prabandho-premer-darshonik-path

প্রেমের দার্শনিক পাঠ
মাসুদুজ্জামান


প্রেম – ছোট্ট একটি শব্দ। কী অমোঘ, কী অনিবার্য এই শব্দের অভিঘাত। প্রেম অজানা পুলকে রক্তে আনে চাঞ্চল্য, শরীরে তোলে ঢেউ, হৃদয় ওঠে নেচে। স্নায়ুকে কখনও তা আচ্ছন্ন করে দেয়, কখনও উৎকর্ণ। প্রেম হলো আমিত্বের অনুভব, সত্তার ঊর্ধ্বায়ন। প্রেম হলো এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। প্রেম যদিও একান্তভাবেই ব্যক্তিক, তবে যুগলত্বের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায়। সত্তার সঙ্গে সত্তার ঘটে মিলন।

প্রেমের শক্তি অকল্পনীয়, সুগভীর। প্রেমের স্পর্শে দস্যু রূপান্তরিত হয়েছে মানবে, রাজা ত্যাগ করেছে রাজমুকুট। মুখরা রমণী বশীভূত হয়ে সমর্পণ করেছে সবকিছু। উদ্ধত পুরুষ নমিত হয়েছে প্রেমাস্পদের পদপ্রান্তে। কলঙ্ক মাথায় নিয়ে কুলত্যাগ করেছে নারী, পুরুষ হয়েছে বিবাগী, গ্রহণ করেছে সন্নাসব্রত।

একটি মাত্র শব্দ, কিন্তু কত রঙ আর রশ্মিপাত। কত অশ্রু, কত রক্তপাত। কত বেদনা আর হর্ষ মিলেমিশে আছে এই একটিমাত্র শব্দে। শারীর বিজ্ঞানের মতে প্রেম শুধু মানবিক অভিজ্ঞতা নয়, প্রেম হচ্ছে জীবনীশক্তি। মনকে চালনা করে প্রেম, সুমিত রাখে শরীরের ছন্দ, মস্তিষ্কের কাঠামোকে আকার দেয়। শরীরী এই ছন্দময়তার সূত্রেই নিজেকে চিনে নিতে পারে মানুষ। প্রেমই বলে দেয় আমি কে, কী হতে পারি, কী আমার আত্মপরিচয়।

যুগলবন্দিত্বই প্রেম, নারীর সঙ্গে পুরুষের। শুধু কী নারীর সঙ্গে পুরুষের? নারীর সঙ্গে নারীরও বটে, পুরুষের সঙ্গে পুরুষেরও; ইতিহাস তো সেই সাক্ষ্য দেয়। প্রেমের রকমফেরও বিচিত্র। সাধারণ অর্থে যে-জিনিসটি পছন্দ করি, তাকে বলি ভালোবাসি। আবার যার সঙ্গে হার্দিক সম্পর্ক, তাকে নিবেদন করি প্রেম, বলি সেই একই কথা – ভালোবাসি। ভালোবাসারও নানান স্তর আছে। আছে আরও নানান দিক। প্রেমকে ঘিরে কত প্রশ্নই না ঘনিয়ে উঠতে পারে আমাদের মনে। কীভাবে উন্মেষ ঘটেছিল প্রেমের? কী এর অর্থ? প্রেমের মনস্তত্ত্বই-বা কী? কামনা-বিজড়িত প্রেম আর কামনা-বিযুক্ত প্রেমের স্বরূপ কী এক? কে বেশি প্রেমময়ী – নারী না পুরুষ? মাতৃপ্রেম আর স্বদেশপ্রেম বলতে কী বুঝবো? প্রেম কী আমাদের শরীরকে প্রভাবিত করে? পুরুষ ও নারীর প্রেম কী একই ধরনের? প্রেম ও যৌনতা সম্পর্কে নারী আর পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কী কোনো পার্থক্য আছে? প্রেম কী দেশ কাল পাত্রভেদে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে? প্রেমের সঙ্গে অপরাধেরই-বা সম্পর্ক কী? আরও আছে – প্রেমকে ঘিরে কত প্রশ্ন, কত অতলস্পর্শী জিজ্ঞাসা। এইসব প্রশ্ন দার্শনিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক। প্রবাদপ্রতিম সেই কথাটাই সত্যি – ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।’ ফলে প্রেম নিয়ে অল্পকথায়, এই ছোট্ট রচনায়, এসব জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া সহজ নয়। তবু দর্শনের দিক দেখা যাক প্রেমকে দার্শনিকরা কীভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রেমের কথা ভাবতে গেলে প্রথমেই আমরা ভাবি, এর কী কোনো প্রয়োজন আছে? আছে কী সেই অনুভবশক্তি যা দিয়ে আমি একজনকে অনুভব করতে পারি, সে অনুভব করবে আমাকে? ব্যক্তিক প্রেমের সূত্রপাত ঘটে আসলে এইভাবে – ‘ভালোবাসতে চাই’, ‘ভালোবাসা পেতে চাই’। চাওয়া আর পাওয়া, সত্তার সঙ্গে সত্তার সেই প্রথম সংযোগ। ফলে যাকে ভালোবাসবো তাকে ব্যক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে শুরু করি। শুধু তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা নয়, স্বাধীনতার দিকটিও শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতে হয়।

প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিকেরা তিনটি ধারণা অনুসরণ করে প্রেমের অর্থ করতে চেয়েছিলেন। এই ধারণার গ্রিক শব্দগুলো হচ্ছে – অগাপো [ঈশ্বর-প্রেম], এরোস [শরীরী-প্রেম] এবং ফিলিয়া [অনুরাগ]। এই তিনটি গ্রিক পরিভাষার ঠিক ঠিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এদের মধ্যেকার পার্থক্য নির্দেশ করাও সহজ নয়। খ্রিস্টধর্ম থেকে অগাপো বা ঈশ্বর-প্রেম ধারণার সূত্রপাত ঘটে। এর অর্থ ঈশ্বর আমাদের ভালোবাসেন, আমরাও ঈশ্বরকে ভালোবাসি। এই প্রেম হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত আর স্বার্থহীন। ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়াই এই প্রেমের লক্ষ্য। প্রেমাস্পদ বলে এখানে কিছু নেই, তার গুণাগুণ বিচারেরও প্রশ্ন ওঠে না। অন্যদিকে এরোস বা শরীরী-প্রেম ও আকর্ষণের ক্ষেত্রে যার প্রতি মানুষ আকর্ষণ অনুভব করে, তারই প্রেমে পড়ে। আকর্ষক কিছু না কিছু গুণ ওই নারী বা পুরুষের থাকতে হবে। শরীরী-প্রেম সহজ অর্থে কামনা-বাসনাযুক্ত প্রেম। যৌন আকর্ষণই হচ্ছে এই প্রেমের উৎস। শরীরী সৌন্দর্য থেকে এই প্রেমের উন্মেষ ঘটে। যদিও সক্রেতিস ভেবেছিলেন, শরীরী সৌন্দর্যের কথা বলা হলে প্রেমের ধারণাটি সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তার কাছে আত্মার সৌন্দর্যই হচ্ছে মূল কথা। ঈশ্বর-প্রেমের সঙ্গে এই শরীরী-প্রেমের মেরুদূর সম্পর্ক। ফিলিয়া বা অনুরাগের সূত্রপাত ঘটে একধরনের ভালোলাগা থেকে। এ হচ্ছে বন্ধুসুলভ অনুভব, প্রেমানুভবের প্রগাঢ় অনুভব নয়। এরোসে যৌনতা যুক্ত থাকে, কিন্তু ফিলিয়াতে কোনো ধরনের শরীরী আকর্ষণ বা যৌন-আকর্ষণ থাকে না। দার্শনিকদের মতে এরোস এবং ফিলিয়ার পার্থক্য করা খুবই কঠিন, আদৌ এই দুই ধরনের প্রেমের মধ্যে পার্থক্য আছে কিনা সন্দেহ।

গ্রিসেই এভাবে প্রেমের ধারণার সূত্রপাত ঘটেছিল। প্লেতো মনে করতেন প্রেমিকা বা প্রেমিক হচ্ছে অসম্পূর্ণ অর্ধমানবী বা অর্ধমানব। পূর্ণ মানুষ হবার জন্যে তাকে খুঁজে নিতে হবে অন্য অর্ধেক অংশকে। বাংলায় তো এরকম একটা শব্দের প্রচলন আছে – অর্ধাঙ্গিনী। এই শব্দটা বলা হয় নারীকে উদ্দেশ্য করে, পুরুষকে কিন্তু বলা হয় না [নারীর] অর্ধাঙ্গ। প্লেতোর মতে একক সত্তায় রূপান্তরিত হবার জন্যে একটা পর্যায়ে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। প্রেম সম্পর্কে প্লেতোর যা কিছু ধারণা, তা তিনি লিখে রেখে গেছেন তার বৈঠকী (সিম্পোজিয়া) গ্রন্থে। এই বইটি হচ্ছে আধুনিক মানুষের হাতে পৌঁছানো সবচেয়ে পুরানো বই যাতে প্রথম প্রেমের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

হিস্পানিক কবি অক্তাভিও পাস প্রেম নিয়ে চমৎকার একটি বই লিখেছেন – দ্বৈত শিখা: প্রেম ও যৌনতা [১৯৯৩]। ওই বইতে গ্রিক দার্শনিকদের প্রেমের ভাবনার সূত্র ধরে পশ্চিমী প্রেমভাবনার চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। পাসই বলেছেন, ধর্মের বিরোধিতা করে কিংবা ধর্মের বাইরে ঘটেছে পশ্চিমী প্রেম-ভাবনার বিকাশ। গ্রিক সভ্যতার শুরুতেই ধর্ম থেকে প্রেম এইভাবে আলাদা হয়ে গিয়েছিল আর প্লেতোই ছিলেন প্রেমের প্রথম দার্শনিক। কবিতাও লিখেছেন তিনি আর কবিতার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে প্রেম। প্লেতোর প্রেমের ভাবনার দ্বারা এখনো অনেকে প্রভাবিত হচ্ছেন। শরীর নয়, সৌন্দর্য নয়, এই ভাবনার কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে আত্মা। অনেকের মতে, আত্মার ধারণাটি অবশ্য গ্রিক ধারণা নয়।

প্লেতোর প্রেমের ভাবনা থেকে পশ্চিমী দুনিয়া পরে অনেক সরে এসেছে। অনেকেই বলে থাকেন, প্লেতো যে প্রেমের কথা বলেছেন তা আসলে প্রেম নয়, যৌনতার ঊর্ধ্বায়িত বোধ। তার বৈঠকীতে পাওয়া যায় সাতজন অতিথির প্রেমের নানান ব্যাখ্যা-বয়ান। এদের মধ্যে অ্যারিত্তোফেনিসের বয়ানটি সত্যি চমকপ্রদ। তিনিই উল্লেখ করেছেন, প্রেমের অনুভব হচ্ছে মানবিক আর সর্বজনীন। নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবে – এটাই চিরন্তন সত্য। উভলিঙ্গধর্মী পুরানের একটা কাহিনী হচ্ছে এই আকর্ষণের উৎস। একসময়ে এই দুনিয়ায় তিন ধরনের মানুষ ছিল : নারী, পুরুষ আর উভলৈঙ্গিক মানুষ। দেবতা জিউস তাদের প্রত্যেককে দুই ভাগে ভাগ করে দিলেন। এরপর থেকে এর এক অর্ধাংশ খুঁজে ফিরছে তার অন্য অর্ধাংশকে। পুরানের এই কাহিনীর তাৎপর্য সত্যি ভাববার মতো। আমরা প্রত্যেকেই অসম্পূর্ণ সত্তার মানুষ, পূর্ণ মানুষ নই। জীবনকে পূর্ণ করে তুলবার জন্যে আমাদের প্রয়োজন ভালোবাসার। আমার অপর অংশকে খুঁজে না পেলে আমি ‘আমি’ হয়ে উঠতে পারবো না। আদম-হাওয়ার ঘটনার সঙ্গেও মিলে যায় এই ভাবনা। আদমের পাঁজর থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বিবি হাওয়া।

সক্রেতিসের কথাই হচ্ছে বৈঠকীর বয়ান। এই বয়ানের দু-জন প্রাজ্ঞ শ্রোতা ছিলেন – দিয়োতিমা আর ম্যানিতেনিয়া। দিয়োতিমা বলেছেন, এরোস মানুষ নন, ঈশ্বরও নন। প্রেমও সুন্দর নয়, কিন্তু সুন্দরকে কামনা করে। প্রতিটি পুরুষের আছে এই কামনা। যে-জিনিসটি শ্রেষ্ঠ, পুরুষ তাই কামনা করে, দখল করে নিতে চায়। এ তো গেল পুরুষের কামনার কথা, কিন্তু প্রেমিক পুরুষ কী কামনা করে? দিয়োতিমা বলছেন, পুরুষ খোঁজে মানবিক সৌন্দর্য। যখনই সুন্দর কাউকে আমরা দেখি, তখনই প্রেমের জন্ম হয়। এই কামনা-বাসনার ব্যাপারটি যদিও সর্বজনীন, তবে প্রত্যেকটির ধরন আলাদা, একরকম নয়। এখানে পৌঁছেই দিয়োতিমা সক্রেতিসকে সতর্ক করে দিয়েছেন – প্রেম কিন্তু সহজ বস্তু নয়। অনেক কিছুর মিশ্রণ হচ্ছে প্রেম, কামনার দ্বারাই তা চালিত হয়, ঐক্যবদ্ধ থাকে কিংবা বন্য হয়ে ওঠে। প্রেমের পাত্র বা পাত্রীও সহজ নয়। প্রেম হচ্ছে মানবিক সৌন্দর্যের অতিরিক্ত কিছু; সময়, মৃত্যুর দ্বারা তা প্রভাবিত হতে পারে। দিয়োতিমা বলে চলেন, সব পুরুষ চায় শ্রেষ্ঠকে, যা তাদের নেই। শরীর আর সৌন্দর্যের কাছেই বাধা পড়ে গেছি আমরা। প্রেমের পাত্র/পাত্রী আলাদা হতে পারে, কিন্তু ফলাফলই একই – যাকে চাই তাকে পেলে আমরা সুখী হই। মানুষ আসলে চায় এই সুখ; চায় চিরদিনের জন্যে। সৌন্দর্যের জন্যে প্রেমের যে কামনা তা ওই সুখের জন্যে। কিন্তু সব মানুষেরই আছে সেই অভাব, সেটা হলো মানুষ অমর নয়। আসলে অমরত্বের এই আকাঙ্খা থেকে একজন মানুষ আরেক জনের সঙ্গে মিলিত হতে চায়। শ্রেষ্ঠকে পাওয়ার জন্যে তার যে আকাঙ্খা, তা শুধু দখল করবার জন্যে। মানুষ এভাবেই দখল করে পেতে চায় চিরকালের আনন্দ। শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণীই চায় এই আকাঙ্খার চরিতার্থতা।

সন্তান জন্মদান হচ্ছে প্রেমের আরেকটি উপাদান। দুই ধরনের জন্ম আছে – একটি হচ্ছে শরীরী, আরেকটি আত্মিক। নারী ও পুরুষ একে অন্যের সৌন্দর্যের দ্বারা মুগ্ধ হয় আর শরীরকে একত্রিত করে নতুন মানুষের জন্ম দেয়। এই মানব প্রজন্মের এই সৃষ্টি, প্লেতো বলছেন – ঐশ্বরিক। কিন্তু আত্মিক সৃষ্টি আরও ঊর্ধ্বায়িত এক সৃষ্টি। এক অবিনশ্বর আত্মা মিশে যায় আরেক অবিনশ্বর আত্মার সঙ্গে, ভাবনার সঙ্গে, অনুভূতির সঙ্গে। প্রেমিক বা প্রেমিকার তাই কোনো লৈঙ্গিক রূপ নেই। সে প্রেমাস্পদের আত্মার সঙ্গে, জ্ঞানের সঙ্গে, সুন্দরের সঙ্গে মিশে যায় আর যা-কিছু সুন্দর খুঁজে পায় তাকে। দিয়োতিমার বয়ান আর সক্রেতিসের মন্তব্য আসলে এক ধরনের বৌদ্ধিক অভিযান। যতই আমরা গভীরে প্রবেশ করি ততই আবিষ্কার করি প্রেমের বিচিত্র রূপ। এ যেন কোনো পাহাড়ের শীর্ষে আরোহন করা। উঁচু একটা স্তর পেরুলেই নতুন নতুন ভূদৃশ্য, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা আর রোমাঞ্চ। কিন্তু এর বাইরে অনেক কিছু আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়।

যৌবনে আমরা শরীরী সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হই, ভালোওবাসি একটি শরীরকে, একটি সুন্দরের কাঠামোকে। কিন্তু সৌন্দর্যই যদি হয় আমাদের আরাধ্য, তাহলে কেন একটি শরীরকে ভালোবাসবো আমরা? কেন ভালোবাসবো না অনেককে? দিয়োতিমা আবার প্রশ্ন তুলছেন, সৌন্দর্য যদি নানা আকারেই উপস্থিত হয়, তাহলে কেন সৌন্দর্যকেই ভালোবাসবো না আমরা? কেন আকারকে ছাড়িয়ে গিয়ে ভালোবাসবো না ধারণাকে, আইডিয়াকে? দিয়োতিমাই লক্ষ করেছেন, প্রেম হচ্ছে একধরনের মই। এর একেবারে নিচের ধাপে আছে সুন্দর শরীর। এরপর একাধিক সুন্দর শরীর। এর উপরে আছে সৌন্দর্য নিজেই। এরপর আছে পবিত্র আত্মা আর সবশেষে আছে শরীরহীন সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের প্রতি প্রেম আর অমরত্ব যদি অভিন্ন হয়, তাহলে কেন অমরত্বকে খুঁজবো না আমি? সৌন্দর্য আর সত্য তো একই; একই বাস্তবতার নানান দিক। দিয়োতিমাই বলছেন, প্রেমের পথেই পৌঁছুনো যাবে অভূতপূর্ব এক সৌন্দর্যলোকে, যার ক্ষয় নেই, বৃদ্ধি নেই, আছে কেবলই অনন্ত। এই সৌন্দর্য স্বয়ংসম্পূর্ণ, একক; শরীরের অংশ থেকে সৃষ্টি হয় না। এই প্রেম আবার সৌন্দর্যকেও অতিক্রম করে যায়, অতিক্রম করে যায় এক শরীর থেকে অনেক শরীর। প্রেম আসলে একধরনের বোধ, একধরনের অনুভব, একধরনের আইডিয়া। এই আইডিয়া হচ্ছে পরম সৌন্দর্যের আইডিয়া। মানুষ এই সৌন্দর্যমন্ডিত জীবনই যাপন করতে চায়। মানুষের সামনে তখন থাকে না কোনো ছবি, থাকে না সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি, থাকে শুধু সৌন্দর্যমন্ডিত বাস্তবতা; আর সেটাই হচ্ছে অমরত্বের পথ।

দিয়োতিমার এই প্রেমভাবনা, বলা নিষ্প্রয়োজন, ঊর্ধ্বায়িত এক প্রেমভাবনা। একে কী প্রেমের ভাবনা বলে আখ্যায়িত করা যাবে? পরবর্তীকালে এই প্রশ্ন তুলেছেন অন্য দার্শনিকেরা। দিয়োতিমা আর সক্রেতিস কী সত্যি সত্যি প্রেমের কথা বলেছেন – এ প্রশ্ন তাই থেকেই যায়। কেননা তারা যে প্রেমের কথা বলেছেন, তা যেমন পুরোপুরি পাশবিক নয়, তেমনই নয় অতীন্দ্রিয় বা ঐশ্বরিক। প্রেমের তাহলে আছে আরও একটা দিক, কামনার দিক, যৌনতার দিক। গ্রিক দার্শনিক প্রেমে এই যৌনতা বা কামনাবাসনা বিজড়িত এরোসের কথা তেমন একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু একথা তো সর্বজনবিদিত যে, অপূর্ব সুন্দর কোনো পুরুষ বা সুন্দরী নারীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা সর্বজনীন একটা মানবিক প্রবণতা। সব সমাজেই এটা ঘটে থাকে। প্রেমের যে দার্শনিক ভাব তা ঐতিহাসিক আর এই প্রেমানুভূতি সৃষ্টি হয় নির্দিষ্ট সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক প্রেক্ষাপটে। আজকের প্রেমভাবনা তাই গ্রিক প্রেমের ধারণা থেকে অনেকটাই আলাদা। আজ আমাদের পৃথিবীতে – কী প্রাচ্য, কী প্রতীচ্য – প্রেমের যে ভাবনা প্রচলিত আছে, তাকে গ্রিক দার্শনিক প্লেতো নিঃসন্দেহে দিগ্ভ্রান্ত, লক্ষহীন প্রেম বলে আখ্যায়িত করতেন। দান্তে বিয়াত্রিসকে কেন্দ্র করে কিংবা পেত্রার্ক লরাকে কেন্দ্র করে যে ঊর্ধ্বায়িত প্রেমের ভাবচ্ছবি এঁকেছেন, তিনি তাকে হয়তো ‘আত্মার পীড়ন’ বলে চিহ্নিত করতেন।

গ্রিক প্রেমভাবনার সঙ্গে আসলে মেরুদূর ব্যবধান ঘটে গেছে আধুনিক প্রেমভাবনার। লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্লেতো দিয়োতিমার জবানিতে যে প্রেমের কথা বলেছেন, তা কোনো প্রেমই নয়, নিঃসঙ্গ মানুষের একক ঐশ্বরিক বিমূর্ত অভিযান মাত্র। প্লেতো প্রেম ও শরীরকে, প্রেম ও আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেছেন। কিন্তু আধুনিক কালের প্রেমে এই বিচ্ছিন্নতার সীমা কতখানি, এদের আদৌ বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় কিনা, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আধুনিক প্রেমের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আত্মা বলে কিছু আছে, সেকথাই কেউ স্বীকার করেন না। আধুনিক জীববিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞানে এর কথা তেমন একটা উচ্চারিত হয় না। আর শরীরের ধারণা? প্লেতোর যুগের তুলনায় শরীর অনেক জটিল হয়ে গেছে। প্লেতোর কাছে তো কী শরীর, কী আত্মা, কখনই দেখার বস্তু হিসেবে, ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধির কথা গুরুত্ব পায়নি। প্লেতোর ভাবনায় শরীর ছিল বটে, কিন্তু সেই শরীরের কোনো আকার ছিল না, রূপ ছিল না। ছিল না কোনো অনুভূতি। আত্মাও ছিল, কিন্তু কী নিশ্চুপ, শীতল সেই আত্মা। কিন্তু এখন? এই আধুনিক কালে প্রেমে শরীরের উপস্থিতি খুবই প্রবল। শরীরকে ঘিরেই প্রেমের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে বলে শারীরবিদ থেকে দার্শনিকরা স্বীকার করে নিয়েছেন। যৌন-অনুভূতির বিষয়টিও প্রেমের ক্ষেত্রে তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়।

পাসই বলেছেন, যৌনতা, কামনা আর প্রেম হচ্ছে পরস্পর সম্পর্কিত কিন্তু বিচ্ছিন্ন তিনটি বিষয়; নারী-পুরুষের ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে যা আবর্তিত হয়। একটি রূপকের মাধ্যমে এই প্রেমের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। রূপকটি হচ্ছে এরকম: যৌনতা হচ্ছে অগ্নি, এর লোহিত গণগণে শিখা হচ্ছে কামনা আর নীল প্রশান্ত শিখা হচ্ছে প্রেম। প্রেমের ক্ষেত্রে যৌনতা মূলত প্রাকৃতিক, জৈবিক; সাংস্কৃতিক নয়। অন্যদিকে প্রেম হচ্ছে সাংস্কৃতিক। এই সময়ের প্রখ্যাত উত্তর-আধুনিক ভাবুক জিগমুন্ত বাউমান বলেছেন, প্রেম হচ্ছে আবেগিক/বৌদ্ধিক অধিকাঠামো [সুপারস্ট্রাকচার]। সংস্কৃতিই প্রেমের এই অধিকাঠামো নির্মাণ করে দেয়। বাউমানের মতে, শরীরের মধ্যেই অনন্ত প্রেমকে অনুভব করতে চায় আধুনিক মানুষ। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো আবার শরীর আর যৌনতার মধ্যে লক্ষ করেছেন ক্ষমতায়নের প্রতিচ্ছবি। যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ ও রাষ্ট্র আর এভাবেই শাসকেরা ক্ষমতার চর্চা করে।

প্রেমের রূপও আধুনিক কালে বদলে গেছে। ঐশ্বরিক অতীন্দ্রিয় প্লেতোনীয় প্রেম নয়, আধুনিক সমাজে উদ্ভব ঘটেছে রোমান্টিক প্রেমের। শিল্পবিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় আধুনিকায়নের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই রোমান্টিক প্রেমের বিকাশ ঘটেছে। ওয়েবার, হাবেরমাস, পারসন্স, সিমেল, লুহমান প্রমুখ সমাজতাত্ত্বিক এই প্রেমের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আরেক ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রের কাছে এই প্রেম ছিল অস্তিত্ববাদী স্বাধীনসত্তার অংশ। আধুনিক সমাজে যখন থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের দিকটি প্রধান হয়ে উঠতে শুরু করে, তখনই রোমান্টিক প্রেমের সূত্রপাত হয়। তরুণ হেগেল তাই একসময় এই প্রেমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সত্তার পৃথকীকরণের দিকটি প্রেম থেকে দিন দিন লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, ঘুঁচে যাচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকার সবধরনের পার্থক্য।’

সমাজতাত্ত্বিক গিডেন্সের মতে রোমান্টিক এই প্রেমের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল উনিশ শতকের ইউরোপে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। যে-সমাজ মূলত মুক্ত, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়, সেখানেই বিকাশ ঘটেছে এই রোমান্টিক প্রেমের। আধুনিক সংস্কৃতির এটাই বৈশিষ্ট্য – ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, ব্যক্তি-অধিকার, আত্ম-উন্নয়নের পথ ধরেই সচেতন নারী ও পুরুষ নিজেই তার প্রেমের পাত্র বা পাত্রীকে খুঁজে নিয়েছে। আধুনিক কালের এই রোমান্টিক প্রেম যৌনতাকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, কামনা-বাসনাকে প্রাধান্য দেয়। এই প্রেম এই সময়ের সংস্কৃতিরই সৃষ্টি। ওয়েবার বলেছেন, যৌন দিকটি ক্রমশ আধুনিক প্রেমের একেবারে কেন্দ্রে চলে আসছে। সেই সঙ্গে প্রাধান্য পাচ্ছে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকটিও। গিডেন্সের মতে, ‘আত্মতৃপ্তির অনুভব’ হচ্ছে এই প্রেমের মূল কথা – তা সে নারী হোক, কিংবা পুরুষ। পরস্পরকে জড়িয়েই সুখ আর তৃপ্ত হতে চায় আধুনিক মানুষ। প্রেম এভাবেই শুধু ব্যক্তিক থাকেনি, হয়ে উঠেছে মানবিক।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *