন, মেয়ের বিয়ে না দিয়ে। সেই ঘটনার চার বছর পর হঠাৎ দেখা হয়ে যায় ট্রেনে তার সঙ্গে, চার দেওয়ালের চৌহদ্দির মধ্যে নয়, দূরপাল্লার ট্রেনে, ট্রেনের গতি, রাতের অন্ধকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুবকটির মনের তোলপাড় কী আশ্চর্য নিপুণতায় গেঁথেছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘মাকে লইয়া তীর্থে চলিতেছিলাম। আমার উপরেই ভার ছিল। কারণ, মামা এবারেও হাবড়ার পুল পার হন নাই। রেলগাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। ঝাঁকানি খাইতে খাইতে মাথার মধ্যে নানাপ্রকার এলোমেলো স্বপ্নের ঝুমঝুমি বাজিতেছিল। হঠাৎ একটা কোন স্টেশনে জাগিয়া উঠিলাম। আলোতে অন্ধকারে মেশা সেও এক স্বপ্ন। কেবল আকাশের তারাগুলি চিরপরিচিত- আর সবই অজানা অস্পষ্ট। স্টেশনের দীপ কয়টা খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া আলো ধরিয়া এই পৃথিবীটা যে কত অচেনা এবং যাহা চারিদিকে তাহা যে কতই বহুদূরে, তাহাই দেখাইয়া দিতেছে…
এমন সময়ে সেই অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত রাত্রে কে বলিয়া উঠিল ‘শিগগির চলে আয়, এই গাড়িতে জায়গা আছে’
বাঙালি মেয়ের মুখে বাংলা কথা কী যে মধুর তা এমন করে আচমকা অসময়ে অজায়গায় শুনলে বোঝা যায়।
‘গাড়ি লোহার মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল। আমি মনের মধ্যে গান শুনিতে শুনিতে চলিলাম। তাহার একটিমাত্র ধুয়া ‘গাড়িতে জায়গা আছে’
এরপর কি উৎকন্ঠা, প্রতি স্টেশনেই একবার করে মুখ বাড়িয়ে দেখা পাছে সে নেমে যায়।
এই ট্রেনযাত্রায় মেয়েটিই হয়ে উঠল মা আর ছেলের পথ প্রদর্শক। এমনকি রক্ষাকর্ত্রীও। সাহেবরা অন্যায় ভাবে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে চাইলে সে প্রতিবাদে ফেটে পড়ল, বলল ‘না আমরা এ গাড়ি ছাড়িব না’। এ গল্প একদিকে যেমন নারীর স্বতন্ত্র সত্তার প্রতিষ্ঠার, তেমনি স্বাদেশিকতার চেতনারও। আর এর প্টভূমি ট্রেন। এই ট্রেনেই মেয়েটি পুরুষমানুষের উপস্থিতির তোয়াক্কা না করে খাবারওলার কাছ থেকে চানা মুঠ কিনে ছোটদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছিল, এই জড়তা ভাঙার পরিবেশটিও রচনা করে দিয়েছিল সেই প্রথম যুগের রেলযাত্রা। মনে রাখতে হবে এ সেই সময়ের কথা যখন ট্রেনে চড়তে হলে অনেক মেয়েই কার্যত না খেয়ে থাকতেন ছোঁয়াছুঁয়ি হবার ভয়ে। দু তিনদিনের ট্রেন যাত্রায় তাঁরা প্রায় আধমরা হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতেন। শরতকুমারী চৌধুরানীর শুভ বিবাহ গল্পে এমন নজির আছে।
কানপুরে গাড়ি এসে থামতে উদ্ঘাটিত হল এ আসলে সেই মেয়েটি, যাকে পেতে গিয়েও পাওয়া হয়নি। তবু আশা ছাড়ে না সেই যুবক, তার কানে বাজে ‘জায়গা আছে’। শুধু তো ট্রেনের কামরায় নয়, মেয়েটির মনের কামরাতেও বুঝি। এই অনির্বচনীয় আশ্বাসে শেষ হয় গল্পটি।
রবীন্দ্রনাথেরই একটি কবিতা ‘হঠাৎ দেখা’-য় আবার প্রাক্তন প্রেমিক যুগলের দেখা বিষাদ ঘনিয়ে তলে। মনে পড়ে যায় ‘জতুগৃহ’ কিংবা ‘ইজাজত’ সিনেমার অবিস্মরণীয় ওয়েটিং রুমের দৃশ্য দুটি।
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু —
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় —
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়;
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
“কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, “বলব।”
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
“আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।”
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
“রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।”
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, “থাক্, এখন যাও ও দিকে।”
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।
তবে সব ট্রেনযাত্রা এমন হয় কি? শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’-র ট্রেন সফর ঘনিয়ে আনে দুর্যোগ, মহিমের কাছ থেকে সুরেশ ছিনিয়ে নিয়ে যায় অচলাকে এই ট্রেন থেকেই।
মনে পড়ছে বিভূতিভূষণের ‘ডাকগাড়ি’ গল্পটা, যেখানে জীবনের সব দিক থেকে বঞ্চিত রাধা ভেবেছিল মাঝে মাঝে স্টেশনে এসে বসে থাকলে ক্লিন্ন মলিন জীবনটা অন্যরকম হয়ে যায়।
বিখ্যাত সিনেমা ‘ফুলেশ্বরী’ তো আগাগোড়া ট্রেন ঘিরেই। ট্রেন এলে ‘ফেলাগ’ দেখানো বৃন্দাবন মোটেই পাত্তা পায় না তিনপুরুষের রেলের কারবারী ফুলির কাছে। সেখানে গানের কথাতেও এসেছে ট্রেন। সেই যে একটু ধেনো খেয়ে এসে যখন অনুপকুমার লিলি চক্রবর্তীকে ঘিরে ঘিরে গাইছেন ‘হ্যাদে গো পদ্মরানি, তুমি ভারি সুন্দরী, তোমার মনের বয়লারে, মন যে আমার কয়লারে, আহা মরি মরি’। ট্রেন নিয়ে আর কী কী গান আছে ভেবে ভেবে দুতিনটে মনে পড়ল-
ইফ ইউ মিস দ্য ট্রেন আই মর্ন, ইউ উইল নো দ্যাট আই হ্যাভ গন, ইউ ক্যান হেয়ার দ্য হুইসেল ব্লো এ হান্ড্রেড মাইলস…হান্ড্রেড মাইলস…!
‘তুফান মেল যায়। তুফান মেল’ কানন দেবীর গাওয়া গান ‘শেষ উত্তর’ ছবিতে। এই সিনেমাতেই সম্ভবত কানন দেবীর স্নানের একটি দৃশ্য ছিল। পোশাক খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন কানন দেবী। দর্শক উদ্গ্রীব। এমন সময় সেই স্নানদৃশ্য ঢেকে দিয়ে তুফান মেল চলে গেল। বাইরে বেরিয়ে নাকি হতাশ জনতা বলাবলি করত ‘একটা দিনও কি ট্রেন লেট করতে পারে না?’
‘ট্রেন নিয়ে আফসোসের পাল্লাটা বেশ ভারি। এ কারণে প্রবাদ হয়ে দাঁড়ায়- নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে? অথবা ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং/আইতে যাইতে কতদিন? কখন ট্রেন ছাড়বে আর কখন পৌঁছাবে, কেমন গতিতে চলবে সেই টেনশন থেকেই গল্প তৈরি হয়। যেমন-স্টেশন মাস্টারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক মহিলা। এই মহিলার তিনকূলে কেউ নেই, শুধু একটা গাভী আছে। রেলস্টেশনে এই গাভী রাজার মতো ঘুরে বেড়ায়। এই গাভীর দুধ প্রতিদিন এক বা একাধিক লোক দুইয়ে নিয়ে যায়। স্টেশন মাস্টারকে জড়িয়ে মামলা করার কারণ এই যে ট্রেন যতক্ষণ স্টেশনে থেমে থাকে আর যাত্রা শুরু করার পর যে গতিতে চলে, তাতে এক বা দুইবার গরুর দুধ দুইয়ে নিয়ে যাওয়া যায়!’
হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ছিল এক পাগলের কথা। সে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতো-‘বাবারা লাইনে থাকিস!’ ট্রেনের মতো জীবনের লাইনে থাকাটাও জরুরি। মারফতি ভাণ্ডারি গানের কথাও তাই এমন-বাবা ভাণ্ডারি/তেল ছাড়া চলে না রেলগাড়ি! বাবা ভাণ্ডারি/লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি! লাইনে না থাকলে নাকি কখনও সাফল্য আসে না।
ইতিহাস বলে ট্রেন আসার পর বাঙ্গালিনীর যৌনজীবন আর আগের মতো রইল না। আগে যারা যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে কলকাতার চাকুরিস্থল থেকে কয়েকমাস অন্তর বাড়ি আসতেন, তাঁরা এখন সপ্তায় সপ্তায় বাড়ি আসতে লাগলেন, কেউ কেউ আবার কলকাতার বাসা বা মেস ছেড়ে বাড়ি হেকেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে লাগলেন। তাতে যেসব স্ত্রীরা চাতকিনীর মতো তাকিয়ে থাকতেন স্বামী ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে, তাঁদের সন্তপ্ত হৃদয়ে প্রলেপ এনে দিল রেল। তাঁরা বহুমুখে রেলের প্রশংসা করতে লাগলেন।
ছড়া বাঁধলেন
‘রেল রেল রেল
তোমার পায়ে দিই তেল’
আগে ছিল জল আনতে যাওয়া। এখন হল ট্রেন দেখতে, কলের গাড়ি দেখতে।
‘-এখন তোদের অদৃষ্টক্রমে ইংরেজ বাহাদুররা কল বানিয়েছেন, সেই কলকেতেই সকল কল চলছে,
-হ্যাঁ গো এই, সকল কল চলছে কি গা, আরও কি কল আছে?
সে কি লো, তাও কি আর বুঝতে পারিসনি? নিত্তি নিত্তি তোদের কত্তা বাড়িতে আসছে, এর চেয়ে কি আর সুখ আছে? … আগে কত্তা ন মাসে ছ মাসে আসত, তা আবার পথ চলতেই ছেলের বয়স যেত, তখন বারো বৎসর একটা ছেলে হওয়াই ভার হত, এখন কলিকালে বৎসর ফিরতে দেয়নি, একটু করে সন্তান বাড়ে, তোমাদের তো এখন বৎসর ফাঁক যায় না।
তবে আই সাহেবরা আমাদের পক্ষে
বানায়ে কলের গাড়ি করেছেন রক্ষে
দিবারাত্র লয়ে পতি থাকি গো সর্বরী
প্রণাম প্রণাম করি বড় উপকারী
এমন উপকার এই কেবা কার করে
নিজ পতি নিত্য নিত্য এনে দ্যায় ঘরে ‘
‘বানিয়েছে রেল, রেলের গাড়ি, ধন্য রেলের কারিকর
এখন বিশ্বকর্মার পূজা ছেড়ে ওই সাহেবকে পূজা কর
কতসব বুরী ঝিউরী, কি ছুঁড়ি, কি যুবা বুড়ি
দেখতে যাই তাড়াতাড়ি, ওই যে দিদি কলের গাড়ি
লোহার চাকা লোহার গাড়ি, লোহার উপর রেখে ভর
আয় গো দিদি বেলা গেল, মাথা বাঁধি গিয়ে চলো
ইস্টিশনে গাড়ি এল, বঁধূ আসবার কথা ছিল
আহ্লাদে চাপিয়া পড়, ধর গা দিদি ধর গা ধর’
এই যে ইতিহাস, এ কিন্তু রেল কলোনি কেমনভাবে জাতপাতের বাধা ভাঙছিল, তারও ইতিহাস। আমরা শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে দেখেছি, না খেতে পেলেও গফুর মেয়েকে নিয়ে ফুলবেড়ের চটকলে যেতে রাজি হয়নি, কারণ সেখানে মেয়েদের আব্রু থাকে না। এই যন্ত্রসভ্যতার আর একটা দিক আছে, সেখানে ছোঁয়াছুয়ির ভড়ং রাখা যায় না, উঁচু জাত নিচু জাত সবাই সমান, পেটের দায়ে বর্ণহিন্দু আর দলিত হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়।
‘সে সময় কেবলমাত্র উঁচু জাতের লোকজনরাই সোনার গয়না পরতে পারত। কিন্তু রেল কলোনিতে যারা থাকত, তারা অনেকেই সোনার গয়না পরত। কোনরকম বিধিনিষেধ সেখানে ছিল না। আসলে ব্রিটিশ শাসনকালে রেল কলোনি আর ক্যান্টনমেন্ট গুলো অনেকটা মুক্তাঞ্চলই ছিল দলিত মানুষদের কাছে। সামাজিক বিধিনিষেধের ফতোয়া সেখানে খুব একটা খাটত না। উঁচু জাতের লোকজনদের মতো তারাও এখানে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেত। উঁচু জাতের লোকজনদের মতো দলিতরাও রোজগার করছিল এবং উন্নততর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হচ্ছিল। জাতপাতের ব্যাপারটা ব্যক্তিগতভাবে মানলেও কর্মক্ষেত্রে সেগুলো মানার কোন উপায় ছিল না। এখানে উঁচু জাত আর নীচু জাতের প্রত্যেককেই একই কুয়ো থেকে জল তুলতে হত। গ্রামের মতো এখানে কুয়ো ব্যবহার করা নিয়ে অচ্ছুতদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর কেউ থাকত না। তবে উঁচু জাতের মহিলারা অচ্ছুতদের ছোঁয়া এড়িয়ে চলত। একই সময়ে তারা জল নিতে আসত না এই ভয়ে যে ছোট জাতের লোকদের বালতির ছোঁয়া লেগে তাদের জাত চলে যাবে। অচ্ছুত মহিলারাও ক্রমশ তাদের জীবনযাত্রা পাল্টাচ্ছিল। তারা প্রতিদিন স্নান করত, নিজেদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখত’
শুধু যে জাতপাতের দেওয়াল ভাঙছিল তাই নয়, ট্রেন খুলে দিয়েছিল মেয়েদের রোজকারের পথ। আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’-র জয়গুণ ময়মনসিংহ থেকে চাল এনে অন্য জায়গায় বেচত। যদিও বেআইনি কাজ চাল পাচার। পুলিশের ভয় ছিল। কিন্তু এইভাবে এ বঙ্গে এবং ও বঙ্গে অনেক মেয়েই সংসার টানত, আর সে কাজ সম্ভব হত এই ট্রেনের জন্যেই। ‘জয়গুণ ফতুল্লা স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ট্রেন আসার এখন অনেক দেরি। সে এদিক ওদিক খুঁজে সাথী জোগাড় করে নেয়। নয়টার ট্রেন আসে দশটার পরে। এখানে এক মিনিটের বেশি দাঁড়ায় না গাড়ি। ভিড়ের মাঝে সঙ্গিনীদের সাহায্যে গাড়িতে উঠে পড়ে জয়গুণ। মেঝেতে থলে বিছিয়ে বসে পড়ে’
এভাবে যেসব মেয়েরা চাল পাচার করত রেলগাড়ি চেপে, তাদের মানবিক মুখ বড় মমতায় এঁকেছেন বিভূতিভূষণ তাঁর ‘গল্প নয়’ গল্পে। একবার হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে উঠে লেখক দেখেন এক বৃদ্ধ মুসলমান হাড় জিরজিরে এক শিশুকে নিয়ে চলেছে। সারা ট্রেনের কারো মাথাব্যথা নেই শিশুটিকে নিয়ে, অথচ বাগনান থেকে ওঠা দুটি নারী, যারা চাল আনতে চলেছে, তাদের কি উদবেগ এই মরণাপন্ন শিশুটিকে নিয়ে। তাদের প্রশ্নের শেষ নেই-
মা কতদিন মারা গিয়েছে বললে?
বয়স কত হল?
কি খেতে দিচ্ছ?
-ঠান্ডা মোটেই লাগিও নি, বিষ্টি হচ্ছে, জানলাটা বন্ধ করে দাও। আহা এমনিতেই ওর কাশি হয়েছে।
একবার খোকা হাঁচল, তরুণী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল জীব!
‘এই গাড়ির মধ্যে এত পুরুষমানুষ ছিল, কেউ ফিরেও চেয়ে দেখেনি ছেলেটার দিকে। সনাতনী মাতৃরূপা নারী দুটি এসে এই মাতৃহীন মৃত্যুপথযাত্রী শিশুকে মাতৃস্নেহের বহু পুরাতন অথচ চির নূতনবাণী শুনিয়ে দিলেঃ সেদিন সে ট্রেনের মধ্যে গুটি কয়েক ক্ষণের জন্য বিংশ শতাব্দী ছিল না- সমাজদ্রোহী, কালোবাজার পুষ্ট লোভী বিংশ শতাব্দী। ছিল সেই অমর মাতৃলোক, বিশ্বের সমগ্র জীবজগত যার করুণাধারায় বিধৌত।
পাঁশকুড়া স্টেশনে বধূটি ও তার সঙ্গিনী ট্রেন থেকে নেমে গেল।’
তবে শুধু স্বনির্ভরতাই নয়, শুধু যৌনতাই নয় কিংবা শুধু মমতাই নয়, ট্রেনের কামরায় লেগে আছে মেয়েদের রক্ত আর অশ্রুও। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ভারত থেকে পাকিস্তানগামী আর পাকিস্তান থেকে ভারতগামী ট্রেনে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ও গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্রেনে চড়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর একাধিক আক্রমণ ও ট্রেনের বগি উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে। কিসান চন্দের ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ আর খুশবন্ত সিং-র ‘ আ ট্রেন টু পাকিস্তান’ ধরে রেখেছে মেয়েদের ওপর নারকীয় অত্যাচারের কাহিনী।
তথ্যসূত্র-
বটতলা সমগ্র, সম্পাদক অদ্রীশ বিশ্বাস
আমার বাবা বালাইয়া, শৌভিক দে সরকার,
আহসান কবির, বাংলাট্রিবিউন
খেরোর খাতা, লীলা মজুমদার
গল্পগুচ্ছ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিভূতিভূষণ গল্পসমগ্র
ও অন্যান্য
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন