নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় রাজনীতির নিজস্ব স্বর

নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় রাজনীতির নিজস্ব স্বর
ড. মিল্টন বিশ্বাস

মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ দাশ হয়ে বাংলা কবিতার ইতিহাসে কবির স্বতন্ত্র বা নিজস্ব কণ্ঠস্বর অন্বেষণ করতে গিয়ে আমরা দশকের হিসাব কষতে থাকি কিংবা কোনো এক-দুটি কাব্য-আন্দোলনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গ সামনে আনি অথবা রাজনৈতিক চালচিত্রের প্রভাবে কবি কীভাবে তাড়িত হয়েছেন তা আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হই কিংবা কবির কাব্যশরীর ঘেঁটে তুলনা করে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি কার কতটুকু আলাদা স্বর। এছাড়া আছে জনপ্রিয়তার মানদণ্ড। রাজনৈতিক কমিটমেন্টের সুস্থির অবস্থান আর কাব্যভাষার নতুন কোনো ব্যঞ্জনার আত্মপ্রকাশ মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে কবিকে একটি ঘরানায় আবদ্ধ করার প্রচেষ্টা। এজন্য কোনো কবি প্রেম ও বিরহের কবি, কোনো কবি বিপ্লবের কবি, কোনো কবি রাজনীতি ও সমাজনীতির কবি হয়ে ওঠেন। তবে প্রেম-প্রকৃতি-সমাজ-রাজনীতি-পুরাণ-চিত্রকল্প প্রসঙ্গের উপস্থাপন কবিদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই উপস্থাপনের মধ্যে একটি পৃথক জায়গা দখল করে কবির নিজের কণ্ঠস্বর পাঠকের সামনে উপস্থিত করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। এজন্য দরকার হয় পঠন-পাঠন, মেধা আর আবেগের সমন্বয়। নির্মলেন্দু গুণের রাজনৈতিক কবিতায় এই কাজটি কীভাবে আছে তা অন্বেষণ করতে পারি আমরা।


২১ জুন নির্মলেন্দু গুণের জন্মদিন; ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে জন্মেছিলেন নেত্রকোণায়। তারপর বহু পথ পেরিয়ে তিনি এখন বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন। বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনিও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। নিজের লেখা কবিতা এবং গদ্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হলো- ‘অনেক সময় কবিতা লেখার চেয়ে আমি গদ্যরচনায় বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষ করে আমার আত্মজৈবনিক রচনা বা ভ্রমণকথা লেখার সময় আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে আমি যে গদ্যটি রচনা করতে চলেছি, তা আমার কাব্য-রচনার চেয়ে কোনো অর্থেই ঊনকর্ম নয়। কাব্যকে যদি আমি আমার কন্যা বলে ভাবি, তবে গদ্যকে পুত্রবৎ। ওরা দুজন তো আমারই সন্তান। কাব্যলক্ষ্মী কন্যা যদি, গদ্যপ্রবর পুত্রবৎ।’

বলা হয়ে থাকে, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা জনপ্রিয়তার মূল কারণ তিনি বাঙালি জাতির ‘ভাষার স্মৃতি’ কে ধারণ করে স্মরণীয় পঙক্তিমালা রচনা করেছে। এই কবি বেড়ে উঠেছেন ষাটের উত্তপ্ত অগ্নিবলয়িত সময়ের ভেতর। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ের দিনগুলোতে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে সক্রিয় ছিলেন। এজন্য সমাজ ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ তিনি এখনো। এই কবি কবিতার মাধ্যমে একাত্মতার বাণী প্রচার করেছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্ম হওয়ার সেই বাণী অসংখ্য পাঠককে মুগ্ধ করেছে, বাংলা কবিতায় নির্মিত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র ধারা। খোন্দকার আশরাফ হোসেন দোষগুণ বিবেচনায় তুখোড় জনপ্রিয় এই কবির কবিতায় স্পষ্টতা ও সরল প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পেয়েছিলেন (বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকন)। তিনি স্বীকার করেছেন যে, শৈল্পিক নিষ্ঠা ও প্রাকরণিক দক্ষতা আছে গুণের কবিতায়।


নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় রাজনীতির প্রসঙ্গ আলোচনা করতে হলে কবি হিসেবে তাঁর সাহস ও আত্মপ্রত্যয়ের কথা সর্বপ্রথম বিশ্লেষণ করা দরকার। এক্ষেত্রে তাঁকে স্বাধীনতার কবি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কবি অভিধা দিতে গেলেও সেই প্রসঙ্গটি সামনে আনতে হবে। আর এই সাহস ও প্রত্যয়ের দৃষ্টান্ত রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত তাঁর কবিতার মধ্যে। আসলে কবিতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রথম উচ্চারিত হয় নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়। তাঁর একাধিক কবিতা কিংবা বলা চলে সবচেয়ে বেশি কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ উচ্চারিত হয়েছে। কবির ‘মুজিবমঙ্গল’(২০১২) কাব্যে সংকলিত উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো- ‘প্রচ্ছদের জন্য: শেখ মুজিবুর রহমানকে’, ‘সুবর্ণ গোলাপের জন্য’, ‘হুলিয়া’, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১’, ‘সেই খুনের গল্প ১৯৭৫’, ‘ভয় নেই’, ‘রাজদণ্ড’, ‘নেড়ী কুত্তার দেশে’, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘মুজিব মানে মুক্তি’, ‘শেষ দেখা’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’, ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, ‘শোকগাথা : ১৬ আগস্ট ১৯৭৫’, ‘পুনশ্চ মুজিবকথা’, ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’, ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ প্রভৃতি। মুজিবকে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর প্রথম তিনি কবিতা লেখেন ‘প্রচ্ছদের জন্য’ (পরে এটি ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ কাব্যগ্রন্থে ‘স্বদেশের মুখ শেফালি পাতায়’ নামে অন্তর্ভুক্ত); তখন শেখ মুজিব কারাবন্দি। ১৯৬৯ সালে রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ তাঁকে নায়কের আসন দান করেন। যাঁকে কেন্দ্র করে বাংলার স্বপ্নও আশা-আকাঙ্ক্ষা আবর্তিত হচ্ছিল তখন। মূলত ১৯৬৭-৬৮ সালে গণ-আন্দোলন যখন সামান্য ভাটা পড়েছে, রাজনৈতিক মহলে বঙ্গবন্ধুর একলা চলার নীতি নিয়ে যখন নানা রকম দোলাচল ও বিভ্রান্তি, ঠিক সেই সময় ‘হুলিয়া’ কবিতায় তিনি লেখেন-

ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর?
– আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
-আইয়ুব খান এখন কোথায়?
-শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?
-আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?
এ সম্পর্কে কবি জানিয়েছেন- ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমি প্রথম কবিতা লিখেছিলাম ১৯৬৭ সালে, যখন তাঁর নাম ছিল শুধুই শেখ মুজিবুর রহমান। খুব সম্ভবত ঐটি ছিল তাঁকে নিয়ে রচিত প্রথম কবিতা। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে প্রথম কবিতাটি আমার পক্ষে লেখাটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। কেননা আমার কবিতা তো তাঁকে অনুসরণ করে এসেছে অনেক আগে থেকেই। তিনি ছিলেন আমার কাব্যের এক প্রধান চরিত্র। দোষে-গুণে মিলে তিনি ছিলেন আমার কবিতার নায়ক। ফলে, নির্মম হত্যাকাণ্ডের ভিতর দিয়ে তাঁর জীবনাবসানের পর তাঁকে নিয়ে প্রথম তো আমারই কবিতা লেখার কথা। এটা ছিল ইতিহাস নির্ধারিত।’(বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তাঁকে নিয়ে লেখা প্রথম কবিতা, কবিতায় বঙ্গবন্ধু, ২০১২, শিল্পকলা একাডেমি) তিনি এর পরই জানিয়েছেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাল্যসুহৃদ মৌলবী শেখ হালিম, আরবি ভাষায়। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ কবরস্থ করার পর বাড়ি ফিরে তিনি যা লিখেছিলেন তার বাংলা এরকম- হে মহান, যার অস্থি-মজ্জা, চর্বি ও মাংস এই কবরে প্রোথিত যাঁর আলোতে সারা হিন্দুস্তান, বিশেষ করে বাংলাদেশ আলোকিত হয়েছিল আমি আমার নিজেকে তোমার কবরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিতেছি, যে তুমি কবরে শায়িত আমি তোমার মধ্যে তিনটি গুণের সমাবেশ দেখেছি, ক্ষমা, দয়া ও দানশীলতা- নিশ্চয়ই তুমি জগতে বিশ্বের উৎপীড়িত এবং নিপীড়িতদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলে সেইহেতু অত্যাচারীরা তোমাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে- আমি/আমরা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে তাদের বিচারের প্রার্থনা জানাই, যারা তোমাকে বিনা-বিচারে হত্যা করেছে।
আমরা মহান আল্লাহর নিকট তোমার আখিরাতের মঙ্গল কামনা করি। বিদায়! বিদায়! বিদায়! হে মহান জাতির জনক।


নির্মলেন্দু গুণ স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তাঁর প্রশস্তিমূলক কবিতা রচনা করেননি; এমনকি ‘বাকশাল’ গঠনকে মেনে নিতে পারেননি বলেও জানিয়েছেন তিনি। (ভূমিকা, নির্মলেন্দু গুণ, মুজিবমঙ্গল) কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আহত হৃদয়ে পঙক্তির পর পঙক্তি রচনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রথম বাংলা ভাষার কবিতাটি লিখেছিলেন তিনিই। তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন- ‘এ কথা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অনেকদিন চলে গিয়েছিল, দেশের ভিতরে কোথাও প্রকাশ্যে কেউ তাঁর নাম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। এ ব্যাপারে সামরিক শাসকদের কোনো বিধি-নিষেধ আরোপিত না থাকলেও, তাদের আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া অলিখিত বিধি- নিষেধ দেশের মানুষের মধ্যে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছিল। যার ফলে ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কোনো কবিতা পাঠ করার সাহস অর্জন করতে পারিনি। ১৯৭৬ সালে আমি একুশের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে পড়েছিলাম ‘ভয় নেই’ নামের একটি কবিতা। ‘৭৫ এর নির্মমনিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর যে ভয় চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার চাপ থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করাটাই ছিল ঐ কবিতার উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে নিজেকেও ভয়ের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা। ১৯৭৭-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি যে কবিতাটি পাঠ করি (আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি) সেটি আমি লিখেছিলাম বেশ কিছুদিন আগেই। দু’একটি অনুষ্ঠানে ঐ কবিতাটি পাঠ করবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ঐ সব অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা আমাকে তখন ঐ কবিতা পাঠ করার অনুমতি দেননি। আমিও কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের কোনো সাংস্কৃতিক অঙ্গ সংগঠনকে তাদের অজ্ঞাতসারে কবিতাটি পাঠ করে বিপদে ফেলতে চাইনি। ফলে, কবিতাটি প্রকাশ্যে পাঠ করার জন্য আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে কাটাতে হয়। তারপর ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে জন্মগ্রহণ করা, জনগণের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিতে একুশের ভোরের কবিতা পাঠের আসরে আমি ঐ কবিতাটি পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিই এবং অনুষ্ঠানে সমবেত সকলকে চমকে দিয়ে আমি ঐ কবিতাটি পাঠ করি। কবিতা পাঠান্তে আমার বুকের মধ্যে চেপে বসা একটি পাথর অপসারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং পরবর্তীকালের বঙ্গ- শাসকদের প্রতি আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ যে, তারা আজ পর্যন্ত ঐ কবিতা রচনা এবং পাঠের জন্য আমাকে কোনোরূপ দণ্ড প্রদান করেননি। ঐ কবিতা পাঠের পর পুলিশ আমাকে কিছুদিন নাজেহাল করেছিল বটে, কিন্তু তা আমার জন্য এমন অপ্রীতিমূলক কিছু ছিল না। শুধু জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই তা ছিল সীমাবদ্ধ।’ (কবিতায় বঙ্গবন্ধু, শিল্পকলা একাডেমি) এই কবিতার জন্য ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র কবিকে অপমান করে। তাদের একজন তাঁকে ‘বেঈমান’ বলে গালি দিয়েছিল। সেসময় নিউমার্কেটের মাংস বিক্রেতা বলেছিল, ‘স্যার কিছু মনে করবেন না, বুঝছি আপনে শেখেরে নিয়া কিছু লিখছেন, তাই রাগ অইছে। ও অইছে হেইদিনের ছেমড়া, হে বঙ্গবন্ধুর মূল্য বুঝবো কেমতে?’ কবি এই ঘটনা উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের মধ্যে কত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা কিংবা পরবর্তী স্বৈরশাসকরা যেখানে জাতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বেঈমানি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল সেখানে কিশোরদের চেতনায় এ ধরনের বিশ্বাস ঢুকে পড়েছিল কিভাবে এটাই বিস্ময়কর। কারণ বঙ্গবন্ধু কোনো দুর্নীতি করেননি এবং ভারতের কাছে দেশকে বিক্রি করে দেবার অভিযোগও ছিল না তাঁর বিরুদ্ধে। তাহলে অপপ্রচার ছিল ভয়াবহ। সেই বিরুদ্ধশক্তির অপপ্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন অব্যাহত থাকেনি। বরং কবিদের রচনা ও মননশীল লেখকদের বিশ্লেষণ বঙ্গবন্ধুকে আরো বিস্তৃত করেছিল জনগণের মধ্যে। বিশিষ্ট কথাকাররা কবিতা লিখেছেন তাঁকে নিয়ে। যেমন, মনীশ ঘটকের ‘সূর্যপ্রণাম’, শওকত ওসমানের ‘১৫ আগস্টের এলিজি’, মাহমুদুল হকের ‘বকুলগন্ধ বাঘের চোখে’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিশুরক্ত’ (যেখানে মুজিব ও রাসেলকে কেন্দ্র করে একটি মর্মন্তুদ কবিতা লেখা হয়েছে)। মূলত পঁচাত্তর পরবর্তী কবিতায় নির্মলেন্দু গুণের আবেগ শতধারায় উৎসারিত হয়েছে এভাবে-
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
(আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি)
বঙ্গবন্ধুর এই শাশ্বত উপস্থিতি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে কবিদের কবিতার চরণে চরণে। কারণ তাঁর মৃত্যু তাঁকে আর ভুলতে দেয়নি। ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’তে কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজেকে পিতার হত্যার জন্য অপরাধী মনে করেছেন। আর তাঁর মানবিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
বন্দুকের নল ও গুলির চেয়ে
মানুষের বেঁচে থাকাকে সত্য বলে মেনেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়
বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য
একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশী।
কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য একজন
শ্রমিকের একবেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি।
মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন, শুধু তোমার জীবন, পিতা।
কবি নিজেই বলেছেন,
‘আমি জানি, সংগ্রামই সত্য, সংগ্রামই সুন্দর। প্রেম, সেও এক সংগ্রাম।’ তাঁর কবিতায় সংগ্রাম ও প্রেমের সুন্দর অভিব্যক্তি রয়েছে; আবার নিজের মনোজগতের আকাঙ্ক্ষা অভিদ্যোতিত হয়েছে বিচিত্রভাবে। যেমন ‘রাজদণ্ড’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
১৯৭৫ এ আমি হারিয়েছি আমার প্রতীক, শৌর্যবীর্যধারা, অন্ধকারে।
তারপর থেকে ভিতরে ভিতরে একা, গৃহহারা। স্বপ্নহীন ক্ষোভে
বসে থেকে থেকে ঘুমে ঘুমে, আত্মগোপনে ক্লান্ত।
একটা কিছুকে উপলক্ষ্য করে আবার দাঁড়াতে চাই;
বাংলার মাটি বাংলার জল আমাকে কি নেবে?


মূলত কবিতায় বঙ্গবন্ধুর মহিমা ও বীরত্বব্যঞ্জক কীর্তিপরম্পরা যেমন উচ্চারিত হয়েছে তেমনি শোকাবহ মৃত্যুর ঘটনায় হৃদয়ের ক্ষরণ ও তাঁর স্মৃতি কবির কবিতায় রূপময় হয়ে উঠেছে। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭ই মার্চের ভাষণটিকে কেন্দ্র করে নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতার পঙক্তিমালায় যথার্থই উপস্থাপিত হয়েছে- ‘লাখ লাখ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে।’ দশ লাখেরও বেশি মানুষের সেই সমাবেশ মানব সভ্যতার ইতিহাসের বিরল ঘটনা। ৭ই মার্চের ভাষণই মানুষকে নতুন এক স্বপ্নে আন্দোলিত করে। জাগরণ ও শিহরণে উদ্দীপিত মানুষ মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে উৎসাহী হয়। জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানানবঙ্গবন্ধু। নির্মলেন্দুর কবিতার আরো একটি অংশ –
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি;
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। (কাব্যসমগ্র-১, ২০১১: ৩৭৬)

কবির বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে ৭ই মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১৫ আগস্টের পরে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে গণ্য করার প্রচেষ্টা নিরর্থক – এই কবিতাই তার সাক্ষ্য। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন। সেদিন মহান নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসেছিলেন মুক্ত স্বদেশে। যে স্বদেশকে তিনি নিজের জীবনের অংশ করে নিয়েছিলেন। সেদিন ঢাকার ১০ লাখ মানুষের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বারবার ভেঙে পড়েছেন; অশ্রু সজল নয়নে চেয়েছেন মানুষের মুখপানে। নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রত্যাবর্তনের আনন্দ’ বঙ্গবন্ধুর আত্মকথনে রচিত। স্বদেশে ফিরে আসা বীরের চেতনার নানা প্রান্ত উন্মোচিত হয়েছে এখানে। পঁচাত্তরের পনের আগস্ট ও পরবর্তীতে সত্যের জয়গান সম্পর্কে জাতির পিতার কথনে কবির চরণ এরকম-
আনন্দের ঘোর কাটতে না কাটতেই,
একাত্তরের পরাজিত এজিদবাহিনী
রাত্রির অন্ধকারে সংগঠিত হয়ে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট সপরিবারে হত্যা করলো আমাকে।…
বহুদিন পর আজ সত্য জয়ী হয়েছে-,
সংগ্রাম জয়ী হয়েছে, সুন্দর জয়ী হয়েছে।
আজ আমার খুব আনন্দের দিন।

১৫ আগস্ট ‘মানব জাতির পথপ্রদর্শক ও মহান নেতা’ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও তার পরিপ্রেক্ষিতে শোক নয়, মানব সভ্যতার বিনষ্টির ইঙ্গিত হিসেবে এ ঘটনা কবিরা চিত্রিত করেছেন। সপরিবারে নিহত বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে শেখ রাসেলকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেকগুলো কবিতা। কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, দাউদ হায়দার প্রমুখ অন্যতম। নির্মলেন্দু গুণের ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’ পঁচাত্তর পরবর্তী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। মুজিব পরবর্তী ইতিহাস এভাবে কবিতায় অভিব্যক্ত হতে থাকে অজস্র ধারায়।


রাজনীতি কি নির্মলেন্দু গুণের নিজস্ব কণ্ঠস্বর? এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উত্থাপন করা হবে। বাংলাদেশের কবিতায় বিপ্লবী চেতনার প্রকাশ কী অতীতে ঘটেনি? উত্তরে বলা যায়, রাজনীতিকে কবি নিজের বাঁচা-মরার অঙ্গীভূত বিষয় করে নিয়েছেন। তিনি কবিতা লেখার সময় ডুব দিয়েছেন মানুষের শোষণ মুক্তির আলেখ্যে; এমনকি রাজনীতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে তিনি যে সমস্ত কবিতা লিখেছেন তার বেশিরভাগই প্রাণের আবেগ দিয়ে লেখা; দরদী হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য। তবে তিনি কবিতায় বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী এবং বিপ্লবী সমাজের আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে বীরত্বের ইতিহাস লেখেননি। তিনি বক্তব্য ও ভাষায় নিজেকে অবারিত করে দিয়েছেন। এজন্য কবিতাগুলো পাঠকের প্রাণের গভীরে বেজে ওঠে, হৃদয়কে মথিত করে; কবিতার ছন্দ- সুরে আবেগ ক্রিয়াশীল থাকে। আর এখানেই তাঁর রাজনৈতিক কবিতার সাফল্য নিহিত।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *